| 3 অক্টোবর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: মাহী ওয়ে , ও মোর প্রিয় । মিতা দাস 

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

 

প্লাজমা টিভির পর্দাটি ধুলো দিয়ে ঢাকা ছিল।  একটি তেনা নিয়ে সেই ধুলো পরিষ্কার করে সে রিমোট নিয়ে চ্যানেলটি পরিবর্তন করতে চাইলো কিন্তু প্রচুর পরিমাণে অপশান ছিল, একটি বাজে গালাগাল দিলো, এই শালা চ্যানেল ওয়ালারাও বিভ্রান্ত করে তুলে । একটি সাধারণ জীবনেও বিভ্রান্তির ভিড়। হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন টা গুনগুন করলো… .. মাহি ওয়ে… .. মোহাবতাঁ সাঁচিও নে , মাঙ্গাতা নাসিবা  কিছু ঔর হ্যায়…। ভলিউমটি গজিয়ে উঠল, যেন সে মোবাইলের রিংটোনটি দমন করতে চায়। মোবাইল আবার বেজে উঠল কিন্তু সে তুললো না। সে রান্নাঘর থেকে রুটি এবং বাটার চিকেন তুলে আনলো । আবার মোবাইলে বেজে উঠলো সে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। “সে বিড়বিড় করে উঠলো সালা যত দুঃখজনক ব্যাপার হোক না কেন পৃথিবীতে তবে পেটেরও নিজস্ব ব্যথা আছে যার নাম খিদে ! 

মোবাইলটি আবার ঘ্যানঘ্যান করে উঠলো । এতো রাতে , ওর চিন্তা বেড়ে উঠেছে , এতো রাতে আবার কেরে ? মোবাইলের স্ক্রিনে একটি আননোন নম্বর ভেসে উঠল ।

 

—- “হ্যালো”

 

—- “তুমি কোথায় আছো আরোহ ?”

 

—- “কে – কে …… কে তুমি”

 

—- “আমি আরোহ ….. অবনী ….” কণ্ঠে ফিসফিস টোন জমে ছিল ।

 

—- “অবনী …… তুমি, কোথা থেকে এবং এখন কেন ?”

 

—- “এখন কেন ও ? এখন কোথায় আছো তুমি ?”

 

—- নিজের ফ্ল্যাটে , কিন্তু তুমি কীভাবে এবং কোথায় এই নম্বর পেলে ?”

 

—- “আমি তোমার বন্ধু কেশুর কাছ থেকে নিয়েছি”।

 

—-“কেশুর থেকে … আর কাউকে পাওয়া গেল না, তাকে কোথায় পেলে ?”

 

—- “অন্য প্রত্যেকে প্রত্যাখ্যান করেছে , ওরা আমায় তোমার ফোন ও ঠিকানা কিছুই দেয়নি ।”

 

—- “তবে এত বছর পরেও কেন তুমি আমার ফোন চাইছো ?”

 

—- ” তুমি কেবল প্রশ্নই করবে বা ফ্ল্যাটটি কোথায় তাও বলবে না ?”

 

—- “মুম্বাই”

 

—- “তুমি কবে এলে এখানে “

 

—- “এখন তুমি প্রশ্ন করছ না”

 

—- “তোমার কাছ থেকে শিখেছি”

 

—- ” ক বছর হয়ে গেল”

 

—– “সেকান্দ্রাবাদ থেকে বড়োদড়া, বড়োদরা থেকে মুম্বাই …. কত পালাবে ?”

 

—- “পালিয়েই বেড়াচ্ছি “

 

—- ” কতদূর ….”

 

— “যতক্ষণ না তুমি পিছু ছাড়ছো  “

 

—- “তাহলে তোমাকে অনেক দৌড়াতে হবে, ম্যারাথনে যোগ দিতে হবে এবং অভ্যস্ত ও হতে হবে”।

 

—- “হাস্যরসের অভ্যাস এখনো  যায়নি , সেই তুমি ! এখনো সেই “

 

—- “অভ্যাস কি কখনও যায় ? যেমন তুমি প্রতিটি প্রশ্নেই প্রশ্ন করবে এবং নিজের দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়াবে ।”

 

—- “আমি বরং বোঝা ছিলাম”, আমাকে বল , কেশু কে তুমি কোথায় পেলে ? “

 

—- “নাগপুরে .. যখন বিয়ের পিড়িতে বসার আগে পালিয়ে ছিলাম , নাগপুরের ট্রেনটি  স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল “

 

—- “তুমি বিয়ের পিঁড়ি থেকে পালালে কেন ?”

 

—- “তোমার সাথে দেখা করতে”

 

—- “তুমি আমার সাথে দেখা করতে ?কি করবে …. বাড়ি থেকে পালিয়ে ! একটি পলাতকের পিছু নিয়ে “

 

—- ” সে সব পলাতক – তলাটক আমি কিছুই জানিনা ।  মামলা মোকদ্দমার কিছুই জানি না …. আমাকে আরোহের মোহ এখানে টেনে নিয়ে এসেছে ।

 

—- “তার মানে তুমি মুম্বাইতে আছ?”

 

—- “হ্যাঁ …… আমি আছি !”

 

—- “কোথায় ? কখন ; কবে থেকে, কার সাথে ?”

 

—- “আর একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর, এতো প্রশ্ন একসাথে”

 

—“সমস্ত নেশা নিয়ে দিলি তো মাটি করে .. ছ্যা “

 

—- “একটি ফ্যাকাশে হাসি …… আরোহ” ……  কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরল ।”  কিছু আছে .এই নিস্তব্ধতায়….. তার মনে হয়েছিল যেন কেউ ধ্রুপদ গাইছে।”

 

“…….. আরোহ  ….. আমার হাতে সময় নেই।”

 

“অবনী ……. আসলে আমি মাতাল, মদ গিলে বুঁদ । মাথার ঠিক নেই , মাথাটা ঘুরছে । নেশাটা আজ একটু বেশি হয়ে গেছে কিনা ! বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা কি ?”

 

” তুমি  অনেক ভাবো, তোমার অভ্যাস এখনো যায়নি …..”

 

“আরোহ …..” একটি হাড় কাঁপানো কণ্ঠ, কেন সে আজো এই কণ্ঠের স্বর  ভোলেনি ?”

 

” আচ্ছা ….দূর হতে কোনো গুহা থেকে যেন এ আওয়াজ ভেসে আসছে ! সে সেই আওয়াজের পিছু – পিছু বেশ গড়িয়ে গেল । সে বেশ অনেকটা , তিন বছর ! কলেজের সেই মধুর দিনগুলো ভেসে উঠছে চোখের সামনে ……..

 ……” ধীরে – ধীরে  মস্তিষ্কের কোষ  থেকে একটি একটি দৃশ্য নেচে উঠতে লাগলো । প্রায়ঃ তিন বছর … দীর্ঘ দিন কলেজের সেই মধুর সোনালী দিনগুলি, মা , বাবুজি ও দুটি বোন ছিল, তবে কেবল পুরুষদেরই মানুষ  হিসাবে গণ্য করা হত। ওর বোন দুটি  ছিল না হবার মত , তবে সবসময় নয়, সে  সর্বদা নিজের বোনেদের বাবার কাছে শুধু বকুনিই খেতে দেখে আসছে বোনেরা ও বকা খেতে – খেতে নিজের আউডেন্টিটি টাই ভুলে বসেছিল যে ওরা ও মানুষ ।  মা ছিলেন, তিনি প্রায়ই বাবুজির নামে ভয়ে রান্না ঘরেই ঢুকে থাকতেন ।  বাবুজি ছিলেন ওখানকার কুমোর টুলির টি 0 আই 0 ( টাউন ইন্সপেক্টর ) বাড়িতে সবাইকে একটি জল্লাদের মত ভয় দেখিয়ে রাখতেন, যেন কেউ কোনো অপরাধ করেছে । ওর বিয়ের জন্য যুদ্ধ স্তরে মেয়ের অনুসন্ধান চলছিল, তবে সে বন্ধুদের নিয়েই মেতে  থাকতো । একদিন কলেজের ক্যান্টিনে এক মেয়েকে টেবিলে মাথা নিচু করে চায়ের চুমুক দিয়ে কিছু নোট লিখতে দেখল । অপূর্ব আকর্ষণীয় মেয়েটি, সে ওর টানে ও মোহ থেকে আর বাঁচতে পারলো না।

 

“আমি বসতে পারি” ….

 

“হ্যাঁ – হ্যাঁ কেন বসতে পারবেন না” …. হালকা হাসি ঠোঁটে চেপে মেয়েটি বলল। সে খুব আকর্ষণীয় ছিল, সে তো তার আকর্ষণে *চারো খানে চিত্ত * বাবুজীর বজ্রকণ্ঠ, দু বোনের ভয়ে কাঁপানো শরীর এবং মায়ের অসহায় চোখ এক মুহুর্তে সমস্ত অজানা মেয়েটির উপরে অর্পণ করে দিল । তারপরে সে প্রতিদিন আসে তখন সেই অচেনা মেয়েটি নোট লেখায় ব্যস্ত এবং চায়ের চুমুক দিয়ে মাথা উঁচু না করেই ওকে চিনে নেয় , এখন সে তার কাছ থেকে অনুমতি নেয় না, কেবল আস্তে আস্তে চেয়ারটি সরায় এবং মেয়েটির লেখার সময় চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকে । মেয়েটিও চুপ করে থাকত, কেবল তার দিকে তাকিয়ে এবং তারপরে মাথা নত করে নোট লিখত কখনো – কখনো জখন সে ক্লান্ত হয়ে মাথা তুলত, সে ওর দিকে তাকিয়ে দেখত এবং তারপর কিছুটা হাসি মুখে আবার লিখত। একদিন অরোহের পিঠে এক বন্ধু একটি হালকা চড় মারল এবং জিজ্ঞাসা করল, “কি হচ্ছে রে ? থানাদার জানেন তো ?” আরোহ হতবাক হয়ে গেল। একবার মাথা তুলে মেয়েটির দিকে তাকাল এবং তার নোট নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে উঠল যেন কিছুই হয়নি ! আরোহ লজ্জায় ডুবে গেল । লজ্জা মেটাবার জন্য টেবিলে আঙ্গুল দিয়ে তবলার তেড়ে কেটে ধিন বাজাতে লাগলো । 

 

—–দয়া করে যোগাযোগের নম্বরটা দেবেন?

—– কার?

—– “আপনার” 

—– “কেন”?

——– “জাস্ট , বন্ধুত্ব করার জন্য “

 

——– ” আমি ইন্ট্রাস্টেড না , কিন্তু আমি জানতে চাই, এই থানাদার টি কে ?? ও উনাকে নিয়ে কি রকম ফেচাং ” এক টানা মৃদু হাঁসি তার মুখের ওপর অনিচ্ছাকৃত খেলা করে গেল | মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুলে গিয়েছিল। মেয়েটি তার নোট সংগ্রহ করে উঠে পড়ল। আরোহের তন্দ্রায় বিঘ্ন পড়ল , বলে উঠলো প্লীজ ..প্লীজ ।”

 

— “এখানে কোন লাভ নেই, এই দিকে কারাগার মানে জেলার  উপস্থিত ।” হাসি এত মারাত্মক ! আর সে  ভাবলো, সে কি তাহলে থানাদার এর অর্থ বুঝে ফেলল ?

…. ” জেলের সিক কেউ – কেউ কেটে ফেলে ” আরোহ বললো 

 

——- “আর থানাদার ? সে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয় !” তারপর একই হাসি ।

 

               প্রক্রিয়াটি শেষ না হওয়ার পথে শুরু হয়েছিল। কখনো ক্যান্টিন, কখনও গ্রন্থাগার, কখনো কখনো বোটানিক্যাল গার্ডেনে , সিনেমা হলে ওদের ভালোবাসার ছবি ও চিন্হ দেয়ালে , বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল । তবে ভালোবাসা আর ভালোবাসার কথা কি আর  লুকিয়ে থাকে ?অবনীকে বাহু ধরে অভয় প্রায় বাপের সামনে টেনে নিয়ে এসেছিল।

——- ” প্রহরী রাখো বা বন্দি কোরে রাখুন ,দেখুন বুলবুল কী ভাবে চোখে চোখ চার করা নিয়ে ব্যস্ত ।” ছেলে ও বেছে নিয়েছে জাতির বাইরে । নিজের জাতের পাওয়া গেলনা … ছ্যা- ছ্যা ।”

 

——– “কাউন জাত বা “

 

——– “মাচ্ছিমার ” বাপ থানাদার, গ্রাম সুলতানপুর “

” ব্রাহ্মণ বংশ কা নাম হী মাটি মা মিলা দী , ইসকী মাইয়া ( মা ) কো হী পড়ি রহী আরও বেশি পড়াতে তভী আচ্ছা দুলহা মিলেগা । যদি মেয়েটি সুশিক্ষিত হয় তবে বর খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হবে না, তবে এত নির্দেশনা সত্ত্বেও, নয়ন  মটক্কা করছিল , আর  আপনি অভয় ভাইয়া আপনাকে এর পাহারাদারের ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল ? তুমি না ভাই ? এত বড় ক্ষতি কী করে কোরলে বাপু ? “তারপর অবনি কে  জানি অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছিল সেই সব কথায় বর্ণনা করা মুশকিল।

 

        চার মাস পরে, খবর এল যে অবনী’র বিবাহ , ছেলে আই এ এস এবং গোয়ালিয়র পোস্টিং । আমি রেলের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছুক, কিন্তু মা ও বোনের চেহারা গুলি চোখের সামনে ভেসে উঠল । তাদের দুশ্চিন্তা ওর পা বেঁধে  দিল। ভাগ্য ওকে হায়দরাবাদ এ পৌঁছে দিলো সে এসেই স্টেশন থেকে কেশু কে ফোন করেছিল। কেশু বলেছিল – “আজা রে আরোহ , আমি এখন সেকেন্দ্রাবাদ আছি, তুই  ওখানে থাক আমি তোকে নিতে আসছি।” এখানে এসে তার শৈশবের সহপাঠীর কাজের খবর এখন জানতে পেরেছি  যে সে একজন সাজানো কুটিল মানুষ এখন। আজকাল এখানে অনেকগুলি মদের বার এবং মাদকের ব্যবসা রয়েছে কেশুর । সে অনুভব করেছিল যে সে এখানে এসেছিল কি ধরণের একটি সমস্যায় নিয়ে আর সে আটকে আছে অন্য একটি সমস্যার মুখে ।কেশুকে থামতে বলল , “আমার সাথে ব্যবসা কর , মস্ত উপার্জন কর আর আয়েশ কর “।  কিছু দিন মন মরা হয়ে কাটিয়ে সে নতুন চাকরীর অজুহাত দেখিয়ে আবার পালিয়ে গেল বডোদরা আর এমনকি সেখানেও থাকেনি সে , কিছু ভুলেতে  পারেনি এবং তারপরে সেই স্বপ্নের শহর মুম্বাইয়ে পালিয়ে এলো  …. হঠাৎ এত দিন পরে এই ফোন ! উফ… মারাত্মক, বেদনাদায়ক একটি মাকড়সার জালে আটকা পড়া পোকামাকড়ের মতো ঝাঁকিয়ে তুললো ওকে। যতটুকু আটকাতে চাইল ধরা তো পড়লোই ।

 

“কোথায় হারিয়ে গেলে আরোহ তুমি কোথায় …..? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। …..” এসো ….. না, আমার কাছে এখন খুব অল্প সময়  “

 

“বলো কোথায় আসবো ?”

 

“কামাঠিপুরা …. রাস্তার নম্বর – আট , খোলী নম্বর – 586, তুমি কখন  আসবে ?”

 

“ওহহহ … শুধু এই বলতে পারলো সে ।”

 

 সবাই বাঁচতে চায়, কেউ মরতে চায় না। সমাজ জীবিত মানুষের জন্য তৈরি, মৃতদের জন্য নয় । সমাজে বেঁচে থাকার জন্য কিছু নিয়ম রয়েছে, অন্যকেও বেঁচে থাকার অধিকার দিতে হবে , একে অপরের দুঃখ-কষ্টের অংশ হতে হবে। এই বিষয়টি প্রায়ই মনে রাখতে হবে, আমাদের বেঁচে থাকার কারণ কেউ মারা যায় না যেন ! এই কথা মনে আসার সাথে সাথে আরোহ গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে পড়ল । তাঁর খালি পেট খিদেয় তোলপাড়  করছিল এবং জেন্টলম্যান জ্যাকের আসক্তি ও নষ্ট হয়ে গেছে। হঠাৎ, তার মাথা বিস্মিত, কিন্তু সে নিজেকে সমর্থন করে। চান্দিভিলি থেকে কামাঠিপুরা পৌঁছতে প্রায় পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন মিনিট সময় লাগে তবে আজ কয়েক শতাব্দী ধরে এই দূরত্ব সে অনুভব করছিল। অবনী কেন তাকে ডাকছে , তার স্বামী, বাড়ি ! সে এখন তার কাছে কী চায় , ভাঙা  জীবন ! আরোহ কে  ভাবিয়ে তুলেছে …. মিথ্যা কথা কেশুকে বলেছে, কেশুর লকার থেকে সে চুরি করে টাকার বান্ডিল নিয়ে , মুম্বাইয়ে পালিয়ে আসা সব গোটা পথে তাকে তাড়িয়ে তুললো …. কত পালাবে , কার – কার কাছ থেকে পালাবে … পালানোর ও একটা সীমা আছে তো ! আরোহ গাড়ি চালাচ্ছিল তাই বাঁ হাত দিয়ে নিজের মেরুদণ্ড চেপে ধরতে লাগল, সে বড় দুঃখ পেয়েছিল। যন্ত্রণা চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল, তার বন্ধু হিসাবে কেশু তার জীবনে বেশ ছিল। কিন্ত বরোদায় আসার পরে রাবিয়া অর্থাত্ বাড়িওয়ালার মেয়ে গাায়ে  ঝুুুলল , তাই সেখান থেকে ভাড়া না দিয়েই সকালে – সকালে জিনিসপত্র গুলি ছেড়েই পালিয়ে এসেছে । এই সব ঘটনা গুলি ফিল্মের মত জল – জল করে তার সাথে চলছিল, চোখ উজ্জ্বল হেডলাইটের মত জ্বলছে ও নিভছিলো । টেনশন  ও ফ্রাস্টেশনে  সমস্ত স্মৃতি  ভাঙচুর হতে লাগলো । উত্তেজনা ও হতাশায় ভুগলে ও অবনী সম্পর্কে সে কিছু ভাবতে পারছে না। দূর থেকে  কামাঠিপুরা উজ্জ্বল ও বর্ণময় আলো বাদে রঙ ফুটে উঠতে শুরু করল। রাস্তার 8 নম্বর… কোথায় সন্ধান করলো , সে কেবল ভাবছিল যেই গাড়ীর কাঁচ নীচে করলো জায়গাটা কোথায় জিজ্ঞাসা করার জন্য , তিন – চারটে মানুষের গলা ওর  কানে এলো চারপাশে ঘিরে রেখেছে ওরা … “ও চিকনে , চলতা ক্যা ?” একটি বড় আপত্তি জনক গালাগাল ওর কানে প্রতিধ্বনিত হল সে চট করে কারের কাঁচ তুলে দিলো । 

 

 দরজায় নক করে,  আস্তে করে দরজা ধাক্কায় , সামনে অবনী, যাকে হালকা অনাবৃত দেখাচ্ছিল, সে তার অবনী ছিল না, সে কোন গ্রহের কোনো অন্য প্রাণি তাকে সে জানে না, বিবর্ণ, বেজার , গন্ধ সম্ভবত সস্তা অ্যালকোহলের গন্ধ বা ড্রাগের দোকান থেকে ভেসে আসা দুর্গন্ধযুক্ত, সমস্ত আশাক – পোশাক ময়লা ছিল।

 

“এসো আরোহ … অনেক দেরি হয়ে গেছে, সময় খুব কম, এখানে এসো,  দেখ আমার একটা কাজ করে দেবে  … শেষ বারের জন্য।”  সে বেশ নিচু সুর ও স্বরে কথা গুলো বলছিল। আধ ঘুম এবং স্তম্ভিত বুকে প্রতিটি শব্দ রেকর্ড করছিল, তার ঘুম ভেঙে গেল যখন একটি জোরে কান্না শুরু হল এবং তার সাথে একটি ধপাস শব্দ  হল…। দেখে অবনী অজ্ঞান হয়ে পড়েছে তার কাছেই মাটিতে । সে ওকে ঝাঁকিয়ে তুলল ।  …. “অবনী তোমার চেতনা তে  ফিরে এস … অবনী …… এস . …এস …এস” সে বিড়বিড় করে উঠল ।

 

 …. “কেশুর লাশ .. ওই ঘরে …..” অবনীর কণ্ঠ স্বরে একটু কম্পিত ভাব অনুভব করল আরোহ , এখন তার নেশা ও ঘুম উধাও ।

 

 …… “কি বলছো … কেশু আর এইখানে … এই কামাঠিপুরায় ?”

 

 …. “তুমি কি এখনো অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করো ? …. কারও কাছ থেকে আগুনের সন্ধান করা যেতে পারে, তবে জীবনের শিখা বাঁচিয়ে রাখতে রোম্যান্টিক সম্পর্কের ও দরকার হয় বা বলা যায় এই নিভে যাওয়া শিখাটির যা দরকার কেশু কি তা দিতে পারে ?  … সে চলে গেছে, এখন আমি ও চলে যাবো। “

 

  ….. তুমি একি বলছো ? ” আরোহ চিৎকার করে উঠল, তার চিৎকার শুনে অন্য খোলির দেয়ালের দরজা গুলিও নড়ে উঠল । 

 

 ……. “ইধার কি গোলমাল করতা হ্যায় ? নাসীন ?” এই ছিল রুকমার কন্ঠ স্বর । 

 

 …….. “খুব দেরী হয়ে গেলো যে শেঠ ? …. … কোনো কথাই কানে নিতো না এই বেশ্যা টা , বিশ্বাস করল না আমার কোনো কথা , এই কুষ্ঠরোগিটি কে জীবনের জঞ্জাল বানিয়েছে, এখন মরতে বসেছে ” …. শুধু সে অবনির নাকের কাছে হাত নিয়ে ওর নিঃস্বাস – প্রশ্বাস দেখলো । আমি যখন ওকে নিজের খোলী থেকে বাইরে ফেলে দিয়েছিলাম কি দরকাটাই ছিল একে ঘরে তোলার ।  “হায় রাব্বা …. মুস্টন্ডা  শেষে ওকে

গিলে ফেলেছে যে , যখন আমি তাকে তার বাচ্চা থেকে টানলাম, তখন সাপকে তার হাতে রাখার দরকার কী ছিল? কাছের বা আত্মীয় কেউ ছিল না কাছাকাছি ও নয় | খালি – পিলি ফোকটে অ্যাশ মাঙ্গাতা , বিন্না আমরাও লখনউএর , আপনি হলেন কুষ্ঠরোগি , আপনি নিজের রোগ নিজে বহন করুন, আমাদের মাথায় ফেলবে না। “রুকমা খালিস ইউ.পি.-র ভাষায় নেমে এল । এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইল আরোহ । তাকে এমনিভাবে তাকিয়ে রইল যেন সে ওকে বলছে, আমাকে পুরো গল্পটি বলবে না, অবনী তো ওকে মাঝপথে একলা ছেড়ে চলে গেল ।

 

……. “সারা বছর ধরে, সেই ঘৃণ্য, কুষ্ঠরোগিটি আমার দরজায় পড়ে থাকত যখন আমি ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতাম , সকাল  পর্যন্ত সে বারান্দায় পড়ে থাকত । যখনই চৌকিদার সকালে ডান্ডা মেরে মেরে তাড়াবার জন্য আসত, সেই তখন এই চাকলার মহিষ এই নেকড়ে কে তুলে রাস্তায় ফেলে আসতে বলত । ওহে এই মানুষ, প্রচুর অর্থ ও কোমল হৃদযের মানুষ , পণ আপুন ভী ধাঁধা ওয়ালি কাহা কারিনা বাই বনেলা আপুন কো ইধার জিন্দা ও সুবাহ কো মূর্খের মতো  ইদরিচ মরনে কা ।  দেহের ময়লা ধুলো জাতা পণ মনের ময়লা ? নামলে ও কি সম্মান হয় ? “

…….. নীরবতা … আর দেরি করো না গো শেঠ , আমি দেখছি  দরবান কে ফোন করে এদের লাশ সরিয়ে দেবে। যান না শেঠ আব্বি …. এক্ষুনি ! “

 

  ……. আরো বলো না?” সজল নয়নে রুকমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ।

 

 ……… এর সন্ধানে কয়েকবার এসেছিল, মেরেছিল, ধাক্কা দিয়েছিল এবং বলেছিল যে সে একজন মালদার ব্যক্তি, নাসীন ইদর হি জিস্ম বিক্রি করে। এই ভাবে সে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল এবং কাঁদছিল । দু’বছর ধরে মহিষটি বেশ মাল লুট করে নিল। আপনি জানেন, তিনি কোথাও থেকে খবর পেয়েছেন যে কামাঠিপুরা, নালাসুপারা, গ্রান্ট রোড, ঘাটকোপার কেউ কি দেখেনি, তিনি পুরো জায়গাটা অনুসন্ধান করে ঘুরে – ঘুরে জানতে পেরেছিলেন যে অবনী এখানেই আছে , প্রতিটি খোলির দরজায় কড়া নাড়লেন এবং এক দিন অবনী কে দেখতে পেলেন আমার ঘর থেকে বেরোতে বাস ….কিন্তু নতুন – নতুন ধান্ধাবাজ মেয়েরা তাকে পূরো চুষে নিয়ে ভিখিরি করে ছাড়লো । একদিন তিনি জানতে পারলেন যে তিনি এইডসে ভুগছেন । তিনি আমার খোলী থেকে নাসীন কে বেরিয়ে আসতে দেখলেন, তারপরে তিনি প্রতিদিন আমার দ্বারে বসে থাকতেন, বমি করার সময় তিনি কিছুই বুঝতে পারতো না যে উনি এখন কার দরজায় । প্রস্রাব করে বমি করে। মহিষটি প্রহরীকে ফোন না করা পর্যন্ত আমার আপত্তি নেই। একদিন নাসীন আমাকে বলেছিল, “আমি অবনী”, আমি বলেছিলাম, এত দিন ওকে কেন নির্যাতন করা হচ্ছে রে হারামজাদী , নাসপিটি । সে বলল এ আমার কেউ না ।

বলিস কি রে ? আমার চোখ দুটি বিস্ময়ে  ফেটে পড়ল ।

 …. হ্যাঁ সে অরোহের বন্ধু, যখন আমি আমার স্বামীর সাথে ব্রেকআপ করলাম মানে বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে পালিয়ে এলাম তখন আমার সাথে ওর দেখা নাগপুর স্টেশনে ।  তিনি আমাকে ওখানে থামার জন্য বলেছিলেন, আমি তাকে খুঁজে দেব । তার সাথে গেলাম , তবে তার বাড়ি ঘর জমজমাট তার লম্পট বন্ধু , ছেলে চক্রদের দল । আমার সাথে কেশু কখনও কোন বাড়াবাড়ি করেনি, সে বন্ধুর বন্ধু ছিল, কিন্তু তার লম্পট বন্ধু ও ছেলে ছোকরা দের লালসার চোখ আমাকে বিরক্ত করেছিল। অনেক সময় গড়িয়ে গেল তিনি  আরোহের ঠিকানা এবং ফোন নম্বরও দেননি তখন আমার বিশ্বাস অবস্বাসে পরিণত হয়ে গেল , তারপর এক দিন আমি মুম্বাই চলে এলাম পালিয়ে । বলতে – বলতে রুকমা  হাঁপিয়ে উঠেছিল ।

 ….. হে শেঠ নাহলে তুমি সমস্যায় পড়বে, আমাকে ছাড়া আর  কেউ আপনাকে দেখেছে বলে মনে হচ্ছেনা , যাও …. চলে যাও .. “

 ….. “আমাকে পুরোটা বলুন না……”

 ….. “একদিন নাসীন জোর করে কেশুকে ধর্ষণ করেছিল।”

 …… “কি? সে কথা বলতে পারল না, কথাগুলো ওর গলায় আটকে রইল ….. 

….. “হ্যাঁ সে বলল কেশু কে বলল আপনি যদি ওর নম্বর ও ঠিকানা টা না বলেন, তবে আমিও বেঁচে থাকব না, আমাকেও আপনার সাথে মরতে দাও, এখানে মুম্বইয়ে, আপনার পরে আমার কী হচ্ছে বা কি হবে কেউ জানবে না, যখন আপনি আরোহের ঠিকানা দিতে পারবেন না তাহলে একা – একা আমার ও বেঁচে থাকায় কোন লাভ নেই ।”

 …… ”সে কয়েকদিন দেখাই যায়নি , অনেকদিন পরেও সে এলো শুকিয়ে কাঁটা হয়ে গিয়েছিল  , সে জানত না , বলল -“ রুক্কো ওকে বলুন আমি তাকে আর জ্বালাতন করব না, মরে যাওয়া টা কি এতই সহজ ! কত পাগল সে , কত অবুঝ ? , আমার বন্ধু সে , আমি বেওফাই করতে পারি না । তবে সে বিশ্বাস করে না যে সে আমার সাথে মরতে চায়, সে আমাকে আঘাত করতে চায় কারণ সে জানে আমার বন্ধু কোথায় হারিয়েছে বা আমি তাকে হারিয়েছি তা জানেনা। সত্যি বলতে, যেদিন সে আমার অর্থ চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিল, সে আমার জন্য মারা গিয়েছিল, কিন্তু যেদিন অবনি কে দেখলাম  আমার প্রেম অরোহার জন্য  উথলে পড়ল , সে আমার বন্ধু , আমাদের বন্ধুত্ত  হ’ল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। তবে আমি এত বড় মুম্বাইতে কোথায় খুঁজে পাব, না ফটো , না ওর কোনো ঠিকানা আমার জানা !  অবনী আমাকে ভালোবাসেনি, সে আমার শরীরকে তার জীবন হত্যার উপায় হিসাবে তৈরি করেছিল। সে  জানত আমার এইডস ছিল এবং এটি শেষ পর্যায়ে। আমার অবনীও আমার মতো মারা যাবে। আজ আমি অরোহের ফোন নম্বর পেয়েছি, সে খুশি হবে তবে কত বছর, কত মাস বা কয় দিন এই সুখ তার জন্য তা জানা যায় না? ” গভীর নীরবতা … কিছুক্ষণের জন্য পুরো খোলির দিকে তাকিয়ে থাকল।

…… “আমরা আমাদের কষ্ট , ক্ষত , খইনি, দুঃখ-বেদনা, রোগ, সমস্ত কিছু ভাগ করি আপসে ।  লোকেরা উঠে সব জেনে যাবে …. যাও শেঠ … যাও এবার । “

মানুষের একাকীত্ব একটি বেদনাদায়ক সত্য, একাকীত্বের সাথে লড়াই করে এমন একজন ব্যক্তিই জানেন যে তিনি একাকীত্বের মধ্যে কতটা বেদনাদায়ক  দিন ও প্রহর একাই কাটাতে হয়।  নিঃসঙ্গতার ছায়া তাদের এমনকি রাতে ঘুমাতে দেয় না এবং একটি সুর অনুরণিত হতে থাকে ও থাকবে…… ”

 ….. মাহি ওয়ে … মাহি ওয়ে ….. সাঁচি মাঙ্গাতা  নাসিবা কুছ ওর হ্যায় ….

অসি  কিসমত দে মারে , অসি কি করিয়ে . . .   কিসমত পে কিসকা জোর হ্যায় । মাহী ওয়ে  …. ,ইক তরফ ইশক হয় তানহা … তানহা ….মাহী ওয়ে!

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত