Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

পাঠ প্রতিক্রিয়া: কোথায় সেই যুগপুরুষ । দিলীপ মজুমদার

Reading Time: 3 minutes

সম্প্রতি রূপক সাহার  ‘ক্ষমা কর হে প্রভু’  উপন্যাসটি পড়লাম। এতে প্রভু বলে সম্বোধন করা হয়েছে চৈতন্যদেবকে। বৈষ্ণব ধর্মালম্বীদের কাছে চৈতন্যদেব ভগবান বিষ্ণুর অবতার। রাধাভাবে তিনি বিষ্ণু বা কৃষ্ণের আরাধনা করেছিলেন।  চৈতন্যদেবের ধর্ম নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু সমাজে তাঁর গুরুত্ব আমি স্বীকার করি। আধুনিক যুগের  রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মতো তিনিও একজন সমাজ সংস্কারক। মানুষে মানুষে বিভেদ যখন প্রকট হয়ে উঠেছিল, ধর্মীয় আচার-আচরণ যখন বিকৃতির পথে চলে যাচ্ছিল, সেই সময়ে চৈতন্যদেব তাঁর নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের দ্বারা তাকে প্রতিরোধ করেছিলেন।  চৈতন্যদেবই এ দেশে প্রথম গণান্দোলনের প্রবর্তক, গণমিছিল ও গণপ্রতিরোধের পথ প্রদর্শক। সে দিক থেকে ষোড়শ শতকেই  হয় প্রথম রেনেসাঁ বা নবজাগরণ।

রূপক সাহা তাঁর উপন্যাসে চারটি চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর কাহিনিটি গঠন করেছেন। প্রকাশক ও পত্রিকা সম্পাদক জয়দেব  তিনি  চৈতন্যদেবের অর্ন্তধান রহস্য নিয়ে গবেষণা করছেন। নবদ্বীপের  বৈষ্ণব পরিবারের মেয়ে উপাসনা গবেষণা করছেন চৈতন্যদেবের নবজন্ম নিয়ে। কৃতি ছাত্র গোরা আবিষ্কার করেন যে চৈতন্যদেবের জীবনে যা যা ঘটৈছিল , তাঁর জীবনেও তাই ঘটছে। পুরীর অনাথ আশ্রমে মানুষ পুরন্দর চৈতন্যবিরোধী পদ্মনাভের নির্দেশে চৈতন্যবিরোধীদের খুন করলেও পরে তাঁর বোধদয় হয়। তাঁর জন্মরহস্য প্রকাশিত হলে তিনি বুঝতে পারেন তিনি গোরার ভাই এবং তিনি তখন গোর, জয়দেব প্রভৃতিদের  রক্ষার ভার গ্রহণ করেন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,অবতার


উপন্যাসটির মূল বিষয় দুটি। চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান রহস্য ও চৈতন্যের নবজন্ম। চৈতন্যদেবের মৃত্যুরহস্যের সুস্পষ্ট মীমাংসা এখনও হয় নি, ধাঁধাঁই থেকে গেছে। কারো মতে রথযাত্রার সময়ে তাঁর পায়ে ইষ্টক বিদ্ধ হয়, পরে তা বিষিয়ে গিয়ে মৃত্যু ডেকে আনে। কেউ বলেন তিনি পুরীর জগন্নাথ মূর্তির মধ্যে বিলীন হন। কারো মতে পুরীর সমুদ্রে তিনি ডুবে মারা যান। আবার একদল গবেষক মনে করেন তাঁকে খুন করা হয়েছিল। ওড়িশার চৈতন্যদ্রোহীরা মনে করতেন চৈতন্য হুসেন শাহের গুপ্তচর,  ওড়িশার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশকে তিনি বিষিয়ে তুলেছিলেন। ওড়িশার ইতিহাস থেকে, জনমানসের মন থেকে চৈতন্যদেবকে মুছে দেবার জন্য গঠন করা হয় এক গুপ্ত সংগঠন, আজও যা সক্রিয় এবং পদ্মনাভদের মতো মানুষেরা যার ধ্বজা বহন করে চলেছেন। যাঁরা  চৈতন্যদেবের মৃত্যুরহস্য নিয়ে চর্চা করেন , এই গুপ্ত সংগঠন তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেন।

উপন্যাসের দ্বিতীয় বিষয় হল চৈতন্যদেবের নবজন্ম। সেজন্য হাজির করা হয়েছে গোরাকে। গোরার নামের সঙ্গে, চেহেরার সঙ্গে চৈতন্যদেবের মিল আছে।  সে কারণে অচেনা মানুষও তাঁর প্রতি স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে ভক্তিপ্রণত হয়। গোরা ভুবনেশ্বেরের ছেলে, মানুষ হয়েছেন এক দলিত পরিবারে। দলিত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তিনি। বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান বলে চৈতন্যদেবকে তিনি সম্মান করেন, যদিও অলৌকিকতায় তাঁর বিশ্বাস নেই। চৈতন্যদেবের মতো গোরা প্রথমে ছিল যুক্তিবাদী, পরে হয় ভক্তিবাদী; চৈতন্যদেবের মতো তারও দিব্যোন্মাদ অবস্থা দেখা যায়।  তখন দলিত আন্দোলন থেকে তিনি  বিদায় গ্রহণ করেন। গোরাকে অবতার বলে নিঃসন্দেহ হন জয়দেব, পুরন্দর, প্রতাপ পট্টনায়ক প্রভৃতিরা।

অবতার রূপে গোরার আবির্ভাবের কারণ হিসেবে শাস্ত্রবাণী উল্লেখ করা হয়েছে। গীতায় কৃষ্ণ বলেছিলেন পৃথিবী যখন পাপে পূর্ণ হয়ে উঠবে তখন পাপীদের বিনাশ ও সাধুদের পরিত্রাণের জন্য তিনি অবতাররূপে আবির্ভূত হবেন। জয়দেব তাঁর গীতগোবিন্দে বর্ণনা করেছেন দশাবতারের। বলা হয়েছে কলিযুগের কথা। এই যুগেই পৃথিবী পূর্ণ হবে পাপে। নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যদ্বাণীর মতো ওড়িশার ‘মালিকা সাহিত্যে’ও কলিযুগের কথা বলা হয়েছে।

শাস্ত্র যাকে অবতার বলে , আমরা তাকেই বলব যুগপুরুষ বা মহামানব। যুগে যুগে এ রকম মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে পৃথিবীতে, যাঁরা বিভেদ ও বিভাজনের বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন তাঁদের বাণী, বদলাতে চেষ্টা করেছেন পৃথিবীকে। আজ পৃথিবীর দিকে তাকালে মনে হয় কলিযুগ বোধহয় প্রকট হয়েছে তার সমস্ত অঙ্গ-ভঙ্গিমা নি্য়ে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিস্ময়কর উন্নতির এই যুগে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা প্রবল, ছলনা ও ভণ্ডামি শিখর স্পর্শ করেছে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, অব্যাহত ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে স্বার্থসাধনের উৎকট প্রবণতা, দুর্বলের উপর সবলের আধিপত্য, আত্মেন্দ্রিয় প্রতিইচ্ছার সাধনা। রবীন্দ্রনাথ আশা করেছিলেন সে রকম মহামানবের। ওই মহামানব আসে দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে। কোথায় সেই মহামানব? পৃথিবীর মহাদানবরা কি মহামানবদের আতুঁড়ঘরে নুন খাইয়ে হত্যা করেছে?

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>