Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ফেদেরিকো ফেলিনি

ফেদেরিকো ফেলিনি:চলচ্চিত্রে নীতিকথা শোনানোর ইচ্ছে যার ছিলো না

Reading Time: 3 minutes

গত শতকের ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্রকার ইতালীয় নিওরিয়ালিজমের অন্যতম প্রাণ পুরুষ ফেদেরিকো ফেলিনি হতে চেয়েছিলেন সার্কাসের পরিচালক, অথচ তিনি কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রে তাঁর স্বতন্ত্র স্বাক্ষরের জন্য। যেখানে নিজের ছবি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘নীতিকথা আমার ছবির উদ্দেশ্য নয়’। তাঁর ছবিগুলোতে প্রকৃতপক্ষে তিনি ফুটিয়ে তুলতেন সর্ব অর্থে আধুনিক মানুষের সংকট। সমালোচকের মতো কোন কিছু প্রমাণ করার দায়িত্ব তাঁর নেই, তাই তাঁর জাত আলাদা। 

কবি অরাগঁ ফেলিনির ছবি সম্পর্কে  বলেছেন, দ্যা গোল্ড রাশ, ব্যাটেলশিপ পটেমকিন ও লা স্ত্রদা তাঁর দেখা শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে গণ্য হবে। ভীষণ রক্ষণশীল বামপন্থী সংস্কৃতির প্রবক্তা দনিওল-বালক্রোজ ফেলিনির চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘১৯৫৫র চিত্রজগতে লা স্ত্রাদা এক স্বাস্থ্যকর বাতাস বয়ে এনেছে। এই হলো সত্যিকারের আভঁ-গার্দ, পুরোগামিতার সত্য উদাহরণ।’ লে লেতর ফ্রঁসেজ-এ সাদুল তাঁর ছবি সম্পর্কে বলেছেন, ‘সততা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সত্যের প্রতি আস্থা ও আশা ফেলিনির কাজে এ সব কিছুরই প্রধান্য।তাঁর ছবি বার বার দেখতে হবে, আর প্রতিবারই দেখার পর আবিষ্কার হবে, প্রথম দর্শনে ছবি অপ্রত্যাশিত ও অস্বস্তিকর বলে মনে হলেও তা মানুষের স্মৃতিতে গভীর ছাপ রেখে যাওয়ার মতো।’

ফেদেরিকো ফেলিনি এক গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতার নাম। ব্যক্তি জীবনে অন্তর্মুখী, উদাসীন আবার সৃষ্টির ক্ষেত্রে অসম্ভব বাস্তববাদী এই চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্ম ২০ জানুয়ারি ১৯২০ সালে রিমিনিতে। বাবা উরবানো ফেলিনি পেশায় ছিলেন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। ফেলিনি ১০ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যোগ দিয়েছিলেন পিয়েরিনোর সার্কাসে। অসুস্থ একটা জেব্রাকে দেখাশোনা করতে হতো তাঁকে। যুদ্ধের সময় পর্যটন থিয়েটার দলের সঙ্গে প্রায় গোটা ইতালি ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। ছোট ছোট নকশা লিখেছেন তাদের জন্য। ফ্লোরেন্সেও কিছুদিন থাকার পর রোমে ফেরেন। তার মা ইদা বারবিয়ানি ছিলেন রোমের মেয়ে। সেখানে হাসির কাগজ ‘ মার্ক আরেলিওর জন্য লিখতেন, ছবি আঁকতেন। অনুবাদক হিসেবে কমিকস নিয়ে সে সময়ে কাজ করেছেন। রেডিও নাটক লিখতেন। রেডিওতে কাজের সূত্রে জুলিয়েত্তা  মাসিনার সঙ্গে আলাপ এবং পরে বিয়ে। দেশে আমেরিকান সৈন্য প্রবেশ করলে ফেলিনি ‘মজার মুখ’ নামে এক দোকান খুলে সৈন্যদের ব্যঙ্গ ছবি ও পোর্ট্রেইট আঁকতেন। সেখানেই ১৯৪৫- এ রসোলিনির সঙ্গে দেখা হয় এবং রোমা, চিত্তা নামক অপেরায় সহকারীর ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮-এ রসেলিনির ‘ ফ্রানচেসকো গিল্যারে দি দিও’ নামক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার ও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এবং ১৯৫০এ এসে নিজেই পরিচালক হিসেবে ছবি তৈরি শুরু করেন। তবে তিনি একজন বাস্তববাদী ধ্রুপদী চলচ্চিত্রকার হলেও সার্কাসের নেশা তাঁকে ছাড়েনি। ফেলিনির মতে, ‘সিনেমা অনেকটা সার্কাসের মতো। সিনেমার যদি কোনো অস্তিত্ব না থাকতো, রসেলিনির সাথে যদি আমার দেখা না হতো, আর যদি সার্কাসের আজও একটা সমকালীন কার্যকরিতা থাকতো আমি তাহলে একটা বড় সার্কাসের পরিচালক হতে পারলে বেশি খুশি হতাম। কারণ সর্কাসও সেই একই প্রয়োগ কৌশল, সূক্ষ ও যথার্থ আর তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনের সংমিশ্রণ।’

তবে সমালোচকরা কেউ কেউ ফেলেনিকেকে বলেছেন ভন্ড, ক্লাউন, একটা পাক্কা শয়তান। আবার ভক্ত বা গুণগ্রাহীদের মতে তিনি ছিলেন জাদুকর লোক, পুরোদস্তুর কবি ও প্রতিভাবান।

ইমানুয়েল ম্যুনিয়ের নামে এক দার্শনিক বলেছিলেন যে, ‘কোন সামাজিক সম্ভাবনার দ্বার মুক্ত করতে চাইলে সবচেয়ে মূলগত আর গুরুতর বিষয় হচ্ছে মানুষের যৌথ অভিজ্ঞতা’। 

সেই যৌথ অভিজ্ঞতা ফেলিনির সৃষ্টি কর্মে স্পষ্ট। 

প্রশংসার মতো সমালোচনাকেও তিনি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতেন। তাঁকে ক্লাউন বলা হলে, ক্লাউন সম্পর্কে ফেলিনি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের অবতরণা করেন। তাঁর মতে, ‘প্রত্যেক সন্ধ্যায় হাততালি পড়া নিশ্চয়ই দারুন ব্যাপার! যে কারণে ক্লাউনদের বয়স বাড়ে ধীরেসুস্থে, দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে তারা। দৈনিক বাহবা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। অন্যদিকে সাফল্য ও আত্মম্ভরিতা কুষ্ঠ রোগের মতো। লোককে দুর্বল করে দেয়, তার যথেষ্ট বয়স হওয়ার আগেই তাকে পরিণত করে বৃদ্ধে।’

কিছু কথা তিনি সমালোচকদের মুখে ছাই দিতে রসিকতা করে বলতেন আবার কিছু কথা ছিল তার আত্মপ্রসাদ। তাইতো কমেডি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘হাসির চেয়ে দুঃখের আর কিছু নেই। প্রগাঢ় নৈরাশ্যের যে আতঙ্ক তার চেয়ে সুন্দর ও রাজসিক, তার চেয়ে মনের উন্নতি ও সমৃদ্ধিসাধক আর কিছু হয় না।’

সেনসরশিপ নিয়ে ছিল তাঁর তীব্র ক্ষোভ। তাঁর মতে, ‘সেনসরশিপ মূলত নির্মাতার দুর্বলতা স্বীকার করিয়ে নেওয়ার একটা পদ্ধতি। সেনসরশিপ চিরকালই রাজনৈতিক হাতিয়ার মোটেই বৌদ্ধিক হাতিয়ার নয়। সমালোচনাকে বরং বলা যায় বৌদ্ধিক হাতিয়ার। সমালোচনা কখনো ধ্বংস করে না, বরং নির্দিষ্ট কোন জিনিসকে অন্যান্য আরো নানান জিনিস এর মাঝখানে সে ঠিক জায়গামত স্থাপন করে। সেন্সর মানে ধ্বংস করা বা বলা চলে বাস্তবতার যে প্রক্রিয়া তার বিরোধিতা করাই সেন্সরের কাজ।’

চলচ্চিত্র জগতে ফেলিনি এক মহৎ স্রষ্টা। অর্ধশতাব্দীর শুরু থেকে ধরলে তিনি চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম মহৎ আবিষ্কার। 

শেষ দৃশ্য বলে ফেলিনির ছবিতে কিছু নেই। তাঁর কোন কাহিনী  উপসংহারে পৌঁছায় না। তাঁর মতে, ‘তাঁর চরিত্রেরা অনেকটাই যেন বৈদ্যুতিক তারের মতো, আলোর মতো, যা আদতেই বদলায় না। বরং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিচালকের মনের মধ্যে এক অপুরণীয় অপরিবর্তণীয় অনুভবের কথা জ্ঞাপন করে। যে কারণেই হোক, তারা ক্রমান্বয়ে  বিকশিত ও বিবর্তিত হতে পারে না।’ সমালোচকদের মতে, তার কারণ অবশ্য অন্য। নীতিকথা শোনানোর কোনো ইচ্ছে ফেলিনির ছিলো না।  তিনি মূলত অনুভব করতেন, যার গল্প তিনি বলছেন, সে নিজে কোনো সমাধান খুঁজে পেলে দর্শককে তা না জানানো। দর্শককে সমাধানটা না জানালেই বরং একটা ছবি অনেক বেশি নীতিবাদী হয়।

১৯৯২ সালে সর্বকালের সেরা প্রভাব রাখা ১০ ছবির তালিকায় তাঁর দুটি ছবির নাম আসে—‘লা স্ত্রাদা’ ও ‘অত্তে মেজো’। পাঁচবার অস্কার পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে ফেলিনি প্রথম পরিচালনা করেন ‘দ্য হোয়াইট শেক’ ছবিটি। কিন্তু তাঁকে সফলতা এনে দেয় ১৯৫৩ সালের ছবি ‘ই ভিত্তেলনি’। ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কার জেতে। এক বছর পরেই ফেলিনি ঘরে তোলেন অস্কার পুরস্কার। ‘লা স্ত্রাদা’ ছবির জন্য বিদেশি ভাষা শাখায় অস্কার জেতেন ফেলিনি। একে একে তৈরি করেন ‘লে নত্তি দি কাবিরিয়া’, ‘লা দোলচে ভিতা’, ‘ফেলিনি সাতিরিকন’, ‘ফেলিনি রোমা’, ‘আমারকরদ’-এর মতো বিখ্যাত সব ছবি। 

পাম দ’র, অস্কারসহ পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা জিতেছেন ফেলিনি। ১৯৯৩ সালে পান আজীবন অস্কার সম্মাননা। জাপান আর্ট অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে ‘প্রিমিয়াম ইম্পিরিয়াল’ সম্মাননা দেয়, যা নোবেল প্রাইজের মতো সম্মানীয় বলে ধরে নেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালে ৭৩ বছর বয়সে রোমে হৃদরোগে মারা যান এ কিংবদন্তি। 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>