Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,মাছ

অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-১১) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

Reading Time: 7 minutes

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায়  চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ‘কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার’ আরু ‘অর্থ’ এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি। ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’। শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িতরয়েছেন।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকা গিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি। 


অনুবাদকের কথা

আলোচ‍্য উপন্যাস ‘রক্তের অন্ধকার'(তেজরএন্ধার) একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস। এটি লেখার সময় কাল ২০০০-২০০১ ছিল অসময়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্যোগের সময়। সেই অশান্ত সময়ে, আমাদের সমাজে, আমাদের জীবনে এক দ্রুত অবক্ষয়ের স্পষ্ট ছাপ পড়তে শুরু করেছিল। প্রতিটি অসমিয়াইমর্মেমর্মে   একথা উপলব্ধি করে ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। রাজ্যের চারপাশে দেখা দেওয়ানৈরাজ্যবাদী হিংসা কোনো ধরনের মহৎ রূপান্তরের সম্ভাবনাকে বহন করে তো আনেই নি, বরঞ্চ জাতীয় জীবনের অবক্ষয়কে আরও দ্রুত প্রকট করে তুলেছিল। আশাহীনতা এবং অনিশ্চিয়তায় সমগ্র রাজ্য ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই যেন থমকে যেতে চায় কবির  কবিতা , শিল্পীর তুলি, লেখকদের কলম। তবে একথাও সত্যি যে শিল্পী-সাহিত্যিকরা সচেতন ছিলেন যে সমাজ জীবনের ভগ্নদশা’ খণ্ডহর’এর মধ্যে একমাত্র ‘সৃষ্টি’ই হল জীবন এবং উত্তরণের পথ। এই বিশ্বাস হারানোর অর্থ হল মৃত্যু । আর এই বিশ্বাস থেকেই সেই সময় লেখক লিখেছিলেন কালান্তর ত্রয়ী উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব – রক্তের অন্ধকার ।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম। আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবেন ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা


 

কিন্তু তখন থেকে হেম এই বিলটিতে মাছ ধরতে আসে। প্রতিদিন নয়, মাঝেমধ্যে।

সেদিনও সে বড়শি নিয়ে মাছ ধরছিল।

সেদিন সকাল বেলা সে বড়শি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল এবং বিলের পারে তার নির্দিষ্ট মাছ ধরার জায়গাটিতেগিয়ে টোপ লাগিয়ে বড়শি গুলি পেতে দিয়েছিল। ক্রমে সূর্যের তাপ বেড়ে চলেছিল। মাছে খোঁটার সময় পার হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য দিন এই সময়ে বড়শি এবং অন্যান্য মাছ ধরার সরঞ্জাম সামলে নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু সেদিন কিছু একটা অলসতায় মাছ খুঁটছে না জেনেও সে বড়শি গুলি পেতে রেখেছিল।ববছা গাছের একটা ডাল দাঁত দিয়েকামড়েকামড়ে সে অলসভাবে ফাতনা গুলির দিকে তাকিয়ে ছিল।

সে বিশেষ কিছু ভাবছিল না। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু চিন্তাভাবনা তার মনের মধ্যে ভেসে উঠছিল। ভেসে উঠছিল আর বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। জলের বুদবুদেরমতো।

তার পেছনে এসে ছেলেগুলি কখন দাঁড়িয়েছিল সে কিছুই বুঝতে পারেনি।

‘ মাছ খুঁটেছেকি?–কেউ একজন বলে উঠেছিল।

হেম এতটাই তন্ময় হয়েছিল যে কথাটা শোনার পরেও প্রথমে তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তার এরকম মনে হচ্ছিল যে সে কথাটা শোনেনি, ভেবেছে। নিজের মনের ভাব সেটা। কিন্তু এক মুহূর্ত পরে তার সম্বিত ফিরে এলঃ কে ডাকল তাকে? এত নির্জন এই জঙ্গলে কে তাকে ডাকল? চমকে উঠারমতো সে পেছনে ঘুরে তাকাল।

হাতে বন্দুক নিয়ে মিলিটারির মতো পোশাক পরা ছয়টি ছেলে তার পেছনে দাঁড়িয়েরয়েছে।

তার হঠাৎ বিরাট ভয় করল।

কে? কে তারা? সে ঠিকই বুঝতে পেরেছিল।কে তারা। বন্দুক বারুদ  নিয়েকয়েকটি ছেলে আজ কিছুদিন থেকে জঙ্গলের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে এ কথা সে এর ওর মুখ থেকে শুনতে পেয়েছিল। বন্দুক হাতে ছেলে– জঙ্গলে যাওয়া আসা করে। আসা– যাওয়া করে না এখানেই থাকে ? শোনা কথাটা সত্যি তাহলে!

‘ বড়শিসামলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেআয়।’ বন্দুক হাতে একটি ছেলে তাকে কর্কশ ভাবে বলেছিল।

হেমর  শরীরে কম্পণ উঠেছিল।সে দ্রুত বড়শি এবং মাছ ধরার অন্যান্য সরঞ্জাম সামলেনিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল।একটি ছেলে তাকে ইশারায় অনুসরণ করতে বলছিল। ছয়জনেরদলটির মধ্যে ঢুকে সে জঙ্গলের মধ্য দিয়েএগিয়ে যেতে লাগল।

তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।

তার মনে হচ্ছিল যেন হাতের বড়শি এবং মাছ ধরার সরঞ্জাম ফেলে দিয়েদৌড়ে পালাবে।

এই ছেলেগুলির কাছ থেকে দ্রুত দৌড়ে এসে পালিয়ে যাবে। কিন্তু সামনে বাঘ দেখে মূর্ছিত  হওয়া  মানুষের মতো তার হাত-পায়ে কোনো শক্তি ছিল না।দৌড়াতে হলে যে পা টা তুলতে হবে, সেই শক্তিটুকুও তার নাই  হয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ। বাঘ দেখে মূর্ছিতহওয়া মানুষের মতো অবস্থা হয়েছিল তার।

সম্মোহিত মানুষের মতো সে নীরবে ছেলেগুলিকে  অনুসরণ করে চলছিল।

ওদের জামা গুলি ঘামে ভেজা ছিল।বগলের নিচ থেকে বাহু  এবং পিঠের দিকটা ঘামে ভিজে চপচপকরছিল।অনেক দূর থেকে ওরা হেঁটে আসছে বলে হেমর মনে হয়েছিল। দলের সঙ্গে হেঁটে যেতে ছেলেগুলির গায়ের ঘামের গন্ধ এসে হেমর নাকে লাগছিল।


আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-১০) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


ওরা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।

জঙ্গলের মধ্যে এক টুকরো খালি জায়গায় ছেলেগুলি বসেছিল।হেমকেওরা সামনে বসিয়েরেখেছিল।বন্দুক হাতে একটি ছেলে তার পেছনে পাহারা দেওয়ারমতোদাঁড়িয়ে ছিল। ওরা হেমকে জেরা করছিল।তার নাম কী? কোন বাড়ির ছেলে? সে কী করে? পড়াশোনা করছে কিনা? প্রতিটি কথা ওরা তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জিজ্ঞাসা করছিল। গ্রামটির বিষয়েও ওরা তাকে জিজ্ঞেস করছিল। ওদের প্রশ্ন থেকেই সে বুঝতে পারছিল গ্রামটির বিষয়ে তারা সবকিছুই জানে।

‘ আমরা কে বুঝতে পেরেছিস?–একজন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল।

সে পায়নি বলে মাথা নাড়িয়েছিল।

আসলে সে ঠিকই চিনতে পেরেছিল যদিও মুখ ফুটে বলতে ভয় করেছিল।

‘ সত্যি কথা বল।’– ছেলেটি তাকে ধমকে উঠেছিল।

অসহায়েরমতো সে এর থেকে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল।

‘ আজকাল অনেক ছেলে জঙ্গলে থাকে…’– এই উত্তরটা শেষ করতে পারেনি।

‘ জঙ্গলে কেন থাকে?’– ছেলেটিরকণ্ঠস্বরে কৌতুক ফুটে উঠেছিল।

হেম এদিক ওদিক তাকিয়ে উত্তর দিয়েছিল–’ সশস্ত্র সংগ্রাম।’

‘ সশস্ত্র সংগ্রাম। সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য জঙ্গলে থাকে?’

‘ হ্যাঁ।’– সে ধীরে উত্তর দিয়েছিল।

‘ জঙ্গলে কেউ আসে না? নয় কি?’– ছেলেটি আবার কৌতুক করেছিল।

হেম  চুপ করে ছিল। সে কেবল বোকার মতো হেসেছিল।

‘ বেরিয়ে এলে কী হবে?’– ছেলেটি আবার জিজ্ঞেস করেছিল।

সে উত্তর দেয়নি।

‘ বলছিস না কেন? বেরিয়ে এলে কী হবে?’

সে ইতস্তত করছিল। কী বলবে কী করবে সে বুঝতে পারছিল না।

‘ বিপ্লব হবে। বুঝেছিস। বিপ্লব হবে।’– কথাটা বলে ছেলেটিদাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দলপতির মতোছেলেটি পুনরায় জিজ্ঞেস করেছিল।

‘ তুই এখানে সবসময় মাছ মারতে আসিস নাকি? ঐ ছেলে, উত্তর দিচ্ছিস না কেন?’

‘ প্রতিদিন আসি না। মাঝেমধ্যে আসি।’

‘ আজ থেকে প্রতিদিন আসবি।’– দলপতি তাকে সজোরে বলে উঠেছিল–’ শুনেছিস, আজ থেকে রোজ আসবি। আমরা যা করতে বলব, তাই করবি। বুঝেছিস তো? আর মুখ বন্ধ রাখবি। তোর কোনো সঙ্গী সাথীদের আমাদের এখানে দেখার কথা বলবি না।’

সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েছিল।

বললে কী অবস্থা হবে, সেটা তারা মুখ ফুটে না বললেও সে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল । দলপতি কথা বলার সময় হাতে নিয়ে থাকা কালো বন্দুকটা ধীরে ধীরে পিষছিল।

পরের দিন সকালে ওদের কিছু জিনিসপত্র কিনে আনার জন্য দুটো টাকা দিয়ে তাকে বাড়িতেপাঠিয়েদিয়েছিল।

‘জিনিসগুলি নিয়ে তুই কাল সকালে এসে যাবি।শুনেছিস? তুই এখানে আমাদের খোঁজ করতে হবে না। তোর জায়গায় বসে তুই মাছ ধরতে থাকবি। আমরা তোকে খুঁজে নেব।’

পরের দিন সে মাছ মারতে যাবে কিনা, সে কথা অনেকবার ভেবেছিল। যেতে ভয় করছিল, না গেলেও বিপদ বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু ক্রমে ভয়েরচেয়ে তার কৌতুহল বড়ো হয়ে উঠল। ওরা কিবা করে? তাকেই বা কী করতে বলবে? এক অদম্য কৌতূহলেরতাড়নায় সে পরের দিন সকালে বড়শি  এবং তার সরঞ্জাম নিয়ে মাছ ধরার ছলে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।

সেই শুরু। সেটাই ছিল শুরু। তারপর তাকে এটা ওটা কাজে লাগাতে লাগল। খরচের জন্য মাঝেমধ্যে তাকে অল্প কিছু টাকাও দিতে লাগল। সে প্রতিদিন বড়শি আর সরঞ্জাম নিয়েডোবাটার কাছে মাছ ধরে। ছেলেগুলির মধ্যে কোনো একজন এসে তার সঙ্গে দেখা করে। কখনও কখনও আসে না। যেদিন আসে না সেদিন রোদটা প্রখর হয়ে ওঠার সময়বড়শিনিয়েবাড়ি চলে আসে।

ছেলেগুলির সঙ্গ ধীরে ধীরে তার ভালো লাগছিল। ওদের দেখতে না পেলে তার মনটা খারাপ হয়ে যেত। ওরা তাকে খুব শীঘ্রই ট্রেনিংয়েনিয়ে যাবার কথা বলেছিল।

‘ খুব তাড়াতাড়ি তোকে নিয়ে যাব’– দলপতি তাকে বলেছিল।’ তুই রেডি হ। একবার ট্রেনিং নিয়ে এলে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবি। তোর আর কোনো চিন্তা থাকবে না।’

ট্রেনিং এর কথা থেকে তার মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল।

সেও ছেলেগুলির মতোইউনিফর্ম পরবে, হাতে বন্দুক নেবে।

ওরা তাকে গ্রামের মানুষগুলির কথা জিজ্ঞেস করল। কে কী রাজনীতি করে জিজ্ঞেস করল। সে যতটুকু মেলামেশা করে জেনেছিল, ততটুকু বলল। ওরা তাকে আরও খবরাখবর করতে বলল। বিশেষ করে যতীনদাদার সঙ্গে কে কে কাজ করে, কারা কারা আসে এইসব পুঙ্খানুপুঙ্খ করে জিজ্ঞেস করে খবর নিতে বলেছিল।

‘ তুই আমাদের সঙ্গের একজন হয়ে গেলি আর কী।’– দলপতি তাকে বলেছিল।

সেদিন তার বড়ো আনন্দ হয়েছিল। এক অজানা গর্বে তার বুকটা ফুলে উঠেছিল বলে মনে হচ্ছিল। তারপরেইওরা তাকে একটি বিশেষ কাজের দায়িত্ব দিয়েছিল। ওরা তাকে যতীন দাদার গতিবিধি সম্পর্কে নিয়মিত জানাতে বলেছিল। তাকে যতীনদাদার সঙ্গে থেকে তার বিশ্বাসী মানুষ হয়ে উঠতে বলেছিল।

সেদিন প্রথমবারের জন্য তার ভয়হয়েছিল।

বুকটা তার দুরুদুরু করে কেঁপে উঠেছিল। মুখের ভেতরটা শুকিয়েগিয়েছিল। প্রথমবারের জন্য সে ভেবেছিল– আমি এসব কীসের মধ্যে ঢুকে পড়লাম? কীসের মধ্যে ঢুকে পড়লাম?

ওদেরকথামতো সে যতীনদাদারবাড়িতে যাওয়া আসা শুরু করেছিল। যতীনদাদাকে সে তার জন্য কিছু একটা কাজ  জোগাড় করে দেবার জন্য অনুরোধ করেছিল। যতীন দাদা দেখবে বলে তাকে আশ্বস্ত করেছিল। তাকে আসা-যাওয়া বজায় রেখে খোঁজ-খবর করতে বলেছিল। ঠিক যেভাবে সে বলবে বলে তারা অনুমান করেছিল, যতীনদাদা তাকে সেভাবেই বলেছিল। সেদিন থেকে সে দুবেলাযতীন দাদার বাড়িতে যাওয়া আসা করতে শুরু করেছিল। একটা চাকরির আশায় সে যেন যতীন দাদার  বাড়িতে আসা-যাওয়া করে এটা ওটা কাজ করে দিত, সেরকম একটি ধারণা অতি সহজেই, অত্যন্ত কম দিনের ভেতরে সৃষ্টি করতে পেরেছিল।এই সমস্ত কাজগুলি সে ওদেরবুদ্ধিমতোই করেছিল।

যতীনদাদা সারাদিন কী করে, কোন সময়ে কী কাজে তিনি ব্যস্ত থাকেন, কার কার সঙ্গে মনের কথা বলেন, সিকিউরিটিমানুষটা কখন কী করে, তার বন্দুকটা সে কোথায় রাখে, কোন সময়েযতীনদার কাছে কে কে থাকে এই সমস্ত কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হেম ছেলেগুলির কথামতোসময়েসময়েজানিয়ে দিত।

মাঝে মাঝে ছেলেগুলি কয়েক দিনের জন্য উধাও হয়ে যায়।’ তুই এক সপ্তাহ পরে খবরা খবর দিবি। এক সপ্তাহ পরে তোর খোঁজ করব’, ওরামাঝেমধ্যে এরকম বলে। সপ্তাহখানেক পরে তখন হেম পুনরায় মাছ ধরতে যায়।

যতীন দাদার বাড়িতে আসা যাওয়া করে, বিশেষ করে ছেলেগুলির না আসার দিনগুলি সে ক্রমশ পছন্দ করতে শুরু করেছিল। যতীন দাদার মা অত্যন্ত স্নেহময়ী, বাড়ির বাকি মানুষগুলো ভালো। তার চেয়েও বড় কথা তাদের বাড়িতে  খাওয়া দাওয়ারআয়োজনটা বেশ ভালো। জলখাবার প্রতিদিনই এবং প্রায়ই দুপুরবেলা সে ভাত খেত। বাড়িতে এটা ওটা কাজ করে, যতীন দাদার সঙ্গে দেখা করতে আসা মানুষগুলিকে চা- পান সুপারি দিয়েআপ্যায়ন করে সে বেশ কাছের লোক হয়ে পড়েছিল। যতীনদাদাও  তাকে ‘ঐ কোথায় গেলি’ বলে সব সময় খোঁজ খবর করতে শুরু করেছিল।

ছেলেগুলি কয়েকদিন ধরে আসছে না। দুই তিনবার সে মাছ ধরতে যাবার পরেও ওরাবেরিয়েআসেনি। হেম মনে মনে খুব একটা অখুশি হয়নি। ছেলেগুলির সঙ্গে দেখা না হলে সে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করে।

ওরা আর আসবে না নাকি? এই জায়গা একেবারে ছেড়ে চলে গেল নাকি। মনে মনে ভাবছিল। সে যে খুব অখুশি ছিল তাও নয়। কেবল ট্রেনিংটার কথা মনে পড়ায় সে একবার না দুবার কথাটা ভেবেছিল। ট্রেনিংয়ে যাবার জন্য তার মনটা খুব উদগ্রীব হয়েছিল– কিন্তু ক্রমে যতীনদারবাড়িতে আসা-যাওয়া করতে শুরু করার পর থেকে তার ট্রেনিংয়ে যাবার ইচ্ছাটা ক্রমশ কমে আসছিল। সে ভাবছিল কোন পথটা ভালো হবে। কোন পথটি? কোন পথ!

সেই দিনটিও ছিল অন্যান্য দিনের মতো।

সকালবেলা অন্যান্য দিনের মতো নাকে মুখে ভাত দুটো গুঁজেনিয়ে সে যতীন দাদার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়েপড়েছিল।

মা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল–’ এই সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস। দিনের পর দিন কেন তুই যতীন দাদার বাড়িতে পড়ে থাকিস ? কী করিস সেখানে গিয়ে? বাড়ির কোনো কাজেই তোর মন নেই। সারাদিন ওখানে পড়ে থাকলেই হবে কি ?’

হেম কোনো উত্তর দেয়নি।মামাঝেমধ্যেই এভাবে তাকে বকাবকি করে ।

বাবা সকালে বেরিয়েগিয়ে সামনের দিকে বারান্দায়কাঁঠালপিড়িটাতে বসেছিল। সে বেরিয়ে যাবার সময় বাবা কিছু বলেনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পরে তিনি ভোগেকে বলেছিলেন–’  যেতে দাও। ওখানে গিয়ে এটা ওটা করে দিলে যদি কোনো কিছুর সুবিধা হয়।আজকাল তো যতীনদেরমতো মানুষের সাহায্য ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব হয় না।’

মা এবার কোনো উত্তর দেয়নি।

দিনটা অন্যদিনের মতোই পার হয়ে যাচ্ছিল।

বিকেলের দিকে যতীনদাদা ভাঁড়ারের  কাছে বকুল গাছটার কাছে গিয়েবসেছিল।হেম চেয়ার-টেয়ার বের করে দিয়েছিল। সামনে দুটো চেয়ার এবং মাঝখানে পানের বাটাটা রাখার জন্য আর টি পয়টা বাইরে এনে রেখেছিল।

সন্ধ্যা হয়হয়। লোকজন একে একেবিদায়নিয়েছিল। যতীন দাদা ভেতরে যাবার জন্য বসা থেকে উঠেছে মাত্র। সেই সময় দুটো সাইকেলে তিনটি ছেলে এসেছিল। কে এসেছে প্রথমে সে খেয়ালকরেনি। সে যতীন দাদার কাছে একটা মোড়াতে বসেছিল।পরিচিতছেলেটিকে সামনে দেখেও সে প্রথমে চিনতে পারেনি।কে? কে তাঁরা? যখন গুলির শব্দ হল তখনই সে সম্বিত ফিরে পেল।

সোয়েটার পরে আসা দলপতি তাকে হেসে বলেছিল–’ তোর একটা কাজ আজ শেষ হল।’

ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে সে বসে থাকা মোড়াটি থেকে হঠাৎ সামনের দিকে লাফ মেরে উঠেছিল । দৌড়ে পালিয়ে যাবার এক প্রচন্ড প্রবৃত্তি তার মনে জেগে উঠেছিল। লাফ মারতে যেতেই– লাফ দিতে হঠাৎ মাথায়প্রচন্ড এক আঘাত লেগে সে পড়েগিয়েছিল । সেই যে পড়ল– তারপরে তার আর কিছু মনে নেই।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>