ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১৭) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনও এক পাড়ায় থাকার সুবাদে ভোগ করা ঝামেলাগুলোর কথা, আমার মনে আছে। মায়েদের নজর থাকত পড়াশুনায় ভাল ফল করা ছেলেমেয়েদের দিকে।ফলে কমবেশি সব দুষ্টু ,দুরন্ত ছেলেমেয়েদের সারাক্ষণ শুনতে হত, “হীরুদাকে দেখেছিস?প্রতিবছর ফার্স্ট হয়।দেখেও কিছু শিখলি না। একই পাড়ায় তোরাও তো আছিস।”
কিংবা, “গান গায় বটে সোনালী। আহা কী গান! তোরা কোন কর্মের না।”
তখন বলা যেত না ,“আমরা যে ভলিবলের শেষের ম্যাচটায় মন্দিরতলাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ান হলাম। সেটা বুঝি কিছু নয়? কদমতলা জিতেছে তো আমাদের জন্য।”
কিংবা “কতবার বলেছিলাম আঁকা শিখব, গান শিখব। ভর্তি করে দিলে না তো।”
না এসব একেবারেই বলা চলত না।তাহলেই বড়দের মুখের ওপর কথা বলার দোষ পড়ত ঘাড়ে।
আমাদের সব কাছাকাছি পাড়া মিলিয়ে শহরের দক্ষিণ দিক। পুরো দক্ষিণ দিকের হিরো ছিলেন একজন।তিনি হলেন সাঁতারু গোলকদা। তাঁর সাঁতারের ক্লাসে পাড়ার সব ছোটরাই সাঁতার শিখতে জড়ো হত। গরমকালে দু’তিনটে ছুটির দিন একসঙ্গে পড়লে তিনি একটা অদ্ভুত খেলা খেলতেন। সেটি হল, ‘অবিরাম সন্তরণ’। তার সাঁতার শেখানোর বিশাল পুকুরটাকে ঘিরে দড়ি টাঙিয়ে, তাতে লাল,নীল বেলুন ঝোলানো হত। সেই পুকুরের জলে অবিরাম সাঁতার কাটতেন তিনি। রাতেও জলেই থাকতেন। কখনো কখনো চিত সাঁতারে বা এমনি ভেসেও থাকতেন। বারো ঘন্টা,চব্বিশ ঘন্টা,আটচল্লিশ ঘন্টা,এভাবে সময় বাড়াতেন।পুকুরের চারধারে মেলা বসে যেত।আর আমরা ছোটরা হাঁ করে সাঁতার দেওয়া কালীন তার লিকুইড খাবার খাওয়া, ডাক্তারদের কাছে ভেসে ভেসেই শারীরিক অবস্থার পরীক্ষা দেওয়া লক্ষ করতাম।
সবচেয়ে বড় কথা এসব তিনি অর্থ উপার্জনের জন্য করতেন না। ক্লাবগুলো কিছু খরচ বহন করলেও বাকিটা হয়ত তাঁর পকেট থেকেই যেত। সাঁতারের জন্য ভাল একটা চাকরি পেয়েছিলেন তিনি।ওই ‘অবিরাম সন্তরণ’ ছিল তাঁর সাঁতারে সিদ্ধির একটা নমুনা প্রদর্শন।যা দেখে অনেকেই সাঁতারে আগ্রহী হত।এখন আরো মনে হয় ওই কষ্টসাধ্য সাঁতারের লক্ষ্য নিছক আমোদ দেওয়া হতে পারেনা। ওটা ছিল একধরণের লোকশিক্ষা। সেই প্রবাদটির মতো, “আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও।”
পাড়ার কোন কোন লোকের কিছু কিছু বিশেষ ব্যাপারে দক্ষতা থাকলে, সেই দক্ষতা অনুযায়ী তাদের নামও দেওয়া হত।একপাড়ায় হয়ত তিনজন শিবু আছেন।বলা হত ,বাঁশি শিবু, নাটুকে শিবু, কিংবা আর্টিস্ট শিবু।সবাই ঠিক লোকটিকে সনাক্ত করত ওই নামে।বাঁশি শিবু ভালো বাঁশি বাজাতেন, পেল্লায় লম্বা ছিলেন।নাটকে পারদর্শী নাটুকে শিবুর ছিল ইয়া লম্বা নাক।আর আর্টিস্ট শিবুর আঁকা ছিল অপূর্ব!ফি বছর সরস্বতী ঠাকুরের পেছনের বনের সিনারিটি তিনি ফ্রিতে এঁকে দি্তেন। আমরা ছেলে ছোকরার দল নিজেদের মধ্যে তাদের আর এক দফা নাম দিই।বাঁশি শিবু হলেন ঢ্যাঙা শিবু, নেকো শিবু বলা হত নাটুকে শিবুকে,আর আর্টিস্ট শিবুকে সিনারি শিবু বলে উল্লেখ করতাম আমরা। এসব ছোটখাট মজা বড়দের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে পাড়ায় নিজেদের মধ্যে সারাক্ষণ চালু থাকত।
আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১৬) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
আরো নানারকমের মজা ছিল।সেটি হল অন্যের বাগানে ঢুকে ফলপাকুড় পাড়া। বারোয়ারি পুকুরে বসে মাছ ধরা। পেয়ারা বা কুল পাড়তে যাওয়া হত দুপুরবেলা। বাড়ির বড়রা দোর দিয়ে ঘুমোচ্ছেন ,আর পাড়ার সব ছেলেমেয়ের দল তাদের বাগানে ঢুকে গাছে উঠে নিঃশব্দে গাছ ফাঁকা করে দিচ্ছে, এ ঘটনা প্রায় ঘটত।হয়ত সে বাড়ির কোন কনিষ্ঠ সদস্য সঙ্গে আছে, আর সবরকমের সাহায্য করছে।পরে বাড়ির লোকেরা যখন আমাদের বলতেন, “এভাবে চুরি করে গাছ ফাঁকা করার কি সত্যি দরকার ছিল?আমাদের বললে কি বারণ করতাম?”
আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতাম। কোন জবাব দিতাম না।
এপ্রসঙ্গে একজনের কথা না বললেই নয়।তিনি হলেন মিতার মা। মিতাদের বাড়িতে ছিল উঁচুজাতের এক পেয়ারা গাছ।হলুদ পাকা পেয়ারা বা সবুজ ডাঁসা পেয়ারায় গাছ ভর্তি হলে আমরা ওদের বাড়ি হাজির হতাম।মিতার মা ছিলেন খুব ভালমানুষ।তাঁকে বলা হত “কাকিমা,আমরা গাছে উঠে কয়েকটা পেয়ারা পাড়ব?”
তিনি বলতেন, “মিতার বাবা ,জ্যেঠা কেউ বাড়ি নেই।গাছে উঠে কোন বিপদ হলে কে দেখবে?ঠিক আছে,দু’একটা পেড়েই নেমে এসো।”
আমরা অম্লানবদনে কথার খেলাপ করে ঘন্টাখানেকের মধ্যে গাছ প্রায় ফাঁকা করে নেমে আসতাম। কাকিমা বারবার নামতে বললেও শুনতাম না।মিতা আমাদের দলেই যোগ দিয়ে হুল্লোড় করত।পুরো ঘটনাটার অসহায় সাক্ষী হতেন নিরীহ কাকিমা।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।