ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১০) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
তাই আজকের এই নতুন ধরণের জাতীয় মিলনের দিনে অভিভাবকদের একথাও বলতে শোনা যাচ্ছে “আমার তামিল বউমা কি সুন্দর বাংলা বলে।”
কিংবা ওমুকের পাঞ্জাবী জামাই অষ্টমঙ্গলায় ধুতি পাঞ্জাবী পরে এসেছিল।যাবার সময় কেমন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে গেল।
ঘরে ঘরে এখন,বাঙালি-পাঞ্জাবী,ওড়িয়া-গুজরাটি আর বিহারি-দক্ষিণী যুগলের ছড়াছড়ি।এমন পরিবার খুব কমই আছে যাদের বাড়িতে,বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়দের পরিবারে এরকম যুগলের উপস্থিতি নেই। এসবই সেই আদি অকৃত্রিম লভম্যারেজের কেরামতি।এখন তিনি অনেক বড় খেলায় মেতেছেন।আগে ভিন্ন জাতে মিলন ঘটাতেন, এখন প্রদেশের বেড়া ডিঙিয়ে যুগলবন্দি করছেন।
ফলস্বরূপ বাড়ির রান্নার মেনুতে অনেক পরিবর্তন এসেছে।সকালের জলখাবারে দোসা আর সম্বর,দুপুরে শুক্তো,ভাত, মাছের ঝাল, অম্বল আর রাতে তড়কা রুটির স্বাদবদল চলছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে গরবা নৃত্যের মহিমা, বেশ লাগছে। ছেলেমেয়েরাও একই সঙ্গে দুটো তিনটে ভাষা শিখছে।দুরকমের সংস্কৃতির বাহক হচ্ছে।মন্দ পালাবদল নয়।
বিয়ে-র সাজেও রকমফের।বউভাতের কনে আর ওড়নায় মাথাঢেকে সিংহাসনে বসে থাকেনা।উল্টে বউভাতের দিনে তাকে আর সকলের ভিড়ে খুঁজেই পাওয়া যায়না। মানে সেদিনের বিশেষ বউটি অতিথিদের ভিড়ে মিলে গিয়ে তার সেই বিশেষ ভাবটি হারিয়ে ,একেবারে সাধারণ হয়ে যাচ্ছে।এখন আর বউভাতের সিংহাসনে বসা, বেনারসী পরা বউ খুঁজেই পাওয়া যায়না। লাহেঙ্গাচোলির রমরমা চলছে। আমাদের পাড়াতুতো বয়স্কা পিসিমা এক বউভাতের বাড়িতে আমার কাছে এসে ফিস্ফিস্ করে বললেন, “ নতুন বউ ওটা কী পরেছে? ও কী বাঙালি নয়?”
আমি বললাম “একশো ভাগ বাঙালি।এখন তো সবাই বিয়ে-র দিনে বেনারসী আর বউভাতে লাহেঙ্গা চোলি পড়ে।এটাই তো রেওয়াজ হয়েছে।”
পিসিমা বললেন, “ অ।” আমি সেই ‘অ’ এর পেছনে স্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেয়ে ওখান থেকে সরে পড়লাম। তিনি বোধহয় নতুন বউকে একদৃষ্টে দেখতে দেখতে মনেমনে ভাবছিলেন, “আমাদের গেছে যে দিন /একেবারেই কি গেছে-/কিছুই কি নেই বাকি?”
বিখ্যাত এই লাইনটি ছিল কবিগুরুর ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতায়। সেটা যে সব বিষয়েই খাটবে ,কে জানত?
কয়েকদিন আগেই একটা বিয়ে বাড়িতে নেভিব্লু রঙের গাউন স্যুট পরা কনে বউ দেখলাম।না না মেমসাহেব নয়।একেবারেই বাঙালি।না বলে দিলে আমি তাকে নব বধূ বলে কখনওই সনাক্ত করতে পারতাম না।সুন্দরী মেয়েটিকে ওই পোশাকে দিব্যি দেখাচ্ছে।যদিও আমাদের আদ্যি বুড়ির চোখে তাকে ‘কনেবউ’ বলে ভাবতে পারছি না। খুব বেশি নতুনত্ব নিতে পারিনা কিনা।
আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৯) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
মনে পড়ছিল আমার বন্ধু উৎপলার কথা। আজ থেকে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর আগে বউভাতের দিনে মাথায় ভারি ফুলের মুকুট পরে চারঘন্টা বসে থাকায় তার ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথা হয়। সে তখন ছিল সদ্য পাস করা ডাক্তার।এখন তার বেশ নামডাক হয়েছে।
বউভাতে ফুলের সেই সাজ আর নেই। রজনীগন্ধার ভারি মুকুট, দুহাতে দুটি দুটি তারে গাঁথা ফুলের বালা ,আর কাউকে পড়তে হয়না। কনে বউকে লজ্জা পেতে হবে ,এমন দাবিও কেউ করেনা।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তনে আমার কোন অসুবিধা হয়না। কিন্তু পিসিমারা মাসিমারা এখনও এসবে ঘাবড়ে যান।দিনে দিনে ওঁদেরও অভ্যেস হয়ে যাবে।
‘লভ ম্যারেজ’ থেকে শুধু ম্যারেজের কথা বলতে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরেই গল্পের ডালপালা গজাচ্ছে।পথ বদল হচ্ছে। লাভ ম্যারেজের আওতায় ফিরে আসি এবার।লাভ ম্যারেজ তো চলছেই।নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা।কথা হতে পারে ‘লাভ’ আর ‘ম্যারেজের’ সহাবস্থান নিয়ে। ম্যারেজের সেই লাভ বরাবর বজায় থাকছে কী? সেটা থাকলেই হল।আঁকাবাঁকা পথে নদী ঘুরপাক খেলেও একেবারে শেষে সাগর সঙ্গমে পৌঁছচ্ছে তো?যাই ঘটুক সবশেষে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ হলেই হল।বরাবরের মিষ্টান্ন প্রত্যাশী আমরা সে রসে বঞ্চিত না হলেই হল।ম্যারেজ যেমন হোক যেভাবে হোক আগেরকালের লেডিকেনি ,সন্দেশের পাতে পড়াটা একরকমই থাক। সেখানে অদলবদলটা একেবারেই মানা যাবেনা কিন্তু।

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।