বাঙালির ফুটবল স্বদেশি আন্দোলনের হাতিয়ার। মুহিত হাসান
বিদেশি খেলা ফুটবল বাঙালির স্বদেশি আন্দোলনে ছিল দারুণ এক হাতিয়ার। ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি প্রতিবাদ করেছিল ফুটবলের মাধ্যমেও।
হালকা রোদ্দুরমাখা এক দিন। ১৮৭৯ সাল। ভারতজোড়া ইংরেজ-রাজের শাসন। কলকাতার প্রখ্যাত ডাক্তার সূর্যকুমার সর্বাধিকারীর দশ বছর বয়সী পঞ্চম পুত্র, হেয়ার স্কুলের ছাত্র নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী তাঁর মা হেমলতার সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গঙ্গা¯স্নানে যাচ্ছিলেন সাতসকালে। এমন সময় ময়দানে, ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে দেখলেন জনাকুড়ি ইংরেজ সৈন্য একটা গোলাকৃতির বলকে ঘিরে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, মাঝমাঠে থাকা খেলোয়াড়দের লক্ষ্য হলো, কীভাবে বলটাকে নিজের বাগে আনা যায়। আর দুই পাশে দুজন দুটো জালের পাশে দাঁড়িয়ে বল যাতে ওদিকে না আসে, সে জন্য হাত উঁচিয়ে তৎপর। তবে মূল খেলার সবটাই পায়ের মাধ্যমে হচ্ছে বলে তারা মোটেও হাত লাগাচ্ছে না। বালক নগেন্দ্রপ্রসাদের কাছে এ দৃশ্য একদমই নতুন। সাহেবদের এই কিম্ভূত খেলা দেখে তিনি মায়ের নিষেধ না শুনেই গাড়ি থেকে তড়িঘড়ি নেমে এগিয়ে গেলেন ময়দানের দিকে। কাকতালীয়ভাবে তখনই কোনো এক ভুল পাসের কারণে বলটা এসে পড়ল তাঁর পায়ের সামনে। বালক তো কৌতূহলবশত তা হাতে তুলে নিয়ে অবাক! দেখতে কম বড় নয়, কিন্তু এত হালকা! পরে এক গোরা সৈন্য তাঁর কাছে ছুটে এসে বলল, ‘কিক ইট টু মি’। নগেন্দ্রপ্রসাদ তখনই বলে ‘কিক’ মেরে তা ফেরত পাঠিয়ে দিলেন সৈন্যদের দিকে। এভাবেই প্রথম কোনো বাঙালি পাদস্পর্শ করলেন ফুটবলে; মানে ফুটবল খেললেন। পরের দিন নগেন্দ্রপ্রসাদের কাছ থেকে ফুটবলের গল্প শুনে তাঁর হেয়ার স্কুলের সহপাঠীরাও আগ্রহী হলেন ফুটবল খেলতে। তাঁরা তড়িঘড়ি চাঁদা তুলে চৌরঙ্গী থেকে একটি চামড়ার তৈরি বিদেশি রাগবি বল কিনে এনে তা দিয়েই ফুটবল খেলতে শুরু করলেন স্কুলমাঠে। তাঁদের এই কাণ্ড দেখে পার্শ্ববর্তী প্রেসিডেন্সি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জি এ স্ট্যাক খানিক অবাকই হলেন। পরে তিনি তাঁদের বললেন, ফুটবল খেলায় রাগবি বল ব্যবহার করাটা শুধু হাস্যকরই নয়; বরং বিপজ্জনকও। আর খেলতে গেলে খেলার আইনকানুনও জানা দরকার। একপর্যায়ে তিনি নিজে একটি ফুটবল কিনে এনে স্কুলের ছাত্রদের খেলার নিয়মকানুন শেখাতে থাকেন। সঙ্গে যোগ দেন তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মী অধ্যাপক গিলিগ্যান।
বাঙালির প্রথম ফুটবল খেলাসংক্রান্ত উপরিউক্ত আখ্যানটি নানা জায়গায় নানাভাবে শোনা যায়, কিন্তু এর সত্যতা সম্পর্কে ক্রীড়া-গবেষকেরা নিশ্চিত নন। ঝানু ক্রীড়ালেখক মতি নন্দীও একে ‘কিঞ্চিৎ লবণসহযোগে গ্রহণের’ পরামর্শ দিয়েছেন (খেলাসংগ্রহ, পৃ. ৯০)। সে যা-ই হোক, এই আখ্যানের সত্যাসত্য যাচাই করা মুশকিল। ফলে কীভাবে প্রথম বাঙালির ফুটবল খেলার শুরু, তা নিয়ে কিঞ্চিৎ ধোঁয়াশা থেকেই যায়।
তবে শুরুর আগেও একটা শুরু থাকে, তার কথাও বলতে হবে। নতুন শাসনব্যবস্থা, অপরিচিত আইনকানুন কিংবা অভিনব কেতা-প্রথার সঙ্গে ইংরেজ শাসককুল ঔপনিবেশিক বাংলায় নিয়ে এসেছিল বাঙালির কাছে অপরিচিত এক মজার খেলা—সেটি ফুটবল। কিন্তু প্রথম দিকে সেই খেলাটি শাসক-সাহেবদের একান্ত অবসরের ব্যাপার হিসেবেই গণ্য হতো। প্রতিযোগিতার কোনো বালাই ছিল না। অবিভক্ত বঙ্গদেশ তথা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের ভূমিতে অনুষ্ঠিত প্রথম ফুটবল খেলাটি হয়েছিল ১৮৫৪ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে, কলকাতার এসপ্ল্যানেডে ওই প্রীতিম্যাচের আয়োজন করেছিল ইংরেজদের ক্লাব অব সিভিলিয়ানস। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল যে দল, তার নাম জেন্টলম্যানস অব ব্যারাকপুর। প্রথম দলে খেললেন অভিজাত সরকারি কর্তারা, দ্বিতীয় দলে শ্বেতাঙ্গ সৈন্য-নাবিকেরা। বলা বাহুল্য, দর্শকেরাও সবাই ছিলেন গোরা। কিন্তু স্থানীয়দের সেখানে ঢোকার সুযোগ হয়নি। এর পরের চৌদ্দ বছর কলকাতা বা বাংলায় কোনো প্রীতি-ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে আর খবর মেলেনি। ১৮৬৮ সালে ইটন কলেজের ইংরেজ ছাত্ররা এবং কয়েকজন ইংরেজ আমলা মিলে দুটি দল বানিয়ে একটি ম্যাচ খেলেছিলেন বলে জানা যায়। অনানুষ্ঠানিকতার খোলস ছেড়ে ইংরেজরা তত দিনে অধিকৃত অঞ্চলে ফুটবল ক্লাব গঠন করতে উদ্যোগী হয়েছে। ১৮৭৮ সালে তাদের প্রচেষ্টায় জন্ম নিল উপমহাদেশের প্রথম ফুটবল ক্লাব—ডালহৌসি।
শাসক ইংরেজদের ফুটবল-সংক্রান্ত নানাবিধ কর্মকাণ্ড ‘নেটিভ’ বাঙালির চোখ এড়িয়ে যাচ্ছিল, এমনটা নয়। এই অপরিচিত খেলাটির সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় হওয়ার পর বাঙালিদের মধ্যেও কেউ কেউ তা খেলতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। অভিজাত বাঙালি পরিবারের সন্তান নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী তেমনই একজন।
এই লেখার গোড়ায় উল্লিখিত কাহিনিটি নিয়ে আমাদের সংশয় থাকলেও ইতিহাস বেশ জোর গলাতেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, পরবর্তীকালে নগেন্দ্রপ্রসাদের উদ্যোগেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালির ফুটবল খেলার শুরু। ১৮৮৪ সালে নগেন্দ্রপ্রসাদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা পায় প্রথম বাঙালি ফুটবল ক্লাব ওয়েলিংটন। কিন্তু এক বছরের মাথায় সদস্যদের মধ্যে বিবাদের কারণে ভেঙে যায় ক্লাবটি, প্রায় ৫০০ জন সদস্য পদত্যাগ করেন ক্লাব থেকে। বিবদমান এক পক্ষ তখন টাউন ক্লাব নামে আরেকটি দল গঠন করে। এর মধ্যে নগেন্দ্রপ্রসাদের বিয়ে হলো শোভাবাজার রাজবাড়িতে। তাঁর শ্বশুরকুলের তখনো রমরমা অবস্থা। তাঁদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তাই আগের চেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ১৮৮৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন শোভাবাজার ক্লাব। বাঙালি সমাজে ফুটবল বিষয়ে আগ্রহ ক্রমে ক্রমে বিস্তারের ক্ষেত্রে এই শোভাবাজার ক্লাবের ভূমিকা তুলনাহীন। উনিশ শতকে শোভাবাজার ক্লাবের দৈনন্দিন ফুটবল-চর্চার একটা প্রাণবন্ত চিত্র এঁকেছেন ক্রীড়া-সাংবাদিক রাখাল ভট্টাচার্য তাঁর কলকাতার ফুটবল বইয়ে: ‘ (শোভাবাজার ক্লাবে) ফুটবল খেলতে তাঁদের বুটের কথা মনে উদয় হলো না। শুধু পায়ে বল শুট করার, পায়ের আঙুল দিয়ে কৌশলে বল টেনে নেওয়ার এবং আলগা পায়ে তরতর করে দৌড়বার কায়দা রপ্ত করে ফুটবলকে তারা নতুন রূপ দিল।…নিজেদের মধ্যে দল ভাগ করে খেলে, অন্য পাড়ার ছেলেদের ডেকে এনে ম্যাচে নামায়। তোড়জোড়-হাঙ্গাম-হুজ্জোতের বালাই নেই; গায়ে গেঞ্জি বা শার্ট, পরে হাফপ্যান্ট বা হাঁটুতুলে এঁটে পরা ধুতি ও বল। দুটো বাঁশ পুঁতে দু মাথায় দড়ি বাঁধলেই গোল তৈরি হয়।…’ (পৃ. ৩০)
১৮৮৯ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ফুটবল টুর্নামেন্ট ট্রেডস কাপে অংশ নেওয়া একমাত্র দেশীয় দল ছিল শোভাবাজার। পরে ১৮৯২ সালে একই টুর্নামেন্টে তারা ইংরেজ ক্লাব ইস্ট সারে রেজিমেন্টকে হারিয়ে দেয়। মূলত ওই সময় থেকেই বাংলার আনাচকানাচে ফুটবল খেলা বিষয়ে একটু একটু করে আগ্রহ ছড়াতে থাকে। বিংশ শতকের শুরুতেই সুদূর পাবনার সাতবেড়িয়া গ্রামেও লোকে দলে দলে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাচ্ছিল। সমগ্র স্মৃতিচিত্র বইয়ে নিজের খুব ছোটবেলার এমন স্মৃতির কথা লিখেছেন লেখক পরিমল গোস্বামী। এমন স্মৃতিচূর্ণের উল্লেখ থেকে ফুটবলের বিস্তার যে কতটা দ্রুত ঘটছিল এই বাংলায়, সে সম্পর্কে অল্পবিস্তর ধারণা করা যায়।
আরো পড়ুন: স্পর্ধার আলোকে মোহনবাগান । শুভজিৎ পাড়ুই
তবে পরবর্তী সময়ে ট্রেডস কাপের থেকেও বেশি মর্যাদাবান হয়েছিল যে প্রতিযোগিতা, সেই ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন শিল্ড বা আইএফএ শিল্ড জেতার সুযোগ হয়নি শোভাবাজার ক্লাবের। ১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ড ঘরে আনে শোভাবাজারের চার বছর পর (১৮৮৯) প্রতিষ্ঠিত আরেক ফুটবল দল, যারা পরে কিংবদন্তি হবে, সেই মোহনবাগান। গোরা খেলোয়াড়দের দল ইস্ট ইয়র্কসকে ২-১ গোলে সেই বছর আইএফএ শিল্ড ফাইনালে হারানোর ঘটনা এখন স্থায়ী ইতিহাস। দল হিসেবে মোহনবাগানের উত্থানের জন্য যেমন, তেমনি ইংরেজদের নিয়ে গড়া ফুটবল দলকে গো-হারানো হারিয়ে ঔপনিবেশিকতায় পিষ্ট বাঙালি সেই সময় পেয়েছিল স্বদেশিয়ানায় প্রতিরোধ গড়ার স্বাদ ও নিজেদের জন্য স্বাধীনতা আনার আত্মবিশ্বাস—সেই নিরিখেও তা ইতিহাস। ইংরেজ শাসকেরা এর আগে ভেবেছিল, ফুটবল খেলায় মাতিয়ে বাঙালিকে হয়তো স্বাধীনতার ভাবনা থেকে দূরে রাখা যাবে। কিন্তু ফুটবল দিয়েই যে বাঙালির স্বাদেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার এমন প্রকাশ ঘটবে,-তা আর কে ভেবেছিল! খেলার দিন মাঠেই ছিল এক লাখ দর্শক। সেই সময়ের পত্রপত্রিকা খেয়াল করেছিল, এই জয়ের আনন্দে কোনো ভেদাভেদ সেই, হিন্দু-মুসলমান সবাই এতে সমান আনন্দিত। ‘…দ্য জুবিলিয়ন ইন কনসিকুয়েন্স অফ ইটস সাকসেস ওয়াজ নট কনফাইন্ড টু এনি পার্টিকুলার রেস অর ক্রিড, ইট ওয়াজ আ সেন্স অফ ইউনির্ভাসাল জয়…’ —ওই ম্যাচ নিয়ে এমন মন্তব্য ছিল তখনকার দ্য মুসলমান পত্রিকার। সেই ফাইনাল ম্যাচে মোহনবাগানের খেলোয়াড়েরা খেলেছিলেন বুট ছাড়াই। উল্লেখ্য, সেই মোহনবাগান একাদশের মধ্যে দশজনই আবার ছিলেন পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’। অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি ছিলেন ঢাকার মানুষ। তাঁর ভাই রামদাস ভাদুড়ি ঢাকায় ওয়ারী ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (দুনিয়াকাঁপানো বিশ্বকাপ, শামসুজ্জামান খান, পৃ. ৮৭)। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বেশ কজন খেলোয়াড়ই তখন মোহনবাগানে খেলেছেন। রবি বোস নামে এক ঢাকাই খেলোয়াড়ের প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামও, ফলে তাঁর মাথায় চেপেছিল ঢাকা যাওয়ার খেয়াল। সেই বিবরণ পাই অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের জবানিতে: ‘কোন এক গোরা টিমকে ছ-ছটা গোল দিলো মোহনবাগান। রবি বোস নামে নতুন এক খেলোয়াড় এসেছে ঢাকা থেকে, এ তারই কারুকার্য।…মোটকথা, ঢাকার লোক যখন এমন অসাধ্যসাধন করলো, তখন মাঠ থেকে সিধে ঢাকায় না যাওয়ার কোনো মানে হয় না।…সুতরাং খেলার মাঠ থেকে সোজা শেয়ালদা এসে ঢাকার ট্রেন ধরলো তিনজন: দীনেশরঞ্জন, নজরুল আর নৃপেন।…’ (কল্লোল যুগ, পৃ. ১৬৬-১৬৭)
মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের পর বাঙালির ফুটবল বিষয়ে আগ্রহ কেমন বেড়েছিল, তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে সেই সময়ের পঞ্জিকার পাতায়। পঞ্জিকায় প্রাপ্ত ফুটবল ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের বিজ্ঞাপন থেকে ফুটবল ইতিহাসের নতুন তথ্য আহরণ করা ফুটবল-গবেষকদের পক্ষে অসম্ভব নয়। ১৯১৪-এর বঙ্গবাসী পঞ্জিকায় ‘নূরজাহান ফুটবল’-এর বিজ্ঞাপনে দেখতে পাই সগর্ব ঘোষণা: ‘নূতন আমদানী এই নূরজাহান ফুটবল ক্রয় করুন। এই বৎসর একমাত্র আমরাই এই বল বিলাত ও আমেরিকা হইতে আমদানী করিয়া মফস্বলবাসী গ্রাহকগণের জন্য মজুত রাখিয়াছি।’ আবার পাশেই একই কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন নিজেদের তৈরি ‘স্বদেশী ফুটবল’-এর: ‘আমরা এই ফুটবল প্রচুর পরিমাণে তৈয়ারি করাইয়া অতি সুলভ মূল্যে বিক্রয় করিতেছি। এই ফুটবল খুব ভাল এবং মজবুত আট প্যানেল চামড়ায় প্রস্তুত।’ ইস্ট বেঙ্গল স্টোর নামে আরেকটি দোকান বিজ্ঞাপনে জানিয়েছে, তাদের কাছে পাঁচ রকমের ফুটবল আছে, সেগুলো যথাক্রমে এমন নামধারী: ‘স্যাটিসফ্যাকশন বল’, ‘হিরো বল’, ‘সিল কক্স মেগ্রেগার বল’, ‘স্যান্ডো বল’ ও ‘ট্রিপোলি ম্যাচ বল’! ওই একই পঞ্জিকায় নজরে আসে আট আনা দামের ‘ফুটবল শিক্ষা প্রণালি’ শীর্ষক একটি বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপন। আছে নানা রকম ফুটবল-ব্লাডার ও পাম্পারের বিজ্ঞাপনও।
মোহনবাগানের কথার সূত্র ধরে ইস্ট বেঙ্গল দলের প্রতিষ্ঠার আখ্যানও আনুষঙ্গিকভাবে চলে আসবে। কিন্তু আশ্চর্য কাণ্ড এই, মোহনবাগানের সঙ্গে যতই রেষারেষি খেলার মাঠে তৈরি হোক, ইস্ট বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাপর্বে এমন কিছুই আদতে ছিল না। উপরন্তু ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব তৈরির পেছনে মোহনবাগানের বিদ্বেষ কাজ করেছিল, এমন ঘটনারও সত্যতা পাওয়া যায় না।
মুন্সিগঞ্জের মালখানগরের সন্তান শৈলেশ বসু চাকরি ছেড়ে ফুটবল খেলতেন, জোড়াবাগান ক্লাবের এক কর্মকর্তা সুরেশ চৌধুরীর অনুরোধে তিনি সেখানে খেলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এক সেমি ফাইনাল ম্যাচে তাঁকে এবং আরেক বাঙাল নসা সেনকে না খেলানোয় তাঁরা এতে ‘বাঙাল-বিদ্বেষের’ গন্ধ পান। পরে তাঁদের ফাইনালে খেলানো হলেও দল হেরে যায়। তখন ক্লাবের ঘটি-প্রশাসকেরা হারের জন্য দুই বাঙালকেই দায়ী করেন। পরে সুরেশ চৌধুরী রাগে-ক্ষোভে ও অপমানে দলের পদ থেকে সরে আসেন, শৈলেশ-নসাকে সঙ্গে নিয়ে। ১৯২০ সালে তাঁরা তিনজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব। এ যেন ক্ষিপ্ত-অবহেলিত বাঙালদের আরেক রকম স্বদেশিয়ানার প্রকাশ (গোল্লাছুট, কাশীনাথ ভট্টাচার্য, পৃ. ৩২-৩৩)!
বাঙালির ফুটবল ইতিহাসের সঙ্গে স্বদেশিয়ানার সংযোগ নতুন নয়। শোভাবাজার ক্লাবের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে মোহনবাগানের উত্থান, ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহ থেকে শুরু করে মোহামেডান ক্লাবের ভিন্ন পায়ে পথ হাঁটা—সবকিছুর সঙ্গেই স্বদেশিয়ানার বহু রূপ বিচিত্র মাত্রায় সংযুক্ত। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিদ্রোহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল এই বিদেশি খেলাটি। তবে যে বাঙালি একসময় দেশীয় ক্লাব ফুটবলকে নিজের স্বদেশিয়ানা ও সংগ্রামের প্রতীক করে তুলেছিল (আজকেও স্বনামখ্যাত ফুটবল-বিশারদ নভি কাপাডিয়া বলতে বাধ্য হন যে বাংলা হলো উপমহাদেশের ফুটবলের ‘এল ডোরাডো’ বা স্বর্গসম ভূমি), সেই বাঙালির কাছেই কি আজ স্বদেশের ফুটবল নিছক ব্রাত্য হয়ে পড়েছে? এই প্রশ্ন তুলে এখন নিজেদেরই বিব্রত করার সময় এসেছে।