| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য প্রবন্ধ: রাজা রামমোহন রায় ও সতীদাহ প্রথা

আনুমানিক পঠনকাল: 28 মিনিট
 
 
 
                            
 
 
               Miss Collet says that it was in the year 1818 that Rammohun’s influence in the abolition of Suttee began to be definitely felt. He used to go dwon to the Calcutta burning-grounds and try to avert the suttee sacrifices by earnest – persuasion. Two of such cases have been recorded, one being in the Asiatic Journal for March, 1818. In these efforts he had, no wonder, often to incur the displeasure and insult of the relatives of the Suttee.
রামমোহন রায় যৌবনকালেই কোন স্ত্রীলোকের সহমরণ ব্যাপারে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা দেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যতদিন পর্যন্ত না এই অমানবিক প্রথা বন্ধ হয়, ততদিন তিনি এর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাবেন। কিন্তু নিজের পরিবারেই এরকম নির্মম এক ঘটনার পরোক্ষ সাক্ষী রয়ে যাবেন তিনি বুঝতে পারেননি । রামমোহনের সহোদর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জগন্মোহনের পত্নী সহমৃতা হয়েছিলেন। ১২১৬ সালে, ২৭শে চৈত্র, রবিবার শুক্লপক্ষীয় চতুর্থী তিথিতে অপরাহ্নে অর্থাৎ ইং ১৮১০ খ্রিস্টাব্দের ৮-ই এপ্রিল এই সহমরণ হয়েছিল। 
রামমোহন তখন রংপুরে। এই ঘটনায় সতীদাহ নিবারণ বিষয়ে রামমোহনের উৎসাহ দ্বিগুণ হয়েছিল। তিনি আরো দুঃখ পেয়েছিলেন তার নিজ মাতা এই সতীদাহের বিরুদ্ধাচারণ করেন নি। আসলে ধর্ম যেখানে সমাজকে গ্রাস করে সেখানে মানুষের বুদ্ধিও পঙ্গু হয়ে যায় । অনেক সুশিক্ষিত ব্যক্তিরাও এই প্রকার সংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন যে জীবিত অবস্থায় স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে এক চিতায় ভস্মীভূত হলে স্বর্গারোহন হয়। কিন্তু বাস্তব কথা দশহাজারের মধ্যে একজন স্ত্রী লোকও এইভাবে জীবন বিসর্জন করতে চাইতেন নাকি সন্দেহ আছে। 
জে প্রেগস নামক জনৈক ইংরেজ, ১৮২৮ সালের ৯ মার্চ ‘The Suttee’s Cry to Britain’ নামক একখানি পুস্তক প্রচার করেন। এই পুস্তকে বলপূর্ব্বক সতীদাহর অনেক করুণ কাহিনি বর্ণিত রয়েছে। এছাড়া ফ্যানি পার্কস্‌ নাম্নী জনৈক ইয়োরোপীয় মহিলা একটি বই লেখেন – Wanderings of a pilgrim in search of the picturesque during four and twenty years in the east with revelations of life in the Zenana.’এই বইটি ১৮৫৩ সালের কলিকাতা রিভিউয়ে সমালোচিত ও বিশেষরূপে প্রশংসিত হয়েছিল । এই বইটিতে বল্পুরবক সতীদাহের কয়েকটি ভয়ঙ্কর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে । 
জে পেগ্‌স্‌ সাহেব বলপূর্বক সতীদাহের বিষয়ে বলেছেন – “The use of force by means of bamboos, is, we believe universal through Bengal. It is intended to present the possibility of the widows escape from the flames, as such an act would be through to reflect indelible disgrace on the family.”
“In the burning of widows as practiced at present in some parts of Hindustan, however voluntary the widow may have been in her determination, force is employed in the act of emmolation. After she has circumambulated and ascended the pile, several natives leap on it, and pressing her down on the wood, bind her with two or three ropes to the corpse of her husband, and instantly throw over the two bodies, thus bound to each other, several large barn boos, which being firmly fixed to the ground on both sides of the pile prevent the possibility of her extricating herself when the flames reach her. Logs of wood are also thrown on the pile, which is then inflamed in an instant.”
অসহায় রমণীর হত্যালীলার আরো বর্ণনা পাওয়া যায় ফ্যানি পার্কসের গ্রন্থে – ১৮৩০ সালের ৭-ই নভেম্বর কানপুর নিবাসী এক ধনশালী বণিকের মৃত্যু হলে তার স্ত্রীকে সহমৃতার জন্য প্রস্তুত করা হয়। সতীদাহ দেখবার জন্য কানপুরের গঙ্গাতীরে উৎসুক জনতা ভীড় করে দাঁড়াল। সতী উপযুক্ত অলঙ্কার বস্ত্র পরিধান করে নিজের হাতে চিতায় আগুন দিলেন। সাহস ও উৎসাহের সঙ্গে স্বামীর মাথা কোলের উপর নিয়ে চিতায় বসলেন। কিন্তু ক্রমে যখন অগ্নিশিখার বিস্তার সতীর জীবন্ত দেহ স্পর্শ করল, তখন যন্ত্রণা সহ্য করতে না পের সতী গঙ্গা বক্ষে ঝাঁপ দিল। যাতে সতীর প্রতি কোনপ্রকার বলপ্রয়োগ না হয় সেই জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। খোলা তলোয়ার হাতে চিতার সন্নিকটে সিপাহী মোতায়েন করা হয়েছিল কিন্তু সতী যখন চিতা হতে পালাবার চেষ্টা করল সিপাহীরা আপন প্রভুর আজ্ঞা ভুলে সতীকে বাধ্য করে পুনর্বার চিতায় প্রবেশ করতে। কিন্তু সতী পুনর্বার চিতায় প্রবেশ করেও সেই অগ্নিশিখায় নিজেকে সঁপে দিতে পারল না – যন্ত্রণায় কাতর হয়ে গঙ্গার জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পূর্বেই সিপাহীর প্রতি বিরক্ত হয়ে তাকে কয়েকবার সতর্ক করেছিলেন। এবার মৃত ব্যক্তির ভ্রাতা, আত্মীয়স্বজন সকলে চিৎকার করতে লাগল বলপূর্বক সতীকে চিতায় এনে দগ্ধ করা হোক। হয়ত এটাই হত। সতীও তাদের কথায় বাধ্য হয়ে পুনরায় চিতায় আসতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সতীকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যান। ফ্যানি পার্কস্‌ কলিকাতার সন্নিহিত স্থান সকলের এই প্রকার সতীদাহের বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন।এ তো শুধু একটিমাত্র বর্ণনা । কত হাজার হাজার সতী ধর্মের নামে খুন হয়েছে তার সঠিক হিসাব কি ইতিহাসে নথিবদ্ধ রয়েছে!  
এই সকল বর্ণনা থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে সহমরণ প্রথা এককথায় রমণীগণকে কুসংস্কার বশত মন্দিরে বলিদান দেওয়া হত। সতীদাহ প্রথার অন্তরে প্রবেশ করলে দেখা যায় সতীরা শোকে অধীর হয়ে প্রথমে স্বামীর সঙ্গে সহমৃত হওয়ার জন্য আকুল হত এবং এমত অবস্থায় সংকল্প করত কিন্তু একবার সংকল্প করলে আর ফেরার উপায় থাকত না। যদি ফিরত পরিবারের দুরপনেয় কলঙ্ক; সুতরাং সংকল্পের পর মত পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখলে অথবা মত পরিবর্তন হলে বিলক্ষণ রূপেই তার স্বাধীনতার উপর বলপ্রয়োগপূর্বক হস্তক্ষেপ করা হত।
বলপ্রয়োগ বিষয়ে রাজা রামমোহন রায় তাঁর যে সকল পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন তার মধ্যে সহমরণ বিষয়ে দুইখানি পুস্তক নিবর্ত্তক ও প্রবর্ত্তক এই দুই ব্যক্তির মধ্যে কথোপকথনচ্ছলে লিখিত। তার থেকে উদ্ধৃত করা হল – 
বলপ্রয়োগ বিষয়ে রামমোহন রায়ের উক্তি – “নিবর্ত্তক, তুমি এখন যাহা করিতেছ, সে অতি অন্যায্য। ঐ সকল বাধিত বচনের দ্বরা এরূপ আত্মঘাত প্রবর্ত্তন করান সর্ব্বথা অযোগ্য হয়। দ্বিতীয়তঃ ঐ সকল বচনেতে এবং ঐ বচনানুসারে তোমাদের রচিত সঙ্কল্প বাক্যেতে স্পষ্ট বুঝাইতেছে যে পতির জ্বলন্ত চিতাতে স্বেচ্ছাপূর্বক আরোহন করিয়া প্রাণত্যাগ করিবেক। কিন্তু তাহার বিপরীত মতে তোমরা অগ্রে ঐ বিধবাকে পতিদেহের সহিত দৃঢ়বন্ধন কর, পরে তাহার উপর এত কাষ্ঠ দাও, যাহাতে ঐ বিধবা আর উঠিতে না পারে। তাহার পর অগ্নি দেওন কালে দুই বৃহৎ বাঁশ দিয়া ছুপিয়া রাখ। এ সকল বন্ধনাদি কর্ম কোন হারীতাদির বচনে আছে, তদানুসারে করিয়া থাকহ, অতএব কেবল জ্ঞানপূর্ব্বক স্ত্রীহত্যা হয়।”
“অন্য অন্য বিষয়ে তোমাদের দয়ার বাহুল্য আছে, এ যথার্থ বটে; কিন্তু বালক-কাল অবধি আপন প্রাচীন লোকের এবং প্রতিবাসীর ও অন্য অন্য গ্রামস্থ লোকের দ্বারা জ্ঞানপূর্ব্বক স্ত্রীদাহ পুনঃপুনঃ দেখিবাতে এবং দাহকালীন স্ত্রীলোকের কাতরতায় নিষ্ঠুর থাকাতে তোমাদের বিরুদ্ধসংস্কার জন্মে; এই নিমিত্ত, কি স্ত্রী কি পুরুষের মরণকালীন কাতরতা তোমাদের দয়া জন্মে না। যেমন শাক্তচারে বাল্যবধি ছাগমহিষাদি হনন পুনঃপুনঃ দেখিবার দ্বারা ছাগ মহিষাদির বধকালীন কাতরতাতে দয়া জন্মে না, কিন্তু বৈষ্ণবদের অত্যন্ত দয়া হয়।”
রামমোহন রায় কলকাতায় এসে সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে ইংরেজি ও বাঙ্গালা ভাষায় কথোপকথনচ্ছলে গ্রন্থ রচনা করে নিজ খরচে মুদ্রিত করে দেশের সর্বত্র বিনা মূল্যে বিতরণ করেন। রামমোহন রায় সহমরণ বিষয়ে ক্রমে ক্রমে তিনটি পুস্তক প্রচার করেন। প্রথম পুস্তকের নাম প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের প্রথম সংবাদ। দ্বিতীয় পুস্তকের নাম প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সংবাদ। ‘বিপ্রনাম এবং মুগ্ধ-বোধচ্ছাত্র নামধারী দুই ব্যক্তির পত্রের উত্তরে তিনি তৃতীয় পুস্তক লিখেছিলেন। প্রথম পুস্তক ১৭৪০ শকে, ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ হয়। ওই বছরই ৩০শে নভেম্বর, ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। দ্বিতীয় পুস্তক ১৭৪১ শকে (১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে) প্রকাশিত হয়। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে তার ইংরেজি অনুবাদ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। 
রামমোহন রায় এই দ্বিতীয় বইটিরই ইংরেজি অনুবাদ, মারকুইস্‌ অব হেস্টিংসের সহধর্মিনীর নামে উৎসর্গ করেছিলেন। গভর্নমেন্ট এবং সাধারণতঃ রাজকর্মচারীদের মতপরিবর্ত্তনের জন্য রামমোহন রায় তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় পুস্তকেরই ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় পুস্তক মুদ্রিত হয়েছিল। এই পুস্তকত্রয়ের সারমর্ম এই যে, সমস্ত শাস্ত্রেই কাম্যকর্ম নিন্দিত হয়েছে। সহমরণ কাম্যকর্ম, সুতরাং শাস্ত্রের প্রকৃত তাৎপর্য অনুসারে তা অকর্তব্য। তিনি বহুল শাস্ত্রীয় প্রমাণ সহকারে প্রতিপন্ন করেছিলেন যে সহমরণ অপেক্ষা ব্রহ্মাচর্য্য শ্রেষ্ঠ। এতদ্ভিন্ন সতীদাহ বিষয়ে সমুদয় যুক্তির সারমর্ম লিখে ইংরেজি ভাষায় আর একখানি পুস্তক প্রকাশ করেন।
রাজা রামমোহন রায়ের পূর্বে গভর্নমেন্ট সতীদাহ নিবারণের চেষ্টা করেছিলেন – লর্ড ওয়েলেসলী-র শাসনকালের শেষভাগে প্রথম সতীদাহ নিবারণ চেষ্টা হয়েছিল। ১৮০৫ খ্রিস্টব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর আদেশানুসারে ডাওডেসওয়েল সাহেব নিজামত আদালতের রেজিস্ট্রার গুড সাহেবকে যে পত্র লিখেছিলেন, তার সারমর্ম এই – 
“নিজামত আদালতের রেজিস্ট্রার শ্রীযুক্ত গুডসাহেব মহাশয় সমীপেষু। 
মন্ত্রীসভাধিষ্ঠিত মাননীয় গভর্নর জেনারেল কর্ত্তৃক আদিষ্ট হয়ে আমি আপনাকে অবগত করছি যে, বেহারের প্রতিনিধি ম্যাজিস্ট্রেটের প্রেরিত পত্রের যে প্রতিলিপি আপনার নিকট পাঠাইলাম, তাহা আপনি নিজামত আদালতের বিচারপতির নিকট উপস্থিত করিবেন। দেখিতে পাইবেন যে, উক্ত পত্রে লিখিত হইয়াছে যে, কোন স্ত্রীলোক স্বীয় স্বামীর মৃত-দেহের সহিত নিজদেহ ভস্মীভূত করিতে চেষ্টা করিলে, উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট তাঁহাকে ঐ কার্য্য হইতে নিবৃত্ত করিয়াছেন। নিজামত আদালত গত আছেন যে, এদেশীয় লোকের ধর্ম্মমত আচার ব্যবহার এবং সংস্কার সকল জ্ঞাত হইয়া, নীতি, সুবিবেচনা ও দয়া ধর্ম্মের সহিত যতদূর সম্ভব, ততদূর পর্য্যন্ত তাঁহাদের সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা ব্রিটিশ গবর্নমেণ্টের একটি প্রধান নিয়ম। বেহারের প্রতিনিধি ম্যাজিস্ট্রেট, এই স্ত্রীলোক সম্বন্ধে যে সমুদয় ঘটনা লিখিয়াছিলেন – ইহার কিশোর বয়স, নেসার অবস্থা – তাহার স্বামীর শবদাহের সময়ে তাহার এই প্রকার অবস্থা বিশেষভাবে পর্যালোচনা করিয়া মন্ত্রীসভাধিষ্ঠিত গবর্ণরজেনারেল ইহা নির্ণয় করা একান্ত কর্ত্তব্য বলিয়া বিবেচনা করিতেছেন যে, এই অস্বাভাবিক ও নৃশংস দেশাচার সম্পূর্ণরূপে রহিত করা যাইতে পারে কি না? অথবা উপরে যে নিয়মের কথা বলা হইয়াছে, তদানুসারে যদি এই প্রার্থনীয় উদ্দেশ্য কার্য্যে পরিনত হওয়া অসম্ভব হয়, তাহা হইলে এমন উপায় সকল অবলম্বন করা যাইতে পারে কিনা, যদ্দ্বারা ভবিষ্যতে সহগমনে প্রবৃত্ত নারীদিগকে তাহাদের আত্মীয়ের অন্যায় উপায়ে উত্তেজিত করিতে না পারে। যেমন, বেহারের ম্যাজিস্ট্রেট লিখিয়াছেন যে, ঐ স্ত্রীলোকের আত্মীয়েরা উহার নেসা করাইয়া উহার বুদ্ধিভ্রংশ করিয়া দিয়াছিল। এরুপ গর্হিত কার্য্য যাহাতে সম্পূর্ণরূপে নিবারিত হয়, তদ্বিষয়ে আমাদিগকে দৃষ্টি রাখিতে হইবে।
নিজামত আদালতকে অনুরোধ করা যাইতেছে যে, আদালত যেন প্রথমে পণ্ডিতগণকে জিজ্ঞাসা করিয়া নির্ণয় করিতে চেষ্টা করেন যে, এই প্রথা হিন্দুধর্ম্মানুমোদিত কি না? যদি এই প্রথা হিন্দু ধর্ম্মের অনুমোদিত না হয়, তাহা  হইলে গবর্ণর জেনেরল আশা করিতে পারে যে, এক্ষণে না হইলেও, সহমরণ প্রথয়া সময়ে রহিত হইতে পারিবে। নিজামত আদালত যদি এরুপ বিবেচনা করেন যে, উক্ত প্রথা হিন্দুধর্ম্মানুমোদিত বলিয়া উহা রহিত করা সম্ভব নহে, তাহা হইলে গবর্ণজেনেরল সাহেব নিজামত আদালতকে অনুরোধ করেন যে, যাহাতে উপরিউক্ত নিন্দনীয় কার্য্য সমুদয় রহিত হয়, এরূপ সদুপায় অবলম্বন করা হয়। যে কোন প্রকারে হউক, যাহাতে সহমরনোদ্যতা স্ত্রীলোকগণকে মাদকদ্রব্য ও ঔষধ সেবন করান না হয়, এরুপ করা আবশ্যক। অল্প বয়স বা অন্য কোন কারণে হিতাহিত নির্দ্ধারণে অক্ষমা স্ত্রীলোকগণকে মৃত্যুগ্রাস হইতে রক্ষা করিবার উপায় অবলম্বন করা উচিৎ।
খ্রিস্টাব্দ ১৮০৫    ভবদীয় ইত্যাদি
৫ই ফেব্রুয়ারি    ডাওডেস্‌ওয়েল
বিচার বিভাগের অধ্যক্ষ”
১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ৪ঠা মার্চ্চ দিবসে, নিজামত আদালতে পণ্ডিতগণের নিকটে, কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য একখানি পত্রপ্রেরণ করা হয়। প্রশ্নগুলি হল – 
“হিন্দুদের মধ্যে সময়ে সময়ে এইরুপ ঘটনা সংঘটিত হইতে দেখা যায় যে কোন লোকের মৃত্যু হলে তার স্ত্রী মৃতস্বামীর চিতায় স্বামীর সঙ্গে অগ্নিতে ভস্মীভূত হয়ে থাকেন, সেজন্য আপনাদের জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে যে, ঐরুপ কার্য্যে শাস্ত্রের কিরুপ বিধি আছে? মৃত স্বামীর অনুগমন করা শাস্ত্রসম্মত কি শাস্ত্রবিরুদ্ধ? শাস্ত্রে সহগমনের ব্যবস্থাই বা কি কি? আপনাদের পঞ্চাশ দিবসের মধ্যে এর উত্তর দিতে হবে।
নিজামতের পণ্ডিম ঘনশ্যাম যা উত্তর দিয়েছিলেন তার সারমর্ম এই প্রকার – 
“নিজামত আদালত কর্তৃক প্রেরিত প্রশ্ন বিশেষরুপ আলোচনা করিয়া আমি যথাজ্ঞান তাহার উত্তর দিতেছি।
“যাঁহারা প্রত্যানুগমের জন্য প্রস্তুত হন, তাঁহাদের অত্যন্ত শিশু সন্তান থাকিলে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থা হইলে, ঋতুকাল হইলে, কিম্বা নাবালিকা অবস্থা হইলে তাহার সহমৃতা হইবার যোগ্য নহেন; উপরি উক্ত প্রতিবন্ধকগুলি না থাকিলে, সহমৃতা হইতে কোন নিষেধ নাই। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চাতুর্ব্বর্ণ্যের প্রতিই এই নিয়ম। যে স্ত্রীলোকের শিশু পুত্র বা কন্যা থাকে, তিনি ঐ শিশুর প্রতিপালনের জন্য কোন স্ত্রীলোককে আপনার প্রতিনিধিস্বরুপ রাখিয়া যাইতে পারেন, তাহা হইলে তাঁহার সহমৃতা হইতে কোন নিষেধ নাই। কোন উৎকট ঔষধ বা মাদকদ্রব্য সেবন করাইয়া কোন স্ত্রীলোককে সহমরণে উত্তেজিত করা অশাস্ত্রীয় ও লোকাচারবিরুদ্ধ। এরুপ অজ্ঞান বা উন্মত্ত করাও অবৈধ। সহমরণের পূর্ব্বে স্ত্রীলোকদিগকে সঙ্কল্প করিতে হয়, এবং অন্যান্য কোন কোন বিধির অনুষ্ঠান করিতে হয়। অঙ্গিরা, ব্যাস, বৃহস্পতি প্রভৃতি মহামুনিগণ ইহার প্রবর্ত্তক। 
“মানবদেহে ‘সার্দ্ধত্রিকোটী লোম আছে। যাহারা সহমৃতা হন, তাঁহারা তৎসংখ্যক বৎসর অর্থাৎ সাড়েতিন কোটি বৎসর স্বামীর সহিত স্বর্গে বাস করেন। ‘যেমন সর্প-ব্যবসায়ীরা গর্ত্ত হইতে সর্পকে টানিয়া বাহির করে সেইরুপ স্ত্রীলোক নরক হইতে নিজ নিজ স্বামীকে উদ্ধার করিতে সক্ষম হইয়া থাকেন। পরিশেষে স্বামীদিগের সহিত স্বর্গলোকে বিচরণ করেন। শিশুসন্তানবতী, গর্ভবতী, ঋতুমতী ও অপ্রাপ্তবয়স্কা স্ত্রীলোকদের পূর্ব্বে যে নিষেধের কথা বলা হইয়াছিল, তাহা সগর রাজার জননীকে ঔর্ব্ব ও অন্যান্য ঋষিরা বলেছিলেন। 
শ্রী ঘনশ্যাম শর্ম্মা” 
ঘনশ্যাম শর্ম্মা নিজামত আদালতের বেতনভোগী পণ্ডিত ছিলেন। তার পত্র পেয়ে নিজামত আদালত আরো কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন – 
যদি কোন স্ত্রীলোক সহমৃতা হতে উদ্যত হয়ে পুনর্ব্বার অস্বীকার করেন এবং কার্য হতে নিবৃত্ত হন তাহলে তার পরিনাম কী হবে? তার আত্মীয়েরা তার প্রতি কিরুপ ব্যবহার করবেন?
ঘনশ্যাম শর্ম্মা এই প্রশ্নের যা উত্তর দিয়েছেন তার সারমর্ম হল –  
“যদি কোন স্ত্রীলোক সহমৃতা হইবার জন্য, সঙ্কল্প ও অন্য সকল ক্রিয়া না করিয়া থাকেন তাহা হইলে, শাস্ত্রানুসারে তাঁহাকে কোন প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে না। এ অবস্থায় তাহার আত্মীয়েরা তাহাকে গ্রহণ করিতে পারেন। শাস্ত্রে তাহার কোন বিধি কিম্বা নিষেধ নাই। কিন্তু যদি কোন স্ত্রীলোক সংকল্প বাক্য উচ্চারণ করিয়া সহমরণ হইতে নিবৃত্ত হন, তাহা হইলে তাহাকে কঠোর প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। প্রায়শ্চিত্তের পর, তাহার জাতি-কুটুম্বেরা তাহাকে সমাজে গ্রহণ করিতে পারেন।
“শাস্ত্রে আছে যে, যে স্ত্রীলোক সাংসারিক মায়াবশতঃ সহমরণ হইতে বিরত হন, তিনি কঠোর প্রায়শ্চিত্ত ব্যতীত পাপমুক্ত হইতে পারেন না।
শ্রী ঘনশ্যাম শর্ম্মা”
কিন্তু সহমরন সম্বন্ধে কোন কার্য্যালয়ের আদেশ না থাকায় অসহায় অনাথা নারীর জীবন্ত দেহ ধর্মের নামে ভস্মীভূত হতে থাকে। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ৩-রা আগষ্ট নিজামত আদালতের রেজিস্ট্রার শ্রীযুক্ত টর্নবুল সাহেবকে পত্র লেখেন তার সারমর্ম এই – 
“শ্রীযুক্ত টর্নবুল সাহেব নিজামত আদালতের রেজিস্ট্রার মহাশয় সমীপেষু।
মহাশয়
সম্প্রতি এক সতীদাহ হইয়া গিয়াছে। তাহাকে নিবারণ করিবার চেষ্টা করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারা যায়নি।
সহমরণ সম্বন্ধে এখানকার কার্য্যলয়ে কোন আদেশ না থাকায় আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি উক্ত বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেট কিছু করিতে পারেন কিনা? এবং কি উপায়ে সহমরন হইতে হিন্দুস্ত্রীলোকগণকে নিরস্ত করা যাইতে পারে?”
সে বছরই ৩রা সেপ্টেম্বরে নিজামত আদালত গবর্ণর জেনারেলকে সতীদাহ সম্বন্ধে কোন কোন বিষয় জ্ঞাত করেন। গবর্ণর জেনারেল সতীদাহ সম্বন্ধে নিম্নলিখিত কয়েকটি নিয়ম বিধিবদ্ধ করেন – 
১ম – ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য জাতির স্ত্রীলোকদের যাতে তাদের আত্মীয়রা সহমৃতা হওয়ার প্রবৃত্তি দিতে, বা উক্ত বিষয়ে তাদের প্রতি বলপ্রয়োগ করতে না পারেন, সেই বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। 
২য়, কোনরুপ মাদকদ্রব্য সেবন করাতে দেওয়া যাবে না। 
৩য়, হিন্দু শাস্ত্রনুসারে যে বয়সে স্ত্রীলোকের সহমৃতা হবার অধিকার আছে, সেই বয়স নির্ণয় করবার জন্য যথাযথ চেষ্টা করতে হবে।
৪র্থ, উপরিউক্ত সকল কারণ থাকলে হিন্দুশাস্ত্রনুসারে সতীদাহ অসিদ্ধ। ঐসব জায়গায় সতীদাহ নিবারণ করিতে হবে।
১৮১২ খ্রিস্টাব্দে, ৫ই ডিসেম্বরে নিজামত আদালতের প্রতিনিধি রেজিস্ট্রার বেলি সাহেব গবর্ণমেন্টের সেক্রেটারী ডাওডেসওয়েল সাহেবকে এক পত্র লেখেন – যার সারমর্ম – 
“শ্রীযুক্ত জর্জ ডাওডেস্‌ওয়েল্‌ সাহেব সরকারী বিচার বিভাগের সম্পাদক
মহাশয় সমীপেষু।
হিন্দুধর্ম্মানুমোদিত কয়েকটি আচার ব্যবহার বহুকাল প্রচলিত থাকিয়া আপনা আপনি ক্রমে লোপ পাইয়াছে, কিম্বা হিন্দু রাজাদিগের উদ্যোগে রচিত হইয়াছে। সতীদাহপ্রথা হিন্দুধর্ম্মসম্মত হইলেও, হিন্দু জতির ধর্মের উপর গুরুতর আঘাত না করিয়া উহা শীঘ্র উঠাইয়া দেওয়া যাইতে পারে কিনা, নিজামত আদালত ইহার মূল অনুসন্ধান করা আবশ্যক মনে করিয়াছিলেন। অত্যন্ত সাবধানতার সহিত অনুসন্ধানের পর উক্ত আদালতের কর্তৃপক্ষীয়গন জ্ঞাত হইয়াছেন যে, এই প্রথার প্রতি লোকের অনুরাগ, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস এত অধিক যে, এ প্রদেশীয় সকল বর্ণের হিন্দুগণ ইহা প্রচলিত রাখিবার জন্য বিসেষ যত্নবান্‌। অন্যান্য প্রদেশ, বিশেষতঃ ত্রিহুতে, ধর্ম্মজ্ঞান উন্নত থাকাতে সতীদাহপ্রথা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়াছে। কোন কোন জিলায় এই প্রথা ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের মধ্যে প্রবল, অন্যান্য জাতির মধ্যে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না।
১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে    বেলি।
৫ই ডিসেম্বর       নিজামত আদালতের প্রতিনিধি রেজিস্ট্রার”
১৮১৫ থেকে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, মার্কুইস অব হেস্টিংসের শাসনকাল। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে, ৪ঠা জানুয়ারি সার্কুলার আদেশানুসারে সতীদাহের একটি তালিকা সংগৃহীত হয়। তা থেকে বোঝা যায় কোন কোন বিভাগে কত স্ত্রীলোক সহমৃতা হয়েছিল। কিন্তু সেই তালিকা সাধারণের নিকটে প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ইংলণ্ডীয় কতকগুলি হিতৈষী ব্যক্তির চেষ্টায় তা প্রকাশিত হয়। পার্লামেণ্ট মহাসভায় এবং ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টরদের সভায় তাঁরা বিশেষ আন্দোলন করেন। তাঁদের চেষ্টাতেই ভারতবর্ষীয় গবর্ণমেন্ট প্রকাশ করতে বাধ্য হন। এর ফলে ইংলণ্ডীয় প্রজাবর্গ সতীদাহের বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত হন এবং ইনল্যণ্ডীয় জনসাধারণ সতীদাহ নিবারণের আবশ্যকতা অনুভব করেন। এতে সতীদাহের নিবারণের পথ পরিষ্কার হয়।
Life and letters of Raja Rammohun Roy by Sophia Dobson Collet-এর বইটি থেকে সতীদাহ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট পাওয়া যায় – 
“The annual returns of the number of Suttees, with the comments of the Judges and the Governor in Council, kept the fires of public indignation well stoked. Each annual increase horrified each decrease encouraged, the upright-minded into projects of reform. We append  a table of totals upto the end of the period covered by the chapter.
Suttees in the Bengal Presidency
Division 1819AD 1820AD 1821AD 1822AD 1823AD 1824AD 1825AD 1826AD
Calcutta 421 370 392 328 340 373 398 324
Dacca 55 51 52 45 40 40 101 65
Moorshedabad 25 21 12 22 13 14 21 8
Patna 40 42 69 70 49 +59 +47 +65
Benares 92 93 114 102 121 +76 +55 48
Borailly 17 20 15 16 12 10 17 8
Total 650 597 654 583 575 572 639 518
…”
যেখানে একটি জাতির ধর্মীয় কুসংস্কার সামগ্রিকভাবে মানুষের মানবিকতাকে গ্রাস করে নেয়, সেখানে সেই জাতিকে উদ্ধার করা সহজ কথা নয়। ব্রহ্মসভার সঙ্গে ধর্মসভার বিবাদের প্রধান কারণই ছিল সতীদাহ। রাজা রামমোহন রায় যেভাবে এই প্রথার বিরুদ্ধে এগিয়ে এসেছিলেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীন লোকেদের ক্রোধের পরিমাণ দ্বিগুণ বেড়ে গেল।  রামমোহন রায়ের গ্রন্থের প্রতিবাদস্বরূপ উত্তর প্রকাশ হল। তিনি প্রতিপন্ন করলেন যে হিন্দুশাস্ত্রানুসারে, প্রত্যনুগমন কাম্যকর্ম বলে নিন্দনীয়। তাঁর বিপক্ষগণ বিচারে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত ও নিরুত্তর হলেন।
রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ বিষয়ক শাস্ত্রীয় বিচারে তিনটি বিষয় প্রতিপন্ন করেন। প্রথমতঃ শাস্ত্রানুসারে পত্যন্দুগমন অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পরিগণিত নয়। উক্ত বিষয়ে শাস্ত্রের কোন আদেশ নাই, অর্থাৎ সহমৃতা না হলে সে  প্রত্যবায় হয়, এমন নয়। দ্বিতীয়তঃ সমস্ত শাস্ত্রেই কাম্যকর্ম নিন্দিত হয়েছে। সহমরণ কাম্যকর্ম, শাস্ত্রের প্রকৃত তাৎপর্য্য অনুসারে সহমরণ অপেক্ষা ব্রহ্মচর্য্য শ্রেষ্ঠধর্ম। সুতরাং সহমৃতা না হয়ে ব্রহ্মচর্য অবলম্বনই বিধবার পক্ষে শ্রেয়স্কর। তৃতীয়তঃ শাস্ত্রের বিধান অনুসারে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সহমৃতা হওয়া আবশ্যক। স্বাধীনভাবে সংকল্প করবে, স্বাধীনভাবে চিতারোহন করবে এবং স্বাধীনভাবে জ্বলন্ত অনলে আপনার জীবন্ত দেহকে ভস্মীভূত হতে দেবে। কিন্তু তা হয় না। পত্যনুগামিনী নারীর প্রতি বলপ্রয়োগ করা হয়ে থাকে। একপ্রকারে জ্ঞানপূর্বক নারীহত্যা করা হয়। সুতরাং এই প্রথা উঠিয়ে দেওয়াই কর্তব্য।
সকাম ও নিষ্কাম দুপ্রকার শ্রূতি আছে। নিষ্কাম শ্রূতি অপেক্ষা সকাম শ্রূতি দুর্বল। নিষ্কাম শ্রূতি অনুসারে কার্য্য করাই কর্তব্য। সকাম ও নিষ্কাম কর্ম কাকে বলে, রামমোহন রায় মনুর বচন অনুসারে প্রদর্শন করেছেন: – 
“ইহ বা মুএ বা কাম্যং প্রবৃত্তং কর্ম কীর্ত্ত্যতে।
নিষ্কামং জ্ঞানপূর্ব্বন্তু  নিবৃত্তমুপ দিশ্যতে।।
প্রবৃত্তং কর্ম সংসেব্য দেবানামেতি সর্ষ্ণিতাং।
নিবৃত্তং সেবামানস্তু ভূঅন্যতেতি পঞ্চ বৈ।।”
কি ইহলোকে কি পরলোকে, বাঞ্ছিত ফল পাব, এই কামনাতে যে কর্মের অনুষ্ঠান করা হয়, তার নাম প্রবৃত্তকর্ম; অর্থাৎ স্বর্গাদিভোগের পর, জন্ম-মরণ রূপ সংসারে তা প্রবর্তক হয়। আর কামনা পরিত্যাগ করে ব্রহ্মজ্ঞানের অভ্যাসপূর্বক যে নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম করা হয়, তাকে নিবৃত্তিকর্ম বলে। যে ব্যক্তি প্রবৃত্ত কর্ম করে সে দেবতাদের সমান হয়ে স্বর্গাদিভোগ করে আর যে ব্যক্তি নিবৃত্ত কর্মর অনুষ্ঠান করে শরীরের কারণ যে পঞ্চভূত তার অতীত হয়ে যায় অর্থাৎ মুক্তি পায়। সতীদাহের আনুষঙ্গিক অত্যাচার বন্ধ করার জন্য নিজামত আদালত যেসকল নিয়ম প্রচার করেন, তা বন্ধ করার জন্য গোঁড়া হিন্দুরা গভর্ণর জেনারলে হেস্টিংসের কাছে একটি আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। উক্ত আবেদন পত্রের বিরুদ্ধে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে গভর্ণর জেনারলের কাছে আরে একটি আবেদন পত্র উপস্থিত হয়। এই দ্বিতীয় আবেদন পত্রটি রাজা রামমোহনের উদ্যোগে প্রেরিত হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ‘এশিয়াটিক জার্নাল’ পত্রে এটি প্রকাশিত হয়। আবেদন পত্রটিকে কলকাতা নিবাসী বহু ভদ্রলোকের স্বাক্ষর ছিল। গোঁড়া হিন্দুদের আবেদনপত্রটি যে কলকাতার প্রধান প্রধান ব্যক্তি দ্বারা প্রেরিত হয়েছিল, তা দ্বিতীয় আবেদনপত্রে অস্বীকার করা হয়।  সতীদাহের আনুষঙ্গিক অত্যাচার নিবারণের জন্য গভর্ণমেন্ট যে সকল আদেশ প্রচার করেছিলেন, এই দ্বিতীয় আবেদনপত্রে সেই সকল ন্যায্য ও একান্ত আবশ্যক বলে প্রতিপন্ন করা হয়।
