| 7 অক্টোবর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য অনুবাদ গল্প: পৃথিবীর হাসি । লুম্মের দাই

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

লেখক পরিচিতি-

অসম এবং অরুণাচল সীমান্তে অবস্থিত পাশিঘাটের ছিলুক নামে এক অখ্যাত গ্রামে লুম্মের দাই ১৯৪০ সনের ১লা জুন জন্ম হয়।শিলঙের এণ্ডমাণ্ডস কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে আকাশবাণী ডিব্রুগড় কেন্দ্রের অনুবাদক এবং ঘোষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন।অসম এবং অসমিয়া ভাষাকে আপন করে নেওয়া এবং পাহাড় ও সমতলের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন স্থাপন করা লুম্মের দাই ২০০২ সনের ৫ এপ্রিল পরলোক গমন করেন।লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘পাহাড়র শিলে শিলে’।অন্যান্য উপন্যাসগুলি যথাক্রমে ‘মন আরু মন’,‘কইনার মূল্য’,‘পৃ্থিবীরহাঁহি’ এবং ‘ওপর মহল’।উপন্যাস ছাড়াও লেখকের বেস কিছু ছোটো গল্প এবং প্রবন্ধ রয়েছে।

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস


মিমি এক টুকরো বিষ তার বাক্সটা থেকে বের করে একটা পাথরে পিষেপিষেগুড়ো করল। তারপরে বিষের গুঁড়োগুলিতে কয়েক ফোঁটা জল দিয়ে চেপে চেপে রস বের করল। রসটা দুধের সঙ্গে মিশিয়ে দুধের পাত্র ভরে নিল। সেখান থেকে উঠে গিয়েবিছানায়নিশ্চিন্তেঘুমিয়ে থাকা শিশুটির মুখের দিকে তাকাল। তার পরই তাকে আলগোছে কোলে তুলে নিল। শিশুটির ঘুম ভাঙ্গেনি। মিমির ভালো লাগল না। সে কেন জাগছে  না? কিছুক্ষণ পার হয়ে গেল। তবু শিশুটির ঘুম ভাঙছে না। তার বেশ রাগ হল। এটাকে কিসে পেয়েছে? কুম্ভকর্ণ কোথাকার। তার ছোটোহাতটাতে একটা চিমটি কাটল। শিশুটি চমকে উঠে হাত নাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে সে কেঁদে উঠল। মিমি দুধের পাত্রটা তুলে নিল। কিন্তু এই যে তার হাতটা কাঁপছে, খুব কাঁপছে। হাতের কম্পনের মৃদু আঘাত পেয়ে দুধের পাত্রে বিষ মেশানো দুধটুকু কাঁপছে। সে অনুভব করল কেবল হাতটাই কাঁপছে না –!তার সর্ব শরীর কেঁপে উঠছে। সে শিশুটির মুখের দিকে তাকাল। সে কাঁদছে ।তার ছোট্ট ছোট্ট ঠোঁট কাঁপছে।জিভটা নড়ছে। হাত পা নাড়াচ্ছে। নিরীহ  শিশু; পৃথিবীর স্নেহ ভালোবাসা তার গালে মুখে স্তূপীকৃত হয়ে আছে। তাকে অযুত চুম্বন ও নিঃশেষ করতে পারবে না।

কিছুক্ষণ পরে শিশুটির কান্না থেমে গেল। সে চোখ খুলে তাকাল। সেখানে পৃথিবীতে মানুষ রূপে বেঁচে থাকার একটা সবুজ স্বপ্ন প্রকট হয়েছে। তার এই ভালোবাসা, এই স্বপ্ন কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।ও মাগো! কীভাবে হবে। সে তো কারও কাছে কোনো অপরাধ করেনি। সে বলতে পারে না কেউ একজন তার জীবনটার পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাইছে। স্বয়ং যম দেবতা তার সামনে উপস্থিত হলেও সে চিনতে পারবে না। ভয়ে সঙ্কোচে তার বুক ধড়ফড়  করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে মিমিমনটাকে শক্ত করে নিল। সে করতে চলা  কাজটা করার আগে অনেকবার ভেবে নিল। এখন আর ভাবারসময় নেই।

মিমি দুধের পাত্রটা কাঁপতে থাকা হাতটা দিয়েশিশুটির মুখের সামনে ধরল। সে হাত দুটি মেলে দুধের পাত্রটা ধরার চেষ্টা করছে। কয়েকবার চেষ্টা করে সে দুই হাতে দুধের পাত্রটা ধরে শিশুর  মুখের সামনে টেনে নিতে চেষ্টা করছে। মিমির বুকের ধড়ফড়ানিটা ক্ষিপ্রতর হল। হাতের কম্পনও তীব্রতর হল, শরীরের উত্তাপ বৃদ্ধি পেল, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হল। সে দুধের বোতলের নিপুলটাশিশুটির  মুখে ঢুকিয়ে দিতে ইতস্তত করছে। অন্তর্দ্বন্দ্বের এক অসহ্য বেদনায় সে অবশ হয়ে পড়ছে। সে শিশুটির মুখের দিকে তাকাতে পারল না, ধৈর্য নেই। মাথা তুলে সে দেওয়ালের দিকে তাকাল। ঠিক তখনই বেড়ার ফাঁক দিয়ে সে বাইরে একটা  মেঠনকে নিজের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়ে শরীর চেটেচেটে আদর করা দেখতে পেল। প্রাণীগুলির ও  নিজের সন্তানের প্রতি এত অগাধ  স্নেহ। সন্তানের জননী হৃদয় ভরা ভালোবাসাটুকু নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য একটা বাচ্চাকে পেয়ে কত গৌরব অনুভব করছে। কিন্তু সে মানুষ। সে কী করতে চলেছে? আত্মসৃষ্টিকেধ্বংস করতে চাইছে। আর এই যে শিশুটি নিজে নিজেই তার জীবননাশকবিষটুকু  মায়ের বুকের দুধ বলে ভেবে নিজের মুখে ঢোকাতে চাইছে। তার দু’গাল বেয়ে ধারাসারে  চোখের জল নেমে এল। দুধের বোতলটা আপনাআপনি তার হাত থেকে মাটিতে খসেপড়ল।সে তুলে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারল। তার মৃত্যু হতে পারে না । তাকে মানুষ হতেই হবে । তার জন্য তাকে বেঁচে থাকতে হবে।মানুষের অন্যায়-অবিচারের সঙ্গে লড়াই করবে। সে জীবনটাকেজয় করবে। দুধের বোতলটা দেওয়ালে লেগে ভেঙ্গেচুরমার হয়ে গেল। বিষ মেশানো দুধটুকু মাটির সঙ্গে মিশে গেল। মিমিশিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার গালে  মুখে কয়েকটাচুমু এঁকে দিল। তার চোখের জলে গাল দুটি ভিজে গেল। তারপরে সে ব্লাউজটা গুটিয়েশিশুটিকে বুকের দুধ খাওয়াল। তার স্নেহশীল মুখটির দিকে একদৃষ্টেতাকিয়েরইল। সে তার মা। মাতৃত্বের গৌরবে সে গৌরবান্বিত হল। খাওয়া হয়ে গেলে সে শিশুটিকে পিঠে তুলে নিয়েউদ্দেশ্যহীনভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মিমিঙেম্পের কাছে নিজেই ধরা দিয়েছিল।

