Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,মদন

ইরাবতী পুনর্পাঠ গল্প: মদন কাহার । আবুল বাশার

Reading Time: 11 minutes

একই জীবনে কতরকম হলো! এতে বিচিত্ররকম হলো যে তার বিবরণ খাড়া করাই মুশকিল। ছেলেবেলাটাকেই আজকাল সবচেয়ে বাঙ্ময় মনে হয়, আর্টের আসল কুঞ্জি সেই ছেলেবেলার মুঠোয় ধরে রেখেছে কেউ—সে আমার স্মৃতিই বটে। স্মৃতিই রিয়েল আর্টিস্ট। যেখানে স্মৃতি নেই, সেখানে শিল্প নেই।

স্মৃতি দিয়েই আমরা জীবনটাকে, এই নিসর্গ, ওই আকাশ, দূরের ওই নক্ষত্রপুঞ্জ, ওই সূর্য, ওই ছায়াপথ, এই সমাজ, এই মানুষ, ওই নদী, সেই ধূলিগ্রাম, পাখিদের, জীবেদের এবং যা আছে এবং যা নেই, সব শূন্যতা ও সব পূর্ণতা—সব কিছু, ‘না’ ও ‘হ্যাঁ’-কে গেঁথে তুলি। মোমবাতির সুতো, মালার সুতো, মিছরির সুতো ছাড়। মোম-মালা-মিছরি যেমন হয় না বা হয়ে ওঠে না, তেমনি স্মৃতি ছাড়া জীবন হয় না বা হয়ে ওঠে না। স্মৃতিই সাহিত্যের ফুঁপি। সাহিত্যের গ্রন্থনা স্মৃতি দিয়েই হয় এবং স্মৃতিই ফুলকারি ও ছবি; স্মৃতিই বুনন ও বয়ান।

আজ হিসেব করে দেখছি, জীবনের অর্ধেকটাই কেটেছে দুটি নদীর কোলে। সাদা কথায় নদী দুটির একটি হলো বড়ো নদী, অন্যটি ছোটো নদী। কিন্তু কথায় একটি জবরদস্ত সংশোধনী আছে। যেটি এরকম:

নদী আসলে তিনটি। বড়ো নদী আর তার দুটি শাখা নদী, তারা ছোটো। একটি ছোটো নদীর নামটিও ‘ছোটোনদী’। অন্য ছোটো নদী নামটি বিশেষ চমৎকার। গোমানী। এই নামটির বিশুদ্ধ রূপটি আরও সবিশেষ সুন্দর—গোমোহনী।

গোমোহনী নামটিই স্মৃতি দিয়ে রচনা করে একটি আশ্চর্য দৃশ্য। একদল গোরু-মোষ নিয়ে কোদালকাটি ডাঁড়ার উপরের চুটে যে কদম গাছটা, তার গোড়ায় বসে রয়েছে একটি বালক, মাথায় ছোটো লাল গামছার পাগড়ি, খালি গা, খালি পা, পরনে ইজের প্যান্ট, আর হাতে একহাতি একটি গো-খ্যাদানে লাঠি। কানে গোঁজা জবা ফুল।

ওই রাখাল বালকটির নাম মদন সেখ; ও আমার সহপাঠী বন্ধু। ওর বাপ পেটভাতার কিষান-মাহিন্দার; মাধবপুরের খানেদের জোতে কাজ করে। তখনকার দিনে, আমি তখন বালক মাত্র, এই একটা ব্যবস্থা ছিল, জোতদারের জোতে পেটভাতায় খাটত লোকে, চাষবাস করত, গোরু মোষ ইত্যাদির দেখভাল, পোষ-পালা করত, লাঙল ঠেলত, মই দিত, নিড়ুনি দিত। বদলে তিনবেলা পেট ভরে খেতে পেত। ফসলের পাঁজা পেত। আর ইদে-পুজোয় জামা-কাপড়-খাটো ধুতি-জোলাটে লুঙ্গি-তরতিপুরি রাঙা গামছা পেত—বাড়ির ছেলেমেয়ে-বউয়ের জন্য যথাযোগ্য বসন পেত। আর পুজো-ইদের জন্য কিছু অর্থ পেত, উৎসবের জন্য খচ্চা করতে বরাদ্দ হতো যৎসামান্য টাকা—এরই নাম ছিল পেটভাতার কাজ, কৃষিকাজ।

পরে এই ব্যবস্থায় কিছু-সামান্য বদল ঘটে। অল্প মাসমাইনে চালু হয়। মদনের বাপ খেলাফত অল্প মাইনেয় পেটভাতার কৃষিকাজ করত কাইয়ুম খানের জোতে।

মদন আধেকটা রাখাল, আধেকটা ছাত্র। ‘অধ্যয়নং তপঃ’ কথাটা মদনের বেলায় খাটত না। ওর ঠাকুমার ইচ্ছে ও দু-এক বছর অন্তত বড়ো ক্লাসে পড়ে, তারপর যা করার করবে। কী আর করবে? অল্প মাইনের সঙ্গে পেটভাতার কাজ ধরবে দৌলতপুরের নবি মণ্ডলের জোতে? অবশ্য নবি মণ্ডলের সঙ্গে কথা হয়েছে ঠাকুমা (দাদি)-র; একটা টাটে-বসা কাজ দেবেন যদি মদন বড়ো ক্লাসে উঠে স্কুলছুট হয়ে যায়! তখন নবি মণ্ডলের ডিমের আড়তে গদিয়ান হিসেবরক্ষকের কাজ জুটবে মদনের। এইটেই হলো টাটে-বসা বাবু ধরনের কাজ।

তার আগে, এখন থেকেই নবি মণ্ডলকে তুষ্ট রাখায় কোনও একটা কাজ জুটিয়ে নেওয়া চাই।

কী সেই কাজ?

আছে। কাজ ঢুঁড়ে নেওয়া চাই। বলেছে দাদিমা।

ডাঁড়ার ব্যাপারটি বোঝানো যাক। এখানে রয়েছে একটি জলকপাট। তার উপর দিয়ে গেছে রাস্তা। কোদালকাটির ডাঁড়া বলতে এই স্লুইস গেটকে বোঝানো হচ্ছে। কোদাল দিয়ে রাস্তার মাটি কেটে বসানো হয়েছে এই জলকপাট। যার ফলে নদীর জল ঢুকেছে বিলে। ফের এই গেটের উপর দিয়ে বয়ে গেছে পথ— সেই পথ গেছে উত্তরের বিশ-বাইশটা গ্রামের ঠিকানায়।

বিল আর জল টানছে না।

নিতান্ত শ্লথ স্রোত বয়ে যাচ্ছে পুরো খোলা কপাট পেরিয়ে বিলের কানায় টইটই করা জলের বিস্তারের ভিতরে ও উপরে। তখনই শুরু হয়ে যায় খেলাটা।

নদীর পাড়-লাগোয়া জমিতে যে- বেতাই ধানের চাষ হয়েছে, সেই ধানে দুধ এসে গিয়েছে। থোড় ফেটে শিষ দেখা দিয়েছে— সেই শিষ যদি জলের তলায় তলিয়ে ডুবে যায়, তখন সমাচার কী দাঁড়ায়?

কথা হচ্ছে, ধান গোলায় তুলতে হলে কি উঠোনে মেলতে হলে নদীর স্বভাব-চরিত্তির জানা চাই। মদন নদীর স্বভাব সবচেয়ে বুঝত ভালো, স্রোতের ভাষাও ধরে ফেলত সবার আগে।

বেতাইয়ের চরিত্তির ব্যাপারে ওর জ্ঞান ছিল সবার চেয়ে টনটনে। এত কড়া-কঠিন জানবাজ ধানবীজ সংসারে আর দ্বিতীয়টি দেখা গেল না।

মূল লড়াই তার গোমানীর জলের শ্বাসরোধী প্রকৃতির সঙ্গে। তবে গোমানীর মতো চাষীর কথা মনে রেখে স্রোতের চাল দেয় এমন নদীও বড়ো-একটা দেখা যায় না।

সেই নদীর উত্তর-দক্ষিণ পাড়ে লম্বা ফালির ২২ বিঘার চাষ রয়েছে নবি মণ্ডলের। এই পাড়েই আমাদের রয়েছে চার বিঘার চটান, বেতাইয়ের চাষ।

আমাদের পরিবার হলো মাস্টার ফ্যামিলি। চাষি-ফ্যামিলিই মাস্টার-ফ্যামিলি হয়েছে। কারণ, আমার দাদিমা বাবাকে চাষি হতে দেয় নাই, লেখাপড়া শিখিয়ে চাষ থেকে টেনে নিয়ে বাবু করে বহাল করেছে। আমিও সুতরাং বাবুই হতে চাই। যদিও মাস্টারবাবুরা সে কালে নিতান্ত গরিব ছিলেন। মাস্টারবাবুর মাসমাইনে ছিল নিতান্ত স্বল্প। টেনেটুনেও সংসার চালানো যেত না। বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের সেকেন্ড পণ্ডিত। আমার ছেলেবেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গরিব মাস্টারকে পণ্ডিত বলে খাতির করার রেওয়াজ ছিল।

খাতির তো ছিল বটে। কিন্তু বিষয়সুখ যা যতটুকু জুটত তা আসত বিঘা ষোলো জমি থেকে। জমি চলত ভাগ-জোতে। জমি আমাদের, কিন্তু চাষ করত কোনও গরিব চাষি। তাকে মুর্শিদাবাদি লব্‌জে বলা হতো ভাগারু।

তিন-চার জায়গায় ওই জমি ছড়ানো ছিল। ডিহিতে, বিলে, নদীর কোখে (কোলে), খালের গর্ভে। খাল বলতে বড়ো নদী ভৈরবের জল ধরবার খাল।

খালের জমি অনুর্বর জমি। এই অনুর্বরতার কারণ ছিল ভৈরবের জলে পলির চেয়ে বালির ভাগ ছিল বেশি। এই বালি জমিকে বছর-বছর অনুর্বর করে তুলেছে— বালির ক্ষার নষ্ট করতে হলে গোবর-সার ঢালতে হয় জমিতে। সে কাজে ভাগারুর তত উৎসাহ ছিল না। এই জমিতে ভাদুই ধান হতো, আমনও হতো না। এতে হতো গম, যব, ছোলা, সর্ষে, খেসারি ইত্যাদি। এখানেও ছিল বিঘা চার জমি।

ডাকাতে জমি ছিল বিলে। সেটি ৩ বিঘার আমন চাষের কালো মাটির; ঈষৎ এঁটেলি মাটির সঙ্গে দো-আঁশ মেশানো বিশেষ উর্বর জমি। ডিহির ৫ বিঘা সাধারণ জমি—বিঘা প্রতি দুই মন ধান ফলাতেই তার বিস্তর কষ্ট হতো।

সব মিলিয়ে গল্প যা দাঁড়াচ্ছে, তা হলো, গোমোহনী নদী জমিকে উর্বর করে প্রায় এক অলৌকিক উপায়ে, তার বিলেন জমি আশ্চর্য উর্বর। তার কোলের জমিতেও ফলন ভালো। ভৈরবের জলকে সে কী-এক কেতায় পলল-উর্বরতায় শুদ্ধ, ফসল-সমৃদ্ধ করে তোলে। এই নদীর জলে পাট-পচাই ও ধোয়ার কাজে এমনই গুণ মিশে রয়েছে যে, সেই হয়ে ওঠে মুর্শিদাবাদি রেশমের মতো রূপবান ও ঝলমলে।

কিন্তু আমাদের এই গল্পটিতে বেতাই সমাচারটাই আসল। নদীই ঠিক করেছে ধানবীজের চরিত্র। নদীর স্রোতের বাড়বৃদ্ধি ও স্রোতবেগের কমতি—সবই একটা নিয়ম রক্ষা করে চলে।

কোনও কোনও বছর নদীতে বন্যা বেলাগাম হয়ে ওঠে। তখন আমাদের জনবসত দুই নদী—বড়ো ও ছোটো—এই দুই নদীর রোখা ধাক্কায় দুই-চার—দুই-দশদিন—কখনও মাসখানেক বানভাসি হয়ে যায়। জল নামতে মাস দেড়েক সময় নিয়েছে এমন ঘটনাও আছে।

সে বছর বেতাই অবধি জলের তলায় তলিয়ে মরেছে, পচে গেছে, বালিতে ও পলিতে খেয়ে নিয়েছে ধানের শিষ। চরম বানভাসি হলে গোমানী তার চরিত্র হারিয়ে ফেলে— তার জল থিতু হতে পারে না বলে জল পরিশোধিত হওয়ার সুযোগ ঘটে না। ভৈরবের ঘোলাটে বালি ঢুকে পড়ে বানের তোড়ে। এই খর বিষাক্ত বালিই সর্বনেশে।

এই অবস্থায় বলা তো দস্তুর যে, বেতাই ধানের নাম বেতাই কেন হলো। এটি একটি সার্থকনামা ধান। বেত শব্দটি থেকেই বেতাই; এই ধানগাছটির রয়েছে বেতসের মতো বেড়ে ওঠার কেতা। জল বাড়ে, বেতাই-ও বাড়ে। এত লম্বা ধানগাছ সংসারে নেই—এর শরীরের রয়েছে গাঁট—একাধিক গাঁট—সেই গাঁটগুলি থেকে ঝুরো-ঝুরো, খোঁচা খোঁচা ঝুরি গজিয়ে ওঠে।

গাঁটের ঝুরি, যা অনেকটা খোঁচা খোঁচা দাড়ির মতো, তা প্রথমে থাকত সবুজ, তারপর হতো হালকা হলুদ, তারপর ফ্যাকাশে সাদা; তখন আমাদের মনে হতো ওগুলো বেতাইয়ের দাড়িই। ঝুরি সাদা হয়ে এলে শিসে পেকে উঠতো।

জলের মধ্যে এতখানি যুঝতে আর কাকে দেখেছি? একটি ধানবীজের এত জোর! অবশ্য গল্পটা জমত নদীর স্বভাবের ফেরে। জল বাড়তে বাড়তে দম ধরত নদী। আর কী আশ্চর্য! দম ধরে থাকত আড়াই দিন।

—‘কী বুঝছিস মদন! নামবে না, চড়বে!’

শুধোই। অর্থাৎ জানতে চাই।

মদন বললো, ‘কাঠি পুঁতেছি। এখন দেখা যাক।’

—‘কই? কোথায় পুঁতেছিস? দেখলাম না তো!’

‘দেখবি কী? বাইশ বিঘার পুরো; তোদের ৪ বিঘা—সব গেছে তলিয়ে; একটা থোড়ের মাথাও পানির ওপর জেগে নেই।’

—‘কী হবে?’

—‘আজ বেশি রাতে চাঁদ উঠবে, যখন শিশাডিহির সিঁথানের কাছে চাঁদখানা ঘড়ি দিবে, তখন ডাঁড়ার এখানে আসব। যদি তুই আসিস তো দেখা হবে। কাঠিখানা যদি পানির উপর মাথা তোলে তো নবি মণ্ডলের বাহিরের পলোঙ্গায় (প্রাঙ্গণে) চলে যাব ফজরের সময়! খবর করে আসব।’

—‘যাবি কিসে?’

—‘তাল-ডোঙায় চোঁ চোঁ করে চলে যাব।’

চাঁদ ঘড়ি দিল মাঝরাত পেরিয়ে। শিশাডিহির শিয়রে জেগে উঠল লাল রঙের প্রকাণ্ড এখখানা চাঁদ—কিসের যেন একটা বেঢপ মাথা দিগন্তে ভেসে রয়েছে।

—‘চাঁদের এই চেহারা হলো কী করে মদন?’

এইরকম বিকট-দর্শন চাঁদ যখন আকাশে দেখা দেয়, তখন গ্রামদেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। এ বার কি দুর্ভিক্ষই ঘটাতে চলেছে গোমানী? বেতাই কি আর তার থোড়-বিস্ফোরিত শীর্ষমুখ উঁকি দিতে মুখ তুলবে না? শিশাপাড়ার খালে পুরো বানভাসি হয়ে গেছে। বাড়ির উঠোনে থইথই করছে বন্যা


আরো পড়ুন: সাইকেলের রিমে সূর্যোদয় । আবুল বাশার


আমার আর মদনের এ বছর ক্লাস সিক্স, দুর্ভিক্ষ হলে হয়তো আমরা দু’জনই স্কুলছুট হয়ে যাব। মাস্টারের ছেলে হলেও বিদ্যা উপার্জন সম্ভব হবে না। চাষিরা অর্জন শব্দটি ব্যবহার করেন না, তার বদলে উপার্জন ব্যবহার করেন—আমরা সেটাই করলাম। যা হোক। চাঁদটা কাটা বেঢপ মুণ্ডুর মতো রক্তাক্ত; আমার ভীষণই ভয় করছে।

‘মদন! মনে হচ্ছে, চাঁদটার কিছু হয়েছে!’

—‘তুই ভয় পাচ্ছিস কেন জমা মুনশি; বলছি তো পানি দুইচার ইঞ্চি আজই নেমে যাবে। তবে পাড়ের কচি কাঁঠাল গাছটা মরবে।’

‘মরবে!’

‘হ্যাঁ। পানির ধাক্কায় গাছের গোড়ার মাটি সরে গিয়ে শিকড় বার হয়ে পড়েছে। শিকড়ে বান ঢুকলে নরম গাছ কাঁঠাল বাঁচে না। চ। পা চালিয়ে চ। গত কাল বিকেলে, তখন অসরের আজান পড়ল, তখন দেখলাম, নদী দম ধরেছে। পোকা পড়ার বিল আর পানি টানতে পারছে না।’

—‘অনেক সময় দম নেয়। তারপর বাড়ে।’

—‘বাড়বে না। চ।’

জল নামল ক’ইঞ্চি। ভাবা যায় না! চাঁদ ক্রমশ সাদা হতে লাগলো। ক্রমশ গোলাকার হল।

জলকাঠি আধ-বিঘত মাথা তুলল জলের উপর।

জলকাঠির উপর এসে বসলো একটি বক।

তারপর সেই গো-বকটা কোঁ-কোঁ করে ডাকতে থাকল জলের ফরিস্তা খাজা খিজিরকে। শরীরটা কেমন শিউড়ে উঠল দুই বন্ধুরই।

চাঁদটা পুরোটা এখনও চাঁদ হয়ে ওঠেনি; এই অবস্থায় ওই গো-বক অমন হাহাকার করে ডাকছে কেন! তা হলে দুর্ভিক্ষই কি আসছে!

—‘বকটা অমন করে ডাকে কেন ভাই?’

এই প্রশ্নের জবাবে মদন পাকা গলায় বলল, ‘ডাকবে না। ফিরতি জলে মাছ ধরবে বলে আহ্লাদে ডাকছে, বুঝলি তো?’

—‘ও!’

—‘আর তা ছাড়া, ও ভেবেছে ভোর হয়ে গেছে, জ্যোৎস্নার আলো আর সূর্যের আলো আলাদা করতে পারে না; এখন তো দুপুর রাত গড়াল, ঘণ্টা দুই হলো।’

আমরা দুজনই সিক্সে পড়ি; কিন্তু দুজনের বয়স সমান-সমান নয়। ও চৌদ্দ বা পনেরো। আমি বারো-তেরো। সে কালে বয়েস বাড়িয়ে ফেলে স্কুলে ভর্তি হওয়ার কতক রেওয়াজ ছিল। বয়েস লুকনো হতো। আমার বেলায় বছর খানেক এবং ওর বেলায় বছর দুই/তিন লুকনো হয়েছে বয়েস। সুতরাং মদনের আসল বয়েস ষোলও হতে পারে—ষোল হওয়াটা বিচিত্র নয়।

আর যদি ষোলই হয়, তাহলে মদন আমার মুরুব্বি হবে, এতে আর কীসের সংশয়? তা ছাড়া ও জীবনের চাপেই আমার চেয়ে যে-কোনও ব্যাপারে অভিজ্ঞ।

সত্তর বছর বয়েসে পৌঁছে এই গল্পটি, গল্পই বটে, লিখে চলেছি। আজ বেতাই ধান এই বাংলা থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। গোমানী নদীটি মজে গেছে। ভৈরবও অর্ধমৃত। ‘ছোটনদী’ নামের নদীটি কবেই ফুরিয়ে গেছে। ওটা আমার জন্মগ্রামের নদী। আমার নাম জমা হলেও আসলে সবই যেন খরচের খাতায় চলে গেছে। এই জমা শব্দটি স্মৃতিবাচক। বাস্তবে নেই, স্মৃতিতে আছে। জমা সেই থাকাকে ইংগিত করছে।

মদন যত দিন যাচ্ছে, বেশি বেশি করে মুরুব্বি হয়ে উঠছে। অনেক সময় আঁটি ভেঙে শাঁস নিতে হয় এমনই গাঢ় ভাবের কথা বলে ফেলতে পারে।

আজ বলল, ‘দেখ জমা, বেতাই না থাকলে অনেক চাষা খাবি খেত, বুঝলি!’

বললাম, ‘সেকি আর না বুঝি! তবে হ্যাঁ, পানির ধান তো! লড়াই করে বাঁচে বলে এ ধানের চাল হয় বেজায় মোটা। হজম করতে নাড়ির জোর লাগে ভাই!’

—‘দেখ জমা মুনশি! আমরা ভড় এলাকার লোক। মোটা কাপড়, মোটা ভাত, জোগাড় করতে পারলেই বর্তে যাই! যদি নদী বাঁচে, বেতাই বাঁচবে—আমরাও বাঁচব। আমাদের হলো কাটমাছার প্রাণ; দাদো (ঠাকুরদা) বলে, মরলে বেতাইয়ের মতো লড়ে মরব—এ জীবন শস্তা লয় হে!’

—‘কিন্তু নদী মরবে কেন মদন!’

—‘দাদোই বলেছে, নদী মরলে বেতাই বাঁচবে না।’

একটু থেমে মদনই বলে ওঠে,—‘নদীও নাকি মরে যায়! তবে আল্লায় মারে, নাকি মানুষে মারে, দাদো, সেটাই নির্ণয় করতে পারেনি। তবে গুনে-গেঁথে বলেছে, ষড়যন্ত্র চলছে; দুচারটি নদী মরে যাবে।’

—‘সেকি!’

—‘তখন বেতাই বেকার হয়ে পড়বে জমা মুনশি! কেউ তেনারে পুছবেও না।’

—‘একটা ভালো কথা বলো না। এ সব থাক।’

—‘সেটাই তো ভাবছি।’

—‘কী ভাবছিস?’

—‘বেতাই বেকার হওয়ার আগেই আমাকে নবি মণ্ডলের টাটে বসতে হবে। আমি পেট-ভাতার বাগাল হতে পারব না মুনশি!’

চাঁদের ক্রমশ রুপোলি হয়ে ওঠা আলোয় দেখি মদনের চোখ দুটি অশ্রু ছোঁয়ায় চিকচিক করছে—দেখে ভারি মায়া হলো!

জীবনে সেই প্রথম জনা মুনশি এক কিশোরের গলায় অবাক-করা বিদ্রোহের বয়েত শুনল। সত্যিই তো পেট-ভাতায় বাগাল খাটতে এই জন্ম; খোদা কি তেনার বান্দাকে নিয়ে অন্য কোনও প্ল্যান করে উঠতে পারেননি!

—‘তোর কী ইচ্ছে মদন?’

—‘টাটে বসব আর ডিম এগজামিন করব, মানে নলের ওদিককার গোল ফুটোয় ডিম রেখে এদিককার ফুটোয় একটা চোখ রেখে দেখব ডিম ঘোলা নাকি ঘোলায়নি; বুঝলি! ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখতে হবে।’

—‘একটা খাসা গল্প বলছিস ভাই মদন!’

—‘একজন ডাক্তার, একজন হেকিম যেমন পরীক্ষা-টরীক্ষা করে, সেই রকম। একজন বিজ্ঞানীও বলতে পারিস! নলটা হলো মোটা কাগজের পুরু জিনিস।’

—‘খাসা!’

—‘দেখ মুনশি, আমি একজন সাবধানী লোক।’

—‘লোক? তুই কবে থেকে লোক হলি মদন?’

—‘কবে থেকে আবার! দেখতে-দেখতে হয়ে গেলাম!’

—‘দেখতে-দেখতে!’

—‘আবার কী?’

—‘কী দেখতে দেখতে তুই লোক হয়ে উঠলি?’

—‘আরে! একটা বেতাই ধানই তো যথেষ্ট ব্যাপার জমা! বল্‌ তাই কিনা! ভেবে বল…।’

আমি দ্বিধা ভরে মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, ‘তা ঠিক!’

—‘চ, তা হলে!’ বলে উঠল মদন সেখ।

তাল-ডোঙায় করে আমাদের নিশীথ অভিযান শুরু হলো দিগন্ত বিস্তৃত জলের উপর; মনে হচ্ছিল এ যেন জ্যোৎস্না-ধূসর এক মরুভূমির উপর দিয়ে চলেছি। জলের মধ্যে রয়েছে একটি মূক প্রবাহ এবং তা নিতান্ত শিথিল।

ডোঙায় চড়া সাইকেলে চড়ে কোমর সিধে রাখার চেয়েও কঠিন। তবে অভ্যাস থাকলে কথা নেই।

ডোঙার মধ্যে দুটি জিনিস রাখা ছিল—একটি লগি আর একটি জল সেচবার ডই, ডোঙায় জল উঠলে সেই জল সেচে ফেলার জন্য। ডোঙার মাথার খোলে ডইখানা পড়ে ছিল। লগিটা ডোঙার মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত শোয়ানো ছিল; তা লেজ ছাড়িয়ে যার বেশ ক’হাত—এতটাই লম্বা।

এই ডোঙা বিলেই চলে। নদীর গভীর ও স্রোতপূর্ণ জলে এ বস্তু চালানো যায় না। ভেতরের জমা জল ডই করে আমি সেচে দিতে থাকি। ডোঙা চলছে।

ভাবছিলাম, লগিতে যদি কোথাও থই না মেলে তো তখন কী হবে! চারা বাবলা গাছগুলো সব ডুবে গিয়ে খানিকটা মাথা জাগিয়ে রেখেছে। ওই কাঁটার মধ্যেই গেঁড়ে পাকিয়ে বসে ফনা-তোলা সাপ। ডোঙা যেন ওই বাবলা-গাছে ধাক্কা না দেয়।

জলের সঙ্গে লড়াই চাট্টি ব্যাপার তো নয়।

বাতাসে অল্প হিম জড়ানো।

—‘দেখ্ মুনশি, পানিতে টান ধরেছে। বুঝলি বেটা?’

—‘কী রকম?’

—‘দ্যাখ না। পানি টানছে কোনদিকে? ডাঁড়ার দিকে। মানে পানির ফিরতি খেলা শুরু। তার মানে ভৈরব গোমানির পানিকে ডাক দিয়ে ফিরিয়ে নিচ্ছে। দু’দিন বাদে জলকপাটের ওখানে পানির গোত্তায় কোঁ-কোঁ ডাক শুনবি।’

—‘তোর আন্দাজ ভালো মদন সেখ।’

—‘আন্দাজই তো আসল জমা মুনশি। দম দরেছিল। এ বার নামছে, এটাই তো আন্দাজ; নামছে মানে ফিরছে। পানি ফিরে যাচ্ছে। এত বড় একটা খবর নবি মণ্ডলকে দিতে পারলে নবি মোড়লের কতটা আহ্লাদ হবে ভেবে দেখ মুনশির বাচ্চা!’

—‘তুই একেবারে ফরিস্তার মতো কথা বলছিস ভাই!’

—‘বটে!’

—‘ষোলআনা মনের কথা বললাম তোকে!’

—‘বটে!’

—‘তুই এত বটে-বটে করছিস কেন খোয়াজা?’

কোনও বাঙালি সেখকে ‘খোয়াজা’ বলাটা বিশেষ প্রশংসা! জলের ফরিস্তার নাম খোয়াজা খিজির—মুর্শিদাবাদে জলের এই ফরিস্তাকে নিয়ে উৎসব হয়।

মদন চুপ করে জলে লাথ মারতে থাকে।

তারপর বলল, ‘ছোটমামু বটে-বটে করে, তাই শিখেছি, শোনায় ভালো।’

আমি অবাক হয়ে গেলাম। সংসারে শব্দেরও জাত আছে বোঝা গেল। কোন শব্দটি ভাল শোনায় দেখতে হবে তো! তবে ওই শব্দটি মনের মধ্যে গেঁথে দিলেন এক আশ্চর্য রাত্রিতে নবি মণ্ডল।

প্রাক-প্রত্যুষের নেমাজ শেষ হলো।

তার আগেই আমরা পৌঁছে গেছি—দৌলতপুরের উঁচু ডিহির উপর অবস্থিত মসজিদের নীচে বিলের কিনারে একটি পাকুড়গাছের হিল্লেয় রেখেছি ডোঙা।

আমরা ডোঙা বেঁধে মসজিদের চাতালে উঠে এলাম।

নবিকে দেখবা মাত্র তাঁর দিকে এগিয়ে গেল মদন। আমি তার পিছুপিছু গেলাম।     

—‘সালাম মণ্ডলজি!’

—‘সালাম। কিন্তু তোমরা কোথা থেকে আসছ? কী চাও?’

—‘জি। আমরা ট্যাঁকা কাহারপাড়ার লোক। ডাঁড়ার কদমতলা থেকে আসছি।’

—‘তোমরা লোক? বল কি বাবুলোক! তা বেশ তো! কী খবর বল।’

—‘খবরই তো এনেছি আপনার কাছে।’

—‘বটে!’

—‘জি।’

—‘পেশ করা হোক।’

একটু থেমে গলায় খাকারি দিয়ে স্বর পরিষ্কার করে নিয়ে মদন বলল, ‘পানি মাঝরাতে প্রায় দুই ইঞ্চি নেমে গেল, এতক্ষণে আধ-বিঘত নেমে গিয়েছে। শিষ জেগেছে নবিজি!’

—‘বটে!’

—‘জি।’

সূর্য এখনও ওঠেনি, কিন্তু পুবের আকাশে কেমন একটা আভা দেখা দিয়েছে।

—‘তোমার নাম কী বাবা?’

—‘মদন।’

—‘আর তোমার?’

—‘জমা মুনশি।’

—‘চমৎকার।’

—‘জি?’

—‘খুব জরুরি খবর। বড়ই সুখবর এনেছ বাবারা।’

আমি বললাম, ‘খবরটা একা মদনের, নদীর মন আর পানির মর্জি ও একাই বোঝে নবিজি!’

—‘বটে!’

আমি চমকে উঠলাম! নবি মণ্ডল কী সুন্দর করে ‘বটে’ বলছেন!

—‘আচ্ছা, কী চাও বল! আমি তোমাকে দিব। আল্লার উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা দিচ্ছি বেটা।’

ছ’ফুট লম্বা সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় নবি মণ্ডল বলে উঠলেন।

আমি বললাম, ‘মদনের ইচ্ছা, টাটে বসে, বাবু হয়।’

—‘টাটে বসে! বাবু হয়!’

বিশেষ অবাক হয়েছেন নবি মণ্ডল।

মদন কথাটা খোলসা করতে বলে উঠল, ‘আমি আর পেট-ভাতায় কাজ ধরব না নবিজি!’

—‘আমি নবিজি নই বাবা, আমি নবি মণ্ডল, আমি রসুলের উম্মত। খোদার একজন তুচ্ছ বান্দা। রসুল দাসকে মুক্তি দিতেন। আমি তোমাকে পেট-ভাতা থেকে মুক্তি দিব। বল কী করতে হবে। কোন টাটে বসতে চাও মদন।’

মদন সিধা গলায় বলে উঠল, ‘আপনার ব্যবসার টাটে হুজুর। ডিমের যাচাই আমি করব। হিসাব রাখব। আমি ক্লাস সিক্স!’

—‘বটে!’

অত্যন্ত খুশির গলায় বলে উঠলেন নবি মণ্ডল। মদনকে তাঁর নিতান্ত পছন্দ হয়ে গিয়েছে।

সবার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে কেমন একটা হৃষ্ট ভঙ্গি করে নবি মণ্ডল বললেন, ‘শুনুন সকলে। আমি এই দশ মজলিসে কথা দিলাম, মদন আমার টাটে বসবে, যে-বচ্ছর স্কুলছুট হবে, সেই বছর। বেতাই যে-বচ্ছর বন্যার নদীর কোলে শিষ খাড়া করে মুখ তুলতে পারবে না, দুর্ভিক্ষ হবে, বাপে পেট-ভাতার কাজ ধরাতে কোনও জোতদারের কাছে মদনকে নিয়ে যাবে। স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেবে। সে বচ্ছর মদনকে ডিম পরীক্ষার নল আর হিসেব রাখার লাল খাতা হাতে দিব; গদিতে বসবে মদন সেখ। কথা দেওয়া গেল জমা মুনশি। দিলাম কথা।’

কিন্তু গল্পটা অন্যভাবে সাজল। অন্য দিশায় গড়াল।

নদী গোমানীর সঙ্গে বেতাইয়ের বোঝাপড়ায় ছন্দ বজায় রইল। জল কমা-বাড়া-দম-ধরা নিয়ম মেনে হলো। বেতাই গ্রামদেশে দুর্ভিক্ষ হতে দিল না।

কিন্তু খেলাফতের সংসারে খাওয়ার মুখ আর-একটি বেড়ে গেল। মদনের ছিল তিন বোন, সংখ্যা বেড়ে হলো চার। খেলাফতের পুত্র বলতে ওই একটিই—মদন। সন্তান সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচ। খেলাফত এ বারে ভয় পেয়ে গেল।

মদন স্কুলছুট হলো।

কিন্তু সে কথা সে নবি মণ্ডলের কানে পৌঁছে দিতে পারল না। মদনের এক দূর সম্পর্কের খালা এলো ওর পিঠের দ্বিতীয় বোনটিকে পোষানি নিয়ে যেতে। সঙ্গে দুটি মাদি ছাগলও পোষানি নিয়ে যাবে। এই বোনটির লেখাপড়া বন্ধ করে দেবে ময়না খালা (মাসি)। ছাগল-গরু চরিয়ে নেবে। তার এই বোনটি, রুহি খাতুন, হয়ে যাবে ছাগল-চরানি আর-এক পেটভাতার দাসী।

মনটা কেমন যেন করছে মদনের। বড্ড কষ্ট হচ্ছিল রুহির কথা ভেবে। বোনের বিদায় মুহূর্তে সে আর বাড়িতে তিষ্ঠোতে পারেনি। আমাকে ডেকে নিয়ে চলে এল কোদালকাটি ডাঁড়ার কদমতলায়।

বেতাইয়ের পানির ওপর মুখ তোলার সুখবর আরও দু’বছর নবি মণ্ডলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে মদন ডোঙা করে। নবি খুশি হয়েছেন; কিন্তু মদনের টাটে বসার কথাটি সম্ভবত ভুলেই গেছেন; দাসের মুক্তির কথা নবি ভুলেই গেছেন! এই ভেবে অধোমুখে ফিরে এসেছে মদন।

এই দু’বছরে মদন আরও মুরুব্বি হয়ে উঠেছিল।

আজ সে কদমতলায় বসে বলল, ‘নদী একটা জীবন্ত ব্যাপার; বেতাইও তাই। বুঝলি জমা! তাই এদের, সঙ্গে আমার কথা হয়।’

—‘কথা হয়!’

—‘তোর হয় না?’

কী বলব! চুপ করে থাকি।

কিছুক্ষণ বাদে মদন নিজে থেকেই বলল, ‘আচ্ছা জমা! নদীর কাছে, বীজের কাছে কখনও দুর্ভিক্ষ চাওয়া যায়! তুই বল, পারবি তুই? আমিও পারিনি। বলেছি, বেতাই তুমি মুখ তোলো! নদী তুমি পানি ফিরিয়ে নাও। ব্যাস। কিন্তু এ কথা তো কারুকে বোঝানো যাবে না। তবে হ্যাঁ, যদি বাবু হতে পারতাম, বোন কয়টাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতাম। সে আর হলো কই? আমি হবো বাগাল। রুহি হবে চরানি। ব্যস।’

ঠিক এই সময় রাস্তায় দূর থেকে ভেসে এলো বুলেট বাইকের গর্জন। এই রাস্তায় এই একটি মোটর-বাইকই যায়-আসে। নবি মণ্ডলের বাইক। একজন চালায়। উনি বসে থাকেন ব্যাকে।

বাইক এসে থামল কদমতলার কাছে।

—‘কী করছো, তোমরা?’

গলায় তুলে জানতে চাইলেন নবি মণ্ডল।

আমি এগিয়ে গেলাম।

—‘কী করছো? পানি নেমে গেছে। ধান উঠে গেছে সরাইতে। তা কোন ক্লাস হলো?’

—‘হলো তো এইট। কিন্তু মদনের স্কুলছুট হয়ে গেছে, ও আর পারল না। ওর একটা বোন হয়েছে। খাবার মুখ বেড়ে গেল বলে পড়া বন্ধ হয়ে গেল নবিজি!’

—‘সেকি!’

বলে বাইকের থেকে মাটিতে নেমে দাঁড়ালেন নবি।

তারপর বললেন, ‘বন্ধুকে ডাকো।’

মদন এগিয়ে এলে নবি বললেন, ‘সামনে বেস্পতিবার সদরঘাটের আড়তে দেখা কোরো। কথা আছে।’

তারপর নবি মণ্ডলের ডিমের আড়তে ডিমের কুসুম পরীক্ষা ও ডিমের হিসেব রাখার চাকরি পেল মদন সেখ কাহার। একটি চৌকির উপর ডেস্কে খাতা রেখে, কলম রেখে বসত মদন। ডেস্কের ড্রয়ারে থাকত ডিম পরীক্ষার মোটা কাগজের নল। এমনকি ডিম বয়ে আনা ডিম বেচ্চদের হিসাব মাফিক টাকা মিটিয়ে দেওয়ার কাজও সে প্রথম দিনই পেয়ে গেল—নবি তাঁকে বিশ্বাস করে সবই দায়িত্ব দিলেন।

মদন বলল, ‘সরিষাবাদ থেকে নৌকা করে রুহি আর দুইটা ছাগী ফিরত আনতে হবে নবিজি! ময়না খালা পোষানি নিয়ে গেছে। ছাড়িয়ে আনতে হবে। রুহিকে ফের স্কুলে দিব হুজুর।’

নবি মণ্ডল বললেন, ‘যাও, ফিরত আনো। বন্ধুকে বোলো, নদী কথা রেখেছে। বেতসি ধান পানির উপর শিষের মুখ তুলেছে বছর-বছর। আমিও কথা রেখেছি। নদীর দেশে, বীজের দেশে থাকি, কথা রাখব না, সে কি হয়!’

মদন আমাকে নিয়ে গেল বোন ও ছাগীদের ফেরত আনতে।

তারপর চারবোন কলেজে পড়ল। মাস্টারি চাকরি পেল।

নদী মরে গেল।

সদর ঘাটের ডিমের আড়তে এখন চোখে চশমা দিয়ে নল নিয়ে ডিম ঠিক আছে কি নেই পরীক্ষা করে মদন কাহার। পেটভাতা থেকে মুক্তি পাওয়া একজন গদিয়ান ক্লার্ক।

ইনিই আমাদের মদনবাবু।

জমা মুনশির বন্ধু মদন সেখ কাহার।

সাকিন ট্যাঁকা কাহার পাড়া, মুর্শিদাবাদ।

 

 

 

 

 

সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৮ পূজাসংখ্যায় প্রকাশিত

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>