রাষ্ট্রের স্বভাব-ধর্ম হচ্ছে নিজের আত্মরক্ষার সমুচিত ব্যবস্থা করা। আর সেই জন্য কোনো একটা রাষ্ট্র একবার বাস্তব রূপ ধারণ করলে, তার পরিচালকদের প্রথম চেষ্টা হয় দেশের আত্মরক্ষামূলক (militarily defensible frontiers) ব্যবস্থা করা। আত্মরক্ষার ক্ষমতা যদি রাষ্ট্রের না থাকে, তা হলে সে প্রতিষ্ঠান এই স্বার্থপ্রধান জগতে স্থায়িত্ব লাভের আশা করতে পারে না। বর্তমান শতাব্দীর দু’ দু’টো মহাসমরের ব্যাপারে এ সত্যের প্রমাণ আমরা নিত্য প্রত্যক্ষ করেছি।
ভারতবর্ষের মানচিত্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সহজেই বোধগম্য হয় যে, আকারে বড় হলেও, এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে প্রকৃতি দেবী একটি অখণ্ড দেশ করেই সৃষ্টি করেছেন। আত্মরক্ষামূলক সীমান্তের কথা তুললেই, আমাদের দৃষ্টি পড়ে খাইবার গিরিবর্ত্মের দিকে, হিমালয়ের অভ্রভেদী প্রাকারশ্রেণীর দিকে, আসামের দুর্গম পার্বত্য-ভূমির দিকে, আর দক্ষিণের অন্তহীন সমুদ্রের দিকে। এই সবই হল প্রকৃতি রচিত সেই আত্মরক্ষার কৌশল যাদের দরুন ভারতবর্ষ এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য অংশ থেকে স্বাভাবিক স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে। এদের সাহায্যেই ভবিষ্যতে ভারতবাসী বৈদেশিক শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার সহজ এবং কার্যকর ব্যবস্থা করতে পারে।
ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজ্য এবং প্রদেশগুলির মধ্যে প্রকৃতি রচিত সেরূপ কোনো দুর্ভেদ্য ব্যবধান নাই। অবশ্য উত্তর ভারত অথবা হিন্দুস্থান এবং দাক্ষিণাত্যের বিস্তীর্ণ ত্রিকোণকে বিভক্ত করে বিন্ধ্যাচলের পর্বতমালা দাঁড়িয়ে আছে; এবং সেই জন্যই ভারতবর্ষের এই দুই প্রধান অংশের মধ্যে যাওয়া-আসা কতকটা কষ্টসাধ্য। তবে প্রকৃতি-রচিত এই প্রাকারশ্রেণীর মধ্যে অনেক ফাঁক এবং ফাটল রয়ে গেছে; তাই রামচন্দ্রের যুগ থেকে ইংরেজদের আমল পর্যন্ত বিন্ধ্যাচলের প্রাকার কোনো দিগ্বিজয়ীর পথ রোধ করতে কিংবা তার অভিযান ব্যর্থ করতে সমর্থ হয়নি। অনেকে বলতে পারেন, খাইবার গিরিবর্ত্মও তো বৈদেশিক শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। আর্যদের সেই সুদূর যুগ থেকে আহমদ শাহ আবদালির যুগ পর্যন্ত এই খাইবার-গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করেই বৈদেশিক শত্রু ভারতবর্ষের সমতল ভূমিতে প্রবেশ করেছে; সে কথা অবশ্য অস্বীকার করবার উপায় নাই। তবে এ কথা অন্তত আমরা সহজে বলতে পারি যে, ভারতবাসীর পক্ষে বৈদেশিক শত্রুকে খাইবার গিরিবর্ত্মের মুখে ঠেকিয়ে রাখা ভারতের অন্য কোনো স্থানে তার গতিরোধের চেয়ে অনেকখানি সহজসাধ্য কাজ। তারপর ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশের লোকদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য করলে সত্যই মনে হয়, প্রকৃতি দেবী যেন ভারত-রক্ষার সমস্যার কথা ভেবেই দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে সেইসব দুর্ধর্ষ যুদ্ধকুশল জাতিকে স্থাপিত করেছেন — যাদের বাহুবল প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এ দেশের রক্ষাকবচ হয়ে আছে। সব দিক থেকে বিচার করলে, মনে এ ধারণা অতি সপষ্ট হয়ে ওঠে যে, আত্মরক্ষার প্রাকৃতিক কুশলতার দিক থেকে ভারতবর্ষ এক অখণ্ড দেশ। সুতরাং রাষ্ট্রের হিসাবে ভারতবর্ষকে এক অখণ্ড মহারাষ্ট্ররূপেই দেখতে এবং ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে এ কথাও ভুললে চলবে না যে, উত্তর-পশ্চিম ভারতের যুদ্ধকুশল জাতিগুলিকে যদি দেশের প্রহরী রূপে গ্রহণ না করা হয়, তাহলে বাহুবলের প্রভাবে তারা শেষে দেশের মালিকের স্থান অধিকার করবে।
তবে মানুষ যন্ত্র নয়। তার রাষ্ট্রজীবনের আলোচনায় কেবল দুর্ভেদ্য সীমান্ত আর তার যুদ্ধকুশলতার কথা ভাবলেই চলবে না। এই যে সীমান্ত-প্রহরীর কথা ভাবতে হয়, এ থেকেই বোঝা যায় যে, লোভ, লালসা, দ্বেষ, হিংসা, রাগ, বিরাগ প্রভৃতি বিভিন্ন রিপুর তাড়নাতেই মানুষের জীবন পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়। তাছাড়া সামরিক বিশেষজ্ঞেরা যাই বলুন, রাষ্ট্রের সবচেয়ে মজবুত আত্মরক্ষার উপায় হল রাষ্ট্রবাসীদের অন্তরের স্নেহ, প্রীতি এবং ভালবাসা। সাধারণ রাজনীতিকরা এই মহাসত্যকে উপেক্ষা করেন বলেই রাষ্ট্রে অন্তর্বিপ্লব এসে দেখা দেয়, আর তার ফলে আত্মরক্ষার বিধি-ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, পরীক্ষার বেলায় রাষ্ট্র ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়।
সর্বদেশের সর্বমানব মিলে পরসপরের প্রেম আর ভালবাসার ভিত্তিতে যদি এই পৃথিবীতে এক অখণ্ড রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারত, তা হলেই সেই হত আমাদের আদর্শ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সে রাষ্ট্রে দ্বেষ-হিংসা, দ্বন্দ্ব-কলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতি অপ্রীতিকর জিনিস কিছুই থাকত না। পরসপরের মঙ্গল সাধনের জন্য, পরসপরকে সাহায্য দানের জন্য সকলেই উদগ্রীব থাকত; মানুষের সেবা করতে পারলে মানুষ নিজেকে ধন্য মনে করত; বিশ্বময় বিরাজ করত সুখ আর শান্তি, প্রেম আর প্রীতি, সেবা আর কৃতজ্ঞতা। এই পৃথিবীই তাহলে স্বর্গ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। হবার কোনো সম্ভাবনাও আপাতত দেখা যাচ্ছেনা। এ কারণ কি?
মানুষ অন্ধকার থেকে আলোয় আসবার চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু এখনও সে অন্ধকারেই আছে। সঙ্কীর্ণতার বাঁধ অতিক্রম করবার চেষ্টা সে করছে বটে, কিন্তু এখনও সঙ্কীর্ণতা তার অন্তরকে দৃঢ়ভাবে ঘিরে আছে। পরের ছেলেকে সে ভালোবাসার চেষ্টা করে বটে, কিন্তু নিজের ছেলেকেই সে বেশি ভালোবাসে; বিদেশীর সঙ্গে, বিজাতীয়দের সঙ্গে সে সহানুভূতি দেখায় বটে, কিন্তু স্বদেশীয়দের প্রতি এবং স্বজাতীয়দের প্রতিই তার অন্তরের টান বেশি; সর্বধর্মের এবং সর্বকৃষ্টির প্রতি সে উদারতা দেখাবার চেষ্টা করে বটে, কিন্তু নিজের কৃষ্টি এবং ধর্মকেই সে অন্তরের সঙ্গে ভালবাসে। মানুষের মনের এই স্বাভাবিক সঙ্কীর্ণতা থেকেই বিভিন্ন দলের, সম্প্রদায়ের এবং গণ্ডীর সৃষ্টি হয়। আর তাই থেকে আসে যত দ্বন্দ্ব আর বিগ্রহ, বিরোধ আর অশান্তি।
রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে আত্মীয়তা। একই গোত্রের লোককে নিয়ে সুদূর কোনো অতীত যুগে মানুষের রাষ্ট্রীয় জীবন আরম্ভ হয়েছিল। গোত্রপ্রীতির প্রভাব এখনও প্রত্যেক রাষ্ট্রে গভীরভাবে অনুভূত হয়। তবে গোত্রীয় ঐক্য এখন আর রাষ্ট্রীয় জীবনে অপরিহার্য নয়। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যাণ্ড প্রভৃতি উন্নতিশীল রাষ্ট্রে কোনোরূপ গোত্রীয় ঐক্য নাই। বর্তমান যুগে ধর্মগত ঐক্যেরও প্রয়োজন দেখা যায় না। আধুনিক অধিকাংশ রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের লোক একত্রে বাস করেন। গোত্রীয় এবং ধর্মীয় ঐক্যের স্থানে এখন অন্যবিধ ঐক্য এসে দেখা দিয়েছে। যথা — ১) কৃষ্টিগত ঐক্য; ২) ভাষামূলক ঐক্য; ৩) স্বার্থসম্বন্ধীয় ঐক্য; এবং ৪) আদর্শমূলক ঐক্য। প্রকৃতপক্ষে ব্যবহারিক ধর্মের এবং গোত্রমূলক আত্মীয়তার স্থান এখন এই শেষোক্ত বন্ধনগুলিই দখল করেছে। এই বন্ধনগুলির সঙ্গে ভৌগোলিক ঐক্যের বন্ধন জুড়ে দিলেই একটা আধুনিক জাতির সৃষ্টি হয়। ভারতের জাতীয়তার সৌধকেও এই শ্রেণীর ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অবশ্য রাষ্ট্রগঠনের বেলায় সীমান্তরক্ষা-ব্যবস্থার কথাও মনে রাখা চাই।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা যে অনেক সময়ে ব্যর্থ হয়, প্রচীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠান যে অনেক সময়ে অন্তর্বিপ্লববশত আপনা থেকেই ভেঙে পড়ে, তার কারণ কি? একটু অনুসন্ধান করলেই দেখতে পাই, ঐক্যের যে সূত্রগলি আমরা উল্লেখ করেছি তাদের সবগুলির কিংবা কতকগুলির অভাব হয়েছিল বলেই সেরূপ ঘটেছে; ঐক্যের স্থানে তাই অনৈক্য এসে দেখা দিয়েছে, মৈত্রীর স্থানে দ্বন্দ্ব এসে দেখা দিয়েছে, সহযোগের স্থানে অসহযোগ দেখা দিয়েছে, আর তারই ফলে রাষ্ট্রসৌধ ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।
প্রথম মহাসমরের পূর্বেকার অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্য পৃথিবীর অন্যতম প্রবল প্রতাপশালী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার রূপেই গণ্য হত। অথচ পরীক্ষার বেলায় সে সাম্রাজ্য টিকল না; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে গেল। তুরস্ক সাম্রাজ্যেরও সেই দশা ঘটল। সেই একই পরীক্ষায় জার্মান রাষ্ট্র কিন্তু টিকে রইল। অস্ট্রিয়ান এবং তুরস্ক সাম্রাজ্যদ্বয়ের অভ্যন্তরীণ জীবনে সেই কৃষ্টিগত, ভাষাগত, স্বার্থগত এবং আদর্শগত ঐক্য ছিলনা — যা সঙ্কটের সময়ে তাদের বাঁচাতে পারত। জার্মান সাম্রাজ্যে সে ঐক্য প্রভূত পরিমাণেই ছিল। জার্মানি তাই টিকে থাকল।
আমাদের দেশের ইতিহাস খুললে দেখতে পাই, অখণ্ড ভারতীয় সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব কেন্দ্রীয় শক্তির বাহুবলের প্রাচুর্যের উপরেই নির্ভর করেছে, জাতির অন্তরের ঐক্যের উপরে নির্ভর করেনি। কেন্দ্রীয় শক্তিতে যখনই বাহুবলের অভাব ঘটেছে, অখণ্ড অন্তরের ঐক্যের অভাবে দেশ তখনই বিভিন্ন খণ্ড-রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। যে অন্তরের ঐক্যের উপরে একটি রাজ্যের স্থায়িত্ব নির্ভর করে সে ঐক্য অখণ্ড ভারতবর্ষে কখনও দেখা দেয়নি। আর তাই কেন্দ্রীয় শক্তি যখনই দুর্বল হয়েছে, স্বাভাবিক ঐক্যের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন খণ্ড-রাষ্ট্রগুলি তখনই মাথা তুলেছে।
ভারতবর্ষে স্থায়ী রাষ্ট্রসংগঠন করতে হলে দুটি জিনিসের দিকে লক্ষ্য রাখা, আর রাষ্ট্রজীবনে তাদের উভয়বিধ প্রয়োজন পরিপুরনের সুব্যবস্থা করা একান্ত দরকার। চতুর্দিকের প্রাকৃতিক সীমান্তের দিকে লক্ষ্য রেখে সমস্ত ভারতবর্ষে এক সমিমলিত রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠান গঠন করার দরকার; এবং অন্তরের স্বাভাবিক সহানুভূতির দিকে লক্ষ্য রেখে কৃষ্টিগত (কালচার), ভাষাগত মিল ও ঐক্যের ভিত্তির উপর দেশে বিভিন্ন খণ্ড-রাষ্ট্রের বা উপরাষ্ট্রের সৃষ্টি করার দরকার। এইভাবে অগ্রসর হলে, ভারতের ভবিষ্যত রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় আমরা সাম্রাজ্যের শক্তি, আর জাতীয় জীবনে সুখ-শান্তি নৈতিক বল ও আত্মিক প্রেরণা-উভয়বিধ সুবিধাই লাভ করতে পারব। একের মধ্যে বহুত্ব, আর বহুর মধ্যে একত্ব — এই উভয়বিধ মঙ্গলের সমাবেশে আমাদের জাতীয় জীবন অভিনব ঐশ্বর্য লাভ করবে।
দেশপ্রেম আমাদের যতই উগ্র হোক না কেন, বাস্তবতাকে ভুলে রাষ্ট্র গড়তে গেলে আমরা মারাত্মক ভুল করব। কেননা, একমাত্র বাস্তবতাই হল আদর্শ-সৌধের প্রকৃত ভিত্তি। সেই বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সহজেই আমরা বুঝতে পারব, সমস্ত ভারতবর্ষকে এক অখণ্ড কেন্দ্রীয় শাসনের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস শেষ পর্যন্ত অসন্তোষ এবং ব্যর্থতাই এনে দেবে। কেননা, সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে ভাষার ঐক্য নাই, কৃষ্টির ঐক্য নাই, স্বার্থের ঐক্য নাই, ধর্ম এবং গোষ্ঠীর ঐক্যও নাই। এরূপ ক্ষেত্রে কৃত্রিম উপায়ে একটা বাহ্য একতানয়নের প্রয়াসে সমাজের অন্তর্নিহিত অনৈক্য আরও সপষ্টতর হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক; আর হচ্ছেও তাই। দৈনন্দিন রাজনৈতিক প্রয়োজন ও সামরিক স্বার্থের তাগিদে জোর করে ঐক্যের অনুভূতি আনা যায় না। তার জন্য দরকার অন্তরের ভালবাসা, অন্তরের সহানুভূতি, অন্তরের আকর্ষণ — আর দরকার স্বার্থ এবং আদর্শের ঐক্যানুভূতি।
তবে নিরাশ হওয়ার প্রয়োজন নেই। অতীত ইতিহাসের আলোচনা করলে দেখতে পাব, দুর্দিনে ভারতবর্ষ মোটামুটিভাবে এবং সাধারণত এমন কতকগুলি খণ্ড-রাষ্ট্রে বিভিক্ত হয়েছিল যাদের প্রত্যেকের মধ্যে জাতীয় (national) জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলি প্রত্যক্ষভাবে অথবা সুপ্তাবস্থায় বিরাজ করেছে। ’মোটামুটিভাবে’ এবং ’সাধারণত’ বলার তাৎপর্য এই যে, রাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনো জিনিসই ঠিক যৌক্তিকতার নিক্তির উপর নির্ভর করে বন্টিত বা নিরূপিত হয়না। তবে বিভিন্ন প্রভাবের, বিভিন্ন গতির একটা মোটামুটি ফল জাতির জীবনের খাতায় তার অঙ্ক কষে যায়।
ভূগোল, ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি বিভিন্ন দৃষ্টিকেন্দ্র থেকে বিচার করলে, ভারতবর্ষে স্বাভাবিক কয়েকটি ভৌগোলিক বিভাগ দেখতে পাওয়া যায়। যথা — বঙ্গদেশ, হিন্দুস্থান, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্থান, সিন্ধুদেশ, মহারাষ্ট্র-দেশ ইত্যাদি। এইসব ভূখণ্ডের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব কৃষ্টি, নিজস্ব ইতিহাস, নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, নিজস্ব অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা আছে। এই ভূখণ্ডগুলির নিজ নিজ বিশেষত্বের দিকে লক্ষ্য করলে, এদের প্রদেশ না বলে এক একটি রাষ্ট্র বা উপরাষ্ট্র বললেই সঙ্গত হয়। ভারতের ভবিষ্যত রাষ্ট্রতন্ত্রে এই বিভিন্ন উপরাষ্ট্রগুলির বিশেষত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণশীল এক একটি রাজ্যের (Dominion) অধিকার দেওয়া দরকার অবশ্য তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহের সম্পর্কে। আর ভারত-রক্ষার জন্য এবং বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতি চালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্রের সৃষ্টি করা দরকার। এই পথে গেলেই আমরা ভারতবর্ষে স্থায়ী এবং বর্তমান জীবনের বাস্তব প্রয়োজনের উপযোগী রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রবর্তন করতে পারব। ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবনের গতি-প্রকৃতি ও ধারাবাহিক ক্রমবিকাশ আমাদের সেই নির্র্র্র্দেশই দিয়ে থাকে।
প্রাকৃতিক কারণে ভারতবর্ষ যে কয়টি সুনির্দিষ্ট খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে তাদের মধ্যে আমাদের বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের কি কি বিশেষত্ব আছে যে-জন্য ভারতের অন্যান্য দেশ থেকে সে স্বতন্ত্র এক আকার ধারণ করেছে, এখন তার আলোচনা করা যাক।
প্রথম যে বৈশিষ্ট্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটি হচ্ছে ভাষাগত ঐক্য। এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলে একই ভাষা ব্যবহার করে; আর সেটি হচ্ছে বাংলা ভাষা। দ্বিতীয়ত, এদেশের বিভিন্ন ধর্মের রোকের মধ্যে মোটামুটিভাবে এমন একটা কুলগত ঐক্য আছে, যে-জন্য, কে কোন ধর্মের লোক, সহজে তা চেনা যায় না; পক্ষান্তরে, যে কোনো বাঙ্গালীকে যেকোনো অবাঙ্গালী থেকে সহজেই পৃথক করে লওয়া যায়। এখানে দ্রাবিড়, আর্য, মোঙ্গল, সেমিটিক প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির শত শত বৎসরের সংমিশ্রণের ফলে অভিনব অথচ সুনির্দিষ্ট এক জাতির উদ্ভব হয়েছে, যাকে আধুনিক বাঙ্গালী জাতি বলা যেতে পারে। আর সেই বাঙ্গালী জাতির এমন কতকগুলি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে যে-জন্য ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোক থেকে সহজেই তাদের পৃথক করে নেওয়া যেতে পারে। যথা — বাঙ্গালী শান্তিপ্রিয়; যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি কাটাকাটি সে ভালবাসে না। বাঙ্গালী বুদ্ধিমান, ভাবপ্রবণ — সঙ্গীত, সাহিত্য, কলাবিদ্যা প্রভৃতিকে অন্তরের সঙ্গে সে ভালবাসে; ধর্মের বিষয়ে সে উদার মত পোষণ করে; গোঁড়ামি সে মোটেই পছন্দ করে না। বিদেশের আমদানি করা কৃত্রিম উত্তেজনা কখনও কখনও বাঙালির মনে ধর্মের গোঁড়ামির সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু সে মনোভাব বেশি দিন স্থায়ী হয়না। কেননা, ধর্ম বিষয়ে সঙ্কীর্ণতা বাঙ্গালীর প্রকৃতিবিরুদ্ধ। নূতনের প্রতি একটা স্বাভাবিক ভালবাসা বাঙ্গালী তার অন্তরে পোষণ করে। নূতন ভাব, নূতন প্রথা, নূতন আদর্শকে নূতন বলেই সে বর্জন করে না, পক্ষান্তরে যাচাই করে নূতনের মূল্য নিরূপণ করতে চায়। কায়িক পরিশ্রমের চেয়ে ভাবের চর্চাই বাঙ্গালীর বেশি প্রিয়। সুযোগ এবং সুবিধা পেলেই সে কাজকর্ম ছেড়ে ভাবের চর্চায় বিভোর হয়ে যায়। নাগরিক জীবনের চেয়ে বাঙ্গালী পল্লিজীবন ও স্বভাব-সৌন্দর্যকে বেশি পছন্দ করে। বাংলার ইতিহাস ধর্মের উৎকট দ্বন্দ্বে কলঙ্কিত নয়। বাংলার হিন্দু ও মুসলমান সহজে এবং স্বচ্ছন্দে পাশাপাশি বাস করে। আর গত হাজার বৎসরের ইতিহাস তাদের মধ্যে এক নিবিড় আত্মিয়তা এবং ঐক্য স্থাপন করেছে। তাদের এক জাতি বলতে এখন আর দ্বিধা বোধ হয়না। বাঙ্গালী জাতির অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং সমস্যা এক। আর বাঙ্গালীর অর্থনৈতিক স্বার্থ ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকের অর্থনৈতিক স্বার্থ থেকেও ভিন্ন। প্রকৃতি দেবীই স্বার্তের এই বৈষম্য সৃষ্টি করেছেন। হিন্দু এবং মুসলমান — এই দুই প্রধান ধর্মসম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা এবং প্রভা-প্রতিপত্তি এদেশে প্রায় সমান-সমান। তাই এক সম্প্রদায়ের উপর অন্য সম্প্রদায়ের প্রভুত্বের সমস্যা প্রকৃতপক্ষে এদেশে উঠেনা। তারপর ইউরোপীয় সভ্যতার সঙ্গে দীর্ঘ এবং ঘনিষ্ঠ সংস্যবের ফলে বাংলাদেশে এমন এক কৃষ্টি এসে দেখা দিয়েছে যার দৃষ্টি স্বভাবতই ভবিষ্যতের দিকে এবং বিশ্বামানবতার দিকে। পশ্চাতমুখী সাম্প্রদায়িক কৃষ্টি সব ক্ষেত্রেই পিছে হটে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ভাব (Democratic) ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে বাঙালিই গণতান্ত্রিকতা এবং জাতীয়তাবাদের প্রধান এবং বিশ্বস্ত সমর্থক।
আমাদের মনে হয়, প্রকৃতি দেবী — নিত্য নূতনের সৃষ্টিতেই যাঁর প্রধান আনন্দ — ভারতের এই পূর্ব ভূখণ্ডে নূতন এক জাতির, নূতন এক সভ্যতার, নূতন এক জীবনধারার, নূতন এক কৃষ্টির, নূতন এক আদর্শের সৃষ্টিপ্রয়াসে নিরত আছেন। অতীতের বিভিন্ন উপকরণের অভিনব সংযোগে বাঙ্গালীর জীবন নিয়ে তিনি এক নূতন শিল্প-নিদর্শনের সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেছেন। যাদের সাহায্যে তিনি এই নূতন রূপ-রচনায় রত আছেন, সে জাতির এখনও তার ভবিষ্যতে গৌরবের বিষয়ে অবহিত হয়নি বটে, তবু মানুষ যেমন ভবিষ্যত সৌভাগ্যের আভাস তার অবচেতনায় পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, অথচ সে উল্লাসের কারণ সপষ্ট বুঝতে পারে না — এই বাঙ্গালী জাতিও তেমনি ভবিষ্যত গৌরবের অসপষ্ট ইঙ্গিত তার অবচেতনায় পেয়ে এক অব্যক্ত আনন্দানুভূতি অনুভব করছে, নূতন কিছুর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে, অভিনব কিছুর সন্ধানে দিশেহারা হয়ে ফিরছে; অথচ কেন যে এমন হচ্ছে, তা ঠিক তারা বুঝতে পারছে না। আর তাই মামুলি ধরনের রাজনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি নিয়ে বাঙ্গালী সন্তুষ্ট হতে পারছে না; মামুলি ধরনের রাজনীতিক এবং সমাজনীতিকরা তার অন্তর যেন সপর্শ করতে পারছে না। সপষ্টভাবে উপলব্ধি না করেও, বাঙ্গালী ভবিষ্যতের পূর্ণতর রাজনীতির জন্য প্রতীক্ষা করছে — একটা সম্পূর্ণ কৃষ্টির জন্য, একটা পরিপূর্ণ জীবনাদর্শের ও পূর্ণতম বিকাশের জন্য যেন বাঙ্গালী এখনও অপেক্ষমান। রাষ্ট্রজীবনের যে পরিকল্পনা, সামবায়িক জীবনের যে ছবি বাংলাদেশের বাইরের ভারতবাসীকে সন্তুষ্ট করে, এই ভাবপ্রবণ কল্পনাকুশল জাতি সে আদর্শ, সে ছবি, সে পরিকল্পনা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না। তার কুহেলিকা-সমাচ্ছন্ন নিগূঢ় অবচেতনায় মহামানবতার মহত্তর এক আদর্শ, পূর্ণতর এক পরিকল্পনা, সুন্দরতর এক ছবি রূপ পরিগ্রহ করতে আরম্ভ করেছে। অদূর ভবিষ্যতে সেই মহনীয় আদর্শ, সেই পরিপূর্ণ পরিকল্পনা, সেই অপরূপ ছবি তার মনে সপষ্ট হয়ে উঠবেই, আর তার প্রভাবে বাঙ্গালী এক অভিনব জীবনের আস্বাদ পাবে; এবং সেই শুভ দিন যখন আসবে তখন বাঙ্গালী কেবল ভারতবর্ষের নয়, কেবল প্রাচ্য-ভূখণ্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হবে — সত্য, সুন্দর, শুভ জীবনপথের। বাঙ্গালী এখন সেই মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে যিনি তাকে এই গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবেন — ভগীরথের মতো এই বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম সুসপষ্ট করে তুলবেন।
আরবের কবি বলেছেন, “কবিরা হচ্ছেন অদৃশ্য মহাশক্তির ভাষ্যকার।” অতি সত্য — অতি মূল্যবান কথা। বাংলার গৌরবময় ভবিষ্যত — মন্ত্রীরা কিংবা ব্যবস্থাপক সভার সভ্যেরা কিংবা রাজনীতিকরা গঠন করবেন না; সে কাজ করবেন-দেশের সত্যকার কবি, মনীষী ও সাহিত্যিকরা। যে অদৃশ্য মহাশক্তির মানবজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করছেন তিনি ব্যবসাদার রাজনীতিকের স্থূল অনুভূতিতে বা তাঁর সঙ্কীর্ণ সীমাবদ্ধ মনের ক্ষেত্রে নিজেকে প্রকাশ করেন না; তিনি আত্মপ্রকাশ করেন ভাবুকের উদার মনে, তার বেদনা-করুণ প্রাণে, তার সুদূর-প্রসারিণী প্রজ্ঞার জগতে। বাংলার কবিদের, বাংলার সাহিত্যিকদের বর্তমানের সীমাবদ্ধ স্বার্থ-ঝটিকার ঘাতপ্রতিঘাতে বিক্ষুব্ধ, সাম্প্রদায়িকতার হিংসা-বিদ্বেষ, হীনতা এবং সঙ্কীর্ণতার বিষবাষ্পে ভারাক্রান্ত বর্তমানকে ছেড়ে, কল্পনার বিমানে চড়ে ভবিষ্যতের মনোরম উদ্যানে চলে যেতে হবে — জাতির গৌরবোজ্জ্বল অনাগত জীবন দেখবার জন্য; আর প্রতিভার তুলিকায় তার ছবি বর্তমানের নৈরাশ্যক্লিষ্ট বাঙালির জন্য আঁকবার উদ্দেশ্যে; এবং আশায় উদ্দীপ্ত সাহিত্যের, সঙ্গীতের ও শিল্পের সাহায্যে সেই গৌরবময় অনাগত যুগে অভিযানের জন্য তাকে অনুপ্রাণিত করতে। আমাদের কবিদের, আমাদের সাহিত্যিকদের, আমাদের শিল্পীদের, আমাদের ভাববাদীদের, আমাদের আদর্শবাদীদের সত্যই এখন ভবিষ্যতবাদী হতে হবে; কিম্ভুত-কিমাকার কোনো পরিকল্পনাকে রূপায়িত করবার জন্য নয়, জাতিকে আমরাবতীর দ্বারে পৌছে দেবার জন্য, সেই আমরাবতীর কথা তাদের শোনাবার জন্য, আর সেই আমরাবতীর স্বপ্ন তাদের মনে জাগিয়ে তোলবার জন্য।
আমি এক শতাব্দী পরবর্তী যে বঙ্গদেশের স্বপ্ন দেখি, তা বর্তমানের ধূলি-ধূসরিত, বন-জঙ্গল-আগাছা-সমাকীর্ণ, শ্রীহীন, সৌন্দর্যভ্রষ্ট ঘর-বাড়িতে ভরা, হত-গৌরব নদ-নদীর খঅতের দাগে কলঙ্কিত বঙ্গদেশ নয়। আমি শতাব্দী-পরের যে বাঙ্গালী জাতির স্বপ্ন দেখি সে বর্তমানের ক্ষীণকায়, মাংসপেশীহীন, রোগ-বিশীর্ণ, অনশনক্লিষ্ট, গতশ্রী, আনন্দহীন, প্রেরণাহীন, কলহপ্রিয় বাঙ্গালী পুরুষের নয়। আমি যে বাঙ্গালী জাতির ছবি দেখি সে বর্তমানের ভারাতুর, লজ্জা-কাতর স্বাস্থ্যহীন, শ্রীহীন, সৌষ্ঠবহীন, খর্বকৃতি, শীর্ণকায় বাঙ্গালী নারীর নয়। আমি যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখি, তাতে কেরানি-সৃষ্টির আগ্রহ নাই; গোড়া হিন্দু, গোঁড়া মুসলমান সৃজনের উৎকট প্রয়াসও নাই — অতীতের প্রাণহীন দেহগুলি সাজিয়ে রাখবার জাদুঘর সে প্রতিষ্ঠান নয়। আমি ভবিষ্যতের যে রাজনীতির স্বপ্ন দেখি তাতে চাকুরির ভাগ-বাঁটোয়ারার কলহ নাই; স্বার্থসর্বস্ব, কুচক্রী, ভণ্ড তপস্বীদের অভিনন্দনেরও ব্যবস্থা নাই। আমি ভবিষ্যতের যে সাহিত্যের কল্পনা করি সে সাহিত্য শুধু অতীতকে নিয়ে কুহক রচনা নয়, নিজেদের তুচ্ছতাকে ঢাকবার জন্য কাল্পনিক অতীতের অশোভন অতিরঞ্জন নয়। আমি যে নাগরিকের কল্পনা করি তার জীবন সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, তুচ্ছতার যুপকাষ্ঠে বৃহত্তর স্বার্থের অমর স্বত্বাধিকারীকে বলিদানের জন্য নয়। আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন শ্রেণীর জীবনাদর্শের, সম্পূর্ণ ভিন্ন শ্রেণীর সাধনার, সম্পূর্ণ ভিন্ন শ্রেনীর কামনার সুখ স্বপ্ন দেখি। আমার সে স্বপ্ন কি, এখন তাই বলি।
আমি যে ভবিষ্যত বঙ্গদেশের কল্পনা করি, তাতে বর্তমানের মজানদীর এবং শুষক খালের খাতে প্রচুর জলপ্রবাহের অশ্রান্ত কলধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাদের বক্ষের ক্ষীরধারায় সমস্ত দেশ ফুলে-ফলে-শস্যে অপূর্ব শ্রী ধারণ করেছে। আমি ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে বাংলার প্রত্যেক পল্লিতে এবং প্রত্যেক জনপদে তার নিজস্ব নদী অথবা খাল আছে, যাদের সাহায্যে উদ্বৃত্ত বর্ষার জল অবাধে সাগর-পথে প্রবাহিত হচ্ছে — বর্তমানের মতো সে জল ম্যালেরিয়ার মশার সূতিকাগারের সৃষ্টি করছে না। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়ি গৃহশিল্পের আলিপনার সুন্দর এক একটি নিদর্শন হয়ে বিরাজ করছে, বর্তমানের মতো গৃহ-সৌন্দর্য-পিপাসুর মনে নিত্য সে নূতন যন্ত্রণার কারণ হচ্ছে না। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি তাতে প্রত্যেক গ্রামের নিজস্ব বাগান, নিজস্ব খেলার মাঠ, নিজস্ব পাঠাগার, নিজস্ব ক্লাব বা ইন্সটিটিউট আছে। আর গ্রামবাসীরা সেইসব প্রতিষ্ঠানে পরসপর সহযোগিতায় নিত্য নূতন আনন্দের সন্ধান পাচ্ছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি তাতে প্রশস্ত সুগঠিত রাজপথ দেশের প্রত্যেকটি গ্রামের সঙ্গে প্রত্যেকটি গ্রামকে, প্রত্যেকটি নগরের সঙ্গে প্রত্যেকটি নগরকে সুলগ্ন রেখেছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি তাতে বাংলার গৃহপালিত পশুপক্ষীর শ্রী এবং সৌন্দর্য বাংলার গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তার মাংশপেশীবহুল, সুঠাম, বলিষ্ঠদেহ বাঙালি বৈদেশিকের বিস্ময় উৎপাদন করছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে বাঙালি নারীর স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্য বিশ্ববাসীর প্রশংসার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তার বিদ্যানিকেতগুলির স্থাপত্য-সৌন্দর্য, তাদের উদ্যানের শোভা, তাদের বেষ্টনীর মনোহারিত্ব মানুষের মনকে সৌন্দর্যের অপরূপ জগতের সন্ধান দিচ্ছে। আর সেইসব প্রতিষ্ঠানের আচার্য এবং ছাত্রদের পরসপরের স্নেহ এবং প্রীতি নাগরিকদের আদর্শ হয়ে উঠেছে; তাদের সত্য-শ্রেয়-সুন্দরের সাধনা বিশ্বের অনুকরণীয় গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি তাতে হিন্দু তার ধর্মের অন্তর্নিহিত সনাতন সত্যের সন্ধান পেয়েছে, মুসলমান তার ধর্মের অন্তর্নিহিত শাশ্বত সত্যের সন্ধান পেয়েছে; আর উভয়েই মর্মে মর্মে বুঝেছে যে, যেখানে সত্য সেখানে দ্বন্দ্ব নাই; যেখানে সুন্দর সেখানে দ্বেষ-হিংসা নাই; যেখানে শ্রেয় যেখানে সঙ্কীর্ণতা নাই, কার্পণ্য নাই; আলোকের পথে অন্তহীন একাগ্র অভিযানই সকলের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তাতে জ্ঞানসমৃদ্ধ, ভাবসম্পদে গরীয়ান বাঙ্গালী রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, দেশ-শাসনের ভার, নেতৃত্বের অধিকার উত্তম-বুদ্ধিবিশিষ্ট যোগ্যতমের উপর অতি সহজভাবেই ন্যস্ত করছে নির্বাচনের অপ্রিয়তা ও স্বার্থান্ধতা সেখানে মুছে গেছে। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তার সাহিত্য থেকে ফাঁকা আড়ম্বর আর ভাবের দৈন্য চিরতরে বিদায় গ্রহণ করেছে। সত্র-শ্রেয়-সুন্দরের নিত্য নূতন অনুভূতিতে সে সাহিত্য নিত্য নূতন পথ রচনা করছে। সে সাহিত্যের দৃষ্টি সম্ভাবনাহীন অতীতের দিকে নয়, দৃষ্টি তার সম্ভাবনাপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে। সে সাহিত্য কোনো শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের জন্য নয়; সে সাহিত্য মানুষের জন্য, বিশ্বমানবের জন্য, চিরন্তন মানবতার জন্য। সে সাহিত্য দৃশ্যমান জগতের সঙ্গে অদৃশ্য জগতের, রূপের সঙ্গে অরূপের, দেহের সঙ্গে আত্মার নিত্র নূতন মিলন-সঙ্কেতে ভরপুর। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিতার নাগরিক হচ্ছে মানবতার আদর্শের অনিন্দ্যসুন্দর এক প্রতীক; বলিষ্ঠদেহ; অটুটস্বাস্থ্য; জ্ঞানসমৃদ্ধ; ভাবে গরীয়ান; ত্যাগে মহীয়ান; প্রেমে ও দাক্ষিণ্যে সকলের আপন জন; সদা মঙ্গল সাধনে রত; উজ্জ্বরতর ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় বর্তমানকে রূপায়িত করবার জন্য সদাই ব্যস্ত এবং তৎপর। আমার মনে হয়, এই গৌরবময় ভবিষ্যতের স্বপ্নই হল বাঙ্গালীর দেখবার মতো স্বপ্ন; এই গৌরবময় ভবিষ্যতের চিন্তাই হল বাঙ্গালীর মনের উপযুক্ত চিন্তা; আর এই গৌরবময় ভবিষ্যতের জন্য সাধনাই হল বাঙ্গালীর শক্তির উপযুক্ত সাধনা।
এ স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে, এ চিন্তাকে রূপায়িত করতে হলে, এ সাধনাকে সার্থক করতে হলে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন। যথা — ১) হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য; ২) বাংলার রাষ্ট্রীয় জীবনের স্বাতন্ত্র্য; আর ৩) শুভবুদ্ধি ও জ্ঞানের উদ্বোধন এবং সম্প্রসারণ।
আমার মনে হয়, এই শেষোক্ত প্রয়োজনটি পুরনের উপরেই অপর দুটির সাফল্য নির্ভর করছে। যাঁরা বাংলার এবং বাঙ্গালীর সত্যকার মঙ্গলকামী, তাঁদের চিন্তা এবং সাধনাকে এই জ্ঞানের উদ্বোধন এবং সম্প্রসারণের কাজেই নিয়োজিত করতে হবে।
আরব জাতির জাতীয়তাবাদ (Arav Nationalism) আজ বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এ জিনিসটি কারও কল্পনাতে ছিল না। আরব জাতি ধর্মে সাধারণত মুসলমান। অথচ আরব-জাতীয়তার গোড়াপত্তন করেছেন আধুনিক প্রথায় শিক্ষিত দুজন খ্রিস্টান মনীষী — নাজিফ এজিদি এবং বেতেরাস বোস্তানি। ভিন্ন-ধর্মাবলম্বী দেশবাসীদের মধ্যে এই দুই মনস্বী জাতীয়তার আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন তা প্রত্যেক দেশের দেশপ্রেমিকদের অনুকরণীয়।
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে আরব জাতি যখন নৃশংসভাবে খ্রিস্টান হত্যায় উন্মত্ত হয়ে উঠল, তখন সে হিংসানল-নির্বাপনের উদ্দেশ্যে বোস্তানি বাই রুটে এসে একখানি সংবাদপত্র প্রকাশ করলেন। খ্রিস্টানদের প্রতি আরব জাতির সম্প্রীতি-সাধন করতে গিয়ে বোস্তানি উপলব্ধি করলেন, মূঢ়তা ঘোচাতে না পারলে মানুষের গোঁড়ামি ঘুচবে না, এবং গোঁড়ামি না ঘোচালে মানুষের মন দ্বেষ-হিংসার কন্টক পরিপূর্ণ থাকবেই। আরবে তিনি শিক্ষা প্রসারের ব্যবস্থা করলেন। সে শিক্ষানিকেতন হল জাতীয় বিদ্যালয়। আরব-প্রেমকে কেন্দ্র করে ধর্ম-বিদ্বেষ ত্যাগ করে এখানে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা হল। এ বিদ্যালয়ে আরবি শিক্ষকতার জন্য বোস্তানি পেলেন নাজিফ এজিদিকে। নিঃস্বার্থ প্রেমিক বোস্তানির আদর্শে এজিদি শ্রদ্ধান্বিত হলেন এবং উভয়ের বিপুল সাধনায় আরব জাতি ক্ষুদ্রতা ভুলে, হিংসা-দ্বেষ ভুলে সর্ব ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শিখল — আরবে আবার নূতন আরবের অভ্যুত্থান হল।
নবীন আরবি অথবা নব্য তুর্কির মতো — প্রকৃতির লীলা-নিকেতন এই সৌভাগ্য-সম্পদশালিনী বাংলাদেশে — এই বাঙ্গালীর জীবনেই বা অখণ্ড এক আদর্শ জাতীয়তা সম্ভব হবে না কেন? এ সম্ভাব্যের প্রচুর উপকরণ বাঙ্গালীর প্রকৃতিতে এবং বাংলার আকাশে-বাতাসে, নদী-নালায়, পথে-প্রান্তরে ও শ্যামলিমায় বর্তমান। শুভবুদ্ধি নিয়ে বাঙ্গালী শুধু নিঃস্বার্থ নয়ন মেলে দেখলেই হয়।
লেখকের এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় জানুয়ারী ১৯৪৩ সালে।