ভাববাদ আর বস্তুবাদ_এই মোটাদাগে বিচার করলে বলতেই হবে যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভাববাদী৷ কিন্তু ভাববাদী বলেই একজন বস্তুবাদীর কাছে কি তিনি অচ্ছুত্ হয়ে যাবেন? হ্যাঁ, স্থূল বস্তুবাদের বিচারধারা এ-রকমই সাধারণত হয়ে থাকে৷ এমন কি, ডায়ালেকটিক বস্তুবাদী বলে যাঁরা নিজেদেরকে মনে করেন তাঁদেরও অনেকেরই বিচারবুদ্ধি যে স্থূলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না, তা-ও আমরা দেখেছি৷ বিশ শতকের চলি্লশের দশকের শেষে ও পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় তো এর উগ্ররূপই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল৷ রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকল ভাববাদী মনীষীর অবদানকে যাঁরা নস্যাত্ করে দিতে চেয়েছেন, তাঁদের সকলের হাতেই তো ছিল ডায়ালেকটিক বস্তুবাদ তথা মার্কসবাদের পতাকা৷ এই পতাকা আন্দোলন করেই এঁদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের গায়ে প্রতিক্রিয়াশীলতার ছাপ মেরে দিয়েছেন, তাঁকে কেবলই একমাত্রিক ভাববাদী রূপে চিত্রিত করেছেন, তাঁর অসাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ও তীক্ষ্ন বিজ্ঞানচেতনার বিষয়টিকে বিবেচনার মধ্যেই আনতে চাননি৷ বুঝতে চাননি যে, ভাববাদী কবি হয়েও রবীন্দ্রনাথ ‘ভাবোন্মাদ’ ছিলেন না, বরং ছিলেন অনেক বস্তুবাদীর চেয়েও অনেক বেশি বাস্তব দৃষ্টির অধিকারী৷ এবং এ-ও তাঁরা বোঝেননি যে, ভাববাদী পরিপাশর্্ব থেকে যাত্রা শুরু করলেও রবীন্দ্রনাথ হাঁটতে হাঁটতে যে-পথে চলে গিয়েছেন সে-পথ মোটেই ভাববাদের নয়, শেষ পর্যন্ত বস্তুবাদের সৈদ্ধান্তিক ভূমিতেই নিজেকে তিনি উপনীত করেছেন৷
রবীন্দ্রনাথ যখন নিতান্ত তরুণ, সেই উনিশ শতকের আশির দশকে, এদেশে একটি বিজ্ঞানবিরোধী অপবৈজ্ঞানিক পশ্চাত্মুখী ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার ধূলিঝড় উঠেছিল৷ সেই ধূলিঝড়টির নাম হিন্দু পুনর্জাগরণবাদ৷ এই হিন্দু পুনর্জাগরণবাদ হিন্দুদের কুসংস্কারগুলোকে বিজ্ঞানের মোড়কে পরিবেশন করতো, এগুলোর তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে আধুনিক মানুষের নিকট গ্রহণীয় করে তুলতে চাইতো৷ ‘বৈজ্ঞানিক হিন্দুধর্ম’ নামে পরিচিত এই প্রচণ্ড অবৈজ্ঞানিক মতবাদটি সে-সময়কার অনেক পাশ্চাত্য-শিক্ষিত হিন্দুর মনেও বিভ্রমের সঞ্চার করেছিল৷ শশধর তর্কচূড়ামণি, কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন ও চন্দ্রনাথ বসুর মতো পণ্ডিতবৃন্দ হিন্দুর সমস্ত অর্থহীন আচারের মধ্যেও বৈজ্ঞানিক অর্থ আরোপ করার মূঢ় প্রয়াসে মেতে উঠেছিলেন৷ এঁরা বলতেন : হিন্দু যে মাথায় টিকি রেখে কপালে তিলক কাটে, হাই উঠলে তুড়ি দেয়_এ-সবের আছে প্রচণ্ড বৈজ্ঞানিক তাত্পর্য৷ পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা মাত্র কিছুদিন আগে আবিষ্কার করেছেন যে ভোরবেলাকার বাতাসে ‘ওজোন’ নামে একটি গ্যাস আছে, সে-গ্যাস স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারী৷ অথচ, কত যুগ আগে আর্যঋষিরা ব্রাহ্মমুহূর্তে (অর্থাত্ খুব ভোরবেলায়) শয্যাত্যাগ করে পুষ্পচয়নের নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন৷ এ থেকেই বোঝা যায় যে ওই হিন্দু শাস্ত্রকাররা সে-সময়েই ‘ওজোন’ গ্যাসের খবর রাখতেন! আধুনিক বিমান আবিষ্কারের কত আগে প্রাচীন ভারতে ছিল পুষ্পক রথ, সেই পুষ্পক রথে চড়ে মেঘের আড়ালে থেকে যোদ্ধারা যুদ্ধ করতো! এ-বিচারে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান তো সেদিনের শিশু_একান্ত অর্বাচীন! এই অর্বাচীনকে ছেড়ে আমাদের শরণ নিতে হবে প্রাচীন প্রাজ্ঞ ত্রিকালদশর্ী মুনিঋষিদের! এই মুনিঋষিরাই অপৌরুষেয় বেদমন্ত্রের স্রষ্টা! বেদেই আছে সব জ্ঞানবিজ্ঞান!
