ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১৪) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
পাড়া
আমাদের পাড়ার নাম ছিল কদমতলা। কোন কদমগাছের অস্তিত্ব কখনও চোখে পড়েনি।বড়সড় একটা আমগাছ পুকুরের ধারে শরীরের একটা দিক হেলিয়ে দিয়ে,বাকি দিকটার পা মাটিতে রেখে দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকত।তার ছায়ায় ছেলেরা ডাংগুলি খেলত।আমরা খোলামকুচির গোল ঘুঁটি নিয়ে,মাটিতে দাগ কেটে,কিত্কিত্ খেলতাম।
পাড়া-র উত্তর দিকের মোড়ে ছিল সত্যদির বাড়ি। সে আমাদের পাড়ার আপার প্রাইমারি স্কুলে ময়দার বিস্কুট বেচত।আর কী কী করত জানিনা। তার বাড়ি পেরিয়ে খানিক গেলেই মন্দিরতলা । অন্য পাড়া।
দক্ষিণদিকের রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদিকে মুদির দোকান, এগোলে গঙ্গা নদীর ঘাটের পথ। অন্যদিকে রাস্তাটা ঘুরে লাল্টুদের বাড়ির পাশ দিয়ে বটতলায় পৌঁছেছে।আমাদের পাড়া-র পূর্ব দিকে গঙ্গা, পশ্চিমদিকে পুরনো জমিদার বাড়ির বিশাল বিস্তার। সেই বিরাট বাড়িটা একাই একটা অন্য পাড়া ।
ভূগোল বইএ সীমানা নির্দেশ করতে শেখার পর আমি বুঝেছিলাম ,দুটো বড় পাড়া-র মাঝখানে আমাদের পাড়া-টা টিঁকে আছে তার অল্পস্বল্প অবয়ব,ঠাসাঠাসি মানুষ আর হারানো গল্প নিয়ে। আমাদের পাশের অন্য দুটো পাড়া-য় জাঁকজমক করে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়, দুর্গাপুজো হয়। আর আমাদের পাড়া-র সারাবছরে একটাই পুজো, তা হল সরস্বতীর বন্দনা ।
মনে ভাবতাম আমরা খুব সৌভাগ্যের অধিকারী।কেননা পাড়ার দুটো মাঠের মধ্যে যেটি আয়তনে ছোট, সেটি আমাদের বাড়ির সামনে, আর সেখানেই এসে বসেন তিনি, শ্রী পঞ্চমীর আগের রাতে।প্রতিবারই রাতদুপুরে বাঁশ আর চট এনে তার ঘর বানায় পাড়ার ছেলেরা। সেই সামান্য ঘরে তিনি নিঃশব্দ চরণে আসেন আর চারপাশ আলো করে অধিষ্টিত হন তাঁর বেদীতে।
আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১৩) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
তখন আমরা ছোট, তাই আমাদের ঘুমোতে যাওয়া রাত নটায়।তার আগেই রাতের খাওয়া সারা।রাতের সেই দেবী আগমন দেখার জন্য জাগার ইচ্ছে থাকলেও, হুকুম নেই। পুজোর দিন সকালে উঠে আমাদের একটাই কাজ, বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত যাবার চাপা গলি পেরিয়ে একছুটে সেই দরজার খিল খোলা। তখন একটা ম্যাজিক হবে আমরা জানি। দরজার সামনে রাস্তা,তার ওপারের ওই ছোট মাঠে একদম সাধারণ একটা প্যান্ডেলে বসে থাকবেন তিনি। সেই অলৌকিক বীণাবাদিনী।
আমাদের পাড়া-র গল্প আমার কাছে এভাবেই শুরু, যা এখনও চলছে। আসলে ওই ছোট্ট পাড়াটাতেই তো আমাদের বড় হয়ে ওঠা। চোখের সামনে একটু একটু করে চেনা ভুবনকে পালটে যেতে দেখা।পাড়া-র মোড়ের একমাত্র টিউবওয়েলটাকে কর্পোরেশনের টাইম কল হতে দেখা। কিংবা রাস্তার আলো জ্বালানোর লোকটাকে ভ্যানিস্ করে, সেই আলোটার নিজে নিজে প্রতিদিন সন্ধ্যায় জ্বলে উঠতে দেখা।
মনে আছে সকাল বেলায় দুধ রুটি খেয়ে বাড়ির লাগোয়া প্রাইমারি স্কুলে পড়তে যেতাম আমরা ।আর স্কুলের শেষে বাড়ি ফিরে চান খাওয়া সেরে মিছিমিছি চোখ বুজে ঘুমের ভান করতাম। নিঝুম দুপুরে মা কাকিমারা দিবানিদ্রা দিলে, আমাদের মত অনেক বাড়ির সদর দরজার খিল নিঃশব্দে খুলে যেত। পাড়া-র ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভরদুপুরের অভিযান শুরু হত নিজেদের পাড়ার পুকুরপারের আমবাগানে, বা অন্য দিকে পুকুরের ধারের পথে হেঁটে পুকুর পেরিয়ে বা রাস্তা পার হয়ে একেবারে অন্য পাড়ায়।নিজেদের পাড়ার সীমানা ডিঙিয়ে ধুলোপায়ে কোথায় না কোথায় যেতাম আমরা।
পাড়ার প্রসঙ্গে এসব কথা এইজন্য যে নাহলে পাড়ার অভিভাবক প্রসঙ্গে আসা যাবেনা । ছেলেধরার ভয় দেখিয়ে এইসব ছেলেমেয়েদের কখনোই আটকানো যায়নি। তারা একমাত্র ভয় পেত পাড়াতুতো অভিভাবকদের।বিভিন্ন বয়সের সেসব অভিভাবকেরা রীতিমত শাসনের অধিকারী ছিলেন।দুষ্টুমী সেরকম মাত্রার হলে এমনকি মারধোর করার অধিকারও প্রত্যেকের বাড়ির উদার অভিভাবকেরা দিয়ে রাখতেন।
সেসময় ওটাই ছিল খুব স্বাভাবিক।দুপুরবেলা সদর দরজা আধভেজা করে আমি উঁকি মারতাম।সামনের রাস্তার ওপারের বাড়িতেই থাকত আমার প্রিয় বন্ধু।সেও জানলা আধখানা খুলে তার মুন্ডু বার করত।কখনও কখনও সেই বন্ধুর বদলে তার দাদার মুন্ডুটি দেখা যেত।সেদিন সেই দাদা, যে আমাদের চেয়ে মোটে পাঁচ ছ’বছরের বড়, আমাকে দেখে ফেললে ধমকে বলত, “কিরে,কী করছিস ওখানে? বাড়ি যা,নাহলে গাঁট্টা খাবি।”
আমি ভয়ে বাড়িতে ঢুকে যেতাম, আর আমাদের অভিযানের সেদিনের মত ইতি ঘটত।

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।