বর্ষার একদিন মাঠে যাওয়ার সময়মিমিকে একটি নদীর তীরে দাঁড়াতেহয়েছিল । নদীটির খোলা জলের স্রোত দ্রুত গতিতে বয়ে চলেছে । সে পার হবে বলে জলে নেমেছিল।জলে কোমর পর্যন্ত ভিজে গেল। স্রোত তাকে ভাসিয়েনিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। সে আর এগোতে পারল না। ফিরে গিয়ে তীরে উঠে পড়ল।পেছন ফিরে তাকাল। একজন যুবক আসছে–ঙেম্পে।

মিমির কাছে এসে ঙেম্পে বলল,’ আজ জল খুব বেড়েছে তাই না?’

মিমি উত্তর দিল না।ঙেম্পের দিকে পিঠ দিয়ে সে দাঁড়িয়েরইল। জলের স্রোতের দিকে বারবার তাকাচ্ছে।

ঙেম্পেই পুনরায় বলল,’ এসো আমি পার করিয়ে দেব।’

‘ওহো’– আমি বাড়ি ফিরে যাব । মিমি উত্তর দিল।

‘ কেন মাঠের কাজ শেষ হয়ে গেল নাকি?’

‘ওহোঁ

‘তাহলে?’

‘ মাঠ থেকে আসার সময় কে পার করে দেবে?’

‘ কেন, আমি পার করিয়ে দেব।’

‘ তোর সঙ্গে দেখা হবে কি?’

‘কেন হবেনা। একটা কাজ করিস। আমাকেই নদীর তীরে না পেলে তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি। অন্যদেরও দাঁড়াতে বলবি। যদি আমি আগে আসি তোদের জন্য অপেক্ষা করব।’

‘অন্যকে নদী পার করায় সময় নষ্ট করার জন্য তোর মা বাবা রাগ করবে না কি?’

‘ সেই সবেতোরকি দরকার? সে হাসতে হাসতে বলল। তারপর পুনরায় বলল,’ আয়।

মিমিরহাতধরেঙেম্পেজলেনাম্ল।জলেবুকপর্যন্তভিজেগেল।জলেরস্রোতএততীব্রভাবেবয়েচলেছেযেমিমিস্রোতেরসঙ্গেভেসেযাবারমতোঅবস্থাহয়েছে।সেতারহাতখুবশক্তকরেধরেআছে।এমনিতেজলেরস্রোততারপরনেরমেখেলাটাখসিয়েদিল।সেএকহাতদিয়েমেখলাটাধরেরাখল।অন্যহাতটাতারবুকেরমধ্যে।তারখুবলজ্জাকরতেলাগল।তার মুখের দিকে সে তাকাল-তার দিকে সে তাকাচ্ছেই না।ওপারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।ওপারেপৌছানর সঙ্গে সঙ্গে সে তার হাত ছেড়ে দিল।সে তার মুখের দিকে তাকাল।এখনও সে তার দিকে তাকাচ্ছে না।সে দ্রুত মেখেলাটা পরে নিল।ওরাতীরে পা রাখল।মিমিদাঁড়াল।ঙেম্পের মুখের দিকে সে তাকাতে পারল না।পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটি খুঁড়েখুঁড়ে মাথা নিচু করল।

‘চল-অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

‘তুই এগিয়ে যা।’মিমি তার দিকে না তাকিয়ে বলল।

‘কেন তুই যাবি না?’

‘তোকে লজ্জা লাগছে।’

‘কেন?’

মিমি চুপ।

‘লজ্জা করার মতো কী হয়েছে?’

‘এখন যে-।’সে শেষ করল না।

তার মনে পড়ল তার উলঙ্গ হয়ে যাবার কথা।তার চোখে পড়েছিল।কিন্তু সে ইচ্ছা করেই তাকায় নি।দেখাটা সে তার প্রতি অন্যায় করা হবে বলে ভাবল।তথাপি তার উলঙ্গ দেহটা তার চোখে পড়েনি এরকম ভাব করে সে বলল,এখন কী হয়েছিল?আয়-আর অপেক্ষা করার সময় নেই।’

মিমি ভাবল-সে হয়তো দেখে নি।তার লজ্জার মাত্রা কমে গেল।সে তাকে অনুসরণ করল।

সেই দিনটা মিমি আর ভুলতে পারল না।তার হাতটা তার বিশাল বুকের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল।তার বুকের তাপ এবং তার বাহুর তাপের সমন্বয়ে গায়ে এক ধরনের শিহরণ অনুভব হচ্ছিল।এখন মনে পড়লে তার লজ্জাও লাগে ,ভালো লাগে-ভালো লাগে বেশি করে। সেদিন তার ব্যবহারে অশ্লীলতার কোনো প্রয়াস ছিল না।একজন যুবক হলে হয়তো তার মনে সেরকম ভাবই জাগত।তার কথা-বার্তাতেও অশ্লীলতার কোনো আভাস নেই।অন্যকে সাহায্য করার জন্য সে সবসময় এগিয়ে যায়।তারকোনোরকম প্রতিদান হয়তো সে আশাই করে না।এরকমএকতিউদারচেতা,হৃষ্টপুষ্ট যুবকের প্রতি সে কখনও বিমুখ হতে পারবে না।তার হৃদয়-মন এখন ঙেম্পেময়।

ঙেম্পে-এত ভালো লাগে তার।‘ঙেম্পে’তাদের ‘পুনং’নাচেরমতো।এতরসাল,তাঁর হাসির মতো এত মিষ্টি মিষ্টিখুবই আদর আদরলাগা।তার বিশাল বুকের মধ্যে নিজের শরীরটা ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছা করল মিমির।

একদিন মিমি নিজের হাতে তৈরি একটি শার্ট তাকে দিয়েছিল।প্রথমে সে নিতে চাইল না।

‘শার্টটা কেন দিচ্ছিস?’

‘দেওয়া ঠিক হয়নি নাকি?’

কথাটা বলে সে লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল।সে যেন তার অনেক দিনের পরিচিত।তার কাছে যেন মিমির অনেক দাবী আছে।সেইসব দাবী সে পরিপূরণ করলে অভিমান করার যেন তার অধিকার আছে।তার সঙ্গে মিমির অবাধ মেলামেশা নেই।বা খুব বেশি কথা-বার্তাও হয় নি।সেভাবল,কথাটা বলার জন্য সে পরিতৃপ্তনয়।তার সঙ্গে অবাধ মিলনের পথ সুগম করার চেষ্টা।যদি সেই কথাটা বলার জন্য তাকে অধিকার না দেয় তাহলে সেদিন সে তাকে কেন নিজের বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে নদী পার করে দিয়েছিল?নদী পার করে দেবার পরেও সে তাকে এগিয়ে যেতে বলেছিল।কিন্তু সে ইচ্ছা করেই কেন তাকে এক সঙ্গে যাবার জন্য ডেকেছিল।

সে মাঝখানে কিছু বলেছিল,কিন্তু সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বলে কিছুই শুনতে পেল না।তার কাছ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে সে হতাশ হয়ে ‘আমি যাই’বলে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল।

‘আমরা দেওয়া জিনিস লোকে নেয় না।‘অভিমান করে সে বলল।

সে দাঁড়াল।সে ভাবল-ও তো তার কিছু লাগে না।ওদের বাড়ির সঙ্গে তাদের খুব মেলামেশাও নেই।অন্যদের কোনো জিনিস দেয় না।

‘শার্টটা নিয়ে আমি তোকে কী দেব?টাকাও নেই।’ঙেম্পে বলল।

‘তোকে শার্ট বিক্রি করে আমি ধনী হতে চাই না।আমি কী করব।আমাদের মতো মেয়ের কাউকে কোনো জিনিস দেওয়া শোভা পায় না।

শার্টটা নিয়ে সে উঠে যেতে চাইল।

‘হবেতাহলে।শার্টটা কিন্তু খুব সুন্দর হয়ছে।’

মেঘলা আকাশের পরে মেঘ সরে গিয়ে হঠাৎ রোদ উঠারমতোমিমির মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

‘ইসহয়েছে।খারাপ বললেও কিন্তু একটুও অখুশি হতামনা।’সে হাসতে হাসতে বলল।

মিমি তার মুখ থেকে এরকম একটি কথা শোনার আশাতেই ছিল।এখন সে যেন তার বাঞ্ছিত একটা জিনিসকে পেয়ে গেল।শার্টটা তাকে দিতে পেরে সে একটা বোঝাতে না পারা আনন্দ পেয়েছে।সেইশার্টটার মাধ্যমে সে যেন তার প্রতি থাকা তার ভালোবাসা সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে দিয়েছে।সত্যিই তার ঙেম্পেকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছা করছে।তাকে পাশে বসিয়ে ভালোবাসলেও যেন তার আশ মিটবেনা।এত মিষ্টি মিষ্টি তার কথাগুলি,যেন বন্য পাখির মন-প্রাণ হরণ করা সুমধুর গান।তার হাসিটা এত সুন্দর যেন সে জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে যেতে গিয়ে দেখা সেই সুন্দর বন্য ফুল।

‘আমি যাই ঙেম্পে।বাড়িতে ধান বানার কাজ বাকি ছিল।’সে অতি নম্র সুরে বলল।

‘যা তাহলে।তুই কিন্তু বড়ো সুন্দর মিমি।’

‘যা-দুষ্ট কোথাকার।’মিমি হাসতে হাসতে তার দিকে আড়চোখে তাকাল।

‘সত্যি কথা বললে মানুষ দুষ্ট হয়।’

‘তুই খারাপ পেয়েছিস নাকি?’

‘হ্যাঁ তো।’সেএমনিতে বলল।

‘খারাপ পাস না ঙেম্পে-আমি এমনিতেই বলেছি।’

‘আমিও এমনিই বললাম।’

দুজনেই একসঙ্গে হাসল।

‘তোকে কিন্তু আমার আদর করতে খুব ইচ্ছা করছে।’ বলে হাসতে হাসতে তার জন্য অপেক্ষা না করে সে দৌড়ে চলে গেল।

– তিনটি বর্ষা অতীতের বুকে হারিয়েগেল।ঙেম্পে এবং মিমির মধ্যে করা ভালোবাসার বিনিময়ওদেরহৃদয়েগভীরতম কোণে পাথরের খোদাই করার মতো আঁকা হয়ে রইল। তাকে খরস্রোতা পার্বত্য নদীর পাথরের হাজার বছরের ঘর্ষণও মুছে ফেলতে পারবে না। ওদেরবিয়ের বয়সও হয়ে গেছে। মিমিরভয় হচ্ছে– এর মধ্যে হয়তো তার মা-বাবা তার বিয়ের কথা ভাবছে। হয়তো কনেও ঠিক হয়ে গেছে। সেই ভাগ্যবতী কনেটিহয়তো সে নয়– গ্রামের এই কোনো একটি সুন্দরী মেয়ে, যাকে সে তার পত্নী বলে মেনে নিতে বেশ কঠিন হবে। সে পরপুরুষ হওয়াটামিমি ভাবতেই পারে না। সে  সদাই মিমির আপনজন হয়ে থাকবে।ঙেম্পের বর্তমানে মিমি হাজার দুঃখ কষ্টকেও অনায়াসে সইতে পারে। মিমি তাকে অন্য মেয়ের স্বামী হতে দিতে পারেনা–দেবে না। মিমি  তার দুগালে অজস্র চুম্বনে হৃদয়ের ভালোবাসা উজার করে দিয়েছে–তার সঙ্গে প্রাণ খুলে হেসেছে।ঙেম্পেও তার ভালোবাসা কোনদিন উপেক্ষা করেনি–শরৎকালের সকালের রোদের মতো তার দুগালে মিষ্টি মিষ্টিচুমু এঁকে দিয়ে তার ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে। সেই ভালোবাসা জঙ্গল থেকে তুলে আনা কোমল পাপড়িরমুগ্ধকরবনফুলগুলি কিছুক্ষণ পরে মুর্ছা যাওয়ার মতোশুকিয়ে যেতে পারে না।

বর্ষা গেল।শীতকাল গেল।বসন্ত এল।শীতকালে পাতাবিহীন গাছ লতা-পাতাগুলি নতুন পাতা মেলে সবুজ হয়ে উঠল।পৃথিবী নতুন প্রাণ পেয়ে জেগে উঠল।মিমিরা খড়ি কুড়োনোর জন্য জঙ্গলে যাবার সময় খেতে না পেয়ে গাছের ডালে বসে মন খারাপ করে থাকা পাখিগুলিকে ‘ও পাখি একটা গান গা তো দেখি’বললেও না গেয়ে অভিমানে উড়ে চলে যাওয়া পাখিগুলি এখন গাইতে না বললেও উপযাচক হয়ে নিজেই গান গাইতে লাগল।এই পাখিগুলিও ঙেম্পের মতো আদরের—তার মতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে—সুললিত গান গায়।তার মতো এরাও তার কথা মানে—গান গাইতে বললে গায়।ঙেম্পের মতো এরাও চুমু খেতে বললে তাকে চুমু খাবে।তাকে চিরসঙ্গী করে তার বুক ভরা ভালোবাসা নিঃশেষ করে দেবার ইছা করার মতো এই পাখিগুলিকে ধরে খাঁচায় ঢুকিয়ে রেখে তার আদর করতে ইচ্ছা করে।

এই সময় বছর জুড়ে কোথাও লুকিয়ে থাকা আরাণ উৎসবটা মিমিদের মাঝখানে এল।আরাণ উৎসব ওদের মনে এনে দিল নতুন উৎসাহ,নতুন রং আরও কত কি!মনেরআনন্দেমিমিরাউৎসবেরদিনগুলিতেনাচগানকরেথাকে।যুবতিদেরনাচঙেম্পেরাএসেদেখেযায়।মিমিসঙ্গীদেরসঙ্গেনেচেথাকারসময়েওলুকিয়েচুরিয়েতারমুখেরদিকেতাকায়।চোখেচোখপড়লেমিমিহাসে।ফলে মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়। তার সঙ্গীরা দলবেঁধে বসে কেউ মন্তব্য করে ‘এর হাত থেকে রক্ষা নেই—নেচে থাকার সময়েওঙেম্পের মুখ থেকে চোখ নামায় না। কেউ বলে,‘এর কপাল কিন্তু ভালো বলতে হবে— ঙেম্পেরমতো একটি যুবক পেয়েছে।’ আবার কেউ বলে,‘এর আর দেরি সইছে না—কয়েক মাসের ভেতরে বিয়ে হবে। ওকে বড়ো ভাগ্যবতী বলতে হবে।’ কেউ বলে—আমাকেও তার ভাগ দিতে হবে হলে।

প্রত্যেকেই একসঙ্গে হেসে ফেলে।মিমিলজ্জায় লাল হয়ে যায়। সে মাত্র বলে,‘যা—তোদের আর অন্য কথা বলার নেই।’ সঙ্গীদের মন্তব্যগুলি কিন্তু তার ভালো লাগে।

একদিন নাচ শেষ হওয়ার পরে মিমি সঙ্গীদের সঙ্গে গেল না। কাছেই একটাপাথরের ওপরে বসে থাকা ঙেম্পেকেসে ডেকে নিল।ওরা একটা কাঁঠাল গাছের নিচে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ দুজনে নীরব হয়ে রইল।

‘ ডেকে আনলি কেন?’ সে নীরবতা ভঙ্গ করল।

‘ তোর সঙ্গে কথা আছে।’

‘ কী কথা?’

‘ তোকে আমি খুব ভালোবাসিঙেম্পে।’

‘ তার চেয়ে তোকে আমি বেশিভালোবাসি।’

‘ তুই আমাকে বিয়ে করবি বল।’

‘করব।’

‘ তাড়াতাড়ি কর।’

‘ কেন?’

