ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১৯) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
কুড়ুনদির কথা তো বলেছি আগেই। ওনাকে দেখেই আমার প্রথম মনে হয় কোন মানুষের সবটা ভালো বা সবটা খারাপ হয়না।মানে ভালো খারাপ বলে কাউকে দাগিয়ে দেবার মত মূর্খামি যারা করেন, তারা আমার এই কথাটা একবার ভেবে দেখলে পারেন।
ওই কুড়ুনদির বাগানে আম কুড়োতে গিয়ে তার গালাগালের হাত থেকে ছেলে বুড়ো কেউ রেহাই পায়নি।অথচ আমাদের ঠাকুমার কাছে বসে তিনি যখন চা মুড়ি খেতেন, তার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে সেকথা বোঝার উপায় ছিলনা।
আমরা ঠাকুমাকে বলতাম, “ও বাজে,ওকে চা খাওয়াও কেন? আমাদের গালাগাল দেয়।”
ঠাকুমা বলতেন, “গরীব মানুষের ওই আমটুকুনি সম্বল। তোরা নিতে যাস বলেই তো খারাপ কথা বলে।”
আমরা বুঝেও বুঝতাম না। মনেমনে ভাবতাম,কী যে বলো,পাড়ার গাছ,আমাদের বুঝি কোন অধিকার নেই?
তখন অধিকারের ব্যাপারটা নেহাত কথার কথা ছিলনা। পাড়ার মেয়ের কলকাতা শহরে বিয়ের পর কতজন যে তার শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে, পরীক্ষা দিয়ে, চাকরির পরীক্ষা বৈতরনী পার করেছে। এমনকি মেয়ে দেখানো থেকে শুরু করে, যেকোন অসুবিধায়, নিজের বাড়ি থেকে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর্ব খুব সহজেই পাড়া প্রতিবেশীরা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিত।
এসব ছিল খুবই স্বাভাবিক।মানচিত্রে যেমন অনেক রেখা দিয়ে সীমানা আঁকা হয়, অথচ বাস্তবে আমরা এক মাটি থেকে অন্য মাটিতে যাওয়ার সময় কিছুই টের পাইনা, ঠিক তেমন পাশের বাড়ির পাঁচিলের সীমানা থাকত, কিন্তু টপকে যাওয়ায় কাঁটাতারের নিষেধ ছিলনা । সব বাড়িগুলো এমন জুড়ে জুড়ে থাকত, মনে হত একটা পাড়া মানে, তার সব মানুষজন মিলে একটাই বাড়ি।প্রত্যেকেই প্রত্যেকের স্বজন,পরমাত্মীয়।
আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-১৮) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
এবার আসি এখনকার কথায়। এখন পাড়া টিঁকে আছে স্মৃতির খাতায়, পরে তার ঠাঁই হবে গল্পের পাতায়।
এখন সব টান মোবাইলে। ওই ছোট টাচ্ স্কিনে একজন আরেকজনকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।মানে টাচ্ করছে।ট্রেনে,বাসে, রাস্তায় এমনকি সভা সমিতিতেও সবার চোখ পড়ে থাকে ওই টাচ্ স্কিনে।সারাটা পথ পাশাপাশি বসেও একটাও বাক্য বিনিময় হয়না, সারাটা ছুটির দিনেও কোন কথা হয়না,এমন স্বামী স্ত্রী,ভাই বোন,বন্ধু বান্ধব আমরা ঘরে বাইরে অনবরত দেখছি। সর্বক্ষণ তারা মোবাইলে মগ্ন হয়ে আছে।আর কোনকিছুর জন্যই সময় নেই। পাড়ার মানচিত্রে এমন মোবাইল সম্পর্কের কোন গুরুত্ব থাকার কথা নয় ।
আমার এক পরিচিতের ফ্ল্যাটের নীচের তলায় দু তিনদিন ধরেই একজন বৃদ্ধ মানুষ মৃত অবস্থায় পড়েছিলেন। আবাসনের কেউ জানতে পারেনি। পচা গন্ধ বেরোতে মানুষটির দেহ উদ্ধার হয়। অভাবিত পরিস্থিতি। তবে এখন এ ঘটনা আকছার ঘটছে। কাগজ খুললেই চোখে পড়ে।
আমি ওই পরিচিতের কাছে জানতে চাই, “সে কী গো, তোমরা অতগুলো ফ্ল্যাটের অতগুলো মানুষ। কেউ কিছু টের পেলে না?”
সে হেসে বলে, “চিনলে তবে তো। আমি তো ওনাকে চিনতামই না।”
খবর নেওয়া তো পরের কথা, ঠিক নীচের তলার মানুষটির সঙ্গে একদম পরিচয় ছিলনা। এখনকার সময়ে এই কথাটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। বিশ্বাস করতে হল।
কদিন আগে কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় একটি খুনের ঘটনা ঘটে। জায়গাটা আমার এক আত্মীয়ের বাড়ির উল্টোদিকের গলিতে। আমি জানতাম,তবু আবার জানতে চাইলাম। “ওই যে স্বামী স্ত্রী খুন হলেন, ওরা তো তোমাদের পাড়ায় দীর্ঘদিন আছেন। ওদের চিনতে?”
“ না তো। ওরা তো বাইরে কম বেরোতেন। তাছাড়া কোন প্রয়োজন থাকলে তবে তো আলাপ হবে। খুন হতে জানলাম।”
অবাক হওয়ার কিছু নেই। মফস্বলেও একই অবস্থা। বড় বড় ফ্ল্যাট হয়েছে। পাশাপাশি বাড়িতে বাস। কেউ কাউকে চেনে না।
সম্পর্কহীনতার এই রোগে আমাদের পরিবারগুলোও কী আক্রান্ত হয়নি। আগে যেকোন বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এলে বাড়ির সবাই তার সঙ্গে দেখা করত। ছোটরা প্রণাম করতে আসত, বাড়ির বাকিরা কুশল বিনিময় করত।এখন সেসব পাট উঠে গিয়েছে। ছোটদের দেখা পাওয়াই যায়না। দেখা হলেও একটু হাসি বিনিময় হয়। তেমন কথাবার্তার সময় নেই। আর বড়রা? কুশল বিনিময় করতে গেলে, আগে থেকে ফোন করে সময় ঠিক করে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। না হলে তারাও হয়ত সময় দিতে পারবেন না।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।