১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের আবেদনপত্রে, আবেদনকারীগণ বলেছেন যে, তারা নিজে জানেন এবং অনেক স্থলে প্রত্যক্ষদর্শী লোকের কাছে শ্রবণ করেছেন যে কোনো নারীর পতিবিয়োগ হলে, তার পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ চেষ্টা করেন, যাতে সেই বিধবা নারী সহমৃতা হন, বিত্তলোভেই এই হত্যার একমাত্র অভিসন্ধি। এমন অনেক ঘটনা থাকে যে, কোন নারী পতিবিয়োগে কাতর হয়ে সহমৃতা হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, কিন্তু সংকল্পের পর ভয়ে অস্বীকার করেন। কিন্তু তাঁর আত্মীয়েরা তাঁকে বলপূর্বক চিতাতে রশি দ্বারা বন্ধন করেন। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত দেহ ভস্মীভূত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত দৃঢ়রূপে চেপে ধরে থাকেন। যদি কোনো উপায়ে কোনো স্ত্রীলোক চিতা থেকে পালিয়ে যান, তার আত্মীয়গণ পুনরায় ধরে এনে চিতানলে ভস্মীভূত করেন। আবেদনকারীগণ বলেছেন যে এরূপ কার্য্য, সকল জাতির সহজ জ্ঞানে, এবং শাস্ত্রানুসারে হত্যা বলে পরিগণিত হবে।
“Your petitioners are fully aware from their own knowledge, or from the authority of credible eye-witnesses that, cases have frequently when women have been induced by the presuasion of their next heir, interested in their destruction to burn themselves on the funeral piles of their husbands; that others who have been induced by fear to retract a resolution rashly expressed in the first moments of grief, of burning with their deceased husbands, have been forced upon the pile and there bound down with ropes and pressed by green bamboos until consumed by the flames; that some often flying from the flames, have been carried back by their relations and burnt to death. All these instances, your petitioners humbly submit, are murders, according to every Shastra, as well as to the common sense of all nations.”
আবেদনপত্রে কোনো তারিখ ছিল না। কিন্তু ঐ আবেদনপত্রের সঙ্গে এশিয়াটিক জারনালে প্রকাশিত হওয়ার জন্য পাণ্ডুলিপি প্রেরিত হয়েছিল, তাতে তারিখ ছিল। সেই তারিখ অনুসারে প্রতিপন্ন হয় যে, ১৮১৮ সালের আগষ্ট মাসের প্রথমে লাটসাহেব তার কর্ম গ্রহণের অল্পকাল পরেই দরখাস্তটি করা হয়। সতীদাহ বিষয়ক রামমোহন রায়ের প্রথম পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের তিনমাস পূর্বে আবেদন পত্রটি প্রেরিত হয়েছিল।
রামমোহন রায় শুধুমাত্র কথোপকথন ও পুস্তক প্রচার দ্বারাই সহমরণ প্রথার অবৈধতা ও নিষ্ঠুরতা লোককে বুঝিয়ে ক্ষান্ত হননি। তিনি কখনও কখনও কলকাতার গঙ্গাতীরে উপস্থিত হয়ে সহগামিনী রমণীর সহগমণ নিবারণের জন্য চেষ্টা করতেন। সেই সম্বন্ধে একটি গল্প শোনা যায় বীরনৃসিংহ মল্লিকের পরিবারস্থ কোনো একটি স্ত্রীলোক সহমৃতা হওয়ার জন্য গঙ্গাতীরে উপস্থিত হয়। রাজা রামমোহন রায় সেই সংবাদ পাওয়া মাত্ত্রই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং সহমরণ হতে স্ত্রীলোকটিকে প্রতিনিবৃত্ত করবার জন্য তার আত্মীয়স্বজনকে নানা প্রকারে বুঝাতে লাগলেন, তারা রামমোহনের মহৎ উদ্দেশ্য হৃদয়ঙ্গম করা দূরে থাক, ভীষণ বিরক্ত হল। একজন ক্রোধান্ধ হয়ে তাঁকে সম্বোধনপূর্বক বলে, “হিন্দুর কার্য্যে মুসলমান কেন?” রামমোহন এই বাক্যে কিছুমাত্র অসন্তোষ প্রকাশ না করে শান্তভাবে তাদের বুঝাতে লাগলেন, কিন্তু তাঁর ভৃত্য প্রভুর অপমানে রেগে উঠলে তিনি তাকে স্থির থাকতে আজ্ঞা করেন। যে রামরত্ন মুখোপাধ্যায় রাজার সঙ্গে ইংলণ্ডে গিয়েছিলেন, তার নিকট হতে বাবু রাজনারায়ণ বসু মহাশয় এই গল্পটি শুনেছিলেন।
১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের এশিয়াটিক জারনাল নামক পত্রে, আরেকটি ঘটনার বিষয় লিখিত আছে। কালীঘাটে কয়েকজন নারী সহমৃতা হবেন শুনে রামমোহন রায় সেখানে উপস্থিত হয়ে তা নিবারণের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কৃতকার্য্য হতে পারেননি।
১৮২১ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় ‘সংবাদ কৌমুদী’ নামে যে পত্রিকা প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন, তাতে সহমরণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব সকল লিখিত হত। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় সহমরণ বিষয়ে তৃতীয় প্রস্তাব ও তার ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করেন।
সতীদাহ বিষয়ে পুস্তক প্রকাশ করাতে; রামমোহন রায় গভর্ণমেন্ট হতে প্রশংসা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ১৮১০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ‘ইণ্ডিয়া গেজেট’-এ এরূপ লিখিত হয়েছিল – 
“আমরা জ্ঞাত হইলাম যে, বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত সতীদাহবিষয়ক এই ক্ষুদ্র পুস্তকখানির কোন বাঙ্গালা সংবাদপত্রে পুনর্মুদ্রিত হইয়াছে। রামমোহন রায়ের এই পুস্তকখানি জনসমাজে পুনর্বার প্রচারিত হওয়াতে ইহাদ্বারা নিশ্চয়ই সুফল উৎপন্ন হইবে।” 
‘ইণ্ডিয়া গেজেট’ যে বাঙ্গালা সংবাদপত্রের কথা উল্লেখিত হয়েছে তার নাম ‘সংবাদ কৌমুদী’। রামমোহন রায় এই পত্রিকা প্রকাশ করেন। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই পত্রিকার সম্বন্ধ ছিল। এতে সহমরণ বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে আরম্ভ হলে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর সংস্রব ত্যাগ করে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ নামক সংবাদপত্র প্রকাশ করলেন। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ প্রকাশিত হয়।
এই সময়ে পুনর্ব্বার ‘ইণ্ডিয়া গেজেট’-এ রামমোহনের প্রশংসা প্রকাশ করা হল। তাতে এইরূপ লেখা ছিল যে – 
“এদেশীয় অতি প্রধান এক বিশ্বহিতৈষী ব্যক্তি অনেকদিন হইতে, সভ্য রাজপুরুষগণের সাহায্যকারী এবং মনুষ্যজাতির হিতকারীরুপে এই গুরুতর বিষয়ে (সতীদাহ) নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি উৎসাহ সহকারে এ বিষয়ে তাঁহার মতামত পত্রের আকারে গভর্নর জেনারেলের সমীপে উপস্থিত করিয়াছেন। অল্পদিন হইল তিনি গভর্ণর জেনারেলের সহিত সাক্ষাৎ করিলে, গভর্ণর জেনারেল মহা অভ্যর্থনা সহকারে, আগ্রহের সহিত তাঁহার কথা শ্রবণ করেন। আমরা জ্ঞাত হইলাম যে গভর্ণর জেনারেল তাঁহাকে জ্ঞাপন করিয়াছেন যে, তিনি এই প্রথা রহিত করিবেন। কারণ, ইহা আমাদের প্রজাবর্গের চরিত্রের দূরপনেয় কলঙ্ক। আর ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট সমর্থন করিতেছেন বলিয়া ঐ প্রথায় রাজপুরুষগণের কলঙ্ক প্রকাশ পাইতেছে।
১৮২০ থেকে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস পর্যন্ত লর্ড আমহার্স্টের শাসনকাল। এই সময়ে হিন্দুশাস্ত্রানুসারে সতীদাহ বিষয়ে রাজনিয়ম বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল। লর্ড আমহার্স্টের পূর্বে এই বিষয়ে যে সকল নিয়ম ছিল, তা এই আইনের অন্তর্গত করা হয়। বারানসীর প্রতিনিধি ম্যাজিস্ট্রেট হ্যামিলটন সাহেব উক্ত আইনের ধারা উদ্ধৃত করে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের 
১২-ই আগষ্ট, তা ঘোষণা করা হয়। 
১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩-ই জানুয়ারি বেলি সাহেব এক সুদীর্ঘ মন্তব্য প্রকাশ করেন। হ্যারিংটন সাহেব ১৮-ই ফেব্রুয়ারি এক সুদীর্ঘ মন্তব্য প্রকাশ করেন। উভয়েই সতীদাহ বন্ধ করবার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। হ্যারিংটন সাহেব একস্থানে লিখেছিলেন, “১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ৮ ধারা ও ১৮০৩ খ্রীষ্টাব্দের ৮ ধারায় সতীদাহের কোন বাধা দিতে পারে নাই।”
বেলি সাহেব যা লিখেছিলেন তার সারমর্ম এই – “১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে, বঙ্গদেশের দক্ষিণাংশে ও পশ্চিম অঞ্চলে কতকগুলি স্ত্রীলোক সহমৃতা হইয়াছিলেন। তৎসম্বন্ধীয় বৃত্তান্ত অন্যান্য পত্র ও বর্ণনার সহিত, মেকনাটেনের যে পত্র গত ২০শে অক্টোবর গভর্ণমেন্টের নিকট উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা আমি বিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করিয়া দেখিয়াছি।
১৭২১ খ্রীষ্টাব্দ হইতে যে সকল সতীদাহের বৃত্তান্ত প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে তাহাতে দেখা যায় যে, ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দে সতীদাহের সংখ্যা ৬৩৯। ইহা সর্বাপেক্ষা অধিক। দুঃখের বিষয় যে, অন্যান্য জিলা অপেক্ষা রাজধানীর নিকটস্থ জিলা সমূহে এই প্রথা অধিক প্রচলিত।
আমার বিবেচনায় গবর্ণমেন্ট যে ঘোষণা করিয়াছেন, তাহা এই নৃশংস প্রথা উঠাইয়া দিবার প্রতিবন্ধক হইতে পারে না। এরুপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা যে উচিৎ, তাহার অনেক যুক্তি প্রদর্শন করা যাইতে পারে।
১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দ বেলি
১৭ ই জানুয়ারি
বেলি সাহেবের অভিপ্রায় পাঠ করে ব্যবস্থাপকসভার সহকারী সভাপতি কম্বারমিয়ার সাহেব ঐ সালের ১লা মার্চে লেখেন – 
“নৃশংস সহমরণ প্রথা শীঘ্র রহিত করবার জন্য বেলিসাহেব যে প্রস্তাব করিয়াছেন অর্থাৎ যে উপায়ে অবলম্বন করিতে বলিয়াছেন, তাহাতে আমার সম্পূর্ণ মত আছে।
১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দ                                                                   
                                                                     কম্বারমিয়ার
১লা মর্চ                        সহকারী সভাপতি 
 
 
 
গভর্ণর জেনারেল লর্ড আমহার্স্ট এ বিষয়ে এরুপ মত লিপিবদ্ধ করেন – 
“আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোন কার্য্য অসম্পূর্ণরুপে সম্পন্ন করা হইলে, তাহাতে সুফল প্রসূত না হইয়া কুফল উৎপন্ন হইবার অধিক সম্ভাবনা। সতীদাহ একেবারে স্থগিত করার জন্য কোন আইন বিধিবদ্ধ করা আমি ভাল বোধ করি না। সে কার্য্যে আমার মত নাই।”
১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দ আমহার্স্ট
১৮ই মার্চ
১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ৪-ঠা জুলাই হতে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২০-শে মার্চ পর্যন্ত লর্ড উইলিয়া বেণ্টিঙ্কের শাসনকাল বেণ্টিঙ্কের সময়ে সতীদাহের পক্ষ সমর্থন করে একশত পৃষ্ঠা পরিমিত এক পুস্তক প্রকাশিত হয়। তাতে অঙ্গীরা, পরাশর, হারিত প্রভৃতির বচন উদ্ধৃত ছিল।
রামমোহন রায় যুক্তি ও শাস্ত্রীয় প্রমাণদ্বারা, স্বদেশবাসীকে বুঝিয়েছেন যে সতীদাহ প্রথা অন্যায় ও ধর্মবিরুদ্ধ। রাজার বিপক্ষগণ সহমরণ সমর্থন পূর্বক বলেন যে সহমরণ দেশাচার পরম্পরা হতে আসার ফলে এতে কোন দোষ নেই। রাজা এই উক্তি খণ্ডন করে বলেন যে যার ধর্মভয় আছে, সে কখনও বলবে না যে, পরম্পরা হয়ে আসছে বলে – নরহত্যা ও চৌর্য্যাদি কর্ম করে মনুষ্য নিষ্পাপ থাকতে পারে। এরুপ শাস্ত্রবিরুদ্ধ দেশাচারে মান্য করলে, অবশ্য বলতে হয় যে, যে সকল বনস্থ ও পার্বতীয় লোক বংশপরম্পরায় দস্যুবৃত্তি করে আসছে, তারাও নির্দোষ। এবং ঐ দুষ্কার্য থেকে তাদের নিবৃত্ত করা কখনই উচিৎ নয়। বাস্তবিক, ধর্মাধর্ম নিরুপনের উপায় শাস্ত্র এবং শাস্ত্রসম্মত যুক্তি। এরূপ স্ত্রীবধ শাস্ত্রবিরুদ্ধ। অবলাকে স্বর্গের লোভ দেখিয়ে বলপূর্বক হত্যা করা যুক্তি অনুসারে অত্যন্ত পাপজনক। স্ত্রীবধ, ব্রহ্মবধ, পিতৃহত্যা, মাতৃহত্যা ইত্যাদি দারুণ পাতক সকল দেশাচার বলে ধর্মরূপে গণ্য হতে পারে না। যে দেশে এরূপ আচার প্রচলিত সে দেশ পতিত হয়। অতএব বলপূর্বক কোন স্ত্রী-লোককে বন্ধন করে অগ্নিদ্বারা দাহ করা সর্বশাস্ত্রনিষিদ্ধ এবং অতিশয় পাপজনক। শাস্ত্রে যে যে ক্রিয়ার কোন বিশেষ বিধি নেই, সেই সকল স্থলে দেশাচার ও কুলধর্মানুসারে ক্রিয়া নিষ্পন্ন হতে পারে। কিন্তু দেশাচার বলে জ্ঞানপূর্বক স্ত্রীবধ কখনই সৎকর্মের মধ্যে গণ্য হতে পারে না।
১৮২৪ সালের জানুয়ারি মাসে, বিশপ হিবর, কলিকাতা হতে লিখেছিলেন যে, তিনি ডাক্তার মার্সম্যানের কাছে শুনেছেন যে, দেশীয় লোকের মধ্যে অনেক ক্ষমতাশীল ও ধনীব্যক্তি সতীদাহ বিষয়ে রামমোহন রায়ের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন। শাস্ত্রে যে সতীদাহ বিষয়ে কোন আদেশ নাই এবং এটি যে একটি নৃশংস প্রথা তা বলতে আরম্ভ করেছেন।
১৮২০ সালের ২৭শে জুলাই ‘ইণ্ডিয়া গেজেট’-এ রামমোহন রায়ের যে প্রশংসা বেরিয়েছিল, তার পাঁচ মাসের মধ্যে রাজবিধিদ্বারা সতীদাহ নিবারিত হয়েছিল।
ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট নৃশংস সতীদাহ প্রথা উঠিয়ে দিতে ইচ্ছা করলেও অনেকক্ষেত্রে পিছিয়ে আসেন এই ভেবে যে প্রজার ধর্মে হস্তক্ষেপ করলে বিদ্রোহের সম্ভাবনা। ১৮২১ সালে ২০শে জুন, এবিষয়ে পার্লামেন্টে যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল, তাতে ক্যানিং সাহেব এই আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন, অনেক ইংলণ্ডীয় রাজনীতিজ্ঞ এবং ভারতবর্ষস্থ রাজ কর্মচারী সতীদাহ প্রথা উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন কিন্তু তারা তাদের অভিপ্রায় কার্যে পরিণত করতে সক্ষম হননি। হিন্দুদের মধ্যে কিছু শিক্ষিত ভদ্রলোক এই প্রথার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হন, রামমোহন রায়ের প্রাণগত চেষ্টায় এদেশের অনেকগুলি ভদ্রলোক ক্রমে বুঝতে পারলেন, সতীদাহ অত্যন্ত অন্যায় ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ কার্য্য। রামমোহন রায় গভর্ণমেন্টকেও বোঝাতে সক্ষম হলেন যে সতীদাহ প্রথা শাস্ত্রসম্মত কার্য নয়।
সতীদাহ নিবারণ সম্বন্ধে একটি গল্প আছে। তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক উক্ত বিষয়ে রামমোহন রায়ের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য তার নিকট একজন এডিকং পাঠান । রামমোহন রায়  এডিকংকে বললেন “আমি এক্ষণে বৈষয়িক কার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া শাস্ত্রচর্চা ও ধর্মানুশীলনে নিযুক্ত রহিয়াছি। আপনি অনুগ্রহপূর্বক লাট সাহেবকে জ্ঞাত করিবেন যে, রাজদরবারে উপস্থিত হইতে আমার বড় ইচ্ছা নাই।” এডিকং কথাগুলি বেণ্টিঙ্ক সাহেবের কাছে অবিকল তাই ব্যক্ত করলেন। বেণ্টিঙ্ক জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি রামমোহন রায়কে কি বলিয়াছিলেন?” এডিকং জানাল সে বলেছিল – “গভর্ণর জেনারল লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্কের সঙ্গে আপনি একবার সাক্ষাৎ করিলে তিনি বাধিত হইবেন।” বেণ্টিঙ্ক পুনর্বার এডিকংকে রামমোহন রায়ের কাছে পাঠান এবং বলতে বলেন যে “মিস্টার উইলিয়াম বেণ্টিঙ্কের সহিত আপনি অনুগ্রহপূর্বক সাক্ষাৎ করলে তিনি বাধিত হন।” গভর্ণর জেনারেলের এতদূর আগ্রহ ও শিষ্টাচার রামমোহন রায় ফিরিয়ে দিতে পারেন নি। বেণ্টিঙ্ক ও রামমোহন রায়ের এই শুভযোগ থেকে মহৎ ফল প্রসূত হয়েছিল। জনৈক সুবক্তা একে মণিকাঞ্চণযোগ বলেছেন।
রাজা রামমোহন রায় গভর্ণমেন্টের কাছে প্রতিপন্ন করেন হিন্দু রমণীগণ বুদ্ধি বিবেচনার অনুবর্ত্তিনী হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে শরীর ভস্মাবশেস করতেন তা নয়। বিধবার সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য স্বার্থপর আত্মীয়গণ সহমরণে বাধ্য করে অসহায় রমণীটিকে। বিধবা যখন পতি বিরহে শোকোন্মত্তা, বাহ্যজ্ঞান শূন্য, সেই সময়ে সহমরণে তাকে সংকল্পবদ্ধ করা হত। শোক, অনাহার, এমনকি নেশাগ্রস্থ করে তার সম্মতি আদায় করা হত।
“A mare official and less picturesque account of the matter is given by the India Gazette of July 27, 1829: – An eminent native philanthropist who has long taken the lead of his countrymen on this great question has been encouraged to submit his views of it in a written form, and has been subsequently honoured with an audience by the Governor General, who, we learn, has expressed his anxious desire to put an end to a custom constituteing so foul a blot. The Gazette goes on to mention three courses as open to the Government, either rigidly to enforce existing regulations; or to supporess Suttee in the provinces of Bengal and Behar where it was most prevalent, but where British rule was longest known and best appreciated; or to abolish it throughout the Presidency.
The purpart of Rammohun’s advice to the Governor General has been preserved in Lord Wm. Bentinck’s Minute of Nov. 8, And here another surprise awaits us. we naturally suppose that the leader of the revolt against the burning of widows would egerly grasp at the prospect of its prompt and farcible suppression by Government. But Ramomohun positively endeavoured to dissuade Lord Bentinck from this drastic project. The Governor General after detailing Mr. Horace Wilson’s arguments against aolition, wrote on: I must acknowledge that a similar opinion as to the probable excitation of a deep distrust of our future intentions was mentioned to me in conversation by that enlightened native Ramomohun Roy, a warm advocate for the abolition of Sati and of all other superstitions and corruptions engrafted on the Hindu religion, which he considers originalay to have been a pure deism. it was his opinion that the practice might be suppressed quietly and unobservedly by increasing the difficulties and by the indirect agency of the police. He apprehended that any public enactment would give rise to general apprehension; that the reasoning would be: ‘while the English were contending for power they deemed it politic to allow universal toleration and to respect our religion, but having obtained the supremacy their first act is a violation of their profession, and the next will probaboly be, like the Muhammadan conquerors to force upon us their own religion.
We may explain Rammohun’s attitutde by recalling his constitutional aversion to coercion; and any one who had undergone the bitter persecution which had fallen to his lot might be pardoned for over-estimating the strength of popular antagonism to reform,. The man of force argued differently from the man of suasion. He observed that out of 463 Suttees 420 took place in the lower provinces and 287 in the Calcutta Division. The figures for Suttees in the Bengal Residency during the last four years in which the practice was tolerated are given thus:  –
Division 1825AD 1826AD 1827AD 1828AD
Calcutta 398 324 337 309
Dacca 101 65 49 47
Moorshedabad 21 8 2 10
Patna 47 65 55 55
Benares 55 48 49 33
Borailly 17 8 18 10
Total 639 518 510 464
The people in these districts had through the centuries been so habituated to submission that insurrection or hostile opposition to the ruling power may be affirmed to be an impassible danger. Had Suttee been prevalent among “the bold and manly people” of the upper provinces, the problem would have been fraught with much graver peril. But, as the faculty of resistance had all but the died out of the chief practisers of Suttee, their apprehensions and suspicions might be safely disregarded.
So Lord Wm. Bentink cut the Gardian knot, and on the 4th of December, 1829 the regulation was passed which declared the practice illegal and punishable as a criminal offence. All persons convicted a aiding and abetting in the sacrifice of a Hindu widow, whether she were a willing victim or not, whether she requested  them or not, here pronounced quality of culpable homicide; and where violence or other means of overpowering the victim’s will were employed, the death sentence might, at the discretion of the Court, be inflicted. Suttee was abolished. The reputation of the British Government and the fair fame of religion itself were redeemed from one of the foulest stains.
But the old custom was not to be surrendered without a strong protest. The sumachar Chundrika the organ of conservative Hinduism, sounded the alarm; and the India Gazette of Nov. 30th announced that a petition against the abolition of widow-burning was already in progress. The Gazette expressed the hope that the Sambad Kaumudi and the Banga Doot, as representing the move liberal portion of the native public, would correct current misconceptions and set the action of the Government in the right light. This deserves notice, as tribute to the value of Rammohun’s journalistic work. The petition against the new regulation found little support, the Gazette said, among the respectable and influential classes. Signatures were procured with difficulty, having to be extorted by threats and taunts. So stated the Asiatic Journal of June 1830, which even went so far as to declare that “the Government had satisfied itself that the majority of the native community was decidedly opposed to the practice. ”
সতীদাহ সম্বন্ধে রাজা রামমোহন রায়ের সুমহৎ কার্য ইতিহাস চিরকাল মনে রাখবে। এই মহৎ কার্যের জন্য যে অসামান্য পরিশ্রম ও স্বার্থত্যাগ করেছিলেন ভারতবর্ষ তাঁকে চিরকাল ভক্তি ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।
সতীদাহ নিবারিত হওয়াতে ধর্মসভার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। তাঁদের ক্ষোভ, ক্রোধ, বিদ্বেষ ও ঘৃণার পরিসীমা থাকল না। আর তাদের পরমারাধ্য জননী, স্নেহপ্রতিম ভগিনী প্রভৃতিকে জ্বলন্ত চিতায় জীবন্ত দগ্ধ করতে পারবে না – এ কী সামান্য দুঃখের কথা। ধর্মসভা কেন, সারা বঙ্গভূমি – ভারতবর্ষে হুলস্থুল পড়ে গেল। ঘোর কলি উপস্থিত; রামমোহন রায়ের প্রতি চারিদিক থেকে গালি বর্ষণ হতে লাগল। ওনাকে সম্পূর্ণ রূপে সমাজচ্যূত করা হল। এই সময় কলকাতার কোন কোন বড়মানুষ বলতে লাগল ওনাকে মেরে ফেলবে। বাস্তবিক রামমোহন রায় ও তার বন্ধুগণের পক্ষে অতি সঙ্কটকাল উপস্থিত হয়েছিল। তাঁর হিতাকাঙ্খী বন্ধুগণ তাঁকে সাবধান হয়ে থাকতে বলতেন। বাইরে যাওয়ার সময় প্রহরী নিয়ে যেতে পরামর্শ দিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি সম্পুর্ণ নির্ভয়ভাবে একা নগরের রাজপথে ভ্রমণ করতেন। একেবারে সাবধান হন নি, তা নয়, বাইরে যাওয়ার সময় বুকের মধ্যে পোষাকের ভিতর কিরিচ রাখতেন। 
রামমোহন রায় নারীজাতির প্রতি চিরকালীন  শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। স্বদেশীয় রমণীকুলের হিতের জন্য এবং তাদের এই কুপ্রথা থেকে রক্ষার জন্য তিনি কোন পরিশ্রমকেই পরিশ্রম মনে করেন নি। দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার তিনি সহ্য করতে পারতেন না। দরিদ্রের প্রতি ধনীর অত্যাচার, স্ত্রীলোকের প্রতি পুরুষের অত্যাচারে তিনি যারপরনাই কাতর হতেন। তাঁর সহমরণ বিষয়ক গ্রন্থের একস্থলে এদেশীয় স্ত্রীলোকদের পক্ষ সমর্থন করে যে লিখেছিলেন – নিম্নে তা উদ্ধৃত করা হল – (এদেশীয় রমণীগণের সম্বন্ধে রামমোহন রায়ের উক্তি) – 
“নিবর্ত্তক। – এই যে কারণ কহিলা তাহা যথার্থ বটে, এবং আমাদিগের সুন্দর-রুপে বিদিত আছে; কিন্তু স্ত্রীলোক কে যে পর্য্যন্ত দোষান্বিত আপনি কহিলেন, তাহা স্বভাবসিদ্ধ নহে। অতএব কেবল সন্দেহের নিমিত্ত বধ পর্যন্ত করা লোকতঃ ধর্মতঃ বিরুদ্ধ হয়, এবং স্ত্রীলোকের প্রতি এইরুপ নানাবিধ দোষোল্লেখ সর্বদা করিয়া তাহার দিগকে সকলের নিকট অত্যন্ত হেয় এবং দুঃখদায়ক জানাইয়া থাকেন, যাহার দ্বারা তাহারা  নিরন্তর ক্লেষ প্রাপ্ত হয়; এ নিমিত্ত এই বিষয়ে কিঞ্চিৎ লিখিতেছি। স্ত্রীলোকেরা শারীরক পরাক্রমে পুরুষ হইতে প্রায় ণ্যূন হয়, ইহাতে পুরুষেরা তাহারদিগকে আপনা হইতে – দুর্বল জানিয়া যে সে উত্তম পদবীর প্রাপ্তিতে তাহার স্বভাবতঃ যোগ্য ছিল, তাহা হইতে উহারদিগকে পূর্বাপর বঞ্চিত করিয়া আসিতেছেন; পরে কহেন যে, স্বভাবতঃ তাহারা সেই পদ প্রাপ্তির যোগ্য নহে; কিন্তু বিবেচনা করিলে তাহারদিগকে যে যে দোষ আপনি দিলেন, তাহা সত্যি কি মিথ্যা ব্যক্ত হইবেক।
প্রথমতঃ বুদ্ধির বিষয়, স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন্‌ কালে লইয়াছেন যে, অনায়াসেই তাহারদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যাশিক্ষা এবং জ্ঞানশিক্ষা দিলে পরে, ব্যক্তি যদি অনুভবও গ্রহণ করিতে না পারে, তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়; আপনারা বিদ্যাশিক্ষা, জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয়, ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন? বরঞ্চ লীলাবতী, ভানুমতী, কর্ণাট রাজার পত্নী, কালিদাসের পত্নী প্রভৃতি যাহাকে যাহাকে বিদ্যাভ্যাস করাইয়াছিলেন, তাহারা সর্বশাস্ত্রে পারগরুপে বিখ্যাতা আছে। বিশেষতঃ বৃহদারণ্যক উপনিষদে ব্যক্তই প্রমাণ আছে যে অত্যন্ত দুরুহবহ্মজ্ঞান তাহা – যাজ্ঞবল্ক্য আপন স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে উপদেশ করিয়াছেন, মৈত্রেয়ীও তাহার গ্রহণপূর্বক কৃতার্থ হয়েন।
দ্বিতীয়তঃ তাহারদিগকে অস্মিরান্তঃকরণ কহিয়া থাকেন, ইহাতে আশ্চর্য জ্ঞান করি; কারন  যে দেশের পুরুষ মৃত্যুর নাম শুনিলে মৃতপ্রায় হয়, তথাকার স্ত্রীলোক অন্তঃকরনের স্থৈর্য্যদ্বারা স্বীকার উদ্দেশে অগ্নি প্রবেশ করিতে উদ্যত হয়, ইহা প্রত্যক্ষ দেখেন, তথাচ কহেন, যে তাহারদের অন্তঃকরণের স্থৈর্য্য নেই।
তৃতীয়তঃ বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়। এ দোষ পুরুষে অধিক কি স্ত্রীতে অধিক, উভয়ের চরিত্র দৃষ্টি করিলে বিদিত হইবেক। প্রতি নগরে, প্রতি গ্রামে, বিবেচনা করা যে কত স্ত্রী, পুরুষ হইতে প্রতারিতা হইয়াছে, আর কত পুরুষ, স্ত্রী হইতে প্রতারণা প্রাপ্ত হইয়াছে; আমরা অনুভব করি যে, প্রতারিত স্ত্রীর সংখ্যা দশগুণ অধিক হইবেক; তবে পুরুষেরা প্রায় লেখা পড়াতে পারগ এবং রাজকর্মে অধিকার রাখেন, যাহার দ্বারা স্ত্রীলোকের কোন এরুপ অপরাধ কদাচিৎ হইলে সর্বদা বিখ্যাত অনায়াসেই করেন; অথচ পুরুষে স্ত্রীলোককে প্রতারণা করিলে তাহা দোষের মধ্যে গণনা করেন না। স্ত্রীলোকের এই এক দোষ আমরা স্বীকার করি, যে আপনাদের ন্যায় অন্যকে সরল জ্ঞান করিয়া হঠাৎ বিশ্বাস করে, যাহার দ্বারা অনেকেই ক্লেশ পায়, এ পর্য্যন্ত, কেহ কেহ প্রতারিত হইয়া অগ্নিতে দগ্ধ হয়।
চতুর্থ, যে অনুরাগ কহিলেন, তাহা উভয়ের বিবাহগণনাতেই ব্যক্ত আছে, অর্থাৎ এক এক পুরুষের প্রায় দুই তিন দশ বরঞ্চ অধিক পত্নী দেখিতেছি আর স্ত্রীলোকের এক পতি, যে ব্যক্তি মরিলে কেহ তাবৎ সুখ পরিত্যাগ করিয়া সঙ্গে মরিতে বাসনা করে, কেহ বা যাবজ্জীবন অতি কষ্ট যে ব্রহ্মচর্য্য তাহার অনুষ্ঠান করে।
পঞ্চম, তাহারদের ধর্মভয় অল্প। এ অতি অধর্মের কথা। দেখে কি পর্য্যন্ত দুঃখ, অপমান, তিরস্কার, যাতনা, তাহার কেবল ধর্মভয়ে সহিষ্ণুতা করে। অনেক কুলীন ব্রাহ্মণ, যাহারা দশ পনর বিবাহ অর্থের নিমিত্তে করেন, তাহারদের প্রায় বিবাহের পর অনেকের সহিত সাক্ষাৎ হয় না, অথবা যাবজ্জীবনের মধ্যে কাহারো সহিত দুই-চারিবার সাক্ষাৎ করেন: তথাপি ঐ সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে অনেকেই ধর্মভয়ে স্বামীর সহিত সাক্ষাৎ ব্যতিরেকেও এবং স্বামীদ্বারা কোন উপকার বিনা পিতৃগৃহে অথবা ভ্রাতৃগৃহে কেবল পরাধীন হইয়া নানা দুঃখ সহিষ্ণুতাপূর্বক থাকিয়াও যাবজ্জীবন ধর্ম নির্বাহ করেন। আর ব্রাহ্মণের অথবা অন্য বর্ণের মধ্যে যাহারা আপন আপন স্ত্রীকে লইয়া গার্হস্থ্য করেন, তাঁহাদের বাটীতে প্রায় স্ত্রীলোক কি কি দুর্গতি না পায়? বিবাহের সময় স্ত্রীকে অর্দ্ধ অঙ্গ করিয়া স্বীকার করেন, কিন্তু ব্যবহারের সময়ে পশু হইতে নীচ জানিয়া ব্যবহার করেন। যেহেতু স্বামীর গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে, অর্থাৎ অতি প্রাতে কি শীতকালে, কি বর্ষাতে স্থানমার্জন, ভোজনাদি পাত্র মার্জন, গৃহলেপনাদি তাবৎ কর্ম করিয়া থাকে, এবং সূপকারের কর্ম বিনা বেতনে দিবসে ও রাত্রিতে করে, অর্থাৎ স্বামী, শ্বশুর, শাশুরী ও স্বামীর ভ্রাতৃবর্গ, অমাত্যবর্গ এসকলের রন্ধন ও পরিবেশনাদি আপন আপন নিয়মিত কালে করে; যেহেতু হিন্দুবর্গের অস্য জাতি অপেক্ষা ভাই সকল ও অমাত্য সকল একত্র স্থিতি অধিককাল করেন এ নিমিত্ত বিষয় ঘটিত ভ্রাতৃবিরোধ ইহাদের মধ্যে অধিক হইয়া থাকে; ঐ রন্ধনে ও পরিবেশনে যদি কোন অংশে ত্রুটি হয়, তবে তাহাদের স্বামী, শাশুড়ী, দেবর প্রভৃতি কি কি তিরস্কার না করেন; এ সকলকেও স্ত্রীলোকেরা ধর্মভয়ে সহিষ্ণুতা করে, আর সকলের ভোজন হইলে ব্যঞ্জনাদি উদরপুরণের যোগ্য অথবা অযোগ্য যৎকিঞ্চিৎ অবশিষ্ট থাকে, তাহা সন্তোষ-পূর্বক আহার করিয়া কালযাপন করে। আর অনেক ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, যাহাদের ধনবিত্ত নাই, তাঁহারদের স্ত্রীলোক সকল গোসেবাদি কর্ম করেন এবং পাকাদির নিমিত্ত গোময়ের ঘোষী স্বহস্তে দেন, বৈকালে পুষ্করিনী অথবা নদী হইতে জলাহরণ করেন, রাত্রিতে শয্যাদি করা যাহা ভৃত্যের কর্ম, তাহাও করেন, মধ্যে মধ্যে কোনো ধনবত্তা হইল, তবে ঐ স্ত্রীর সর্বপ্রকার জ্ঞাতসারে এবং দৃষ্টিগোচরে প্রায় ব্যভিচার দোষে মগ্ন হয়, এবং মাস-মধ্যে এক দিবসও তাহার সহিত আলাপ নাই। স্বামী দরিদ্র যে পর্য্যন্ত থাকেন, তাবৎ নানাপ্রকার কায়ক্লেশ পায় আর দৈবাৎ ধনবান হইলে মানস দুঃখে কাতর হয়। এ সকল দুঃখ ও মনস্তাপ কেবল ধর্ম ভয়েই  তাহারা সহিষ্ণূতা করে। আর যাহার স্বামী দুই তিন স্ত্রীকে লইয়া গার্হস্থ্য করে, তাহারা দিবারাত্রি মনস্তাপ ও কলহের ভাজন হয়, অথচ অনেকে ধর্মভয়ে এ সকল ক্লেশ সহ্য করে; কখন এমত উপস্থিত হয় যে, এক স্ত্রীর পক্ষ হইয়া অন্য স্ত্রীকে সর্বদা তাড়না করে এবং নীচ লোক ও বিশিষ্ট লোকের মধ্যে যাহারা সৎসঙ্গে না পায় তাহারা আপন স্ত্রীকে কিঞ্চিৎ ত্রুটি পাইলে অথবা নিষ্কারণ কোন সন্দেহ তাহাদের প্রতি হইলে, চোরের তাড়না তাহাদিগকে করে। অনেকেই ধর্ম ভয়ে  লোকভয়ে ক্ষমাপন্ন থাকে, যদ্যপিও  কেহ তাদৃশ যন্ত্রণায় অসহিষ্ণু হইয়া পতির সহিত ভিন্নরুপে থাকিবার নিমিত্ত গৃহত্যাগ করে, তবে রাজদ্বারে পুরুষের প্রাবল্য নিমিত্ত পুনরায় প্রায় তাহারদিগকে সেই সেই পতিহস্তে আসিতে হয়। পতিও সেই পূর্বজাত ক্রোধের নিমিত্ত নানা ছলে অত্যন্ত ক্লেশ দেয়, কখন বা ছলে প্রাণবধ করে; এসকল প্রত্যক্ষসিদ্ধ সুতরাং অপ্রলাপ করিতে পারিবেন না। দুঃখ এই যে, এই পর্য্যন্ত অধীন ও নানা দুঃখে দুঃখিনী, তাহারদিগকে প্রত্যন্ত দেখিয়াও কিঞ্চিৎ দয়া আপনকারদের উপস্থিত হয় না, যাহাতে বন্ধনপূর্বক দাহ করা হইতে রক্ষা পায়।”
যে সমাজে নারী শুধুমাত্র ব্যবহার্য সামগ্রী হিসাবে পরিবেশিত হয়েছে, তার হিতসাধনের জন্য রামমোহনের মহৎ উদ্দেশ্যপথে কেউ তৃণ সংযোজন করবেন না একথা রামমোহন রায় নিজে জানতেন। তিনি প্রথম থেকেই জানতেন তার বিরুদ্ধপক্ষ সর্বদা অগ্নিবানসম বাক্য বিচ্ছুরণের জন্য তৈরি আছে। এই বিরোধী পক্ষের অন্যতম ছিলেন রাধাকান্ত দেব-গোষ্ঠী। রামমোহন কলিকাতায় ১৮১৪ বা ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে স্থায়ী হয়ে আত্মীয়সভার মাধ্যমে তাঁর ধর্ম ও সমাজে সংস্কারের কর্মসূচির প্রকাশ্য ব্যাখ্যা করবার সময় থেকেই রাধাকান্ত দেব-গোষ্ঠী রামমোহনের বিরুদ্ধতা করে এসেছে। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হওয়ার কালে এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষসভা থেকে তাকে বাদ দেওয়ার চক্রান্তের মধ্যে এই মনোভাবের প্রকাশ। তাছাড়া ধর্ম ও সমাজ-সংক্রান্ত এই সব প্রকাশ্য বিতর্কে রধাকান্ত সচরাচর স্বয়ং লিখিতভাবে যোগ দিতেন না। এর একমাত্র ব্যতিক্রম রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্রে প্রকাশিত উইলসনকে লিখিত তাঁর পত্র। তাঁদের গোষ্ঠীভুক্ত ও পোষিত রক্ষণশীল পণ্ডিতগণ দিয়েই তাঁরা সাধারণত প্রতিবাদ লেখাতেন। সতীদাহ-উচ্ছেদ ও পরবর্তীকালের বিধবা বিবাহ প্রচলন – দুটি আন্দোলনের ক্ষেত্রেই তা দেখা গেছে। সতীদাহ-উচ্ছেদ আইন পাশ হওয়ার (১৮২৯) বহু পূর্ব হতেই এই বিষয়ে রামমোহনের মতকে আক্রমণ করে রক্ষণশীল পক্ষীয় একাধিক পণ্ডিত রচিত পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। উইলসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি স্বয়ং লেখনী ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সম্ভবত এই কারণে যে বিলাতে প্রকাশিত ইংরেজি নিবন্ধের উত্তর দেওয়ার সাধ্য ইংরেজিতে অনভিজ্ঞ তাঁর পণ্ডিতগণের ছিল না। ভবতোষ দত্ত বলতে চেয়েছেন, “রাধাকান্ত হিন্দুসমাজের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে সংস্কার করে সামাজিক পরিবর্তন ঘটাবার পক্ষপাতী ছিলেন; আইনের সাহায্যে বাইরে থেকে হস্তক্ষেপের দ্বারা হিন্দুসমাজের পরিবর্তন হোক – এ তিনি কামনা করেননি। তার ভাষায়, “হিন্দু সমাজেও সংস্কার হয়েছে। রঘুনন্দনের কথা আমরা জানি। তিনি সমাজে থেকেই এ কাজ করেছিলেন। বস্তুত রাধাকান্ত সহমরণ প্রথাকে উৎকৃষ্ট সামাজিক আচার মনে করতেন কিনা বলা শক্ত, কারণ তার পরিবারে সহমরণ কখনো হয়নি; তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস যাই হোক, রামমোহনের বাদবিতর্কের তিনি কোনো প্রতিবাদ করেছিলেন বলে জানি না। তাঁর প্রতিবাদ তখনই উচ্চারিত হল যখন ইংরেজ শাসক এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে এগিয়ে এল। কেননা তাঁর মনে হল সমাজের অধিকারকে শাসক হরণ করে নিচ্ছে।” এই কয়েকটি বাক্যের মধ্যে লেখকের একাধিক প্রমাণহীন অনুমানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। প্রথমত হিন্দুসমাজের অভিব্যক্তির ইতিহাসে সমাজের অন্তর্নিহিত জীবনীশক্তি বারবার নূতন পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমাজ দেহে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ঘটিয়েছে একথা সাধারণভাবে সত্য হলেও রঘুনন্দন এই প্রক্রিয়ার দৃষ্টান্তস্থল নয়। তাঁর চেষ্টা মুখ্যত ছিল কিভাবে পুরাতন আচারের নিগড়ে ভগ্ন সমাজব্যবস্থার ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অঙ্গগুলিকে একএ জোড়া দেওয়া যায়। বস্তুত হিন্দুসমাজকে তিনি এক অনড় অচলায়তন রূপে কল্পনা করেছিলেন। রামমোহন-কাল পর্যন্ত বঙ্গীয় রক্ষণশীল স্মার্ত পণ্ডিতগণের সতীদাহ সমর্থনের মূল উৎস যে প্রকারন্তরে ছিল রঘুনন্দনেরই শুদ্ধিতত্ত্ব। দ্বিতীয়ত রাধাকান্ত সহমরণ প্রথাকে উৎকৃষ্ট সামাজিক আচার মনে করতেন কিনা বলা শক্ত নয়। সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ হওয়ার অনেক পরে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্রের অধ্যাপক উইলসন বিচার করে দেখান, ‘ইমা নারীর বিধবা’ ইত্যাদি যে মন্ত্রটিকে এতাবৎকাল সতীদাহবাচক গণ্য করা হয়ে আসছিল, তা প্রকৃতপক্ষে সতীদাহ বিধায়ক নয়। রামমোহন পূর্বেই একথা বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন রাধাকান্ত দেব। উইলসনকে লিখিত এই দীর্ঘ পত্রে রাধাকান্ত তাঁর পণ্ডিতদের জবানীতে খণ্ডিত ও বর্জিত পুরাতন যুক্তিসমূহ পুনরুস্থাপিত করে প্রমাণ করবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, সতীদাহ প্রথা শাস্ত্রসমর্থিত, এমনকি বেদসমর্থিত। ইংরেজি অনুবাদে প্রাচীন রোমান কবি প্রপেতিয়ুস রচিত সতীদাহের সপ্রশংস, উচ্ছ্বাসপূর্ণ, রোম্যান্টিক বর্ণনা সম্বলিত এক কবিতাংশ উদ্ধৃত করে রাধাকান্ত পত্র শেষ করেছেন। এই দীর্ঘ পত্রের অন্তর্নিহিত সুরটি একাধারে গর্বের ও বিষাদের। হিন্দু হিসাবে এই প্রথার জন্য লেখক গর্ব অনুভব করেছেন এবং এর অবলুপ্তির জন্য দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছেন। সুতরাং সতীদাহ প্রথা মনে মনে অপছন্দ করেও মাত্র সমাজ রক্ষার জন্য রাধাকান্ত এর উচ্ছেদবিরোধী ছিলেন এ যুক্তি টিকছে না। তাঁর নিজ পরিবারে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল না – এ তথ্য রাধাকান্তের সতীদাহবিরোধী মনোভাব প্রমাণ করে না। তখনকার দিনে এমন অনেকেই সতীদাহ উচ্ছেদ-প্রচেষ্টার সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন, যাঁদের পরিবারে সতীদাহপ্রথা প্রচলিত ছিল না। রামকমল সেন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভৃতি বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া চলে।
রামমোহনের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদী এও বলেন যে অল্পবুদ্ধি স্ত্রীলোকের মন থেকে কেমন করে কামনা দূর হতে পারে? রাজা এর উত্তরে বলেছেন যে, পরমেশ্বরের আরাধনাতে প্রবৃত্তি দিলেই নিন্দিত কাম্যকর্ম হতে নিবৃত্তি ও তৎপরে সদ্‌গতি, কি স্ত্রীলোক কি পুরুষ উভয়ের সমানরূপ হতে পারে প্রমাণ ভগবদ্গীতা।
মাং হি পার্থ ব্যপাশিত্য যেপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ
স্ত্রিয়োবৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাংগতিং।।
মৈত্রেয়ী প্রভৃতি স্ত্রীলোক কাম্যকর্ম ত্যাগপূর্বক, পরমেশ্বরের আরাধনা দ্বারা পরমগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। বেদ, পুরাণ, ইতিহাসে তা প্রসিদ্ধ আছে। সহমরণ বিষয়ে রাজা রামমোহন রায়ের আরেকজন প্রতিবাদী বলছেন যে, যে সকল স্ত্রীলোক সর্বদা বিষয়সুখে এবং কাম্যকর্মফলে নিতান্ত আসক্ত, তাদের সহমরণরূপ বিধবার পরমধর্ম হতে বিরত করে জ্ঞানাভ্যাসে নিযুক্ত করলে তাদের উভয় দিক ভ্রষ্ট করা হয়। এ বিষয়ে গীতার প্রমাণ – 
“ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাং”
রামমোহন রায় এ কথার উত্তরে বলেছেন – সহমরণে স্ত্রীলোককে প্রবৃত্ত করার অভিপ্রায় কি, তা এখন বিশেষরূপে ব্যক্ত হল। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্ত্রীলোকেরা অত্যন্ত বিষয়সুখে আসক্তা। সহগমন না করলে তাদের ইত্যেভ্রষ্টন্ত তো নষ্ট হবে, এই ভয়ে স্বর্গের প্রলোভন দেখিয়ে স্বামীর সঙ্গে তাদের আয়ুঃশেষ করেন। কিন্তু আমরা জানি যে, কি পুরুষ কি স্ত্রীলোক স্বভাবতঃ কাম, ক্রোধ, লোভে জড়িতে। কিন্তু শাস্ত্রনুশীলন এবং সৎসঙ্গ দ্বারা ক্রমশঃ ঐ সকল দোষের দমন হতে পারে, এবং তাঁরা উত্তম পদপ্রাপ্তির যোগ্য হতে পারেন। এই জন্য আমরা কি স্ত্রীলোক কি পুরুষ সকলকে অধম শারীরিক সুখের কামনা হতে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করি। স্বর্গে গমন করে স্বামীর সঙ্গে অভ্যস্ত স্ত্রী-পুরুষের ব্যবহারপূর্বক কিছুকাল বাস করে পুনরায় অধঃপতিত হয়ে গর্ভের মলমূত্রঘটিতো যন্ত্রণা ভোগ কর, এমন উপদেশ আমরা কখনো প্রদান করি না। শাস্ত্রে এইরূপ বিধি দিয়েছেন যে, স্ত্রীলোক ও পুরুষের মধ্যে যাদের ব্রহ্মজিজ্ঞাসা উৎপন্ন হয়, তারা পরমেশ্বরের শ্রবণ মনন করে সাংসারিক অত্যন্ত দুঃখ হতে মুক্ত হবেন। আর যাদের ব্রহ্মজিজ্ঞাসা হয়নি, তাদের পক্ষে শাস্ত্রের আদেশ এই যে, কামনারহিত হয়ে নিত্যনৈমিত্তিক কর্মানুষ্ঠান্দ্বারা চিত্তশুদ্ধি পুর্বক জ্ঞানাভ্যাস করা। অতএব শাস্ত্রানুসারে বিধবাদের নিন্দিত এবং অচিরস্থায়ী যে স্বর্গসুখ, তা হতে নিবৃত্ত করতে প্রয়াস এবং যে জ্ঞানভ্যাস দ্বারা পরমপদ লাভ হয়, তাতে প্রবৃত্ত করতে যত্ন করি।
রামমোহন আরো বলেছেন আপনার স্ত্রীলোককে মোক্ষসাধনে অযোগ্য জ্ঞান করে সহমরনে প্রবৃত্তি দেন। কিন্তু, যারা সহগমন করেন না, আপনাদের সিদ্ধান্তানুসারে তাদের ইত্যেভ্রষ্টস্ততো নষ্ট হওয়া নিশ্চিত হল।
রাজা রামমোহন রায় এইভাবে প্রতিটি যুক্তি খণ্ডন করে বেণ্টিঙ্কের সহায়তায় বাংলা তথা ভারতবর্ষে একটি কুপ্রথার – যার নাম সতীদাহ, অবলা রমণীর হত্যালীলার যবনিকা পাত করলেন।
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৬-ই জানুয়ারি, বঙ্গাব্দ ১২৩৬ সালের ৪-ঠা মাঘ, রাজা রামমোহন রায় টাউনহলে এক সভা করে লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ককে অভিনন্দন পত্র প্রদান করেন। রামমোহন রায়, কালীনাথ রায়, হরিহর দত্ত এবং অপর কয়েকজন ব্যক্তি কলিকাতা নগরের তিনশত অধিবাসীর পক্ষ হতে গভর্ণর জেনারেলকে প্রদান করেন। দু’খানি অভিনন্দন পত্র লিখিত হয়েছিল। একটি বাংলা ভাষায় ও একটি ইংরেজিতে। বাংলাখানি মূল। ইংরাজিখানি তার অনুবাদ। টাকির সুপ্রসিদ্ধ জমিদার বাবু কালীনাথ রায় মহাশয় বাংলা অভিনন্দন পত্র পাঠ করেন। বাবু হরিহর দত্ত এর ইংরেজি অনুবাদটি পাঠ করলেন।
রামমোহন রায় উক্ত অভিনন্দন পত্রের এরূপ উপসংহার করেছেন – 
“We are, my Lord, reluctantly restrained by the consideration of the nature of your exatted situation, from indicating our inward feelings by presenting any valuable offerings as commonly adopted on such occassions; but we should consider ourselves highly guilty of insincerity and ingratitude if we remained negligently silent when unrently called upon by our feelings and conscience to express publicly the gratitude we feel for the everlasting obligation you have graciously conferred on the Hindoo community at large. We, however, are at a loss to find language sufficiently indicative even of a small portion of the sentiments we are desirous of expressiong on the occassion; we must therefore conclude this address with entreating that your Lordship will condescendingly accept our most grateful acknowledgement for this act of benevolence toward us, and will pardon the silence of those who, though equally partaking of the blessing bestowed by your Lordship, have through ignorance or prejudice omitted to join us in this common cause.”
কিন্তু ধর্মসভা নিশ্চিন্ত থাকল না। সতীদাহ নিবারণ আইন রহিত করবার জন্য বিলাতে আপীল করলেন– 
“The orthodox Hindu leaders of Calcutta at the instance of the Dharma Sabha, made an appeal to the King in Council against Lord William Bentink’s decree abolishing the practice of Suttee. Against this Rammohun drafted and took with him from India a counter-petition and presented it to the House of Commons [Asiatic Journal, May 1831]. The Raja had the satisfaction of being present when the appeal against the abolishing of the inhuman rite was rejected by the Privy Council and the decision announced on the 11th July, 1832.
The Privy Councilors who heard the appeal of the Council Chamber, Whitehall, mere the Lord President of the Council, the Lord Chancellor, the Master of the Rolls, the first Lord of the Admiralty, the Paymaster of the Forces, the Marquis of Wellenley, the Marquis of Lansdowne, Lord Amherst, Lord John Russell, Sir James Graham, Sir L. Shadwell and Sir W.H.East.” The Raja, we read in a contemporary account, “sat near their Lordships.”
কালক্রমে বহমান কুসংস্কার একটি দেশ, জাতি এমনকি শিক্ষিত ব্যক্তিদেরও অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দেয়। সেই অন্ধকারে সেই দেশ তথা সমগ্র জাতির কোন উন্নতি সাধন হতে পারে না। রাজা রামমোহন রায় সেই অন্ধকারময় কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিদগ্ধ গুহা থেকে সমগ্র  জাতিকেই শুধু টেনে বের করেন নি, একটি দেশকে উন্নতির পথ দেখিয়েছেন। রামমোহন রায়ের চিরকালের স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হল – সতীদাহ প্রথা ভারতভূমি থেকে তথা অনাথা অবলা নারীর ললাট থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিল। 
 
 
তথ্যসূত্র:
১. মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত – নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশকাল- পঞ্চম সংস্করণ, আষাঢ় ১৪২০, দে’জ পাবলিশ.     [ page – 171 to 199 ] 
২. Rammohun Roy – Compiled and edited, The Man and His Work by Amal Home and published under the Auspices of the Rammohun Roy Centenary Committee, June 1933.    [page – 41,62] 
৩. Life and Letters of Raja Rammohun Roy – Sophia Doboson collet, Edited by Hem Chandra Sarkar, 1913. Page –      [ 117,118,146 to 150] 
 
৪.  নারী সতীদাহ ও পর্দাপ্রথা – সম্পাদনা – মিতালী হোডেন, ইরাজ হায়দার। প্রকাশক-         নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, প্রকাশকাল – ২০১৪।    [ page  17 to 19]  
৫.   রামমোহন সমীক্ষা – দিলীপ কুমার বিশ্বাস, সারস্বত লাইব্রেরী, প্রকাশকাল – ১৯৮৩।              [page – 470 to 472 ]  
 
 
 
 
                             
 
 
 
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত