| 26 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১৫) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
কীচকের লাথি খেয়ে দ্রৌপদী যখন আছড়ে পড়লেন সবার সামনে, যুধিষ্ঠির প্রথমেই তাঁর দিকেই কঠোর চোখে তাকালেন। আরে! কী আশ্চর্য! কী কাপুরুষ লাগছিল তাঁর যুধিষ্ঠিরকে দেখে! নিজে নিরুপায়! স্ত্রীকে পাশাখেলায় পণ রাখতে লজ্জা হয় না লোকটার! অজ্ঞাতবাসের সময়েও এসে সেই পাশাই খেলছে আবারও। আর স্ত্রীকে সবার সামনে এইভাবে অপমানিত দেখে স্ত্রীর ওপরেই চোখ রাঙাচ্ছে! যুধিষ্ঠিরকে দেখে তাঁর মনে ঘেণ্ণা জন্মাচ্ছিল। তার পর যখন দেখলেন, ভীম রাগে কাঁপছেন, ঠোঁট কামড়াচ্ছেন, আঙুলগুলি মুঠো করছেন, তখন আবার পায়ের আঙুল দিয়ে ভীমের পা চেপে তাঁকে সংযত হবার ইশারা করলেন! হায় রে সভ্য নাগরিকের দল! বনের আইনে কেউ আর কিছু ভাবত না। কীচককে সবার সামনেই ছিঁড়ে ফেলত। কিন্তু এখানে তো ভাবতে হবে প্রতি মুহূর্তেই। রাজনীতির খেলা চলছে যে। সেখানে স্ত্রী বারবার অপমানিত হোক, ধর্ষিত হোক, সকলের সামনে তাকে লাথি মারা হোক; সব মেনে নিতে হবে চুপ করে থাকতে হবে। কিন্তু দ্রৌপদী তো ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন। তিনি বহুদিন আগেই বুঝে গেছেন তাঁর নিজের লড়াই তাঁকেই লড়তে হবে।
 
তাই যেমন বিরাট রাজাকে যেমন অভিযোগ কলেন, তেমন যুধিষ্ঠিরকেও ছাড়লেন না। 
“যাঁরা নাকি নিজেদের অপরাজেয় বলে গর্ব করেন, তাঁদের স্ত্রীকে সবার সামনে লাথি মারা হচ্ছে, আর তাঁরা নপুংসকের মতো বসে আছেন? তাঁদের রাগ, তেজ, আত্মসম্মান বোধ, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা কোথায় হারিয়ে গেল”? দ্রৌপদীর সেই সাহস দেখে, তাঁর কথা শুনে সভাসদরা ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। তখন যুধিষ্ঠির কী বললেন! “সৈরিন্ধ্রী, তুমি রাণী সুদেষ্ণার কাছে ফিরে যাও। তোমার গন্ধর্ব স্বামীরা নিশ্চয়ই এই অন্যায়ের প্রতিকার করবেন। কখন কী করতে হয়, তুমি তো বোঝই না দেখছি! তাই শৈলূষীব বিরোদিষি! নটীর মতো কান্নাকাটি করছ”! 
 
দ্রৌপদী ভাবছিলেন। সেই সভায় অপমানিত তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠিরের তীক্ষ্ণ শলাকার মতো কথায় বিদ্ধ হতে হতে অর্জুনের পায়ের মলের ঝঙ্কারও শুনতে পাচ্ছিলেন যেন! তাঁর চুল ধরে দুঃশাসন টানছে….. তা ধিন তা ধিনতা…..এবার তাঁর কাপড়ে টান পড়ল ….. তা ধিন তেই তৎ তা ধিন তেই তৎ….. কীচক তাঁর চুল ধরে টানতে টানতে সভায় আছড়ে ফেলছে….. তাকা দিগ তাকা দিগ তাকা দিগ, দ্রুত তালে বাজছে ….. এবার পা তুলল… তাকিত ধিগ তত্… অর্জুন নেচে চলেছে…. উলূপী চিত্রাঙ্গদা সুভদ্রা…… ! রাজনীতির মঞ্চে, পুরুষের নকল ভালোবাসার ভানসজ্জায় নাচের বোলে দ্রৌপদী একা ঘুরে যাচ্ছেন। তাঁর খোলা চুলের রাশি, কালো পোষাক এলোমেলো, ঘুরছেন। কে ধরবেন তাঁর হাত? এই একের পর এক অপমান থামানোর কেউ কি নেই? 
 
আছেন অবশ্য। একজন আছেন। ভুল মানুষকে ভরসা করেছিলেন তিনি। প্রাণের সবটুকু প্রেম সখ্য স্নেহ ঢেলে দিয়েছিলেন যাঁকে, সেই অর্জুন নয়। যাকে বুঝেও বোঝেন নি, যাঁর একান্ত ভালোবাসাকে অবহেলা করেছেন অর্জুনেরই প্রেমে, সেই ভীম। তিনিই তো সবসময় পাশে ছিলেন। সেই স্বয়ংবর সভা থেকে। দেখেও দেখেন নি। অর্জুনের মোহে।
 
অথচ এই অর্জুন যখন বনবাসকালে দেবতাদের কাছে চলে গেল দীর্ঘ দিনের জন্য, অস্ত্রশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে, তিনি কী কষ্টই না পাচ্ছিলেন। কেন তাঁর আর অর্জুনের মধ্যে বারবার দূরত্ব তৈরি হয়! কী আশ্চর্য ভাগ্যের খেলা। যাঁকে বেছে নিতে হবে স্বামী রূপে, পাঞ্চাল রাজার প্রতিশোধ পূরণের জন্য, যেখানে প্রেমের কোনও স্থান ছিল না; অথচ সেই অজানা অচেনা পুরুষটিকে দেখামাত্র তিনি সেই পুরুষটিকে যেন মনপ্রাণদেহ দিয়ে দূর থেকেই জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু পাকে চক্রে বিয়ে করতে হল পাঁচ ভাইকেই। যতই অন্যদের প্রতিও তাঁর খানিক টান থাকুক, অর্জুন তো ছিলেন আসল। অর্জুনের এক বছর দ্রৌপদীর সঙ্গে কাটানোর পালা আসার আগেই বারোটি বছরের জন্য হাস্যকর একটি প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য তাঁকে চলে যেতে হল। সেখানে তিনটি নারীর সঙ্গ করলেন তিনি। বাবাও হলেন। তাও উলূপী আর চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে তিনি কম কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু সুভদ্রা! তিনি তো ইন্দ্রপ্রস্থেই চলে এলেন। আর অর্জুনের ওপর সুভদ্রার হল সারা জীবনের অধিকার! মাঝে মাঝে অতি কূট অতি বিষাক্ত একটি সন্দেহ জাগে তাঁর মনে। এসব কৃষ্ণের চাল নয় তো! কৃষ্ণ কোনও ভাবে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট নন তো? সেই জন্যই সুভদ্রাকে টোপ রূপে ব্যবহার করা! তাঁকে সখী বলে সম্বোধন করলেও তাঁর যন্ত্রণা লাঘব করতে কবে কী করেছেন তিনি?

আরো পড়ুন:  একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১৪) । রোহিণী ধর্মপাল
 
কৃষ্ণের বেশ কিছু আচরণ তাঁর মনে সন্দেহ জাগায়। কৃষ্ণ অসম্ভব বুদ্ধিমান এবং তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা অতুলনীয়। তিনি নিঃসন্দেহে জানতেন ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসূয় যজ্ঞের বিপুল আড়ম্বর দেখার পর দুর্যোধন চুপ থাকতে পারবে না। এবং তাদের সাহস নেই ভীম আর অর্জুনের বিরুদ্ধে মুখোমুখি আক্রমণ চালানোর। তারা নিশ্চয়ই কূট কোনও উপায় নেবে। অথচ তিনি যুধিষ্ঠিরকে কোনও পরামর্শ না দিয়ে, কোনও আলোচনা না করে উধাও হয়ে গেলেন কতদিনের জন্য। আর দ্রৌপদীর ওই বীভৎস অপমানের কথা শুনে সত্যিই কতটা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি! সত্যি বলতে কী ভীম ছাড়া কাউকেই তাঁর অপমানের জন্য খুব বেশি ক্রোধ প্রকাশ করতে দেখেনি নি তিনি। ভীমই সরাসরি দুর্যোধনের উরু ভঙ্গ করবেন বলেছিলেন, কারণ দুর্যোধন অসভ্যের মতো নিজের উরু চাপড়ে দ্রৌপদীকে সেখানে বসতে বলেছিল! আর দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত খাওয়ার মতো ভয়াবহ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কারণ দুঃশাসনই দ্রৌপদীকে চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল আর কর্ণের কথায় তাঁকে বিবস্ত্র করতে গেছিল!
 
এই ভীমই আবার দ্রৌপদীকে কাঁধে করে নিয়ে গেছিলেন অর্জুনের সঙ্গে দেখা করাতে! মানে সবাই যাচ্ছিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির বলেছিলেন “কৈলাশ পাহাড়ে অর্জুনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া কৃষ্ণার পক্ষে অসম্ভব। সহদেবও নরমসরম। বরং তুমি এখানে এঁদের সঙ্গে থেকে যাও। আমি নকুল আর আমাদের সঙ্গে লোমশমূনি, যিনি এখানকার পথঘাট চেনেন, বিপদ আপদ সম্পর্কে অবহিত, এই তিন জন যাই”। যুধিষ্ঠিরের কথা শুনেই দ্রৌপদীর বুকের ভেতর জ্বলে উঠেছিল। এতদিন পর তিনি অর্জুনকে দেখার আনন্দে বিভোর হয়ে আছেন, আর ইনি যেতে দেবেন না! আশ্চর্য! একে তো খালি অর্জুনের সঙ্গেই তাঁর বারবার দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। নানা কারণে! তারপর এ কী মনোভাব। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার যে তাঁকে কিছুই বলতে হল না! ভীমই তাঁর হয়ে উত্তর দিলেন!
 
 “দ্রৌপদী এনিতেই দুঃখে বিষাদে কাতর, তিনি যাবেন না? তা কী করে হয়! রাজপুত্রী শ্রমেণার্ত্তা দুঃখার্তা চৈব ভারত! অর্জুনকে দেখার জন্য আপনার মতো তাঁর মনও কাঁদছে! আর আমি বা সহদেবও তো চাইব ভাইকে দেখতে। পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তায় রথ চলবে না, বুঝতে পারছি। আমরা হেঁটেই যাব। আর যেখানে পাঞ্চালীর হাঁটতে এতটুকু অসুবিধে হবে, আমি তাঁকে তুলে নেব। আর শুধু পাঞ্চালী কেন, প্রয়োজন হলে আপনাদেরও তুলে নেব। তবুও কাউকে ছেড়ে যাব না। দ্রৌপদীকে তো নয়়়ই”। দ্রৌপদীর কানে যেন মধুবর্ষণ হয়েছিল। আর অসম্ভব অবাকও হয়েছিলেন। স্বভাবতই পুরুষেরা প্রেমের ব্যাপারে যথেষ্ট ঈর্ষাপ্রবণ হয়। মেয়েদের উপর দোষটি বেশি চাপে, কারণ সপত্নী যন্ত্রণা মেয়েদেরই সহ্য করতে হয়। কিন্তু বিষয়টি যদি এতটুকু উল্টে যায়? দুর্যোধন কর্ণ, এমনকী যুধিষ্ঠিরের ঈর্ষা তিনি তো অনুভব করেছেন। সেখানে ভীম এইভাবে তাঁকে নিয়ে যেতে চাইছেন তাঁর প্রেমাস্পদের কাছে!!! নগরের এই জটিল জীবনে ভীম সত্যিই ব্যতিক্রম!
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত