| 6 অক্টোবর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য প্রবন্ধ: সা অপি কন্যারূপেণ বিদ্যতে – মৃন্ময়ী সত্ত্বার চিন্ময়ীরূপের প্রকাশ । শ্রীঅর্ঘ্য

আনুমানিক পঠনকাল: 32 মিনিট

“গিরি, গণেশ আমার শুভকারী। 

নিলে তার নাম, পূর্ণ মনস্কাম, 

সে আইলে-গৃহে আসেন শঙ্করী। 

বিল্ববৃক্ষ-মূলে করিব বোধন, 

গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন;

ঘরে এলে চন্ডী, শুন্ বো আমার চন্ডী, 

আসবে কত দন্ডী, যোগী জটাধারী। ” (আগমনী পর্যায়)

উক্তপদটিতে পদকর্তা স্বয়ং শারদীয়া দুর্গোৎসবের প্রাক্কালে বিঘ্নবিনাশক সিদ্ধিদাতা গণেশের সাথে গণেশজননী ভবানীর আহ্বানের মনোবাসনাই ব্যক্ত করেছেন। মাতৃশক্তির আরাধনার ভাব সমগ্র বাংলা তথা ভারতের শিল্প, সংস্কৃতি, সঙ্গীত ও সাহিত্যে সুস্পষ্ট। প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ কৌলশাস্ত্র বা তন্ত্রশাস্ত্র মতে তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা- বিষ্ণুক্রান্তা, রথক্রান্তা ও অশ্বক্রান্তা। শক্তিসঙ্গমতন্ত্রে বিন্ধ্যপর্ব্বতকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষকে এই তিন ক্রান্তার বিভক্ত করা হয়েছে। এই তিনটি ক্রান্তার ভাগ, যথা-

“বিন্ধ্যপর্ব্বমারভ্য যাবচ্চট্টলদেশতঃ।

বিষ্ণুক্রান্তেতি বিখ্যাতা মুণিভিস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।।

বিন্ধপর্বতমারভ্য মহাচীনাবধি প্রিয়ে।

রথক্রান্তেতি বিখ্যাতা মুণিভিস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।।

বিন্ধ্যপর্ব্বতমারভ্য যাবদেব মহোদধিঃ।

অশ্বক্রান্তেতি বিখ্যাতা মুনিভিস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।।”

বিন্ধ্যাচল থেকে পূর্বে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিষ্ণুক্রান্তা, বিন্ধ্যাচল থেকে উত্তর-পশ্চিম ও উত্তরে মহাচীন (নেপাল, কাশ্মীর) অবধি রথক্রান্তা এবং বিন্ধ্যাচল থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত অশ্বক্রান্তা। অখন্ড বৃহৎ বঙ্গ ও তার আশেপাশের এলাকা বিষ্ণুক্রান্তার অন্তর্গত। শক্তিসঙ্গমতন্ত্র মতে, পূর্বে গৌড় মধ্যে কেরল ও পশ্চিমে কাশ্মীর এই তিন সম্প্রদায়ের মোট ছাপ্পান্নটি দেশ জুড়ে সমগ্র ভারতবর্ষের সীমানা নির্দেশ করা আছে-

“কেরলশ্চৈব কাশ্মীরো গৌড়মার্গস্তেতীয়কঃ।ষটপঞ্চাশদ্দেশভেদাৎ সর্বত্র ব্যাপা তিষ্ঠতি।।”

এই তিনটি ক্রান্তার অন্তর্গত গৌড়াদি তিনটি কুলে প্রত্যেকটিতেই ৬৪টি করে মোট ১৯২টি তন্ত্রশাস্ত্র বা কৌলশাস্ত্রের প্রচলন আছে। তন্ত্রে বলা হয়েছে-

“ককারদ্ ব্রহ্মরূপত্বং তৎকাদিমতমীরিতম্। 

হকার শিবরূপত্বং তদ্ধাদিমতমীরিতম্।।

কাদ্যং হাদ্যং মহেশানি কাদ্যং কালীমতং ভবেৎ।

হাদ্য ত্রিপুরাখ্যাং কহাখ্যং তারিণী মতম্।।” 

‘ককার’ ব্রহ্মস্বরূপ (শক্তিস্বরূপ)। যে মতে ‘ক’-বর্ণকে আদি স্বীকার করা হয় তা ‘কাদি’ মত। ‘হকার’ শিবস্বরূপ ,যে মতে ‘হ’-বর্ণকে আদি স্বীকার করা হয় তা ‘হাদি’ মত। কাদিতে ব্রহ্মস্বরূপ (শক্তিস্বরূপ) কালীমত, হাদিতে শিবস্বরূপ ত্রিপুরামত আর কহাদিতে মিশ্রস্বরূপ তারিণীমত প্রচলিত আছে। তাই বিষ্ণুক্রান্তার বা গৌড়কুলের প্রধান উপাস্য দেবী হলেন কালভয়বিনাশিনী দক্ষিণাকালী তাই এটি কালীকুল হিসাবেও প্রসিদ্ধ। অশ্বক্রান্তার বা কেরলকুলের প্রধান উপাস্য দেবী হলেন শ্রীমাতা ষোড়শী তাই এটি শ্রীকুল এবং রথক্রান্তার বা কাশ্মীরকুলের উপাস্য দেবী হলেন নীলসরস্বতী তারা তাই এটি সারদাকুল হিসেবে পরিচিত। কৌলশাস্ত্রের প্রধান হলেন মহাদেব ও মহামায়া। মহামায়া মূলপ্রকৃতিতত্ত্বের অন্তর্গত হওয়ায় তিনি নারী, কন্যা, কুমারী, শক্তি, মাতা ইত্যাদি নামেও আখ্যায়িত। “শক্তি” শব্দের যথার্থতা বিশ্বকোষ থেকে দু’টি অর্থের দ্বারা সুসংহতভাবে নিষ্পন্ন হয়, “ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে শ্রীমচ্ছঙ্করাচার্য্য লিখিয়াছেন- 

“কারণস্যাত্মভূতা শক্তিঃ শক্তেশ্চাত্মভূতং কার্য্যম্।”

অর্থাৎ কারণের যাহা আত্মভূত তাহাই শক্তি এবং শক্তির যাহা আত্মভূত তাহাই কার্য্য। আবার সপ্তপদার্থী সংহিতায় শিবাদিত্য দ্রব্যাদি স্বরূপকেই শক্তি নামে অভিহিত করেছেন। তদ্ যথা-

“শক্তির্দ্রব্যাদিকস্বরূপমেব।” (সপ্তপদার্থী সংহিতা) 

আমরা প্রকৃতিকেও শক্তি বলতে পারি। কেননা যাহা দ্বারা কোন কর্ম্ম নিষ্পন্ন হয়, যাহাতে কার্য্যসাধনের যোগ্যতা আছে তাহাই শক্তি। প্রকৃতি শব্দের বুৎপত্তি সাধনেও আমরা এই অর্থই প্রাপ্ত হই। ‘প্র’ উপসর্গ পূ্র্ব্বক ‘কৃ’ ধাতুর উত্তর কর্তৃবাচ্যে ‘ক্তি’ প্রত্যয় করিয়া ‘প্রকৃতি’ পদ সিদ্ধ হয়। যাহা কিছু উৎপাদন করে বা প্রকৃষ্টরূপে কোন কার্য্য সাধন করে, তাহাই প্রকৃতি।” 

 

 

 

প্রকৃতি বা শক্তি দেবীকে আরাধ্য হিসাবে ধরে নেওয়ার এই ধর্মীয় শাখাকে “শাক্ত” শাখা হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়। এটি ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ্যধর্মের এক অন্যতম প্রধান শাখা। তবে শৈব, বৈষ্ণবাদি ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্যান্য শাখাসমূহেও মাতৃশক্তিকে অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে আরাধনা করা হয়। যিনি সর্বভূতে মাতৃরূপে অধিষ্ঠিতা এবং শক্তিরূপে বিরাজিতা তিনি অখিল ব্রহ্মান্ডের পালিকাশক্তি হওয়া সত্ত্বেও পুরাণাদি শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক লোকসাহিত্যধারায় কখনও তাঁকে বাল্যভাব প্রকাশিনী ঈশ্বরী হিসেবে কখনও বা একৈকা স্বাতন্ত্রা পালিকা শক্তি হিসেবে আবার কখনও সন্তানার্থে বোঝাতে এই শক্তিদেবীকে কুমারী, নারী, পুত্রী ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করা হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধ সেই কন্যা-কুমারীরূপিণী মাতৃকাশক্তির চরণ-কমলেই নিবন্ধিত হল। 

 

 

 

দেবীভাগবত পুরাণের নবম স্কন্ধের প্রথম অধ্যায়ে প্রকৃতি উৎপত্তি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শ্রীনারায়ণ নারদকে বলছেন,

“কলাংশাংশসমুদ্ভূতাঃ প্রতিবিশ্বেষু যোষিতঃ।

যোষিতামবমানেন প্রকৃতেশ্চ পরাভবঃ।।

ব্রাহ্মণী পূজিতা যেন পতিপুত্রবতী সতী।

প্রকৃতিঃ পূজিতা তেন বস্ত্রালঙ্কারচন্দনৈঃ।। 

কুমারী চাষ্টবর্ষা যা বস্ত্রালঙ্কারচন্দনৈঃ। 

পূজিতা যেন বিপ্রস্য প্রকৃতিস্তেন পূজিতা। 

সর্বাঃ প্রকৃতিসম্ভূতা উত্তমাধমমধ্যমা।।”

এই জগতে নারীগণ বা স্ত্রীগণ প্রকৃতির কলাংশের অংশ হতে উৎপন্ন; তাই স্ত্রীগণের অপমানে প্রকৃতির অপমান হয়। যদি কেউ কোনো সধবা পুত্রবতী সতী ব্রাহ্মণকুলবধূকে দেবীজ্ঞানে বস্ত্রালঙ্কার ও চন্দনসহযোগে পূজা করেন, তাতে প্রকৃতি স্বয়ং পূজিতা হন। যদি কেউ অষ্টমবর্ষীয়া ব্রাহ্মণের কুমারী কন্যাকে দেবীজ্ঞানে বস্ত্রালঙ্কার ও চন্দনের দ্বারা পূজা করেন, তাহলে সে পূজা প্রকৃতিই স্বয়ং প্রাপ্ত হন। উত্তম, মধ্যম এবং অধম সকলপ্রকার নারীগণই প্রকৃতি হতে উৎপন্না তাই সকলকেই প্রকৃতির সাথে অভিন্ন জ্ঞান করতে হবে। এই দেবীভাগবত পুরাণেরই সপ্তম স্কন্ধের আটত্রিশতম অধ্যায়ে দেবীর প্রীতিবর্দ্ধক ব্রত-উৎসব ও মানবগণের আবশ্যিক কর্তব্য সম্পর্কে হিমালয় কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হয়ে শ্রীদেবী বলছেন, 

“মদ্ভক্তান ভোজয়েৎ প্রীত্যা তথা চৈব সুবাসিনীঃ। 

কুমারীবটুকাংশ্চাপি মদ্বুদ্ধ্যা তদ্গতান্তরঃ।

বিত্তশাঠ্যেন রহিতো যজেদেতান্ সুমাদিভিঃ।।

য এবং কুরুতে ভক্ত্যা প্রতিবর্ষমতন্দ্রিতঃ।

স ধন্য কৃতকৃত্যোহসৌ মৎপ্রীতে পাত্রমঞ্জসা।।”

বিত্তশাঠ্য বা কৃপণতা না করে সুবাসিনীগণ (সধবা সবৎসা স্ত্রীগণ), কুমারীগণ ও বটুকগণকে (ব্রাহ্মণকুমারগণকে) আমার (দেবীর) স্বরূপবোধে ভক্তিবিনম্র চিত্তে শাস্ত্রোক্ত বিধানানুসারে পূজা করবে। যে ব্যক্তি প্রত্যেকবর্ষে অতন্দ্রিতভাবে এরূপ আমার উৎসব করতে পারে, সেই ব্যক্তি ধন্য, কৃতার্থ ও আমার পরম প্রীতিকর পাত্র হয়ে থাকে। আলোচ্য উদ্ধৃতাংশ দুটিতে পরমেশ্বরী মাতৃশক্তির সাথে সকল নারী জাতিকেই দেবীজ্ঞানে ভক্তি করার কথাই বলা হয়েছে। তাইতো সাধক কবি রামপ্রসাদ গেয়েছেন, 

“মা বিরাজে ঘরে ঘরে ।

এ কথা ভাঙিব কি হাঁড়ি চাতরে ॥

ভৈরবী ভৈরব সঙ্গে, শিশু সঙ্গে কুমারী রে ।

যেমন অনুজ লক্ষণ সঙ্গে

জানকী তার সমিভ্যারে ॥

জননি, তনয়া, জায়া, সহোদরা, কী অপরে,

রামপ্রসাদ বলে, বলব কী আর,

বুঝে লও গে ঠারেঠোরে ॥”

 

 

 

দেবীভাগবত পুরাণের তৃতীয় স্কন্ধের ছাব্বিশতম অধ্যায়ে মানবগণের আবশ্যিকভাবে অনুষ্ঠেয় নবরাত্রব্রতের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে কুমারী পূজার প্রসঙ্গে শ্রীব্যাসদেব জনমেজয়কে বলছেন, 

“নিত্যং ভূমৌ চ শয়নং কুমারীণাঞ্চ পূজনম্।

বস্ত্রালঙ্কারণৈর্দিবৈ্যর্ভোজনৈশ্চ সুধাময়ৈঃ।।

একৈকাং পূজয়েন্নিত্যমেকবৃদ্ধ্যা তথা পুনঃ।

দ্বিগুণং ত্রিগুণং বাপি প্রত্যেকং নবকঞ্চ বা।। 

বিভবস্যানুসারেণ কর্ত্তব্যং পূজনং কিল। 

বিত্তশাঠ্যং ন কর্ত্তব্যং রাজঞ্ছক্তিমখে সদা।। 

একবর্ষা ন কর্ত্তব্যা কন্যা পূজা বিধৌত নৃপ।

পরমজ্ঞা তু ভোগানাং গন্ধদীনাঞ্চ বালিকা।। 

কুমারিকা তু চ প্রোক্তা দ্বিবর্ষা যা ভবেদ্বিহ।

ত্রিমূর্তিশ্চ ত্রিবর্ষা চ কল্যাণী চতুরব্দিকা।।

রোহিণী পঞ্চবর্ষা চ ষড়্বর্ষা কালিকা স্মৃতা। 

চন্ডিকা সপ্তবর্ষা স্যাদষ্টবর্ষা চ শাম্ভবী।।

নববর্ষা ভবেদ্দুর্গা সুভদ্রা দশবার্ষিকী।

অত উদ্ধং ন কর্ত্তব্যা সর্ব্বকার্য্যবিগর্হিতা।।”

প্রত্যহ ভূমিতে শয়ন এবং প্রত্যহ বস্ত্রালঙ্কার ও অমৃতায়মান সুমিষ্ট খাদ্যদ্রব্যের দ্বারা কুমারীকে পূজা করা কর্ত্তব্য। প্রত্যহ এক একটি করে কিংবা প্রত্যহ এক একটি করে বৃদ্ধি করে অথবা প্রত্যহ দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ করে বৃদ্ধি করে কিংবা প্রত্যেকদিন নয়টি করে কুমারীর পূজা করা কর্তব্য। এহেন শক্তির উপাসনায় কৃপণতা করা উচিত নয়, নিজ সামর্থ্যানুসারেই করা উচিত। কুমারী পূজায় একবছর বয়সী কন্যা গ্রহণযোগ্যা নয়। কারণ সে গন্ধাদি বিবিধভোগ্য বিষয়ে অনভিজ্ঞা তাই। দু’বছর বয়স্কা কন্যাকে কুমারী বলে জানবে এবং ক্রমশ তিনবছর বয়স্কা ত্রিমূর্তি, চার বছর বয়স্কা কল্যাণী, পঞ্চমবর্ষীয়া কন্যা রোহিণী, ছ’বছর বয়স্কা কন্যা কালিকা, সাত বছরের মেয়েকে চন্ডিকা, আট বছরেরকে শাম্ভবী, নয় বছরেরকে দুর্গা এবং দশ বছরের বালিকাকে সুভদ্রা বলা হয়। এর অতিরিক্ত বয়স্কা কন্যা কুমারীজ্ঞানে পূজ্যা নয় অর্থাৎ প্রাক-কৈশোরী কন্যাই এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। অন্যত্র রুদ্রযামল তন্ত্রের ষষ্ঠপটলে কুমারী পূজা প্রসঙ্গে মহাভৈরব আনন্দভৈরবকে বলছেন, 

“কুমারী ভোজিতা যেন ত্রৈলোক্যং তেন ভোজিতম্। 

একবর্ষা ভবেৎ সন্ধ্যা দ্বিবর্ষা চ সরস্বতী।। 

ত্রিবর্ষা চ ত্রিধামূর্তিশ্চতুর্বর্ষা তু কালিকা। 

সুভগা পঞ্চবর্ষা তু ষড্বর্ষা চ হ্যুমা ভবেৎ।। 

সপ্তভির্মালিনী প্রোক্তা হ্যষ্টবর্ষা চ কুব্জিকা। 

নবভিঃ কালসন্দর্ভা দশভিশ্চাপরাজিতা।। 

একাদশা তু রুদ্রাণী দ্বাদশাব্দা তু ভৈরবী। 

ত্রয়োদশা মহালক্ষ্মী দ্বিসপ্তা পীঠনাশুকা।। 

ক্ষেত্রজ্ঞা পঞ্চদশভিঃ ষোড়শে চাম্বিকা ভবেৎ।

এবং ক্রমেণ সম্পূজ্য যাবৎপুষ্পং ন জায়তে॥

প্রতিপদাদি পূর্ণান্ত বৃদ্ধিভেদেন পূজয়েৎ।

মহাপর্বসু সর্বেষু বিশেষাচ্চ পবিত্রকেূ

মহানবম্যাং দেবেশি কুমারীশ্চ প্রপূজয়েৎ।

তস্মাৎ ষোড়শপর্যন্তং যুবতীতি প্রচক্ষতে।।”

কুমারী আহার গ্রহণ করলে ত্রিলোকের আহার করা হয়ে যায় বা ত্রিলোকের সকলেই তৃপ্ত হয়। এক বছর বয়স্কার নাম সন্ধ্যা ও দু’বছর বয়স্কার নাম সরস্বতী। তিন বছর বয়স্কা হলেন ত্রিধামূর্তি ও চার বছর বয়স্কার হলেন কালিকা। সুভগা হলেন পাঁচ বছর বয়স্কা ও ছয় বছর বয়স্কা হলেন উমা। সাত বছর বয়সী কন্যার নাম মালিনী, আর আট বছর বয়সী কন্যার নাম কুব্জিকা। নবমবর্ষীয়া হলেন কালসন্দর্ভা এবং দশমবর্ষীয়া হলেন অপরাজিতা। এগারো বছর বয়স্কা রুদ্রাণী এবং বারো বছর বয়স্কা ভৈরবী। তেরোতম বছরের বালিকা হলেন মহালক্ষ্মী ও চৌদ্দতম বছর বয়স্কা পীঠনায়কা। ক্ষেত্রজ্ঞা পঞ্চদশতম বছরের বালিকা এবং ষোড়শতম বছরের কন্যা হলেন অম্বিকা। যতদিন না পর্যন্ত বালিকারা পুষ্পবতী বা পুর্ণ-রজঃবতী না হচ্ছেন ততদিন পর্যন্ত এঁনাদের এইক্রমে পূজো করা উচিত। প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা অবধি চন্দ্রকলা বৃদ্ধির ক্রমানুসারে পূজা করা উচিত। সকল মহান উৎসবে, বিশেষ করে পবিত্র দিনে, মহানবমী তিথিতে দেবীজ্ঞানে কুমারীর আরাধনা করা উচিত। তাই ষোড়শবর্ষীয়া কন্যাকে যুবতী বলা হয়ে থাকে। এইতন্ত্রের সপ্তম পটলে গ্রহণীয়া পূজ্যা কুমারী-কন্যার বিষয়ে বলা হচ্ছে, 

“কন্যাং দেবকুলোদ্ভূতাং রাক্ষসীং বা নরোত্তমাম্। 

নটীকন্যাং হীনকন্যাং তথা কাপালিকন্যকাম্।। 

রজকস্থাপি কন্যাং তে তথা নাপিতকন্যকাম্।

গোপালকন্যকাশ্চৈব তথা ব্রাহ্মণকন্যকাম্।। 

শুদ্রকন্যাং বৈশ্যকন্যাং তথা বণিক্কন্যকাম্। 

চন্ডালকন্যকাং বাপি যত্র কুত্রাশ্রমে স্থিতাম্।। 

সুহৃদ্দর্গস্থ কন্যাং চ সমানীয় প্রযত্নত। 

পূজয়েৎ পরমানন্দৈরাত্মধ্যানপরায়ণঃ।।”

কন্যা দেবকুলজাত হোক, রাক্ষসকুলজাত হোক কিংবা উত্তম মানবকুলজাত হোক; নটীকন্যা হীনবংশীয়া কন্যা কিংবা কাপালিককন্যা হোক। সে রজককন্যা কিংবা নাপিতকন্যা কিংবা গোপকন্যা অথবা ব্রাহ্মণকন্যা হোক; সে শুদ্রকন্যা, বৈশকুলোদ্ভবকন্যা কিংবা বণিককন্যা হোক। চন্ডালকন্যা কিংবা নিজকুলজাতা কোনো কন্যা হোক। সকলেই দেবীজ্ঞানে সমানভাবে পূজ্যা। তাই এঁদের প্রত্যেকেই পরমানন্দ সহকারে আত্মধ্যানপরায়ণ হয়ে পূজো করা উচিত। 

 

 

 

যোগিনীতন্ত্রের সপ্তদশ পটলে বিষ্ণুর ব্রহ্মশাপজাত দেহমল থেকে উৎপন্ন কোলাসুরের বধ হেতু দেবী কালীর কুমারীরূপে আবির্ভাবের প্রসঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেবীকে বলছেন,

“ততো বিষ্ণুর্দয়ো দেবাঃ কালীং গত্বা সনাতনীম্।

তুষ্টুবুর্ভক্তিযোগেন রক্ষ রক্ষেতি বাদিনঃ।।

শ্রীকাল্যুবাচ। 

ইদানীং রে বৎস বিষ্ণো হন্মি কোলান্ সবান্ধবান্।

কোলানগরমাস্থায় কুমারীরূপমাস্থিতা।।”

বিষ্ণু আদি সকল দেবগণ সনাতনী কালীর নিকট গিয়ে “রক্ষ রক্ষ” ইত্যাদি বাক্যে ভক্তিপূর্বক স্তবস্তুতি করলেন। তখন দেবী কালী সন্তুষ্টা হয়ে বললেন যে হে বৎস! বিষ্ণু! বর্তমানে আমি (তিনি) কুমারীরূপ ধারণ করে কোলানগরীতে গমন করব এবং সবান্ধবে কোলাসুরকে বধ করব। সেই কথামত ভগবতী কালিকা ব্রাহ্মণ কুমারীর বেশে কোলাসুরের কাছে আহার্য্য দ্রব্য প্রার্থনা করার ছলনায় তাকে সসৈন্য সবান্ধবে আহার করেন এবং কোলাসুরকে বধ করেন। এই পটলেই শিব মহাদেবীকে কুমারী পুজো প্রসঙ্গে বলছেন, 

“পূজিতা তৈঃ কুমারী সা কুসুমৈর্নন্দনোদ্ভবৈঃ। 

সর্ব্বলোকৈঃ পূজিতা চ কুমারী সা গৃহে গৃহে।।”

সকল দেবতারা মিলিত হয়ে হৃষ্টচিত্তে নন্দনকাননোদ্ভব পুষ্প-চন্দনে সেই কুমারীর পূজো করলেন। তারপর থেকে সমস্তলোকে এবং গৃহে গৃহে কুমারী দেবীজ্ঞানে পূজিতা হলেন। বৃহদ্ধর্ম পুরাণের শারদীয়া দুর্গোৎসবের অকাল বোধন প্রসঙ্গেও সনাতনী মহামায়ার বাল্যরূপের বা কুমারীরূপের সন্ধান পাওয়া যায়, তথায়-

“দেব্যুবাচ- এবমুক্তা তদা দেবী সত্ত্বরূপা সনাতনী। 

কন্যারূপে দেবনামক্রতো দর্শনং দদৌ।

দেবা ঊচুঃ- ত্বাং নমস্যামহে দেবীং দয়ার্দ্রহৃদয়াং শিবাং। ইত্যাদি- ভয়েভ্যস্ত্রাহি নোহম্বিকে। 

কন্বোবাচ- দেবা ব্রহ্মাদয়ঃ সর্ব্বে পরিতুষ্টাস্মি বৈ ধ্রুবম। 

দুর্গয়া প্রেরিতাচাহং শৃণুষ্ব যদ্ ব্রবীমি বঃ। 

শ্বো বিল্ববৃক্ষে তাং দেবীং বোধয়িষ্যথ সম্প্রতি।

যুষ্মাকমুপরোধেন বোধনং সা গমিষ্যতি। 

স্তুত্বা প্রণম্য সংবোধ্য পূজয়িষ্যথ তাং শিবাং।

ভবিতা কার্য্যসিদ্ধির্বো রাজস্য চ মহাত্মনঃ।”

দেবী বলছেন যে (জগজ্জননীর কৃপা ছাড়া রাম কর্তৃক রাবণ বধ অসম্ভব জেনে) ব্রহ্মাসহ দেবগণ চিন্তিত হৃদয়ে ভক্তিপূর্বক দেবীর স্তব করায় ভগবতী কৃপাবশত কুমারী কন্যার রূপে দেবগণকে দর্শন দিলেন। ভগবতীর আবির্ভাব হেতু দেবগণ আনন্দিত হয়ে দয়ার্দ্রহৃদয়া পরমানন্দস্বরূপা ব্রহ্মসনাতনী দেবীকে স্তব-স্তুতির মাধ্যমে প্রণাম করলেন। কুমারীরূপা দেবী সন্তুষ্টা হয়ে দেবগণকে জানালেন তিনি ভগবতী দুর্গাদেবীর দ্বারা প্রেরিতা। আগামীকাল বিল্ববৃক্ষে ভগবতী দুর্গাকে বোধন করলে দেবগণ কর্তৃক তিনি বোধিতা (জাগ্রত) হবেন। বোধন স্তব ও পূজা দ্বারা ভগবতী শিবাকে আরাধনা করলে অচিরেই দেবগণের ও মহাত্মা রামের রাবণবধ কার্য্য সিদ্ধ হবে। (পুনরায়), “দেব্যুবাচ- পৃথিবীতলমাসাদ্য ব্রহ্মা দেবগণৈঃ সহ।

নির্জ্জনে কাপি দৃশ্য বিল্ববৃক্ষং সুদুর্গমে। 

তস্যৈকপত্রে রুচিরে সুচারু-নবমালিকাং।

নিদ্রিতাং তপ্তহেমাভাং বিম্বোষ্ঠীং তনুমধ্যমাং। 

অনাবৃতাঙ্গাং নিশ্চেষ্টাং রুচিরাং নবমালিকাং। 

বিরিঞ্চিরথ তাং দৃষ্ট্বা বিস্মিতস্তর্চ্চরিত্রবিৎ। 

তুষ্টাব ভূয়ঃ প্রণতঃ সর্ব্বৈ দেবগণৈ সহ।”

দেবী বলেছেন ব্রহ্মাসহ দেবগণ সুদুর্গম এক নির্জ্জন স্থানে বিল্ববৃক্ষ দেখলেন। সেই বিল্ববৃক্ষের একটি মনোহরপত্রে প্রত্যক্ষ করলেন এক তপ্তকাঞ্চনবর্ণা সুচারু নবমালাবিভূষিতা বিম্বফলের ন্যায় রক্তিমাভ অধর-বিশিষ্টা কৃশাঙ্গী সুরুচিরা অচিরপ্রসূতা বালিকা নিদ্রিতা; তিনি গভীর নিদ্রায় নিশ্চেষ্টা এবং নগ্নাও বটে। দেবীকে এরূপ দেখে দেবীর-চরিত্রজ্ঞ ব্রহ্মা বিস্মিত হলেন এবং সমস্ত দেবগণের সাথে তাঁর নিদ্রাভঞ্জনের নিমিত্ত স্তব-স্তুতির দ্বারা দেবীর কাছে প্রার্থনা জানালেন। 

“দেব্যুবাচ-

এবং স্তোত্রৈঃ সা প্রবুদ্ধা মহেশী

বাল্যং ত্যক্ত্বা সা যুবতাস্তু সদ্যঃ। 

নিদ্রাং ত্যক্ত্বা চোত্থিতা দৈবতানাং

দৃষ্টিং প্রাপ্তা চোগ্রচন্ডেতি নাম্না।। “

দেবী বলেছেন, সেই মহেশ্বরী ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবগণের দ্বারা প্রবুদ্ধা হয়ে তৎক্ষণাৎ বালিকারূপ পরিত্যাগ করে যুবতীরূপ ধারণা করলেন। তিনি নিদ্রা পরিত্যাগ করে উগ্রচন্ডা রূপে দেবগণের দৃষ্টিপথবর্ত্তিনী হয়ে উঠলেন। 

 

 

 

তাহলে কুমারী কন্যা বা বালিকা যে দেবীর সাথে অভেদজ্ঞানে বন্দনীয়া তা উপরিউক্ত শাস্ত্র বাক্যসমূহের দ্বারাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। যদিও তত্ত্বের দিক থেকে ব্যাখ্যা করতে গেলে “শক্তি”-র কৌমারীত্ব সত্তার যথার্থতা বোধগম্য হয়; জীবের মধ্যে সাধারণ অবস্থায় যে সুপ্ত ইচ্ছাশক্তিরূপা ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকে তাই সঠিক অনুশীলনের দ্বারা বা সাধনার দ্বারা সাধকের মানসে পূর্ণরূপে প্রকাশিতা হন। মানবী কুমারী-বালিকাকে দেবীজ্ঞানে ভজনার দ্বারাই সেই উদ্দেশ্যে সম্যকভাবে চরিতার্থ হয়। তাই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, “শুদ্ধাত্মা কুমারীতে দেবী বেশী প্রকাশ পায়। কুমারী পূজার মাধ্যমে নারী জাতি হয়ে উঠবে পূত-পবিত্র ও মাতৃভাবাপন্ন, শ্রদ্ধাশীল।” তাঁর এই ভাবনার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখতে পাই স্বামী বিবেকানন্দের জীবন ইতিহাসে। স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারী পূজা করেন ১৮৯৮ সালে, তাঁর কাশ্মীর ভ্ৰমণকালে। তিনি যখন ১৮৯৮ সালে কাশ্মীর ভ্রমণে গিয়েছিলেন, তখন তিনি ঝিলাম নদীর ধারে এক মুসলমান মাঝি “ইব্রাহিম “-এর সাত কিংবা আট বছরের কন্যা “সাবিহা”-কে কুমারীরূপে পূজা করেছিলেন এবং ভক্তিবিনম্র চিত্তে মাতৃজ্ঞানে তাঁর উদাত্ত কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল “সুসংকাশা মাতৃমৃষ্টেব যোষাবিস্তন্বং কৃণুুষে দৃশে কম্……….।”-ইত্যাদি বৈদিক মন্ত্র (ঋগ্বেদের ১/১২৩/১১ নং সূক্ত) । তাঁর উচ্চারিত এই উদ্ধৃত বৈদিক মন্ত্রের অর্থ হল “যেন মায়ের নিজের হাতে সাজিয়ে দেওয়া সুরূপা কন্যাটি মানুষের দৃষ্টির সামনে নিজের তনু প্রকাশ করছে……..।”। শাস্ত্ররীতিতে সাধারণত ব্রাহ্মণবংশীয়া কুমারী কন্যাকেই দেবীজ্ঞানে পূজার প্রথা রয়েছে (যদিও এবিষয়ে শাস্ত্রান্তরে অনেক মতভেদ আছে)। কিন্তু তিনি সমস্ত রীতির উর্ধ্বে গিয়ে পূজা করেছেন এক মুসলমানবংশীয়া-কন্যাকে বা তথাকথিত যবন-কন্যাকে। তখন তিনি জাতপাতের বাহ্যসংস্কারের উর্ধ্বে গিয়ে সাক্ষাৎ চিন্ময়ী দেবীর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। দেবীত্ব কেবল ব্রাহ্মণত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বা দেবীত্ব ও মাতৃত্ব কারোর একচেটিয়া সম্পদ নয়। মাতৃত্ব ও দেবীত্ব প্রতিটি নারীর আজন্ম সম্পদ। স্বামীজীর ধ্যানে ও দর্শনে তা প্রমাণিত। তাই তিনি মুসলমান-কন্যার মধ্যে দেবীত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন। স্বামীজী এই পূজার দ্বারা যেন একটা নূতন দিগন্তের উন্মোচন করেছিলেন। সমস্ত প্রথাবদ্ধ সামাজিক রীতি-নীতির উর্ধ্বে গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক নতুন সাম্যের নীতি। ১৮৯৯ সালে তিনি কন্যাকুমারী শহরে ডেপুটি একাউণ্ট্যাণ্ট জেনারেল মন্মথ ভট্টাচার্যের কন্যাকে কুমারীরূপে পূজা করেছিলেন। ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা ও কুমারীপূজা শুরু করেছিলেন; সেই সময় বেলুড় মঠের প্রথম কুমারী পুজায় স্বামী বিবেকানন্দ নয় জন কুমারী কে পূজা করেছিলেন। এখন বেলুড়মঠে একজনকেই কুমারীজ্ঞানে পূজো করা হয়ে থাকে। স্বামীজীর দিব্যদৃষ্টিতে সকল কুমারীই দেবীর এক-একটি রূপ। সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই তিনি পূজা করেছিলেন ৯ জন কুমারীকে শারদীয়া দুর্গোৎসবের মহাষ্টমী তিথিতে। স্বামীজী প্রতিটি কন্যাকে ভক্তিভরে পূজা করেছিলেন। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেছিলেন শ্রদ্ধাভরে। এই নয়জন কন্যার মধ্যে একজন ছিলেন গৌরীমার পালিতা কন্যা দুর্গামা। যাঁর কপালে টিপ পরাতে গিয়ে স্বামীজি স্বয়ং ভাবাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। চন্দনের টিপ পরানোর সময় তিনি ভাবে শিহরিত হয়েছিলেন। আবেগভরে তিনি বলেছিলেন- “ আঃ! দেবীর বোধ হয় তৃতীয় নয়নে আঘাত লেগে গেল।” তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিই সঠিক ছিল। আমাদের দুটো চোখ থাকলেও, তৃতীয় চোখ থাকে দেবী দুর্গার। তিনি সেই কুমারীর মধ্যে তৃতীয় নয়ন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে তিনি যেমন ‘সেদিন দুর্গারূপে প্রতিষ্ঠিতা’ হয়েছিলেন; পরবর্তীকালেও সেই কন্যা দুর্গামা নামে পরিচিতা হয়েছিলেন। স্বামীজীর স্নেহধন্যা ছিলেন এই কন্যা। স্বামীজীর কুমারীপূজায় যেন সত্যি সত্যিই দুর্গামারূপে তিনি পরিগণিতা হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে ‘দুর্গামা’ অধ্যক্ষারূপে প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন সারদেশ্বরী আশ্রমে। স্বামীজীর অন্তর্দৃষ্টি যেন বাস্তবায়িত হয়েছিল এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। তিনি নারীজাতির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা নিদর্শন করেছেন এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, তাই আজও সেই পরম্পরাকে স্মরণে রেখে বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও অন্যান্য শাখা রামকৃষ্ণ মঠে শারদীয়া দুর্গাপূজার মহাষ্টমী তিথিতে জীবন্ত কন্যাকে কুমারীজ্ঞানে পূজা করার যে প্রচলন তা স্বামীজীরই নির্দেশিত পথ। কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হল নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে ত্রিশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের ক্রিয়া ঘটিয়ে চলেছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী কন্যাতে দেবীভাব আরোপ করে তাঁর সাধনা করা হয়। এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্ববন্দিতা কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করেন; তার নিকট নারী তখন ভোগ্যা নয়, হন শুধু পূজ্যা।

 

 

 

প্রাচীনকালে বেদে এবং শ্রৌত সাহিত্যসমূহে “নারী” শব্দটিকে “নর” শব্দের স্ত্রীবাচক শব্দ হিসাবে ব্যবহার করা হত না বলেই মনে হয় তাই যাস্কের নিরুক্তেও “নারী” শব্দটিকে সর্বময়ী কর্ত্রী (বা পারিবারিক নেত্রী) হিসেবে বলা হয়েছে। তাই নারীরূপিণী প্রকৃতিই সর্বময়ী কর্ত্রী- রূপে স্বীকার্য। মার্কণ্ডেয় মহাপুরাণান্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীর দশম অধ্যায়ে নিশুম্ভ বধের পরে রণোন্মত্ত শুম্ভের সাথে যুদ্ধের প্রাক্কালে অম্বিকা দেবী সাবধান বাণী করে বলছেন, –

“একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।

পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।।”

অর্থাৎ রে দুষ্ট! আমি একলাই আছি! আমি ছাড়া এজগতে আর কে আছে ? দেখ, এই সবই (ব্রহ্মাণী আদি মাতৃকাগণ) আমারই বিভূতি, তাই এরা আমার মধ্যেই বিলীন হচ্ছে। “শ্রীশ্রীচণ্ডী”-এর এই ভাবনার প্রতিধ্বনি দেখতে পাই পঞ্চদশ শতকের উল্লেখযোগ্য ওড়িয়া কবি শূদ্রমুনি সারলা দাসের রচিত “চন্ডী-পুরাণ” কাব্যগ্রন্থে; এখানে দেবী চন্ডী যুদ্ধের পূর্বে অসুরের প্রতি বলছেন, 

“আরে আহ্মে জাতকালে মাতা রূপ হেউঁ। 

যুবাকালে ভার্য্যা রূপে রতিরঙ্গ দেউঁ।। 

অন্তকালে হেউঁ পুন কালিকা মূরতি। 

দহন করুঁ সকল গেলই দহতি।। 

আদি অন্ত মধ্য আহ্মমানঙ্কর নাহিঁ। 

সমস্ত করুঁ আহ্মকু কেহ ন জাণই।। 

জন্মকালে তুহ্মঙ্ক করীউঁ উৎপন্ন। 

অন্তকালে সমস্তঙ্কুঁ করিবুঁ ভক্ষণ।। 

অজ্ঞান মুর্খপণে ন জাণ মন্দ বাই। 

আহ্মে যে পরম যোগিনী আদি মহামায়ী।।” এই একই তত্ত্বের অবতারণা দেখতে পাই ষোড়শ শতাব্দীর রাঢ়-বাংলার বিশিষ্ট কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী-এর রচিত “চন্ডী-কাব্য”-এর “কমলে কামিনী বর্ণনা”-তে:

” অপরূপ দেখ আর, ওহে ভাই কর্ণধার, 

কামিনী কমলে অবতার। 

ধরি রামা বাম করে, সংহারয়ে করিবরে, 

উগারিয়া করয়ে সংহার।। 

কনক-কমল-রুচি, স্বাহা স্বধা কিবা শচী, 

মদনসুন্দরী কলাবতী।

সরস্বতী কিবা উমা, চিত্রলেখা তিলোত্তমা

সত্যভামা রম্ভা অরুন্ধতী।।” 

সাক্ষাৎ বুদ্ধিরূপা দেবী চন্ডীই, মায়ায় আবিষ্ট ভ্রমে-মত্ত বুদ্ধিরূপী গজ ভক্ষণের মাধ্যমে ভক্তের ত্রাণকারিণী আবার মদে-মত্ত বিষয়বু্দ্ধিরূপী গজের উদগিরণের দ্বারাই মায়াপাশে বন্ধনকারিণী। তাইতো তিনি “বুদ্ধিরূপা বুদ্ধিহরা সংসারতারিণী। বন্ধন স্থানেতে হও বন্ধনহারিণী”।

 

 

 

কৃষ্ণযজুর্বেদীয় শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্ প্রথম অধ্যায়ে তৃতীয় শ্লোকে উল্লিখিত আছে-

“তে ধ্যানযোগানুগতা অবশ্যম্ভাবী

দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈর্নিগূঢ়াম্। 

যঃ কারণানি নিখিলানি তানি

কালাত্মযুক্তান্যধিতিষ্ঠত্যেকঃ।।”

যে অদ্বিতীয় পরমাত্মা কাল ও জীব (কাল, স্বভাব, নিয়তি, যদৃচ্ছা, পঞ্চভূত অথবা বিজ্ঞানাত্মা ইত্যাদি) প্রভৃতি পূর্বোক্ত নিখিল কারণকে যথানিয়মে পরিচালিত করেন, সেই দেবের স্বাত্মভূত ত্রিগুণাত্মিকা শক্তিকেই (উক্ত) ব্রহ্মবাদিগণ সমাধি সহায়ে পরমাত্মার জগৎকারণত্বের সহায়রূপে দর্শন করেছিলেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও বলা হয়েছে, “দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে, মূর্তঞ্চামূর্তঞ্চ”। এই অমূর্তই নির্গুণ অবস্থা এবং মূর্তই সগুণ। সগুণরূপেই তো মায়ের মূর্তি। সগুণ রূপ হতেই তো আমরা জাত, সগুণেই প্রতিপালিত ও বিধৃত, তাই সগুণই মাতা। এই প্রসঙ্গে কবীরের নামে একটি বাণী প্রচলিত আছে, – “নির্গুণ হৈ পিতা হমারা সগুণ মহতারী” অর্থাৎ নির্গুণ হলেন আমার পিতা ও সগুণ হলেন আমার মা। এই কথাটি আসলে শক্তিবাদের মূল কথা। তাই কবীরের এই বাণীটি অত্যন্ত সারগর্ভ। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব শক্তিকে অচলের ‘চল’ বা অটলের ‘টল’ বলেছেন। অচল অটলই হল নির্গুণ, ‘চল’ ও ‘টল’-ই হল সগুণ অবস্থা। 

 

 

 

সামবেদীয় কেনোপনিষদের তৃতীয় ও চতুর্থ খন্ডের উল্লিখিত প্রসঙ্গ ভগবতীর পূর্বোক্ত “নারী” অভিধার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ বলা যেতে পারে। দেবাসুর সংগ্রামে দেবতাদের বিজয় লাভের ফলে দেবতারা ত্রিলোকে মহিমান্বিত হলেন। তাঁরা মনে করলেন যুদ্ধ জয়ের শ্রেষ্ঠত্ব তাঁদেরই। বস্তুতপক্ষে এই সমস্ত ঘটনাই কার্য্যকারণরূপ ব্রহ্মের দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়েছে। ব্রহ্ম এই সমস্ত বিষয়ে অবগত থাকায় তিনি দেবতাদের সুচৈতন্য প্রদানের জন্যে তাঁদের মঙ্গলার্থে যক্ষ হয়ে দেবতাদের ইন্দ্রিয়গোচর হলেন। এহেন পরিস্থিতিতে অনভিজ্ঞ দেবতাগণ যক্ষের পরিচয় জানতে উদ্যত হলেন। যক্ষরূপী ব্রহ্ম দেবতাদের সম্মুখে একটি তৃণ স্থাপণ করে তাঁদের সামর্থ্যের পরীক্ষা দিতে বললেন। অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্রাদি দেবগণ সেই পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ও বিস্মিত হলেন। সেইহেতু ইন্দ্র যক্ষের পরিচয় জানতে উদ্যত হলে যক্ষ সেখান থেকে তিরোহিত হলেন এবং ইন্দ্র দেখলেন-

“স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়মাজগাম বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীম্। তাং হোবাচ-কিমেতদ্ যক্ষমিতি।।” (ইতি তৃতীয়ঃ খন্ড) 

ইন্দ্র সেই আকাশেই সুবর্ণালাঙ্কার-ভূষিতা নারীর ন্যায় অতি সুশোভন স্ত্রীরূপিণী উমা (বা ব্রহ্মবিদ্যা) -এর সকাশে উপস্থিত হলেন। তাঁকে প্রশ্ন করলেন- “এই পূজনীয়স্বরূপ কে? “

(প্রত্যুত্তরে) “সা ব্রহ্মের হোবাচ, ব্রহ্মণা বা এতদ্বিজয়ে মহীধ্বমিতি ততো হৈব বিদাঞ্চকার ব্রহ্মেতি।। (১) 

তস্মাদ্ বা এতে দেবা অতিতরামিবান্যান্ দেবান্- যদগ্নির্বায়ুরিন্দ্রন্তে হ্যেনন্নেদিষ্ঠং পস্পৃশুস্তে হ্যেনৎ প্রথমে বিদাঞ্চকার ব্রহ্মেতি।। (২) 

তস্মাদ্বা ইন্দ্রোহতিতরামিবান্যান্ দেবান্ স হ্যেনন্নেদিষ্ঠং পস্পর্শ, স হ্যেনৎ প্রথমো বিদাঞ্চকার ব্রহ্মেতি।। (৩) 

তস্যৈষ আদেশো-যদেতাদ্বিদ্যুতো ব্যদ্যুতদা ইতীন্ন্যমীমিষদা-ইত্যাধিদৈবতম্।। (৪) ” (ইতি চতুর্থঃ খন্ডঃ) 

সেই উমা বললেন-“ইনি ব্রহ্ম; ব্রহ্মেরই এই বিজয়ে তোমরা নিজেদের মহিমান্বিত মনে করছ। ” সেই উমাবাক্য হতেই ইন্দ্র জানলেন যে উনি ব্রহ্ম। (১) যেহেতু তাঁরা বা অগ্নি আদি দেবতারা এঁনাকে স্পর্শ করেছিলেন এবং তাঁর সম্মুখবর্তী হয়ে ওঁনাকে ব্রহ্ম বলে জেনেছিলেন সেইজন্যেই অগ্নি আদি দেবতারা অন্যান্য দেবতাদের থেকে অধিকতর উৎকর্ষ লাভ করেছিলেন। (২) যেহেতু ইন্দ্র ওঁনাকে নিকটতমরূপে স্পর্শ করেছিলেন এবং তিনি সর্বাগ্রণী হয়ে ওঁনাকে ব্রহ্ম বলে জেনেছিলেন, সেইজন্যেই ইন্দ্র অন্য দেবগণ অপেক্ষা অধিকতর উৎকর্ষ লাভ করতে পেরেছিলেন। (৩) সেই ব্রহ্মবিষয়ে এই উপদেশ-এই যে বিদ্যুৎপ্রভা চমকে উঠল, এর সদৃশ; আর এই যে চোখের নিমেষ হল, এর সদৃশ-এইরূপেই ব্রহ্মের অধিদৈবত্ব বিষয়ক উপদেশ কথিত হল। (৪) এই জগতের সমস্ত পদার্থই এক ও অভিন্ন ব্রহ্মের থেকেই উৎপন্ন হয়ে তাতেই লয় প্রাপ্ত হচ্ছে। তাই অখিল বিশ্বের সমস্ত কিছুই ব্রহ্মেরই স্বরূপ। এই ব্রহ্মই স্বেচ্ছায় অঘটন-ঘটন-পটিয়সীরূপে সকল কার্য্য সম্পাদন করছেন। এখানে দেব দানব মনুষ্যাদি জীবগণ নিমিত্ত মাত্র। আর গুণত্রয়বিভাবিণী অখিল বিশ্বের পালিকা শক্তি “স্ত্রীরূপিণী হৈমবতী উমা”-এই হলেন সাক্ষাৎ ব্রহ্মবিদ্যা। পরবর্তীতে পুরাণতন্ত্রাদি শ্রৌতসাহিত্যে ব্রহ্মবিদ্যার এই কাহিনীই অনুসৃত হয়েছে। এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া আগমশাস্ত্রে দেবী জগদ্ধাত্রী দুর্গার আবির্ভাব কল্পে, সেখানে বলদর্পে-মত্ত দেবতাদের গর্ব খর্ব করে পূর্ণচৈতন্য সম্পাদনের নিমিত্তে প্রকাশিতা হলেন জগদ্ধাত্রী দুর্গা মহাবিদ্যা রূপে-

“কার্তিকে শুক্লপক্ষে ভৌমবারে জগৎপ্রসুঃ।

সর্বদেবহিতার্থায় দুর্বৃত্তপ্রশমনায় চ।।

আরিরাসীৎ জগচ্ছান্ত্যৈ যুগাদ্যৌ পরমেশ্বরী।”

দেবগনের হিত ও দুর্বৃত্তের প্রশমন এবং জগতের শান্তি বিধানের হেতু কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে পরমেশ্বরী জগদ্ধাত্রী আবির্ভূতা হন। শিবমহাপুরাণের পঞ্চম সংহিতা উমাসংহিতার উনপঞ্চাশতম অধ্যায়ে উমাদেবীর আবির্ভাব প্রসঙ্গে একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, তথায়-

“এতস্মিন্নন্তরে তত্র নির্ব্যাজকরুণাতনুঃ।

তেষামনুগ্রহং কর্তুং হর্তুং গর্বং শিবাঙ্গনা॥

চৈত্রশুক্লনবম্যাং তু মধ্যাহ্নস্থে দিবাকরে।

প্রাদুরাসীদুমা দেবী সচ্চিদানন্দরূপিণী॥

মহোমধ্যে বিরাজন্তী ভাসয়ন্তী দিশো রুচা।

বোধয়ন্তী সুরান্ সর্বান্ ব্রহ্মৈবাহমিতি স্ফুটম্॥

চতুর্ভির্দধতী হস্তৈর্বরপাশাঙ্কুশাভয়ান্।

শ্রুতিভিঃ সেবিতা রম্যা নবযৌবনগর্বিতা॥

রক্তাম্বরপরীধানা রক্তমাল্যানুলেপনা।

কোটিকন্দর্পসঙ্কাশা চন্দ্রকোটিসমপ্রভা॥

ব্যাজহার মহামায়া সর্বান্তর্য্যামিরূপিণী। 

সাক্ষিণী সর্বভূতানাং পরব্রহ্মস্বরূপিণী।।”

সেই সময় অহৈতুকী করুণাময়ী সচ্চিদানন্দরূপিণী শিবপ্রিয়া উমা দেবতাদের উপর দয়াবশতঃ এবং তাঁদের গর্ব হরণ করার জন্য চৈত্রমাসের শুক্লা নবমীর মধ্যাহ্নকালে দিবাকর বা সূর্যদেব যখন মধ্যগগনে অবস্থান করছিলেন তখন প্রকটিতা হয়েছিলেন। তিনি তেজঃপুঞ্জের মধ্যে বিরাজ করছিলেন, নিজ কান্তিতে দশদিক প্রকাশিত করছিলেন এবং সমস্ত দেবতাদের সুস্পষ্টরূপ জানিয়েছিলেন যে ‘আমিই সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম পরমাত্মা’। তিনি চার হাতে ক্রমান্বয়ে বর, পাশ, অঙ্কুশ ও অভয় ধারণ করেছিলেন। শ্রুতিগণ সাকার হয়ে তাঁর সেবা করছিলেন। নবযৌবনগর্বিতা রমণীয়া সেই দেবী রক্তবস্ত্র এবং রক্তচন্দনের অনুলেপযুক্ত মাল্য ধারণ করেছিলেন। তিনি কোটি কন্দর্পের ন্যায় মনোহারিণী এবং কোটি চন্দ্রের ন্যায় চমকিত জ্যোৎস্নায় সুশোভিতা ছিলেন। তারপর মহামায়া সকলের অন্তর্যামী রূপে প্রকাশিত হলেন এবং তিনি সমস্ত জাগতিক জীবের নিকট সাক্ষাৎ পরব্রহ্মস্বরূপিণী।

 

 

 

অন্যভাবে এই একই তত্ত্বের বহিপ্রকাশ দেখা যায় দেবীভাগবতের সপ্তম স্কন্ধের একত্রিশতম অধ্যায়ে, সেখানে জনমেজয় ও ব্যাসদেবের কথোপকথনে ভগবতী ভুবনেশ্বরী দেবীর আবির্ভাব কীর্তিত হয়েছে। দেবাদিদেব মহাদেব, মহাবিষ্ণু আদি অমরবৃন্দের এবং শৈলরাজ হিমালয়ের পূজার্চনা, হোমযজ্ঞ ও ব্রতানুষ্ঠানের দ্বারা সন্তুষ্টা হয়ে “হ্রীঁ”-মন্ত্রাধিষ্ঠাত্রী শ্রতিপ্রতিপাদিতা মণিদ্বীপবাসিনী ভুবনেশ্বরী দেবী কোনো এক চৈত্রমাসের শুক্লানবমী তিথির শুক্রবারে স্বকীয়-ব্রহ্মতেজে আবির্ভূতা হলেন;-

“অকস্মাচ্চৈত্রমাসীয়নবম্যাং চ ভৃগোর্দ্দিনে। 

প্রাদুর্ব্বভূব পুরতস্তন্মহঃ শ্রুতিবোধিতম্।। “

সেই অনির্ব্বচনীয় আদ্যন্তরহিত তেজঃপুঞ্জের হস্তপদাদি অবয়বহীন; সুতরাং তা কোনো রমণী কিংবা কোনো পুরুষ নাকি কোনো নপুংসক মূর্তি এবিষয়ে কেউই কিছু বুঝতে পারলেন না। সেই ভীষণ তেজঃপ্রভায় সকলেরই চোখ নিমীলিত হয়ে গেল। অনন্তর সকলে ধৈর্যাবলম্বনকরে পুনরায় দৃষ্টিপাত করে দেখলেন, সম্মুখে এক মনোহর দিব্য রমণী মূর্তি বিরাজ করছেন। সেই নবযৌবনান্বিতা কুমারীর অঙ্গসকল অতীব সুন্দর-

“দীপ্ত্যা পিধানাং নেত্রাণাং তেষামাসীন্মহীপতে। 

পুনশ্চ ধৈর্য্যমালম্ব্য যাবত্তে দদৃশঃ সুরা।। 

তাবত্তদেব স্ত্রীরূপেণাভাদ্দিব্যং মনোহরম্। 

অতীবরমনীয়াঙ্গীং কুমারীং নবযৌবনাম্।।”

উদ্ধৃতাংশে “স্ত্রীরূপিণী” বলতে কৃষ্ণযজুর্বেদীয় শ্বেতাশ্বতরোপনিষদক্ত ব্রহ্মবাদীগণেরজ্ঞেয় অদ্বিতীয় পরমাত্মার সাত্মভূত ত্রিগুণাত্মিকা শক্তিকে এবং “কুমারী” অর্থে স্বাতন্ত্রা শক্তিকে বোঝানো হয়েছে। উপরোক্ত কাহিনী দুটিই একই তত্ত্বের প্রকাশ ঘটেছে। ব্যতিক্রম হিসেবে শুধুমাত্র আবির্ভাব কাল ও তিথির ভেদ পরিলক্ষিত হয়। শাস্ত্রকারগণ এইভেদকে কল্পান্তর-ভেদ বলে উক্ত করেছেন। দেবীভাগবত পুরাণের গ্রন্থ শেষে দেবীর বন্দনা করা হয়েছে উক্ত মন্ত্রে- “সচ্চিদানন্দরূপাং তাং গায়ত্রী-প্রতিপাদিতাম্। নমামি হ্রীঁময়ীং দেবীং ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।।” যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির প্রযোজিকা, আমি গায়ত্রী-প্রতিপাদিতা সচ্চিদানন্দরূপা হ্রীঁময়ী দেবীকে প্রণাম করি। 