বেদ-বেদান্তের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল হয়েও রবীন্দ্রনাথ কখনও এ-রকম অন্ধ বেদভক্তিকে প্রশ্রয় দেননি, তথাকথিত বৈজ্ঞানিক হিন্দুধর্মের মাদক কখনও তাঁকে নেশাগ্রস্ত করতে পারেনি৷ বৈজ্ঞানিক হিন্দুধর্মের পরম রমরমার দিনে প্রায় একাই তিনি এর বিরুদ্ধে লড়েছেন, নানা ব্যঙ্গকবিতায়, নাটকে, কথিকায় একে বিদ্রূপবিদ্ধ করেছেন, এর স্বরূপ উদঘাটন করেছেন৷ রবীন্দ্রকাব্যের যে-কোনো অমনোযোগী পাঠকও এ-প্রসঙ্গে ‘হিং টিং ছট্’ কবিতাটির কথা স্মরণ করতে পারবেন৷ হিন্দুর টিকি রাখা ও তিলককাটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রতি বিদ্রূপঠাসা সেই পংক্তি দুটোর কথাও তো অনেকের মনে পড়বে_
টিকিটি যে রাখা আছে তাহে ঢাকা
ম্যাগনেটিজম্ শক্তি৷
তিলকরেখায় বিদু্যত্ ধায়
তায় জেগে ওঠে ভক্তি \\
মনে পড়বে তাসের দেশ কিংবা অচলায়তন-এর কথাও৷ কিংবা লিপিকার সেই ‘কর্তার ভূত’-এর কথা৷ আর প্রবন্ধে নিবন্ধে ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে ও অজস্র খণ্ডকবিতায় কতভাবেই-না তিনি অবৈজ্ঞানিক, অপবৈজ্ঞানিক ও ছদ্মবৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গিকে তিরস্কার করেছেন৷ তাঁর সেই সব রচনা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে আমরা শুধু রবীন্দ্রনাথের সুগভীর বিজ্ঞানচেতনারই পরিচয় পাবো না, রবীন্দ্রমননে বস্তুবাদের উদ্ভাসন দেখেও চমত্কৃত হয়ে যাবো৷ শুধু সাহিত্যকর্মেই নয়, তাঁর জীবনের নানা সময়ের নানা কর্মকাণ্ডেও এই ভাববাদী কবির বস্তুবাদীসুলভ কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় আমরা পেয়ে যেতে পারি৷
দুই
অনেকে রবীন্দ্রনাথের প্রেতচর্চার প্রসঙ্গটির উল্লেখ করে তাঁকে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী বলে প্রমাণ করতে চান৷ কিন্তু এঁরা ভুলে যান যে রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র বিষয়ে কৌতূহল ছিল৷ এই কৌতূহলবশেই এক সময় তিনি প্ল্যানচেট নিয়ে প্রেতচর্চার বিষয়টিও পরখ করে দেখতে চেয়েছিলেন৷ প্ল্যানচেটের মাধ্যমে পরলোকগত মানুষের আত্মাকে মর্ত্যলোকে ডেকে আনার এবং সে-আত্মার সঙ্গে মতবিনিময় করার হুজুগটি এক সময়ে খুবই জাঁকালো হয়ে উঠেছিল৷ রবীন্দ্র পরিমণ্ডলের কিছু মানুষের মধ্যেও সে-হুজুগটির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল৷ তাঁরা রবীন্দ্রনাথকেও সেই প্রেতচর্চার আসরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ চির কৌতূহলী চিরকিশোর রবীন্দ্রনাথ প্রেতচর্চার সেই খেয়ালখেলার আসরে একজন আমুদে কিশোর খেলোয়াড়ের মতোই যোগ দিয়েছিলেন৷ এতে এমন কথা মোটেই প্রমাণিত হয় না যে তিনি প্রেততত্ত্ব তথা অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন৷ অনেক উচ্চ আধ্যাত্মিক ভাবের কথা রবীন্দ্র রচনায় আছে নিশ্চিয়ই, কিন্তু প্ল্যানচেট-বাহিত প্রেততত্ত্বে বিশ্বাসের পরিচয় রবীন্দ্রসাহিত্যের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
মানুষের আত্মা মৃতু্যর পরে পরলোকে যায়, এবং সেখানে গিয়ে ইহলোকের কৃতকর্ম অনুযায়ী শাস্তি বা পুরস্কার লাভ করে_এ-রকম বিশ্বাস তো পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই৷ কিন্তু পরলোক বা স্বর্গ নরক সম্পকর্ীয় সাধারণ বিশ্বাসের পাশাপাশি মৃতু্য-পরবতর্ী আত্মার অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে হিন্দুদের বিশ্বাসে অন্যতর একটি বৈশিষ্ট্য ও অভিনবত্ব আছে৷ হিন্দুরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী৷ অর্থাত্ মৃতু্যর পর আত্মা আগেকার দেহ ছেড়ে অন্য দেহ আশ্রয় করে, দুষ্কৃতি বা সুকৃতির মাত্রা অনুযায়ী নীচকুলে বা উচ্চকুলে জন্মগ্রহণ করে, এমন কি মহাপাপী মানুষের আত্মা ইতরপ্রাণী রূপেও জন্ম নিতে পারে৷ জন্মান্তর গ্রহণকারী এই আত্মা নিশ্চয়ই প্ল্যানচেটে এসে ভর করতে পারে না, কোনো আত্মা এ-রকম করেছে বলে কোনো প্রেতচর্চাকারীর কাছে শোনা যায়নি৷ তবে, কিছু কিছু আত্মা নাকি নতুন জন্ম নেয়ার পরও পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পারে৷ এদেরই বলা হয় ‘জাতিস্মর’৷ কেউ কেউ আবার পুরোপুরি জাতিস্মর না হয়েও স্বপ্নযোগে পূর্বজন্মের কিছু প্রসঙ্গ জেনে যায়৷ রবীন্দ্রনাথ একবার এ-রকম একজন আধাজ্ঞাতিস্মর যুবকের পাল্লায় পড়েছিলেন৷ সেই যুবকটি দাবি করেছিল যে পূর্বজন্মে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী ছিলেন তার জননী৷ স্বপ্নযোগেই এ-খবর সে জানতে পেরেছে৷ যুবকটি বলেছিল যে সে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, অনেক চিকিত্সাতেও সেই ব্যাধি থেকে সে মুক্ত হতে পারেনি৷ অবশেষে স্বপ্নযোগেই জানতে পারে যে, সে যদি তার পূর্বজন্মের মায়ের (অর্থাত্ রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর) পাদোদক (অর্থাত্ পা ধোয়া জল) পান করে তবেই সে সুস্থ হতে পারবে৷ রবীন্দ্রনাথ ঘর থেকে সাধারণ জল এনেই তাকে পত্নীর ‘পাদোদক’ বলে চালিয়ে দিলেন, যুবকটি বেশ কিছুদিন কবির বৈঠকখানাতে অবস্থান করে সেই জলই পান করতে লাগলো, এবং বললো যে সে এতে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু সুস্থ হয়েও কবির বাড়ি থেকে চলে যাবার গরজ দেখালো না৷ পরে অনেক কষ্টে কবি তাঁর ‘পূর্বজন্মের পুত্রে’র হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন৷ এই খবর প্রচার হয়ে যাবার পর আর একটি মেয়েও কবির পূর্বজন্মের কন্যা হওয়ার দাবি জানিয়েছিল, এবং সে-ও নাকি স্বপ্নেই তার পূর্বজন্মের খবর জানতে পেরেছিল৷ পূর্বজন্মের পুত্রকে নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাবার পর পূর্বজন্মের কন্যাকে কবি যে আর প্রশ্রয় দেননি, একান্ত কৌতুকের সঙ্গেই তিনি তাঁর জীবনস্মৃতিতে সে-কথার উল্লেখ করেছেন৷ বোঝা যায় : প্ল্যানচেটে পরলোকগত মানুষের আত্মাকে ডেকে এনে প্রেতচর্চার প্রতি যেমন, তেমনই পূর্বজন্মের স্মৃতিবাহী ‘জাতিস্মর’দের প্রতিও রবীন্দ্রনাথ নিতান্ত কৌতুকের দৃষ্টিতেই তাকিয়েছেন, এ-সব বুজরুকিকে নিজের বিশ্বাসের চৌহদ্দিতে ঠাঁই দেননি৷ লৌকিকেই তাঁর বিশ্বাস ছিল, অলৌকিকে নয়৷ আর এ-কথা কে না জানে যে লৌকিকে বিশ্বাসই বস্তুবাদের বৈশিষ্ট্য, এবং অলৌকিক বিশ্বাস ভাববাদের?
রবীন্দ্রনাথের যৌবনে এদেশে থিওসফির চর্চা ছিল খুবই ফ্যাশনদুরস্ত একটি বিষয়৷ রবীন্দ্রনাথ এই অলৌকিকতা-সর্বস্ব থিওসফির প্রতিও কৌতুকের দৃষ্টিতেই তাকিয়েছেন, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটিতে থিওসফির ‘অপূর্ব ম্যাগনেটিজম অথবা দৈবশক্তি, অথবা সূক্ষ্মশরীর, অথবা ঐ ভাবের একটা কিছু’ নিয়ে বিদ্রুপাত্মক বক্রোক্তি করেছেন, একদিনের জন্যও এই ফ্যাশনের কাজে আত্মসমর্পণ করেননি৷ অথচ, সে-সময়ে অনেক অনেক পাশ্চাত্য শিক্ষিত মননশীল হিন্দুও থিওসফি নিয়ে কী মাতামাতিটাই-না করেছেন! মাদাম ব্লাভাটস্কি, কর্নেল অলকট ও এ্যানি বেসান্তের মতো বিদেশী বিদেশিনীরা ছিলেন থিওসফির প্রচারক৷ সমগ্র বিশ্বচরাচরের পেছনে একটি অলৌকিক সত্তা বা আত্মা আছে বলে তাঁরা প্রচার করতেন৷ তাঁরা বলতেন : ‘এক শ্রেণীর সাধু’ আছে যাঁরা অলৌকিক ক্ষমতা বলে সেই অদৃশ্য সত্তার পরিচয় লাভ করেছেন, এবং সেই সাধু মহাত্মারা আজও হিমালয় পর্বতে বাস করে তপস্যা করে যাচ্ছেন৷ মাদাম ব্লাভাটস্কি নাকি সেই মহাত্মাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে ‘অনেক গূঢ়তত্ত্ব’ জানতে পেরেছেন এবং নিজেও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিণী হয়ে উঠেছেন৷ এ-সব কথা অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী হিন্দুদের খুব মনে ধরে, তাঁরা থিওসফির মধ্যে দিয়ে হিন্দুত্বের অভিমান চরিতার্থ করার সুযোগ পেয়ে যান৷ খ্রীস্টান ধর্মযাজক ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষরা হিন্দুর প্রতিমা পূজা, জাতিভেদ ও অন্যান্য অনেক কুসংস্কারের নিন্দা করতো৷ সেই নিন্দার জুত্সই জবাব দেবার মতো কোনো যুক্তি সনাতনী হিন্দুদের হাতে ছিল না৷ ঠিক সেই সময়েই থিওসফিস্টরা হিন্দুদের প্রায় সব যুক্তিহীন বিশ্বাস ও আচরণের সমর্থনে এগিয়ে আসে৷ আর তাতে হিন্দুরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যায়৷ থিওসফিস্টদের সমর্থনই তাদের ‘বৈজ্ঞানিক হিন্দুধর্ম’ তথা হিন্দু রিভাইভ্যালিজম্কে আরও পোক্ত করে তোলে৷ ভাববাদী ভাবোন্মত্ততা তাদের নতুন করে পেয়ে বসে৷
হিন্দু কলেজের ছাত্ররা যে মুক্তবুদ্ধির চর্চার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর হিন্দুদের শাস্ত্রীয় মূঢ়তা থেকে মুক্ত করার যে প্রয়াস নিয়েছিলেন, অক্ষয় কুমার দত্ত ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’-এর মধ্য দিয়ে যে বস্তুবাদী চিন্তার প্রসারে এগিয়ে এসেছিলেন_সে সবকিছুই যেন উনিশ শতকের আশির দশকে থিওসফিতে চোলাই-হওয়া হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের ধাক্কায় ভাববাদী চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে বসলো৷ সে সময়ে সেই চোরাবালি সম্পর্কে সচেতনতা আর কারো মধ্যে তেমন দেখা গেল না৷ সচেতনতা দেখালেন, বলতে গেলে, একমাত্র রবীন্দ্রনাথই৷ ভাববাদী কবি হয়েও একজন নিষ্ঠাবান বস্তুবাদীর মতোই তিনি বৈজ্ঞানিক দায়িত্ব পালন করলেন৷
তিন
রবীন্দ্রনাথের ভাববাদ ছিল উপনিষদের অদ্বৈতবাদ থেকে উত্সারিত৷ উপনিষদের অদ্বৈতবাদ সমস্ত সৃষ্টিকে এক ও অভিন্ন সত্তার বিকাশ রূপে দেখে থাকে৷ উপনিষদের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’, কথাটার মানে ‘এক ভিন্ন দ্বিতীয় কিছুই নেই’৷ অর্থাত্ এই মতে পৃথক কোনো ঈশ্বরেরও অস্তিত্ব নেই, বস্তু বা ভাব বা কোনো কিছুই ঈশ্বরের থেকে আলাদা নয়, সমস্তই একই সত্তার বিকাশ, সেই সত্তারই নাম দেয়া যায় ঈশ্বর কিংবা ব্রহ্ম কিংবা অন্য কিছু৷ অষ্টম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্য এই অদ্বৈতবাদেরই মায়াবাদী ভাষ্য প্রচার করেন৷ সে-ভাষ্য অনুযায়ী দৃশ্যমান জগত্ মোটেই সত্য নয়, সত্য হচ্ছেন একমাত্র ‘ব্রহ্ম’, ব্রহ্মের মায়াশক্তির কারণেই জগত্কে সত্য বলে প্রতিভাত হয়৷ রবীন্দ্রনাথ অদ্বৈতবাদকে গ্রহণ করেন, কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেন অদ্বৈতবাদের শঙ্করভাষ্য তথা মায়াবাদ৷ বস্তুজগত্কে তিনি মায়া বলে উড়িয়ে দিতে নারাজ৷ দৃশ্যস্পর্শ শব্দ গন্ধে ভরা এই জগত্টি তাঁর কাছে একান্ত সত্য৷ শুধু সত্য নয়, এ-জগত্ সৌন্দর্যময় মঙ্গলময় ও আনন্দময়৷ তবু, মনে রাখা উচিত, ভাব ও বস্তু দুই-ই তাঁর বিবেচনায় সত্য হলেও তিনি দ্বৈতবাদী নন৷ অদ্বৈতবাদী বলেই বস্তু ও ভাব তাঁর কাছে পৃথক নয়৷ আরেকজন প্রখ্যাত অদ্বৈতবাদী স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে, তিনিও এক অর্থে বস্তুবাদী বা