ইরাবতী ধারাবাহিক:ফুটবল (পর্ব-১) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
অষ্টম শ্রেণির দুই বন্ধু রাজ আর নির্ঝর। রাজ আর অনাথ নির্ঝরের সাথে এইগল্প এগিয়েছে ফুটবলকে কেন্দ্র করে। রাজের স্নেহময়ী মা ক্রীড়াবিদ ইরার অদম্য চেষ্টার পরও অনাদরে বড় হতে থাকা নির্ঝর বারবার ফুটবল থেকে ছিটকে যায় আবার ফিরে আসে কিন্তু নির্ঝরের সেই ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার পেছনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ঝরের জেঠু বঙ্কু। কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু ও তার ফুটবলার বন্ধু তীর্থঙ্করের বন্ধুবিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? সবশেষে নির্ঝর কি ফুটবলে ফিরতে পারবে? রাজ আর নির্ঝর কি একসাথে খেলতে পারবে স্কুল টিমে? এমন অনেক প্রশ্ন ও কিশোর জীবনে বড়দের উদাসীনতা ও মান অভিমানের এক অন্য রকম গল্প নিয়ে বীজমন্ত্রের জনপ্রিয়তার পরে দেবাশিস_গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন কিশোর উপন্যাস ফুটবল আজ থাকছে পর্ব-১।
অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। চারদিক সয়ে যাবার পর হালকা আভা ফুটছে। তাতে চোখ রাখলে মনে হচ্ছে জানলার বাইরেএকটা দুটো মূর্তি দাঁড়িয়ে।রাজ বালিশ আঁকড়ে পড়ে আছে ভয়ে।বুকের মধ্যে একটা মারাত্মক ভয় গ্রাস করছে। পাশে শুয়ে আছেন ছোটমামা।তাকে ডাকবার শক্তিও ওর নেই।
তিন-চারদিন আগেই পাড়ায় চুরি হয়েছে। জিতুদের বাড়িতে রাতে চোর ঢুকে সবকিছু নিয়ে গেছে। চুরির খবর শুনে সবাই দৌড়ে গেছিল।মা বারণ করলেও রাজ জিতুদের বাড়ি গেছিল। জিতুর ঠাকুমা অঝোরে কাঁদছিলেন।কাদঁতে-কাদতে তিনি চোরের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। চোর নাকি চুরি করার আগে একটা কিছু স্প্রে করেছিল। তাই বাড়ির কেউ টের পায় নি।
রাজের মনে সেই ভয়টাই এখন হচ্ছে।সে বিছানায় চুপ করে রইল। নাক বন্ধ করে রাখল।যদি চোরে স্প্রে করে সেই ভয়ে। বাঁ-হাত দিয়ে সে ছোটমামাকে একবার হালকা করে খোঁচা দিল। ছোটমামা যদি ওঠে তার সাহস বাড়ে।
ছোটমামার সাড়াশব্দ নেই।ঘুমিয়ে পড়লে তাকে ডাকা খুব কঠিন। তা জানে রাজ।একদম সাড় থাকে না ছোটমামার।
এখন অবশ্য রাজ অন্য কিছু ভাবছে না। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রয়েছে। চোরটা এখনো অন্ধকারে স্থির। তাদের বাড়ির পেছন দিক একটু জংঙ্গলমত। একটা-দুটো নাম না জানা গাছ রয়েছে।
রাজ চোখ স্থির করে অনেকক্ষন রইল। চোরের নড়াচড়ার কোনো লক্ষন নেই। আগের চেয়ে তার সাহস একটু বাড়ল। সে হঠাৎ ভেবে বসল, আচ্ছা! চোর কি এতক্ষন স্থির হয়ে বসে থাকবে? তার দেখার ভুল নয় তো?
আরো কিছুটা সময় কাটল। দেয়ালঘড়ি থেকে ঢং ঢং শব্দ বেজে উঠল।দুটো বাজল।রাজ অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়ত।ছোটমামার সাথে গল্প করতে করতেই অনেক সময় চলে গেল। গল্প বলার পর ছোটমামা দিব্যি ঘুমিয়ে পড়লেন।রাজের চোখে ঘুম এল না।
ছোটমামা নিজে না খেলাধুলা করলেও খেলার খবর বেশ জানেন। রাজ খেলার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী। সে মোটামুটি সব খেলাই খেলতে পারে। সে যখন ভাবে ক্রিকেটের কথা তখন ওর ইচ্ছে হয় বড় ক্রিকেটার হবার। ফুটবল খেলার কথা ভাবলে সে একইভাবে ফুটবলার হবার কথা ভাবে। পাড়ার মাঠে ফুটবল ক্রিকেট দুই খেলাই হয়। রাজ দুটো খেলাতেই সাবলীল। ইদানিং ফুটবলের উপর টান বেড়েছে।
আজ ছোটমামা তাদের সময়ের ফুটবলের কথা বলছিলেন। মোহনবাগান-ইষ্টবেঙ্গল-মহামেডানের কথা। ছোটমামা নাকি এক-দুবার ছোটবেলায় ষ্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গেছিলেন। সেইসব ম্যাচের বর্ননা দিচ্ছিলেন ছোটমামা। সেসময়ের নামকরা বড় বড় প্লেয়ারদের ছোটমামা চোখের সামনে দেখেছেন। গ্যালারি থেকে তাদের সঙ্গে নাকি হ্যান্ডশেকও করেছেন।
রাজের খুব আনন্দ হয়েছিল। সে জিজ্ঞেস করেছিল,“এখন তুমি খেলা দেখতে যাও না?”
“না রে। এখন আর সময় হয় না। যা হয় টুকটাক টিভিতেই দেখি। আমাদের সময় কি আর এখনকার মত টিভি ছিল? এখন তো দেশবিদেশের কত খেলা দ্যাখা যায়।“
রাজ বলেছিল, “ তা হয়। কিন্তু আমি দেখি না। মা কি টিভিতে ঘেঁষতে দেয়? খেলা দেখলেই মা বকে।“
ছোটমামা বলেছিলেন,“টিভি দেখিস না তা বলিস না !”
রাজ চুপ করে শুনেছিল। ছোটমামা কথাটা ঠিকই বলেছেন। মা শর্ত দেন। টিভি দেখার শর্ত। সারাদিন ভাল করে পড়লে তাকে মা কিছুক্ষনের জন্য টিভি দেখতে দেবেন। কিন্তু গন্ডগোলটা সে নিজেই করে ফ্যালে। সারাদিন সে কি যে ফাঁকি মেরে ফেলে ! তার ভাল করে পড়া হয় না। সে তাই এখন ঘাড় নাড়িয়ে বলেছিল,“সে অল্পস্বল্প।“
ছোটমামা বলেছিলেন,“কেন? এই তো কদিন আগে তুই আমি মিলে খেলা দেখলাম। ছেলেটার কি যেন নাম।ওই রোহিত বর্মা।“
“রোহিত বর্মা নয়। শর্মা।“
“ওই হল।“
রাজ মোটেই খুশী হয় নি। ছোটমামা ওর পেছনে লাগার জন্য বলেছেন। ক্রিকেটারদের মধ্যে তার প্রিয় খেলোয়াড় রোহিত শর্মা। তারও খুব ইচ্ছে করে ওইরকম ব্যাট করবার।তবে পাড়ার খেলায় বেশি ব্যাট করার সুযোগ ঘটে না। বেশিরভাগ সময় ফিল্ডিং করা যাচ্ছেতাই ব্যাপার।তার চেয়ে ফুটবল ভালো। সেখানে খেলার জায়গা আছে। সে বেশ ভাল দৌড়াতে পারে। স্কুলের ইভেন্টে নাম দেয়।এখন সে ক্লাস এইট। এখন আগের থেকে সে ভালোই খেলে। পাড়ায় খেলায় সে দুচারটে গোলও করতে পারে।
ছোটমামা ঘুমিয়ে পড়ার পর সে এসবই ভাবছিল। তার চোখে ঘুম আসছিল না। বরং সে কল্পনা করছিল একটা ফুটবল ম্যাচের কথা। তার পায়ে বল, সে দৌড়াচ্ছে। কেউ তাকে আটকাতে পারছে না। একটার পর একটা প্লেয়ারকে কাটিয়ে সে যখন বলটা জোরে মারতে যাবে তখনই জানলার বাইরে তাকাতেই সে চোরটাকে দেখতে পেয়েছিল।
এখন ভয়টা তার একটু কমেছে। চোর অনেকক্ষন ধরেই স্ট্যাচু। চুরি করতে এসে কি কেউ স্ট্যাচু হয়ে যায় ! কিছুক্ষণ সে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। একটু একটু করে এবার একটা বিষয় স্পষ্ট হল। সত্যিই চোরের কোনো হেলদোল নেই। তাহলে কি চোর নয়? রাজ ধীরে ধীরে তার মাথা তুলে সে তাকাল। একটু সামনে ওঠার পর সে বুঝল আসল কান্ডটা।চোর কোথায়? এতক্ষন সে খামোকা ভয় পাচ্ছিল। এতো নেহাতই একটা কলাগাছের পাতা! একটু হেলে পড়েছে বলে তার মনে হচ্ছিল অন্ধকারে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে! ভেবে তার নিজেরই হাসি পেয়ে গেল।সত্যি। সে ভয় পেয়ে গেছিল! হয়ত একটু পরে ছোটমামাকে সে ডেকেই ফেলত। নিজের বোকামির জন্য তার লজ্জা লাগল। সে প্রতিজ্ঞা করল এ গল্প সে মা বাবাকে বলবে না। তারা হাসাহাসি করবেন।তারা তাকে ভীতু ভাববেন।
আরো কিছুক্ষন বিছানায় এপাশ-ওপাশ করল রাজ। নানারকম কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
দেড় দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। ‘কাঠবেড়ালি’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘চার অঙ্গ’, ‘তিথির মেয়ে’, গল্পগ্রন্থ : ‘গল্প পঁচিশ’, ‘পুরনো ব্রিজ ও অন্যান্য গল্প’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বীজমন্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন।
বেশ টেনশন এ ছিলাম….