Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ফ্রেড

ধারাবাহিক: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-২) । আদনান সৈয়দ

Reading Time: 7 minutes

নিউইয়র্ক জ্যাকসন হাইটস এর বাঙালিদের জীবন, তাদের স্বপ্ন, তাদের ত্যাগ, তাদের মন, মনন, প্রেম, ভালোবাসা আর বুক চাপা কান্নার গল্প । সব মিলিয়ে এই ধারাবাহিক লেখায় উঠে আসবে নিউইয়র্কের বাঙালির গল্পগাথা। আজ ইরাবতীর পাঠকদের জন্য থাকছে পর্ব-২।


অ্যাকুরিয়ামের মাছ ও হলুদ প্রজাপতির গল্প

সূর্যাস্তের সময় নিউইয়র্কের ইস্ট রিভারের চেহারাটা সত্যি অন্যরকম হয়ে যায়। নদীর পূর্ব পারে জ্যাকসন হাইটস থেকে ১০ মিনিটের ড্রাইভের দুরুত্বে অ্যাস্টোরিয়া পার্ক। পার্কের পশ্চিম পারে ম্যানহাটনের সুউচ্চ দালান। নদীর এপার থেকে নদীর উপর ঝুঁকে পরা ম্যানহাটানের দালানগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। সেই দালানের ফাঁক দিয়ে সূর্য যখন ধীরে ধীরে ডুব দেয়, তখন তার লাল কমলা রঙের আভা ছড়িয়ে পড়ে ইস্ট রিভারের জলে। সেই জলের বুকে তখন জেগে উঠে লাল কমলা রঙে মেশানো  এক অসাধারণ নান্দনিক শিল্পকর্ম। মনে হয় স্রষ্টা যেন স্বয়ং তাঁর নিপুণ হাতে জলের উপর এই শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন। তখন  সেই  শিল্পকর্ম দেখতে কার না ভালো লাগে? আমার তো লাগেই। কারণ আমি আজন্ম প্রকৃতিপ্রেমী। পার্কে বসে চোখ দিয়ে প্রকৃতির  অপার সৌন্দর্য যখন চাটছি  ঠিক তখন আবিষ্কার করি আমার পাশের বেঞ্চেই বসে  আছেন একজন বকয়স্ক মানুষ। চেহারাটা তাঁকে খুব চেনা চেনা মনে হল।

ঠিক মনে পড়েছে! গত বসন্তে তাঁর সঙ্গে ঠিক এখানেই আমার দেখা হয়েছিল। এই অ্যাস্টোরিয়া পার্কেই। শুধু দেখা নয়, সেই সঙ্গে সখ্যতাও। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমাদের নানান বিষয় নিয়ে আড্ডা হতো। আমাদের আলোচনায় উঠে আসত  ফেলে আসা শৈশব, দেশ, মাতৃভূমি, প্রিয় মানুষের মুখ আরও কত কী!  নাম তাঁর ফ্রেড ডিভিটো।  মাত্র পঁচিশ বয়সে তিনি ইতালির সিসিলি থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন।  এখন বয়স হয়েছে প্রায় তিনগুণ!  জীবনের দীর্ঘ  এই যাত্রা পথে তিনি নানা রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। আমেরিকায় আলো হাওয়ায় জীবনকে টেনে নিয়েছেন বটে কিন্তু অন্তরের অন্তস্থল থেকে তিনি কখনো তার সিসিলিকে বিদায় জানাতে পারেননি।   সম্ভবত কোনো অভিবাসীই তা পারে না। আমিও পারি না। দেশকে ভোলা যায়? নিজের মাকে কী কেউ কখনো ভুলতে পারে? দীর্ঘ এক বছর পর ফ্রেডকে দেখে মনে হল, তার চেহারায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।  চোখের নিচে চামড়া ঝুলে গেছে। চোখের উজ্জ্বলতা আর নেই।  চুল কাশফুলের মত  সাদা। হাত আর পায়ের চামড়াও আগের চেয়ে বেশি কুঁচকানো। মুখের হাসিটাও আগের মতো দেখছি না। তাহলে কী বার্ধক্যের কাছে নীরব সমর্পণ? কিন্তু তা হবে কেন? এমনতো কথা ছিল না?

আজ  হঠাৎ করেই ফ্রেডকে খুজে পেয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা! আরো অবাক বিষয় হল তিনি আমাকে চিনতে পারছেন না। খুব স্বাভাবিক!  গত বছর তিনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন এবার পাকাপাকি নিজ দেশে চলে যাচ্ছেন।  ইস্ট রিভারের দিকে মুখ রেখে উদাস হয়ে বসে আছেন ফ্রেড। কি দেখছেন এত তন্ময় হয়ে? হয়তো নদীর জলের সঙ্গে আকাশের রঙের লুকোচুরি খেলা!  নদীর সঙ্গে আমাদের জীবনের কতই না মিল! সেই মিল আর অমিলগুলো খুজছেন ফ্রেড! কাছে গিয়ে হাঁক দিতেই  ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকালেন তিনি।

আমাকে চিনতে পারছেন? গত বসন্তে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। আমরা প্রতিদিন এখানে কত গল্প করেছি, কত আড্ডা দিয়েছি। মনে আছে?’ আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে ফ্রেডের দিকে তাকালাম।

আমার দিকে খানিকক্ষণ মোটা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন । তারপর হঠাৎ করেই  চোখদুটো  জ্বল জ্বল করে উঠল।

‘ অবশ্যই অবশ্যই। চিনতে পারছি!! কেমন আছেন আপনি? হায় ঈশ্বর, কীভাবে হঠাৎ করেই না দেখা হয়ে গেল! জানেন, আমি কিন্তু আপনাকে অনেক খুঁজেছি! পার্কে  এলেই আমার চোখ আপনাকে খুঁজতো।  কিন্তু আপনি সম্ভবত এই পার্কে আর খুব একটা আসেন না। তাই না?’ এই বলে তিনি আমার কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষায় হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন।

‘কী আশ্চর্য কথা! আমিও তো আপনাকে খুঁজছি। তবে আমার ধারণা ছিল, আপনি সিসিলিতে পাকাপাকিভাবেই চলে গেছেন। তাই আর আপনাকে সেভাবে খুঁজিনি। তবে আমার জানা ছিল, পার্ক আপনার খুব পছন্দের একটি জায়গা। তাই যেকোনো পার্কে গেলেই আমার চোখ  ঈগলের মতো আপনাকে খুঁজত। যদি আবার আপনার দেখা পেয়ে যাই! তবে হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। এই অ্যাস্টোরিয়া পার্কে এখন আমার আসা হয় খুব কম। আমি অ্যাস্টোরিয়া থেকে এখন জ্যাকসন হাইটস এলাকায় চলে গেছি। আমার বাসার আশপাশের পার্কগুলোই এখন আমার একমাত্র ভরসা। যাক, আপনাকে ফের খুঁজে পেয়েছি, এটাই আসল কথা।

এবার ফ্রেডের খুব কাছে গিয়ে বসলাম। তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে খুব আস্তে আস্তে বললাম। কী, এবারও যাওয়া হল না বুঝি?

ফ্রেড মাথা নিচু করে বসে রইলেন। শুধু মাথা নেড়ে বললেন, না। আমি বুঝতে পারলাম ফ্রেড প্রতি বছরের মতো এ বছরও তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। যেমনটা আমরা প্রায় সবাই করি। প্রতি বছরই আমরা শপথ নিই। না, এই তো আর কয়েকদিন। তারপর আমেরিকাকে বিদায় জানিয়ে নিজ মাতৃভুমিতে আবার ফিরে যাব। কিন্তু হায়! এ যেন শুধুই মরীচিকা! আমাদের আর সময় হয় না, নিজ দেশে আর যাওয়া হয় না। প্রতিদিনই আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করি। তবে আজ  ফ্রেডকে দেশের কথা বলে তাঁর মন খারাপ করতে মন চাইল না। তবে তাঁর কথা শোনার লোভও সামলানো যায় না। ফ্রেডকে বলেই ফেললাম, কাল কিন্তু দেখা হবে। আর দীর্ঘ সময় নিয়ে আড্ডাও হবে। কী বলেন? ফ্রেড উত্তর দিলেন, সেই ভালো। এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। কাল না হয় পুরো বিকেল আমরা দুই বন্ধু মিলে আড্ডা দেব।

আমি ঠিক আছে বলে তাঁর সঙ্গে করমর্দন করে বাড়ি ফিরে এলাম।

বাড়ি ফিরে বারবারই ফ্রেডের কথা মনে হচ্ছিল। গত বছর তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল অ্যাস্টোরিয়া পার্কেই। কথায় কথায় তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, দীর্ঘ ৪৫ বছর তিনি আমেরিকায় আছেন অথচ একদিনের জন্যও তিনি তাঁর সিসিলিকে ভুলতে পারেননি। তিনি আমেরিকায় টাকা বানিয়েছেন, বাড়ি কিনেছেন। কিন্তু সবকিছুর পরও তিনি তাঁর নিজ গ্রামে ফেলে আসা বাড়িটাকে ভুলতে পারছেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পাকাপাকিভাবে দেশে চলে যাবেন। ছোট্ট একটি জীবন। এই এক জীবনে আর কী বা চাওয়ার আছে? জীবনের শেষ সময়টা অন্তত নিজে গ্রামেই কাটুক। ফ্রেড ডিভিটোর দুই ছেলে। তারা কেউই নিউইয়র্ক থাকে না। বছরে বড়দিন অথবা থ্যাংকস গিভিং ডেতে ওদের সঙ্গে দেখা হয়। স্ত্রী মারা গেছেন বছর পাঁচেক হল। বলা যায় এখন তিনি একা। ছেলেদেরকে ফ্রেড বলে দিয়েছেন, বাড়িঘর এসব তাঁরা যেন দেখভাল করে। এখন তাঁর সময় হয়েছে নিজের মতো করে সময় কাটানোর। যে গ্রাম তিনি ৪৫ বছর আগে রেখে এসেছিলেন, সেই গ্রামেই তিনি আবার ফিরে যেতে চান। অবশ্য ছেলেরাও তাতে রাজি। কথা ছিল ফ্রেড গত বছরই সিসিলি চলে যাবেন। কিন্তু আজ  আবার হঠাৎ করে ফ্রাডকে দেখে একটু অবাকই হলাম। কেন তিনি যেতে পারলেন না?


আরো পড়ুন:  দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-১) । আদনান সৈয়দ


ফ্রেড কে নিয়ে এসব হাবিজাবি কথা ভাবতে ভাবতেই আমি ড্রয়িংরুমে সোফায় হেলান দিয়ে বসি। ঘরটার চারপাশে তাকাই, বড় একটি বইয়ের আলমারি। ডান পাশের দেয়ালে রয়েছে বাংলাদেশ থেকে আনা একটি সুন্দর পেইন্টিং। সেই পেইন্টিং এ ফুটে উঠেছে বাংলার গ্রাম, নদী আর সবুজ গাছগাছালি। সোফার পাশেই সুন্দর একটা অ্যাকুরিয়াম। সেই অ্যাকুরিয়ামের তলানি থেকে কৃত্রিম বুঁদ বুঁদ উঠছে। সেই বুঁদ বুঁদে অ্যাকুরিয়ামে কৃত্রিম একটি জলের স্রোতধারা তৈরি হচ্ছে। আর সেই জলের মধ্যে কিছু লাল নীল রঙের মাছ আপন মনে সাঁতার কাটছে। তারা কখনো লেজ নেড়ে নেড়ে একজন আরেকজনকে তাড়া করছে, কখনো কখনো অ্যাকুরিয়ামের ভেতরে রাখা পাথরের নুড়ি, কৃত্রিম শেওলার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। আমি তন্ময় হয়ে অ্যাকুরিয়ামের মাছের এই রঙ্গ তামাশা দেখছিলাম। ভাবছিলাম বোকা মাছগুলোর কথা। ছোট এই এক চিলতে অ্যাকুরিয়ামটিকে সমুদ্র ভেবে কী আনন্দটাই না করছে! কিন্তু একী! আমি ধীরে ধীরে আবিষ্কার করি, আমিও তো অ্যাকুরিয়ামে থাকা একটি মাছ। লক্ষ্য করি, আমার চারপাশেও রয়েছে একটা রঙিন কাঁচের দেয়াল, যার স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে বাইরের রঙিন পৃথিবীটাকে দেখা যায়। যে পৃথিবীর ঝকঝকে আলোয় আমিও নেশাগ্রস্থ। হায়! তাহলে আমিও কি অ্যাকুরিয়ামে রাখা রঙিন এক বোকা মাছ? অথচ, আমার হলুদ প্রজাপতি হওয়ার কতই না শখ ছিল! প্রজাপতির মত মুক্ত স্বাধীন হয়ে যত্রতত্র উড়ে বেড়াব, ঘুরব। কত আনন্দ! আর আমি কিনা খাঁচায় বন্দী! ।

পরদিন যথারীতি অ্যাস্টোরিয়া পার্কে হাজির হলাম। পার্কে গিয়ে দেখি, ফ্রেড আমার আগেই এসে গেছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমার আর দেরি সইছিল না। কুশল বিনিময় পর্ব শেষ করেই ঝটপট জিজ্ঞেস করলাম, ফ্রেড, আপনি এখানে কেন? আপনার না ইতালিতে চলে যাওয়ার কথা? কেন যেতে পারেননি? এবার কী হল?

আমার কথা শুনে ফ্রেডের মুখটা কেমন যেন একটু শুকিয়ে গেল। তারপর একটু গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করলেন,জানেন তো, একজন অভিবাসী যখন তার নিজ দেশ ছেড়ে অন্য আরেকটা দেশে নোঙর ফেলে, তখন থেকেই তিনি তাঁর দেশের অভিশাপে পড়ে যান। আমিও সেই অভিশপ্তের দলে। যতই তিনি দেশ দেশ করুন না কেন, দেশ আর কখনো তাকে বুকে তুলে নেয় না। নিজ দেশ থেকে আরেক দেশে চলে আসার মতো অভিশপ্ত জীবন আর কী হতে পারে? আমার জীবনের ৪৫ বসন্ত এই আমেরিকার চার দেয়ালে বন্দী হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমেরিকা বুঝি আমাকে জাদু করে ফেলেছে। অথবা আমি মাকড়সার একটা জালে জড়িয়ে পড়েছি। শত চেষ্টা করেও এই মাকড়সার জাল থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছি না। গত বছর আমার সিসিলি যাওয়ার আয়োজন যখন মোটামুটি নিশ্চিত, তখনই আমার জীবনে এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল। আমার হার্ট অ্যাটাক হল। তারপর বাইপাস সার্জারি হল। আমার দুই ছেলে এসে বলল, বাবা পাগলামি করা চলবে না। আপনি আমেরিকায় থাকলে ভালো চিকিৎসা পাবেন। তা ছাড়া ইতালিতে কে আপনার দেখভাল করবে? আপনার বন্ধু বান্ধবদের এখন কাউকেই আর খুঁজে পাবেন না। আপনার আত্মীয়স্বজন সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। আপনি যে গ্রাম ফেলে এসেছিলেন, সেই গ্রাম এখন নিউইয়র্কের মতোই বড় একটা শহর। আপনার শৈশবের কোনো চিহ্নই আর সেখানে নেই। আপনি কোথায় যাবেন? কার কাছে যাবেন?

জানেন, আমিও অনেক ভেবেছি কথাটা। আমি কার কাছে যাব? সিসিলিতে যেখানে আমার জন্ম, সেখানে আমাদের পাড়ায় একটা ভালো ফুটবল দল ছিল। আমি ছিলাম সে দলের নেতা। সেই দলে যারা খেলতেন, তাদের অনেকেই আজ  নেই। আমি বছর তিনেক আগে একবার আমার গ্রামে মাস খানিকের জন্য গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে বের করা। কিন্তু তখন জানতে পারলাম, আমার বন্ধুদের যারা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরা কেউ আর সেই গ্রামে থাকেন না। হয়তো ভিন্ন কোনো শহরে তারা তাদের সন্তানদের সঙ্গে আছেন। তাই এখন সব দিক বিবেচনা করে ভাবলাম, এই তো আর কিছু দিন! কদিনই বা বাঁচব! কী আর হবে দেশে গিয়ে! আমার হৃদয় মন্দিরে সিসিলির যে গ্রামটাকে অনেক ভালোবাসায় সিন্দুকের কৌটায় যত্ন করে তুলে রেখেছি, সেটি না হয় আজীবন সেই সিন্দুকের কৌটাতেই বন্দী থাকবে! তাই না? কথাগুলো বলেই ফ্রেড তাঁর চোখ মুছলেন।

আমি ফ্রেডের কথা শুনে আঁতকে উঠি! তাহলে কি আমারও ফ্রেডের দশাই হবে! আমিও বাংলাদেশ থেকে এসেছি প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেল। দেশ থেকে শিক্ষার্থী ভিসায় যখন আসি, তখন বাবাকে বলেছিলাম, এইতো মাত্র চার বছরের জন্য আমেরিকায় যাচ্ছি। সময়টা দেখতে দেখতেই চলে যাবে। তারপর দেশের ছেলে আবার দেশেই ফিরে আসব’। হায়! চার বছর এখন তির তির করে দুই যুগেরও বেশি! প্রতি বছরই শপথ করি। এই তো আর মাত্র দুটি বছর। পড়াশোনাটা শেষ হোক। তারপর দেশে চলে যাব। কিন্তু পড়াশোনা শেষ হয়, আর দেশে যাওয়া হয় না। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর আবার শপথ করি। ভালো একটা কাজ বাগিয়ে কিছু টাকা পয়সা সঞ্চয় করে চলে যাব। হায়! অর্থকড়ি টাকাপয়সা জমানোর পর আর যাওয়া হয় না। তারপর বিয়ে করলাম। বউ,বাচ্চা,সংসার! এখন বলি, বাচ্চাগুলো আরেকটু বড় হোক। তারপর ঠিক দেশে চলে যাব। বাচ্চাগুলো বড় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমার আর যাওয়া হয় না। হায়! কত টাকা জমাতে পারলে আমার দেশে যাওয়া হবে? কেউ কি তা বলতে পারেন? এখন সন্তানেরা স্কুলে যাচ্ছে। সেদিন স্ত্রী বললেন, দেশের রাজনীতির অবস্থা খুব একটা ভালো না। ঢাকা নাকি এখন থাকার মতো শহরও না। তা ছাড়া বাচ্চাগুলো মাত্র স্কুলে যাচ্ছে। আরেকটু বড় হোক, তরতাজা হোক। তারপর আমরা পাকাপাকি দেশে চলে যাব।

মনে পড়ে গেল লিও তলস্তয়ের বিখ্যাত ‘কতটুকু জমি দরকার’ গল্পটির কথা। সেই গল্পের মূল চরিত্র লোভী পেখোমের প্রচুর জমি প্রয়োজন। প্রচুর জমি তার চাই। পেখোমকে বলা হল, সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার আগে সে যত জমি দিয়ে হাঁটবে সব তার হবে। তবে শর্ত হল, তাকে সূর্যাস্তের আগে আবার নির্দিষ্ট জায়গায় ঠিক ফিরে আসতে হবে। লোভি পেখোম প্রাণভরে দৌড়োতে শুরু করল। কারণ প্রচুর জমি তার প্রয়োজন। প্রচুর জমির ওপর দিয়ে সে হাঁটল। এদিকে সূর্যাস্ত হয় হয়। পেখোম তখন ক্লান্ত। শরীর তার অবসন্ন। রুদ্ধশ্বাসে সে পাহাড়ের তলে নিজ সীমানায় পৌঁছানোর চেষ্টা করল। সে ফিরে এল এবং উন্মাদের মতো তার জমির ওপর আছাড় খেয়ে পড়ল। কিন্তু পেখোম আর সেই জমি থেকে উঠল না। সে চিরদিনের জন্য সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল। সেখানেই পেখোমকে কবরে শুইয়ে দেওয়া হল। ওইটুকু জমিই তার প্রয়োজন ছিল।

আমি তখন ভাবছি অন্য কথা! আমিও কি তাহলে অ্যাকোরিয়ামে রাখা মাছের মতো এই বদ্ধ রঙিন খাঁচায় আজীবন সাঁতার কেটে যাব! আর কখনোই কি সমুদ্রকে ছুঁতে পারব না? হলুদ প্রজাপতির মত আর কখনো কি আকাশে উড়োউড়ি করতে পারবো না?

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>