মেটিরিয়ালিস্ট৷ কারণ বস্তুবাদীরাও তাঁর মতোই অদ্বৈতবাদী৷ অর্থাত্ তারাও সমগ্র সৃষ্টিকে একই সত্তার বিকাশ বলে বিশ্বাস করে৷ তবে বস্তুবাদীদের সঙ্গে তাঁর (বিবেকানন্দের) পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, বস্তুবাদীরা বলে সেই সত্তাটি বস্তুময় বা মেটেরিয়াল, আর তাঁর মতে তা চৈতন্যময় বা স্পিরিচুয়াল৷ রবীন্দ্রনাথ ঠিক এ-রকম কিছু না-বললেও তিনি যে ভাবচৈতন্য ও বস্তুরূপের ডায়ালেকটিক ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন সেটি তাঁর কবিতায় নিবন্ধে ও নানা চিঠিপত্রে বারবারই প্রকাশ পেয়েছে৷ ধূপ আর ধূপের গন্ধ, ভাব আর রূপ, সীমা আর অসীম যে পরস্পরের সংঘাত সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই সার্থকতা পায়, এককে বাদ দিয়ে অন্যের অস্তিত্ব যে অসম্ভব, এই ডায়ালেকটিক বোধ রবীন্দ্রনাথ একদিনের জন্যও পরিত্যাগ করেননি৷
বিজ্ঞানের অভিব্যক্তিবাদ (থিয়োরি অফ ইভোলিউশন) যে রবীন্দ্রনাথের বোধকে বিশেষভাবে পুষ্ট করেছে, সে-প্রমাণ তাঁর অনেক কবিতাতেই পাওয়া যায়৷ প্রভাত সঙ্গীত কাব্যের ‘সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়’ কিংবা সোনার তরীর ‘সমুদ্রের প্রতি’ ও ‘বসুন্ধরা’ থেকে শুরু করে বলাকা কিংবা বনবাণী পর্যন্ত প্রায় সকল কাব্যেই এমন বহু কবিতা আছে যে-গুলোর মর্মে মর্মে অভিব্যক্তিবাদের ধারণা সঞ্চারিত৷ উনিশ শতকে আবিষ্কৃত অভিব্যক্তিবাদ রবীন্দ্রনাথের অদ্বৈতবোধে এমন একটি মাত্রা দান করেছে যাতে তা শুধু শঙ্করের মায়াবাদ থেকেই পৃথক হয়ে পড়েনি, প্রচলিত ভাববাদকেও তা অনেক দূর অতিক্রম করে গেছে৷ শুধু অভিব্যক্তিবাদই নয়, বিশ শতকের তিন দশক অবধি যত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলোর প্রায় সব ক’টিরই পরিচয় রবীন্দ্রনাথ লাভ করেছিলেন৷ সে-পরিচয়ে বিশ্বের মূলগত ঐক্য সম্পর্কে তাঁর বোধ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে৷ সেই ঐক্য থেকে বৈচিত্র্যের উদ্ভবকে তিনি উপলব্ধি করেছেন বস্তুবাদী বিজ্ঞানীর দৃষ্টি দিয়েই৷ অবৈজ্ঞানিক ভাববাদের কুহেলিকা তাঁর চৈতন্যকে কখনও আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারেনি৷ বলা যায়, তাঁর চৈতন্যে ভাববাদের নির্মোকে তিনি বস্তুবাদের অন্তঃসারকেই ধারণ করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে বিশ্বপরিচয় নামে বিজ্ঞানের যে বইটি লিখেছিলেন তাতে তো একান্ত স্পষ্ট ভাষায় ‘অপ্রাণ থেকে প্রাণের’ বা ‘জড় থেকে চৈতন্যের’ উদ্ভবের বস্তুবাদী বোধেরই প্রকাশ ঘটেছে৷ বিশ্বপরিচয়-এর ‘ভূলোক’ প্রবন্ধটিতে তিনি এই বোধেরই প্রসাদগুণসম্পন্ন অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন৷ এই বইয়েরই উপসংহারে তিনি লিখেছেন_
অপ্রাণ বিশ্বে যে-সব ঘটনা ঘটেছে তার পিছনে আছে সমগ্র জড় জগতের ভূমিকা৷ মন এইসব ঘটনা জানছে, এই জানার পিছনে মনের একটা বিশ্বভূমিকা কোথায়? পাথর লোহা গ্যাসের নিজের মধ্যে তো জানার সম্পর্ক নেই৷ এর দুঃসাধ্য প্রশ্ন নিয়ে বিশেষ একটা যুগে প্রাণ মন এল পৃথিবীতে_অতিক্ষুদ্র জীবকোষকে বহন করে৷
পৃথিবীতে সৃষ্টি-ইতিহাসে এদের আবির্ভাব অভাবনীয়৷ কিন্তু সকল কিছুর সঙ্গে সম্বন্ধহীন একান্ত আকস্মিক কোনো অভু্যত্পাতকে আমাদের বুদ্ধি মানতে চায় না৷ আমরা জড়বিশ্বের সঙ্গে মনোবিশ্বের মূলগত ঐক্য কল্পনা করতে পারি সর্বব্যাপী তেজ বা জ্যোতিঃপদার্থের মধ্যে৷ অনেক কাল পরে বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে আপাতদৃষ্টিতে যে-সকল স্থূল পদার্থ জ্যোতিহীন, তাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন আকারে নিত্যই জ্যোতির ক্রিয়া চলছে৷ এই মহাজ্যোতিরই সূক্ষ্ম বিকাশ প্রাণে এবং আরও সূক্ষ্মতর বিকাশ চৈতন্যে ও মনে৷ বিশ্বসৃষ্টির আদিতে মহাজ্যোতি ছাড়া আর কিছুই যখন পাওয়া যায় না, তখন বলা যেতে পারে চৈতন্যে তারই প্রকাশ৷ জড় থেকে জীবে পর্দা উঠে মানুষের মধ্যে এই মহাচৈতন্যের আবরণ ঘোচাবার সাধনা চলেছে৷ চৈতন্যের এই মুক্তির অভিব্যক্তিই বোধ করি সৃষ্টির শেষ পরিণাম৷
কবির এ-বক্তব্য অবশ্যই কট্টর জড়বাদী বা যান্ত্রিক বস্তুবাদীর নয়৷ ‘জড়বিশ্বের সঙ্গে মনোবিশ্বের মূলগত ঐক্য’ বিধানের জন্য এক ‘সর্বব্যাপী তেজ জ্যোতিঃপদার্থের’ কল্পনা করেছেন তিনি৷ এই কল্পনার জন্যও অবিশ্যি তাঁকে বিজ্ঞানেরই দ্বারস্থ হতে হয়েছে৷ বস্তুবিজ্ঞানের আবিষ্কারকে অবলম্বন করেই তিনি ঔপনিষদিক অদ্বৈতবাদে আস্থাকে সজীব রাখতে চেয়েছেন, প্রাচীন ভারতীয় ভাববাদকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপাদান দিয়ে সংস্কার করে নিয়েছেন৷ যে ‘সর্বব্যাপী তেজ বা জ্যোতিঃপদার্থে’র কথা তিনি বলেছেন তাকে নিশ্চয়ই ধর্মশাস্ত্রের ‘ঈশ্বরে’র সঙ্গে এক করে দেখা চলে না, বরং বস্তুবাদীদের মতে যা বিশ্বসৃষ্টির মূল উপাদান এটি সে-রকম ‘বস্তু’ই৷ কাজেই বিশুদ্ধ ভাববাদীর দলে আমরা তাঁকে ফেলতে পারি না৷ বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথের ভাববাদ একান্তই সাংস্কৃতিক ভাববাদ৷ এ-রকম সংস্কার সাধন করতে গিয়েই তিনি, আগে যেমন বলেছি, ভাববাদের নির্মোককে বস্তুবাদের অন্তঃসার দিয়ে পূর্ণ না-করে পারেননি৷
চার
ভাববাদী কবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে-রকমটি দেখেছি, তার বিপরীতটি দেখেছি বস্তুর স্বরূপ-সন্ধানী অনেক বিজ্ঞানীর মধ্যে৷ বস্তুজগত্ নিয়ে কারবার যে-বিজ্ঞানীর, তিনি যে মূলগতভাবেই বস্তুবাদী হবেন_এতে তো কোনোই সন্দেহ থাকার কথা নয়৷ কারণ বিজ্ঞানীর নিরীক্ষার বিষয় যে-বস্তু, সেই বস্তুরই যদি অস্তিত্ব না থাকে, কার্যকারণ নিয়মের অনধীন নিরালম্ব ভাবই যদি হয় সার্বভৌম, তাহলে তো বিজ্ঞানীর আর দাঁড়াবারই জায়গা থাকে না৷ অথচ, কী আশ্চর্য, বিজ্ঞানীদেরও অনেকে বস্তুবাদ ছেড়ে ভাববাদে আশ্রয় নিয়েছেন, যে-ডালটি তাঁদের আশ্রয় সেই ডালটিই কেটে ফেলে নিজেদের আশ্রয়চু্যত করার ব্যবস্থা করেছেন৷ এবং এ-রকম ঘটনা বিশ শতকের শুরুতেই বেশি করে ঘটেছে৷ এটি ঘটিয়েছে নব্য পদার্থবিজ্ঞানের কিছু নতুন আবিষ্কার৷ সেই আবিষ্কারকে উপলক্ষ করেই জেম্স্ জিন্স্ ও এডিংটনের মতো বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা ‘বস্তুর অস্তিত্বহীনতা’-তত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে বসেন৷ বস্তুর অস্তিত্বে অবিশ্বাসই তাঁদেরকে স্বাভাবিকভাবেই, ভাববাদে বিশ্বাসের দিকে ঠেলে দেয়৷ ভাববাদী বিজ্ঞানীদের প্রাদুর্ভাব পুরো বিজ্ঞানকেই কলুষিত ও উন্মার্গগামী করে তোলে৷ আগে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন যে, মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলো কঠিন ও অবিভাজ্য, এদের কোনো বিনাশ নেই৷ কিন্তু উনিশ শতকের শেষভাগে পারমাণবিক গবেষণায় নতুন যুগের সূত্রপাত ঘটে, ইলেক্ট্রন ও প্রোটনের আবিষ্কারের ফলে পরমাণু সম্পর্কে আগেকার ধারণা বদলে যায়৷ আবিষ্কৃত হয় যে : পরমাণুর জগতেও অবিরত ভাঙাগড়া চলছে, পরমাণুগুলোও অবিভাজ্য নয়, এদের মধ্যেও আছে গতিচঞ্চলতা ও পরিবর্তনশীলতা৷ বিজ্ঞানের এই নতুন আবিষ্কার রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তে যে-আলোড়ন তোলে, সে-আলোড়নই তাঁর কলমে ভাষারূপ লাভ করে এ-ভাবে_
এককালের বিজ্ঞানীরা খুব দৃঢ়স্বরেই ঘোষণা করেছিলেন যে ৯২টি আদিভূত বিশ্বসৃষ্টির মৌলিক পদার্থ৷ অতিপরমাণুদের সাক্ষ্যে আজ সে-কথা অপ্রমাণ হয়ে গেল৷ একদা মৌলিক পদার্থের একটা খ্যাতি ছিল যে তার গুণের নিত্যতা আছে৷ তাদের যতই ভাঙা যাক কিছুতেই তাদের স্বভাবের বদল হয় না৷ বিজ্ঞানের নতুন অধ্যায়ে দেখা গেল তাদের চরম ভাগ করলে বেরিয়ে পড়ে দুই জাতীয় বৈদু্যতের জুড়ি নৃত্য৷
পরমাণু সম্পর্কে এ-রকম নতুন ধারণা দিয়ে পুরনো ধারণাকে স্থানচু্যত করেই কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান থেমে থাকেনি৷ এরপর হাইসেনবার্গ-আবিষ্কৃত ‘অনিশ্চয়তাবাদ বা অনির্ণেয়বাদ তত্ত্ব’ তো বিজ্ঞানে এক যুগান্তরেরই সূচনা ঘটায়৷ আর এ-যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে অনেক বিজ্ঞানীও এমন গাড্ডায় পড়ে গেলেন যে তাঁরা বিজ্ঞান সাধনার যে মূল উপাদান, সেই বস্তুর অস্তিত্বের প্রতিই বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেন৷ অনিশ্চয়তাবাদের প্রকৃত বৈজ্ঞানিক মর্মের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে তাঁরা পরমাণু জগত্সহ সমগ্র বস্তুজগতে দেখলেন ‘নিয়মহীনতা’র রাজত্ব৷ অথচ প্রথাগত অর্থে বিজ্ঞানী না-হয়েও কবি রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এ-রকম বস্তুবিরোধিতা তথা বিজ্ঞান-বিরোধিতার পাঁকে আটকে গেলেন না৷ উনিশ শতকের প্রেততত্ত্ব বা থিওসফিতে যেমন তিনি বিশ্বাস করেননি, তেমনই বিশ শতকের নব্য পদার্থবিজ্ঞানের ভুল ব্যাখ্যাজাত নব্যভাববাদও তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি৷
বিশ শতকে আবার উদ্ভব ঘটে এক ধরনের ‘নাস্তিক ভাববাদ’-এর৷ এ রকম নাস্তিক ভাববাদ বিশেষভাবে অধিকার বিস্তার করে মনোবিজ্ঞানের এলাকায়৷ সিগমুন্ড ফ্রয়েড হলেন এর পুরোধা৷ ফ্রয়েড সাহেব ঈশ্বরবিশ্বাস ও ধর্মভাবনার বিরুদ্ধে নানা দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েছিলেন৷ অর্থাত্ ফ্রয়েড ছিলেন এথিস্ট_এবং ‘এথিস্ট’ শব্দটির বহুল প্রচলিত বাংলা প্রতিশব্দ অনুসারেই_’নাস্তিক’৷ অথচ নাস্তিক হয়েও ফ্রয়েড কিন্তু প্রচণ্ড ও মারাত্মক ধরনের ভাববাদেরই পোষকতা করলেন৷ কারণ ঈশ্বরের ভূমিকায় তিনি নামালেন তাঁরই ভাবকল্পনার সৃষ্টি ‘লিবিডো’ নামক এক দানবকে৷ এই দানবটিকে চর্মচক্ষে দেখা বা চেনা যায় না, সে বাস করে মানুষের মনের গহিন তলদেশে,_’অচেতনে’ আর ‘অবচেতনে’৷ ঈশ্বরের মতোই সে নিরাকার নির্বিকল্প আর সর্বশক্তিমান৷ এই লিবিডোই যেমন মানুষের মনে ‘রমণেচ্ছা’ রূপে দেখা দেয়, তেমনই দেখা দেয় ‘মরণেচ্ছা’ রূপেও৷ মানুষের কাজ-কাম তার সচেতন ইচ্ছা দিয়ে খুব কমই চলে, তার অচেতন মনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ‘রমণ’ আর ‘মরণ’ই তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়৷
রবীন্দ্রজীবনের শেষ অধ্যায়ে এই নাস্তিক ভাববাদ বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে বসেছিল৷ ফ্রয়েডবাদের অনুসারিতাকেই সে-সময়কার নবীন সাহিত্যিকেরা ‘আধুনিকতা’র পরাকাষ্ঠা বলে মেনেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথও এই ফ্রয়েডবাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, কিন্তু এর কুহকে মজেননি৷ তাঁর সবল কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই এর ভেতরকার গলদ ও ভ্রান্তিগুলিকে তিনি চিনে নিয়েছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথের মৃতু্যর অনেক বছর পরে_১৯৭৮ সালের ৩ মার্চ সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় ‘বিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন শ্রীমতী সুমিতা মিত্র৷ সে-প্রবন্ধে তিনি এতাবত্কালের অজ্ঞাত একটি তথ্য পরিবেশন করেন৷ তথ্যটি হচ্ছে : ১৯৪০ সালের শেষ ভাগে শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক বিনয় গোপাল রায় ‘মানবজীবনে অবচেতনার প্রভাব’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখে তার পাণ্ডুলিপি রবীন্দ্রনাথকে পড়তে দিয়েছিলেন৷ প্রবন্ধটিতে ফ্রয়েডীয় মতবাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত হয়েছিল৷ প্রবন্ধটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ সেই পাণ্ডুলিপির মার্জিনে কিছু চোখা চোখা মন্তব্য লিখেছিলেন৷ যেমন_
১. স্বভাবের কোনটা আসল কোনটা আসল নয় সে-ও এমন একান্ত করে বলা যায় না৷ সমষ্টিগত স্বভাব চেতনায়-অবচেতনায় মিলিয়ে৷ বিশ্লিষ্ট করলে ধরা পড়ে সবুজ রঙের মতো তার এক উপাদান নীল আর এক উপাদান হলদে৷ প্রশ্ন এই, অবচেতনায় যেটা ধরা পড়ে সেইটিই কি আসল স্বভাব? তার সঙ্গে মিলেছে অভ্যাস শিক্ষা ও ভয়-লজ্জার প্রভাব_চরিত্র সব জড়িয়েই কি নয়? বিশেষ মানসিক রোগে ঐক্য ভেঙে যায়, তখন উপরকার চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে ভিতরের চামড়া দেখা দেয়৷ কিন্তু সহজ অবস্থায় আবরণটা স্বভাবের অন্তর্গত নয় কি?
২. আমরা চা খাই, তাতে আছে দুধ, চিনি ও চা, চেতন মন ভোগ করে সম্মিলিত স্বাদ_অবচেতন মনে কি এই স্বাদ বিশ্লিষ্ট করে জানি? অনেক ঢেউ যে শব্দ করে সব জড়িয়ে সেটা এক করে জানি৷ প্রত্যেক ঢেউয়ের শব্দ স্বতন্ত্রভাবে মৃদু_অবচেতন মনে কি হাজার হাজার মৃদু শব্দ বিশ্লিষ্ট হয়েই থাকে, এক হয় চেতন মনে? ইন্দ্রিয়বোধের অনেকগুলিই যৌগিক_যেমন নীলের সঙ্গে হলদে মিললে হয় সবুজ_অবচেতন মন কি সবুজকে দেখেই না? বড় শব্দ ছোট শব্দের সমষ্টি_অবচেতন মন কি সেই সমষ্টি ভাঙ্তে পারে?
৩. পরস্পরের অবচেতন স্বভাব নিয়েই যদি আমাদের স্বভাব হোত তাহলে তো সমাজ একটা পাগলাগারদ হয়ে উঠত৷
কবি রবীন্দ্রনাথ এখানে খাঁটি বিজ্ঞানের বিপরীতে ছদ্মবিজ্ঞানকে অতি সহজেই চিনে নিতে পারলেন; অথচ বিজ্ঞানী ফ্রয়েড ও তাঁর অনুগামীরা একটি ছদ্মবিজ্ঞানেরই প্রচার-প্রসার ঘটানোর কাজে আত্মনিয়োগ করলেন৷ ধর্মবিরোধী ও নাস্তিক ফ্রয়েড হয়ে গেলেন এক ভাববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা, আর ঔপনিষদিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী আস্তিক রবীন্দ্রনাথ সেই ভাববাদী তত্ত্বেরই ভ্রান্তি নির্দেশ করলেন বস্তুবাদীসুলভ বিজ্ঞানদৃষ্টি দিয়ে৷ বিষয়টি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক বটে!
আর, কী আশ্চর্য, স্নায়ুবিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রগতির যুগেও ফ্রয়েডীয় কুহক ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারছেন না অনেক বাঘা বাঘা মনোবিজ্ঞানীও৷ মনোবিজ্ঞানকে এখনও তাঁরা আত্মমুখী ভাববাদের কুঠুরিতে বন্দী করে রাখতে চাইছেন, প্রকৃত বিজ্ঞান হয়ে উঠতে দিচ্ছেন না৷ সেই অবিজ্ঞানই আবার শিল্পসংস্কৃতির জগত্কে রাখছে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে, অচেতন-অবচেতনের কূটকচালি দিয়ে আবিল করে রাখছে শিল্পসাহিত্য-বিচারের সুস্থ ধারাকে৷ পশ্চিমে নয়া-ফ্রয়েডবাদীরা ফ্রয়েডকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য নানা রকম কোশেশ করে যাচ্ছেন৷ এঁরা ফ্রয়েডের মতবাদ দিয়ে মার্কসকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে চাইছেন, কিংবা ফ্রয়েডবাদ দিয়ে মার্কসবাদকে ‘শোধন’ করে নেয়ার হাস্যকর প্রয়াসে মেতেছেন৷ ফ্রয়েডীয় নাস্তিক ভাববাদে আস্থা স্থাপন করেও মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে প্রত্যয়ী থাকা, কিংবা এই দুই মতবাদের সম্মিলন ঘটানো, এর যে-কোনোটাই একান্ত অবৈজ্ঞানিক ভ্রান্তিবিলাস_সে-কথা এঁদের কে বোঝাবে?
পাঁচ
মজার কথা হচ্ছে : রবীন্দ্রনাথকেও কখনও কখনও_বিশেষ করে জীবনের শেষ পর্বে_নাস্তিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়েছে৷ এ-রকম একজন অভিযোগকারী হলেন রমাপ্রসাদ চন্দ৷ বিশিষ্ট রবীন্দ্র-সমালোচক দেবদাস জোয়ারদার কলকাতার সাহিত্য-পত্রিকা চতুরঙ্গ-এর একটি সংখ্যায় (১ শ্রাবণ, ১৪০১) চন্দ মহাশয়ের রবীন্দ্র-বিষয়ক দু’টি লেখার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন৷ রমাপ্রসাদ চন্দ ১৩৪০ বঙ্গাব্দের (১৯৩৩ খ্রীঃ) জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা বসুমতী পত্রিকায় লেখেন ‘মানবধম্মর্ের মমর্্মকথা’ এবং একই পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায় ‘মানবসত্যে ভুল’৷ দুটো লেখারই আলোচ্য বিষয় ছিল Religion of Man (১৯৩১-এ অক্সফোর্ডে প্রদত্ত হিবার্ট বক্তৃতা) ও ‘মানুষের ধর্ম’তে (১৯৩৩-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত কমলা বক্তৃতা) রবীন্দ্রনাথের ধর্ম-সম্পকর্ীয় মতামত৷ এগুলো পর্যালোচনা করেই চন্দ মহাশয় সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে রবীন্দ্রনাথ এখন নাস্তিক হয়ে উঠেছেন, এবং ‘কমতের ধম্মর্ের এবং রবীন্দ্রনাথের ধম্মর্ের মমর্্মগত পার্থক্য দেখা যায় না৷’
রমাপ্রসাদ চন্দের বক্তব্যের পরিচয় দিতে গিয়ে দেবদাস জোয়ারদার লিখেছেন_ “ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসী দার্শনিক কোঁত্ (১৭৯৮-১৮৫৭) [এই কোঁত্ নামটিতেই উনিশ শতকের বাঙালী লেখকগণ লিখতেন কোমত্ বা কমত_য. স.] Positivism -এর প্রবক্তা৷ কোঁতের GRANDETRE এবং রবীন্দ্রনাথের মহামানব চন্দ মহাশয়ের কাছে এক বলে মনে হয়েছে৷ কবির মানবিক ভূমাকে তিনি ‘কাঁঠালের আমসত্ত্বের মত আজগুবি’ বলেছেন৷ তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথ ‘য়ুরোপে এসিয়ার প্রেরিত আধ্যাত্মিকতার সমাচারবাহক দূত’ নন, ‘ভারতবর্ষে তিনি য়ুরোপের প্রেরিত ঐহিকতার (Materialism) সমাচারবাহক দূত৷’ …চন্দ মহাশয়ের অভিযোগ, কবির ব্যাখ্যাত মানবধর্মে য়ুরোপীয় নাস্তিকতা ও বস্তুবাদেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে৷”
আজকের দিনে আমরা যে-রকম স্পষ্টভাষায় ‘আইডিয়ালিজম’ ও ‘মেটিরিয়ালিজম’ শব্দ দুটির বাংলা রূপে ‘ভাববাদ’ ও ‘বস্তুবাদ’ ব্যবহার করি, উনিশ শতকে ঠিক তেমনটি করা হতো না৷ এমন কি, বিশ শতকের গোড়ার দিকেও ‘ভাববাদ’ ও ‘বস্তুবাদ’ শব্দদুটির ব্যাপক প্রচলন ঘটেনি৷ তখন মেটিরিয়ালিজমকে বাংলায় ‘জড়বাদ’ বলা হতো বটে, কিন্তু শব্দটির উদ্দিষ্ট অর্থটি খুব গৌরবদ্যোতক ছিল না৷ গোঁড়া ধার্মিকরা যে-কোনো উদার ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেই ‘জড়বাদী’ বলে ভর্ত্সনা করতেন, এমনকি মুক্ত বুদ্ধিচর্চাকারী ব্যক্তি ঈশ্বর বিশ্বাসী হলেও ‘নাস্তিক’ বলে নিন্দিত হতেন৷ তাই, ১৯৩৩ সনেও তো দেখি, রমাপ্রসাদ চন্দের মতো একজন প্রাজ্ঞ ইতিহাসবিদ্ও রবীন্দ্রনাথের উদার মানবিক চিন্তার মধ্যে য়ুরোপীয় নাস্তিকতার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন৷
‘নাস্তিক’-এর বিরপীত শব্দ ‘আস্তিক’৷ ‘আস্তিক’ কথাটির মূল ‘অস্তি’ বা ‘আছে’, আর ‘নাস্তিক’-এর ‘নাস্তি’ বা ‘নাই’৷ তা থেকে শব্দদুটোর ব্যবহারিক অর্ধ দাঁড়িয়ে গেছে যে, ‘ঈশ্বরে যার বিশ্বাস আছে, সে-ই আস্তিক’ আর ‘ঈশ্বরে যার বিশ্বাস নেই, সেই
নাস্তিক’৷ আদিতে কিন্তু শব্দদুটোর অর্থ এ-রকম ছিল না৷ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বেদের প্রামাণিকতায় অবিশ্বাসীকেই বলা হয়েছে নাস্তিক৷ সাংখ্য দর্শনের কপিল যদিও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ছিলেন, তবু বেদের প্রামাণিকতা মানতেন বলেই তিনি আস্তিক৷ কিন্তু বৌদ্ধ জৈন ও লোকায়তিকরা বেদের প্রামাণিকতায় অবিশ্বাসী ছিলেন বলেই সে সময়কার সমাজের কতর্ৃত্বশীল ব্রাহ্মণরা তাদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়েছে৷ বেদের প্রামাণিকতায় বিশ্বাস মানেই তো ব্রাহ্মণদের দেয়া শাস্ত্রবিধানে বিশ্বাস, এবং এ-রকম বিশ্বাস যাদের আছে তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও ব্রাহ্মণ্য সমাজ স্বস্তিতে থাকতে পারতো, তাই সেকালের ব্রাহ্মণ সমাজ-বিধাতাদের বিচারে তাদের আস্তিক হতে বাধা থাকেনি৷ কিন্তু পরে নানা অবস্থান্তরের মধ্য দিয়ে এক সময়ে ঈশ্বরে অবিশ্বাসীকেই সাধারণভাবে ‘নাস্তিক’ বলা হতে লাগলো৷ তবু, এখনও, ‘নাস্তিক’ ও ‘আস্তিক’ শব্দদুটোর অর্থ একেবারে অবিসংবাদী হয়ে গেছে বলা যায় না৷ স্বামী বিবেকানন্দ তো উনিশ শতকেই বলেছিলেন, ‘প্রাচীন ধর্ম বলিত যাহারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না তাহারই নাস্তিক, নবীণ ধর্ম বলিতেছে যাহারা নিজেকে বিশ্বাস করে না তাহারাই নাস্তিক৷’
এ বিচারে তো রবীন্দ্রনাথকেও কিছুতেই নাস্তিক বলা চলে না, ‘নবীন ধর্মে’র সাধক রূপেই তিনি ‘নিজেকে বিশ্বাস’ করেন, এবং এ-কারণেই তিনি আস্তিক৷ কিন্তু এ-রকম নবীনধর্মে যারা বিশ্বাস করে না, তাদের দৃষ্টিতে তো তিনি নাস্তিকই৷ বেদ-উপনিষদের প্রতি শ্রদ্ধা সত্ত্বেও কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিচারে তিনি ‘আস্তিক’ হতে পারেন না, কারণ বেদ-উপনিষদের ব্রাহ্মণ্যভাষ্যে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না, তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মতোই বেদকে তিনি অপৌরুষেয় বলে মানেন নি, বেদ-উপনিষদ তথা কোনো শাস্ত্রকেই যুক্তি-বিচারের ঊধের্্ব রাখতে রাজি হননি৷ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘যাহা বিশ্বাস্য তাহাই শাস্ত্র, যাহা শাস্ত্র তাহাই বিশ্বাস্য নহে৷’ এ-রকম যুক্তিবিচারশীল দৃষ্টি দিয়ে যখন তিনি Religion of Man বা মানুষের ধর্মের ব্যাখ্যা প্রদান করেন, তখন তাঁর সে-ধর্ম সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকেই পৃথক হয়ে গেল৷ তাই যে-কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গোঁড়া অনুসারীরা তো তাঁকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিতেই পারেন৷ রমাপ্রসাদ চন্দও এভাবেই, একজন গোঁড়া ধার্মিকের অবস্থান থেকেই, রবীন্দ্রনাথকে নাস্তিক বলেছেন৷
আসলে রবীন্দ্রনাথ।
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ আগস্ট (বাংলা ১৩৪৩ সনের ২ ভাদ্র) তারিখে যতীন সরকারের জন্ম হয় নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে।
শিক্ষকতা করতে করতেই তিনি আজ ‘গণশিক্ষক’। ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বিএ পরীক্ষা দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে তিনি দু’মাস কেন্দুয়ার আশুজিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরবর্তী দু’বছর (১৯৫৯-১৯৬১) বারহাট্টা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পরীক্ষা দেয়ার পর দশমাস গৌরীপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা শেষে ১৯৬৪ সালে যোগ দেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসাবে।
চার দশক একাগ্রচিত্তে শিক্ষকতার পর অবসর নেন তিনি।
কলেজ জীবনে লেখালেখির সূচনা হলেও যতীন সরকারের লেখা প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে, পঞ্চাশ বছর বয়সে। প্রথম বইয়ের নাম ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যশা’। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশের কবিগান’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, মানবমন, মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’, ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’, ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’, ‘পাকিস্তানের ভূত দর্শন’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও সমাজ চেতনা’, ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’, ‘রাজনীতি ও দুর্নীতি বিষয়ক কথাবার্তা’, ‘আমদের চিন্তার চর্চার দিক্ দিগন্ত, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভুত ভবিষ্যত’, ভাষা সংস্কৃতি উৎসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’, ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন’, ‘সত্য যে কঠিন’, ‘বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি’, ‘বাংলা কবিতার মূলধারা এবং নজরুল’, ‘ভাবনার মুক্ত বাতায়ন’, রচনা সমগ্র(১ম ও ২য় খ-)সহ আরও বেশকিছু জীবনীগ্রন্থ ও সম্পাদিত বই। ‘সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ নামে একটি তাত্ত্বিক ত্রৈমাসিক সম্পাদনা করতেন তিনি।
রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য সবক্ষেত্রেই তিনি এক ক্ষুরধার লেখক। অসামান্য প্রতিভার কারণেই মফস্বলের নিভৃতে পড়ে থাকা সত্ত্বেও সচেতন লোকচক্ষু তাকে এড়িয়ে যায়নি কখনও।
স্বাধীনতা পদক(২০১০), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার(২০০৭), বাংলা একাডেমী প্রদত্ত ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক(১৯৬৭), খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পরস্কার(১৯৯৭), প্রথম আলোর বর্ষসেরা বই পুরস্কার(২০০৫), মনিরউদ্দিন ইউসুফ স্মৃতি পদক(১৯৯৭), ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব সাহিত্য পদক(২০০১), আলতাব আলী হাসু পুরস্কার(২০০৯) সহ অসংখ্য পুরষ্কার-খ্যাতি পেয়েছেন।