২৬ মার্চ সংখ্যা: নবজন্ম । বিপ্রদাশ বড়ুয়া
ভূরুঙ্গামারী থেকে সাহেবগঞ্জ, ওদিকে গীদালদহ ক্যাম্প, মোগলহাট, লালমনিরহাট সব এখন এলোমেলো লাগছে। কাহিনির জোড়া লাগাতেও খুব একটা চেষ্টা করি না। কিন্তু প্রতিটি ঘটনা আমার কাছে জ্বলজ্বলে। মাঝেমধ্যে না হয় থাক না এলোমেলো।
রাইফেলের ছোট একটি স্ক্রু বা পিন পড়ে যাওয়ার ঘটনাও হুবহু বলে দিতে পারি। একবার যুদ্ধ করতে করতে স্টেনটা হঠাৎ গেল বিগড়ে। কী ব্যাপার! এ রকম তো সচরাচর হওয়ার কথা নয়! অঙ্কে তো মেলে না! আগের রাতে ভালো করে সাফসুতরো করে রেখেছি। কী ব্যাপার, কী ঘটনা—মুহূর্তের দেরিতে প্রলয় ঘটে যাওয়ার অবস্থায়। ওদিকে শত্রু এক মুহূর্তের সুযোগ পেলে এগিয়ে আসবে। আমি তো শেষ হবই, সঙ্গীরাও শেষ হয়ে যেতে পারে। সেকেন্ডের মধ্যেই মনে পড়ে গেল একটা সেফটিপিন দিয়ে কালের খোল ফেলছিলাম শত্রুর অপেক্ষা করতে করতে, আর কোনো ফাঁকে সেটা স্টেনের গুলি ভরানোর ম্যাগাজিনের জায়গায় আশ্রয় নিল না তো? আমার মাথার মধ্যে ছিল না যে একটা দৈত্যের শক্তি নিয়ে সেফটিপিনটা সেখানে লুকিয়ে পড়বে। গুলি শুরু করব আর ঠিক তখনই এ অবস্থা।
রৌমারীর একটা আক্রমণে পরপর তিন দিন ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। নেতৃত্ব ছিল একে একে সমর, অদিত ও সিরাজুলের। পরপর তিন দিন ব্যর্থ হওয়ার মানে মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। চতুর্থবারে দায়িত্ব নিলাম আমি। না, চ্যালেঞ্জ করে নয়, সাহসিকতা দেখানোর জন্যও না, খুব ধীরস্থির সিদ্ধান্ত আমার। আমি পারব, পারতে হবে আমাকে। পরপর দুদিন আবার রেকি করে এলাম। গ্রামবাসী আমাদের বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল। এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে চুমো খেয়ে বলল, পাকিস্তানিদের অত্যাচার তো আর সহ্য হয় না, বাবা। আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো বাবা, ওই পড়ে থাকা আমার মেয়েটিকেও একটা করো বাবা, তুমি আমার পেটের ছেলে হলে বলতাম, যা এই মুহূর্তে গিয়ে হয় শত্রু মেরে আসবি, নয়তো ফিরে আসবি না আর। স্বামী হলে বলতাম, জয় চাই না, প্রতিশোধ নিয়ে এসো মেয়ের অপমানের, এক শ বছর পরেও যদি দেশ স্বাধীন হয় তো হোক। আমার মেয়ের অপমান তো চোখে সহ্য করতে পারি না। মেয়ের সাধের যৌবন হয়ে গেল বিষের। কত সুন্দর স্বপ্ন মেয়েদের থাকে, তুমি বুঝবে না। স্বামী বা প্রেমিকাকে নিয়ে প্রথম যৌবনের স্বপ্ন পৃথিবীর বিনিময়েও ছেড়ে দেওয়া যায় না। যৌবনের স্বপ্ন ও আনন্দ আর কোথায় পাবে আমার এই একরত্তি মেয়েটি! নারীত্বের যন্ত্রণা নিয়ে সে সারা জীবন বেঁচে থাকবে? আমাদের আর কিছু দাবি নেই, আমার আর কিছুই বলার নেই এর বেশি।
তারপর আরেক মহিলা এলো, তারপর আরেকজন। গ্রামের প্রায় মানুষ যেদিকে পারে পালিয়ে গেছে। যারা আছে তাদের আর কোনো উপায় নেই বলে যায়নি। ওই মহিলা তাঁর লাঞ্ছিত মেয়েকে নিয়ে কোথাও যেতে পারেননি বলে প্রতিদিন একইভাবে অত্যাচারিত হচ্ছেন।
সিরাজুল ও অদিত আমার পাশে। নতুন করে রেকির কাজ প্রায় শেষ। আমরা ২১ জনের খুদে বাহিনী। ওই মহিলার কথা শুনে আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, একে একে শেষ হয়ে যাব, প্রয়োজন হলে আত্মঘাতী সামনাসামনি যুদ্ধ, প্রত্যেকে অন্তত একজনকে শেষ করে হলেও আমরা মরব…। জয় চাই, জয়!
রাত সাড়ে ১২টায় আমরা ক্যাম্প ছেড়ে বের হলাম ওদের রাজাকার খবরদাতাদের ফাঁকি দিতে। সামনে একটা গ্রাম, তারপর ব্রহ্মপুত্রের বালুচর, আবার একটি ছোট গ্রাম, তারপর ধু ধু বালুচর বা চরের জমে থাকা পানি। পথ আমাদের এতই চেনা হয়ে গেছে যে অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও কিছু যায় আসে না। পা আপনিই পথ করে নেয়। কোথায় গ্রাম, কোথায় বালুচর এবং কাকে কোন দিকে ফেলে যেতে হবে তা অথবা শত্রুকে কতদূর চক্করে রেখে ঘিরে ধরতে হবে বা প্রয়োজনে কোথায় অস্ত্র রাখতে হবে, তা আমাদের নখদর্পণে। অঘ্রাণের হিমেল হাওয়ার সঙ্গে কুয়াশা আর উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত অসচরাচর শীত। একবার মনে হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, বৃষ্টি নামল বুঝি। সেই মায়ের কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছেন, আমরা সারা রাত জেগে তোমাদের সাহায্য করব, অস্ত্র বয়ে নিয়ে যাব শাড়ির ভেতর লুকিয়ে, যা আছে খেতে দেব, আর কিছু যদি না-ও করতে হয় সারা রাত জেগে থাকব, তোমাদের জন্য দোয়াদরুদ পড়ব আর জয়ের আওয়াজ ও উল্লাস শোনার অপেক্ষায় থাকব…। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে শীতটা কোথায় উড়ে গেল। বলতে গেলে ততক্ষণে আমরা কুয়াশার বৃষ্টিতে ভিজে গেছি। এ অবস্থায় আক্রমণ তো দূরের কথা, আনন্দে উল্লাসও করা যায় না বলে মনে হলো। আসলে একেকটি আক্রমণে আমরা প্রচলিত অর্থে সুস্থ মানুষ থাকতাম না। প্রতিটি আক্রমণও এত আলাদা যে প্রতিবার মনে হতো, বাঃ, জীবনের শেষ সঞ্চয় হলো এবার। —আমাদের এক লক্ষ্য। সব স্নায়ু, টানটান, একটা সামান্য টোকা পড়লেই প্রলয় ঘটে যাওয়ার মতো অবস্থা। বুদ্ধিশুদ্ধি যেন লোপ পেয়ে গেছে বলে মনে হয়—আসলে লোপ পায় না, যদি তা-ই হতো, তাহলে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হতো। কিন্তু শুধু এ কারণে কখনো আমরা সিদ্ধান্ত পাল্টাইনি। সময়ের প্রয়োজনে এমনও সময় গেছে যে মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে সহযোদ্ধাকে অন্য রকম নির্দেশ দিয়েছি।
আমাদের সামনে একটা ঝাঁকড়া মাথার বটগাছ। হ্যাঁ, দ্রুম বলা যায়। মস্ত বড়। এর ছায়ায় আমরা আগে বিশ্রাম নিয়েছি, শত্রুরাও বিশ্রাম নিয়েছিল। ওটা যার দখলে থাকে তার সুবিধা বেশি। ‘কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে’ সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল। অন্ধকার অন্ধকারেও গাছ গাছের ছায়া বিছিয়ে আছে। এই বটগাছ মহাশয় যার দখলে থাকে তার সুবিধা বেশি। ওর দখলের জন্য আমরা আগের তিনবার তিনজন করে সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি। অন্য সময় এই বটগাছ স্বাধীন-মুক্ত, কিন্তু আক্রমণের সময় ওটা কার ভাগে আছে সেটা খুব জরুরি বড় কথা। পাকিস্তানিরাও এই বট মহাশয়ের জন্য হারিয়েছে কম করে হলেও ১৫ জন। একবার দখল করে ওদের হটিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামগ্রিক যুদ্ধে আমরা জিততে পারিনি। দুই পক্ষের গুলিতে স্বাধীনতার এই সৈনিকের গোড়ার ছাল ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। কত গুলি ওর গায়ে বিঁধে আছে জানি না—রাত বাড়তে লাগল। চারদিক ঝিঁঝির ডাক ছাড়া নিস্তব্ধ। একসময় তাতে আবার শিশিরের শব্দ যোগ হলো, শুনতে পেলাম। হিমেল রাত ও হাওয়ার গতি তো খালি হাতে মাপা যায় না। গায়ের ভেজা সামান্য কাপড় একসময় শুকিয়ে যাচ্ছে মনে হলো। আক্রমণের আগের সন্ধিক্ষণে সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছি, মৃত্যু অথবা জয়ের লড়াইয়ের শেষ প্রস্তুতি, শেষ প্রহর কবজা করে নিচ্ছি। বাংলাদেশকে মনে হতে লাগল একটি ছোট্ট সাদা-কালো দোয়েলের মতো, শীতে কাঁপছে, তাকে উত্তাপ দিয়ে রক্ষা করতে হবে। আবার মনে হলো দোয়েল নয়, ছোট্ট একটি তুলার বল। কুয়াশায় ভিজে ভিজে তুলাগুলো খালি ভিজে চলেছে, আমরা ২১ জনে মিলে খালি হাতে তুলার বলটি শিশিরের হাত থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ওদিকে রাতের প্রহরী ডাকল কি ডাকল না, শ্মশানঘাটে আলেয়া দেখা গেল কি গেল না, রাতের অন্য প্রহরী শেয়াল বা কুকুর—কে কী বলল জানি না। হঠাৎ দেখি, কুয়াশা কেটে পুব দিকে আলোর আভাস ভেসে উঠল মুহূর্তের মধ্যে, ব্রহ্মপুত্রের নীরব শব্দও বুঝি শুনতে পেলাম! আড়মোড়া দিয়ে নিজের দখল থেকে সিরাজুল আমার কাছে আসতে চেয়েও থেমে গেল। শত্রুর ঘাঁটি সামনেই, একেবারে কয়েক গজের মধ্যেই। সিরাজুল মাটি থেকে কী যেন একটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। অন্ধকারে মাটির শক্ত ঢেলা মনে করল কি! কেমন যেন চিন্তা ও বিহ্বলতাও। তবে মুহূর্ত মাত্র। আমি এক মুহূর্তও সময় ধ্বংস না করে চাপা গলায় বললাম, কী কী কী! ততক্ষণে সিরাজুল বুঝে নিয়েছে। সে বিস্ময়, ভয় ও সাহস একসঙ্গে গিলে দুই গজ দূরেও কেউ শুনতে না পায় মতো করে বলল, মা-ই-ন!
তাকে কোনো রকম সময় না দিয়ে উড়ে তার সামনে গিয়ে হাত থেকে মাইনটি ছোঁ মেরে নিয়ে ছুড়ে মারলাম। বোধ হয় মাটিতে পড়ার আগেই শব্দ করে উঠল বিকট, শত্রুর একেবারে মাঝখানে গিয়ে পড়ল মনে হলো। কারণ ততক্ষণে আমরা শত্রুর কুড়ি-তিরিশ গজের মধ্যে চলে গিয়েছি। ওপাশে শখানেক গজ দূরে আদরের সেই বটগাছ, অমনি আমার সাঙাতরা শুরু করল আক্রমণ। শত্রুরাও আচমকা শব্দের তরঙ্গে জেগে গেছে, আমাদের আগমন টের পেয়ে গেছে। এলোপাতাড়ি দৌড় দিল প্রথমে ওরা, তারপর শুরু করল ওদের প্রতিরোধ। আমাদের চেয়ে চার-পাঁচ কি ১০ গুণ বেশি ওদের লোকবল, ২০ গুণ বেশি সামরিক অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান। তবুও ওদের শক্তি যেন মুহূর্তে মুহূর্তে কমতে লাগল। যুদ্ধ করতে করতে তত দিনে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছি, গুলির আওয়াজ শুনে অনেক কিছু বুঝতে শিখে গেছি, ওদের শক্তিও অনুমান করে নিতে পারি। ওরা হচ্ছে তবে হানাদার বাহিনী, ওদের মনে সব সময় ভয়, একটা কিছু টের পেলেই ওরা সামগ্রিক শক্তি নিয়ে আক্রমণ করে বসে, একসঙ্গে সর্বশক্তি ঢেলে দেয়। আমরা করি ঝটিকা আক্রমণ, কলাকৌশলের সর্বোচ্চ ব্যবহার, শক্তির পূর্ণ সদ্ব্যবহার। বুঝতে পারি ওদের মর্টারের গর্জনের ভাষা, কামানের আওয়াজের বুলি। ততক্ষণে আমাদের লাইনে আরেকটি মাইন ফেটেছে। সঙ্গে সঙ্গে পজিশন পাল্টে নিয়ে ছুটলাম নিজেকে আড়াল করে। আমার আহত হওয়া চলবে না, শত্রুর পোঁতা মাইনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। দলের অবস্থাও নির্ভর করছে ওই মাইন বিস্ফোরণের ওপর।
আরো পড়ুন: ২৬ মার্চ সংখ্যা: ফেরা না ফেরা । মাহবুব আলী
সজল, সাব্বির ও রকিবকে অক্ষত দেখে বুঝলাম, দ্বিতীয় মাইনটিও আমাদের রেহাই দিয়েছে। তৃতীয়টি যদি না দেয়? সঙ্গে সঙ্গে রকিবকে দিয়ে খবর জানিয়ে দিলাম মাইন থেকে সাবধান থাকতে, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। আমাদের প্রত্যেকের এলএমজি এবং কভার দেওয়ার অটোমেটিক রাইফেল ভালো কাজ করছে। আমাদের লাইনের অক্রমণের শব্দ আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে। একটু কিছু হলেই ওরা পজিশন পাল্টাতে থাকে আর ওটাই মোক্ষম সুযোগ। জয় আমাদের মুঠোর মধ্যে এসে গেছে। শত্রুর দিক থেকে সাদা পতাকা হাতে চারজন সৈন্য হাত তুলে এগিয়ে আসছে? ভোরের প্রথম আলোয় দেখতে পাচ্ছি, শত্রুর অনেক মৃতদেহ পড়ে আছে। রকিব ছুটে যাচ্ছে, সিরাজুল চলে গেছে, পেছনে গগনভেদী জয় বাংলার ঢেউ, গ্রামবাসী ছুটে আসছে। সত্যিই! ভোরের আলোয় দেখতে পেলাম, সেই মা দৌড়ে আসছেন আমাদের দিকে। আমি সবার পেছনে পড়ে গেছি, কারণ আমাদের আহত চারজনের দেখার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছি, আমার মূল দায়িত্ব তুলে দিলাম সিরাজুলের হাতে। দ্রুত সব বদলে যাচ্ছে, পাল্টে গেছে।
… আহত মুনির, রতন, কামরুল ও হাসানকে দেখতে হবে। যুদ্ধে আহত প্রাণের মূল্য মৃত্যু থেকে বেশি, একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন অনেক অনেক মূল্যবান। ওরা প্রত্যেকে পরীক্ষিত ও শিক্ষাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে কী যে হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। বিকট শব্দের ধাক্কায়ই যেন ছিটকে পড়লাম। আমার ডান পায়ের অর্ধেকটা ঝুল-ঝুল করছে, বাঁ হাত থেকে এসএমজি খসে পড়েছে, যেন সারা শরীর একটি নদী, রক্তস্রোত বইছে। সে অবস্থায় কোথা থেকে মস্ত বড় চাঁদোয়ার মতো এক অতিকায় কুয়াশা এসে আমাকে ঢেকে ফেলল, আমি আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। সারা শরীর দিয়েই কি রক্ত ঝরছে, এত রক্ত কোথা থেকে আসে, আর প্রায় উলঙ্গ, প্রায় জ্ঞানশূন্য আমি। সে অবস্থায়ও হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম কি! সে যে কী অনুভূতি, তা বোঝানো যাবে না বলে। আহত সঙ্গীরা কোথায়? ওদিক থেকে ছুটে আসছে সিরাজুল, আসছে রকিব—ওরা কি আমাকে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে, কুয়াশার চাদরের তলায় কী ঘটছে? বাঁচার ইচ্ছা ভীষণ প্রবল হয়ে উঠল। ওরা অমন করছে কেন? আমরা কি পরাজিত, আমরা কি হেরে গেলাম! কুয়াশার এই জাদুখেলা কেন! মাথায় এত কিছুর ভিড় আর বিশ্রী কুহক কেন! গামছা দিয়ে কে আমার পা বেঁধে দিল! শত্রুর ডাক্তার কি রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে! ওরা কি অত কিছু মানে, মানবতা আছে! আমাকে নিয়ে যাচ্ছে শত্রুর ক্যাম্পে! মুনির, রতন ও কামরুল—কোথায় তোরা, আমি বাঁচব, বাঁচব, বাঁচতে চাই। একটি দোয়েল ডেকে উঠল বুঝি! নাকি মৃত্যুঘণ্টা, ট্রেনিংয়ের সময়ের পায়ের আওয়াজ…!
জ্ঞান যখন ফিরল, তখন দেখি সেই মা আর মেয়ে আমার সেবায় ঘিরে আছে। কী বিষণ্ন মেয়েটি! সেই বিষাদের গহ্বর থেকে ডাক দিল, তাজুল ভাই আমার, এটুকু দুধ খাও। আর দূরে দাঁড়িয়ে লোকজন আমার ক্ষতবিক্ষত চেহারার দিকে দেখে আছে। ডান হাতটা একটু তুলে ধরে ওকে বললাম, আমি তোমাদের মাঝে কী করে ফিরে এলাম! সিরাজুলরা কোথায়! তাহলে আমরা জিতেছি! এখন আমার একমাত্র সঙ্গী নূরী ও পঙ্গু আমি।
নূরীর চোখ আজ অন্য রকম। সিরাজুলের গলা শুনতে পাচ্ছি দূরে। একটা রংচটা আরাম কেদারা নিয়ে আসছে গ্রামের লোকজন। নূরীর চোখ অশ্রুসিক্ত ঝাঁঝরা নয়, সে বলল, তোমার জন্য আমি বেঁচে থাকব। শুনে বুকের ভেতরটা এবং দুই পায়ের প্রচণ্ড ব্যথা গর্জে উঠল একসঙ্গে। কোথা থেকে একটা ভাঙা প্রায় আরাম কেদারা নিয়ে এলো জয় বাংলার গ্রামের মানুষরা। সিরাজুল এসে তাতে আমাকে তুলে নিল। তারপর দীর্ঘ অনেক বছর কেটে গেল। বাঁ পাটি একেবারে গোড়া থেকে কেটে বাদ দিয়েছে।
আমার একমাত্র সঙ্গী এখন নূরী, ওকে ছাড়া আমি নিজেকে ভাবতেও পারি না।
![ইরাবতী ডেস্ক](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2021/12/irabotee-cover-e1640636602578-150x150.jpg)