 

 

 

হিন্দী কবি ‘অনুপ’-কৃত “শর্বাণী” কাব্যে দেবীর বিশ্বসৌন্দর্য্যময়ী রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে যথার্থ বলেছেন :

“তূ হী ব্রহ্ম-বাদিয়োঁ কী ব্রহ্ম-নাম ধারিণী হৈ

তূ হী কর্ম-বাদিয়োঁ কো কর্ম-রূপ ভাতী হৈ। 

তূ হী শাক্ত জন কী প্রসিদ্ধ পরমেশ্বরী হৈ

ন্যায়-বাদিয়োঁ কো বিশ্বকারিণী লখাতী হৈ। 

সাংখ্য-জ্ঞানিয়োঁ কো দিব্য পুরুষ-স্বরূপ তূ হী

শৈব মানবোঁ কো বিশ্ব-সদৃশ দিখাতী হৈ। 

সৌর-প্রাণিয়োঁ কা সবিতা তূ অতি পাবণ হৈ

তূ হী কবিয়োঁ কো কবিতা হো দৃষ্টি আতী হৈ।”

 

 

 

সচ্চিদানন্দময়ী সনাতনী মহাদেবীকে জগতের কল্যাণ্যার্থে, দেবতাদের হিতার্থে কার্য্য সম্পাদনের জন্যে এবং ভক্তের আহ্বানে বারংবার কন্যারূপে আবির্ভূতা হয়েছেন কখনও অযোনিসম্ভবারূপে আবার কখনও মানবীরূপে। ঋগ্বেদের দশম মন্ডলে উল্লেখ আছে মহর্ষি অম্ভৃণের মন্ত্রদষ্টৃ কন্যা ‘বাক্’-এর। তিনি তাঁর আত্মোপলব্ধির দ্বারা নিজেকে জানতে পেরেছিলেন ব্রহ্মস্বরূপিণীভাবে, তিনি স্বীয় বলে এই বিশ্বচরাচরের সবকিছু ধারণ করছেন এবং প্রকাশ করেছিলেন নিজের আত্মপরিচয় : 

“ওঁ অহং রুদ্রভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুভ বিশ্বদেবৈঃ। অহং মিত্রবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা।।………. ইত্যাদি” (ঋগ্বেদ, ১০/১২৫/১-৮)। [অর্থাৎ আমি (তিনি) একাদশ রুদ্ররূপে, অষ্টবসুরূপে বিচরণ করি; দ্বাদশ আদিত্যরূপে, সকল দেবতারূপে বিচরণ করি। আমি মিত্র ও বরুণ উভয়কে ধারণ করি, ইন্দ্র ও অগ্নি উভয়কে ধারণ করি, আর ধারণ করি অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে। ইত্যাদি।]I

 

 

 

আদ্যা দেবীই আবার কাত্যায়ন ঋষি-কন্যা ও কাত্যায়ন ঋষি-পূজ্যা কাত্যায়নী। মার্কণ্ডেয় মহাপুরাণান্তর্গত  “শ্রীশ্রীচণ্ডী”-এর “গুপ্তবতী” টীকার রচয়িতা ভাস্কর রায় বলেছেন- “কাত্যায়নীতি দেবকার্যার্থং কাত্যায়নাশ্রমে আবির্ভূতা তেন কন্যাত্যেন স্বীকৃতেতি কাত্যায়নীতি নাম ভগবত্যাঃ” অর্থাৎ ঋষি কাত্যায়ন দেবীকে কন্যা রূপে পালন করেছিলেন দেব কার্যের কল্যাণের নিমিত্তে, সে’জন্যে দেবী হলেন কাত্যায়নী। যদিও কালিকা পুরাণে অন্য একটি মত পাওয়া যায়, সেখানে দেবতাদের হিতার্থে মহিষাসুর বধের নিমিত্তে দেবতাদের তেজঃপুঞ্জকে যোগবলে মহর্ষি কাত্যায়ন এক দিব্য নারীমূর্তির রূপ দিয়েছিলেন এবং সপ্তম্যাদি দিনত্রয়ে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে অবস্থিত থেকে পূজা গ্রহণ করে অবশেষে মহিষাসুরকে বধ করেন; “তত্তোজোভির্ধৃতবপুর্দেবী কাত্যায়নেন বৈ। সন্ধুক্ষিতা পূজিতা চ তেন কাত্যায়নী স্মৃতি।।” অর্থাৎ সেই তেজঃপুঞ্জ হতে উৎপন্ন (দেবীর) শরীর কাত্যায়ন ঋষির দ্বারা সর্বপ্রথম সন্ধুক্ষিত ও পূজিত হওয়ার, তিনি কাত্যায়নী হয়েছেন। কাত্যায়নী দুর্গার দেবীর গায়ত্রী মন্ত্রে তাঁকে কন্যাকুমারী বলা হয়েছে, যথা- “ওঁ কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারি ধীমহি তন্নো দুর্গেঃ প্রচোদয়াৎ।”

 

 

 

এই আদ্যাদেবীকে আবার নন্দগোপজাতাও বলা হয়। তাই এঁনার আরেক নাম নন্দা। আগমশাস্ত্রে “দুর্গাষ্টকম্” স্তোত্রে বলা হয়েছে,-

“বসুদেবসুতে কালি বাসুদেবসহোদরি ।

বসুন্ধরাশ্রিয়ে নন্দে দুর্গাদেবি নমোঽস্তু তে।।”

অর্থাৎ হে কালি, হে বসুদেবসুতা, হে বাসুদেবের সহোদরি, হে বসুন্ধরা, হে শ্রী, হে নন্দা, হে দুর্গাদেবী তোমাকে প্রণাম। মার্কণ্ডেয় মহাপুরাণান্তর্গত  “শ্রীশ্রীচণ্ডী”-র ষড়ঙ্গের অন্তর্গত মূর্তিরহস্যে দেবী নন্দজার উল্লেখ পাওয়া যায় : “ওঁ নন্দা ভগবতী নাম যা ভবিষ্যতি নন্দজা। স্তুতা সা পূজিতা ভক্ত্যা বশীকুর্যাজ্জগত্রয়ম্।। ” অর্থাৎ নন্দ থেকে উৎপন্ন যে নন্দা নাম্নী দেবী, সেই দেবীর ভক্তি ভরে স্তুতি ও পূজা করলে, তিনি তাঁর উপাসককে ত্রিলোকের অধীশ্বর করেন। মহর্ষি ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের বিরাটপর্বের ষষ্ঠ অধ্যায়ের প্রথমেই যুধিষ্ঠিরকৃত দুর্গাস্তবে মহাদেবীকে  যশোদাগর্ভসম্ভূতা, নন্দগোপ-কুলজাতা, বাসুদেবের ভগিনী বলে সম্বোধন করা হয়েছে- 

“বিরাটনগরং রম্যং গচ্ছমানো যুধিষ্ঠিরঃ। অস্তুবন্মনসা দেবীং দুর্গাং ত্রিভুবনেশ্বরীম্।।

যশোদাগর্ভসম্ভূতাং নারায়ণবরপ্রিয়াম্। নন্দগোপকুলে জাতাং মঙ্গল্যাং কুলবর্দ্ধিনীম্।। 

কংসেবিদ্রাবণকরীমসুরাণাং ক্ষয়ঙ্করীম্। শিলাতটবিনিক্ষিপ্তামাকাশং প্রতি গামিনীম্।। 

বাসুদেবস্য ভগিনীং দিব্যমাল্যবিভূষিতাম্। দিব্যাম্বরধরাং দেবীং খড়গখেটকধারিণীম্।।”

রম্য বিরাটনগরে যেতে যেতে যুধিষ্ঠির মনে মনে ত্রিভুবনেশ্বরী যশোদাগর্ভসম্ভূতা, নারায়ণবরপ্রিয়া, নন্দগোপের কুলে জাতা, মঙ্গলকারিণী, কুলবর্দ্ধিনী (সৎবংশবৃদ্ধিকারিনী), কংসবিদ্রাবণকারিণী (কংসবধকারিণী), অসুরক্ষয়কারিণী, (কংসকর্তৃক) শিলাতটে বিক্ষিপ্ত হলে আকাশে গমনকারিণী, বাসুদেবের ভগিনী, দিব্যমালাধারিণী, দিব্য-বস্ত্রপরিধানকারিণী, খড়গখেটকধারিণী দেবী দুর্গার স্তব করলেন। হরিবংশ পুরানেও বিষ্ণুপর্বের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিষ্ণুর আদেশে নন্দজারুপে যোগমায়ার পৃথ্বিলোকে বিন্ধ্যাচলে অবতরিত হওয়ার কাহিনী পাওয়া যায়, তথায়-

“কৌমারং ব্রতমাস্থায় ত্রিদিব ত্বং গমিষ্যসি। তত্র ত্বাং শতদৃক্ছক্রো মৎপ্রদিষ্টেন কর্ম্মণ।

অভিষেকেণ দিব্যেন দৈবতৈঃ সহ যোক্ষ্যসে। তত্রৈব ত্বাং ভগিন্যর্থে গ্রহীষ্যতি স বাসবঃ।

কুশিকস্য তু গোত্রেণ কৌশিকী ত্বং ভবিষ্যসি। স তে বিন্ধ্যে নগশ্রেষ্ঠে স্থানং দাস্যতি শাশ্বতম্। 

ততঃ স্থানসহস্রৈস্ত্বং পৃথিবীং শোভয়িষ্যসি। ত্রৈলোক্যচারিণী সা ত্বং ভুবি সত্যোপাযাচনা।”

(ভগবান বিষ্ণু দেবী যোগমায়াকে বলছেন) তুমি আমার নির্দেশ অনুসারে কুমারী-যোগ্য ব্রত পালন করে ত্রিদিবে প্রয়াণ করবে। সেখানে সহস্রলোচন ইন্দ্র আমার আদেশে তোমার অভিষেক করবেন, দেবতাদের সঙ্গে তোমার পূজা করবেন এবং তোমাকে সকলেই আপন ভগিনীরূপে গ্রহণ করবেন। কুশিক গোত্রের পরিচয়ে তুমি কৌশিকী নামে পরিচিতা হবে। ইন্দ্র পর্বতশ্রেষ্ঠ বিন্ধ্যে তোমার শাশ্বত স্থান নির্দিষ্ট করে দেবেন। তারপর পৃথিবীতে সহস্র স্থানে তুমি শোভা পাবে। তুমি ত্রৈলোক্যচারিণী হবে। তোমার পূজা করে তোমার কাছে যা প্রার্থনা করা হবে তা অবশ্যই সফল হবে। দেবীভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধের তেয়িশতম অধ্যায়ে যশোদা গর্ভসম্ভূত যোগমায়া দেবীর আবির্ভাব বর্ণিত আছে, 

“তদৈব তত্র সঞ্জাতা যশোদাগর্ভসম্ভবা।

যোগমায়াংশজা দেবী ত্রিগুণা দিব্যরূপিণী।।

জাতাং তাং বালিকাং দিব্যাং গৃহীত্বা করপঙ্কজে।

তত্রাগত্য দদৌ দেবী সৈরেন্দ্রীরূপধারিণী।।”

সেই দিনেই (কৃষ্ণের জন্মের দিনেই) দিব্যরূপিণী বালিকা ত্রিগুণাত্মিকা দেবী যোগমায়ার অংশে তথায় যশোদার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন সাক্ষাৎ দেবী যোগমায়া সৈরেন্দ্রীর রূপ ধারণ করে সেই দিব্যরূপিণী বালিকাকে নিয়ে সেই স্থানে এসে বসুদেবের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। দ্বাপর যুগে নন্দজারূপে যোগমায়া দেবীর আবির্ভাবের উদ্দেশ্যে ছিল, ধরিত্রী থেকে দানবকুলের ভার লাঘব করাতে শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেবকে লীলাসহচরী হয়ে সহায়তা করা। বসুদেব দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেবকে দুর্বৃত্ত অত্যাচারী কংস ও তার অসুরসেনাদলের হাত থেকে রক্ষা করতে গোকুলে নন্দজায়া যশোদার কাছে রেখে এসেছিলেন এবং তার বদলে মথুরায় নিয়ে এসে ছিলেন নন্দজা যোগমায়াকে। বিন্ধ্যাচলবাসিনী সম্বন্ধে একটি হিন্দী লোকসঙ্গীতে দেখতে পাওয়া যায়, সে ঘটনারই প্রতিরূপ-

“গয়ে পর্বত ভবন তেরা মাঁ নীচে গংগা বহাই, 

বিন্ধ্যাচল মাঈ ওহো বিন্ধ্যাচল মাঈ। 

নন্দ গোপ ঘর জন্ম লিয়োঁ হৈ মথুরা মেঁ প্রশ্নটাই।

কংস রাজ জব পটকন লাগা ছুট আকাশ সো জাঈ শব্দ সুনাই।।”

 

 

 

সর্বজ্ঞা মহামায়াই অন্তর্যামিনীরূপিণী নিখিল বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী, দুর্গম সঙ্কটনাশিনী দেবী দু্র্গা এবং ত্রিলোকের শোভাস্বরূপা, জীবের জীবনদায়িনী শস্যরূপা লক্ষ্মী দেবী হয়ে এই দুইই পূর্ণকলায় আবির্ভূতা হয়েছিলেন। দেবী দুর্গা প্রথম জন্মে দক্ষকন্যা দাক্ষায়ণী সতী এবং দ্বিতীয় জন্মে গিরিসুতা উমা হয়েছেন। দেবীভাগবত পুরাণের সপ্তম স্কন্ধে উনত্রিশতম ও একত্রিশতম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে সৃষ্টির প্রথমভাগে দেবী আদ্যা ভুবনেশ্বরী কৃপায় মহাদেব গৌরী বা উমাকে, বিষ্ণু শ্রী বা লক্ষ্মীদেবীকে এবং ব্রহ্মা দেবী বাণী বা সরস্বতীকে শক্তিরূপে লাভ করেছিলেন। একদা হলাহল নামে এক অমিত প্রতাপশালী অসুর ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয় ত্রিলোকে বিজয় লাভ করেছিল। পরবর্তীতে সেই অসুর কৈলাশ ও বৈকুণ্ঠ অবরোধ করলে মহাদেব ও বিষ্ণুর তীব্র যুদ্ধোদযোগে অসুর নিহত হয়। যুদ্ধে বিজয় লাভের পর মহাদেব ও বিষ্ণু স্ব স্ব শক্তির নিকটে নিজেদের যুদ্ধের পরাক্রমের বিষয়ে আত্মশ্লাঘা করলে দুই শক্তি দেবী অসন্তুষ্ট হয়ে অন্তর্নিহিতা হলেন। এতে মহাদেব ও বিষ্ণু শক্তিহীন হয়ে পরলেন। তাই সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার্থে এবং মহাদেব ও বিষ্ণুর স্বকীয় শক্তিদ্বয়কে পুনর্লাভের জন্যে প্রজাপতি ব্রহ্মার নির্দেশে দক্ষ, মনু, সনকাদি ব্রহ্মাপুত্রগণ দেবী মহামায়াকে সন্তুষ্ট করতে কঠোর তপশ্চর্চায় ব্রতী হলেন। অতঃপর এঁনাদের কঠিন তপশ্চর্চায় ভগবতী ভুবনেশ্বরী প্রীত হয়ে দর্শন দিলেন এবং তাঁদের অভিলষিত বর চাইতে বললেন। প্রজাপতি দক্ষ প্রথমে হরি ও হরের ক্লেশশান্তি, সুস্থতা এবং তাঁদের শক্তিলাভবিষয়ক বর প্রার্থনা করলেন এবং পরবর্তীতে দক্ষ নিজকুলে নিজ কন্যারূপে দেবীকে পাওয়ার জন্যে প্রার্থনা করলেন। ভক্তবৎসল দেবী সম্মতি জানিয়ে বললেন,

“অধুনা মৎকৃপালেশাচ্ছরীরে স্বস্হতা তয়োঃ। 

ভবিষ্যতি চ তে শক্তি ত্বদগৃহে ক্ষীরোদ সাগরে। 

জনিষ্যতস্ততস্তাভ্যাং প্রাপ্স্যতঃ প্রেরিতে ময়া।।”

এখন আমারই কৃপাবিন্দুলাভে হরি ও হরের দেহে সুস্থতা জন্মাবে এবং সেই শক্তিদ্বয়ের মধ্যে একজন তোমার গৃহে এবং আরেকজন ক্ষীরোদসাগরে জন্মলাভ করবে। পরে আমি তাঁদের প্রেরণ করলে, হরি ও হর নিজ নিজ শক্তি পুনর্লাভ করবেন। পরবর্তীতে মহাদেবী দাক্ষায়ণী সতীরূপে দক্ষ গৃহে জন্ম নিলেন এবং মহাদেবকে পতিত্বে বরণ করলেন, মহাদেব পুনরায় শক্তিমান হলেন। শিবদ্বেষী দক্ষ শিবহীন যজ্ঞের আয়োজন করলে সেখানে বিনা আমন্ত্রণে সতী উপস্থিত হওয়ায় পিতা দক্ষ কর্তৃক সতী অপমানিত হন এবং দক্ষের দম্ভনাশের পণ করেই যজ্ঞস্থলেই আত্মাহুতি দেন। এই ঘটনায় সতীর বিরহে মহাদেবের ক্রোধাংশ থেকে উৎপন্ন বীরভদ্র কর্তৃক দক্ষের অহংকারের বিনাশ ঘটে। তাই ব্রহ্মযামলের “আদ্যা” স্তোত্রে বলা হয়েছে, -“দক্ষস্য দুহিতা দেবী দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী।”- ব্রহ্মাপুত্র দেবীভক্ত প্রজাপতি দক্ষের দর্প বিনাশের জন্যেই মহামায়া তাঁর কন্যারূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। অন্যদিকে কালক্রমে ত্রিলোক শ্রীহীন হয়ে পরলে দেব ও দানবের সমুদ্রমন্থনে দেবী লক্ষ্মীর পুনরাবির্ভাব ঘটে এবং তিনি ভগবান বিষ্ণুকে পতিত্বে বরণ করেন। তিনি ক্ষীরোদসাগর থেকে সম্ভূতা হয়েছিলেন বলে ক্ষীরোদপুত্রী নামে খ্যাত হন।

 

 

 

দেবী ভাগবতের সপ্তম স্কন্ধেের একত্রিশতম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে মহাদেবীর গিরিসুতা হওয়ার ঘটনাটি। ত্রিলোক বিজয়ী দুর্ধর্ষ অত্যাচারী তারকাসুরের অত্যাচারে তটস্থ দেবগণ হিমালয়কে সঙ্গে নিয়ে আদ্যা দেবীর কাছে প্রার্থনা জানালেন। দেবী কৃপাবশত দর্শন দিলে তাঁরা বর্তমান পরিস্থতির কথা দেবীকে জানালেন। তারকাসুরের মৃত্যু একমাত্র শিবপুত্রের হাতেই হওয়া সম্ভব। এই পরিপ্রেক্ষিতে সবকথা শুনে মহাদেবী বললেন, 

“ইতি তেষাং বচঃ শ্রুত্বা প্রোবাচ পরমেশ্বরী। 

মম শক্তিস্তু যা গৌরী ভবিষ্যতি হিমালয়ে।। 

শিবায় সা প্রদেয়া স্যাৎ সা বঃ কার্য্যং বিধাস্যতি।

ভক্তির্মচ্চরণাম্ভোজে ভূয়াদ্ যুষ্মাকমাদরাৎ।। 

হিমালয় হি মনসা মামুপাস্তেহতিভক্তিতঃ। 

ততস্তস্য গৃহে জন্ম মম প্রিয়করং মতম্।।”

আমার নিজের শক্তির অংশে গৌরী হিমালয় গৃহে জন্মগ্রহণ করবেন। তিনি শঙ্কর হস্তে সমর্পিত হলে, তোমাদের কার্য্যসিদ্ধ হবে, সন্দেহ নেই। তোমাদের আমার চরণ-কমলে প্রগাঢ় ভক্তি জন্মাবে। হিমালয়ও সর্ব্বদা পরম ভক্তিভাবে মনে মনে আমার উপসনা করে, সেই জন্যেই তাঁর গৃহে জন্মগ্রহণই আমার প্রীতিকর অভিমত। ঊনবিংশ শতকের চতুর্থ পাদের হিন্দী কবি বালমুকুন্দ গুপ্তের লেখা একটি কবিতায় পিতা হিমাচলের গিরিপুরে কন্যারূপিণী পার্বতীর আবির্ভাবের সুন্দর লৌকিক বর্ণনা দেখতে পাই-

“আজ মধুর ধুন বজত সৈল-পতি ভবন বধাঈ। 

নাচত গাবত বহু কিন্নরি সুর তাল মিলাঈ। 

বহুবিধি ফূলে ফূলে পবন সৌরভ ফৈলাবত। 

বিকসে কমল তড়াগন মহঁ সোভা সরসাবত। 

গিরিপুরবাসিনকো আনন্দ কহ্যো নহীঁ জাঈ। 

আজ হিমাচলকে মহলন এক কন্যা আঈ। “

কালিকা পুরাণে গিরিকন্যা আবির্ভাবের প্রেক্ষাপটটি একটু অন্যভাবে রচিত হয়েছে, এই পুরাণ মতে আদ্যা দেবীই হলেন কালিকা। তিনি নিত্যা প্রকৃতিস্বরূপিণী হওয়া সত্ত্বেও দাক্ষায়ণী সতীরূপে শিবকে বিবাহ করেন। সতীরূপে কৈলাশে থাকাকালীন হিমাচলজায়া মেনকা তাঁর প্রতি হিতৈষিণী ছিলেন। তাই দক্ষকন্যারূপে তাঁর দেহ ত্যাগের সময় স্বয়ং গিরিসুতা হয়ে মেনকা গর্ভ সম্ভূত হবেন বলে নির্ণয় নেন। তিনি যখন দেহত্যাগ করেছিলেন তখন মেনকা শিবা দেবীর আরাধনায় রত ছিলেন। কঠোর তপশ্চর্চার দ্বারা মহামায়া কালিকাকে মেনকা সন্তুষ্ট করলে দেবী আবির্ভূতা হয়ে মেনকাকে বর চাইতে বললেন। তখন মেনকা বীর্যবান, আয়ুষ্মান ধন সম্পন্ন শতপুত্র এবং সুরূপা ও গুণশালিণী ত্রিভুবন দুর্ল্লভা কন্যা প্রার্থনা করলেন। তখন দেবী সম্মতি জানিয়ে বলছেন,– 

“দেব্যুবাচ-

শতং পুত্রাঃ সম্ভবন্তু ভবত্যা বীর্যসংযুতাঃ। 

তত্রৈকো বলবান্মুখ্যঃ প্রথমং সম্ভবিষ্যতি।।

সুতা চ তব দেবানাং মানুষাণাঞ্চ রক্ষসাম্। 

হিতায় সর্ব্বজগতাং ভবিষ্যাম্যহমেব তে।।”

তোমার বীর্যমান একশত পুত্র হবে কিন্তু তাদের মধ্যে প্রথম পুত্র অত্যন্ত বলবান হবে। দেবতা, রাক্ষস, মনুষ্যাদি সকলের হিতার্থে আমি তোমার (মেনকার) কন্যা হব। এই বর দান পূর্বক দেবী অন্তর্হিতা হলেন এবং মেনকাও প্রফুল্ল চিত্তে নিজ স্থানে গমন করলেন। তাই বাংলার সাধক কবি রামপ্রসাদ দেবীর জন্মের লীলা-খেলাকে উপলক্ষ করে গেয়েছেন, 

“আমার উমা সামান্য মেয়ে নয়।

গিরি, তোমারি কুমারী- তা নয়, তা নয়।। 

স্বপ্নে যা দেখেছি গিরি কহিতে মনে বাসি ভয়। 

ওহে কার চতু্র্ম্মুখ, কার পঞ্চমুখ, উমা তাঁদের মস্তকে রয়।।

রাজ-রাজেশ্বরী হয়ে হাস্য বদনে কথা কয়। 

ও কে গরুড়-বাহন কালো বরণ, যোড় হাতেতে করে বিনয়।।

প্রসাদ ভণে, মুনিগণে যোগ ধ্যানে যাঁরে না পায়।

তুমি গিরি ধন্য! হেন কন্যা পেয়েছ কি পুণ্য উদয়।।” (বাল্যলীলা)

 

 

 

মহাদেবী কখনও পূর্ণকলায় আবার কখনও কলাংশে আবির্ভূতা হয়েছেন আত্মজারূপে জগৎ হিতার্থে ও কল্যাণ কামনায় কখনও নাগলোকে কখনও মনুষ্যলোকে কখনও দেবলোকে আবার কখনও অসুরলোকে। তিনি নিত্যা হওয়া সত্ত্বেও বারংবার প্রকট হয়েছেন সৃষ্টির সর্বত্র সাম্যতা রক্ষার্থে। দেবীভাগবত পুরাণ মতে, মহাদেবীর ষষ্ঠ-কলাংশে জাত ষষ্ঠীদেবী আবির্ভূতা হন প্রজাপতি ব্রহ্মার আত্মজারূপে, তিনি দেবগণের রণকারিণী দেবসেনা এবং মনুষ্যগণের কাছে পুত্রদা হয়ে। দেবী মনসা আবির্ভূতা হয়েছেন শিবাংশসম্ভূতা ও কশ্যপ মুনিকন্যারূপে জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ থেকে সর্পকুলকে রক্ষা করতে এবং মানবগণের নাগভয় নিবারণের জন্যে। দেবী তুলসী জন্ম নিলেন রাজা ধর্মধ্বজরাজের দুহিতা হয়ে, কলিকালের কলুষরূপ শুষ্ক ইন্ধন ভস্ম করতে। তিনি বসুন্ধরারূপে প্রকাশিতা হলেন সর্ব্বশস্যের প্রসূতি ও জগতের আধার হয়ে। স্বাহারূপে আবির্ভূতা হলেন দেবতাদিগের যজ্ঞের হবিঃ বহনের নিমিত্তে। পিতৃগণের তৃপ্তির জন্যে স্বধারূপে প্রকাশিতা হন। পুষ্টি নামে খ্যাত হলেন মনুষ্য স্ত্রী-পুরুষকে ক্ষীণতা থেকে রক্ষা করতে। দেবমাতা অদিতি, দৈত্যমাতা দিতি, সর্পপ্রসূতি কদ্রু, পক্ষীমাতা বিনতা, গো-প্রসবিনী সুরভি এবং দানবজননী দনু এঁনারা সকলেই মহাদেবীর কলাংশ হতে উৎপন্না এবং আপন মনঃপ্রবৃত্তি অনুযায়ী সৃজন কর্মেরতা। অশ্বপতির কন্যা সাবিত্রী জন্মান সত্যবানের প্রাণ রক্ষার জন্যে। পুলোমাহ্ দৈত্যের কন্যা হয়ে জন্ম নেন ইন্দ্রপত্নী পৌলোমী শচী। আবার মিথ্যা রূপে অধর্মের সহধর্ম্মিনী হন, ইনিই কলিতে সর্ব্বব্যাপিনী হয়ে অত্যন্তপ্রগলভভাবে কার্পট্যরূপ ভ্রাতার সঙ্গে প্রতি গৃহে বিচরণ করেন।  কালিকা পুরাণ মতে, ভগবতীর অংশে গঙ্গাও জন্ম নেন “কুটিলা” নামে হিমালয় দুহিতা হয়ে, জগতের পাপীদিগের পাপকার্য্য দহন করতে এবং মর্ত্যলোকের মুমুক্ষুদিগের মুক্তিপ্রদায়িনী হিসেবে। কালিকা পুরাণ মতে গঙ্গার ন্যায় কান্তিরূপ জলপ্রবাহে পূর্ণ চঞ্চলা রতিদেবীও প্রজাপতি দক্ষের স্বেদ-জলসম্ভুতা হন এবং ব্রহ্মার মানসপুত্র কামদেবের পত্নীরূপে জগত সঞ্চালনে সহগামিনী হন।

 

 

 

ভবিষ্য মহাপুরাণের “রাধাষ্টমী ব্রত” প্রসঙ্গে কথিত আছে, একসময় সূর্যদেব পৃথিবী ভ্রমণ করতে আসেন। সেই সময় পৃথিবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি মন্দার পর্বতের গুহায় গভীর তপস্যায় নিমগ্ন হন। সূর্যদেব দিনের পর দিন তপস্যায় রত থাকায় পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। স্বর্গের দেবতারা তখন সৃষ্টি রক্ষার জন্য শ্রীহরির শরণাপন্ন হন। তখন স্বর্গের দেবতারা ভীত হয়ে শ্রীহরির কাছে সাহায্যের জন্যে যান। শ্রীহরি সূর্যের সামনে উপস্থিত হলে সূর্যদেব খুব আনন্দিত হন। সূর্যদেব বলেন আপনার দর্শন পেয়ে আমার তপস্যা সার্থক হলো। শ্রীহরি তাকে বর দিতে চাইলে, সূর্যদেব বলেন আমাকে এমন একটি গুণবতী কন্যার বর প্রদান করুন যার কাছে আপনি চিরকাল বশীভূত থাকবেন। শ্রীহরি তথাস্ত বলে তাই বর দিয়েছিলেন। শ্রীহরি বলেছিলেন পৃথিবীর ভার লাঘবের জন্য আমি বৃন্দাবনের নন্দালয়ে প্রকট হব। তুমি সেখানে (গোকুলে) বৃষভানু রাজা হয়ে জন্মাবে। শ্রীমতি রাধা তোমার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করবে। এই ত্রিলোকে আমি একমাত্র শ্রী রাধিকারই বশীভূত থাকবো। রাধা ও আমার মধ্যে কোনো প্রভেদ থাকবে না। আমি সবাইকে আকর্ষণ করি কিন্তু একমাত্র রাধিকাই আমাকে আকর্ষণ করবে। এরপর শ্রীহরি মথুরায় জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে নন্দালয়ে পালিত হন। সূর্যদেব বৈশ্যকুলে জন্মগ্রহণ করে বৃষভানু রাজা হলেন এবং গোপকন্যা কীর্তিদার সঙ্গে তার বিবাহ হল। তারপর যথাকালে ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষে অষ্টমী তিথিতে বিশাখা নক্ষত্রযোগে মধ্যাহ্নকালে অভিজিৎ মুহূর্তে ধরিত্রীকে পবিত্র করে কীর্তিদার গর্ভে শ্রীমতি রাধারানী জন্মগ্রহণ করেন। এই রাধারানীর আবির্ভাব তিথিই রাধাষ্টমী নামে পরিচিত। (তথায়- “শ্রীসুত উবাচ।। অথ মাথুর-ভূখন্ডে প্রাদুর্ভূতে জগদ্গুরৌ। নন্দে পিতরি তত্রৈব ভাস্করো ভক্তি-তৎপরঃ।। বৃষভানুরিতি খ্যাতো জজ্ঞে বৈশ্যকুলোদ্ভবঃ। সর্ব্বসম্পত্তিসম্পন্নাং প্রতপ্তকনকপ্রভাম্।। বৃষভানোর্মহাভক্ত্যা কীর্তিদায়স্তপোবলাৎ। অস্মাদিনয়-বাহুল্যাত্তৎকন্যা রাধিকাভবৎ।। ভাদ্রে মাসি সিতে পক্ষে অষ্টমী যা তির্থিরভবেৎ। তস্যাং বিশাখা নক্ষত্রে দিনর্দ্ধেহভিজিতে ক্ষণে।।”) 

 

 

 

রাধাতন্ত্রেও এইরূপ একটি কাহিনী পাওয়া যায়, উক্ত তন্ত্রে উল্লেখিত আছে যে ইনিই জন্ম নিয়েছেন বৃকভানুসুতা (বৃষভানুসুতা) রাধারূপে শ্রীকৃষ্ণের লীলাসহচরী হয়ে। রাধাতন্ত্রের ষষ্ঠপটলে ভগবতী কাত্যায়নী বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন :

“কাত্যায়ন্যুবাচ। 

বাসুদেব মহাবাহো মা ভয়ং কুরু পুত্রক। 

মথুরা গচ্ছ তাতেতি তব সিদ্ধির্ভবিষ্যতি।। 

গচ্ছ গচ্ছ মহাবাহো পদ্মিনী সঙ্গমাচর। 

পদ্মিনী মম দেবেশ ব্রজে রাধা ভবিষ্যতি। 

অন্যাশ্চ মাতৃকা দেব্যঃ সদা তস্যানুচারিকা।।”

হে মহাবাহো বাসুদেব! তুমি ভয় পেও না। হে পুত্র! তুমি মথুরাতে গমন কর, তবেই তোমার কার্য্য (মন্ত্রবিদ্যা) সিদ্ধি হবে। হে মহাবাহো! তুমি শীঘ্র মথুরাতে গমন করে পদ্মিনীর সঙ্গ কর। আমার অংশভূতা পদ্মিনী বৃন্দাবনে রাধারূপে অবতীর্ণ হবেন এবং অন্যান্য মাতৃকাগণ তাঁর অনুচারিকা হবেন। এই শুনে বাসুদেব মহামায়ার কাছে পদ্মিনী দেখতে চাওয়ায় তৎক্ষণাৎ পদ্মিনী বিভূতি বাসুদেবের সম্মুখে প্রকট হয়ে বললেন, 

“তবাগ্রে দেবদেবেশ মম জন্ম ভবিষ্যতি। 

গোকুলে মাথুরে পীঠে বৃকভানু গৃহে ধ্রুবং।। 

দুঃখং নাস্তি মহাবাহো মম সংসর্গহেতুনা।” 

হে দেবদেবেশ! আমি তোমার পূর্ব্বেই গোকুলে মথুরাপীঠে বৃকভানুর ঘরে জন্মগ্রহণ করব। হে মহাবাহো! আপনি আমার সংসর্গে কোনো দুঃখ ভোগ করবেন না। সম্মোহনতন্ত্র মতে গণেশজননী দুর্গা ও কৃষ্ণ-প্রাণাধিকা রাধা অভিন্না। রাধাকৃষ্ণ ও হরগৌরী সম্বন্ধে বিশ্বমহাধর্মসভার সভাপতি ডঃ. মহানামব্রত লিখেছেন, “শ্রীরাধা শ্রীদুর্গা দুইই আদ্যাশক্তি। শ্রীরাধা আদিরসের মূলাধার বলিয়া আদ্যাশক্তি। দুর্গা জগৎ সৃষ্টির আদি জননী বলিয়া আদ্যাশক্তি। দুই কি আদ্যাশক্তি হয় ? দুই একই। এক নারীর দুই দিক।”

 

 

 

শ্রী সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য প্রণীত “রসতত্ত্ব ও শক্তিবাদ” গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছদের “শক্তিবাদ” নামক চতুর্থ অধ্যায়ে স্থুলা তথা জ্ঞানস্বরূপা অন্নময় কোষাভিমানী দুর্গারহস্য এবং সূক্ষ্মা তথা হ্লাদিনীশক্তি-স্বরূপা আনন্দময় কোষাভিমানী রাধারহস্য “গুরু শিষ্য সংবাদ”-এর মাধ্যমে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তথায়-

” শিষ্য। হাঁ। এই স্থলে আমার একটি কথা মনে আসিয়াছে । 

গুরু। কি? 

শিষ্য। ব্রজগোপী রাধিকাকে আপনি পরমা প্রকৃতি বা রসস্বরূপা বলিয়া গিয়াছেন এবং অনেক মনীষীই তাহা বলেন, কিন্তু প্রকৃতির ঐ যে মূর্তি সকলের কথা বলিলেন, তাহাতে রাধার কোন উল্লেখই নাই? 

গুরু । থাকিবার কথা নহে। 

শিষ্য। কেন? 

গুরু । যে প্রকৃতির কথা হইতেছে, তিনি স্থুলা অর্থাৎ 

জ্ঞানস্বরূপা এবং রাধা প্রাণস্বরূপা। জ্ঞানের নিকটে প্রাণের কথার প্রয়োজন কি? 

শিষ্য। একটা কথা বলিতে ভয় হইতেছে, -যদি, বাচালতা মার্জানা করেন, বলিতে পারি। 

গুরু। তত্ত্বজিজ্ঞাসু হইয়া কোন বিষয়ে সন্দেহ হইলেই জিজ্ঞাসা করিতে পারা যাইবে, তজ্জন্য ক্ষমা অক্ষমা কিছুই নাই। যাহা জিজ্ঞাস্য থাকে, -বল।

শিষ্য। বৈষ্ণবতত্ত্ব প্রকাশক শাস্ত্রগ্রন্থে রাধা-শক্তির কথা আছে, কিন্তু কোন শক্তিবিষয়ক গ্রন্থে কি রাধার কথা আছে? 

গুরু । আছে।

শিষ্য। আমায় যদি তাহা শোনান, বড়ই বাধিত হই। 

গুরু। দেবীভাগবত নামক মহাপুরাণের নাম শুনিয়াছ কি? 

শিষ্য । হাঁ, শুনিয়াছি,-এবং ইহাও শুনিয়াছি, শ্রীমদ্‌ভাগবত যেমন বৈষ্ণবধর্ম-সম্বন্ধীয় প্রামাণিক গ্রন্থ, শাক্তধর্ম-সম্বন্ধীয় দেবীভাগবতও তদ্রুপ প্রামাণিক গ্রন্থ। 

গুরু। হাঁ, তাহা ঠিক। আমি তোমাকে ঐ গ্রন্থ হইতেই রাধাতত্ত্ব শুনাইতে পারি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমানে আমার নিকটে ঐ গ্রন্থের মূল নাই,-একখানা অনুবাদ আছে, তবে অনুবাদটি তুমি অভ্রান্ত ও মূলের অনুবাদ বলিয়াই গ্রহণ করিতে পারিবে। এই অনুবাদ শব্দকল্পদ্রুম কার্য্যালয় হইতে প্রকাশিত ও দুই জন বিখ্যাত পণ্ডিতের দ্বারা অনুবাদিত।

ঐ শক্তি বিষয়ক মহাগ্রন্থে লিখিত হইয়াছে,– “বেদবর্ণিত রাধা ও দুর্গারহস্য কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। এই সারাৎসার ও পরাৎপর রহস্য আমি আর কাহারও নিকটে বর্ণনা করি নাই । এই রহস্য অতীব গোপনীয়, ইহা স্মরণ করিয়া আর কাহারও নিকটে প্রকাশ করা কর্তব্য নহে। প্রাণাধিষ্ঠাত্রী রাধা ও বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দুর্গা, এই মূল প্রকৃতি ভুবনেশ্বরী হইতে জগতের উৎপত্তি হইয়াছে। ঐ উভয় শক্তিই জগতের পরিচালক।

এক্ষণে ইহাতে কি অবগত হইতে পারিলে?

শিষ্য। অবগত হইতে পারিলাম, রাধা বৈষ্ণব ও শাক্ত উভয় সম্প্রদায়েরই আরাধ্য। 

গুরু। কেবল তাহাই নহে। ঐটুকুতে আরও অনেক কথা নিহিত আছে। 

শিষ্য। কি? 

গুরু। যেটুকু উপরে পঠিত হইল, তাহাতে আছে,– 

“বেদবর্ণিত রাধা ও দুর্গাররহস্য কীর্তন করিতেছি,-এই সারাৎসার ও পরাৎপর রহস্য”-ইহাতে সমসংখ্যার ক্রমান্বয় নিয়মানুসারে বুঝিতে হইবে, রাধারহস্য সারাৎসার রহস্য এবং দুর্গাররহস্য পরাৎপর রহস্য। আর রাধা প্রাণাধিষ্ঠাত্রী এবং দুর্গা বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী শক্তি। বুদ্ধি অর্থে জ্ঞান,-জ্ঞানই ঐশ্বর্য্য। দশমহাবিদ্যা, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং দৃশ্যমান জগৎ সমস্তই ঐশ্বর্য্য-সমস্ত জ্ঞেয়, সমস্তই জ্ঞানের স্বরূপ, সুতরাং দুর্গা শক্তি; আর বুদ্ধিতত্ত্বের অতীত যে প্রাণতত্ত্ব তাহাই রাধা। 

শিষ্য । তাহা হইলে রাধা প্রকৃতির অব্যক্ত মূর্তি আর দুর্গা ব্যক্ত মূর্তি ? 

গুরু । হাঁ।

শিষ্য। অব্যক্ত মূর্তিকে মূলা প্রকৃতি এবং ব্যক্ত মূর্তিকে স্থুলা প্রকৃতি-বলিয়া অনেকে উল্লেখ করিয়া থাকেন-কিন্তু উক্ত পুরাণের উদ্ধৃতাংশে উভয় শক্তিকে মূলা প্রকৃতি বলা হইয়াছে,-তাহার কারণ কি? 

গুরু। মূলার আর স্থুলার প্রভেদ নাই। যাহা মূলা, তাহাই আবার স্থুলা। অপ্রকট আর প্রকট বৈত নয়। যাহাই বাহিরে জ্ঞান স্বরূপ, তাহাই অন্তরে আনন্দ স্বরূপ।”

 

 

 

গৌড়ীয় বৈষ্ণবদিগের কাছে “নারদপঞ্চরাত্র”-এর এই নিগূঢ় সাধন তত্ত্বই গৃহীত হয়েছে। “নারদপঞ্চরাত্র”-এর বৈধীভক্তিরূপ গঙ্গাপ্রবাহের সাথে “শ্রীমদ্ভাগবত”-এর রাগাণুরাগভক্তির যমুনাপ্রবাহের সম্মিলনে আমরা গৌড়ীয়বৈষ্ণব ভক্তি-দর্শনের গঙ্গাযমুনাসঙ্গমের পবিত্র তীর্থক্ষেত্রের সন্ধান পাই। এই ” নারদপঞ্চরাত্র”-এ আলোচ্য রাধাতত্ত্বই প্রাধান্য পেয়েছে। এমনকী শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষায় শ্রীরাধাকে বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কথিত হয়েছে গোলকের নিত্য রাসমন্ডলে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ সৃজনেচ্ছায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বামাঙ্গা হতে স্ত্রীরূপ রাধিকার আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃতির অতীত শ্রীকৃষ্ণ যেমন ব্রহ্মস্বরূপ, শ্রীরাধাও সেইরূপ ব্রহ্মস্বরূপা ও প্রকৃতির পরস্থিতা। মাধবের ন্যায় তিনিও নিত্যা ও সত্যস্বরূপা। স্বয়ং পর্ব্বতকন্যা গণেশজননী অম্বিকাই যে নিত্য রাসমন্ডলে রাসেশ্বরী হয়ে শ্রীহরিবক্ষঃস্থলবিহারিণী রাধারাণী হয়েছেন এবং ইনিই বৈকুন্ঠলোকে নারায়ণ পাদপদ্ম পরিচর্যায় তৎপরা ক্ষীরোদপুত্রী লক্ষ্মীদেবী হয়েছেন, আবার তিনিই বিদ্বদজনের আরাধ্যা সরস্বতী তাঁর প্রমাণ এই গ্রন্থে দৃষ্ট হয়। নিত্যরাসমন্ডলে অধিষ্ঠিতা সর্ব্বজনারাধিতা ও সর্ব্বশক্তিস্বরূপা রাধারাণীই মর্ত্যলোকের লীলায় বৃকভানুনন্দিনী (বৃষভানুনন্দিনী) রাধা হয়েছেন তা সুস্পষ্ট। তিনি শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষাও অধিক বন্দনীয়া। স্বয়ং শ্রীহরি তাঁর অনুগামী এবং তাঁরই অধীন। বৈষ্ণবদিগের সকল সিদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী শ্রীরাধারাণীই গোপীজনবল্লভ শ্রীকৃষ্ণের একমাত্র ধ্যেয় এবং সর্ব্বাদ্য ভগবতী রাধার কৃপা ছাড়া শ্রীকৃষ্ণও সমস্তরকম সাধন ফল দিতে অক্ষম। উক্ত “নারদপঞ্চরাত্র “-এর দ্বিতীয়রাত্রের ষষ্ঠ অধ্যায়ে “নারদ শিব সংবাদে” ঐ রাধাপ্রশংসাই কীর্তিত হয়েছে, 

“দ্বয়োশ্চৈকো ন ভেদশ্চ দুগ্ধধাবল্যয়োর্যথা।। 

শ্রীকৃষ্ণরোসি যা রাধা যদ্বামাংশেন সম্ভবা।

মহালক্ষ্মীশ্চ বৈকুন্ঠে সা চ নারায়ণোরসি।। 

সরস্বতী চ সা দেবী বিদুষাং জননী পরা।

ক্ষীরোদসিন্ধুকন্যা সা বিষ্ণুরসি চ মায়য়া।। 

সাবিত্রী ব্রহ্মণো লোকে ব্রহ্মবক্ষঃস্থলস্থিতা। 

পুরা সুরাণাং তেজঃসু সাবির্ভূত্বা দয়া হরেঃ।। 

স্বয়ং মূর্তিমতী ভূত্বা জঘান্ দৈত্যসঙ্ঘকান্। 

দদৌ রাজ্যং মহেন্দ্রায় কৃত্বা নিষ্কন্টকং পদম্।। 

কালেন সা ভগবতী বিষ্ণুমায়া সনাতনী। 

বভূব দক্ষকন্যা চ পরং কৃষ্ণজ্ঞয়া মুনে।। 

ত্যক্ত্বাং দেহং পিতুর্যজ্ঞে মমৈব নিন্দয়া মুনে। 

পিতৃণাং মানসী কন্যা মেনকন্যা বভূব সা।। 

আবির্ভূতা পর্ব্বতে সা তেনেয়ং পার্ব্বতী সতী। 

সর্ব্বশক্তিস্বরূপা সা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী।। 

বুদ্ধিস্বরূপা পরমা সা কৃষ্ণস্য পরমাত্মনঃ।

সম্পদ্রূপেন্দ্রগেহে সা স্বর্গলক্ষ্মীস্বরূপিণী।। 

মর্ত্ত্যে লক্ষ্মী রাজগেহে গৃহর্লক্ষ্মীর্গৃহে গৃহে। 

পৃথক্ পৃথক্ চ সর্ব্বত্র গ্রামেষু গ্রাম্যদেবতা।।”

অর্থাৎ তাঁহারা (শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা) দুই এক; দুধ ও ধবলতার যেমন প্রভেদ নেই, সেইরকম তাঁহাদেরও কোনো ভেদ নেই। শ্রীকৃষ্ণের বক্ষঃস্থলনিবাসিনী রাধাই (রাসমন্ডলে) শ্রীহরির বামাংশ-সমদ্ভূতা, তিনি বৈকুন্ঠৈ মহালক্ষ্মী নাম ধারণ করে বিষ্ণুবক্ষঃস্থলবিহারিণী হন। তিনিই জ্ঞানিগণের জননীস্বরূপা সরস্বতী; তিনি আবার ক্ষীরোদসাগর-তনয়া হয়ে বিষ্ণুর বক্ষঃবিলাসিনী হয়েছেন। ব্রহ্মলোকে তিনিই সাবিত্রী নাম ধারণ করে ব্রহ্মার প্রেয়সী হয়েছেন। পুরাকালে হরি ও অন্যান্য দেবতাদের অপর দয়াবশত স্বয়ং দেবতাদের তেজে মূর্তিমতী হিসাবে আবির্ভূতা হয়ে দৈত্যকুলকে নিধন করে ইন্দ্রকে নিষ্কন্টক রাজ্য প্রদান করেন। হে মুনিবর, কালক্রমে ঐ সনাতনী ভগবতী বিষ্ণুমায়াই শ্রীকৃষ্ণের আদেশে দক্ষ প্রজাপতির পুত্রীত্ব স্বীকার করেন। হে মুনিবর, ঐ দেবীই পিতা দক্ষের যজ্ঞক্ষেত্রে আমার (মহাদেবের) নিন্দাবাদ শ্রবণ করে দেহত্যাগ পূর্ব্বক পিতৃগণের মানসকন্যা মেনকার কন্যা হয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। পর্ব্বতরাজের গৃহে আবির্ভূত হয়েছেন বলে ঐ সতী দেবী পার্ব্বতী নামে খ্যাত হয়েছেন। তিনি সর্ব্বশক্তিস্বরূপিনী এবং দুর্গা নামে সমস্ত রকম দুর্গতিনাশিনী। এই দেবীই শ্রীকৃষ্ণরূপী পরমাত্মার বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী এবং সাক্ষাৎ স্বর্গলক্ষ্মীস্বরূপিণী হয়ে ইন্দ্রের সম্পত্তিরূপা। তিনিই মর্ত্যলোকের রাজগৃহে লক্ষ্মীরূপা এবং প্রতি গৃহে গৃহলক্ষ্মীরূপে অধিষ্ঠান করেন। তিনি ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে এবং সর্ব্বত্র গ্রামদেবতারূপে প্রকটিত হন।

 

 

রাবণসহ রক্ষকুলকে ধবংস করতে মহাদেবী লক্ষ্মীর কলাংশে ধরিত্রী গর্ভ থেকে প্রকট হন জনক নন্দিনী হয়ে এবং সীতা আখ্যায় ভূষিতা হন। ব্রহ্মযামলের “আদ্যাস্তোত্র”-এ দেবী সীতাকে বলা হয়েছে-“রামস্য জানকী ত্বং হি রাবণধ্বংসকারিণী।।”। কৃত্তিবাসী রামায়ণ “শ্রীরামের পাঁচালী”-এর আদিখন্ডে সীতা জন্মপ্রসঙ্গে লিখেছেন- 

“পরমা সুন্দরী কন্যা যেন হেমলতা।

সীরালে হইল জন্ম নাম থুল সীতা।। 

লক্ষ্মীর রূপের কিবা কহিব তুলন।

যাঁর রূপে ভুলিলেন নিজে নারায়ণ।।

যেই জন শুনে এই লক্ষ্মীর জনম। 

ধন পুত্র লক্ষ্মী তারে দেন নারায়ণ।। 

কৃত্তিবাস পন্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ। 

গাইল এ আদিকান্ডে লক্ষ্মীর জনম।।” 

 

 

 

কিন্তু “অদ্ভুত-রামায়ন”-এ দেবী সীতার মহাদেবীত্ব শক্তির পরিচয় পাই একটু অন্যরূপে (সংস্কৃত “অদ্ভুত রামায়ণ” মহর্ষি বাল্মীকি কতৃর্ক রচিত এবং বাংলা ভাষায় “অদ্ভুত রামায়ণ” অনুবাদ ও লিপিবদ্ধ করেন জগদ্রাম ও তাঁর পুত্র রামপ্রসাদ), এখানে লঙ্কার দশানন রাবণ বধ প্রত্যক্ষভাবে রামাবতার কর্তৃক হলেও, তা আদতে পরোক্ষভাবে সীতাদেবী কর্তৃক হয়েছিল। তার প্রমাণ মেলে “অদ্ভুত রামায়ণ”-এর কাহিনীতেই। এই রামায়ণের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হল এটি মূল রামায়ণ মহাকাব্যের মত সাতটি খন্ড নয় বরং “পুষ্কর খন্ড” সমন্বিত মোট আটটি খন্ডে বিভক্ত। ঐ “পুষ্কর খন্ড”-এই সহস্র শিরা রাবণ বধ প্রসঙ্গে দেবী জানকীর মধ্যে মহাশক্তিতত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বাল্মীকি রচিত মুল রামায়ণ মহাকাব্যের পঁচিশ হাজার শ্লোকে (মতান্তরে চব্বিশ হাজার শ্লোকে) রামের মনুষ্য-চরিত্র অবলম্বন করে রচিত হয়েছিল সেখানে সীতা মাহাত্ম্য বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়নি। তাই মুলপ্রকৃতিস্বরূপা যোগীগণের কাছে মহতীবিদ্যা এবং জাগতিক প্রাণীসমূহের কাছে অবিদ্যারূপা সীতা চরিত্র মাহাত্ম্য কীর্তন হেতুই “বাল্মীকি ভরদ্বাজ সংবাদে” এই অতীব গুপ্ত রামলীলা-তত্ত্বের অবতারণা। দেবর্ষি নারদের ব্রহ্মশাপের মর্যাদা রক্ষার্থে দেবী লক্ষ্মীর রাক্ষসকুলে পার্থিব দেহ ধারণ করেন। অন্যদিকে ত্রৈলোক্যবিজয় কামনায় এবং অমরত্ব লাভের অভিলাষে লঙ্কার দশানন রাবণ বহু বছর তপস্যা করে ব্রহ্মাদেবকে সন্তুষ্ট করেন। ব্রহ্মাদেব দর্শন দিলে তাঁর কাছে “অজর ও অমর” হওয়ার বর চান। কিন্তু ব্রহ্মা তা দিতে অস্বীকার করলে রাবণ বুদ্ধির চতুরতায় বলেন যে, দেবতা, অসুর, পিশাচ,নাগ, যক্ষ, রাক্ষস, বিদ্যাধর, কিন্নর, অপ্সরাগণ ইত্যাদি কেউই যেন তাঁকে মারতে সক্ষম না হন। মানব এবং বানরকে তিনি ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি, কারণ তারা রাবণের নিত্য ভক্ষ্য। পরক্ষণেই বলেন-“তবে নিজ কন্যা যবে করিব হরণ। সে কালে বিকলে হবে আমার মরণ”। এই সমস্ত আকাক্ষায় ব্রহ্মার সম্মতি লাভ করলে রাবণ নিজেকে অজেয় ও অমর মনে করে দশদিকে ত্রাস সৃষ্টি করলেন। ত্রিলোকে আধিপত্য স্থাপনের পরেও তাঁর আশা মিটল না। তারপরেও বহু ঋষিদের আশ্রমে গিয়ে অত্যাচার শুরু করলেন, বহু ঋষিদের অনাদরে হত্যা করলেন, পবিত্র যজ্ঞস্থলে রক্ত ফেলে যজ্ঞ নষ্ট করতে লাগলেন। একদা দুরাত্মা ত্রৈলোক্যবিজয়ী অমিত প্রতাপশালী বলদর্পিত রাবণ দন্ডকারণ্যে তপস্বী মুণিগণের ওপর স্বীয় ক্ষমতার প্রভাব দেখানোর জন্যে তাঁদের অঙ্গ শরগ্র দ্বারা বিদ্ধ করে সেই রক্ত একটি কলসে গ্রহণ করে আপন গৃহে প্রস্থান করলেন এবং মন্দোদরীকে ওই কলস রক্ষার্থে দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর (রক্ষকুলের) কাছে ঋষি শোণিত বিষতুল্য হওয়াই ওই কলসের রক্ত পান করা থেকে সকলকে বিরত থাকতে বলেন। দৈবক্রমে ওই কলসেই শত পুত্রের জনক গৃহসমুদ নামে এক ঋষি দেবী লক্ষ্মীকে নিজ পুত্রীরূপে কামনা করে প্রত্যহ কুশাগ্র দ্বারা মন্ত্রপূত ঘৃত স্থাপন (সঞ্চয়) করতেন। ঐদিকে দুষ্ট ভ্রষ্টাচারী রাবণ দেব, দানব, যক্ষ, গন্ধর্ব্বাদি কুলের রমণীদের সাথে কামবিলাসে দিন অতিবাহিত করতে থাকায়, পতিবঞ্চিতা সাধ্বী মন্দোদরী নিজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ধীক্কারে ঐ কলসের শোণিতরূপী বিষ পান করে মৃত্যু কামনা করলেন। দৈবক্রমে দেবী লক্ষ্মীর মন্ত্রপূত ঐ শোণিত থেকে মন্দোদরীর উদরে গর্ভের সঞ্চার ঘটে। পতির সাথে সম্পর্কহীনা রাবণপ্রেয়সী লজ্জিত বোধ করেন। তিনি তৎক্ষনাৎ বিমানে আরোহণ করে কুরুক্ষেত্রে গমন করলেন এবং আপন গর্ভ নিঃসারিত করে ভুমিতলে প্রোথিত করলেন। কিছুকাল পরে দৈবযোগে ওইস্থানে একদিন মহামনা জনক ঋষি কর্তৃক কুরুক্ষেত্রে স্বর্ণলাঙ্গল দ্বারা ভূমি কর্ষণকালে ঐ লাঙ্গলের সীতায় মন্দোদরী কন্যা উত্থিত হলেন এবং লাঙ্গলের সীতায় উত্থিতা হয়েছেন বলে সীতা নামে ভূষিতা হন। – 

“ততঃ কালেন কিয়তা জনকর্ষির্ন্মহামনা। কুরুক্ষেত্রং সমাসাদ্য লাঙ্গলং যজ্ঞমাবহৎ।।

স্বর্ণলাঙ্গলমাদায় যজ্ঞভূমিঞ্চকর্ষ সঃ। স্বর্ণলাঙ্গল সীতাতঃ কন্যৈকা প্রোত্থিতাভবৎ।।………………………………….. 

নামাস্যাঃ কিল সীতেতি সীতায়া উত্থিতা যতঃ।।” এরপরের কাহিনী সকলেরই কম-বেশী জানা, কীভাবে রামে সহিত সীতার বিবাহ হয়! কেন তাঁরা বনবাসে গেলেন? কীভাবে দশানন রাবণ দেবী সীতাকে হরণ করে বন্দিনী করেন! এবং কীভাবে হনুমান, সুগ্রীবাদিদের সঙ্গে রামের পরিচয় ঘটে! বানর সেনাবাহিনী গঠন করে সেতুবন্ধন করেন! এবং সর্বোপরি সবংশে দশানন রাবণকে যুদ্ধে নিহত করে দেবী সীতাকে উদ্ধার করেন!-এই সবই। এই সমস্ত পর্যালোচনা আর দীর্ঘায়িত করছি না, বস্তুতপক্ষে জনকের পালিতা কন্যা সীতার মন্দোদরীর গর্ভে উদ্ভব যে দশানন রাবণ বধের জন্যে দৈব-চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়, তা আলোচ্য গ্রন্থে সুস্পষ্ট। তবে সীতারূপিনী দেবীর মহতী বিদ্যা তত্ত্ব আলোচনা করতে গেলে এইগ্রন্থের অষ্টম খন্ড বা পুষ্কর খন্ডটি খুবই আবশ্যিক।

 

 

 

দশবদন রাবণের মৃত্যুর পর সবাই রামচন্দ্রের বীরত্বের প্রশংসা করেছেন, সীতা দেবীর মুখে মুচকি মুচকি হাসি। সেই হাসি দেখে সবাই উপস্থিত সমস্ত মুনি, ঋষি ও মহাত্মারা সীতার কাছে জানতে চাইলেন এই হাসির অর্থ। এর উত্তরে রামপ্রিয়া একটি বৃত্তান্ত জানান। পুরাকালে বীর রাক্ষস সুমালী দেবতাদের থেকে পুষ্কর পর্ব্বত ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে তার রাজ্য স্থাপন করেন। সুমালীর কন্যা নিকষার সাথে বিশ্বশ্রবা মুনির বিবাহ হয়। বিশ্বশ্রবা মুনির ঔরসে নিকষার গর্ভে দুজন রাবণের জন্ম হয় একজন দশবদন রাবণ এবং আরেকজন সহস্রবদন রাবণ। লঙ্কার রাজা দশবদন রাবণ নিহত হন কিন্তু পুষ্করের রাজা সহস্রবদন রাবণ এখন জীবিত। তথায়- 

“ভয়ঙ্কর জেষ্ঠ্য পুত্র সহস্রবদন।। 

কনিষ্ঠ হইল দশস্কন্দ সে রাবণ। 

দেবেতে রাখিল্য নাম দুজন রাবণ।।”

………………………………………… 

…………………………………………

“লঙ্কার রাবণ বলবান বড় লয়। 

তাহারে রাঘব রণে করিলেন ক্ষয়।। 

ইহার বিনাশে সবে প্রভুর বাখান। 

এ নিমিত্তে হাস্য চিত্তে শুন মুণিগণ।। 

জদি দুষ্ট হয় লষ্ট সহস্র বদন।

শ্রীরামের পৌরষার্থ জানিব তখন।।”

দেবী জানকীর মুখে সাঙ্ঘাতিক কথা শোনার পর রঘুবীর সসৈন্য বেরিয়ে পড়লেন সহস্রবদন রাবণ বধের উদ্দেশ্যে। এবার যুদ্ধে রঘুপতির পাশেই আছেন সীতা। দুপক্ষের ভয়বহ যুদ্ধের পরে অবশেষে সহস্রবদন রাবণের ক্ষুরপ্র বাণের আঘাতে রাঘব মূর্ছিত হয়ে সংজ্ঞা হারালেন। এমতাবস্থায় শোকে ও রাগে বিহ্বল হয়ে জনক নন্দিনী সীতা মহাকালীর রূপ ধারণ করে সহস্রবদনের বিনাশ করলেন-

“কোপ হল্য পরকাশ, ঘনঘন বহে শ্বাস,

ভ্রুকুটি কুটিল হল্য ক্ষণে।

বিচ্ছেদ হইছে মর্ম, সর্ব্বদেহে বহে ঘর্ম,

অট্ট অট্টহাস ঘন ঘনে।।

অতি কোপ হল্য স্ফূর্তি, ত্যাগ করল নিজ মূর্তি,

দীর্ঘ জংঘা হল্যা মহাকালী।

হইলা বিকটাকর ঘোর রূপা খরস্বরা,

কোটরাক্ষী ভীমা মুন্ডমালী।।

অস্থির কিঙ্কিনী জুতা, চতুর্ভূজা হল্যা সতী,

লহ লহ করএ রসনা।

দলিত অঞ্জন আভা, শব শিশু কর্ণে শোভা,

ক্ষুধাতুরা বিকৃত আননা।।

জটাজুট শোভে শিরে, সে খড়গ খর্পর করে,

ঘংটা পাশ ধরিলা দক্ষিণে।

অধিক প্রচন্ড রোমা, ভীম বেগা পরাক্রমা,

দিগম্বর হল্যা ততক্ষণে।।

ঘূর্ণিত হইছে নেত্র, কোপে কাঁপে সর্ব্বোগাত্র,

ঘর্ঘর শব্দ ঘোর ধ্বনি।

কোটি সূর্য্য জিনি ছটা, ব্রহ্মান্ড ভেদিল জটা,

পদভরে কম্পিত জননী।।”

এরপর সহস্রবদন রাবণকে বধ করলেন দেবী, 

“রাবণের স্কন্ধে হত্যে মুন্ড সব পড়ে। 

এক কালে পাকা তাল ভাদ্রে যেন পড়ে।।”

সহস্রবদন রাবণের বধের পর দেবী তার মায়ায় সৃষ্ট যোগিনীগণের সাথে ভয়ঙ্কর নৃত্য করতে লাগলেন। 

“রণমদে মত্ত কালী মনেতে উল্লাস।। 

উদর বিদারি রাবণের অন্ত করি। 

সহস্র মুণ্ডের মালা গাঁথি মাহেশ্বরী।। 

আজানুলম্বিত মুন্ডে মালা দোলে গলে।”

দেবী সীতার এই মহাকালী রূপ দেখে দেব, মানব, বানর, লোকপালগণ, গন্ধর্ব্বগণ সকলেই ভীত হয়ছ উঠলেন। তাঁর পদসঞ্চালনে মেদিনী কম্পিত হয়ে ওঠে। দেবীকে শান্ত করতে স্বয়ং মহাদেব শব রূপে রণোণ্মত্ত দেবীর পদতলে শায়িত হয়ে দেবীর ভার ধারণ করলেন এবং পৃথিবী সুস্থিরতা প্রাপ্ত হল। ভগবতী সীতাকে শান্ত করতে ব্রহ্মাদিদেবগণ, পিতৃগণ এবং ঋষিগণ প্রশস্তিবাক্য ও স্তবস্তুতির দ্বারা দেবীর সন্তোষ বিধান করেন। দেবী সীতা তাঁর ক্ষোভ প্রশমিত করে শ্রীরামের চৈতন্য সম্পাদনের কথা বলেন। ব্রহ্মাদেব কর্তৃক ধনুর্দ্ধারীর জ্ঞান প্রাপ্তি ঘটলে তিনি দেবী মৈথিলীর মহাকালীরূপ দর্শন করে ভয়ে বিস্মিত হলেন–

” নাপশ্যজ্জানকীং তত্র প্রাণোভ্যোহপি গরীয়সীম্। 

নৃত্যন্তীং চাপরাং কালীমপশ্যচ্চ রণাঙ্গনে।।

চতুর্ভূজাং লোলজিহ্বাং খড়গখর্পরধারিণীম্। 

শবরূপমহাদেবহৃৎসংস্থাঞ্চ দিগম্বরাম্।।

পিবন্তীং রুধিরং ভীমাং কোটরাক্ষীং ক্ষুধাতুরাম্। 

জগদ্গ্রাসে কৃতোৎসাহাং মুন্ডমালাবিভূষণাম।।”

সম্মুখে প্রাণাপেক্ষাও প্রিয়তরা জানকীকে দেখতে পেলেন না। দেখলেন রণস্থলে এক কালী নৃত্য করছেন। তিনি চতুর্ভুজা, লোলজিহ্বা এবং খড়গ ও খর্পর ধারণ করে দিগম্বরী বেশে শবরূপী মহাদেবের বক্ষঃস্থলে অবস্থান করছেন। তিনি ক্ষুধার্ত এবং তাঁর চোখ দুটি কোটরে প্রবেশ করে রয়েছে। সেই ভীমরূপা দেবী ঘন ঘন রক্ত পান করছেন, যেন জগৎ গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছেন। ব্রহ্মাদেবের নিকটে রঘুনাথ সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে দেবী জানকীর পূর্ণ তেজে তিনি ভীত ও বিমোহিত হয়ে নতজানু হয়ে ভক্তি বনম্র চিত্তে কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণাম জানালেন, “কা ত্বং দেবি বিশালাক্ষী শশাঙ্কবয়বাঙ্কিতে। ন জানে ত্বাং মহাদেবি যথাবদ্ ব্রূহি পৃচ্ছতে।।” অর্থাৎ হে বিশালনয়না, হে চন্দ্রকলা-অঙ্কিতা, হে দেবি, আপনি কে? হে দেবি, আমি আপনাকে জ্ঞাত নই! 

 

 

 

যোগীগণের অভয়দায়িনী রামপ্রিয়া জানকী রঘুপতির এই বাক্য শ্রবণ করে তিনি রামচন্দ্রকে দিব্যদৃষ্টি দান করে তাঁর সর্ব্বজ্ঞানময়ী বিরাটরূপ দর্শন করালেন। রঘুনন্দন দেবী সীতার ঐ রূপ দর্শন করে বিমোহিত হয়ে বিবিধ স্তবস্তুতির দ্বারা দেবীর প্রীতিবর্দ্ধন করলেন এবং দেবীকে পুনরায় তাঁর শান্ত মূর্তি ধারণের আর্জি জানান- 

“প্রণমিয়া রামচন্দ্র কন প্রিয় বাণী। 

ভয়ঙ্করী বেশ ত্যেজ জনক নন্দিনী।। 

পূর্বের শরীর ধর ধরণী তনয়া। 

মহাভয় হয় এই আকৃতি দেখিয়া।। 

পতিরে প্রসন্ন হৈয়া পরম প্রকৃতি। 

উগ্রবেশ ত্যাজি হৈলা পূর্বের আকৃতি।। 

 

 

 

সংস্কৃত ও বাংলা “অদ্ভুত রামায়ণ”-এ বর্ণিত সীতাদেবীর এইরূপের সাদৃশ্য দেখতে পাই ওড়িয়া কবি সারলা দাস রচিত “বিলঙ্কা-রামায়ণ”-এ। বিলঙ্কার রাবণ হল সহস্রশিরা। রাম ও লক্ষ্মণ সহস্রশিরা রাবণকে বধ করতে অসমর্থ দেখে দেবগণ স্মরণ নেন সীতাদেবীর। সীতাদেবীও তৎক্ষণাৎ দেবী সর্বমঙ্গলার স্মরণ নিলে, দেবী সর্বমঙ্গলা সীতাদেবীকে একটা পুষ্পধনু প্রদান করলেন। দেবী সীতা তাঁর যৌবন দেখিয়ে সহস্রশিরা রাবণকে পুষ্পশর নিক্ষেপ করে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করলেন এবং সেই অবসরে রাম ও লক্ষ্মণ কর্তৃক সহস্রশিরা রাবণ বধ হন। কিন্তু সহস্রশিরা রাবণের মৃত্যুর পর আবার লক্ষশিরা রাবণের উৎপত্তি হয়। লক্ষশিরা রাবণকে বধ করতে অসমর্থ লক্ষ্মণ স্মরণ নেন দেবী সীতার। দেবী সীতাও পূর্ব মত স্মরণ নিলেন দেবী সর্বমঙ্গলার। তখন দেবী সর্বমঙ্গলা সীতা দেবীর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁর ও সীতার অভেদ-তত্ত্ব বললেন, – 

“তোর মোর কিছুমাত্র প্রভেদ ত নাহীঁ।। 

তোর তেজ তোরে মুহীঁ করুছি প্রদান। 

মহাভৈরবী রূপকু কর তুই ধারণ।।”

তখন সীতাদেবী মহাকালীরূপ ধারণ করে লক্ষশিরা রাবণকে বধ করলেন। 

 

 

 

মহর্ষি বেদব্যাস রচিত ব্রহ্মান্ড পুরাণের অন্তর্গত “অধ্যাত্ম রামায়ণ”-এর আদিকান্ডের প্রথম অধ্যায়ে “নারদ ব্রহ্মা সংবাদে” উমা ও মহেশ্বরের কথোপকথনের মাধ্যমে “রাম হদয়”-এ জীবগণের মহাকুন্ডলিনী শক্তিরূপা এবং শ্রীরামের প্রকৃতিস্বরূপা জনক নন্দিনী সীতাদেবীর মহতী বিদ্যা-তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীরামের লঙ্কা-বিজয়ের পর সবান্ধবে অযোধ্যা নগরীতে প্রত্যাগমন করলে, তিনি রাজাসনে অভিষিক্ত হন এবং বশিষ্ঠাদি ঋষিগণের দ্বারা পরিবৃত হয়ে, কোটি সূর্যের ন্যায় প্রদীপ্তশালী প্রভা ধারণ করে রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্মুখে নিষ্কাম শুদ্ধভক্তিবান মহামতী হনুমানকে বিনীতভাবে কৃতাঞ্জলিপুটে দন্ডায়মান দেখে তাঁর প্রতি করুণাবশত শ্রীরামচন্দ্র সীতাদেবীকে রামলীলার পরমতত্ত্ব উপদেশ দিতে বলেন। -“সীতোবাচ। 

রামং বিদ্ধি পরম ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দমদ্বয়ম।সর্ব্বোপাধিবিনির্মুক্তং সত্তামাত্রমগোচরম্।।

আনন্দং নির্মলং শান্তং নির্ব্বিকারং নিরঞ্জনম্। সর্ব্বব্যাপিনমাত্মানং স্বপ্রকাশম-কল্মষম্।। 

মাং বিদ্ধিমূলপ্রকৃতিং সর্গাস্থিত্যন্তকারিণীম্। তস্য সান্নিধিমাত্রেণ সৃজামীদমতন্দ্রিতা।। 

তৎসান্নিধ্যান্ময়া সৃষ্টং তস্মিন্নারোপ্যতে বুধৈঃ।।”

সীতাদেবী বললেন, হে পবনতনয়! শ্রীরামচন্দ্রকে অব্যয়, সচ্চিদানন্দ, পরব্রহ্ম বলে জানবে; ইনি স্থূল সূক্ষ্মাদি সকল প্রকার উপাধি হতে বিনির্মুক্ত বস্তুমাত্রে বিদ্যমান এবং বাঙ্ময়ের অগোচর। ইনি আনন্দ, নির্মল, নির্ব্বিকার, শান্ত, নিরঞ্জন, সর্ব্বব্যাপী, স্বপ্রকাশ ও অকল্মষ পরমাত্মা। আর আমাকে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়কারিনীরূপা মূলপ্রকৃতি বলে জানবে। এই পুরুষ প্রধান পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়ে আমি অতিন্দ্রিতা হয়ে (নিরলসভাবে) এই জগৎ সৃষ্টি করে থাকি। শ্রীরাম সহযোগে আমি যা সৃষ্ট করেছি, পন্ডিতগণ সে সমস্তই শ্রীরামচন্দ্রে আরোপ করে থাকেন। বস্তুতপক্ষে শ্রীরামরূপ সগুণ নিরঞ্জন পরব্রহ্মের মহিষী লোকবিমোহিনী মহাশক্তি সীতাদেবী কর্তৃকই এই নিখিল বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে, ইনিই জগতের আধার এবং সর্ব্বময়ী কর্ত্রীরূপে সদা বিরাজমানা; ইহাই রামলীলা-তত্ত্বের পরম কারণ। শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, “পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতম্, ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে।” (অর্থাৎ সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ এবং ধর্ম পুনঃস্থাপনের জন্যে আমি প্রত্যেক যুগে অবতীর্ণ হই।)। এই উক্তির বাস্তবায়ন দেখা যায় জগদীশ্বরীর লীলার ক্ষেত্রেও তিনি “সর্বস্বরূপে সর্বেশে সর্বশক্তিসমন্বিতে “- হয়ে একাধারে যেমন  ভক্তবৎসলা অন্যদিকে তেমন দুষ্টদের দমনের জন্যে সত্যাদি এই চার যুগে বারংবার বিবিধ বিভূতিতে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছেন।

 

 

শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, “যথা যে মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।” অর্থাৎ “আমাকে যিনি যে প্রকারে ভজনা করেন, আমি তাকে সেইমত ফলপ্রদানের দ্বারাই অনুগ্রহ করি।” বস্তুতপক্ষে এটাই ভারতীয় সাধনরীতির মূলকথা, তবে সে সাধনা যে মতেই হোক না কেন। যুগে যুগে সাধক, ভক্ত, সিদ্ধাচার্যগণ তাঁদের উপাস্যকে দর্শন করেছেন আপন আপন ভাব সাধনায়। তাই যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, “নিরাকার, নির্গুণের ঘর বড় উঁচু ঘর, সেখানে মন বেশীক্ষণ রাখা যায় না; তাই তাঁর সন্তানভাব”। এই প্রসঙ্গে শ্রীমৎ স্বামী সম্বুদ্ধানন্দজীর একটি পদ স্মরণ না করলেই নয়, 

“কে তুমি বালিকা ভুবন পালিকা মধুর মধুর হাসো, 

জগত চালিকা তুমি কী কালিকা ভুবন ভুলিয়ে নাচো।। 

হৃদয় গহণ কর গো হরণ প্রেমের প্লাবন ঢালিয়ে,

কভু ফুল কভু মুন্ডমালিকা ষোড়শীকে তুমি বালিকা।। 

তুমি কী জানকী রক্ষপাতকী দেবী কৌষিকী অনামিকা, 

রুক্মিণী না কী শ্রীমতী রাধিকা, তুমি বুঝি জগদম্বিকা।। 

ঋতিকা সাধিকা বুঝি এ বালিকা নামেতে ক্ষেমঙ্করী, 

শ্যামেরও গোপিকা বুঝি এ রাধিকা সারদা শ্বেতাম্বরী।।

তুমি মায়াময়ী তুমি কী জননী প্রেমে বাঁধো প্রেমসরোজবাসিনী, 

তুমি কী সাধিকা কুসুম কলিকা মোহিনী হইয়ে নাচো।।” 

ভগবতী সনাতনীর যে ব্যাপকতা তা এই পদটি পাঠের দ্বারাই পরিস্ফুটিত হচ্ছে। সৃষ্টির সর্বত্র তিনিই নিহিত আছেন; কোথাও তিনি প্রভু, তিনি কর্ত্রী, তিনি পিতা, তিনি মাতা, তিনি সখা, তিনি পুত্র, তিনি কন্যা, তিনি গুরু, তিনিই ইষ্ট, তিনিই সাধক, তিনিই সাধন, তিনিই বিষয়, তিনিই বিষয়েরমুক্তি আবার তিনিই সাক্ষাৎ মোক্ষ। সবই তাঁর স্বেচ্ছাধীন, তাই জনৈক বাঙালী কবি রামদুলাল নন্দী গেয়েছেন, 

“সকলি তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি, 

তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি। 

পঙ্কে বদ্ধ কর করি, পঙ্গুরে লঙ্ঘাও গিরি, 

কারে দাও মা ব্রহ্মপদ, কারে করো অধগামী।”

 

 

 

এইভাবেই ভক্তের আহ্বানে প্রকট হয়েছে ভগবানের নিত্য লীলা। ভক্ত আছেন বলেই ভগবানের মাহাত্ম্য, তার জন্যেই তিনি ভক্তের ভগবান। ভগবানের যত লীলা আছে! তারমধ্যে সর্বোত্তম হল “নরলীলা”। মানব লীলায় তাঁর মানবের মতই আচার-আচরণ, তাই তাঁর নরদেহ ধারণ। তিনি মায়া আবার তিনিই মায়াধীশ; তিনি প্রেম আবার তিনিই প্রেমময়। প্রেমের দুর্বার আকর্ষণেই তিনি মায়াধীশ হওয়া সত্ত্বেও মায়ার অধীন। তাই জগদীশ্বরী মহামায়া মানব লীলা করেছেন গিরিসুতা গৌরী হয়ে গিরিজায়া মেনকার কোলে। বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদোৎসবে তিনি মর্ত্যে আসেন মানবী কন্যারূপে। যদিও শাস্ত্র মতে বাসন্তী ও শারদীয়া দুর্গাপূজা এই উভয় পূজার প্রচলন থাকলেও, আপামর বাঙালীর জীবনে জনপ্রিয়তা পেয়েছে শারদোৎসব। তবে এর পরিপ্রেক্ষিতে নানা মত প্রচলিত থাকলেও, স্বরোচিষ মন্বন্তর কালে রাজা সুরথের মত একচ্ছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরে পেতেই প্রায়শ্চিত্তকল্পে কলিযুগে মহাযজ্ঞের ব্যবস্থারূপে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ তাঁর কুলপুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীর সুপরামর্শে তৎকালীন সময়ে সাড়ে আটলক্ষ টাকা খরচ করে ভগবতীর শারদীয়া দুর্গাপূজা করার ঘটনাটি ঐতিহাসিকভাবে উপেক্ষা করা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখনীয় যে বামকেশ্বর তন্ত্রে শারদীয়া দুর্গাপূজাকেই “মহাপূজা” আখ্যা দেওয়া হয়েছে (“আশ্বিনে চ মহাপূজা যাত্রা যজ্ঞবলিপ্রিয়া” বা “আশ্বিনে চ মহাপূজাং নবম্যামায়ভেৎ সুধীঃ……………….. তত্রাপ্যশক্তো দেবেশি ত্রিদিনং পূজয়েচ্ছিবাম্।।” ইত্যাদি)। পরবর্তীকালে বিট্রিশ সরকারের আমলে কলকাতা নগরীতে তদানীন্তন সমাজের বিত্তশালী জমিদারবর্গ বিট্রিশ সরকারের তোষামোদ করতে, নিজেদের আধিপত্য প্রতিপত্তি দেখাতে ও অন্যান্য রাজনৈতিক পটভূমিকায় এই শারদীয়া দুর্গোৎসবকে আরও মহিমান্বিত করে তুলেছিলেন। তাই একসময় কলকাতা নগরীতে বিত্তশালী বাঙালীর দুর্গাপূজার আড়ম্বরকে কেন্দ্র করে একটা প্রবাদ প্রচলিত ছিল, “দেবী মর্তে এসে গয়না পড়েন জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁর বাড়িতে, ভোজন করেন কুমারটুলীর অভয়চরণ মিত্রের বাড়িতে ও রাত জেগে নাচ দেখেন শোভাবাজার রাজবাড়ীতে”। কালক্রমে শারদোৎসব এক সময়ে শুধু্ বাংলা ও বাঙালীর নয় সমগ্র পূর্বভারতের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়ে উঠতে পেরেছিল। বর্তমানে এই পূজো দেশের গন্ডী পেরিয়ে সুদূর বিদেশেও পারি দিয়েছে। ২০২১ সালের ১৩ থেকে ১৮ ডিসেম্বর, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে UNESCO-র ইন্টারগভর্নমেন্ট কমিটির ১৬তম অধিবেশনে ‘কলকাতার দুর্গাপুজো’-কে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ তালিকায় যুক্ত করে আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত করেছে, রাষ্ট্রসংঘের এই শাখা সংগঠন। তবে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণ যাইহোক বাঙালীর সংস্কৃতিতে এই শারদীয়া দুর্গোৎসব ও আনন্দিনী উমাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা লোকাচারের গুরুত্ব বাংলার সামাজিক জীবনে অপরিসীম। বাঙালীর কল্পনায় মহিষাসুরমর্দ্দিনী দুর্গা হয়ে উঠেছেন হিমালয়-দুহিতা। হিমালয়-কন্যা মর্তে আসেন মানবীরূপে বাপের বাড়ীতে, সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত তিন দিন থেকে দশমীতে ফিরে যান শ্বশুরবাড়ি কৈলাশে। দেবীর এই মানবী লীলাকে কেন্দ্র করেই তৈরী হয়েছে “আগমনী” সঙ্গীত। “আগমনী”-কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় যেমন- বাল্যলীলা, পূর্ব আগমনী, উত্তর আগমনী ও বিজয়া। বাল্যলীলা তৈরী হয়েছে দেবীর শৈশব এবং জননী মেনকা ও উমার বাৎসল্যরস নির্ভর ভক্তিগীতিকে কেন্দ্র করে। পূর্ব আগমনী গড়ে উঠেছে মর্ত্যে আসার পূর্বের প্রেক্ষাপটে যেখানে শরৎ ঋতুর আবির্ভাবে মেনকার সন্তানবাৎসল্যতার উৎকণ্ঠার সূচনা এবং পূর্ব আগমনীর পরের অংশই উত্তর আগমনী। দশমীতে দেবীর কৈলাশে পুনর্যাত্রাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে বিজয়ার পদসমূহ। উত্তর আগমনী ও বিজয়ায় দেখা যায় মাতা ও কন্যার অশ্রুবিগলিত মিলন দৃশ্য। তাই জনৈক পদকর্তা রামচন্দ্র মালী তাঁর পদে বলেছেন :

“গিরি, আমার গৌরী এসে বসেছে, 

রূপে ভুবন আলো হয়েছে। 

মায়ের রূপের ছটা সৌদামিনী

দিন-যামিনী সমান করেছে।………………….

ভোলানাথ আসবে নিতে- দশমীতে, 

এখনি ভাবিতেছি তাই মনে। 

(আমার) আঁধার ঘরের উজল মাণিক

ছেড়ে দিব্ কোন্ পরাণে ?

দুখ-পাসরা দুঃখিনীর ধন, আমার এই উমা-রতন, 

কে তারে করবে যতন ? শিব থাকে শ্মশানে।

তাঁর বাড়ির ভিতর ভূতের আড্ডা, 

ভূতে কী আর যত্ন জানে!” (আগমনী পর্যায়) 

 

 

 

শাক্তপদাবলীর এই পদগুলি পাঠ করলেই বোঝা যায়, কোন উপলব্ধি থেকে জনৈক ইংরেজ কবি লিখেছিলেন, “Our sweetest songs are those that tell of saddest thoughts”. পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন অনুভুতির এমন সুষ্ঠ ও সর্বাঙ্গীণ প্রকাশ বিশ্বসাহিত্যের কোথাও খুঁজে পাওয়া ভার। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, “বাঙ্গলার জলবায়ুতে মধুর রস বিরাজ করে, তাই বাঙ্গলাদেশে অত্যুগ্র চন্ডী ক্রমশঃ মাতা অন্নপূর্ণারূপে, ভিখারীর গৃহলক্ষ্মীরূপে, বিচ্ছেদ বিধুর কন্যারূপে,-মাতা, পত্নী ও কন্যা, রমণীর এই ত্রিবিধ মঙ্গলসুন্দররূপে দরিদ্র বাঙ্গালীর ঘরে মধুররস সঞ্চার করিয়াছেন।” তাই মৈথিলী কবি আদিনাথের ভণিতায় বলা যায় :

“হম অতি বিকল বিষয় রস মাতল ভগবতি তোহর ভরোশে। 

অশরণ শরণ হরণ দুঃখ দারিদ তুঅ পদ পংকজ কোশে।। 

বিধি হরি শিব শণকাদিক সুরমুনি পারি মনোরথ দানে।

তুঅ গুণ যশ বরণন কর অনুছন বেদ পুরাণ বখানে।।” তাই ভারতীয় সাধন শুধু জ্ঞানমার্গে নয়, বিচার মার্গে নয়, প্রেমঘন ভক্তির মার্গে।

 

 

 

তথ্যসূত্র :-

১) দেবীভাগবত পুরাণ (নবভারত পাবলিশার্স) – আচার্য্য পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত,
২) কালিকাপুরাণম্ (নবভারত পাবলিশার্স) – আচার্য্য পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত ও ড. শ্রীশ্রীজীব ন্যায়তীর্থ কর্তৃক পরিদৃষ্ট,
৩) শিব পুরাণ (নবভারত পাবলিশার্স) – আচার্য্য পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত ও ড. শ্রীশ্রীজীব ন্যায়তীর্থ কর্তৃক পরিদৃষ্ট,
৪) উপনিষদ্ গ্রন্থাবলী (উদ্বোধন কার্য্যালয় সম্পাদিত) – স্বামী গম্ভীরানন্দ,
৫) মহিষাসুরমর্দ্দিনী দুর্গা (শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা) – স্বামী প্রজ্ঞানন্দ,
৬) শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তি সাধনা (রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কলকাতা) – উপেন্দ্রকিশোর দাস,
৭) যোগতন্ত্র-গ্রন্থমালা (Vol-VII) অন্তর্গত রুদ্রয়ামলম্ (উত্তরতন্ত্রম্, প্রথমো ভাগঃ) – আচার্য্য শ্রীরামপ্রসাদ ত্রিপাঠী সম্পাদিত (সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, বারাণসী),
৮) যোগিনীতন্ত্রম্ (নবভারত পাবলিশার্স)- স্বামী সর্ব্বেশ্বরানন্দ সম্পাদিত,
৯) বৃহৎতন্ত্রসার (নবভারত পাবলিশার্স)- শ্রীরসিক মোহন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত,
১০) বাংলাভাষার অভিধান (সাহিত্য সংসদ) – জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস,
১১) শ্রীশ্রীচণ্ডী (গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর) – শ্রীদুর্গাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য কর্তৃক বাংলাভাষায় অনূদিত,
১২) দুর্গোৎসব তত্ত্ব ও পদ্ধতি (গিরিজা) – শ্রীভগবতীচরণ কাব্যভূষণ সঙ্কলিত এবং শ্রীশীতাংশুশেখর পৌরহিতরত্ন সম্পাদিত,
১৩) বৃহদ্ধর্ম পুরাণ (নবভারত পাবলিশার্স) – আচার্য্য পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত,
১৪) বিশ্বকোষ (বিংশ ভাগ) – শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসু সঙ্কলিত ও প্রকাশিত,
১৫) বাঙ্গালীর গান – শ্রীদুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত,
১৬) Saktisangama Tantra (Oriental Institute, Baroda) – Edited by Benoytosh Bhattacharyya,
১৭) অষ্টাদশ মহাবিদ্যা পূজাপদ্ধতি – কিংকর শ্রীনিরঞ্জন ভক্তিবিনোদ সঙ্কলিত ও সম্পাদিত,
১৮) সিন্ধু থেকে হিন্দু – ড. আর. এম দেবনাথ,
১৯) প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য,
২০) কুমারী পূজা (তরফদার প্রকাশনী) – তারাপদ আচার্য,
২১)যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ (গীতাঞ্জলি, ২০১২) – অলোককুমার সেন,
২৩) স্বামী বিবেকানন্দ নতুন তথ্য নতুন আলো (আনন্দ পাবলিশার্স) – শঙ্করীপ্রসাদ বসু,
২৪) শাক্ত পদাবলী-সাধনতত্ত্ব ও কাব্য-বিশ্লেষণ (এস্ ব্যানার্জি এন্ড কোং) – শ্রীব্রজেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য,
২৫) শাক্ত পদাবলী – ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়,
২৬) শাক্তপদাবলী ও শক্তিসাধনা (ডি. এম. লাইব্রেরী) – শ্রীজাহ্নবীকুমার চক্রবর্ত্তী,
২৭) ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য (সাহিত্য সংসদ) – শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত,
২৮) কৃত্তিবাসী রামায়ণ (অক্ষয় লাইব্রেরী) – শ্রীবেণীমাধব শীল সম্পাদিত,
২৯) পন্ডিত জানকীনাথ বিরচিত পদ্মাপুরাণ (অক্ষর পাবলিকেশনস্, আগরতলা) – ড. হরেকৃষ্ণ আচার্য,
৩০) কবিকঙ্কণ চন্ডী – শ্রীনটবর চক্রবর্ত্তী দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত,
৩১) প্রাণতোষিণী তন্ত্র (বসুমতী সাহিত্য মন্দির) – শ্রীসতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রকাশিত,
৩২) রাধাতন্ত্রম্ (নবভারত পাবলিশার্স) – যোগাচার্য্য স্বর্গীয় কামিক্ষ্যা নাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত,
৩৩) বনেদী কলকাতার দুর্গোৎসব (কলিখাতা প্রকাশনী) – শুভদীপ রায় চৌধুরী,
৩৪) রসতত্ত্ব ও শক্তিসাধনা – শ্রীসুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য প্রণীত,
৩৫) পুরোহিত-দর্পন – শ্রীসুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সঙ্কলিত, সত্যনারায়ণ লাইব্রেরী,
৩৬) বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতি (কলিখাতা প্রকাশনী) – তিলক পুরোকায়স্থ,
৩৭) জগদ্রামী রামপ্রসাদী রামায়ণ (কবির চিঠি) – সম্পাদনা ডঃ পঙ্কজ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,
৩৮) মহর্ষি বাল্মীকি প্রণীত অদ্ভুত রামায়ণ – শ্রীদুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত বঙ্গানুবাদ এবং শ্রী নবকুমার দত্ত কর্তৃক প্রকাশিত,
৩৯) মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত অধ্যাত্মরামায়ণম্ – শ্রীযুক্ত নীলকান্ত তর্কবাগীশ কর্তৃক অনুবাদিত,
৪০) মহাভারত (নবভারত পাবলিশার্স) – আচার্য্য পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত,
৪১) হরিবংশ পুরাণ – পন্ডিত রামচন্দ্র শাস্ত্রী বিঞ্জওয়াডেকর সম্পাদিত,
৪২) শিবমহাপুরাণ (চৌখাম্বা সংস্কৃত প্রতিষ্ঠান) – শ্রী ব্রহ্মানন্দ ত্রিপাঠী সম্পাদিত,
৪৩) নারদপঞ্চরাত্রম্ (সংস্কৃত পুস্তক ভান্ডার) – শ্রীশ্রীরামশাস্ত্রী ও শ্রীনির্মলানন্দসরস্বতী কৃত বঙ্গানুবাদ এবং প্রভুপাদ শ্রীকৃষ্ণগোপালগোস্বমীশাস্ত্রী কৃত সম্বলিত,
৪৫) আন্তর্জালের বিভিন্ন লিঙ্ক, ই-ম্যাগাজিন ও অনলাইন সংবাদপত্র হতে তথ্যাদি সংগৃহীত।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত