| 7 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৮) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায়  চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


 

‘ স্যার দেখুন, স্যার দেখুন, এটা কি লিখেছে।’

ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে হুলস্থূল করে শ্রীমান সম্পাদকের রুমে  প্রবেশ করল।

হাতে তার সেদিনের প্রকাশিত একটি খবরের কাগজ।

এডিটর সাহেব সেগুন কাঠের প্যানেল দেওয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছোটো অফিসটাতে একা বসে সিগারেট টানতে টানতে অলসভাবে একটি ইংরেজি ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলেন। নিজের কাগজ বের হতে এখনও দেরি আছে। প্রথম ডামি সংখ্যাটা মাত্র প্রকাশ করার সময় হয়ে এসেছে। কাগজের মালিক এবার প্রেছের মেশিন না এলেও অন্য জায়গায় ছাপিয়ে হলেও কাগজ বের করতে চায়, আবার কখনও  প্রেসটা চালু করে তবে কাগজ বের করার কথা বলে। এই ধরনের এগোনো-পেছোনের মধ্যে তার আসলে করার কিছু নেই। ইংরেজি ম্যাগাজিনের পাতা না উল্টে সে আর কী করবে!

গুরু গম্ভীর ইংরেজি ম্যাগাজিন নয়, একটি জনপ্রিয় সিনেমা পত্রিকার পাতা তিনি উল্টে যাচ্ছিলেন।তাঁর নির্দেশ মতোই কয়েকটি বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিন  অফিসে রাখা শুরু করা হয়েছে। আগের অভিজ্ঞ সম্পাদক জানে যে এই ধরনের ম্যাগাজিন গুলি মাঝেমধ্যে ফোটো কাটার জন্য লাগে। বিভিন্ন চিত্র তারকার বা খেলোয়াড়ের ফটো কেটে নিজের প্রকাশনায় লাগাতে হয়। কাজটা সহজ। বড়ো সহজ। ইংরেজি ম্যাগাজিন গুলি তো অসমের বেশিরভাগ পাঠক পড়ার সুযোগই পায় না। কীভাবে সেই ম্যাগাজিন গুলিতে প্রকাশিত মুখরোচক খবরের সঙ্গে কিছু কল্পনা মিশিয়ে একটি মজার স্টোরি বানাতে পারা যায়, এই বিষয়ে তিনি ইতিমধ্যে কলাকৌশল শেখাতে আরম্ভ করেছেন। অনেকটা পরীক্ষায় নকল মারার মতো কাজ আর কি!

শ্রীমান হুলস্থুল করে ভেতরে চলে আসায় সম্পাদক অনিচ্ছা সত্ত্বেও ম্যাগাজিন-টা সরিয়ে শ্রীমানের দিকে তাকাল। শ্রীমানের অবস্থা দেখে তিনি প্রথমে চমকে উঠলেন।

‘ কী হল? কী হল?

‘স্যার ,এটা দেখুন তো?’

‘কী?কীহে?’ চোখ থেকে নামিয়ে নেওয়া চশমা জোড়া তিনি দ্রুত পুনরায় পরে নিলেন।

‘ এটা দেখুন স্যার, খবরটা দেখুন’‐- অপহৃতের মৃতদেহ উদ্ধার।

‘অ্যা,কী খবর? কোথায় উদ্ধার হল?’

‘ এই যে দেখুন স্যার, এই যে লিখেছে।’

‘ কী লিখেছে দেখি’‐ সম্পাদক খবরটা পড়তে শুরু করলেন।

শ্রীমান অস্থিরভাবে অপেক্ষা করতে লাগল। একটি পা থেকে অন্য একটিতে গায়ের ওজন এদিক ওদিক করে সে অধৈর্য ভাবে অপেক্ষা করল। তার গরম লাগল। সম্পাদকের রুমে মৃদুভাবে চলতে থাকা এয়ারকন্ডিশনারের মৃদু শব্দ এবং পাতলা বাতাস তার শরীরের উত্তাপ কমাতে পারল না।

একটা অপরিচিত শবদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। গুয়াহাটির পার্শ্ববর্তী একটি এলাকায় পুঁতে রাখা একটি শব  শিয়াল-কুকুর মাটি খুঁড়ে বের করায় মানুষের চোখে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সেখানে জমা হতে শুরু করে। একটু দূরেই পাথর কুয়ারিতে কাজ করতে থাকা মজদুররা এসে জমা হয়। কয়েক ঘন্টার পরে পুলিশ আসে।পুলিশ এসে শবটা মাটি খুঁড়ে বের করে। একটি যুবকের মৃতদেহ।


আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-৭) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


‘ একটি যুবককে মেরে পুঁতে রেখেছিল’‐- সম্পাদক মন্তব্য করল।

‘ হ্যাঁ স্যার’‐- শ্রীমান বলল।

‘ তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন বসো, বসো।’‐- সম্পাদক পুনরায় খবরটা পড়তে শুরু করল।

একজন যুবক ছেলেকে কেউ মেরে পুঁতে রেখেছে কে হবে কে হবে? প্রশ্নটা শ্রীমানের মস্তিষ্কের ভেতরে বিষাক্ত কীটের মতো বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল। সে সম্পাদকের সামনের চেয়ারে বসে চেয়ারের হাতল দুটো দুহাতে খামচে ধরল। হাতের ছোটো গিঁটগুলো তার ঠান্ডা হয়ে এল। একটা ছেলেকে মেরে পুঁতে রাখল‐- কতদিন আগে? খুব বেশিদিন নিশ্চয় হবে না। শুকনো মাটির মধ্যে ঢুকে থাকা শবটা পচতে শুরু করেছিল‐- কিন্তু পচে শেষ হয়ে যায়নি। পরনের কাপড় জোড়া, জিন্সের প্যান্টটা, সোয়েটারটা একই রকম ছিল। সাংবাদিকটি নিজ চোখে দেখার মতো ঘটনাটির একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছে। অথচ শবটা এনে পুলিশ মর্গে রাখার তিনদিন পর পর্যন্ত শবটা কার সনাক্ত হয়নি।

‘ তিন দিন পর্যন্ত কার শব কথাটা প্রকাশিত হয়নি’‐- সম্পাদক বললেন।

শ্রীমান মাথা নেড়ে সায় দিল।

‘ মাঝেমধ্যে আমি ভুলে যাই যে আমরা একটি এবনরমাল সময়ের মধ্যে বাস করছি’‐ তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কখন কে কাকে কোন আক্রোশে মেরে ফেলে কেউ বলতে পারে না।’

‘ হ্যাঁ, স্যার।’ 

‘ দেখ, এই কেসটার কথাই বলা যেতে পারে।’

‘স্যার!’

‘ এই ছেলেটির কথাই ধর।একটি ছোটো শহরে, মফসল শহরের একটি ভেনচার স্কুলে কাজ করত, টিউশন করত আর একটি খবরের কাগজের স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে মাঝেমধ্যে খবরা-খবর দিত। হঠাৎ একদিন শহর থেকে ছেলেটি নাই হয়ে গেল‐ নাই হয়ে গেল হে…’ সম্পাদক নাটকীয় ভঙ্গিমায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ছেলেটির হঠাৎ নাই হয়ে যাওয়া কথাটা এবং তার গুরুত্বটা তিনি যেন বেশি গভীরভাবে বোঝাতে চাইলেন।

‘ নাই হয়ে গেল। সে কোথায় গেল কেউ জানে না। কোনো সূত্র নেই। নেই মানে নেই।’ তিনি কথাটা আবার বললেন।

‘হ্যাঁ স্যার’।

‘ আর তার বাড়ির, সেই ছোটো শহরটি থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে, হঠাৎ গুয়াহাটি মহানগরের উপকণ্ঠে তার মৃতদেহ আবিষ্কার হল!হেঃ।কবে যে তাকে মেরেছে তার কোনো ঠিক নেই।’

‘ স্যার!’

‘ বল।’

‘ ওকে কেন মারল?’

‘ কীভাবে বলবে। কিন্তু এই কথাটা ঠিক যে সে নিশ্চয় এরকম কিছু কথা জানতে পেরেছিল যা প্রকাশিত হয়ে যাওয়াটা হয়তো কিছু মানুষ চায়নি। তা না হলে…।’ সম্পাদক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল।

‘ তা না হলে, কোনো বিশেষ কারণ নাও থাকতে পারে। হ্যাঁ, কোনো বিশেষ কারণ নাও থাকতে পারে। নিছক সন্দেহের বশে অথবা কারও কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতেও মেরে ফেলতে পারে। আজকাল এই ধরনের পরিস্থিতিতে সব সম্ভব বুঝেছ, সব সম্ভব।

     দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

     ‘কিন্তু স্যার ,আপনি একটা কথা লক্ষ্য করেন নি বোধহয়। ‘খবরটাতে এটা বড়ো করে লিখেছে। সেই ছেলেটিকে তার বাড়ির কাছে অ্যারেষ্ট করাটা বা ধরার কথাটা অনেক মানুষই দেখেছে। যদিও তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে ,অন্ধকার হতে শুরু করেছে ,সামনের সাইকেল মেরামতি করার দোকানটিতে দুই-তিনজন মানুষ ছিল। রাস্তার ওপারে থাকা ঘুমটিতাতেও মানুষ ছিল। প্রত্যেকেই দেখেছিল যে হঠাৎ দুটি মারুতি ভ্যান এসে পথ ধরে আসতে থাকা ছেলেটির কাছে দাঁড়িয়েছিল এবং গাড়ি দুটি থেকে কয়েকজন মানুষ নেমে এসে তাকে ধরে ,টেনে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।’এই সমস্ত কথাই খবরের কাগজটিতে লিখেছে ।

     সম্পাদক মাথা নাড়াল। ঠোঁট দুটি চেপে ধরে তিনি এভাবে মাথা নাড়লেন যেন তাঁর এই কথাগুলিতে খুব একটা বিশ্বাস হয় নি।

     ‘আর সবচেয়ে বড়ো কথা ’—শ্রীমান বলে গেল—‘তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া মানুষগুলি সাধারণ পোশাকে আসা পুলিশ-মিলিটারির মানুষ বলে লোকেরা সন্দেহ করছে। ধরন-ধারণ,চুল কাটার স্টাইল এসবেই বোঝা যায়। সঙ্গে আরও কয়েকজন মানুষ ছিল,সন্দেহজনক…’শ্রীমান কথাটা অর্ধ সমাপ্ত রাখল।

     ‘হুম’সম্পাদক গম্ভীর হয়ে বল্ল।তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রিলেন।তারপরে বেশ দার্শনিক সুরে মন্তব্য করলেন-‘তোমার অতীত এসে একসময়ে তোমাকে খামচে ধরবেই,রক্ষা নেই।অতীতের হাত থেকে রেহাই নেই।একটি প্রজন্মের একদল ছেলে আন্ডারগ্রাউণ্ড হ্ল।তার মধ্যে একদল থাকতে না পেরে ফিরে এল।আরম্ভ হল সন্দেহ,অবিশ্বাস এবং তারপরে কাটা-মারা।নিজেদের মধ্যে কাটা-মারা।আর এ রকম এক রেডিমেড পরিস্থিতি!এর সুবিধা পুলিশ বা ইন্টিলেজেন্স এজেন্সি কেন নেবে না?তুমি যদি পুলিশের মানুষ হও তুমি নেবে কি নেবে না?নেবে তো?হাঃ!নিয়েছে।প্রত্যেকেই সুবিধা নিয়েছে।নেবেই।তাই গুপ্তহত্যা হয়েছে।একপক্ষ অপরপক্ষকে ধরে এনে চুপিচুপি হত্যা করেছে।আন্ডারগ্রাউণ্ডে যদি আগের সতীর্থ কাউকে মেরেছে,ওরা গিয়ে আন্ডারগ্রাউণ্ডকে খুঁজে না পেয়ে পরিবারের মানুষকে মেরেছে। কী জঘন্য কারবার বলতো।অনেক আন্ডারগ্রাউণ্ড -যাদের বিষয়ে মানুষ জানে না,বিশেষ কোনো বড়ো লিডারও নয় ,দাদের ধরার পরে আজকাল বাঁচিয়ে রাখে না।মেরে ফেলে।বেঁচে থাকলে কোর্ট-কাচাড়ি করা অসুবিধা।মেরে ফেলে চুপি চুপি পুঁতে ফেললেই লেঠা শেষ…’

     সম্পাদকের কথাগুলি শুনে শ্রীমানের মনে এক বোঝাতে না পারা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল।তার মাথা ঘোরাতে লাগল।বমি বমি লাগছে নাকি তার?তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল।সে যে দেখেছিল -সেই বালির খাদানের মানুষটা! সে কী ছিল?আন্ডারগ্রাউন্ড -ইন্সারজেন্ট।খুব বড়ো লিডার নয়।ধরা পড়ল।ধরা হল।তারপরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল-টর্চার করা হল।আর তারপরে নির্জন বালির খাদানে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হল।মাথার পেছনদিকে।আর সে শ্রীমান সেটাই দেখতে পেল।

শ্রীমানের মাথাটা ভারী হয়ে পড়ল।

তার বুকটা পুনরায় ধপ ধপ করতে লাগল।কেন বলতে পারেনা সে, কিন্তু গত দুদিন কমে থাকা ভয়টা আবার বেশি হয়ে পড়ল। তার জিভটা শুকিয়ে এল। বুকের মধ্যে সে অনুভব করল এক দুর্বিষহ চাপ। তার চোখ দুটি বড়ো হয়ে পড়ল। তার সামনে বসে থাকা সম্পাদককে তার মনে হতে লাগল– এ যেন সেই বালির খাদানের মানুষটা। মুখ মেলে থাকা মানুষটা। হ্যাঁ, হ্যাঁ সেই মানুষটা।

তার মুখ দিয়ে যেন অস্ফুট একটা চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইল।

‘ কী হল তোমার’ সম্পাদক তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।’ কী হল? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’ সে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

বলবে নাকি? সে সম্পাদককে বলবে নাকি। কথাটা কাউকে বলতে পারলে তার মনটা বেশ হালকা হত।আঃবলবে নাকি? কথাটা বুকের মাঝখান থেকে একবার বের করে দিতে পারলে তার মনটা অনেকটা হালকা হয়ে যেত। সে সম্পাদকের মুখের দিকে তাকাল। মানুষটা তার দিকে উৎকণ্ঠাসহ তাকিয়ে রয়েছে।

‘ না। এমনিতেই হঠাৎ শরীরটা খারাপ লাগল’– শ্রীমান বলল।’ একটু ভাইরাল ফিবারের মতো হয়েছে।’ সে মিথ্যা কথা বলল। না, সে সম্পাদককে কথাটা বলতে পারবে না।

‘ তাই নাকি? যাও যাও, তুমি বাড়িতে যাও’– সম্পাদক ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সামনে যেন মূর্তিমান ভাইরাল ফিবারের বীজানু বসে আছে সেরকম একটা ভয়ের ভাব তার মুখে প্রকাশ পেল। চিৎকার করে তিনি চৌকিদারকে ডাকলেন। তিনি পিছিয়ে বসলেন। যেন শ্রীমান থেকে যতটা দূরে সরে থাকা যায় ততটাই রক্ষা। তিনি অফিসের গাড়ি করে তখনই শ্রীমানকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার নির্দেশ দিলেন। শ্রীমান কোনো কিছু বলার সুযোগ পেল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই থাকে বাড়িমুখী একটা গাড়িতে এসে বসতে হল। অফিস থেকে বেরিয়ে আসার সময় সে দেখতে পেল একটা মানুষ অফিসের দিকে তাকাতে তাকাতে স্কুটার চালিয়ে যাচ্ছে।

ইস। মানুষটাকে পরিচিত বলে মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ, সেই বালির খাদানের মানুষটা। পানবাজারের মর্গের সামনে সাক্ষাৎ করা মানুষটা। সে এখানে এসে কী করে বেড়াচ্ছে?…

ভয়ে শ্রীমানের গলা শুকিয়ে গেল, তার বুকটা ধপ ধপ করতে লাগল। বুকের ধপ ধপানিটা ক্রমশ গলার দুপাশ দিয়ে উঠে গিয়ে মাথায় ছড়িয়ে পড়ল।

নিশ্চয় অনুসরণ করছে। মানুষটা তাকে অনুসরণ করছে। হ্যাঁ মানুষটা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর খুঁজতে খুঁজতে সে হয়তো এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে।

মানুষটা দাঁড়িয়ে থাকা একটা  ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে আর কথা বলতে বলতে এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে। বালি বহন করার ট্রাকের সঙ্গে কথা বলাটা তার একটা ছল। সে শ্রীমানের খোঁজেই এসেছে। আর এই যে সে শ্রীমানকে দেখতে পেয়েছে। সে একটু হাসছে বলে মনে হচ্ছে। শ্রীমান উঠে আসা অফিসের মারুতি ভ্যানটা রাস্তার ভিড়ের জন্য গেটের মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে পারছে না। আর ঠিক সেই সময়ই মানুষটা এসে শ্রীমানকে দেখতে পেল। গন্ধ নিতে নিতে আসা শিকারি কুকুরের মতো এসে এসে তাকে খুঁজে বের করেছে। সে এখন জেনে গেল শ্রীমান কোথায় কাজ করে, কোথায় তাকে পাওয়া যায়– সমস্ত কথা জানতে পেরে গেল। আর সেই মানুষটাই বালির খাদানের শ্রীমান মৃতদেহটা দেখেছিল বলে জানে…

মারুতি ভ্যানের  ভেতরে শ্রীমান ঘামতে শুরু করল।

সে ঘামতে আরম্ভ করল। দেখব না বলে সে একবার পেছন ফিরে তাকাল।

মানুষটা দেখছি এবার ওদের অফিসে ঢুকে গেল মনে হচ্ছে। ওদের অফিসের ভেতর ঢুকেছে?

শ্রীমান মারুতি ভ্যানের পেছনের সিটে হেলান দিয়ে মাথাটা সিটের উপরে হেলিয়ে দিল।

‘ শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে স্যার?’ ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল।’ আমি ধীরে ধীরে চালাব, চিন্তা করবেন না। গ্লাসটা খুলে দিন। বাতাস লাগলে ভালো লাগবে’–- সে বলল।

‘ না, না লাগবে না। লাগবে না’– শ্রীমান হাহাকার করে উঠল।’ জানালা খুলতে হবে না। জানালা বন্ধ থাকুক।

‘ অনেকে অবশ্য বাতাসটা সহ্য করতে পারে না’– ড্রাইভার মন্তব্য করল। শ্রীমানের বমি বমি লাগতে লাগল। বমি হবে নাকি এখন? সে প্রাণপণে বমি আসার ভাবটা বন্ধ করতে চেষ্টা করল। একবার উদগার আসার মতো ওকলি হল। বমি হল না। একটু ভালো লাগল।

ড্রাইভার গাড়িটা সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার কাছে নিয়ে রেখে বলল–’স‍্যার?’

‘দাঁড়াবে না, দাঁড়াবে না,যেতে থাক।’– শ্রীমান বলল।

সে যেন অফিসের কাছ থেকে যত দূরে যেতে 

পারে ততই খুশি হয়।

       

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত