বিশেষ রচনা: ধীরে বহে ইরাবতী । সংগ্রামী লাহিড়ী
গ্রীষ্মের দুপুরে সূর্য যখন মাঝ আকাশে, নদীর জলে লক্ষ হীরের চিকমিক, বুড়ো মং-এর শরীরে কেমন আলসেমি ঘন হয়ে আসে। পাখনাগুলো অজান্তেই স্থির হয়ে যায়। ঢেউয়ের তালে তালে শুধু একই জায়গায় ভেসে থাকা। ঝিমঝিমে দুপুরের বড্ড মায়া, শীতল জলের আদর মাখতে বড় আরাম।
বয়সটাও তো কম হল না? মং বুড়োর সময়কার কেউই আর এখন বেঁচে নেই। দু-কুড়ি পার করল সে। যদি বল, কী করে জানলে?
“ও মা, আমি জানব না? বল কী গো? হুই যে সেই অত্যেচারী রাজা, এদেশের সিংহাসনে বসল গায়ের জোরে, সে গল্প আমি মায়ের কাছে শুনেছি। সেই সময়ই তো আমি জন্মালাম। নদীর জলে, মায়ের কোলে।”
“উফ, বয়েসের গাছপাথর নেই তোমার খুড়ো!” দুষ্টুমি করে পাখনা দিয়ে ছোট্ট একটু ঠেলা দেয় পাশের সঙ্গীটি। “সে রাজাকে চক্ষেই দেখিনিকো আমি।”
মং আর নু – মে মাসের এক দুপুরের ঝিকিমিকি আলোয় দুই শুশুক পাশাপাশি অলস সাঁতার কাটে আর গল্প করে। কোথায় সে জায়গা? বিরাট হিমালয় পাহাড় ধরে তুমি যদি সোজা পুবদিকে এগিয়ে যাও, এগোতেই থাকো, আর এগোতেই থাকো, তাহলে একসময় বৃষ্টিভেজা পুবের দেশে পৌঁছে যাবে, যেখানে পুব-হিমালয়ের পায়ের কাছে ঘন সবুজ বনে ঢাকা পাহাড় – ফুটহিলস। পাহাড় কেটে সমতলে নেমে এসেছে বিরাট ব্রহ্মপুত্র নদ। তারই অসংখ্য শাখানদী জালের মত বিছিয়ে আছে সেই পুবের দেশে। তেমনি এক নদীর নাম ইরাবতী। সেই ইরাবতীর জলে ছোটো ছোটো ঝাঁক বেঁধে ঘোরে ওরা – ইরাবতী ডলফিন। ধূসর রং, গোল মাথা, বিরাট লেজ, চ্যাপ্টা মুখ। অস্পষ্ট ঠোঁট প্রায় দেখাই যায় না। শুশুক তো নয়, যেন বাচ্চা এক তিমি! মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত ঝাঁক বেঁধে নদীর অগভীর জলে ঘুরে বেড়ায়। সাগরের কাছটিতে থাকাই পছন্দের, যেখানে নোনা জল মেশে নদীর মিষ্টি জলের সঙ্গে। সাঁতার কাটে ঢেউয়ের তালে, রোদের তাপে গা সেঁকে নেয়, ছোটো ছোটো মাছ, কাঁকড়া ধরে খায়, আর মাঝে মাঝেই মাথা তুলে তাজা হাওয়া বুকের মধ্যে ভরে।
বুড়ো মং এখন আর নদীর জলে বেশি আসে না। ইরাবতী-র জল যেখানে দক্ষিণের আন্দামান সাগরে গিয়ে মিশেছে, সেখানে নোনা মাটিতে শিকড় জড়িয়ে পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ম্যানগ্রোভ গাছের বন। সবুজ ছায়ায় ঘেরা সাগরের নোনা জলে শুয়ে আরাম করে মং। দু’কুড়ি বয়েস হল। আর বেশিদিন বাঁচবে না, জানে সে। শেষের ক’টা দিন একটু শান্তিতে কাটানো আর কী। আজই কী মনে হল, নু-এর সঙ্গে সাঁতরে ঢুকে এসেছে নদীর বুকে, যেখানে তার জীবনের বেশিটাই কেটেছে।
“তুই তো এই সেদিনের ছেলে, কীই বা দেখেছিস, কীই বা জানিস।” মং-এর চ্যাপ্টা, গোল মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। “সে কি আজকের কথা?”
“শোনাও না গো সেই রাজার কথা।” আবদারের সুর।
“সে বড় মন্দ রাজা। দেশের মানুষগুলোকে রাখত লাঠির ডগায়, কথায় কথায় জেলে ভরত, মেরে কেটে লোপাট করে দিত। মানুষ তো নয়, যেন পোকামাকড়।” মং বুড়ো একটু থামে।
“তারপর কী হল গো খুড়ো?” নু জানতে চায়। বেশি বয়েস নয় তার, দশ বছরের নওজোয়ান। খুড়ো ছাড়া কেই বা এসব আদ্যিকালের কথা শোনাবে?
“না, খুব আদ্যিকালের কথা তো নয়? দু’কুড়ি বছরেরও কম।” মং শুধরে দেয়। “এমন রাজার রাজত্বে মানুষ গরীব থেকে গরীব হয়। না খেতে পেয়ে মরে।”
“কী করে এসব জানলে খুড়ো? তুমি তো থাকো জলে। ডাঙার খবর পেতে কী করে?”
“ও মা, কী যে বলিস বোকার মত কথা! শুনলে হাসি পায়। কেন, আমার জেলেবন্ধুরা নেই?”
“ওই এক তোমার আদিখ্যেতা খুড়ো। জেলেরা তোমার বন্ধু? এই তো সেদিনই ওদের জালে জড়িয়ে গেলে, পিঠের পাখনায় ঘা হয়ে গেল, সে ভোগান্তি ভুলে গেছ?”
“অমন করে বলিস না, একবার ভেবে দেখ দেখি, জাল না ফেলে ওদের উপায় কী? মাছ ধরে বিক্রি করে তবেই তো ছেলেপুলের মুখে দুটো খাবার জোটাবে! ওরাও জানে যে আমরা ওদের বন্ধু। দেখিস না, ঘন্টা বাজিয়ে ডাকে? আমি মাছধরা নৌকার সঙ্গে সঙ্গে চলি, মাছের ঝাঁককে ওদের জালের দিকে নিয়ে যাই। আহা, বাছারা দুটো খেতে পাক।”
“হ্যাঁ, তা নইলে তোমার সুবিধে হবে কেন? জালে আটকে একটা পাখনা তো ছিঁড়েছ, আরও ছিঁড়ুক, কিচ্ছুটি বলব না।” রাগে গরগর করতে করতে লেজ দিয়ে একটা ঝাপ্টা মারল নু। ইরাবতীর বুকে জল ছিটকে উঠল।
মং একটু আনমনা হয়ে যায়। অত্যেচারী রাজার রাজত্ব গেছে সেই কবেই, কিন্তু শান্তি তো এখনো এল না? ইরাবতীর ঢেউ ঠিক সাগরের মতই অশান্ত, দেশ জুড়ে শুধুই টালমাটাল। কত মানুষ পালিয়ে গেল দেশ ছেড়ে। জেলেদের দেখে তার কষ্ট হয়। যেমন করে বাদলের মেঘ ঝুঁকে আসে ইরাবতী নদীর ওপর, ঠিক তেমনিই যেন আঁধার করেছে ওদের মুখগুলো। ওই, ওই যে এসেছে আরেকটা দল। এদের স্টিমবোট দেখতে যেন একটু অন্যরকম।
এই স্টিমবোটটা দেখেই চমকে সরে আসে নু। পাখনার ঝাপট মারে মং-এর গায়ে, “চলে এস খুড়ো।” গলার স্বর উত্তেজিত।
“দাঁড়া না, দেখি একটু, ওরা কারা।” মং নড়ে না।
“মরবার ইচ্ছে হয়েছে নাকি?” নু-এর পাখনা চঞ্চল হয়ে উঠেছে, ঘন ঘন লেজ নাড়ছে সে। ইরাবতীর অতল জলের তলায় লুকিয়ে পড়তে হবে। এক্ষুনি। আর দেরি নয়। স্টিমবোট থেকে নদীর জলে জাল ফেলে দিয়ে যাচ্ছে ওরা। নতুন রকমের মাছ ধরা জাল। জলে সরাসরি ঝোলে এই কানকো-জাল। মাছের কানকোতে সোজা ঢুকে আটকে যাবে। ব্যাস, মাছের জারিজুরি খতম। মং বা নু-এর মত কোনো শুশুক যদি এ জালে একবার আটকায় তো আর রক্ষে নেই। আটকেই থাকবে। জলের ওপর খোলা হাওয়ায় উঠতে না পেরে দমবন্ধ হয়ে মরবে। এমন মরণ সে হামেশাই দেখছে। মং খুড়ো এগুলো বোঝে না। সেই কোন আদ্যিকালের মন নিয়ে বসে আছে, জেলেদের বন্ধু হবে, মাছের ঝাঁক তাড়িয়ে জালের দিকে নিয়ে যাবে, যাতে মাছ ধরতে সুবিধে হয়! হুঁহ!
নু-এর ধমক খেয়ে মং বুড়ো খানিক সজাগ হয়েছে। কাঁকড়া খাচ্ছিল কুটুর কুটুর করে, খাওয়া থামিয়ে কৌতূহলে লক্ষ্য করে। জলের ভেতরে ঝুলছে কানকো-জাল, ওপরে ভাসছে বোতল। বোতল দিয়ে চিহ্ন করা আছে জাল ফেলার জায়গাটি।
নু সাঁতার কেটে দূরে চলে গিয়েছিল। আবার কাছে এসেছে, “খবর রাখো, জালের তারে এখন কারেন্ট থাকছে?”
বুড়ো মংএর গোল মুখ এবার হাঁ হয়ে গেছে, “কারেন্ট? সে আবার কী রে?”
“কারেন্ট জাল, গায়ে ঠেকলেই বিদ্যুতের শক। সঙ্গে সঙ্গে মাছ মরে যাবে। তোমার গায়ে ঠেকলে মরবে তুমিও। চলে এস বলছি!”
ধমক খেয়ে মং বুড়ো আস্তে আস্তে দূরে চলে আসে।
নু বলেই যাচ্ছে, “আজকাল জাল দিয়ে আমাদেরও ধরছে, জানো সে কথা?”
“আমাদের ধরছে? কেন?” মং সত্যিই অবাক হয়েছে।
“কেন আবার, অ্যাকোয়ারিয়ামে রাখবে। খেলা দেখাব আমরা, মানুষজন ভিড় করে দেখবে! এই তোমরাই তো মানুষকে ভালোবাসো, তাদের কাছে কাছে থাকো! মানুষ এখন তার দাম মেটাচ্ছে!” নু-এর গলায় বিদ্রুপ।
শুনতে শুনতে মং-এর কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে। নিজের অজান্তেই জলের ওপর ভেসে ওঠে, বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে জোরে ফোয়ারার মত জলের ধারা বার করে। কাছেপিঠে থাকা ছোট্ট মাছগুলো সে জলের ধাক্কায় দূরে ছিটকে ছত্রখান হয়ে যায়। যাকগে, মং-এর এখন ওসব দিকে মন নেই। ভাবছে ছেলেবেলার কথা।
তার বাবা-মা জেলেনৌকার সঙ্গে সাঁতার কাটত। দলের আর পাঁচটা ডলফিনের মতই। এক একটা জেলেনৌকার সঙ্গে একটা বা দুটো ডলফিন। জেলেরা দুহাতে জাল তুলে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিত নদীর জলে। ডলফিনরা সাঁতার কাটত সে জালের চারপাশে ঘুরে ঘুরে, বৃত্তাকারে। মাছগুলোকে নিয়ে আসত জালের দিকে। কখনো আবার জালের তলায় গভীর জলে গিয়ে সাঁতরে মাছগুলোকে উপরের দিকে নিয়ে আসত। জেলেরা চিনত ওদের। ওরাও জেলেদের চেনে। কার নৌকায় কোন ডলফিন, ঠিক খেয়াল রাখে। জালের দিকে সাঁতরে আসা মাছের দল দিয়ে ভালোই ভোজ হয়। জালের ধারেও কত মাছ আটকে থাকে, সেগুলো ধরে খেতেও ভারী মজা। জেলেদের সঙ্গে মিলে মাছ ধরার আনন্দ কি কম?
কালোকোলো জেলে মানুষগুলোও ওদের ভালোবাসত। খেতে দিত নিজেদের ধরা মাছ থেকে। কতবার ঝগড়াও করেছে নিজেদের মধ্যে, “ওই মাছগুলো আমার ডলফিন তাড়িয়ে এনেছে, তুই নিলি কেন?”
শুনে ইরাবতী ডলফিনের দল হেসেছে। ওদের চ্যাপ্টা, গোলমুখ তো এমনিতেই হাসি হাসি।
সেসব দিন বোধহয় আর নেই। আস্তে আস্তে সবই কেমন বদলে যাচ্ছে। কারেন্ট জাল? মানুষ তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে? বাব্বা, এতটি বয়েস হল, মং এমন কক্ষনো শোনেনি! নু ঠিকই বলে। বুকে কেমন অভিমান ঘনিয়ে আসে। মানুষ তাহলে ডলফিনের বন্ধু হয় না? এতদিন যা জেনেছে সব ভুল?
ধীরে ধীরে সাগরের দিকে সাঁতরাতে থাকে বুড়ো মং। ফিরে যাবে। কেমন এক অভিমান জমছে বুকে। ইরাবতীর দুপাশের ঘরবাড়ি আবছা হয়ে আসছে। ঢেউ বাড়ছে। সাগরের নোনা জল ঝাপ্টা মারছে নাকে, মুখে। আঃ, আরাম।
ঠিক সেই সময় দূর দিয়ে যাচ্ছে একটা সাদা রঙের স্টিমবোট। কিছু মানুষ তাতে চড়ে সতর্ক পাহারা দিচ্ছে। নো ফিশিং জোনে যাতে জেলেরা জাল না ফেলে। মানুষকে বোঝানো হচ্ছে ইরাবতী ডলফিনদের বিপদের কথা। ডলফিন ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জেলেদের শেখানো হচ্ছে কেমন করে ডলফিনদের রক্ষা করতে হবে, কেন তারা প্রকৃতি ও পরিবেশের অচ্ছেদ্য অঙ্গ। জলে দূষণ যেন না মেশে। ডলফিনরা ফিরলে তবেই পরিবেশ বাঁচবে, মানুষ, মাছ, ডলফিন সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকবে ইরাবতীর বুকে।
নু এখনো তার খবর পায়নি। কিন্তু খুব শিগগিরই পাবে। বুঝতে পারবে সুফল। দেখতে পাবে মানুষের বাড়িয়ে দেওয়া বন্ধুত্বের হাত। বুড়ো মং-ও কি আর তখন অভিমান করে দূরে থাকতে পারবে? নাঃ, আবার সবাই মিলে ওরা ফিরবে ইরাবতীর কোলে, ঢেউয়ে ভাসবে ইচ্ছেমত। শান্ত নদীটি বুকভরা মায়া নিয়ে বয়ে চলবে দিগন্তরেখার দিকে, যেখানে হাতছানি দেয় নীল সাগরের জল।
** ফুটনোট: Endangered species, বিপদগ্রস্ত প্রাণী ইরাবতী ডলফিন (Irrawaddy Dolphin)দের নিয়ে এটি একটি কাল্পনিক লেখা। ইরাবতী ডলফিনদের বাঁচানোর প্রচেষ্টা চলছে সব স্তরেই। সুফলের আশায় আছি আমরা।
ইঞ্জিনিয়ার, পেশায় কনসালট্যান্ট। শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুদিনের চর্চা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর ‘এ’ গ্রেড শিল্পী। লেখালেখির অভ্যাসও ছোট্টবেলা থেকে, বাবা-মা’র উৎসাহে। বর্তমানে কর্মসূত্রে নিউ জার্সির পারসিপেনি শহরে বসবাস। তবে বিদেশে বসেও সাহিত্যচর্চা চলে জোর কদমে। নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত ‘অভিব্যক্তি’ ও ‘অবসর’ পত্রিকার সম্পাদক।
‘ও কলকাতা’ ই-ম্যাগাজিনে ধারাবাহিক ‘সুরের গুরু’ প্রকাশিত হচ্ছে রাগসংগীতের শিল্পীদের নিয়ে। এছাড়া ‘বাংলালাইভ ডট কম’, ‘বাতায়ন’, ‘পরবাস’, ‘উদ্ভাস’, ‘প্রবাসবন্ধু’, টেকটাচটক’, ‘গুরুচণ্ডা৯’, ‘ইত্যাদি ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখিকা।