| 6 অক্টোবর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য ভ্রমণ: নীলপাহাড় ও তিনবোনের গল্প । ক্ষমা মাহমুদ

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

সিডনি যাবো শুনেই এক বন্ধু বললো, ‘ব্লু মাউন্টেইন এ অবশ্যই যাস।’ নামটা শুনেই মন কাড়লো- নীল পাহাড়! বাহ! বেশ তো নামটা! ভ্রমণ তালিকায় টুকে নিলাম। যেকোন নতুন জায়গায় যাওয়ার আগে একটা গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করা আমার অভ্যাস- মানে যাওয়ার আগেই সেই জায়গার ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, সংস্কৃতিসহ বর্তমান অবস্থা- সবকিছুর উপর একটু ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিই – অন্ধের মত কানাগলিতে ঘুরতে ইচ্ছা করেনা একদমই। একটু জেনে বুঝে গেলে জায়গাগুলো  ঘোরার আনন্দ সহস্রগুণ বেশি হয়ে ওঠে।

যাওয়ার আগে বিভিন্ন তথ্য ঘেটেঘুটে, কি কি অবশ্যই দেখবো, সেই তালিকাটাই এত বড় হয়ে গেল যে মাত্র বারো দিনে সেগুলো কিভাবে দেখবো, সেটা একটা চিন্তার বিষয় হয়েই রইলো; তার উপর এটা আবার পারিবারিক ভ্রমণ, পুরো সময়টা যে টো টো করে ঘুরতে পারবো তাও হবেনা। যাহোক বিশাল সেই তালিকার মধ্যে নীল পাহাড়কে আমি একটু বিশেষ তারকা চিহ্ন দিয়ে রাখলাম যেন এটা কোনভাবেই ফাঁক গলে পড়ে যেতে না পারে-  কারণ নীলের প্রতি রয়েছে আমার দুর্বার দুর্বলতা- বেদনার রং যে! সাথে রয়েছে আবার পাহাড়টা … সেও যে আমার ভীষণ প্রিয়; বড় একা কিন্তু মাথাটা খুব উচুঁ করে নিঃশব্দে সব বেদনা সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকে! – দুই প্রিয় মিলে একেবারে একাকার- নীলাকার! ইউটিউবে নীল পাহাড় নিয়ে বিভিন্ন ভিডিও দেখে মাথা আরো নষ্ট- সেই আধেক নষ্ট মাথা নিয়েই রওনা দিলাম সিডনি॥

সিডনি পৌঁছানোর কয়েকদিনের মাথায় এক রোদ ঝলমলে সকালে পরিবারের কজন মিলে নীল পাহাড়ের দিকে আমাদের গাড়ী ছুটলো। বিশাল এই শহরের সিল্কের মত মোলায়েম আর মসৃণ রাস্তায় গাড়ীটা যেন পঙ্খিরাজের মত উড়ে চলছিল। উপকূলীয় শহর সিডনির একদিকে যেমন রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের চোখ জুড়ানো অবারিত নীল জলরাশির হাতছানি আরেকদিকে এর দিগন্ত বিস্তৃত অপরূপ পর্বতমালার সমাহার। প্রকৃতি যেন শহরটাকে তার কোলের মধ্যে পরম যত্নে আগলে রেখেছে।

নীল পাহাড় আসলে শুধুই একটা পাহাড় নয়, এই ব্লু মাউন্টেইন হলো অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস এর একটি জাতীয় উদ্যান যা এর রাজধানী সিডনি থেকে ৮১ কিমি পশ্চিমে বিস্তৃত এলাকা “ব্লু মাউন্টেইন্স” এ অবস্থিত, অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে একটি। সিডনি থেকে গাড়িতে পৌঁছতে লাগে ঘণ্টা দেড়েক। সকালবেলা বের হয়ে সারাদিন ঘুরে ফিরে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসা সম্ভব তবে আমার মত পর্যটক, যারা সবকিছু খুঁটে খুঁটে দেখতে ভালোবাসে তাদের জন্যে এটা অতি অবশ্যই দুতিন দিন ধরে দেখবার মত একটা জায়গা। ৯৬ কিমি লম্বা এবং প্রায় ১১,৪০০ স্কয়ার কিমি জায়গা জুড়ে এই ব্লু মাউন্টেইন রেন্জ, প্রকৃতি প্রেমিক মানুষদের জন্য সিডনির অন্যতম দর্শনীয় স্থান। ১৯৩২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মী মিলস ডানফির “Greater Blue Mountains National Park” গঠনের প্রস্তাবনার মাধ্যমে এই জাতীয় উদ্যানের সৃষ্টি হয়। ১৯৫৯ সালে এলাকাটি “ব্লু মাউন্টেইন্স ন্যাশনাল পার্ক” নামে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালে ইউনেস্কো এটিকে গ্রেটার ব্লু মাউনটেইন্স এলাকার অংশ হিসেবে ১৪তম বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।


ব্লু মাউন্টেইন

কাটুম্বা অভিমুখে যেতে যেতে দুপাশের অপূর্ব সুন্দর গাছপালা আর পাহাড়ী সৌন্দর্যে মগ্ন হয়ে রইলাম- মুগ্ধতার সে রেশ গোটা পথ জুড়ে রইলো! কাটুম্বা হলো ব্লু মাউন্টেইনের মধ্যে ছোট্ট একটা ছবির মত শহর, চোখে না দেখলে যার সৌন্দর্য বর্ণনা করা অসম্ভব। ইউটিউবে নীল পাহাড় নিয়ে খোঁজ খবর করতে গিয়ে কাটুম্বা নামটা আমার হৃদয় ছুয়েছিল। ১৮৩১ সালে ইউরোপীয়রা প্রথম এখানে পা রাখে এবং ১৮৭৯ সালে কয়লা খনি শুরু হওয়ার পর কাটুম্বা একটা ছোট্ট শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আদিবাসীদের দেয়া নাম কাটুম্বা অর্থ ‘উজ্জ্বল জলপ্রপাত’। কাটুম্বা ফলসের নামেই শহরটার নাম রাখা হয়েছে। ছবির মত এই ছোট্ট শহরে কমবেশী প্রায় আট হাজার মানুষের বাস।

আমার দেবর সুমন আর ওর বউ ফারিন যেতে যেতে এখানে ওদের আগে যাওয়ার অভিজ্ঞতা জানালো যে , সিডনিতে কেউ এলেই এটা অন্যতম দর্শনীয় স্থান, এভাবে ওদের কয়েকবার যাওয়া হয়ে গিয়েছে, তারপেরও এখানে ওরা সুযোগ পেলেই চলে আসে। কথা বলতে বলতেই আমরা দেড় ঘন্টার রাস্তা যেন মুহূর্তেই পার হয়ে এলাম আর অপূর্ব … ভীষণ সুন্দর কাটুম্বা শহরে ঢুকে গেলাম। গাড়িতে যেতে যেতেই দুপাশে যা দেখছিলাম, আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না, এত সুন্দর কোন জায়গা হয়! নিখুঁত পরিকল্পনা করে, পরম যত্নে পুরো এলাকাটা যেন কোন শিল্পী একেঁ রেখেছে! দুপাশ জুড়ে শত শত রঙের ফুলেরা রাস্তার পাশে লুটোপুটি খাচ্ছে আর বিশাল জায়গা জুড়ে ভয়ংকর সুন্দর নীল সবুজে ঘেরা উঁচু পাহাড়ের রেখা। অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে মন ও শরীর তাজা হয়ে উঠলো! নীল সবুজের সাথে আরো কত রং যে সেখানে সেজেগুঁজে আছে, মনে হলো রঙের হলি খেলা চলছে!


ছবির মত ছোট্ট শহর কাটুম্বা।

গাড়ি পার্কিং করে কাটুম্বার মাটিতে পা রেখে সামনের দিগন্ত বিস্তৃত নীলচে পাহাড়ের সারি আর নীল সাদা মেঘের ভেলা দেখতে দেখতে আমার প্রিয় কবি বোদলেয়ারের সেই কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ে গেল …. ‘আমি ভালোবাসি মেঘ. . .চলিষ্ণু মেঘ. . . ঐ উঁচুতে. . . ঐ উঁচুতে. . . আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল…’

অপরূপ, মোহনীয় বিশাল পাহাড় সামনে দাঁড়িয়ে, তাকে জড়িয়ে আছে হাল্কা নীলের আভা। পাহাড়ের সবুজ গাছ গাছালির সাথে আকাশের নীল মিশে একটা অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ যা ভাষায় বর্ননা করা সম্ভব নয়। মনে হচ্ছিলো একটা নীল পর্দা দিয়ে যেন গোটা পরিবেশটাকে ঢেকে দেয়া হয়েছে। সঙ্গীদের তাড়ায় ভাবালুতা কাটিয়ে বাস্তবের  মাটিতে ফিরলাম, নাহলে এত অল্পসময়ে আমাদের অনেক কিছুই অদেখা রয়ে যাবে যে!


দাঁড়িয়ে আছি নীল পাহাড়কে পেছনে রেখে ইকো পয়েন্ট লুক আউট।

প্রথমেই গেলাম ইকো পয়েন্ট লুক আউটে- যেখান থেকে পুরো ভ্যালিটা খুব সুন্দর ভাবে চোখে পড়ে। এরকম অসংখ্য লুক আউট বা দেখার বিভিন্ন জায়গা আছে এখানে, সেসব জায়গা থেকে নানাভাবে এই পাহাড়ের – এই গোটা এলাকার সৌন্দর্যে অবগাহন করতে হয়। প্রকৃতি অনুরাগীরা এখানে এসে সবুজে ঘেরা এই বিশাল নীলাভ পাহাড় থেকে চোখ ফেরাতে পারেনা। আমরা ভাগ্যবান একেবারে রোদ ঝলমলে দিনে এসেছি সেই সাথে আছে হাল্কা শীতের আরামদায়ক আমেজ।


নীল পাহাড়ের তিন বোন।

এই জায়গা বিভিন্ন জাতের গাম ট্রী বা ইউক্যালিপটাস গাছে ভরা।  ব্লু গাম গাছ প্রায় ১২০-১৫০ ফুট উঁচু হয় আর এর পাতা থেকে ইউক্যালিপটাস তেল তৈরি হয়। ইউক্যালিপটাস গাছের পাতায় যখন সূর্যের কড়া আলো পড়ে তখন একধরণের তেল নিঃসরিত হয়, ঐ তেল এবং সূর্যের আলোর মিশ্রণে নীল আভাটা তৈরী হয়, দেখে মনে হয়  বিশাল এলাকা জুড়ে পাহাড়গুলো যেন নীল রঙে ডুবে আছে – একারণেই এই জায়গার নাম ব্লু মাউন্টেইন ।

লুকআউটে দাড়িয়ে ঠান্ডা বাতাসের আমেজে চারদিকের অবিশ্বাস্য দম বন্ধ করা সেই সৌন্দর্যের কাছে নতজানু হই আমি। হাজার হাজার বিরল প্রজাতির উঁচু উঁচু গাছ, কাটুম্বা জলপ্রপাত, বিভিন্ন প্রজাতির পাখির এক অনবদ্য মিলনস্থল এটি – নানাধরণের উদ্ভিদ গোটা এলাকা জুড়ে। এখানে অনেক প্রজাতির বড় বড় প্রাণী দেখা যায়, সরচেয়ে বড় আদি মাংশাসী প্রাণী হল কৌল এবং সবচেয়ে বড় পাখি এমু। প্রচুর অ্যাস আর ফার্ন গাছও দেখা যায় এখানে, এই অ্যাস গাছ থেকে খুব সহজেই বুশ ফায়ারের সম্ভাবনাও থাকে। ব্লু মাউনটেইন্স অঞ্চলটি ৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে  প্লাইওসিন যুগে গঠিত হয় এবং এটা সেই সময় যখন ডাইনোসররা এই এলাকায় বাস করতো কারণ অসংখ্য ডাইনোসরের ফসিল এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে! এই এলাকার প্রাচীনত্ব চিন্তা করে, আমি যে সেখানে দাড়িয়ে আছি- পুরো ব্যাপারটাই এক গা শিরশির করা অনুভূতি জাগালো।  বিশাল এই উদ্যানের আয়তন ২,৬৮,৯৮৭ হেক্টর এবং এর সীমানার ভেতরে বিভিন্ন রাস্তা, শহর এলাকা ও বাসস্থান অবস্থিত। এলাকার নাম মাউন্টেইন্স হলেও এখানে উঁচু উঁচু সব মালভূমি রয়েছে যার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বড় বড় নদী এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে।

যেখানে দাড়িয়ে আছি সেই ব্লু মাউন্টেইন ইকো পয়েন্ট লুক আউট থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বহূশ্রুত সেই তিন বোনের অবয়ব- ব্লু মাউন্টেইন এর বিখ্যাত থ্রী সিস্টার্স, পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি পর্বত, যা ব্লুমাউন্টেইন থ্রি সিস্টার্স নামে পৃথিবী বিখ্যাত। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, বরফের দাপট আর প্রতিকূল আবহাওয়ায় ব্লু মাউন্টেইন পাহাড়ের কিছুটা অংশ এমনভাবে রূপান্তরিত হয়েছে, দেখলে মনে হবে যেন তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এই তিনটি পাহাড়ের উচ্চতা ছোট থেকে বড় ক্রমান্বয়ে ৯০৬, ৯১৮ ও ৯২২ মিটার। স্থানীয় লোকেদের দেওয়া থ্রী সিস্টারস নামে এরা বিখ্যাত।অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে ব্লু মাউন্টেইন থ্রী সিস্টারস বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। বিভিন্ন ওয়াকওয়ে ধরে হেঁটে তিন বোনের একেবারে কাছে চলে যাওয়া যায় এমনকি ছুঁয়েও দেখা যায়, সময় স্বল্পতার কারণে আমরা আর সেসবের মধ্যে গেলাম না, দূর থেকে দেখেই তৃপ্তি মেটালাম।

বিশ্বের প্রায় সব দর্শনীয় স্হানেই কিছু মজার গল্প বা মিথ চালু থাকে আর ট্যুর গাইডরা যুগ যুগ ধরে সেসব গল্প শুনিয়ে পর্যটকদের নির্মল আনন্দের যোগান দেয়। বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নে না গিয়ে রুপকথার মত সেসব গল্প শুনতে আসলে মজাই লাগে। থ্রী সিস্টার্স নিয়েও মজার কিছু গল্প চালু আছে।

তিন বোনের সেই গল্পটা তাহলে  বলি-

অনেক অনেক কাল আগের কথা, কাটুম্বা গোষ্ঠীর তিন বোন মিহনি, উইমলাহ এবং গুননেদু বাস করতো ব্লু মাউন্টেনের জেমিসন উপত্যকায়। তারা প্রেমে পড়ে আরেক গোষ্ঠীর তিন ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু তাদের আইনে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহবন্ধন নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই তিন ভাই এই নিয়ম মানতে রাজি ছিল না, যেভাবেই হোক তিন বোনকে তারা বিয়ে করবে। অবশেষে তারা যুদ্ধ বাঁধাল দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। যুদ্ধে তিন বোনের বিপদ দেখে কাটুম্বা গোষ্ঠীর এক জাদুকর তিন বোনকে জাদুমন্ত্র বলে তিনটি পাথর বানিয়ে রাখে, যুদ্ধ শেষ হলেই আবার তাদের আগের রূপে ফিরিয়ে আনবে সেটা ভেবে। কিন্তু জাদুকর নিজেই যুদ্ধে নিহত হয় আর আগের রূপে ফিরিয়ে আনার মন্ত্র একমাত্র সেই জানত, তাই জাদুকরের মৃত্যুতে তিন বোন আর মানুষে রূপান্তর হতে পারেনি এবং সেই থেকে যুগযুগ ধরে প্রকৃতির বিস্ময় হয়ে এই তিন বোন তিনটি পাহাড় রূপে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে আছে প্রেম আর যুদ্ধের স্মারক হিসেবে। তিন বোনের পাশেই আছে আরো একটা ক্ষুদ্র পর্বত। স্থানীয়রা এটার নাম দিয়েছে ‘ছোট ভাই কেভিন’।

এই তিন পাহাড় বা তিন বোন নিয়ে আরো মজার একটা গল্প খুঁজে পেলাম, তো সেটা আর বাদ থাকে কেন, বলেই ফেলি-

এটাও সেই অনেককাল আগের কথা। ব্লু মাউন্টেইনের জেমিসন উপত্যকায় বাস করা কাটুম্বা গোষ্ঠীর তিন বোন, মিহনি, উইমলাহ এবং গুননেডুর বাবা ছিলো একজন তান্ত্রিক চিকিৎসক যে তাইয়াওয়াহ  নামে পরিচিত ছিলো। বুনিপ নামে সেখানে একটি ‘জিনিস’ (ভূত-প্রেত জাতীয় কিছু) ছিলো, যে পাহাড় সংলগ্ন গভীর গর্তের ভেতর বাস করতো। সবাই তাকে ভয় পেতো। তাইয়াওয়াহ বাইরে যাওয়ার সময় তার তিন কন্যাকে নিরাপদে রেখে তবেই বিদায় নিতো। এরকমই একদিন বাবা কন্যাদের কাছে বিদায় নিয়ে বুনিপের গর্ত পার হয়ে গেলো। হঠাৎ পাহাড়ের ওপর থেকে কিছু একটা আছড়ে পড়লো নিচে। মিহমি ভয় পেয়ে গেলো আর ভয় পেয়ে সে নিজেও পাহাড় থেকে পাথর তুলে ছুঁড়ে মারতে থাকলো। এক পর্যায়ে সমস্ত পাহাড় ভেঙেচুরে পড়তে লাগলো বুনিপের গর্তে। বুনিপ তো ক্ষিপ্ত হয়ে গর্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এবং তিন বোনকে দেখে ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে তাদের শাস্তি দেয়ার জন্যে ছুটে গেলো। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে ফেলে তাইয়াওয়াহ, তিন বোনের বাবা। নিরুপায় হয়ে সে বুনিপের অত্যাচার থেকে মেয়েদের রক্ষা করার জন্য তার হাতের জাদুর হাড্ডি দিয়ে তিন বোনকে পাহাড়ে পরিণত করে দিলো। ক্রুদ্ধ বুনিপ এবার আক্রমণ করলো কন্যাদের বাবাকে। তাইয়াওয়াহ বুনিপের হাত থেকে বাঁচার জন্য যাদু বলে পাখি হয়ে আকাশে উড়ে গেলো। সবাই নিরাপদ হলো ঠিকই কিন্তু যাদুর হাড্ডিটা পড়ে গেলো পাখি হয়ে যাওয়া বাবার হাত থেকে। এরপর বুনিপ চলে যেতেই তাইয়াওয়াহ ফিরে এসে জাদুর হাড্ডি খোঁজা শুরু করলো কিন্তু কোথাও সেটা আর খুঁজে পেলো না। নীল পাহাড়ের আদিবাসীদের মধ্যে কথিত আছে যে, সেই থেকে তাইয়াওয়াহ এখনো তার সেই জাদুর হাঁড়টি খুঁজে বেড়াচ্ছে, ওটা পেলেই তিন বোন আবার তাদের প্রাণ ও  সতেজ রূপ ফিরে পাবে। তাই তারা এখনও পর্যন্ত সেই অপেক্ষাতেই আছে।

আদিবাসীদের এই গল্প শোনার রেশ ধরেই, নীল পাহাড়ে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করা আদিবাসী মানুষদের জন্যে আমার মন কেমন করে উঠলো! আজকের এই ভীষণ টিপটপ করে সাজানো জায়গাটাতে দাড়িয়েও সেই প্রাচীন মানুষগুলোর কথা মনে করে আমার কান্না পায়। এই ভূমি ছিল তাদের, পাহাড়, বনাঞ্চলের যত অলিগলি সবকিছু ছিল তাদের নখদর্পনে। ইউরোপীয়রা এসে প্রথমদিকে এই অঞ্চল কাজ করার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের সাহায্যে নিয়েছে, সুবিধামত তাদের কাজে লাগিয়েছে আবার ছলচাতুরী করে তাদেরকে ভূমিচ্যুতও করেছে। আমি ভাবি কেমন কষ্টের ছিল সেই সময়টা, যখন সেই সরল মানুষগুলো দেখেছে কিভাবে হাজার বছর ধরে বাস করা তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমিগুলো একটু একটু করে তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল!

নীল পাহাড়ে ঢোকার মুখে একটা তথ্য কেন্দ্র আছে, সেখানে  গোটা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের একটা বিশাল ম্যাপ রাখা আছে যেখানে দেখানো হয়েছে যে কোন অঞ্চলগুলোতে আদিবাসীরা থাকতো। বাস্তবতা এটাই ছিল যে, সমস্ত মহাদেশেই জালের মত ছড়িয়ে ছিল শত শত বিভিন্ন গোষ্ঠির আদিবাসী মানুষ। বিশেষ করে ‘দারুক’ গোষ্ঠী, বিভিন্ন পাথরের গায়ে যাদের আঁকা ছবির প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখনও এখানে প্রচলিত বিভিন্ন প্রাচীন নাম জানান দিচ্ছে যে ওরা ছিল এখানে, এখনও মিশে আছে সব জায়গায়, এমনকি আদিবাসীদের দেওয়া কেদুম্বা নদীর নামে নাম এই কাটুম্বা শহরের। বেশ কিছুটা সময় এই বেদনায় বুঁদ হয়ে থেকে এই নীল উপত্যকাকে আরো নানা ভাবে আবিষ্কার করার জন্যে যে বিশাল আয়োজন এখানে রয়েছে এবার সেদিক পানে এগোতে হলো।


ব্লু মাউন্টেন
সিনিক রেইলওয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে খাড়া রেইলওয়ে।

কাটুম্বা সিনিক ওয়ার্ল্ডের টিকেট কাউন্টারে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমরা একটু দেরীই করে ফেলেছি কারণ রাইডগুলো চড়ার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে এবং লম্বা লাইন থাকে । বহূ মানুষ বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে প্রতিদিন ছুটে আসে এই জায়গায়। রাইড গুলোতে চড়ে এই ভ্যালির সৌন্দর্য নানান ভাবে দেখাও এখানকার অন্যতম আকর্ষন। টিকেট কেনার প্রক্রিয়া শেষ করার পর টিকেট কাউন্টার থেকে আমাদের হাতে বারকোডওয়ালা ব্যান্ড পরিয়ে দেয়া হলো। একই টিকেটে চার রকমভাবে, সিনিক স্কাইওয়ে, সিনিক রেইলওয়ে, কেবল কার ও সিনিক ওয়াকওয়ের মাধ্যমে এই ভ্যালি দেখা যায়। যেকোন রাইডে প্রবেশের মুখে বারকোড স্ক্যান করলেই গেইট খুলে যায়। প্রথমেই সিনিক রেইলওয়ের গেটে হাতের ব্যান্ড স্ক্যান করে লাইনে দাঁড়ালাম। প্রত্যেকটা রাইডে আপ এবং ডাউন মিলে দুবার চড়া যায় সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য।


খাড়া ট্রেন থেকে দেখা নীল পাহাড়।

একটু পরেই রেইলওয়েতে শিশুপার্কের রাইডের মত কেবিনগুলো চলে আসলো। প্রত্যেকটা রাইডের দশ মিনিট পরপরই কেবিনগুলো হাজির হয় আর একদম সিস্টেম অনুযায়ী সবাই উঠে পড়ে, কোন গ্যানজামের সুযোগ নেই। গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে আছে, বিশ্বের সবচেয়ে খাড়া রেইলওয়ে (Steepest railway) রাইড এই কাটুম্বা সিনিক রেলওয়ে। পড়ে যেতে পারে এমন কোন জিনিস সাথে থাকলে অবশ্যই সাবধানে রাখতে হয় তবে এমন ভাবে বসার ব্যবস্থা করা আছে যে ভয়ের কিছু নেই, মাথার উপরের রেলিং ধরে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। রাইডটা অনেক উপর থেকে খাড়াভাবে সংকীর্ণ একটা লাইন দিয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করে। এই নামার পথে অসাধারণ সব দৃশ্যের সাথে দেখা হয় যা আজীবন মনে রাখার মত। এটা চলা শুরু করার কিছুক্ষণ পর  মনে হয় সোজাসুজি কোন গভীর সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে গেছি যেখানে অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই, শুধু মানুষের চিৎকার আর রাইডের শব্দ শোনা যায়। আবার সেই সুড়ঙ্গ থেকে বের হওয়ার পরেই চোখে পড়বে ব্লু মাউন্টেইন ভ্যালির অপরূপ, অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য – আকাশ, পাহাড় ও নীল সবুজের মিতালী যেন একদম চোখের সামনে দাড়িয়ে আছে। সেই ঘোর কাটতে না কাটতেই রাইডটা নীচে নেমে আসে এবং শেষ হয়ে যায়। রাইডটা খুবই কম সময়ের কিন্ত সারাজীবন মনে রাখার মত অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা।

আবার একইভাব নীচে থেকে রাইডটা উপরে উঠে যায় কিন্তু তার ফাঁকে রেইলওয়ে থেকে নেমে রেইনফরেস্টের মধ্যে দিয়ে সিনিক ওয়াকওয়ে ধরে হেটে জায়গাটা দেখার দারুণ আয়োজন করে রাখা হয়েছে। পুরোনো কয়লা খনির আদলে এক একটা স্থাপনা গড়া, যা দেখতে দেখতে কিভাবে এখানে ইউরোপীয়দের প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল কয়লা খনির সেই শুরুর দিকের দিনগুলো থেকে একবার ঘুরে আসা যায়। বলাবাহুল্য এই কয়লা খনি এখানে সৃষ্টি না হলে এই সিনিক ওয়ার্ল্ড তৈরিই হতো না। এখন যেখানে এই রেইলওয়ে ঠিক সেখানেই কয়লা খনি থেকে কয়লা তুলে তখনকার প্রযুক্তির কেবল কারের মাধ্যমে কয়লা উপর তোলা হতো। সেই প্রযুক্তিই আরো উন্নত হয়ে আজকের সিনিক রেইলওয়েতে পরিবর্তিত হয়েছে, যে বিনোদনের জন্যে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ ছুটে আসে। এখানে চারদিকে, ছবিসহ  সেই পুরনো দিনের ইতিহাস খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যেন মানুষ বর্তমানের আনন্দের পাশাপাশি শুরুর সেই গল্পগুলোও জানতে পারে।

সময়ের অভাবে এই জায়গাটা আমার পুরোটা ঘুরে দেখা হয়নি। কিন্তু এই জায়গা নিয়ে একজন পর্যটকের চমৎকার একটা লেখা পড়ে মনে হলো জায়গাটা যেন আমি সত্যিই দেখেছি, তার লেখা থেকেই একটু তুলে দিলাম এখানে।

‘হাঁটতে হাঁটতে প্রথমেই দেখা যায় কাটুম্বা কয়লা খনির অফিস। সেই অফিসের জানালা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলেই দেখা যায় একটা লোক তার সামনের টেবিলে খোলা খাতার উপর চশমাটা রেখে মনে হয় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। টেবিলের উপর রাখা আছে একটা জ্বলন্ত হারিকেন। এরপরই আছে ভেন্টিলেশন ফার্নেস, তারপর রাখা আছে ঘোড়ার গাড়িতে কয়লা টেনে নেয়ার ভাস্কর্য। এরপর আছে খনির একটা দেয়াল। তার সামনের কাঁটাতারের বেড়ায় লেখা আছে ইতিহাস। এরপরই আছে খনির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির একটা বোর্ড। এটা ধরে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে খনি শ্রমিকদের গ্রামের। সেখানে পুরনো বাড়ির আদলে তৈরি করা আছে ঘর। আর ঘরের ভেতরের আসবাবগুলো একেবারে সেই আমলের-‘ লেখাটা পড়তে যেয়ে আমার মনের মধ্যে খুবই আকুলি বিকুলি করে উঠেছিলো এটা মনে করে যে, সেইসব দিনের গল্প যদি কারো কাছ থেকে শুনতে পেতাম! কত গল্পই না গাঁথা আছে এখানকার দেয়ালে দেয়ালে!

রেলওয়ে শেষ করে আবার একইভাব কেবল কারে যাত্রা শুরু করলাম। কেবল কার যাত্রাটাও দারুণ, ভ্যালির চারপাশের সৌন্দর্য একসাথে দেখা যায় তবে খুবই সংক্ষিপ্ত, সর্বসাকুল্যে চার পাঁচ মিনিট হবে- বুঝতে না বুঝতেই শেষ হয়ে যায় আর শেষ হওয়ার পর একটা ‌অতৃপ্তি তৈরী হয়, কেন আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারলাম না! সময় থাকলে আমি আরেকবারও এটাতে চড়তে রাজী ছিলাম কিন্তু আমার সাথের মানুষরা সেকথা জানলে, নির্ঘাত আমাকে মারতে আসতো কোন সন্দেহ নেই। তাদের একবারেই সব দেখা হয়ে যায় কিন্তু বুভুক্ষু আমার যেন কোন কিছু দেখে তৃপ্তিই মেটেনা!

সুর্যের আলো ছিল বলে আমরা খুব পরিষ্কার ভাবে পুরো ভ্যালিটা উপভোগ করতে পেরেছিলাম, অনেক সময় মেঘলা থাকে, তখন নীল আভাটা ভালো বোঝা যায়না। কেবল কার থেকে নেমে আমাদের আর সময় ছিলনা স্কাই রাইডে ওঠার। শুনলাম সেটা থেকে পুরো ভ্যালি দিগন্তবিস্তৃত ভাবে দেখা যায়, কেবল কারের সাথে এটাই পার্থক্য। স্কাইওয়ের আরেকটা মজা হলো চার পাশের দৃশ্য দেখার পাশাপাশি মেঝেতে লাগানো পরিষ্কার কাঁচের মধ্যে দিয়ে একেবারে নিচের দৃশ্যও দেখা যায়। দেখা যখন হলোনা এসব শুনেই মনকে স্বান্তনা দিতে হলো! কেবল কারের পাশেই রয়েছে একটা ক্যাফেটারিয়া। আমার সঙ্গীদের ততক্ষণে ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় অবস্থা’, যদিও আমার জন্যে না খেয়ে বরং সেই সময়টা আরো কিছু দেখতে পারলে ভালো হতো। যাহোক দারুণ মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে পিৎজা আর সুস্বাদু কফি দিয়ে ভোজন পর্ব সারা হলো। পাশেই ছিল নানা স্যুভেনির শপ যেখান থেকে কিছু সৌখিন কেনাকাটাও বাদ গেলনা।


ব্লু মাউন্টেন
ফুলের শহর কাটুম্বা।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে, বেশ অনেকটা পথ ড্রাইভ করে আবার ফিরতে হবে। আমার মনে হলো যেন কয়েকটা ঘন্টা নয়, কয়েক মুহূর্তই মাত্র কেটেছে! কিছুতেই মন মানছিল না যে এত তাড়াতাড়ি সময়টা শেষ হয়ে গেল অথচ অনেক কিছু দেখা বাকী রয়ে গেল- তাই ফিরে যেতে যেতে আরো যা দুপাশে চোখে পড়লো, বুভুক্ষের মত সেসব দেখতে  লাগলাম।  মনে মনে ভাবলাম, অন্য সব ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে আর একটা গোটা দিন এখানে কাটানোর জন্য আর একবার অবশ্যই আমি আসবো – কিন্তু বাস্তবে সেই সময়টা আর পাওয়া গেলনা…জীবনটা যে এমনই!

ছবি লেখক ও ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত।

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত