তোমার ভুলে যাওয়া কথাগুলো
সোনার চিরুনিতে মাথায় গেঁথে রেখো
আমি একদিন সময় করে ঠিক
খোঁপাটা খুলবো দেখো
—সাধনা মুখোপাধ্যায়
স্বামীর মৃত্যুর পর আমার সামনে একটি পথই খোলা। আত্মীয় স্বজনেরা বললো, টাকা জমা দিয়ে এইবার হজটা সেরে আসো। তোমার একার জীবন আর কয়দিন। বাচ্চাকাচ্চা থাকলে না হয় কথা ছিল। আমি তখন মুখের ওপর কিছু বলতে পারি নাই। শোকের বাড়ি। লোকটার নিশানা কোথায় নেই! বেডরুমের লাগোয়া ক্লজেটে ফুলস্লি ভ-হাফস্লিভ, খাটো-লম্বা, স্কিনটাইট-ঢোলা-ঢিলা—হরেক রঙের, নানান সময়ের ফ্যাশনের জামাকাপড়। পাল্লা সরালে পারফিউমসমেত গায়ের গন্ধটাও নাকে লাগে। শীতের শুরুতে সে খাদি পাঞ্জাবিই পরতো। প্রবল শৈত্যপ্রবাহে মোটা পুলওভার বা বিচিত্র নকশার কাশ্মীরি শাল। বিয়ের সময় মায়ের দেওয়া ছাই-ছাই ব্লেজারটা তাই দুই দশকেও নিভাঁজ-নিপাট রয়ে গেছে। তখনও টানেলমতো পেছনের লম্বা বারান্দায় বিন ভর্তি ভাঙা অ্যাম্পুল, সিরিঞ্জ, খালি স্যালাইন বোতল। পাশের নোনা-ধরা দেয়ালে কাত করে থোয়া শ্যাওলারঙা বেডপ্যানটা শেষের কয়দিন আমাকে ঝামা দিয়ে ঘষে ঘষে সাফ করতে হয়েছিল। তখন আর বিছানায় পেসাব-পায়খানা করতে আপত্তি করতো না। সে শক্তিই ওর ছিল না।
বাড়িটা ফাঁকা হওয়ার পর আমি একা হয়ে গেলাম। ওর কাপড়চোপড় রোদে মেলে দিই। তুলে এনে ইস্ত্রি করে থুই ট্রাঙ্কেরটা ট্রাঙ্কে, ওয়্যারড্রবেরগুলি ওয়্যারড্রবে। ভাঁজে ভাঁজে বড়ো বড়ো মুক্তাদানার মতো ন্যাপথলিন বেঁচে থাকতে সে যেমন করে রাখতো, অবিকল সেইভাবে মালার মতো সাজিয়ে রাখি। খানার অক্তে আগের মতো টেবিল লাগাই। মুখোমুখি চেয়ারের সামনে সোনালি বুটিদার দুটি কাচের প্লেট, যার একটি খালিই পড়ে থাকে। পাতে খাবার বেড়ে দেওয়া আমার স্বামীর পছন্দ ছিল না। বল-বাটি থেকে ভাত-তরকারি নিজেই তুলে নিতো আন্দাজমতো। খেতো ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ ধরে। প্লেটটাও আঙুল টেনে টেনে এমনভাবে সাফ করতো, যেন তাকালেই আয়নার মতো মুখ দেখা যাবে। উঠে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে ভাবি, দিনযাপনের চেয়ে রাতযাপন যে আরও কষ্টকর! ঝকঝকে খালি প্লেটটা সরিয়ে নিয়ে গ্লাসে পানি ভরে রাখি না কেন। আমার স্বামী তো রাতে উঠে উঠে এক চুমুক করে পানি খেতো। দেখি সকাল অব্দি গ্লাসটা ভরা থাকে কি না!
কারও ছায়ার ওপর ভরসা করে জীবন চলে! আচ্ছা, আমাদের বাচ্চা হলো না কেন! রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবি। আমি বরাবর ডাক্তারের কাছে যেতে চাইতাম। বেশি জোরাজুরি করলে আমার স্বামী বাড়িতে খানা-দানা ছেড়ে দিতো। টেলিভিশন দেখাও যেতো বন্ধ হয়ে। বারান্দাটাই ওর নিবাস। আরামকেদারায় দোল খেতে খেতে ঘুমাতোও সেইখানে। আমি হাল ছেড়ে দিতাম। অহেতুক হাঙ্গাম করা কেন। আমরা তো সুখেই আছি। বছরে দু-এক বার নতুন নতুন জায়গায় বেড়াতে যাই। সেসব ছবিতে ঠাসা ডজন খানেক ঢাউস অ্যালবাম। বেছে বেছে গুটিকয় দেয়ালেও টাঙানো হয়েছে।
সকালে উঠেই ডাইনিং স্পেসে ছুটে যাই। যেন ঘোলের শরবতে গুঁড়া মরিচ ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, এক গাদা লাল পিঁপড়া পুরু হয়ে ভাসছে গ্লাসের পানিতে। মনটা কেমন দমে গেল। আমার স্বামী তো স্বেচ্ছায় চলে যায়নি। অকথ্য যন্ত্রণা দিয়ে তাকে দুনিয়া থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। পঞ্চাশ কোনও বয়স হলো! যে প্লেট চেটেপুটে তৃপ্তি করে খেতো, যার শখ ছিল বিচিত্র সব পোশাক-আশাক কেনাকাটার, সপ্তাহান্তে চুল রং করায় যার গাফিলতি ছিল না, বেড়ানোর নাম শুনলে যে নেচে উঠতো শিশুর মতো, সে কি জীবনের দাবি ছেড়ে গেছে? আলবত নয়। বাতাসে জানালার পর্দা দুলে উঠলে মনে হয়- এসেছে। গভীর রাতে ডাইনিং স্পেস দিয়ে হালকা পায়ে বারান্দায় হেঁটে যায়। ক্লজেটে উঁকি মেরে দেখে সব ঠিকঠাক আছে কি না। অপাঙ্গে তাকায় আমাদের জোড়া খাটে, যার এক কিনারে আমি বেজোড় সংখ্যার মতো অসম্পূর্ণ, নিজেকে জড়িয়ে-মড়িয়ে শুয়ে রয়েছি।
এভাবে রাতদিন মরা মানুষ নিয়ে পড়ে থাকা—আমি যেন শিমুলগাছে গা ঘষে ঘষে নিজেকে রক্তাক্তই করছি।
এক সন্ধ্যায় আমার এক কলিগ আর স্কুলের সহপাঠী বাসায় এলো। স্বামীর দীর্ঘস্থায়ী ব্যারাম, অতঃপর মৃত্যু উপলক্ষে আমার এ ড্রয়িংরুমেই দুজনের মোলাকাত। দুজনই আমার হিতকারী। হাতে চট্টগ্রামগামী তিনটি ট্রেনের টিকিট। আমাকে মরাবাড়ির বাইরে নেওয়ার শল্লা করে একসঙ্গে ঢুকেছে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। ট্রেনে দুলতে দুলতে মনে হলো কত দিন গা এলিয়ে দিয়ে আরাম করি না! রোগীর শিয়রে বসে থেকে থেকে শিরদাঁড়া লোহার রডের মতো শক্ত হয়ে গেছে। কোনও আড়া নেই, ভাঁজ নেই। চেয়ারে বসে মেঝে থেকে কিছু তুলতে গেলে পা লম্বা করে সামনে ঝুঁকতে হয়। ট্রেনের খাবারের মধ্যে হালকা মাখন বোলানো পাউরুটি সহযোগে চিকেনফ্রাইটা আমার বেশ মনে ধরে। বেসনে চুবিয়ে ডোবা তেলে ভাজা দেশি মুরগির বাদামি রান। আমি দাঁতে হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো করে আয়েশ করে খাচ্ছি, স্কুল সহপাঠী আলেয়া বলে—‘ফিরে গিয়ে ইয়োগা ক্লাশে ভর্তি হবি। রোশনি শোন, এখন আমাদের যা বয়স, এ ছাড়া গতি নাই।’ আলেয়া নিজে মডেল না হোক, বিজ্ঞাপনী সংস্থার বাণিজ্যিক বিভাগের কমিউনিকেশন অফিসার। সে শরীরচর্চা, স্লিম হওয়ার কথা তো বলবেই। বলবে আমাকেই। যার মাস খানেক হয় স্বামী মারা গেছে, তাকে কারও না কারও কিছু বলার থাকেই। দীর্ঘ পথ। চুপ করে ওর শরীরচর্চা, ডায়েট নিয়ে বিস্তর নসিহত শুনতে হলো। চলন্ত ট্রেনে ধরে ধরে ও আমাকে টয়লেটে নিয়ে যায়। বেরিয়ে দেখি তেলেসমাত কাণ্ড। দুই কম্পার্টমেন্টের সংযোগে নিরালম্ব দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনও সার্পোট নেই। আমার বিমুগ্ধ দৃষ্টির সামনে তিন সন্তানের মা এক পায়ের ওপর পাক দিয়ে নাচল ব্যালে নতর্কীর ঢংয়ে। নন-স্টপ ট্রেনটা তখন ঝমঝমিয়ে আখাউরা জংশন ছেড়ে যাচ্ছে।
আলেয়া পরে আছে চুড়িদারের ওপর খাটো কামিজ। লাল-হলুদের চুনটের ওড়না গলা পেঁচিয়ে লম্বা দড়ির মতো কাঁধের দুই পাশ দিয়ে ঝুলছে। আমি আর আমার সহকর্মী কলেজশিক্ষক। ওর ভূগোল, আমার ইতিহাস। তবে দুজনই শাড়ি ছাড়া পাবলিক প্লেসে পারতো যাই না। কখন ছাত্ররা দেখে ফেলে! আঁচলও তাই কাঁধের ওপর দিয়ে বুকের ওপর টেনে রাখি। সব সময় পিঠে ঝোলে ইঁদুরের লেজের মতো সরু বিনুনি। আগায় ক্রচেট করা জোড়া গোলাপের ব্যান্ড। সকালে ক্লাশ থাকলে ভেজা চুলেই ছুটতে হয়। তখন জলে ভারী চুল কাঁধের পাশ দিয়ে সামনে নামানো থাকে। কতদিন চুল ছেড়ে বা বেণি করে আমি ক্লাশে যাই না! স্বামীর লাং-ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে, তা প্রায় আট-নয় মাস হবে।
মগধেশ্বরী মন্দির ও সমাধিক্ষেত্র
আমাদের গেস্ট হাউসের দেয়ালে দেয়ালে টুনি বাল্ব জ্বলছে-নিভছে। কারও বিয়ে ছিল সম্ভবত। উৎসব-শেষ, অতিথিরাও বিদায় নিয়েছে। বাতিগুলি অক্লান্ত। আমরা ক্লান্ত পা টেনে টেনে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠি। পাঁচতলা বাড়ির নীচের তিনটি ফ্লোর নিয়ে গেস্ট হাউস। উল্টা দিকে মগধেশ্বরী মন্দির ও সমাধিক্ষেত্র। প্রতিষ্ঠার তারিখ ১৭৮৮ সাল। পরদিন সন্ধ্যায় ঝিরঝির বৃষ্টি মাথায় হাঁটতে না বেরোলে নজরেই পড়তো না। যে কোনও খালি প্লটের মতো পাঁচিলঘেরা। লোহার গেট। বন্ধ পাল্লার গাত্রের সাদা হরফগুলিও তেমনি শান দেওয়া—সূচ্যগ্র পরিমাণ ভুঁই নাহি ছাড়িবার ঘোষণা দিচ্ছে। বিশাল ঝাঁকড়া বটগাছটা প্রথম নজর কাড়ে। তারপর চোখ নেমে আসে নীচে, গেটের পাল্লায়। উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির মধ্যিখানে সমাধিক্ষেত্র।
বাতাসের তোড়ে বৃষ্টির ছাট ক্রমে ধারালো হচ্ছে। ঘন ঘন বজ্র নির্ঘোষ। গেস্টহাউজের দারোয়ান সাতকানিয়ার বুড়ো মানুষ। মাথায় ছোট্ট মতন গোলটুপি। তিলা-পড়া সাদা পাঞ্জাবির নীচে, গোড়ালির ওপরে পরা সবুজ লুঙ্গি। পায়ের পাতা রস জমে টুসটুস করছে। অকারণে আমাদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজতে দেখে ‘আয় আয় চইচই’র ভঙ্গি করে গ্যারাজের চাকাওয়ালা গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন হাঁস-মুরগি খোঁয়াড়ে ফিরলে সাটার টেনে দেবেন।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ১৭৮৮ সাল! আমি একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজি। তখন তো মগেরা ‘মগ-ধাওনি’র চোটে চট্টলা ছেড়ে পগারপার। সেটা ১৬৬৬-তে শায়েস্তা খাঁর তনয় উমেদ খাঁর মুঘল-ধজা ওড়ানোর সময়কার কথা। তখন তাড়াহুড়ায় ধনরত্ন, সোনা-রুপার বিগ্রহ মাটি-চাপা দিয়ে তাদের ভাগতে হয়েছিল। অরাজগতার পর ধীরে ধীরে শান্তি নামে। গুপ্তধন রহস্য জিইয়ে থাকে আরও যুগ যুগ। বগলে মানচিত্র, ভবনের নীচে খন্তা-খুরপি। রাতের অন্ধকারে খোঁড়াখুঁড়িতে মোহান্তরাও বাদ গেল না। মাটিচাপা ধনরত্ন দফায় দফায় তুলে নিয়ে নিজ রাজ্য রোসাঙ্গ ফিরে গেছে, তা-ও কবেকার কথা! তবে মগধেশ্বরী মানে মগদের মন্দির কে বললো? কোথাও তো লেখা নেই! শবদাহ হতো হয়তো তখন, যখন পাশে ছলছলিয়ে কাক-চক্ষু নদী বইত, নিদেন শাপলা-শালুক ফোটা দিলদরিয়া খাল।
বড়ো বড়ো দালানকোঠার মাঝখানে বনানীতলে সমাধিক্ষেত্র। দ্বীপের মতো একা। থেকে থেকে বেলি-কামিনীর গন্ধ আসছে। আমার মনজুড়ে অতীতের চোরাটান। ঘরের দিকে পা সরে না। আলেয়া আর আমার সহকর্মী গ্যারাজে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়ছে। কী নিয়ে যেন বালিকার চপলতায় হাসছে দুজন। আমি গেটের ধারের আধখানা শেডের নীচ থেকে মৌসুমি ফুলের গন্ধমাখা সমাধিক্ষেত্র নিরালে ভিজতে দেখি।
সুনামগঞ্জেও কি এখন বৃষ্টি হচ্ছে! হাওড় এলাকা। আকাশটা বড্ড ছিঁচকাঁদুনে। দূরের ছায়া-ছায়া পাহাড়ের গায়ে মাওসেনরাম, চেরাপুঞ্জি—বৃষ্টির জন্য বিশ্বখ্যাত। মাওসেনরামই বর্তমানে এগিয়ে, যার ওয়াটার ফল বর্ষা ঋতুতে দেখবার মতো। উঁচু পাহাড় থেকে যেন টন টন পাউডার ঢালা হচ্ছে—এমন মিহি আর জোরালো জলপতন! আমরা মমলু পাহাড়ের গ্রানাইট পাথরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। নীচে যত দূর চোখ যায়, জলে থইথই। কলা গাছের ভেলার মতো ভাসছে যে ছাড়া-ছাড়া জনপদ, ওটাই হাওড় অঞ্চল। আমার স্বামী তর্জনী নাচিয়ে বলেছিল—ওই তো সুনামগঞ্জ, আমাদের দ্যাশ। চেনা জায়গাটাও উঁচুতে দাঁড়িয়ে আমার অচেনা লাগে। কোনও টান অনুভব করি না। আমার স্বামী করতো। এই টানে টানে কী অসময়ে ওখানে শয্যা নিলো! ভেজা, সোঁদা, ধসে ধসে পড়া কালো এঁটেল মাটি। ইট-সিমেন্টের পলেস্তারা সত্ত্বেও যা এক বর্ষায় শিয়ালের গর্তের মতো ডেবে যায়। বুকটা হাঁ-করা অন্ধকার।
আলেয়া আর আমার সহকর্মী ওপরে চলে গেছে। সাতকানিয়ার দারোয়ান চাচা বললেন—রাস্তার ওপাশে নাকি মন্দির বলে কিছু নেই। বট গাছের গোড়াটা শানবাঁধানো। পাশেই ছোটো ছোটো গর্ত খুঁড়ে গোর দেয় হিন্দু সাধুদের। তিনি স্বল্পবাক মানুষ। এটুকু জ্ঞান বিতরণ করে ঢুলতে লাগলেন টুলে বসে। হাঁস-চরা পুকুর শূন্য। খোঁয়াড়ে শিকলি পড়ে গেছে।
রাতে স্বপ্ন দেখলাম—খাপরা চালের বস্তিবাড়িতে আমার স্বামীর দ্বিতীয় সংসার। গুটি কয় ছেলেমেয়ে। বউয়ের মুখটা মেচেতাভরা, পরে আছে পেটিকোট-ব্লাউজহীন ফিতা পাড়ের মোটা শাড়ি। বউটা মাটিতে ল্যাটা মেরে বসে নানা অভিযোগ-অনটনের কথা বলছে। আমি স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না। ওকে বেজায় খুশি খুশি লাগে। তবে বিছানায় পেসাবের গন্ধ; এ সংসারে এটা বড্ড একটা অসুবিধা। ও বোধ করি রাতটা এ বউয়ের সঙ্গেই কাটাতে চায়। রাতের শেষ বাস ছাউনি ছেড়ে হর্ন বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি রিকশাওয়ালাকে জোর তাড়া দেই। চাকাগুলি অনঢ়। কাদায় ডেবে গিয়ে চরকির মতো ঘুরছে তো ঘুরছেই। খুব অশান্তির মধ্যে ঘুম ভেঙে গেল।
এ স্বপ্নটা এ জীবনে আমি কতবার দেখেছি!
ভেজা বটের পাতায় সকালের রোদ পড়ে চিকমিক করছে। আমার কামরাটা গেস্ট হাউসের তৃতীয় তলায়। জানালা পেরেক ঠুকে চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে, যেন মহামূল্য এসির বাতাস নিকলাতে না পারে। অনেক কসরত করে পর্দা খানিকটা ফাঁক করা গেল। গাছটা যেন মা-পাখির মতো ডানা ঝাপটে আছে—এর গুঁড়ি জড়ানো শানবাঁধানো বেদি, পাশের গর্ত-খোঁড়া ছোটো ছোটো কবর—সব অদৃশ্য। ডানার তলে উষ্ণ, নিরাপদ। তাই যেন থাকে দুনিয়ার তাবৎ কবর, হে দয়াময়!
নীচ থেকে ডাক পড়েছে। দুই দিন হয়ে গেল, ফয়’স লেকেই যাওয়া হলো না! তারপর আছে আমানত শাহের মাজার। নদীর ওপারে শাহ পরান। আমার সহকর্মী চরম বিরক্ত। পায়ে টিলায় চড়ার উপযোগী কেড্স। শাড়ির আঁচল বুকের ওপর টেনে ধরে ঘন ঘন পা ঠুকছে। নাস্তা সেরে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে। আমি এসি বন্ধ করে দরজায় তালা লাগাই।
বাসায় ফিরে নিজের ফ্ল্যাটের তালা খুলতে খুলতে মনে হলো, কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই। রোজ ঘুম ভেঙে দেখতে পাবো, পানির গ্লাসটা ভরাই রয়ে গেছে। ঘোলা জলে ভাসছে গুঁড়া মরিচের মতো এক গাদা লাল পিঁপড়া।
ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া
আমি যেন ভিনদেশে বিনা পাসপোর্টে ঢুকে পড়েছি। শরীরে অজানা শিহরন। বগলে রোল করা গোলাপি ইয়োগা ম্যাট, আরেক হাতে মামের বোতল। সালোয়ার-কামিজ পরনে রিকশা থেকে লাফিয়ে নামি। এখানে ভারতীয় হাইকমিশনের অফিস ছিল যখন, লোকে থিক থিক করতো। ভোর থেকে ভিসার লম্বা লাইন। সে পাট চুকে যাওয়ার পর গেটের ডান হাতায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তকমা ঝোলানো হয়েছে, তা-ও বছর দশেক হবে। গাড়িবারান্দা থেকে দুই ধাপ উঠতেই সামনের রোয়াকে বীণা হাতে সরস্বতী, দুই ধারে দুটি শুভ্র হংস ডানা মেলে ওড়ার ভঙ্গিতে গ্রীবা তুলে দিয়েছে। খুশিতে মনটা নেচে ওঠে। আমারও যেন পালকে হাওয়া লেগেছে, সিঁড়ি বেয়ে উঠছি নেচে নেচে। দেয়ালজুড়ে ফ্রেমবন্দি ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার নানা স্থিরচিত্র। মুখোশ পরা আর উদ্ভট সাজগোজের নানা রঙের মানুষ। আর কত কত মেলা আর জাঁকালো উৎসব! নৃত্যরতা নারী মাথার পেছনে হাত রেখে কদমফোটা বুক ঠেলে দিয়েছে সামনে। তাম্বুলরসে রাঙানো ওষ্ঠে মাপা হাসি। চোখে বিলোল কটাক্ষ। বালা, কে গো তুমি, এমন সুন্দর সাজে নাচ করো! নীচের হলঘর থেকে ভেসে আসে তবলার বোল, নূপুরের রিনিঝিনি, সঙ্গে গান- ‘আমরা চঞ্চল আমরা অদ্ভুত/আ-ম-রা নতুন যৌবনেরই দূত’। শিশুকণ্ঠের কোরাস সংগীত।
দোতলার দুয়ার ঠেলে ঢুকতেই নাচ-গান হারিয়ে গেল। খানিক বাদেই ইয়োগা ক্লাশ শুরু হবে। বন্ধ ঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে আমার মতো ভঙ্গুর, পোড় খাওয়া ক-জন নারী। শরীর সারাতে এসেছে বা মনের সংহতি দরকার হয়তো কারও কারও। অদূরে দাঁড়ানো টাকমাথা পুরুষ দুটির অবস্থা আরও বেহাল। সারা গায়ে যেন পানি নেমেছে, আর হাঁসফাঁস করছে গরমে। এসব আধমরার ছোঁয়া বাঁচিয়ে এক সদ্য তরুণী রোল করা ম্যাটে চিবুক ঠেকিয়ে করিডোরের আরেক প্রান্তের রেলিং-এ পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ট্রাউজার, টি-শার্ট কালো রঙের—অবিকল ভুজুঙ্গা, ধনুরাসনের মডেলকন্যার গড়নের শরীর, পোশাক। আমি অচেনা ভঙ্গুর নারীদের ভিড়ে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরা যেন বাপের বাড়ি বেড়াতে আসা আপন মায়ের পেটের বোন, কেমন অকপটে সুখ-দুঃখের কথা কইছে। ‘ইউরিক অ্যাসিড বাড়ছে তো, আপনার আথ্রাইটিস হবেই হবে।’ যে কথা কইছে, তার চেহারাটা মনে হলো চেনা-চেনা। টিভিতে খবর পড়ে খুব সম্ভব। সে যার আথ্রাইটিস হবে তাকে ‘লাউ-পেঁপের ঝোল’ খেতে বলল। আমি মনে মনে টুকে নিলাম। কী পোশাক পরে ইয়োগা করা সমীচীন—সেই ভাবনা দূর হয়ে গেল সংবাদপাঠিকার ঢিলেঢালা সালোয়ার-কোর্তা দেখে। শরীরটাও তার আমার চেয়ে দ্বিগুণ। টিভিতে শুধু মুখ দেখা যায়, ধড়ের আন্দাজ করা যায় না। যাক, আয়রনম্যান শ্রীনীলমণি দাশের ‘ব্যায়াম স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য্য’ দেখে গোটা কয় আসন মকশো করে এসেছি। ইউরিক অ্যাসিড, আথ্রাইটিস, ব্লাডপ্রেসার নিয়ে আর সবাই পারলে আমি পিছিয়ে থাকবো কেন।
‘জায়গাটা তোরে যাদু করছে!’ আলেয়া পর পর দুই দিন বাসায় না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ‘হপ্তায় তিন দিন ক্লাস, তুই কি রোজই যাস?’ ফোনের ওপর কী করে বলি, ‘যা ভাবছ তা নয়, আমি গানের ক্লাসেও ভর্তি হয়ে গেছি’, তা-ও এমন একজনকে, যে জানে আমার দৌড় ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ পর্যন্ত! আলেয়া আর আমি গলা ধরে মঞ্চের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে গানটি গেয়েছিলাম স্কুলের হেডস্যারের বদলি উপলক্ষে। সেদিন নেচেও ছিলাম দল বেঁধে। আমরাই নাচছি, আমরাই গাইছি- ‘ওগো নাইয়্যা ধীরে চালাও তরণী’, হাতে রঙিন কাগজে মোড়ানো ছোটো ছোটো কঞ্চির দাঁড়, পায়ে ঘুঙুর। সবে সামনের দুধদাঁত দুটির জায়গায় বিস্তর ফাঁক রেখে কোদাল-মার্কা দন্ত গজিয়েছে। নাচ-গানের মধ্যিখানে আমার হাসি পেয়ে গেল। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম, যাতে বিকট দন্তযুগল বিকশিত হতে না পারে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুঙুরের বাজনা গেল থেমে। আমার একার জন্য গোটা দল নাজেহাল হলো। নাচ-গানেরও ইতি সেখানে। এরপর যদিও কোদাল-দন্ত মসৃণ হয়ে হাসিতে বকুল ফুল ফুটেছে, সেই সুযোগ জিন্দেগিতে আর আসেনি। আমি আলেয়াকে হাসতে হাসতে বলি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, একেই বলে গুরুমারা বিদ্যা। রোজ রোজ যোগব্যায়াম করে আমি যোগিনী হবো—দেখি কে ঠেকায়!’
আসলে গান-টান কিছু না; বিকালটা আমার কাটতে চায় না বলে যোগব্যায়ামে যাই, গান শিখি। একই হাটে রথ দেখা কলা বেচার সুবিধা অনেক, জায়গাটা যদি মনের মতো আর অনাবিল হয়। শুক্রবার ছাড়া বাকি ছয় দিন কলেজ থেকে সটান ধানমণ্ডি দুই নম্বর। ঝড়বাদল, হরতাল-ধর্মঘট, কলিগের বাচ্চার জন্মদিন কি মরা আত্মীয়ের কুলখানি—কোনও কিছুই আমাকে রুখতে পারে না। এখন ইয়োগার দিন ব্যাগে থাকে সালোয়ার-কোর্তার বদলে কালচে মেরুন ট্র্যাকস্যুট, মাথায় বাঁধার রঙিন সিল্কের স্কার্ফ। ড্রেসিংরুমে ঝটপট কাপড় বদলে লম্বা করিডর ধরে অনভ্যস্ত পোশাকে পা টিপে টিপে চলি। হাতে বিস্তর সময়। আমার দু-ধারে অবিশ্বাস্য ভারত সিরিজের সারি সারি ছবি…
জঙ্গল সাফারি ইন সানসেট। বাহ্ সূর্যাস্তের রং এমন বেদানার রসের মতো রাঙা হয়! যেন রক্তাক্ত প্রান্তরে হাতির পিঠে সওয়ার মানুষগুলো আবিরে চোবানো, অপার্থিব। কিংখাবের গদিতে বসে দুলতে দুলতে অস্তগামী সূর্যের পথ ধরে চলে যাচ্ছে। পদতলে কদলী বন মিসমার। পাশেই বরফের টোপর পরা লাদাখের পর্বতগুহা। আমি রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছি। আমার আর আমার স্বামীর একবার কোরবানি ইদের ছুটিতে কাশ্মীর যাওয়ার কথা ছিল। সে বছরই পাহাড়ের সুড়ঙ্গপথে বরফ-চাপা পড়ে এক ট্রেন বোঝাই যাত্রী নিকাশ হয়ে গেল। তা ছাড়া ভূ-স্বর্গ লাগাতার জঙ্গ-ফ্যাসাদে মিসমার। আমাদের আর যাওয়া হলো না। আমি হাত লম্বা করে তাজমহলের শুভ্র মর্মর কাচের ওপর দিয়ে একটুখানি ছুঁয়ে দেখি। এটি পতির পত্নীপ্রেমের সর্বকালের সেরা নজির। আগ্রার রেডফোর্টের যে কামরায় শাহজাহান নজরবন্দি ছিলেন, এর বাতায়ন থেকে তাজমহল পরিষ্কার দেখা যায়। মধ্যিখানে আলকাতরা-রঙা যমুনার ক্ষীণ ধারা। কুলভাঙা খরস্রোতা নদীর এ হাল কী করে হলো! সময় বড়ো সাংঘাতিক জিনিস। পেছনে প্রহরারত তাতারনিদের চোখরাঙানি নেই। নেই কোমরে ভোজালি গোঁজা খোজার দল। কতগুলি ছাইরঙা কবুতর আঙিনায় ওড়াওড়ি করছে। জায়গায় জায়গায় টুরিস্ট গাইডদের তুখোর চাপাবাজি ছাপিয়ে ওঠে বকবকম বকম কবুতরের আহ্লাদী স্বগতোক্তি। কোথাও আমাদের গাইড ভাড়া করার জরুরত হতো না। সে রোল নিতাম আমি, ইতিহাসের মাস্টারনি। আমার স্বামী হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা করে বসে পড়েন সম্রাটের খোলা বাতায়নপাশে। যমুনার উদাসী হাওয়ায় ওর চুল ওড়ে। পত্নীহারা বাদশা শাহজাহানের মতো বিষণ্ণ, তন্দ্রালু দৃষ্টি। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি খিঁচি। মানুষ নাই। তাজমহলে দৃষ্টি-নিবদ্ধ মূক ছবিটি টেবিলের স্ট্যান্ড থেকে আজ কত কথা বলে! ওর কেন, আগে চলে যাওয়ার কথা ছিল তো চিররুগ্ন আমার—আমি ভাবি। হয়তো ওরও ভাবনা ছিল তা-ই।
সেদিন মুঘল সম্রাজ্ঞীর সমাধির গিলাফে পয়সা ছিটিয়ে আমরাও এক ভ্রাম্যমাণ ছবিওয়ালার ক্যামেরার সামনে নবদম্পত্তির মতো পোজ দিয়েছিলাম। যেন যুগল ছবি না উঠালে এ প্রেমতীর্থে আসাটাই বৃথা। ‘বি ক্লোউজ, স্মাইল স্মাইল’, লোকটার হুকুম পুরোপুরি তামিল করা না গেলেও আমার স্বামী আমার কাঁধে হাত রেখে মাথাটা কাত করে দাঁড়িয়েছিল, পেছনে তাজমহল আর সারবাঁধা সাইপ্রেস বৃক্ষ রেখে। আমি ঘোমটা-মাথায় কালো চশমার ডাইনি বুড়ি। কড়া রোদে কপালে দুই ভাঁজ ফেলে লেন্স-বরাবর তাকিয়ে আছি। ছবিটা অ্যালবামের অন্য ছবির তলায় বহুদিন চাপাই ছিল। তুলে দেখি, গায়ে সিপিয়া রঙ লেগে অ্যান্টিকের গরিমা লাভ করেছে।
‘আপা লেগে থাকেন। মনে সংকল্প থাকলে গলা কোনও বাধাই না।’ তবলচি ছোড়া বড্ড বাচাল। আমি ওর কথায় পাত্তা দিই না। কোরাসে গলা মিলাই—‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদেরই বসুন্ধরা’ বা ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’। পুরোনো কালের দেশাত্মবোধক গান। তাতে কি! বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়ের সারিতে বসে সারেগামা করতেও আমার লাজলজ্জার বালাই নেই। আমি তো জানি এখানে রোজ কেন আসি। মোটা পর্দার কলেজের টিচার্স রুমের পর এ যেন চোরকাঁটাহীন খোলা প্রান্তর। সামনের দাঁতের ফাঁক দেখে কেউ বলতে আসে না, অকাল বৈধব্য আমার কপাললিখন ছিল। এখানে চেনা কেউ থাকলেই তো আমার নাকের বাম পাটায় হিরার ঝলকানিতে তার চোখ টাটাবে! আমি অচেনাদের ভিড়ে বিলি কেটে কেটে গাছের ঝরাপাতার মতো আলগাভাবে চলি। সময়টা কোন দিক দিয়ে কেটে যায়, নিজেও টের পাই না।
আমার শুক্রবারের দিনটা যেন উত্তর মেরুর গ্রীষ্মকালের, ফুরাতেই চায় না। রাতটাও পাহাড়চাপা দিয়ে চলে যায়। আজ এর ব্যত্যয় ঘটল। গত চার বছরে আমাদের সাদা টয়োটা মাত্র দু-বার ওয়ার্কশপে গেছে। গ্যাসও খরচ হতো কম। আজ সকালে ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে চাচাতো ভাই ইমরান একে গাড়ির হাটে নিয়ে গেল। আমি বারান্দা থেকে সরে আসি। আমার কলেজ, ইয়োগা ক্লাস রিকশার দূরত্বে। এ দুটি জায়গা ছাড়া আমি তো আর কোথাও যাই না। এ ছাড়া গাড়ি রাখতে গেলে মাস মাস ড্রাইভারের যা বেতন, তা আমার আধেক মাইনের কাছাকাছি। জুমার নামাজের আগ দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে ইমরান হাজির। জাপানি গাড়ির এ এক গুণ—কেনা দামেই বিকিয়েছে। লোকসান শুধু বড়ো বড়ো মানকচুর ঝাড়ের ধারে আমাদের গ্যারাজের বরাদ্দটুকু শূন্য হয়ে গেল।
তখনও অর্ধেক দিন, গোটা একটা রাত বাকি। ঘরে পরীক্ষার খাতার পাহাড় জমে গেছে। কেউ দাওয়াত দিতে এলে, আমি তাকে থরে থরে খাতার বান্ডিল দেখাই। বলি, ‘মরার টাইম নাই ভাই। একা মানুষ কত দিক সামলাবো!’ তারা মনে মনে ভেংচি কাটলেও মুখের ওপর ঘাঁটায় না। কিন্তু আমার এ বেসাতি আর কত দিন! এ দণ্ডে ফলাফল না জানালে ছাত্রছাত্রীরা দেয়ালে পোস্টার মারবে আমার নামে। অগত্যা জানালার ধারে টেবিল টেনে খাতা কাটতে বসি। এ কাজে আমি যেন বেমানান, বারান্দার রেলিং থেকে তারস্বরে চেঁচায় একটি মিশমিশে দাঁড়কাক। কী সাহস, একদম চোখে চোখ রেখে লম্বা পুচ্ছ নাচাচ্ছে! একে তাড়িয়ে ফ্রিজ থেকে কাঠি-আইসক্রিম বের করি। এ রকম হাফ ডজন লাগবেই এক বান্ডিল খতম করতে। কুড়মুড়িয়ে বরফ ভাঙতে ভাঙতে জিব যত অসাড় হবে, কলমের আগারও তত ধার বাড়বে। ফর্মুলাটা আমার স্বামীর।
কলেজের চাকরির আর সব ভালো, আমার স্বামী বলতো—এই খাতা কাটা ছাড়া। পাশের বাড়ির গাড়িবারান্দার ছাদে ডিশের লোক কাজ করছে। জড়ানো-মড়ানো গুচ্ছের তার। আমার দুই মাসের বিল বাকি। ওদিক থেকে কাকটা উড়ে এসে ফের রেলিংয়ে বসেছে। রাগী মানুষের মতো মাথার চুল কাঁটা কাঁটা। এবার আর চেঁচায় না। ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে গরগর আওয়াজ করে। ভূয়োদর্শন তো কম হলো না! আমি নাক থেকে চশমা নামাই। রেলিং ছেড়ে বারান্দায় লাফিয়ে নামেন মাননীয় ভূশণ্ডি। তারপর হেলে-দুলে ঘরে ঢোকেন। ছোটোবেলায় গল্প শুনেছিলাম, এক দেশের এক মেয়ে সতিনের হাতে কাকের মাংস খেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল। আমার স্বপ্নে দেখা খাপরা চালের বস্তিবাড়ির সেই মেয়েটির চেহারা কিছুতেই মনে পড়ে না।
ভাগ্যিস আজ গানের ক্লাস ছিল। আমার পরনে টাঙ্গাইল তাঁতের সাদা-সবুজ ডুরে শাড়ি, লম্বা হাতার কালো ব্লাউজ। রিকশা থেকে দেখি, গেটের সামনে আমার ভাশুর সাবের আলম কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখছেন, গার্ডের লম্বা বেঞ্চিতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের লাইন করে বসিয়ে দিয়ে। আমি মনে মনে জিব কাটলাম। আজ যে আমার স্বামীর মৃত্যুদিন মনেই ছিল না। প্রথম মৃত্যুবাষিকী। সারা দিন কোন ঘোরে ছিলাম! ‘আমরা ধরেই নিছিলাম আজকের দিনে তুমি বাসায় থাকবা। যাক বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নাই।’ ভাশুরের ফোন না করে আসার কৈফিয়তের কী জবাব দেবো, আমার ভাষা নেই। মুখ নামিয়ে তার ষোড়শী কন্যার চিবুক ছুঁয়ে চুমকুড়ি দিলাম। সবাই উঠে দাঁড়ালো।
ওরা কে কী ভাবছে জানি না, তবে আমি যে স্বামীর মৃত্যুদিবস ভুলে গেছি, তা আশা করি ভাবছে না। শোকের দিন। ভাশুরের দুরন্ত বালকপুত্রটিও মুখ গম্ভীর করে ঘরে ঢুকল। আমি ত্রস্ত হাতে আগরবাতি জ্বালিয়ে স্বামীর ছবির নীচে রাখলাম। চিকন ধূমায় মুখটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কাকে কী খেতে দেই! মাথার ভেতরটা ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ থইথই, ফর্সা। রান্নাঘরে পা বাড়াতে দরজায় কলবেল বেজে উঠল। দেওর নাফিস হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে। ‘ভাবী, মিলাদের আয়োজন করেন নাই?’ বলে ভাগ্যকুলের দুটি মিষ্টির প্যাকেট সশব্দে টেবিলের ওপর রাখল। সব দায়িত্ব কি আমার একার! আমার ওপর বন্ধ্যা নারীর দায়ভার চাপিয়ে ভাইকে তো ওরা বিয়ে করাতেও চাইছিল। এই নাফিস, ডির্ভোসি শ্যালিকাকে গছাতে হন্যে হয়ে গিয়েছিল! এদিক থেকেও তালি বেজেছিল কি না জানি না। তবে এ নিয়ে জা কুসুমের সঙ্গে আমার একচোট হয়ে গেল একদিন। আজ অফিস থেকে একাই এসেছে নাফিস। কুসুম আসতে পারতো আমার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত। ডিভোর্সি মেয়ের ফের বিধবা হওয়া—বোঝার ওপর শাকের আঁটি। ভাতারখাকি উপাধিও জুটে যেতো। আমি রুখে দাঁড়িয়েছিলাম বলেই না আরেকটা ক্ষণস্থায়ী বিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেলো মেয়েটা!
আমার সামনেই মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাত নিয়ে দুই ভাইয়ে খিটিমিটি লেগে গেল। দুজনই চাকরি বাকরি নিয়ে ব্যস্ত। অর্থেরও টানাটানি। আমার স্বামীই ছিল তুলনায় সচ্ছল। ভাগ্যিস, ফ্ল্যাটটা আমার নামে। না হয় কবে কামড়াকামড়ি লেগে যেতো! নাফিস তো ঘরে ঢুকে এখনও কুকুরের মতো দেয়ালের গন্ধ শোঁকে।
আমি চা নিয়ে ফিরে দেখি দুই ভাইয়ে রফাদফা হয়ে গেছে। দুজনের নজর আমার সদ্য কেনা হারমোনিয়ামটায়, যা ডিভানের তলা থেকে কে যেন টেনে বের করেছে। বাটিকছাপের ঢাকনাটাও উধাও। বাদ্যযন্ত্রটা না, যেন নাঙ্গা করা হয়েছে আমাকেই। আমি স্বরূপে ধরা পড়েছি। আর তামাশা দেখছে দুটি জোয়ান জোয়ান লোক। আমি নীরবে ফুঁসতে থাকি। আমি বাইরে গিয়ে গান শিখি, নাচি- তাতে কার কী! আমি কারও খাই না পরি! আমার ঠান্ডা মেজাজের বড়ো জা মনোযোগ দিয়ে জিটিভিতে সুবর্ণলতা দেখছেন। একজন শাশুড়ি বউ-ছেলের ওপর কাঁহাতক ছড়ি ঘোরাতে পারে! চেঁচাচ্ছে যে হারে, এত দিনে গলার তার ছিঁড়ে যাওয়ার কথা। জেহাদি পুত্রবধূ সুবর্ণলতার আধো-আধো বোল আরও অসহ্য।
বাদ এশা পাড়ার মসজিদেই মিলাত পড়ানো হবে। সবে আজান দিয়েছে। আমি এক কাঁড়ি টুপি টেবিলের ওপর রাখলাম। একটা লক্ষ্মৌ কাজের গোলটুপি নাফিসের মাথায় আঁটসাঁট বসে গেছে। মায়ের পেটের ভাই। অথচ আমার স্বামীর তুলনায় ভাশুরের প্রায় কেশহীন টাকমাথাটা ভয়ানক ছোটো। তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে কায়দা করে মাথায় বাঁধলেন। এক নিমেষে বয়স দশ বছর নেমে গেল। বড়ো একটা কাচের গামলায় ভাগ্যকুলের প্যাকেট দুটি খালি করে জিলাপি ভরা হয়েছে। ওপরে কুশিকাঁটা কাজের সাদা ঢাকনা। নাফিস গামলা হাতে দরজার দিকে আগ বাড়ে। পেছনে ভাশুর ও ভাশুরপুত্র।
আমি দরজা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, ভাসুর-ঝি শারমিন ওড়নার তল থেকে একটি লালগোলাপ আমার হাতে দিলো। আহা বেচারা! এমন সরল-সোজা মেয়ে যে, বিয়েবার্ষিকী আর মৃত্যুবার্ষিকীর ফারাক বোঝে না। আমাদের আঠারোতম বিবাহবাষির্কীতে ও এমনই একটা গোলাপ উপহার দিয়েছিল, ওদের ছাদের বাগানের। আর চৌদ্দ দিন বাদে কুড়িতম হবে। এর আগেই সব শেষ। আমার চোখ দুটি মরিচ-ফোঁটা দেওয়ার মতো জ্বালা করে ওঠে। শারমিনকে বুকে চেপে ধরলাম। ওর মাথার তালুতে আমার থুতনি রাখা। জায়ের দিকে পিঠ দিয়ে আমি কাঁদছি। কেউ যেন না দেখে—স্বামীর মৃত্যুদিনে আমার বিলম্বিত ক্রন্দন।
মোরা আর জনমে…
‘এখানে একা একা কী করেন, রোশনি আপা? অঃ, অমরপ্রেমের স্মৃতি দেখতেছেন!’ আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে তবলচি ছোকড়া গলা বাড়ায়। ওর নাম ডালিম। ক্লাসের সবাই ডাকে ডালিমকুমার। আজ আমার মিউজিক ক্লাস ছিল না। ইয়োগা করে বেরিয়ে কতক্ষণ গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের অকাল বর্ষণ। ইয়োগা-মেটরা একে একে চলে যেতে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। বৃষ্টির জোর আরও বাড়ছে। ভিজে ভিজে ঘরে ফেরার তাড়া নেই আমার। বাগানের লাল-হলুদ কলাবতী তালশাঁসঘন বৃষ্টিধারায় হারিয়ে গেলে আমি পায়ে পায়ে বারান্দা ছেড়ে করিডরে উঠে আসি। ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া সিরিজের ছবিমালা যেন আমার একার জন্য রোজ রোজ প্রদর্শিত হয়। আমিই এর দর্শক।
‘কী বানাইছে দেহেন? মধ্যযুগের এক বাদশার কী কেরামতি!’ ডালিম কুমারের কথা শুনে আমি বিরক্ত হলেও অবাক হই না। ও তো গানপাগলা মানুষ। আর সব ব্যাপারে অগামূর্খ। আগেও দেখেছি। কিন্তু আমি যাদের মোটা মোটা ইতিহাসের বই পড়াই, হাতে হাতে দিস্তা দিস্তা ক্লাসনোট বিলি করি, ওদের জ্ঞানগম্যি আর কল্পনাশক্তি দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয়। মৃত মানুষকে এরা মানুষ বলেই গণ্য করে না। অতীতকে ভাবে নিরেট বর্বর যুগ। তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতেই শিখলো না, মাস্টার্সের সনদ পাওয়া একেক জন দিগ্গজ! হঠাৎ করে আমার বড্ড ভিজতে ইচ্ছে করে। বলি—চলো বেরোই।
আরো পড়ুন: ভালোবাসার পরিধি । শাহীন আখতার
মাথায় ছাতি ধরে ডালিমকুমার আমার সঙ্গে সঙ্গে আসে। এ আচরণে আমি অভ্যস্থ। ছাত্ররা প্রায়ই করে। কিন্তু এমন বৃষ্টিবাদলার রাত, ওকেও তো বাসায় ফিরতে হবে। রাস্তায় রিকশা মিলছে না। ছাতার আশ্রয় ছেড়ে আমার এগিয়ে যাওয়া উচিত।
ছেলেটা নাছোড়। আমি এত খারাপ গাই, তবু কেন জানি আমার ন্যাওটা হয়ে গেছে। আমার দিকশূন্য চলন-বলনে কেউ যদি কৌতূহলী হয়, তার আর কী দোষ। দুধসাদা গাড়িটার কথা মনে পড়ল। আজ সেটি থাকলে বেঘোরে ভিজতে হতো না। বাসার কাছাকাছি এসে আমি ডালিম কে চায়ের আমন্ত্রণ জানাই। বৃষ্টিতে ভেজার পর এক কাপ গরম চা, সঙ্গে গরম গরম শিঙাড়া—আহা, কী দারুণ! ঠাঠাপড়ার শব্দ করে হাসে ডালিমকুমার।
চার দিন আগের কেনা তালা, বারবার চাবি ঘোরাচ্ছি, তবু যদি খোলে! যত্তসব চায়না-মেড রদ্দি মাল। ‘আপা, দুলাভাই এহনতরি ফিরে নাই? টুরে-ফুরে গেছে নাকি?’ পেছনে ডালিমের গলা—বৃষ্টিতে ভেজার জন্য কাঁপা কাঁপা সম্ভবত। এমনিতেই আমি কথা বলি কম। আর এখন তো তালা খোলার বিড়ম্বনা। যাক বাবা, বাঁচা গেল। ঘরে ঢুকে আমি লাইট জ্বালাই। জুতার স্ট্যান্ডের মুখোমুখি দেয়ালে আমাদের হানিমুনের ছবি। সমুদ্রের খাড়ুজলে-বালিতে জড়াজড়ি করে বসা। আমার স্বামীর উদলা গা, চোখে কালো চশমা, পরনে ডোরাকাটা শর্টস। ‘ভদ্রলোক অসম্ভব হ্যান্ডসাম তো! আপা, চোখে চোখে রাইখ্যেন কিন্তু।’ অঃ, এ তো বিশ বছর আগের ছবি! ডালিমের মতো অনেকেই এ কথা পইপই করে বলতো আমাকে, ওর অসুখটা ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত। ওদের বাক্যি ফুরিয়েছে। আমার চোখে চোখে রাখার দিন শেষ হবে কবে?
গায়ের পানিতে মেঝেতে বন্যা বইছে। আমি ডালিমের ছাতাটা বারান্দায় মেলে দিয়ে আসি। আগে শুকনা কাপড়ের সংস্থান করতে হবে, পরে গরম চা।
চপবোর্ডে শিঙাড়ার কোনা মুড়তে মুড়তে মনে হয়, কাজটা কী ভালো হলো? ডালিম আমার স্বামীর চেক লুঙ্গি আর কালো টি-শার্ট পরে টিভি দেখছে! ও বুঝতেও পারছে না এ মৃত মানুষের পোশাক—সদ্য সাবান-কাচা আর এমন নিপাট। ওর নিজের প্যান্ট-শার্ট-আন্ডারওয়্যার বাইরের দিকের বারান্দায় মেলা। চা-শিঙাড়া খেতে খেতে কাপড়ের পানি ঝরে যাবে নির্ঘাত। বৃষ্টির ছাট তো ওর হাড্ডি ফুঁড়ে কইলজায় বিঁধে গেছে। যথেষ্ট ওম হবে ভেবে, আমি কালো রেশমের সোনালি ড্রাগন নকশার নাইট গাউনটাই এগিয়ে দিয়েছিলাম। ‘ওরে বাবা, এ ডি বাদশাহি আচকান! সম্রাট শাহজাহানের মনে হয়?’ বোকার মতো হেসে পোশাকটা হাত দিয়ে সরিয়ে দিলো ছেলেটি।
আমি রান্না ঘরে থাকতেই ‘কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, এ কোন সোনার গাঁয়’ রিমঝিম বৃষ্টি ছাপিয়ে ভেসে আসে ড্রয়িংরুম থেকে। নতুন হারমোনিয়াম। ডালিমের পাকা হাতে সরগর হচ্ছে। তারপর গানে গানে মাঝরাত। প্রাণহীন বাড়িটা যেন ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠেছে। মৃতের ছায়া ক্রমশ কুয়াশার মতো উবে যাচ্ছে আনন্দ-উল্লাসের উত্তাপে। আমি বারান্দায় এসে নিচু হয়ে বেলি ফুলের ঘ্রাণ নিলাম। গেস্টরুমটা বহুদিন তালামারা। খুলে ঝাট-পাট করতে রাত কাবার হবে। ডালিমের শোয়ার ব্যবস্থা ড্রয়িংরুমেই করা হলো। আমি ডিভানের চাদর পাল্টে পাতলা একটা কাঁথা রেখে চলে আসি নিজের ঘরে। রাত অনেক হয়েছে। শাড়ি পাল্টাতে আর ইচ্ছা করল না। আগেই বৃষ্টিভেজা চুল তোয়ালেতে নিংড়ে নিয়েছিলাম, এখন ঢিলা করে পিঠের ওপর বেণি করা যেতো; যেমন-তেমন একটা হাতখোঁপা বেঁধে দোর লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। বারান্দার দিকে দরজাটা খোলাই রইল। সে পথে আজ বেলি-কামিনীর গন্ধে-আকুল ভেজা হাওয়ার আনাগোনা।
বহুদিন পর মনটা খুশি খুশি লাগছে। একা মানুষের এত বড়ো ফ্ল্যাট, বুকের ওপর ভারী হয়ে চেপে থাকে সব সময়। আজ পাশের ঘরে আরেক জন মানুষ আছে, আমার স্বামীর পোশাক পরা। আর ওর মতোই হয়তো রিমোট হাতে টিভির চ্যানেল থেকে চ্যানেলে ঘুরছে অনির্দিষ্টভাবে। বাড়িটা আবার আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। এ শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের মতো শুষ্ক-কাষ্ঠ কিছু নয়, আমার কুঞ্জ।
অনেক দিন স্বামীকে স্বপ্ন দেখি না। ঘুমিয়ে পড়ার আগে ওর কথাই ভাবছিলাম মনে মনে। ওদিক থেকে ত্বরিত সাড়া আসে। বেঁচে থাকার সময় মাঝরাত অব্দি টেলিভিশন দেখে পা টিপে টিপে যেমন করে অন্ধকার ঘরে ঢুকতো, ঠিক সেভাবে এলো বিছানায়। তবে পরনে সেই ড্রাগন-আঁকা নাইটগাউনটা নেই। চেক লুঙ্গির ওপর কালো টি-শার্ট, যা আমি একরাতের জন্য ডালিমকুমারকে ধার দিয়েছি। টি-শার্টের বুকে জোড়া সারস একে অন্যকে লম্বা গলা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। নীচে লেখা ‘মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম’। আমার চোখ দুটি যেন গাড়ির হেডলাইট, এর তীব্র আলোয় রিফ্লেক্টর পেইন্টের মতো জ্বলে জ্বলে উঠছে প্রাণের আখরগুলি। অথচ স্বামীর মুখটি আমি দেখতে পাচ্ছি না। দেখার অবশ্য চেষ্টাও নেই আমার। আমরা সারস দুটির মতো একে অন্যের গ্রীবা জড়িয়ে আদরে আদরে মোম হয়ে গলে পড়ছি। জল হয়ে ভাসছি তরঙ্গে তরঙ্গে। আমি গলা তুলে ওর মাথায় মুখ ডুবিয়ে লম্বা দম নিই। ওই তো চুল থেকে উঠে আসছে ওর প্রিয় রঙ হাইস্পিডের জুতার কালির মতো গন্ধটা। আগের মতো আমি বলতেও চাইছিলাম- ‘প্লিজ এ রংটা আর মেখো না! বয়স বাড়লে মানুষের চুলে পাক তো ধরবেই।’ দেখি, আমার গলায় স্বর নেই। হাতটাও অবশ, যে হাত দিয়ে আমি ওর লোমশ বুকে বিলি কাটতে চাইছি। বুঝলাম, আমায় বোবায় ধরেছে। আদর-সোহাগ কিছু না, এ দুনিয়ার ভোজবাজি। গতকালই যার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী গেল, তার দেহাবশেষ আর কতখানি পড়ে রয়েছে ভাঙা কবরের শয্যায়!
আমি সাইডটেবিল থেকে গ্লাস তুলে ঢগঢগ করে পানি খাই। একা বেঁচে থাকার মূল্য অনেক। বারান্দা দিয়ে আসা চন্দ্রালোক বিষাদ, নিরানন্দ মনে হলো। গুড়গুড়িয়ে মেঘ ডাকছে দূর-আকাশে। খানিক বাদেই হাওয়া ছাড়বে। দুলে দুলে উঠবে নদীকূলের কাশবন, কাছের তমালতরু। চাঁদে-পাওয়া সারস দুটি বিশাল চরের দুই দিক থেকে হেঁটে আসছে, তখনও একে অন্যকে দেখতে পায়নি, আমার স্বামী বিড়ালের মতো হামাগুড়ি দিয়ে ফের বিছানায় ঢুকল। এবার আমি চেরাকাঠ হয়ে পড়ে রইলাম। আগের মতো আর সাড়া দিচ্ছি না। চলেই যদি যাবে, বারবার ফিরে আসা কেন! আচমকা মনে পড়ল—গ্লাসে তো আজ পানি ভরে রাখা হয়নি! আমার স্বামীর তিয়াস সাংঘাতিক। এ ছাড়া ওর পোশাক-আশাক অন্যে পরুক, ও কখনও চাইত না। তাই বোধ হয় জ্বালাতন করছে। তবে এত অসূয়া ভালো নয়, আমিও তো মানুষ—কথাটা কাচভাঙার মতো আমার গলায় আটকে রয়, বাইরে আসে না। মাথার ওপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে, তবু ঘামছি দরদরিয়ে। একসময় জোর করে বিছানা থেকে নামলাম।
ড্রয়িংরুমের দেয়ালে দেয়ালে যেন আগুন লেগে গেছে, পেস্টরঙা প্লাস্টিক পেইন্টে রক্তিম আলোর নাচন। টিভিতে হলিউডের ধুন্ধুমার ছবি হচ্ছে। একটু আগেই কেউ হয়তো বোমা ফাটিয়েছে, বিশাল বিশাল বিল্ডিং সব নিঃশব্দে ধসে পড়ছে খেলনা বাড়ির মতো। ঘরের বাতি নিভিয়ে সাউন্ড অফ করে দিয়ে টিভির সামনে ডালিম আধশোয়া। ‘আপা ঘুমান নাই?’ সে বিনীতভাবে উঠে দাঁড়ালেও আমি বিনাবাক্যে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। ভয় হচ্ছে, আমার গলায় বুঝি এখনও স্বর ফিরে নাই।
জগ, বোতল সব খালি। ফিল্টারের চাবি ঘুরিয়ে বোতলে পানি ভরছি, ডালিম এসে দাঁড়ায় দরজায়, ‘আপা, আমারও ঘুম আসতেছে না, একটু পানি দেন তো খাই।’
পানি নয় যেন কড়া মদিরা, গলা দিয়ে জ্বলতে জ্বলতে নামছে। কেমন একটা বোটকা গন্ধ। এত বাইরে বাইরে থাকি, অনেক দিন ফিল্টারটা মাজা হয় না। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাতালের মতো দুলছি কেন! গত রাতে মিলাদ পড়িয়ে এসে নাফিস ফিল্টারটা নাড়াচাড়া দিয়ে বলছিল- ‘এ বদলানো দরকার। মালটা কোন সালে কিনছেন, ভাবী?’ তারপর এ থেকে আর পানি গড়িয়ে খাওয়া হয়নি। প্রবল ত্রাসে আমার শরীর কেঁপে ওঠে। কে না জানে এ ফ্ল্যাটের প্রতি ওর বড্ড লোভ! আমার পা ফেলায় হয়তো অসংগতি ছিল, ডালিম চট করে এক হাতে পানির বোতল নেয়, আরেক হাতে আমাকে ধরে—প্রবল বৃষ্টিতে মাথায় ছাতা ধরার মতো, আমার নিদানের বন্ধু যেন। রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর মনে হয় যোজন পথ। আমি জড়ানো পায়ে ওর গায়ে ভর দিয়ে হাঁটছি।
‘নেন্, শোন্ এইবার। আপনিই ঘুম চলে আসবে।’ লাইট নিভিয়ে চলে যেতে যেতে ডালিম মনে হলো দরজায় দাঁড়িয়ে বোতল থেকে পানি খাচ্ছে। ওকে হাত তুলে বাধা দেওয়ারও শক্তি নেই আমার। হঠাৎ কাচ ভাঙার আওয়াজ। ‘আপা, এ পানি না অন্য কিছু!’
এ যন্ত্রণার কোনও নাম নেই। তীব্র, ঝাঁঝালো, নাকি শরীর অবশ করা ক্লোরফর্মের ঝিমঝিম অনুভূতি! না, এর চেয়েও বেশি কিছু। আমরা সারস দুটির মতো গলা জড়িয়ে বিছানায় বসে রয়েছি। একের ঘাম-ঝিল্লি ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিচ্ছে আরেক জনের শরীর। বেদনা-আতঙ্ক ভাগাভাগি করে নিচ্ছি সমানভাবে। ঘরের অর্ধেকজুড়ে মেঘকাটা নীলচে জ্যোৎস্না। দমকে দমকে বাতাস আসছে বারান্দা দিয়ে। রেডফোর্টের জানালায় দূরে তাকানো স্বামীর চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। উদাসী হাওয়ায় ওর চুল উড়ছে। ওর জীবন থেকে আমি সরে যাচ্ছি, আর ও করুণচোখে চেয়ে আছে আমার দিকে, যমুনার ওপারে আমার কবরের দিকে। ‘আপা, ওইটা তো কবর না, অমরপ্রেমের সৌধ।’ ডালিমের সরল ভাষ্য ভেসে আসে অনেক দূর থেকে।
ভোরের দিকে ভয়-যন্ত্রণার অবসান হয়। লম্বা পা ফেলে আমরা বিছানা থেকে নামি। ওজনহীন, নির্ভার। কাঁধ ঝাঁকাতে পিঠের পালক দুটি ফুলে ওঠে। তবু বারান্দা পর্যন্ত হেঁটেই যাই। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে শূন্যে ওড়ার আগে শেষবারের মতো লম্বা গ্রীবা তুলে পেছন ফিরে তাকালাম। মানুষ-জন্মের ইতি হলো তাহলে! সাদা জমিনের ময়ূরকণ্ঠি কলকাছাপার চাদরের ওপর দুটি মানবশরীর এলিয়ে পড়ে রয়েছে, অচিরেই যারা রোমাঞ্চের জন্ম দিতে নানা অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরাবন্দী হবে। তারপর যাবে হিমঘরের লম্বা টেবিলে। গ্লাভস পরা বাদামি তেলোয়, আঙুলগুলিতে কালো কালো জমাট রক্ত।
‘আপা, সাংঘাতিক একটা রাত গেল! চলেন, পানির ফিল্টারটা ধরাধরি করে বাইরে ফালাই দিয়া আসি।’ ডালিমের কথায় আমি কান দিই না। ছেলেটা ভীষণ অবুঝ। এখনও ওর পিছুটান গেল না। আমিও কি জানতাম—কী চাই! এখন কত কত পাহাড়-কান্তার পাড়ি দিয়ে উড়ে উড়ে যাচ্ছি নতুন ঠিকানায়। আমার ডানা ছুঁয়ে উড়ছে নতুন সঙ্গী। সৌরবৎসর শেষ না হতেই, আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখি—গহীন চরের শরবনে দোলা লেগেছে। আমাদের ছানাপোনারা পিলপিলিয়ে বেরিয়ে আসছে ঘাস-বালুর গর্ত ছেড়ে। তখনও ওদের চোখ ফোটেনি।
সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৮ পূজাসংখ্যায় প্রকাশিত
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ভারতে চলে যান এবং সেখানে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ে পড়াশুনা করেন। ভারত থেকে ১৯৯৭ সালে দেশে ফিরে আসেন। কর্মজীবনে তার প্রথম কাজ ছিল প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ এবং তার চলচ্চিত্র নির্মাণেরও সুযোগ ছিল। কিন্তু পরিবারের অনিচ্ছা ও বিয়ের কারণে আর তা হয়ে ওঠে নি। বর্তমানে শাহীন ঢাকাস্থ আইন ও শালিস কেন্দ্রের গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিভাগের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৯৭ সালে ভারত থেকে দেশে ফিরে তিনি তার প্রথম উপন্যাস পালাবার পথ নেই রচনা শুরু করেন। এই বইতে তিনি দুজন নারী একা শহরে বাস বিষয়ক জটিলতা ও সংগ্রামের কথা বর্ণনা করেন। ২০০৪ সালে তার রচিত তালাশ উপন্যাস সাড়া ফেলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সময়ে নির্যাতিত এক নারীর যুদ্ধ চলাকালীন ও যুদ্ধোত্তর জীবনের করুণ চিত্র তুলে ধরেন। বইটি সেই বছর প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার লাভ করে। তার লেখা কয়েকটি ছোটগল্প হল বোনের সঙ্গে অমরলোকে, পনেরটি গল্প, নারীর একাত্তর ও যুদ্ধ পরবর্তী ক্ষত কাহিনী ও আবারও প্রেম আসছে। ২০১৪ সালে তিনি ময়ূর সিংহাসন উপন্যাস রচনা করেন। এই উপন্যাসের জন্য তিনি আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার – ২০১৪ লাভ করেন। ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।