‘ না হলে তোর বাবা তোকে অন্য কোনোমেয়ে এনে দেবে।’

‘ আচ্ছা, আমি কাকাকে বলব। কাকা রাজি হলে বাবারা মতামত দেবে।’

দুজনেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল।

‘ আমাকে  একটা চুমু খা ঙেম্পে।’মিমি মুচকি হেসে বলল।

‘তুই আমাকে আগে খা।’

মিমি তার দুই কাঁধে দুই হাত রেখে তার গালে কয়েকটিচুমু এঁকে দিল। তারপর বলল,‘তোকে খুব ভালো লাগে।’

সে নিজের গাল দুটো পেতে দিল।ঙেম্পেতারগালেকয়েকটিচুমু খেল।

ঙেম্পেরকাকু হতাশ হয়ে মিমিদেরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।মিমির বাবা      ঙেম্পে-মিমিরসম্পর্ক সম্বন্ধে অনেক দিন থেকে জানে।মিমিকেঙেম্পের কাছ থেকেসরিয়ে আনার জন্য মিমিরবাবা তার জন্য একটা ছেলে ঠিক করেছে। এখন পর্যন্ত তাকে জানানো হয়নি। খুব শীঘ্রই মিমিকে  ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে দেবে।মিমি সব কিছু শুনল।

মিমির মাথার ওপর যেন পর্বতের ওপর থেকে একটা বড়ো পাথর খসে  পড়ল। শীতের সকালে মিষ্টি রোদ দিতে থাকা সূর্যটা ঘন মেঘের আড়ালেলুকিয়ে অদৃশ্য হওয়ারমতোহঠাৎ যেন  ঙেম্পেএই পৃথিবীতে নাই হয়ে গেল। পৃথিবীটা জনশূন্য হল। কেবল মিমি আছে। এখন মিমি যে সমস্ত মানুষ দেখছে ওরা সে স্বপ্নে দেখা রাক্ষসরা মাত্র।ওদেরকণ্ঠস্বর এখন বড়ো কর্কশ হল—তাকে শেলে বেঁধারমতোবিঁধে। ঙেম্পে ছাড়া তার জীবন অর্থশূন্য—ঠিক রসাল স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠলে নিমেষের মধ্যে সবকিছু নাই হওয়ার মতো।সে অনুভব করল—সে বাতাস প্রবেশ না করা একটা পর্বতের অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে আছে।

বর মিমিদের বাড়িতে এল (বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে বর কনের বাড়িতে কয়েক বছর আসা যাওয়া করা নিয়ম)।বাড়ির প্রতিটি মানুষ ঘুমোনোর পরে সে মিমির বিছানায় উঠে আসে।মিমি বিছানা থেকে উঠে যায়।সে তার বোনের বিছানায় বোনের সঙ্গে গিয়ে শুয়েপড়ে।বরমিমির বিছানায় একা একাশুয়েপড়ে।কয়েকদিনএভাবেই  গেল। বরের বাড়ি থেকে আপত্তি এল। ওরা কনে গ্রহণ করবে না। কনে বরকে  অপমান করার জন্য বরপক্ষ কন্যা পক্ষের কাছে অর্থদণ্ড দাবি করেছে। মিমির বাবার উপায় নেই। তাকে ছলে বলে হলেও বরের বাড়িতেপাঠিয়ে দিতে হবে। না হলে সে ঙেম্পের সঙ্গে গিয়ে দেখা করবে । কিন্তু তার কাছে তিনি মেয়েকে দিতে পারবেন না । ওদের জমি নেই, কোনো ধনসম্পত্তি নেই। ওরা কার বাড়িতেচাষবাস করে ছেলে মেয়েদের লালন পালন করবে? অন্যেরা তাদের মানবতারখাতিরে নিজেদের মাটিতে চাষ করতে দিচ্ছে বলে ওরাদুবেলা দুমুঠো  খেতে পাচ্ছে। অন্যেরা জমি-দেব না বললে অনাহারে মরতে হবে। এরকম একটা পরিবারে তিনি কোনো মতেই মেয়েকে দান করতে পারেন না—মান মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে।

বাবার কথা জানতে পেরে মিমি একদিন ঙেম্পের সঙ্গে দেখা করতে গেল।

‘ তুই আমাকে পালিয়ে নিয়ে যা। এছাড়া আমার হাতে আর কোনো উপায় নেই।’

‘ তুই এভাবে বলিস না মিমি। তুই বিয়েতে মত দে। মা বাবার কথা শুনতে হয়।’

‘ তাহলে তুই আমাকে ভালোবাসিস না?’

‘ ভালোবাসি।’

‘ বিয়ে করবি না?’

‘ করব না।’

‘ তাহলে আগে কেন রাজি হয়েছিলি?’

‘ তোর মা বাবা আমার কাছে তোকে দেবে না— তুই হয়তো সে কথা ভুলে গেছিস।’

‘ পালিয়ে নিচ্ছিস না কেন?

‘ কাজটা খারাপ হবে।’

মিমি কিছু না বলে রাগ করে চলে গেল।

মিমিবাড়ি থেকে পালিয়ে সমতলে নেমে এল। সুদীর্ঘ পথ পর্বত পাহাড় অতিক্রম করে পাহাড়ে পাদদেশে সে এখন পাশিঘাট শহরে এসে পৌঁছেছে। ওদের গ্রামের পাশ দিয়ে পর্বত ভেদ করে বয়ে আসা সিয়াংনদীটা এই পাশিঘাট শহরের ওপর দিয়েবয়ে চলেছে। নদীটা এখানে খুব প্রশস্ত। সে এই ধরনের এক মাইল জোড়া বিস্তৃত নদী জীবনে দেখেনি। ওই যে বিরাট বাড়িগুলিদৈত্যাকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেড়াগুলি ওদের বাড়ির মতো তক্তার নয়– কেমন যেন পাথরের মতো শক্ত জিনিস। চুন দেওয়াহয়েছে বলে সাদা দেখাচ্ছে। বাড়ির চালগুলি ওদের বাড়ির চালের মতোটকৌপাতা বা জেঙুপাতাদিয়ে তৈরি নয়– লোহার মতো এক ধরনের চ্যাপ্টা জিনিস। উঁচু প্রশস্ত রাস্তাগুলি দিয়ে মোটর গাড়িগুলি দ্রুত বেগে দৌড়াচ্ছে। সে আগে মোটরের নাম শুনেছে কিন্তু দেখেনি। এই যে শহরের মাঝখানে একটা বিশাল ঘাসে আচ্ছাদিত মাঠ। আকাশের জাহাজগুলি এখানে নামে। সে ওদের বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়া আকাশি জাহাজ দেখেছে কিন্তু কাছ থেকে দেখেনি– এখন দেখছ। লোকেরা এটাকে ‘এরোপ্লেন’ বলে। সেই পাশিঘাটে একটা ‘উইভিং স্কুল’ আছে বলে শুনেছে। সেখানে ছেলেমেয়েরা নাকি যন্ত্রের সাহায্যে কাপড় বোনে। সে সেখানে যোগদান করবে। কাপড় বোনে বাজারে বিক্রি করে সে পয়সা পাবে। তা দিয়েই তার পেট চলে যাবে। এভাবেই সে জীবনটা কাটিয়ে দেবে।

— উইভিং মাস্টার দত্ত স্যার খুব দুষ্ট। তিনি কেবল তার দিকে তাকিয়ে থাকেন– হাসেন। তার কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করেন। সে তাঁতে বসলে তিনি তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে এটা ওটা দেখিয়ে দেন। গায়ে হাত দিয়ে বলেন– মাফ করবি। সে জানে তিনি করবেন বলেই করেন। তার চিৎকার করে গালিগালাজ করতে ইচ্ছা করে। লোকটারকণ্ঠস্বরবড়ো কর্কশ, যেন পাহাড়খসে পড়ার শব্দ। তোর হাসিটা বড়োকুৎসিত, যেন বাদুরের মুখ। একবার সে কোনো একটা কাজে বাইরে বেরিয়েগিয়েছিল। দত্ত স্যার তার পেছনপেছন এলেন। দরজাটা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার কাছাকাছি চলে এলেন। মিমি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠল। সে তার গালে কয়েকটি চড় বসিয়ে দিল । লোকটি যেন কোনো রকম ব্যথা পায়নি এভাবে হেসেহেসে ভেতরে চলে গেল। সে চলে যাবার পরে মিমি ভাবল— মাস্টারকে এভাবে চড় মারাটা উচিত হয়নি। সে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু মাস্টারের কি নিজের ছাত্রীর সঙ্গে এই ধরনের ব্যবহার করা উচিত? তিনি তো কোনো ধরনের অনুতাপ করেননি। তবু সে ভেবেছিল— এই ঘটনার পরে দত্ত স্যার তার প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহণ করবে । কিন্তু সেরকম কোনো কিছু হল না, স্যারের ব্যবহার আগের মতোই।অবশ্য অল্প ভয়েভয়ে।

সেদিন বিকেলে স্কুল ছুটি হওয়ার পরে সে হোস্টেলে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল। সেএকবার পেছন ফিরে তাকাল। দত্ত স্যারও তার পেছন পেছনে আসছে। তার খুব রাগ হল। এ আবার কোথা থেকে এসে হাজির হল? কিছুদূর যাবার পরে দত্ত স্যার  মিমির কাছাকাছি পৌঁছে গেল। তিনি বললেন মিমি তুই আমার ওপরে রাগ করেছিস নাকি?’

‘ যা অভদ্র।’ সে দত্তস্যারের দিকে রাগী চোখে তাকাল।

‘ তোকে আমি কিন্তু খুব ভালোবাসিমিমি।’

মিমি কোনো কথা না বলে একটা পাথরের টুকরো কুড়িয়েনিয়ে দত্তের দিকে ছুঁড়ে মারল। পাথরটা দত্তের হাড়ের মধ্যে আঘাত করল।’ইস’ বলে সে বসে পড়ল।

‘ টের পেলি।’ বলে মিমি দ্রুত পায়েএগিয়ে গেল।

কিছুদূরগিয়ে সে দত্ত স্যারের দিকে ঘুরে তাকাল। দত্ত ব্যথায় কাতরাচ্ছে। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে– পারছে না। হঠাৎ দত্তের প্রতি মিমির করুণা জন্মাল। সে ফিরে গিয়ে দত্তের সামনে দাঁড়াল। হাসি হাসি ভাবে দত্ত তাকে বলল–’ পায়ে  খুব ব্যথা পেয়েছিমিমি।’

দত্ত মিমির প্রতি যতই অভদ্র ব্যবহার করুক না কেন, মিমির তো একটি নারীর হৃদয় রয়েছে। তার অন্তর গলে গেল। সে দত্তের  প্যান্টটা গুটিয়েনিয়ে দেখল তার লোমশ পা দিয়ে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। সে নিজের রুমালটা মাঝখান দিয়েছিঁড়েনিয়ে এক টুকরো দিয়ে রক্তটা মুছে দিল এবং অন্য টুকরো দিয়ে ঘা-টাতেব্যান্ডেজ করে দিল।

‘ তুই হাসপাতালে চলে যা। মিমি খুব নম্র সুরে বলল।

‘ যাব না– এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।’

‘যা না– না গেলে আমি খুব খারাপ পাব।

কিছুক্ষণ আগে স্যার ছিল তার ঘোর শত্রু। এখন সে হয়ে পড়ল তার একান্ত আপনজন।

‘ ডাক্তার জিজ্ঞেস করলে আমি কী বলব?’

‘কোথাও হোঁচট খেয়েছিস বলে দিবি।’

দত্তের মনে হল সহজ সরল মিমিকথায় কাজে সত্যিই অত্যন্ত স্নেহশীল। তাকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করল।

সে চারপাশে তাকাল।আশেপাশে কেউ নেই।

‘মিমি।’

‘কী?’

‘এখানে বস।’

মিমি দত্তস্যারের কাছেই বসে পড়ল। সে মিমির গালে একটা চুমু খেল। মিমি আপত্তি করল না। সে শুধু বলল’ লোকে দেখবে।’

সে অনুভব করল– আগে দুরাচার বলে ভাবা দত্তসারের ঠোঁটের উষ্ণতাটুকু দেখছি তার খুবই ভালো লেগেছে, ঠিক শীতকালেগায়ে জামা কাপড়নেওয়াউষ্ণতারমতো। তার কণ্ঠস্বর ও কবুতরের আওয়াজেরমতো বড় করুণ। দত্ত স্যারের প্রতি কঠোর হওয়ার সাহস তার আর নেই।

‘ দত্ত স্যার।’

‘কি?’

‘ তুই কিন্তু খারাপ পাস না।’

‘ কেন খারাপ পাব— দোষটা তো আমার নিজের, কারণ— আমি খারাপ মানুষ।’

মিমি কিছু একটা বলবে বলে মুখ খুলেছিল— বলতে পারল না। বললে সে এভাবে বলত যে সে খারাপ মানুষ নয়। কারণ মিমি তার পায়ে রক্ত বইয়েদিয়েছে তবু সে রাগ করেনি— বরং দোষটা সে নিজের কাঁধে নিয়েছে। সে ভাবল— দত্ত স্যার কখনও খারাপ মানুষ হতে পারে না— সে তাকে ভালোবাসে। কিন্তু মিমি তাকে ভালবাসতে পারেনি। কেননা সে এখনও ঙেম্পেকেভুলতে পারেনি। একবার একজনকেভালোবেসে অন্য কাউকে ভালবাসতে সে জানে না।

‘ তুই হাসপাতালে যা। এখনই সন্ধ্যা হবে।’ মিমি দপ্তর স্যারের হাত ধরে তাকে উঠাল। এখন ও ব্যথা কমেনি। তবু ধীরে ধীরে হাঁটতে পারছে।

— দুদিন ধরে দত্তস্যার স্কুলে আসছে না। মিমি ভাবল—বোধহয় পায়ের ব্যথা বেশিহয়েছে।একদিন বিকেলে মিমি স্কুল থেকে এসে দত্ত স্যারের বাড়িতে গেল।সে দেখল দত্ত স্যার একটা বেতের চেয়ারে বিষন্ন ভাবে বসে আছে।

‘তুই ভালো হসনি নাকি?’মিমি বলল।

‘একটু ভালো লাগছে।’

‘ওষুধ দিয়েছে কিনা?’

‘দিয়েছে—কাল পরশু শুকিয়ে যাবে।’

‘আমার খুব চিন্তা হচ্ছে—ঘা টা তাড়াতাড়ি না শুকোলে তোর অনেক ক্ষতি হবে।’

‘চিন্তার কিছু নেই।এখনও আমি স্কুলে যেতে পারি।কিন্তু ডাক্তার নিষেধ করেছে বলেই যাই নি।’

তুই সুস্থ হয়ে উঠলে আমিও মনের দিক থেকে হালকা হয়ে যাব।’

‘মিমি’

‘কী?’

‘তোকে আমি সত্যিই ভালোবাসি।’

মিমি নীরব।

‘তোকে আমি বিয়ে করব মিমি।’

‘কিন্তু পারবি না।’

‘কেন?’

‘সমতলের মানুষ পাহাড়ি মেয়েকে বিয়ে করে না।’

‘তুই কীভাবে জানিস?’

‘আমি সব জানি।বিয়ে করার ছলে সমতলের মানুষ অনেক পাহাড়ি মেয়ের সতীত্ব নষ্ট করেছে।পরে ফেলে রেখে চলে যায়।’

‘আমি ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে বলছি তোকে আমি বিয়ে করব।তোর কথাটা সত্যি।কিন্তু তুই কি দেখিস নি সমতলের মানুষ এখন পাহাড়ি মেয়েকে বিয়ে করে এখানে কয়েকবছর থাকা সমতলের মানুষগুলিকে তুই কি বিশ্বাস করিস না?মানুষ পশু নয় যে নিজের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের ফেলে রেখে কোথাও চলে যাবে।ওদেরমতো আমিও তোকে বিয়ে করে সবসময় তোদের এই পাহাড়ে থাকব।সব মানুষ এক রকম নয়।মেয়েদেরসতীত্ব নষ্ট করে ফেলে রেখে চলে যাওয়া মানুষগুলির কথা আলাদা।ওরা মানুষ নয়—ওরাপশু।তুই আমাকে বিশ্বাস কর।’

মিমিঅন্তঃসত্ত্বাহল।হোস্টেলেরসুপারিন্টেণ্ডডেন্ট তার চরিত্রের দোষে তাকে হোস্টেল থেকে বের করে দিল।উইভিং স্কুল থেকেও তার নাম কেটে দেওয়া হল।সে এখন কার আশ্রয়ে যাবে?দত্ত স্যারকে সে তার একমাত্র আশ্রয়দাতা বলে ভেবেছিল।কিন্তু সে আজ দুদিন আগে বাড়ি থেকে একটা টেলিগ্রাম পেয়ে বাড়ি চলে গেছে।সে চোখ মুছতেমুছতেহোস্টেল থেকে বেরিয়ে এল।তার বাড়ির কথা মনে পড়ল।বাড়ি ফিরে যাবে ভেবে পালিয়ে আসে নি।বাবা নিজে কয়েকবার পাশিঘাটে এসে তাকে নিয়ে যেতে এসেছিল,কিন্তু সে যায় নি—এখনও যাবে না।তাহলে সে কোথায় আশ্রয় নেবে?এখন সিয়াং নদীর স্রোতই তাঁর একমাত্র আশ্রয়দাতা হবে?ওহো—আত্মঘাতী হয়ে মরলে অন্যেরা তাকে নিয়ে হাসবে।কোনো একজন দয়ালু মানুষ তার প্রাণটা নাশ করে দিলেও সে শান্তি পেত।

অন্ধকার নেমে এল।তার আশ্রয় নেই।তথাপি সে ধীরে ধীরেহাঁটছে—বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নেই।যেতে হবে বলে যাচ্ছে।রাত অনেক হয়েছে। সে রাস্তার পাশে একটা গাছের নিচে বসে পড়ল।

তখনই একজন মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছে।সে অন্ধকারের মধ্যে অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে।ধীরে ধীরে মানুষটা তার কাছে চলে এল।

‘আরে মানুষ যে তুই কোথাকার?’মিমি জবাব দিল না।

মানুষটা পুনরায় বলল,’আমি আরও গরু বলে ভেবেছিলাম।আমার একটা গাভী হারিয়ে গেছে।গরুটাকে খুঁজতে গিয়ে এখানে এসে পৌছেছি।তুই কোথাকার?’

‘বলে লাভ নেই।’মিমিমানুষটার দিকে না তাকিয়ে বলল।

‘তাহলে বলিস না।এখানে বসে আছিস কেন?’

‘যার কোনো আশ্রয় নেই তার এখানে বসে থাকার মধ্যে আশ্চর্‍্যের কী আছে?’

‘তোর ঘর নেই?’

‘নেই।’

‘কোথা থেকে এসেছিস?’

মিমি চুপ করে বসে আছে।

‘আচ্ছা পরে কথা বলব।চল আমাদের বাড়িতে।আমার পরিবার তোকে দেখলে খুব খুশি হবে।’

‘আজ তোর বাড়িতে আশ্রয় নিলাম।কাল আমার কী হবে?আবার এই গাছের নিচেই আশ্রয় নিতে হবে।ধন্যবাদ—তুই যা ’

কেন  তুই অন্য কোথাও আশ্রয় না পাওয়া পর্যন্ত আমার ঘরে থাকতে পারবি। আমার পরিবারের সহায়ক হবি চল।’

মিমি ভাবল— মানুষটার আন্তরিকতা আছে। গেলে খারাপ হবে না। রাত্রে কয়েকদিন থেকে সে একটা আশ্রয় বের করে নিতে পারবে। এখন কোনো কথা ভাবারসময় নেই। ইতিমধ্যে দত্তস্যার হয়তো এসে যাবে।

তিনি এসে গেলে তার আর কিছু চিন্তার থাকবে না।

— প্রায় এক বছর হল। দত্ত স্যার আসার কোনো খবর নেই। ছেলেটি জন্ম দেওয়ার আজ আট মাস হল। দত্ত স্যারের মুখের আকৃতি। উইভিং স্কুলের দু একটি মেয়ে দত্ত স্যারের ছেলে বলে এসে আদর করে যায়। কিন্তু দত্ত স্যার আসার আর কোনো আশা নেই। তাকে একটা চিঠি পর্যন্ত দেয়নি। উইভিং স্কুলের কর্তৃপক্ষকে সে দত্ত স্যারের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। আসবেনা বলে দিয়েছে। কেন আসবে না তার কারণ জানায়নি। তার জায়গায় অন্য একজন মাস্টার এসেছে। দত্ত স্যার এলে সে হাসতে হাসতে’ এই যে তোর ছেলে’ বলে ছেলেটিকে তার কোলে দিয়ে মাতৃত্বের গৌরব অনুভব করতে পারত। কিন্তু সব মিথ্যা।

— বাড়ির গৃহিণী, স্বামী এবং মিমিকে সন্দেহ করতে লাগল। সে স্বামী এবং মিমিরগতিবিধি লক্ষ্য করছে। মিমি ভাবে— সন্দেহ করার মতো কিছু নেই। মানুষটার আন্তরিকতা আছে বলেই গৃহিণীর এই সন্দেহ। মহিলাটি নিজে নিজে সন্দেহ বাড়িয়ে চলেছে। স্বামীর সঙ্গে মহিলা কথা বলা বন্ধ করেদিয়েছে।অহেতুকসন্দেহ করার জন্য স্বামী তাকে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু কোনো ফল হয়নি।স্ত্ৰীরওপরে তার রাগ হয়েছে। ঘরের পরিবেশ ধীরে ধীরেবিষময় হয়ে উঠল। আজ কয়েক দিন ধরে গৃহিণী মা-বাবার কাছে ফিরে যাবার চেষ্টা করছে। মিমি ভাবল‐–গৃহিণীকেচলেযেতেদিয়েসেএইঘরেথাকতেপারবেনা।তাকেআগেইবেরিয়েযেতেহবে।মিমিবড়োঅসহায় বোধ করল। এই পৃথিবীতে তার কোথাও আশ্রয় নেই। মানুষের ঈর্ষা পরায়ণতাপৃথিবীটিকেবিষময় করে চলেছে। পৃথিবীর বায়ু বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর মানুষ জীবন সমস্ত কিছুই মিথ্যা। এই অলীক পৃথিবীতে কম জলের মাছ হয়ে সে থাকবেনা।

কিন্তু তার বাচ্চা।তার  মৃত্যুর পরে তার অবস্থা কি হবে? শিয়াল শকুনের আহার হবে। ওহো সেই কথা সে ভাবতেও পারে না। সে আগে মরুক—- তারপরেমিমি মরবে। বাচ্চাটি কীভাবে মরবে? হঠাৎ তার মনে পড়ল—- সে পালিয়ে আসার আগে বাবার কাছ থেকে এক টুকরো বিষ চুরি করে বাক্সে রেখে দিয়েছিল— এখন  ও আছে। সেই বিষই তার সহায়ক হবে।

সে বাক্সটার দিকে এগিয়ে গেল।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত