প্রণব বসুরায় এর একগুচ্ছ কবিতা
প্রণব বসু রায়। লেখালিখির শুরু ১৯৬২-৬৩ থেকে, প্রথম মুদ্রিত হয় ১৯৬৪ সালে। প্রথমে “কন্ঠস্বর”, পরে “শীর্ষবিন্দু” পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। “শীর্ষবিন্দু”-র সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য হিসেবে ২০০১ অবধি, পরে একক সম্পাদনায় ঐ পত্রিকা ২০০৮ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ২০১৮ সালে, পত্রিকার ৫০ বছরে, স্মারক কাব্যগ্রন্থ “শীর্ষবিন্দু–৫০ বছরের কবিতা” প্রকাশ করেন, যুগ্ম সম্পাদনায়। নামী-দামি পত্রিকার সঙ্গে লিখেছেন প্রচুর লিটল ম্যাগে। এ পর্যন্ত ৪টি কাব্যগ্রন্থ, যথাক্রমে ১) প্রণয়রাংতা, ২) এবাড়িতে রান্নাঘর নেই, ৩) ফ্রেডরিক নগরের বাসিন্দা ৪) মাইনাস ডেসিবল প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য ও সমাজ-কল্যাণ মূলক কাজেও যুক্ত–“শ্রীরামপুর স্বর বর্ণ”নামক রেজিস্টার্ড সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবে।
প্রণব বসু রায়ের অকাল প্রয়াণে ইরাবতী পরিবার শোকাহত। তাঁর একগুচ্ছ কবিতায় কবিকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানায় ইরাবতী।
যাব ফুল গাঁয়ে
আজ এত ঘুম কেন
দুচোখ পাতায় বুঝি পারদ নেমেছে?
সামান্য তোষকের কোলাহল আর বালিশ-নৈকট্য
অল্প হলেও কিছুটা দূরেই সরায়…
একাকি এ সময়ে হোম করি, আয়োজন সারি
পূর্ণ আহুতির–
বাল্যের বন্ধু ঝিলের ওপার থেকে ডাকে– শব্দহীন উচ্চারণে
পদ্ম দেখায়, তার হাতে উড়ান-বেলুন।
ক্লোরোফর্ম ভেসে আসে হঠাৎ হাওয়ায়
বলি তাকে– যাব, যাব
তার আগে একবার ঘুরে আসি ফুল গাঁয়ে…
ম্যাপ দেখি, কম্পাস হাতড়াই
কতটা দূরত্ব তার, এভাবে বুঝি না
এই মধুবেলা
অমোঘ অস্ত্র সব এইভাবে তূণীরে রাখলে
দুর্বল রাখালের জন্যে এত আয়োজন!
অথচ এ বসন্তদিনে রঙিন বাতাস বহে যায়–
বসেছ আমার সামনে, আমিও তোমার মুখোমুখি
নিরুচ্চারে কেটে যায় এই মধুবেলা, উত্তাপবিহীন
মনে করি গিয়েছি সমুদ্রের কাছে, অতি দূর থেকে
মাছের নৌকো ভেসে আসছে ঢেউয়ের আদরে
পারে উদগ্রীব, চোখে সানগ্লাস আর ছোট দূরবীন
অপেক্ষায় আছি, আমি আহাম্মক…
নৌকোর সব মাছ নিয়ে যায় মহাজন এসে
অথচ এ বসন্তদিনে রঙিন বাতাস বহে যায়…
লজ্জা
যদিও গঙ্গা দুকূলেই বহে যায়
তবুও তা যেন আমাদের কিছু বেশি
নিবিড় সময় কাটিয়েছি তার পাশে
খোঁপা খুলে গিয়ে হঠাৎ যে এলোকেশী!
গুপ্তির কথা আমরাই শুধু জানি
বছর গিয়েছে, যাক না যাবার যাহা
আমাদের কাছে সেই নূপুরের ধ্বনি
এখনো ‘তারিফ’, এখনো বলছি ‘আহা’
তোমার কি এতে দ্বিমত কিছুবা আছে?
লজ্জার মুখ লুকোও পাশের গাছে…
কিঙ্কিণী উড়ে গেছে
তর্জনী উঠিয়ে নির্দেশ দিও না, দ্যাখো
নিজের অনামিকাই বাধ্য নয়–মুখ অন্য দিকে
কেন সে মানে না হুকুম, আনপথে যায়– জেনেছ তা?
জানি, তুমি সফল সন্ন্যাসী নও, বিরিয়ানির লোভে
ছেঁড়া অছিলায় পায়ে পায়ে হাঁটো, ঘোরো দূরের বাগানে
মোগলাই খানার সাবেক পাড়ায়, লোকাল কুকুরদের
বন্ধু করেছো বিলিতী বিস্কুটের চারে…
কয়েদিহীন জায়গা ঘিরে পাঁচিল তুলেছ
ত্যক্ত পোশাক দেখে ভ্রমে তাকে দেখতেও পাও–
আসলে কিঙ্কিণী বহুদিন উড়ে গেছে–
চলে গেছে সীমানা ছাড়িয়ে…
সহজাত
একটা বাঁকের মধ্যে গুটিয়ে ফেলেছ
রীল থেকে খুলে ফেলা সব সুতো–
খেলতে খেলতে
হাত থেকে পড়ে গেছে রূপোর চামচ
পায়েস গড়িয়ে যায়, পিঁপড়েও ধাবমান…
গোলাপি ভেলভেটের পর্দা ঝুলিয়ে
একটি কামরা তৈরী করি, এসো
এখানে শুরু হচ্ছে নতুন একাঙ্কিকা
পারস্য-জাজিমে বসে আচমন করি
আতরদান এনে দিক রহস্য বালিকা
সুতোর রীল, কক্ষণো আর হাতেও নিও না
অন্তর্বাসের শাসন সহজাত ছিলো না তোমার
প্রতি স্টেপে
সব দরজাই এক দিকে খোলে,
খিল লাগালেই প্রবেশ নিষেধ সূচিত হয়ে যায়
কালো মেঘ, পড়ুক বাজ
ওপাশের ওভেনে মোগলাই খানার খুশবু…
এদিকে এলেই ছিঁড়ে যাবে–তাই অর্গল আয়োজন
আমিও প্রতি স্টেপে দু’পা করে দূরে চলে যাই..
এইবার বলো
কষ্ট জাগাতে চাই নি বলে আর বার ডাকি নি তোমায়
সেকথা জানে খোলা স্ক্রীন ও ইঁদুরছানা
বিমূর্ত যন্ত্রণায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছি অসহায় রাতে
যতটা বলেছি, তার থেকে ঢের বেশি
অনুক্ত থেকেছে…অন্দরে জ্বালিয়েছি…
কথা কি বেদনার পরিভাষ হয়েছে কখনও!
সন্ধি সমাস আমি শিখি নি তেমন
ক্লীব লিঙ্গ কাকে বলে, তাও তো জানি না
অভুক্ত থেকেছি, রান্না হয় নি কতকাল
আমাদের ঘোড়াশালে ম্যাজিকের তাঁবু
খালি পেট সুন্দরীকে কেউ যেন করাত চালিয়ে
নীল নিশানা তোলে আকাশ ছাপিয়ে
এইবার বলো
রূপক যমকের সংসার এতই দুর্লভ!
ছাই হ’বো
আগুন জ্বেলেছি তাই আগুনেই পুড়ে গেছে মুখ
সারা অঙ্গে অনির্বাণ দাউ দাউ, দেখুক দেখুক —
এতে যদি তৃপ্তি আসে শান্তি আসে তাহার প্রাণেতে
পুড়ে পুড়ে ছাই হ’বো, অস্থি দেবো জলের প্রপাতে…
সমাবর্তন
কথার ম্যাজিক আজ অচল পয়সা
যেদিক দিয়েই আসুক, যাবে তা
ভূমধ্যসাগরে…
আমি আর ভুল করে হুতাশ করি না
বরং স্বাগত জানাতে লাল কার্পেট খুলে দিই
বিছানায় শুয়ে এস এম এসে লিখি ‘শুভেচ্ছা, অভিনন্দন’
পোষাকী আচরণ নিখুঁত হলেও
আবহ সঙ্গীতে শুনি যুদ্ধ-দামামার মহলাই শুধু
নট নটী জেনে গেছে, সেও তো ভাদ্রের গর্জন…
সমাবর্তনের দিনে পাঠিয়ে দিচ্ছি ফরাসী নির্যাস
সেই জলে স্নান সেরে নিও,
সূর্যকে বলেছি তোমার চুল শুকিয়ে দেবে
তোমার জন্যে রেখে যাচ্ছি কুসুম-প্রস্তাব
আলিঙ্গন
যে মানুষ একেবারে প্রান্তিক, তার ঠিক কী চাই
জানে কেউ?
যে শহরে শীত আসছে সেখানে উষ্ণতার বলয়ে
পা রাখার পারমিট, কে রেখেছে সোনালি ব্যাগে!
ব্যালকনি থেকে দূরে দ্যাখা যাচ্ছে সবুজের আভা
সেখানে সাতনড়ি হার খুলে রেখে
কে যে গ্যালো সমুদ্রে, স্নানে–
সূর্য নেমে যাচ্ছে ঢেউয়ের আহ্বানে
কাঠ-কুটো নেই আমার সঞ্চয়ে
শীতের আলিঙ্গন, বলো, কী করে এড়াই?
না
আমার স্বপ্নের ভেতর ঘুম আছে, কিন্তু
ঘুমের কোন পূর্ব পরিচয় নেই
ঘুমের মধ্যে আছে রেলগাড়ি, কিন্তু
সেই ট্রেন কোথাও যায় না
সোনালী ধানের উৎসবে প্রতিবেশি আসে
স্বজন আসে না
আগুন-পরবের রাশি কাঠ জমানো হয়েছে
….. অগ্নিশলাকা নিয়ে কেউ তো আসেনি!
তুলো ধোনার টঙ্কার শুনেছি, গিয়ে দেখি
আমার পূর্বপুরুষ কিছুই জানে না
তোমার হাতের বাতি জ্বালাতে পারি না
কেন তুমি মোম জ্বেলে আসোনি, বলতো!
নাকি তুমি
রাত গভীর হলে চুঁইয়ে জল নামে ক্ষতে…
শুশ্রুষা করার সাদা স্কার্টের নার্স
টহল দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়ে।
সেই জ্বালা পোড়াতে থাকে চোখ, চুল
চর্ম ও ধমনী — শুনশান নৈঃশব্দে
কোন আত্মীয় বা বান্ধব দমকলে কর্মরত নয়
ত্রাণ মন্ত্রীর নামটাও জানা নেই
জানি শুধু অরণ্যদেব আর পাহাড় উপড়ে আনা
পৌরাণিক মহাবলীকে
জ্বালার উপশম দিতে পারা গুল্ম এরাও চেনে না
রাত গভীর হলে চুঁইয়ে জল নামে ক্ষতে…
ওই জল তুমি কি পাঠাও, যাকে আমি দৈব বলি?
নাকি তুমি দহন ভালোবাসো…
