| 27 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

উর্দু অনুবাদ গল্প: লেপ । ইসমত চুঘতাই

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট
অনুবাদক: ভবভূতি ভট্টাচার্য

বেগমজানউর্দুভাষা তথা ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে ইস্মত চুঘতাই (১৯১৫-১৯৯১ খ্রিঃ) এক গরিমাময়ী স্থান অধিকার করে আছেন। আধুনিক উর্দুর উৎপত্তি যদি মীর তাকি মীর ও আসাদুল্লাহ্‌খাঁন ‘গালিব’-এর মত কবিগণের হাত ধরে হয়ে থাকে, আর উর্দু ছোটগল্পের (‘আফসানা’) ভগীরথ যদি মুন্সি প্রেমচন্দ হন, তবে আধুনিক উর্দু ছোটগল্পের চার স্তম্ভ মানতে হবে মান্টো-বেদী-চুঘতাই ও কৃষ্ণচন্দ্রকে। ইস্মত চুঘতাইয়ের লিখনের সবচেয়ে বড় বিশেষত্বটা কী, যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়? পন্ডিতেরা বলেন, তা তাঁর সাহস! সাহস, বিশেষতঃ, বিষয় নির্বাচনে। 

আজ এই ‘লেপ’ গল্প পড়তে পড়তে ভেবে নিতে হবে এর প্রকাশকাল ১৯৪২-এর ভারতবর্ষকে, যে-সময়ে এক মুসলিম লেখিকার হাত দিয়ে এই প্লটের গল্প যে বার হতে পারে—পাঠক তা মেনে নিতে পারেননি। অশ্লীলতার দায়ে ইস্মতকে তাই আদালতে হাজির হতে হয়। কিন্তু এত শিল্পীক ছিল ইস্মতের প্রকাশভঙ্গি, না-বলেও-বলা-কতকথা, যে তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতা প্রমাণিত হয়নি, বেকসুর খালাস পান লেখিকা। কিন্তু ‘লেপ’-এর চমক উর্দু সাহিত্যকে নাড়া দিয়ে গেল। এই ‘চমক’ ইস্মতের এক বিশেষত্ব রয়েই গিয়েছে—সাহিত্যকীর্তিতে যেমন, তেমন জীবনে–দেবনাগরী অক্ষরে উর্দু লিখতেন; আর তাঁর ইচ্ছানুযায়ী, মৃত্যুর পর তাঁকে সমাধিস্থ নয়, দাহ করা হয়!

মূল গল্পটি আছে নন্দ কিশোর বিক্রম-সম্পাদিত “ইস্মত চুঘতাই কী সর্ব্‌শ্রেষ্ঠ্‌ কহানিয়াঁ” গ্রন্থে। বর্তমান বঙ্গানুবাদটি ভাবানুবাদ নয়, আবার আক্ষরিক-অনুবাদও নয়। উর্দু-হিন্দীর লিখনভঙ্গির সঙ্গে বাঙলারটা পুরোপুরি মেলে না। বাঙালির পাঠাভ্যাসকে স্মরণে রেখে তাই অনুবাদে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন রাখা হয়েছে, যদিও তা দু’আনার বেশি নয়। 

—অনুবাদক


প্রবল শীতের রাতে আমি যখন লেপ মুড়ি দিয়ে শুই, তখন তার ছায়া যেন দেওয়ালে মস্ত এক হাতির মতো হয়ে দেখা দেয়! আর মন ছবি এঁকে যায় একে একে ফেলে আসা দিনগুলোর। সেই-সব সময় কত কথা যে মনে পড়ে যায়!

মাফ করবেন, আমি কিন্তু লেপ নিয়ে কোনো রোমান্টিক কাহিনি শোনাতে বসিনি, না লেপের সঙ্গে কোনো রোমান্স জড়ানো যায়। কম্বল অবশ্যই কম ওম্‌ দেয় কিন্তু তার ছায়া দেওয়ালে লেপের মতো অমন ভয়াবহ রূপ নেয় না। এ’ সেই সময়কার গল্প যখন আমি ছোট ছিলুম ও সারাদিন দাদা ও তাদের বন্ধুদের সঙ্গে মারপিট করে দিন কাটাতুম। মাঝে মাঝে এখন আমার মনে হয়, আমি তখন অত মারকুটে ছিলুম কেন? সেই বয়সে, যদ্দিনে আমার অন্য দিদি-বোনেরা প্রেম-ট্রেম করা শুরু করে দিয়েছে।

এই কারণেই, মা যখন আগ্রা গেলেন, সপ্তাহখানেক আমাকে রেখে গেলেন তাঁর সইয়ের বাড়ি। কেননা, মা জানতেন যে সেখানে একটা ইঁদুরছানাও নেই যার সঙ্গে আমি মারপিট করতে পারি। আমার পক্ষে এটা ভারি শাস্তি হয়ে গেল। হ্যাঁ, মা আমাকে বেগমজানের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। ইনিই সেই বেগমজান যাঁর লেপের স্মৃতি আমার মনে আজও উষ্ণ লোহার মতো দাগ ফেলে আছে। তাঁর স্বামী নবাবসাহেব বয়স্ক হলেও অতি সজ্জন মানুষ ছিলেন যার জন্য বেগমের দরিদ্র পিতামাতা তাঁকে জামাই করেন। কক্ষনো কোনো যেমন-তেমন মেয়েমানুষ নবাবসাহেবের কাছ ঘেঁষতে পারত না। নিজে হাজি ছিলেন ও তাঁর সব বোনেদেরও হজ করিয়ে আনিয়েছিলেন!

ওঁনার ছিল এক আজব শখ। ধনী মানুষ পায়রা ওড়ায় বা মুর্গি লড়ায় । নবাব সাহেব কিন্তু এ’হেন কদর্য ক্রীড়াকে ঘৃণা করতেন। ওনার গৃহে অল্পবয়স্ক ছাত্ররা থেকে পড়াশুনা করত—কিশোর-তরুণ ছাত্র, ফর্সা-ফর্সা, ছিপছিপে সব ছাত্র। এদের সকল খরচ-খরচা উনিই দিতেন; আর এটাই ছিল নবাবসাহেবের শখ। উনি বেগমসাহেবাকে বিবাহ করে সাজিয়ে-গুজিয়ে সসম্মানে ঘরে রেখে বেমালুম ভুলে গেলেন; আর তিনি বেচারি রোগাসোগা লাজুক মেয়েটি একা একা দুঃখে গুমরাতে লাগলেন।

জানিনা ওনার জীবনের শুরু কোথা থেকে? তবে থেকে, যেদিন উনি ভুল করে জন্ম নিয়েছিলেন, না যেদিন নবাবসাহেবের বেগম হয়ে এ’গৃহে এসেছিলেন, না যবে থেকে নবাবের ঘরে ছাত্রদের বাস শুরু হল? ছাত্রদের জন্য রসুই থেকে মুরগির হালুয়া আর লচ্চা পরোটা যেতে লাগল আর বেগম বেচারা দূর থেকে ছাত্রদের নও-জওয়ান বদন ও আতরের গন্ধ ওড়ানো কুর্তা দেখে দেখে ফিরতে লাগলেন। না কি তবে থেকে ওনার জীবন শুরু যবে মানত-তাবিচ সব হার মেনে গেল? টোটকা ও রাতে সুর করে পড়া বজীফ সব চিৎপাত। বলে, পাথরেও ঘুণ ধরে, কিন্তু নবাবসাহেবের কোনো হেলদোল হল না। এবার বেগমসাহেবার মন সত্যিই ভেঙে গেল এবং তিনি পুরোপুরি ধর্মকর্মে মন দিলেন। কিন্তু এখানেও উনি কিছু পেলেন না। প্রেমের উপন্যাস ও রোমান্টিক কবিতা পড়া শুরু করলেন। এতে রাতের ঘুমটাও গেল এবং সম্পূর্ণ নিরাশায় ডুবে গেলেন বেগমজান। উড়োখুড়ো বেশবাস—সাজগোজের দিকে কোনো দৃষ্টিই নেই। সাজগোজ তো নারী করে কারোকে দেখাবার জন্য। নবাবসাহেবের এদিকে তাঁর সুদর্শন ছাত্রদের কুর্তার সুগন্ধ ফেলে বেগমের প্রতি নজর দেবার ফুরসৎই নেই। বেগমজানকে কোথাও যেতেও দিতেন না উনি। যবে থেকে উনি বিয়ে হয়ে এ’বাড়িতে এসেছেন, ওনার হাজার আত্মীয় এসে এসে মাসভর থেকে গেছেন। কিন্ত বেগম বেচারি নিজগৃহে কয়েদি রয়ে গেলেন। এই আত্মীয়দের দেখলেই ওনার ঊষ্মা হত—এরা এসে এসে অন্নধ্বংস করে যাবে ও নিয়ে যাবে শীতের তত্ত্ব; আর উনি বেচারি নতুন তুলোর গরম লেপ পড়ে থাকতেও শীতে কাঁপবেন।

প্রতিবার পাশ ফিরলে লেপের ছায়া দেওয়ালে নতুন নতুন রূপ নেয়, কিন্তু কোনো ছায়াই ওনাকে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয়। মানুষ তবে বাঁচে কেন, কিসের আকর্ষণে? বেগমজানের জীবনে বেঁচে থাকার কোনো আকর্ষণই আর ছিল না।

তবু উনি বাঁচলেন, বড় আনন্দের সঙ্গেই বাঁচলেন। সেই নিয়েই আজকের এই গল্পঃ

রব্বু ওনাকে বাঁচিয়ে দিল। ওনার শুষ্ক শরীরে আবার চাকচিক্য ফিরে এলো, গালে লাগল লালের ছোঁয়া। এক অদ্ভুত তেল মালিশ করে বেগমের শরীরে এই চাকচিক্য। মাফ করবেন, এই তেলের ফর্মুলা আমি আপনাদের দিতে পারব না, না কোনো বড় কেমিস্টের দোকানে তা পাওয়া যাবে।

রব্বু হল বেগমের খাস নৌকরানি। বেগমের যেমন ননীর মতো ত্বক, পুরুষ্টু গড়ন, সুডৌল নিতম্ব, ঠিকরে পড়া রূপ, রব্বু ছিল তার ঠিক বিপরীতঃ মিশকালো শুকনো পেটানো লোহাটি, মুখে হালকা বসন্তের দাগ, শরীরে অদ্ভুত এক গন্ধ।

আমি যখন তাঁকে প্রথম দেখি, ওনার চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর বয়স হবে। পায়ের ওপর এক রঙিন দোশালা ফেলে ডিভানে উনি মহারানির ন্যায় অর্ধশায়িন, আর রব্বু ওনার পিছনে বসে কোমর মালিশ করছে। প্রথম দর্শনেই আমি ওনার রূপে মুগ্ধ! ইচ্ছে হচ্ছিল ঘন্টার পর ঘন্টা কেবল ওনার মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকি। তৈলসিঞ্চিত আলুলায়িত কালো কেশদাম। ওনার সিঁথি কখনও একচুল এ’পাশ-ও’পাশ হতে দেখিনি। একটু ফোলাফোলা নয়ন, বড় বড় আঁখিপল্লব। মুখের মধ্যে ওনার অধরোষ্ঠই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়ঃ রাঙা তম্বুলচর্চিতা, ওষ্ঠোপরি হালকা গুম্ফরেখা। কানের পাশে লপেটা কেশগুচ্ছ। সব মিলিয়ে, অনেক অল্পবয়স্কাই মনে হত ওনাকে। দীর্ঘাঙ্গিনী, যখন মালিশ করাতে পদযুগল নিরাবরণ করতেন, হাঁ করে কিশোরী-আমি ওনার পুরুষ্টু গোছ দুটি দেখতুম। আর রব্বু মাগি সারাদিন ওনার পিঠ মালিশ করছে নয়তো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, নয়তো পা টিপে দিচ্ছে। হায়রে, মালিশ করানোও জীবনের জরুরি কার্যের মধ্যে পড়ে! হয়তো, জীবনের প্রয়োজনের চেয়েও বেশি জরুরি কার্য! আর রব্বুর তো এ’ছাড়া আর কোনো কাজও ছিল না। তার ওপর যখন বেগমজান উষ্ণ পানিতে নাইবেন, তখন তো রৈ রৈ কাণ্ড! ঘরে আগল দিয়ে পাক্কা দু’টি ঘন্টা ধরে ওনার সুগন্ধি মালিশ চলবে, যেখানে রব্বু ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। অন্য চাকরানিরা গজগজ করতে করতে বন্ধ দরোজার ফাঁক গলিয়ে হুকুম মতো এটাওটা জুগিয়ে যাবে।


আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ গল্প: রঘুনাথ, কাপড় পর । অতনু ভট্টাচার্য


কী আর করা যাবে, বেগমজানের ছিল চুলকুনির রোগ, হাজার তেল-ঔষধেও যার আরাম হয়নি। ডাক্তার-বদ্যিরা বলতেন, কিচ্ছুটি হয়নি, পরিষ্কার ত্বক। রব্বু বলত, “হায় অল্লাহ্‌। ডাক্তাররা সব পাগল। উপরওয়ালা মালকিনের খুন রাখুন সদা গর্ম!” বলত, আর শয়তানি-ভরা দৃষ্টি নিয়ে বেগমজানকে দেখতে থাকত। আর সারাটা ক্ষণ এই ওনার কোমর টিপছে তো পরক্ষণেই থাই মালিশ করছে তো এবার গোড়লি ধরল। আমি তো যখনই বেগমজানের পাশে যেতুম, লক্ষ রাখতুম রব্বু-শাঁকচুন্নির হাতটা এখন ওনার কোন্‌ অঙ্গে বিচরণ করছে। শয়তানটা বেগমের সাথে উঠত-বসত খানা খেত আর সাথে শুতোও! ওদের এই মাখামাখি পল্লীতে মুখরোচক আলোচনার বিষয় ছিল। বেগমজান অবশ্য ও’সবে কান দিতেন না। ওনার নিজের জগতে উনি ছিলেন আর ছিল ওনার চুলকুনি!

এবার মা যখন আমায় এখানে রেখে আগ্রা গেলেন, প্রশ্ন উঠল, রাতে আমি শোব কোথায়? স্বাভাবিকভাবেই, বেগমজানের পাশেই। তাই ওনার পালঙ্কের পাশে আমার জন্যেও এক ছোট পালঙ্ক রাখা হল। রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত তো গল্প-গুজব তাসখেলা চলল। যখন আমার হাই উঠছে রব্বু দেখি তখনও ওনার পিঠে সুড়সুড়ি দিয়ে চলেছে। ‘শয়তান’। এরপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। হঠাৎ মাঝরাতে যখন ঘুমটা ভেঙে গেল আমার, অদ্ভুত এক ভয় লাগতে লাগল। ঘর ঘুরঘুট্টে অন্ধকার, আর সেই আঁধারে বেগমজানের লেপটা এত জোরে জোরে দুলছে যেন তার ভিতরে কোনো হাতি ঢুকে পড়েছে!
“বেগমজান!” আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলুম। খাট নড়া বন্ধ হয়ে গেল, লেপও দেবে গেল।
“কী হল? ঘুমিয়ে পড়ো,” কোন্‌ অন্দর থেকে বেগমজানের গলা ভেসে এলো।
“আমার ভয় করছে”, চিঁ চিঁ করে বলি।
“ভয়ের কী আছে। ঘুমোও। আয়াত-উল-কুর্সি আওড়াও”।
“আচ্ছা,” আমি জলদি জলদি আয়াত-উল-কুর্সি পড়তে লাগলুম মনে মনে, কিন্তু “ইয়াওল্ মু মাবীন” পর্যন্ত এসে আটকে গেলুম, যদিও পুরো আয়াতটা আমার কণ্ঠস্থ।
“বেগমজান, আমি আপনার কাছে চলে আসব?” শুধোই।
“না, ওখানেই শুয়ে থাকো,” এবার একটু কড়া গলায় বললেন বেগমসাহিবা, ও দুটি মানুষের ফিসফাস শোনা গেল। হায়রে, এই দ্বিতীয়জন কে?
“বেগমজান, কোনো চোর-টোর ঢুকে পড়েনি তো?”
“কোথায় চোর? এবার ঘুমিয়ে পড়ো, বেটা,” এটা রব্বুর গলা!! আমি সঙ্গে সঙ্গে লেপে মাথা ঢেকে চোখ বুজে ফেলেছি।

***** 
ভোরে উঠে গতরাতের এত ঘটনা কিছু মনেই ছিল না। লেপখানাও এখন নিপাট ভোলেভালা পড়ে রয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় রাত্রে ফের যখন আমার ঘুম ভেঙে গেল, পাশের খাট থেকে বেগমজান ও রব্বুর মধ্যে কোনো ঝগড়া যেন অতি মৃদুস্বরে হলেও আমার কানে আসতে লাগল। রব্বু হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদতে লাগল। তারপর বেড়ালের সপড়-সপড় রেকাবি চাটার মতো শব্দ আসতে লাগল। আমি তো অজানা কোনো ভয়ে ফের লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।

পরের দিন রব্বু গেছে তার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। বড্ড ঝগরুটে আকাট ছেলে রব্বুর। বেগমসাহিবা অনেক করেছেন তার জন্যে। নবাবসাহেবকে বলে দোকান করে দিয়েছিলেন। সে-সব ছেড়ে ভেগেছে ছেলে। রব্বুকে তাই যেতে হয়েছে ছেলের কাছে, গ্রামে।

এদিকে বেগমসাহিবা সারাদিন আনচান করছেন। কে তাঁর পিঠ চুলকিয়ে দেবে, কোমর মালিশ করে দেবে? আর কারোকে হাতই ছোঁয়াতে দিচ্ছেন না। সারাদিন কিছু খেলেনও না। শেষে অনেক উৎসাহে আমি বললুম, “বেগমজান আমি তোমার পিঠ চুলকিয়ে দিই?” উনি একদৃষ্টে আমায় অবলোকন করতে থাকেন। এরপর আমি খানিকক্ষণ ওনার পিঠে সুড়সুড়ি দিই, আর বেগমজান চুপটি করে শুয়ে থাকেন। দ্বিতীয় দিন রব্বুর ফেরার কথা ছিল, ফিরল না। বেগমজানের মেজাজ সপ্তমে চড়ল। বারবার চা-পান করে করে মাথা ধরিয়ে ফেললেন। আজও আমি গভীর আগ্রহে ওনার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকি। মার্বেলের মতো চকচকে পিঠ! মনে কী আনন্দ হয় ওনার জন্য খিদমত খেটে। “আরও জোরে জোরে চুলকে দাও…..হ্যাঁ এবার ঠিক হচ্ছে। হ্যাঁ…হ্যাঁ…..বাঁধনটা খুলে দাও….আরও নিচে আরও নিচের দিকে…” এবার বেগমের গলায় খুশির সুর, “এঃ, তুই তো কাতুকুতু দিয়ে ফেলছিস রে !” ওনার গলায় প্রশ্রয়। আমার গর্ব!
“তোকে তো পুরস্কার দিতে হয়! কী নিবি বল? সেই চোখ পিটপিট করা পুতু্ল?”
“য্যাঃ, পুতুল কী নোব? আমি কি আর বাচ্চা আছি না কি?”
“বাচ্চা নয় তো কি বুড়ি হয়ে গেছিস নাকি? আচ্ছা, তোকে একটা বাবুয়া দেব। তাকে অনেক কাপড় পরিয়ে রাখবি।” উনি চিৎ হয়ে শুলেন, আর যেখানে যেখানে ওনার ‘চুলকোচ্ছে’ আমার হাতটা সে-সেখানে দিচ্ছেন ও আমি যন্ত্রবৎ হাত চালিয়ে যাচ্ছি। উনি সমানে গল্প করে চলেছেন। আর না-জানি আমার হাতটা কোথায় কোথায় পৌঁছে গেছে। উনি হঠাৎ কপট রাগে আমাকে ধমকিয়ে ওঠেন, “আরে মেয়েটা, দেখে চুলকোচ্ছিস না? আমার পাঁজর ভেঙে দিবি নাকি?” আমি সঙ্গেসঙ্গে হাত গুটিয়ে নিলুম। “আয় দেখি, এসে শো’ তো আমার পাশে,” এবার হেসে বলেন বেগমজান, “এ’মা, তুই তো শুকিয়ে গেছিস, রে। তোর পাঁজর গোণা যাচ্ছে। দেখি তো গুণে তোর কয়টা পাঁজর……এক..দুই…তিন….।” আমি একটু কুঁকড়ে গেলুম। “ভয় পাচ্ছিস নাকি? আমি কি তোকে খেয়ে নোব? দেখি, হাতটা সরা তো….।” কোন্‌ এক অজানিত ভয়ে আমি উঠে পালাতে চাইছি আর উনি আরও জোরে আমায় জড়িয়ে ধরেছেন। “উঁ..উঁ…উঁ….উঁ…..” বেগমজান জোরজোর হাসতে লাগলেন। আজ এতো বচ্ছর পরেও তাঁর সেদিনের সেই রূপের কথা মনে পড়লে আমি ঘাবড়ে যাই। তাঁর সেই বিলোল দৃষ্টি, প্রবল শৈত্যেও ঠোঁটে-নাকে স্বেদবিন্দু। ওনার অঙ্গ থেকে শাল কখন খসে পড়েছে আর রেশমকোমল ত্বক স্বল্পালোকেও ঝকমকাচ্ছে! মনে মনে আমার কান্না জমে আসতে লাগল। নিথর পড়ে আছি আমি, আর এক কাঠপুত্তলীর মতো আমায় নিয়ে খেলছেন বেগমজান। ওনার উষ্ণ শ্বাস পড়ছে আমার শরীরে। কোনো এক না-মানুষী যেন ভর করেছে ওনার ওপরে। আমার মনের এমন অবস্থা, না চীৎকার করতে পারি, না পারি কাঁদতে।

এর কিছুক্ষণ পরে বেগম ক্ষান্ত হয়ে ঢলে পড়লেন। ওনার চেহারার সেই জেল্লা চলে যেতে লাগল ও লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে লাগলেন উনি। আমি ভাবলুম, আরে ইনি আবার মরে-টরে গেলেন না তো?! এই ভেবে কুর্তা সামলে সেখান থেকে চোঁ-চাঁ দৌড়। কী ভাগ্যি, রব্বু সেই রাত্তিরে ফিরে এসে গেল। আমিও প্রবল শীতের রাতে ভালো করে লেপখানি মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছি। কিন্তু চোখে ঘুম কই? নানা উদ্ভট চিন্তা আসতে লাগল মনে। এদিকে, আমার মায়েরও ফিরতে দেরি হচ্ছে। আমি সারাদিন ঘরের অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে সময় কাটাতে লাগলুম। কাকে বলি, আর কী করে বলি যে আমি বেগমজানের কাছে ঘেঁসতে ভয় পাচ্ছি?! বেগমজানের কাছে ঘেঁসতে ভয় পাচ্ছি! আমি! যে-বেগমজানের কাছে আসার জন্য আমি সদাই উন্মুখ হয়ে থাকতুম!

আজ ফের কী নিয়ে কি জানি, বেগমজানের সঙ্গে রব্বুর মনকষাকষি চলছে। আর এতে অকারণে আমার ভয় ভয় করতে লাগল। কারণ, হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল যে আমি ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় ঘুরে বেড়াচ্ছি ও নিমুনিয়ায় মরব। “কী রে মেয়েটা, আজ আমার মাথা টিপে দিবি নাকি?” বড় টবে গরম পানিতে হাত-মুখ ধুতে ধুতে উনি আমায় শুধোলেন। টিপয়ের ওপর চা ঠাণ্ডা হচ্ছিল।

“মা, আমি দাদা আর তার বন্ধুদের সঙ্গে কত লড়াই-ঝগড়া করি যে তুমি আমায় বোঝা ভেবে এখানে ফেলে রেখে গেলে?” মনে মনে বলি আমি। আমার ভাইয়েদের সঙ্গে খেলা করা চিরকাল মায়ের না-পসন্দ। কিন্তু কেবল ছেলেরাই কি বাঘ-সিংগি নাকি যে তোমার কচি মেয়েটাকে গিলে নেবে? মেয়ে জাতটাকে তো তোমরা চিরকাল সাতটা তালাচাবি দিয়ে বন্দী করে রাখতে চাও, কিন্তু বেগমজানের দুনিয়ার এই গুণ্ডামি থেকে বাঁচাবে কী করে? অত রাত্তিরে তখন রাস্তায় বাস চলাও বন্ধ হয়ে গেছে, নৈলে আমি একা একাই রাস্তায় নেমে বাস ধরে পালাতুম। কিন্তু উপায় নেই। তাই অজানিত কোনো ভরোসায় বুক বেঁধে বসে রইলুম।

এতক্ষণে সেজেগুজে আতর মেখে রাতপোষাকে বেগমজান আমায় আদর করতে এলেন, “আয়, আমার কাছে আয়। বাজার থেকে তোর জন্যে কী আনাবো,বল্‌…।” “আমি বাড়ি যাবো” অনড় গোঁ ধরে বসে আছি আমি। কোনো খেলনা মিঠাই বা আর কিছুর টান আর নেই, সেই এক জেদ, “আমি বাড়ি যাবো।” “সেখানে তোর দাদা তোকে পিটবে,” বলেন। “তা হোক্‌, আমি বাড়ি যাবো,” আমার এক কথা।

“কাঁচা আম একটু বেশিই টক হয়, সাহিবা,” ওপাশ থেকে রব্বু ফুট কাটলো। আর এতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেন বেগমজান; অসম্ভব ছটফটাতে লাগলেন। যে সোনার হার একটু আগে আমায় পরাতে যাচ্ছিলেন কোথায় টুকরো-টুকরো হয়ে পড়ে রইল। মিহি জালীর দোপাট্টা ছিন্নভিন্ন। ওনার যে সিঁথি কখনও টেরা হতে দেখিনি আমি, আজ তা লণ্ডভণ্ড। “ওঃ ওঃ ওঃ ওঃ” কী যাতনায় উনি শয্যায় খানখান হতে থাকেন। আমি তো পালিয়েছি ঘর থেকে।

এর অনেক পরে শীতের ভয়ে আমি যখন টিপিটিপি পায়ে ঘরে ফের ঢুকতে যাচ্ছি, দেখি রব্বু ওনার বিছানায় শুয়ে ওঁর কোমর টিপে দিচ্ছে। “জুতো খুলে এসো,” ওনার পাঁজরে হাত বুলোতে বুলোতে আমায় হুকুম করে রব্বু। আমি ভীত নেংটি ইঁদুরটির মতো লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম। পরে লেপ একটু ফাঁক করে দেখি পাশের লেপের মধ্যে ফের হাতি সেঁধিয়েছে। নড়ছে। চপড় চপড় যেন চাটনি চাটার মতো শব্দ হচ্ছে ! এবার আমি বুঝেছি। বেগমজান তো আজ সারা দিন কিছু খান নি। আর রব্বুটা তো চিরকালের লোভী। নিশ্চয় সে কোনো রসভরা মিঠাই সাঁটাচ্ছে। এবার লেপের মধ্যের হাতিটা আরও উছল-পাছল করতে লাগল। আমার ভয় হতে লাগল, আমার ওপর না এসে পড়ে। ভয়ে আমি মনে মনে “আম্মি আম্মি” ডাকতে লাগলুম। আর শেষে অনেক সাহস সঞ্চয় করে পালঙ্কের ওপাশ দিয়ে নেমে ঘরের বাল্বের সুইচটা জ্বালিয়ে দিলুম। লেপের মধ্যের হাতিটা হঠাৎ ডিগবাজি খেয়ে চেপ্টে গেল। লেপটা গেলে সরে!

আল্লাহ্‌!!! আমি লাফ মেরে ফের নিজের লেপের তলায় ঢুকে গেছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত