অবিনাশ

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৭) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

Reading Time: 6 minutes

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায়  চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।

অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


শ্রীমান কাঁটায় কাঁটায় দশটার সময় অফিস পৌঁছে গেল।ইস,প্রথম দিনই সে দেরি না করে অফিসে উপস্থিত হতে পেরেছে। সিটি বাসটা মাঝখানে এত দেরি করেছিল যে সে ভেবেছিল সময়ে অফিস পৌঁছাতে পারবে না।গণেশগুড়ি চৌরাস্তার কাছে একটা মিলিটারি কনভয় পার হচ্ছিল। উচু উঁচু ক্রোধী গাড়িগুলির উপরে মাথায় কালো কাপড় বাঁধা সেনারা উদ্যত মেশিনগান তাক করে রেখেছিল।

শিকারি শ‍্যেনের মতো তারা পথচারীদের লক্ষ্য করে যাচ্ছিল।

শিকারি শ‍্যেনের মতো ওদের চোখগুলি চকচক করছিল।

অফিসে এসে দেখি কেউ আসেনি।এডিটর নেই। দিদি নেই।

সে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ।

কোথায় বসবে সে ঠিক করতে না পেরে অফিসের খালি একটা টেবিলের সামনে বসে রইল। কিছুক্ষণ পরে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে হাসি ঠাট্টা করতে করতে ভেতরে প্রবেশ করল। ওরা তার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে  নিজের জায়গায় বসল।

অদ্ভুত ইংরেজি এবং ভাঁজ দেওয়া অসমিয়া উচ্চারণে ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকল। দু একবার তারা আড় চোখে শ্রীমানের দিকে তাকাল।

‘ আপনি কাউকে খুঁজছেন নাকি?’– মেয়েটি কোমল স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করল।

সে চমকে উঠল। এতক্ষণ পর্যন্ত সে নানা ধরনের চিন্তার আবর্তে ডুবেছিল। ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো তার মনের মধ্যে পাক খাচ্ছিল বালির খাদান, হাঁ করে থাকা মানুষটি, গুম হয়ে যাওয়া ডেড বডিটা ….। হঠাৎ মেয়েটির কোমল স্বরে সে চমকে উঠল।

‘ না, না কাউকে খুঁজছি না।’– অপ্রস্তুত হয়ে সে দ্রুততার সঙ্গে জবাব দিল।

মেয়েটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘ না, মানে আমি’,সে এবার তোতলাতে শুরু করেছিল।’ আমি মানে গতকাল এখানে সাব-এডিটর হিসেবে জয়েন করেছি, আজ অফিসে প্রথম দিন। কাউকে চিনি না। এডিটর স‍্যারও আসেনি। আমার নাম শ্রীমান।’

‘ও,তাই নাকি?হাউ নাইস,আমি প্রিয়ম্বদা,ও কৌশিক।আমরাও ‘সাব’। ওয়েলকাম  টু ডি য়েট আনলান্সড নিউজ পেপার।’ মেয়েটি প্রগলভ হয়ে উঠেছিল। কৌশিক নামের ছেলেটি হাসল। শ্রীমান সহজ হয়ে উঠল। তার মনের মধ্যে কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকা মৃত মানুষটির মুখটা, ঘটনাগুলির বিক্ষিপ্ত স্মৃতি এই সমস্ত কিছু সাময়িকভাবে মন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।


আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৬) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


ওরা কফি খাচ্ছিল।(দিদি কফি খেতে ভালোবাসে।দিনে দুবার স্টাফদের জন্য কফির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফ্রি। ভালো ব্রেন স্টিমুলেন্ট।),গল্প গুজব করছিল, কাগজটার কথা আলোচনা করছিল। কোন কোন বিভাগ কীভাবে সাজানো হবে সেই সব কথা বলছিল। এডিটরের  বিষয়ে পরচর্চা করছিল– মহা কৃপণ, স্ত্রীর সঙ্গে খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই। দিদির গুনগান করছিল,বেতনটা একটু বেশি হলে যে ভালো ছিল সে কথা বলছিল।শ্রীমানের  বেতন সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। তার বেতনের পরিমাণ কত হবে কেউ বলেনি।বাছাৱট আয়োগ ধরা হলে বেতন খারাপ হবে না’– প্রিয়ম্বদা বলেছিল। কৌশিক সশব্দে হেসেছিল।’ গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’– সে মজা করছিল।’ কাগজ বের হয়নি। ডামি কবে বেরোবে তার ঠিক নেই।এখনই বাছাৱত। শ্রীমানের কাছে এই কথাগুলি নতুন ছিল। সে রস পেয়েছিল। সবাই খুব জোরে জোরে হাসছিল ।

বিকেলে অবিনাশ এসে উপস্থিত হল।

‘ তুই কী করছিস দেখতে এলাম– হাসতে হাসতে সে বলেছিল।

‘ এদের কাছ থেকে জার্নালিজম শিখছি’, প্রিয়ম্বদা এবং কৌশিককে দেখিয়ে সে বলেছিল।

‘ এক্সিলেন্ট, গুরু খুব ভালো পেয়েছিস।’

‘ আরে গুরুতো তুই ভাই। তোর জন্যই এই কন্টকাকীর্ণ পথে পদক্ষেপ।’

অবিনাশ একটা আত্মসন্তুষ্টির হাসি হাসল। প্রশংসা সবাই ভালোবাসে আর ভালোবাসে স্বীকৃতি। শ্রীমান অকৃপণভাবে কথাটা বলায় সে খুশি হয়েছিল। তার পুরো মুখে ভালো পাওয়াটা ফুটে উঠল।

‘ তোকে আজ পার্টি দিতে হবে চল।’ অবিনাশ তাকে বলেছিল

‘ পার্টি? কী দিয়ে পার্টি দেব! তুই টাকা ধার দে, বেতন পেলে দিয়ে দেব।’

‘ আরে, অ্যাডভান্স দেবে। দাঁড়া, দিদি এসেছে নাকি?’

‘ এসেছে বোধহয়।’

‘ দাঁড়া, আমি কথা বলে আসি।’ শ্রীমানকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অবিনাশ ভেতরে চেম্বারে ঢুকে গেল।

কিছুক্ষণ পরে শ্রীমানের ডাক পড়ল।

দিদি সুন্দর করে হেসে বলল–’ কাজ করতে কেমন লাগছে?’

‘ সবে তো আজ এসেছি। কাজ তো হয়নি।’

‘ অবিনাশ আমাকে আপনার সমস্ত কথা বলেছে। আপনি নাকি খুব ভালো গল্প– কবিতা লেখেন। খুব ভালো কথা। এডিটর স‍্যার ও বলেছেন( সম্পাদককে দেখিয়ে) যে আপনি প্রথমে সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠাটাই দেখুন। তিনি আপনাকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দেবেন। কেমন হবে?’

‘ ভালো হবে,দিদি।’ 

‘ ঠিক আছে। আপনি উনার কাছ থেকে বুঝে নেবেন। ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে যাবেন। আপনাকে কিছু এডভান্স দিয়ে দেবে।’

‘ হবে দিদি, ধন্যবাদ।’

শ্রীমান যেন তার ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

কড় কড়ে একশো টাকার পাঁচটা নোট নিয়ে সে এডিটরকে বলে অবিনাশের সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিল।

‘ চল, এই দুপুর বেলা আর কী খাবি, বিয়ার খাই গিয়ে।’

‘চল।’ শ্রীমান সম্মতি দিয়েছিল।

দুজন এসে রাজধানীর কাছে একটা হোটেলে ঢুকেছিল। বারে না গিয়ে অবিনাশ তাকে ওপরের একটা রুমে নিয়ে গিয়েছিল। বিয়ার এবং খাবারের অর্ডার দিয়েছিল ।

‘খাবারটা ফ্রি।দাম দিতে হবে না। তোর পয়সা বাঁচিয়ে দিলাম। বিয়ারের দামটা কেবল দিয়ে দেব।’– অবিনাশ বলেছিল।

শ্রীমানের প্রশ্নবোধক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলেছিল।

‘ আমার পরিচিত হোটেল। খাতির আছে। সব ফ্রি ভালো লাগেনা। তাই আমি বিয়ার খেলে সব সময় দামটা মিটিয়ে দিই।’

ধীরে ধীরে শ্রীমানের একটু একটু নেশা হতে লাগল। নেশা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমানের সকাল বেলার ঘটনাটা পুনরায় মনে পড়ল।

অবিনাশের নাক-মুখ এবং হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেট থেকে কুন্ডুলি পাকিয়ে অনবরত ধোঁয়া উঠছিল। ওরা বসে থাকা রুমটা ক্রমশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে লাগল। এটা ওটা কথা বলার সময় শ্রীমানের হঠাৎ ঘটনাটা কথা মনে পড়ে গেল। তার মনটা ছটফট করে উঠল। সে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। অবিনাশ এবার তার ছটফটানি বুঝতে পারল।

‘ কি হল তোর? নেশা লেগেছে নাকি?’– সে জিজ্ঞেস করল।

‘ না। আমি মুখটা ধুয়ে আসছি দাঁড়া।’

শ্রীমান এবার বাথরুমে ঢুকে গেল। বেসিনের কলটা খুলে দিয়ে সে খুব জোরে জোরে চোখে- মুখে জলের ছিটা দিতে লাগল। চোখেমুখে জলের ছিটা দেওয়ায় তার অনেকটা ভালো লাগতে লাগল। মুখের জলটা হাত দিয়ে মুছে সে মাথা তুলে সামনের আয়নার  দিকে তাকাল।

আঃ! আয়নায় এটা কে? কে তার পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে।আঃ, এটা সেই মরা মানুষটা– বালির খাদানের মানুষটা।

শ্রীমান চমকে উঠল। মুখ দিয়ে তার একটা অস্ফুট শব্দ বের হল।

আয়নার ছায়ামূর্তিটার হাসি বন্ধ হল। আয়নায় ফুটে উঠা শ্রীমানের ভয় বিস্ফোরিত মুখের দিকে তাকিয়ে ছায়া মূর্তিটা বলল, কী হল? এত চমকে উঠলি?’

আঃ। এটা অবিনাশ। কোন মুহূর্তে সে বাথরুমের খোলা দরজা দিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল শ্রীমান বুঝতেই পারেনি। দুবার ঢোক গিলে শ্রীমান র‍্যাক থেকে টাওয়েলটা নেবার জন্য হাত বাড়াল।

অবিনাশ ভেতরে প্রবেশ করল। শ্রীমানের কাছে দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভাবে পেন্টের জীপ খুলে টয়লেটে প্রস্রাব করতে আরম্ভ করল । ‘কি হল তোর?’ অবিনাশ প্রশ্ন করল । ‘এত ভয় পেতে পারে কোনো মানুষ?’ 

বাথরুমটা প্রস্রাবের খারের গন্ধে ভরে উঠল। প্রস্রাব করে ফ্লাস টেনে অবিনাশ সহজভাবে বেরিয়ে গেল। শ্রীমানের পা দুটো হঠাৎ বড়ো দুর্বল বলে মনে হল। দেওয়ালে একটা হাত দিয়ে ভর দিয়ে সে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করল। তারও প্রস্রাব করার ইচ্ছে জাগল।

‘নে আর ও একমগ বিয়ার নে।’ সে বাথরুম থেকে আসার পরে অবিনাশ বলল।

‘না, আমার হবে নাকি, তুই খা।’

‘নে,নে, কিছুই হবে না। নেশা হলে দুপুর বেলাটা এখানেই শুয়ে থাকব। বিকেলের দিকে কাগজের অফিসে গেলেই হবে। তোর তো সেটাও করতে হবে না। কাগজ বের হয়নি। কাগজ বের হলে ল‍্যাঠা  লাগবে।’

শ্রীমানের পুনরায় নেশা হতে লাগল। তার পা টলমল করতে লাগল। মাথাটা সামান্য ঘোরাতে লাগল।

‘ একটা কথা অবিনাশ’–কিছুক্ষণ পরে সে ইস্তস্তত করে বলল।

‘কী?’

‘ এই যে চারপাশে কিলিং গুলি হচ্ছে। কখনও মরা মানুষের শব দেহটি কোনোরকম চিহ্ন না রেখে অদৃশ্য হয়ে যায়। তাই না?’– সে জিজ্ঞেস করেছিল। 

কখনও কখনও কিছু ডেড বডি গুম করে দেওয়া হয়।– অবিনাশ হালকা সুরে উত্তর দিয়েছিল।

শ্রীমান কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে পড়ল।

‘ গুম করে দেওয়া হয়’– সে নিজের মনেই বলল। কেন? কে করে?’

‘কে? কেন করে মানে? এখন দেশে ইমার্জেন্সি কাউন্টার ইমার্জেন্সি চলছে। একপ্রকার তাড়ানো শিকারের মতো কারবার। একদিকে আত্মগোপনকারীরা আর অন্যদিকে পুলিশ, মিলিটারি, ইন্টেলিজেন্স। এখন এরকম অবস্থা হয়েছে যে একদল ছেলে আত্মগোপনকারীদের সংশ্রব ত্যাগ করে চলে এসেছে। চারপাশে সন্দেহ, সংশয় ,ভয়। মাঝেমধ্যে ঘটছে  বিশ্বাসঘাতকতা। আসলে কী ঘটেনি বলতো! সবই তো ঘটেছে। এতদিন বইপত্রে যা সব পড়তাম, শুনেছিলাম সেসব ঘটছে। গ্রামীণ গেরিলা যুদ্ধ, শহুরে সন্ত্রাসবাদ, গুপ্তহত্যা…’

‘সেই সব তো বুঝলাম– কিন্তু একটা লাস গুম হয়ে যাওয়া কথাটা…’

‘ কী লাস একটা গুম হয়ে যাওয়ার কথা বারবার বলছিস? কী হল বলতো।’

‘ না, কিছু হয়নি…।’

‘ কিছু একটা হয়েছে। খুলে বল।’

বলব নাকি শ্রীমান ভাবল। তার কারোকে কথাটা বলতে ইচ্ছা করছে। কাউকে খুলে বলতে পারলে যেন তার ভালো লাগবে। মনটা হালকা হবে। কথাগুলির কোনো একটি সমাধান বের হবে। কোথাও আলো! অন্য কিছু না হলেও তার মনের বোঝাটা, ভয়টা কিছুটা কমবে। অল্প নয় বেশ ভালোই কমবে। তার অবিনাশকে কথাটা খুলে বলতে ইচ্ছা হল। কিন্তু একই সঙ্গে তার ভয়ও হল। কী এক অনামী ত্রাস তাকে চেপে ধরতে লাগল। বলবে কি? বলা উচিত হবে কি?ও হো। উচিত হবে না। কাউকে এই কথাটা বলা ঠিক হবে না। ভয়ের কথা। হ্যাঁ কথাটাতে ভয় আছে। ভয় আছে। সত্যিই ভয় আছে।

না ,সে অবিনাশকে এখনই কিছু বলবে না বলেই স্থির করল।

‘ বলতে পারিনা কেন এই গুপ্তহত্যা এবং ডেড বডি গুম করে দেওয়া কথাটা আমাকে এত অশান্তি দেয়। কাগজে এই যে খবরগুলি বের হয় অমুক নিরুদ্দেশ, খুঁজে পাওয়া যায়নি, জীবিত না মৃত কেউ জানে না। কখন ও ডেড বডিটা বহুদিন পরে প্রকাশ্যে আসে, কখন ও পাওয়া যায় না। এই সার্গেই  নামে রাশিয়ান  ইঞ্জিনিয়ারটা, সঞ্জয় ঘোষ– ওদের তো খুঁজে পাওয়া গেল না। আরও হয়তো এরকম কত আছে।’

‘ সেটা তো ঠিক।’

‘ এই কথাটাই আমাকে বড় এ্যাফেক্ট করে বুঝেছ। এটাকে আমি মেনে নিতে পারি না। রাজনৈতিক হত্যা– আমি বুঝতে পারি। কিন্তু এটা? এটাকে তুই কীভাবে মেনে নিবি বলতো।’ শ্রীমানের মনে হল অবিনাশ তার কথাটা মেনে নিয়েছে। সে বিশ্বাস করেছে। সে কথাটা শুনে কিছুটা গম্ভীর হয়ে পড়েছে। শ্রীমানের মনটা ভালো লাগল। একটা বিরাট স্বস্তি পেল বলে মনে হল তার।

দুজনেই প্রায় নীরবে ভাত খেল।

‘ এখন আর কোথায় যাবি’– অবিনাশ বলল।’ শুয়ে থাকি আয়। বিয়ার খেলে ঘুম পায়।’

দুজনেই হোটেলের রুমে শুয়ে পড়ল। সংকীর্ণ বিছানা দুটিতে দুজনে দুদিকে পড়ে রইল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অবিনাশ ঘুমিয়ে পড়ল। তার নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ ঘরটাতে ছড়িয়ে পড়ল। শ্রীমানের ঘুম এল না। ঘরটার ডিম লাইটের আলোতে সে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগল।

এই যে জলজ্যান্ত একটি ছেলে আমার পাশে শুয়ে আছে!

আগামীকাল যদি কেউ একে ধরে নেয়?

কোনো নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। বালির খাদানে, পাথরের খনিতে।

নির্জন জায়গায় কোনো কারনে( কারণ তো থাকবেই। কারণ না থাকলেও সন্দেহ থাকবে। সন্দেহই যথেষ্ট।) টর্চার করে, তারপর মাথার পেছনদিকে গুলি করে মেরে ফেলে এবং তারপরে কোনো চিহ্ন না থাকা ডেড বডিটা কোনো এক অজ্ঞাত জায়গায় পুতে ফেলে! একটা জীবন একটাও বুরবুরি না তুলে হঠাৎ অন্তর্ধান  হয়ে যাবে।

‘আঃ, আমি এসব কী ভাবছি!’ শ্রীমান বিছানায় উঠে বসল। সে ঘামতে শুরু করল। দরদর করে সে ঘামতে লাগল।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>