জীবননামা
যাচ্ছি কোথায় সঠিক জানি না তবু,
জীবন আমার যাচ্ছে যাবেই চলে
নিজের পাঁজরে সজোরে আঘাত দিয়ে
জেগে বা ঘুমিয়ে, স্বপ্নের কথা বলে।
নিয়ত শ্রমে জমেছে ঘামের জল
ঢেলেছি কিছু তা বিষবৃক্ষের গায়ে
ভুলের ঘরাও ভরেছি মুহুর্মুহু
জোছনা জড়িয়ে মুমূর্ষু দুই পায়ে।
তোমার কাছেও গিয়েছি কতেকবার
জড়িয়ে নিজের ঋজুতার আবরণ।
কখনো ঠেলেছো, কখনো দিয়েছ ঠাঁই
কিছু ভালোবাসা আর কিছু প্রয়োজন।
তবুও আমার মগজের ভাজে ভীড়,
কাউকে দূষী না, নিজের ভেতরই কাদা।
ইবলিশ আর আদমের চলে লড়াই,
সংসার জুড়ে মায়ার খোলসে ধাঁধাঁ।
সাফল্য যত হয়েছে মাথার তাজ,
ব্যার্থতাগুলো বেজেছে কাঁটার মতো
হিসেবের শেষে গুনে দেখি সঞ্চয়,
গুটি কয় মুখ, আর কিছু প্রিয় ক্ষত।
কর্ম হয়েছে, ধর্ম হয়েছে তবু
আসলে কারোই নই আমি ঠিকঠাক
মর্মে যখন নিগূঢ় সত্যি বাজে
একলা মানব, নিঃস্ব হয়েই থাক।
নিজেকে বিলিয়ে জগতের ছাঁচে চলা
হয়নি আমার, হবারও কারণ নাই
শবের দুঃখে, কাফন কাঁদে যেন,
আমার শুধু তেমন মৃত্যু চাই…
শেষ চিঠি
তুমি ছাড়াও আমি দিব্যি বাঁচতে পারতাম…
পৃথিবীর আলো বাতাসে নিজের ভাগ ছেড়ে দিয়ে
চলে যাবার কোন ইচ্ছে আমার একদমই ছিলো না।
আমারও ছাদের টবের বেলি গাছটার জন্যে মায়া ছিল।
অসময়ে চায়ের কাপে চুমুক আর একটা যাচ্ছেতাই
কবিতার জন্যে মন কেমন করা দুপুর ছিল।
ফুল তোলা চাদর আর পল্কা ডটের স্কার্ফ জুড়ে
ছড়িয়ে থাকা, নিজের গন্ধ, আমার প্রিয় ছিল…
তুমি না থাকলেও আমার থাকা জুড়ে থেকে যাওয়া
তোমার অংশ নিয়ে আমি দিব্যি ভালোই ছিলাম।
খাঁচায় পোষা পাখি দুটোর জন্যে আমার আদর ছিল।
পাশের বাড়ির ছোট্ট বুবাই, ওর জন্যে স্নেহ ছিল।
হঠাৎ বৃষ্টি এলে, বারান্দায় শুকাতে দেয়া কাপড়,
আর বাহারী আচারের বোয়াম তোলার তাড়া ছিল।
তুমি নাই, তবু রোদ, বৃষ্টি, মেঘ আর স্মৃতি ছিলো।
থমকে থাকা সময় আঁকড়ে আমিও একটা জীবন
ঠিক ঠিক কাটিয়ে দিতে পারতাম, মনস্থির ছিল।
তুমি ছাড়াও আমি দিব্যি বাঁচতে পারতাম…
এতো এতো মায়া মাখানো মূহুর্ত ছেড়ে
চলে যাবার কোন ইচ্ছে আমার একদমই ছিলো না।
শুধু একদিন… একদিন কোন দূরের স্টেশনে,
যদি তোমার সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়,
আর “কেমন আছো?” জিজ্ঞেস করার বদলে,
যদি তোমাকে না চেনার ভান করে পাশ কাঁটিয়ে
হেঁটে যেতে হয়, শুধুমাত্র সে ভয়েই চলে যাচ্ছি…
আমার সমস্ত স্বত্তা সত্যের চূড়ান্তে গিয়ে জেনেছে,
মৃত্যুর চেয়ে ঢের কঠিন অচেনা হয়ে বেঁচে থাকা…
আরো পড়ুন: একগুচ্ছ কবিতা । পারিসা ইসলাম খান
একটা ভোর অন্যরকম হতে পারতো
আকাশজোড়া ধুসর মেঘ,বৃষ্টি হতে পারতো।
নির্লজ্জ আশাবাদের মতো ঝকঝকে রোদ,
হয়তো অভিশপ্ত রাজকন্যার ঘুম ভাঙ্গাতো।
লিখে রাখার মতো দিন, কবেই বা আসে
আসার আগেই হারালো যে অধরা সময়,
তার ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হতে হলো।
ঘড়ির কাঁটা হারিয়ে গেলে, অনন্তই সত্য।
একটা দিন অন্যরকম হতে চেয়েও হয় না।
সোনার কাঠি রূপার কাঠির অদল বদলে
আর কখনো জেগে ওঠা হবে না,
এই জেনে রাজকন্যা ফের চোখ বুঁজে।
বন্ধ চোখে বয়ে চলে নোনাজলের স্রোত,
সে অতলে ডুবতে ডুবতে বিভ্রান্ত
রাজকন্যা ভাবে, আদতে কোনটা শ্রেয়?
মৃত্যু সম নিদ্রা, না নিদ্রা সম মৃত্যু…
অসমান
তোমার গ্রীবার কাছে আটকে থাকা
নীলকন্ঠ ব্যাথার শপথ –
শীত, গ্রীষ্ম, বসন্তে,
আমার বিষাদও কিছু কম পোড়েনি।
তোমার তালুর ভাঁজে আজলা ভরে
তুলে নেয়া গ্লানির তরলে,
আমিও দিয়েছি মুখ।
আমার গরলও কিছু কম পড়েনি।
তোমার পাঁজরে বেঁধা প্রতিটি বিষের তীর
ছুঁয়ে গেছে আমাকেও
তোমার কাঁধের যতো যন্ত্রণার দায়ভার
আমাকে তলব তারা কম করেনি।
তোমার পায়ের চিহ্ন রেখেছো যে কন্টকে
ক্ষয়েছো যে ক্ষতের ক্ষরণে
সেই স্রোতে রক্তকণা আমারও রয়েছে,
ব্যাথার ব্যাঞ্জনা কিছু কম বাজেনি।
তবুও কখনো আমি তোমার সমান নই
আধা, পৌনে, শতাংশ হিসাব মেলে না।
যথেষ্ট না হওয়ার এই খেলায় বরাবর
একলা আমিই শুধু কম পড়ে যাই।
যেরকম কথা ছিলো
তোমায় আমি আড়াল করেছি
আমার নিজস্ব অন্ধকার থেকে
তোমার জন্যে বরাদ্দ কেবল
উঠোনে ছড়ানো অনাবিল আলো।
আমার অবচেতনের পলেস্তারা খসা
দেয়ালের ফোকড়ে, লেপ্টে আছে
অনাদিকালের অনন্ত প্রশ্নেরা-
সেসব প্রশ্ন তোমার জন্যে নয়।
তোমার জন্যে নয়, আমার
কদাকার ভাবনার দুর্নিবার ঘূর্ণি,
তোমার জন্যে আচার শুকানো দুপুর
রূপকথার চাদর পাতা পালঙ্ক।
আমার মুখোশের পাশ ঘেঁষে
গালে হাত দিয়ে বসে থাকা
অক্ষয়, অব্যয় যে স্থবিরতা –
সেও তোমার জন্যে নয়।
তোমার জন্যে আরাম মোড়া ভাতঘুম
পাটভাঙ্গা স্বপ্ন আর আদুরে বিকেল
তোমার জন্যে সূর্যমুখীর সাথে
সূর্যও খুঁজে দেবার আশ্বাস।
তোমায় আমি আড়াল করেছি
আমার নিজস্ব অস্তিত্বহীনতা থেকে
তোমার পদতলে বিছানো তাই
তারকাখচিত সুবিশাল ছায়াপথ।
বিবর্ণতার রঙ
চারিদিকে শতেক রঙ দেখি –
সাদা সভ্যতা, কালো কৌতুক
গোলাপী শহর আর বেগুনি ক্ষত
হলুদ সময় ঘিরে আসমানী স্মৃতি
কোথাও তো তোমায় দেখি না।
রক্তিম রাজপথ, ধুসর বাহানা
সবুজ উজাড় করা বুনো বৃক্ষরাজি।
ক্রোধের কালচে লাল, বিরহের নীল
খয়েরী ইটের ভীরে গেরুয়া বসতি
কোথাও তো তোমায় দেখি না।
তোমায় খুঁজতে গিয়ে, নিজেই হারালে
বুঝি কেন বিবর্ণতা অমূল্য লাগে।
মনে পড়ে বাতাসেরও কোন রঙ নেই,
মনে পড়ে অশ্রুর কোন রঙ নেই,
মনে পড়ে হৃদয়ের কোন রঙ নেই …
জন্ম ১ ডিসেম্বর ১৯৮০।
বর্তমানে প্রবাসে অবস্থান করলেও, পেশাগত জীবন কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। দীর্ঘদিন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ।
পারিসা ইসলাম খানের জন্ম, লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। এই শহরটাকে তাই মনে প্রাণে ধারণ করেন তিনি। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে কেটেছে রঙ্গিন শৈশব আর কৈশোর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির হাতেখড়ি। বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা ও সংকলনে প্রকাশিত কবিতা, গল্প, ফিচারগুলো একসময় আরো লিখে চলার ইন্ধন জুগিয়েছে। তারপর দীর্ঘ বিরতি। বন্ধুদের উৎসাহে আবারো লেখালেখিতে ফেরা। সাহিত্যের নানান মাধ্যমে বিচরণ থাকলেও কবিতাতেই সাবলীল। ২০২২ এর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে পারিসা ইসলাম খানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “উপসংহার নেই”।
প্রকৃতি ও মানবজীবন বরাবরই ভাবায় এই কবিকে। এই শহরের আনাচে কানাচে ভেসে বেড়ানো দীর্ঘশ্বাস আর প্রবলভাবে টিকে থাকার গল্পগুলোকে ছন্দে-অছন্দে বেঁধে রাখার চেষ্টাতেই মগ্ন যেন এই কবিতাগুলো।
ই-মেইল: [email protected]