Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,চোদ্দ শাকের

চোদ্দ শাক ও আলোর কথা । পায়েল চট্টোপাধ্যায়

Reading Time: 4 minutes

সকালবেলায় মাঠের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে বিনতা। এই সময় মিত্তিররা কেউ এদিকে আসে না। এই ফাঁকেই কাজটা সারতে হবে। আলপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে ও। সূর্যের আলো এখনো তেমন ভাবে চোখ মেলেনি। তাই তো নিশ্চিন্ত। আলপথ থেকে নেমে পড়েছে এবার। জমিতে। মিত্তিরদের জমি এটা। বিনতা জানে। ওর দু’চোখ জুড়ে তখনো হালকা ঘুমের আবেশ। সেই আবেশ মেখেই চোখ খুঁজে চলেছে জিনিসগুলো। এই তো বেতো শাক। ওই যে, ওই দিকে গুলঞ্চ। ওপাশেই হিংচের পাতাগুলো তাকিয়ে রয়েছে। পটলের পাতা ও নিয়ে যেতে হবে। কাল রাত থেকে বারবার করে মা সব বলে দিয়েছে। অপেক্ষায় বসে থাকবে। বিনতা গেলে রান্না করবে। বিনতা শুরু করে দেয় গোছানো। যতগুলো নাম মনে আছে সব সংগ্রহ করার কাজে লেগে পড়ে।  কিন্তু অষ্টাদশী বিনতার শতচ্ছিন্ন সালোয়ারের ভেতর দিয়ে বারবার পাতাগুলো পড়ে যাচ্ছে। বিনতা প্রাণপণে চেষ্টা করছে গুছিয়ে নেওয়ার। এদিকে একটু একটু করে সূর্য তার জায়গা দখল করছে। মিত্তিরদের বাড়ির কেউ যদি এদিকে চলে আসে! ভয়ে ওর বুক ঢিপঢিপ করছে! কিন্তু অর্ধেক কাজ করে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। মা বারবার বলে দিয়েছে চোদ্দ শাকের কথা। মরসুম বদলের এই সময়টায় চোদ্দ শাক খেতে পারলে সারাবছর নাকি রোগব্যাধি কম হয়। তাহলে আর বারবার লক্ষীর ভাঁড় ভেঙে ওষুধের খরচ যোগাতে হয় না। বিনতা আশা করে। বেশ ঝকঝকে, পরিষ্কার, নিকোনো উঠোনের মত জীবন হবে ওদের! কিন্তু বিনতার কোঁচড় আর দুই হাতের মুঠির ফাঁক দিয়ে বারবার ঝরে পড়ছে অবোধ শাকের পাতাগুলো। ওদের জীবন থেকে পুষ্টি নামের ভোজবাজিটা ঠিক যেভাবে পালাতে চায়!

বিনতার রাগ হচ্ছে এবার। এত যোগান রয়েছে মিত্তিরদের, তবুও একটুও দেয় না। সব একা ভোগ করবে! ক্ষমতাবান মানুষরা ‘এমনধারা’ হয় কেন? প্রশ্নটা কুরে কুরে খায় বিনতাকে। প্রকৃতি সকলের জন্য একই ভাবে সাজিয়ে দিয়েছে। তবুও কিছু মানুষ সূর্য, চন্দ্র, আকাশ-বাতাস, মাঠের ফসল একা ভোগ করতে চায় কেন? ভাগ করতে অসুবিধা কোথায়? বেশি আর কমের সূক্ষ্ম তফাতটুকু সহজ-সরল মাথায় ঢোকেনা বিনতার। তাহলে কার্তিক মাসের এই সময়টাতে লোকে কেন চোদ্দ প্রদীপের আলোয় অন্ধকার দূর করার কথা বলে? নাহ, বেশিক্ষণ নিজের এসব আবোল-তাবোল ভাবনায় ডুবে থাকার সময় নেই বিনতার। সূর্য উঠে গেছে। পালাতে হবে বিনতাকে। মোটামুটি চোদ্দ রকম হয়ে গেছে। দুহাত ভরে শাক নিয়ে দৌড়চ্ছে ও। যেন কোন জাদুকরের জাদু-কথার কয়েকটা পাতা উপড়ে ফেলতে পেরেছে। ওর হাতের ফাঁক দিয়ে সকালের শিশিরের ওপর গড়িয়ে পড়ছে মরসুমী সমস্যাকে একহাত নেওয়ার সবুজ রঙের জাদুকাঠিগুলো, যাদের সহজ-সরল, গ্রাম্য ভাষায় নাম চোদ্দ শাক।

চোদ্দ শাকের বিধান কে দিয়েছিলেন তা জানা নেই। তবে এমন অজস্র বিনতারা আজও চোদ্দ প্রদীপের মতোই আলোর কাহিনী খোঁজে চোদ্দ শাকে। কার্তিক সকালের শিশির, ভোরের হিম, সন্ধ্যের শিরশিরে বাতাসে ভর করে ভেবলে যাওয়া একখানা মাস। মানুষ প্রেমের থেকেও তাড়াতাড়ি অসুখে পড়ে। গ্রামের মানুষরা বিশ্বাস করেন এই সময় জীবনের দরজার পাশে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করে থাকে নানা অসুখ-বিসুখ। জ্বর, কাশি, পেটের রোগের হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড। দীপাবলীর উৎসবে আঁধারের ছায়া। ভূত চতুর্দশীর দিন একরকম আলো জ্বালানোর জন্যই চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে চোদ্দ শাক খেয়ে মৃত্যুভয়, মারীর ভয়, রোগ ব্যাধির ভয়কে ফানূসের মত উড়িয়ে ফেলতে চায় মানুষ।

চোদ্দ শাকের এই উৎসব আসলে এক মহাসমারোহ। খাদ্যের প্রাপ্তির উদযাপন। শাক মহোৎসবের শুরু। ঋতু পরিবর্তনকে ভালবেসে স্বাগত জানানোর উপায়।

প্রকৃতি তার অফুরন্ত ভান্ডার এইভাবেই সাজিয়ে দেয় আমাদের জন্যে। গ্রামের মানুষ এসময় শাক-ভাত দিয়ে পেট ভরিয়ে নিতে জানেন। তবে আমাদের দেশের খাদ্যাভ্যাস ও তার সঙ্গে জুড়ে থাকা পুষ্টিগুণ বলে, অবহেলায় বেড়ে ওঠা এইসব শাকপাতার মূল্য আসলে অসীম। কিন্তু বিনতাদের ভাগ্যে সেটাও জোটে না সহজে। ওর কোঁচড় যদি ভর্তি হত, তাহলে হয়তো সহজ হতো ওর বাঁচার লড়াই। চোদ্দ শাক এমনই এক টুকরো জীবন যেন। তবে শুধু গ্রাম নয়, শহরতলি, এমনকি খুঁজলে শহুরে আদব-কায়দার মধ্যেও তুলসীতলার প্রদীপের এক টুকরো আলোর মতোই চোদ্দ শাক খাওয়ার এই রীতি আজও বর্তমান। বাজারেও এ সময় কুঁচো শাকের সমারোহ। সব রোগ-ব্যাধিকে পক্ষীমাতার মতো গ্রাস করে সন্তানদের সুস্থ রাখার আয়োজন।  সেই আয়োজনে মিশে থাকে আদুরে জীবনের গল্প। কত উপকথা, কাহিনী কিলবিল করে বয়ে চলে জীবনের ভেতর দিয়ে। চোদ্দ প্রদীপের আলোর মতোই উজ্জ্বল তাই চোদ্দ শাক।

কে কে আছে এই চোদ্দ শাকের তালিকায়? ওল, কেঁউ, বেথুয়া, কালকাসুন্দি, নিম, সর্ষে, শালিঞ্চা, জয়ন্তী, গুলঞ্চ, পটল গাছের পাতা বা পলতা পাতা, হিঞ্চে, ঘেঁটু, শেলূকা, শুষনি। মূলত এই চোদ্দজন মিলেই গড়ে তোলে চোদ্দ শাকের ভান্ডার। পেট খারাপের দাওয়াই, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা, জ্বরজারি, মানসিক চাপের সমস্যা, এমনকি হাড়ের সমস্যা পর্যন্ত সারাতে পারে চোদ্দ শাকের একেকসদস্য। তবে আধুনিকতার সিঁড়িতে এদের মধ্যে অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির পথে। তাই বর্তমানে লাউ শাক, কুমড়ো শাক, নটে শাক, কলমি শাকের মত রোজকার খাওয়ার থালা যারা পুষ্টিগুণে ভরিয়ে দেয় তারাও অবলীলায় ঢুকে পড়েছে চোদ্দ শাকের ভান্ডারে। নব্য-স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দন পূর্বে উল্লেখিত শাকগুলির কথাই বলেছেন। এই শাক মূলত তেতো। এই শাক খাওয়ার ফলে মুখ ও পাকস্থলীতে প্রচুর লালা ও উৎসেচকের ক্ষরণ হয়। এই উৎসেচক সাহায্য করে রোগ নিরাময়ে।

আবার সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন দীপাবলীর সময়ে ভূতচতুর্দশীর দিনে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালা ও চোদ্দ শাক খাওয়া আসলে এক শুভ বার্তা। এই প্রথার সঙ্গে শস্যদায়িনী দেবী ভাবনার যোগ রয়েছে। অনাহার বা সঠিক এবং প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে অন্ধকার দূর করে জীবনের মূল রসদ অর্থাৎ খাদ্য মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার একটা শুভ চেষ্টা আসলে এই রীতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

চোদ্দ শাকের সংখ্যা হঠাৎ চোদ্দ হল কেন? মূলত এই রীতি ভূতচতুর্দশীর দিন পালিত হয় বলেই শাকের সংখ্যা চোদ্দ। এর সঙ্গে যোগ রয়েছে পুরাণের। দানবদের রাজা বলি স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল দখল করেছিলেন একবার। যথারীতি ব্রহ্মাণ্ড দখল করেই বলি শুরু করেন তাঁর ধ্বংসলীলা। দেবতারা অতিষ্ঠ। দেবতা, মানুষ সকলের জীবনে মূর্তিমান বিপদ আকারে অন্ধকারের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন দানব রাজা বলি। বলিকে জব্দ করতে দেবতারা একবার দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে গেলেন। তিনি ভগবান বিষ্ণুকে উপায়ের কথা জানালেন। কী সেই উপায়? ছলে, বলে, কৌশলে দানব রাজার কাছ থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দখল ফিরে পাওয়া।

ভগবান বিষ্ণু বামনের ছদ্মবেশে বলিকে দেখা দিলেন। বলি ছিলেন দানশীল রাজা। তার কাছ থেকে বামন রূপী ভগবান বিষ্ণু তিন পা জমি চেয়েছিলেন। বামন রূপী দেবতা এক পা রেখেছিলেন মর্ত্যে, এক পা পাতালে ও এক পা স্বর্গে। ফলে আবার ব্রহ্মাণ্ড দখলে চলে এলো দেবতাদের। দানবদের রাজা বলি চলে গেলেন পাতালে। তবে একটি শর্তে। কী সেই শর্ত? তিনি বছরের একটি দিন এই পৃথিবীতে  আসবেন নিজের পুজো নিতে। তাকে সঙ্গ দেবে অসংখ্য ভূত, প্রেতাত্মা। এমনটাই পৌরাণিক বিশ্বাস। পুরাণ অনুযায়ী এই দিন ভূতচতুর্দশী পালিত হয়। পৃথিবীর মানুষরা প্রেতাত্মা দের নজর থেকে বাচার জন্য চোদ্দ প্রদীপ জ্বালায় ও চোদ্দ রকমের শাক খায়। যদিও অনেক ঐতিহাসিক পৌরাণিক এই ব্যাখ্যার সঙ্গে চোদ্দ শাক খাওয়ার এই যোগ মানতে নারাজ। তবে চোদ্দ শাক খাওয়ার সঙ্গে আসলে আলোর যোগ রয়েছে। যে কোনো অশুভ অন্ধকার কাটিয়ে যা শুভ, যা অন্তরাত্মাকে আলো দেয় তারই প্রতীক এই চোদ্দ শাক। এই আলো আসলে কার্তিক মাসের ভোরে শিশির বিন্দুর মত জীবনকে নরম, ভারহীন চাদরে জড়িয়ে রাখার মত জাজ্বল্যমান আলো, যা জলতেই থাকে। উৎসবের প্রাসঙ্গিকতায় যে আলো সারা বছর জ্বলতে থাকে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>