গোলাপ

ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব ৩৯)। সর্বাণী বন্দ্যোপাধায়

Reading Time: 2 minutes

সেসময়ের আরো অনেক পিকনিকের কথাই মনে আছে।এক এক করেই বলা যাক।একদম ছোটবেলার আবছা একটা স্মৃতি আছে। তখন আমার খুবই কম বয়স ,মামারবাড়ির সকলের সঙ্গে যাওয়া হয়েছিল আদিসপ্তগ্রামের নার্সারিতে পিকনিক করতে। ট্রেনে করে যাওয়া এবং ট্রেনেই ফেরা। আমার বাবা চিরকালই উদ্যোগী মানুষ ছিলেন। ফলে তিনি সেই পিকনিকের উদ্যোক্তাও বটে। মামাতো বড় বড় দাদারাও রীতিমত হুজুগে । ফলে বিশাল একটা দল হাজির হয়েছিল ওই নার্সারির ফাঁকা একটি বাগানে।

ওই নার্সারিতে গোলাপের চাষ হত। বিশাল বড় বড় আকৃতির লাল, হলুদ, সাদা আর গোলাপী গোলাপ ফুটে ছিল বাগানে। সেই স্মৃতি আবছা হলেও আছে। কেননা আমরা তার আগে অত বড় গোলাপ দেখিনি। আর মনে আছে কিছু কিছু মানুষকে। তারা ঘুরছে ,ফিরছে, কথা বলছে। আমোদ করছে। মনে করতে গেলে বিষয়টা নেগেটিভের ছবি দেখার মত হয়ে যায়। তখন মুরগীর মাংসের কোন  ভূমিকা ছিল না। সবজায়গায় পাঁঠার মাংস হত, এবং বেশিরভাগ সময়েই ছোটরা সেই ঝাল মাংস খেতে পারত না। পিকনিকেও সেই একই কান্ডের পুনরাবৃত্তি।

রান্না, সবজি কুচোন, মশলা বাটার জন্য বাড়ির মহিলারা একযোগে নেমে পড়তেন। রান্নার দায়িত্ব পুরুষদের ঘাড়েই থাকত।তারা বড় বড় কড়াই ,হাঁড়িতে যাবতীয় রান্না এবং পরিবেশনের কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করে ফেলতেন। রান্নার ব্যাপারে সুনাম আছে এমন কাউকে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হত।

ওই পিকনিকের নকল করতাম আমরা নিজেদের পিকনিকে। শীতকালে ছাদে পাড়ার মহিলাদের করা একটা ফিস্টে প্রতিবারই ডিমের ডানলা মেনুতে থাকত। আর বাড়িতে অর্দ্ধেক ডিমে অভ্যস্ত আমরা দুটো ডিম পাব বলে বেশ উত্তেজিত থাকতাম। তাছাড়াও শীতের সময় পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আমরা বাগানে পিকনিক করতাম। সজনে ফুলের বাটিচচ্চরি ছিল সেই পিকনিকের এক এবং অন্যতম মেনু।


আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব ৩৮)। সর্বাণী বন্দ্যোপাধায়


ঘটনাটা অনেকটা ‘কুড়ুলের খিচুড়ি’র মত ঘটত। ছোটবেলায় কে না গল্পের বইএ কুড়ুলের খিচুড়ির কথা পড়েছে? সেই যে এক রাশিয়ান বুড়ির বাড়িতে রাতদুপুরে এলো এক সৈনিক।বুড়িমা কিপ্টেমি করে তাকে বলেছিল “ঘরে কিছু নেই বাছা, তোমাকে কিছুই খাওয়াতে পারব না।”

আর সে বুড়ির কাছ থেকে একটা কুড়ুল চেয়ে নিয়ে বলেছিল, “কিছু লাগবে না,সে কুড়ুলের খিচুড়ি বানাবে।”

তারপর  মশলাপাতি ,জাউ, ঘী সব আদায় করে সে চমৎকার জাউ এর খিচুড়ি রেঁধেছিল। সেই খিচুড়ি খেয়ে বুড়িও খুশি হয়েছিল। ঠকে যাওয়াটা ধরতে পারেনি একদম।

আমরাও পরীক্ষার পর শীতের ছুটিতে সকালে বেরিয়ে পড়তাম সজনে ফুল কুড়োতে।তারপর দুপুরবেলা সবাই বাড়ি থেকে আলু ,তেল, কাঁচালঙ্কা ,হলুদ নিয়ে কোন এক নির্জন বাগানে, শুকনো কাঠকুটোয় আগুন জ্বেলে, আলু ফুলের বাটিচচ্চরি বসিয়ে দিতাম বাটিতে। সেই আলুচচ্চরি অনেকটা কুড়ুলের খিচুড়ির মতই ছিল।বাড়তির মধ্যে তাতে মেশানো থাকত আমাদের মনের আনন্দের নির্যাস।

আসলে সে সময়ের সব পিকনিকই ছিল গায়ে গতরে পরিশ্রমের ফসল। না খেটে কোনকিছুই হত না। পাড়ায় পাড়ায় সরস্বতী পুজো মিটলেও যে আলুরদম ফিস্টি হত তাতেও আমরা ছোটরাই আলু ছাড়াতাম বস্তায় ঘষে ঘষে ,বড়রা মশলা বানাতেন,রান্না করতেন।পাত পেড়ে চটে বসে শুধু আলুরদম খাওয়ার সেই স্মৃতি ভোলার নয়।

জীবন বড় পালটে যায়। এখনকার দ্রুত জীবনে সময় পাওয়াই মুশকিল।আমরা বাঙালিরা বরাবরই হুজুগে তাই পিকনিকের অভ্যাসও যাচ্ছে না।পিকনিক হচ্ছে,তবে এখন তার চেহারায় কর্পোরেট দুনিয়ার ব্যস্ততার ছাপ। পিকনিকেও প্যাকেজ সিস্টেম চলছে। জায়গা বাছার পর সবাই জড়ো হচ্ছে। গল্পগুজব গান বাজনা চলছে।বাক্সে চলে আসছে জলখাবার, সঙ্গে কফি চায়ের ইয়াবড় ক্যান।।তারপরে দুপুরেও রেডিমেড রান্না। অর্ডার দেওয়া খাবার কাঁচের প্লেটে পরিবেশিত হচ্ছে, তাতে ইচ্ছেমত কাবাব,স্যালাড,মাটন, পোলাও যতখুশি খান না কেন? আপনার নেলপালিশ অক্ষত রেখে চামচে করে মুখে তুলুন কোর্মা পোলাও এর সম্ভার।

“আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না”র বিভ্রাট নেই। “বিরিয়ানি কোর্মা পটলের দোর্মা” আছে।

মানে বাহারি ভাড়া করা পিকনিক স্পটের গার্ডেন আছে।বনভোজন আছে। এলোমেলো বনের, ইচ্ছেমত মেনু্‌র নামগন্ধ নেই কোথাও। আধুনিক এই জেট ব্যবস্থায়, ধোঁয়ার গন্ধ নেই, নেই ঝাল মাংসের চোখ থেকে আর জিভ থেকে জল পড়ার ঐক্যতান। আমরাও আছি, পিকনিক ও আছে, হারিয়ে গিয়েছে যা, তা আর ফিরে আসবে না।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>