ইরাবতী ধারাবাহিক:ফুটবল (পর্ব-৭) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
অষ্টম শ্রেণির দুই বন্ধু রাজ আর নির্ঝর। রাজ আর অনাথ নির্ঝরের সাথে এইগল্প এগিয়েছে ফুটবলকে কেন্দ্র করে। রাজের স্নেহময়ী মা ক্রীড়াবিদ ইরার অদম্য চেষ্টার পরও অনাদরে বড় হতে থাকা নির্ঝর বারবার ফুটবল থেকে ছিটকে যায় আবার ফিরে আসে কিন্তু নির্ঝরের সেই ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার পেছনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ঝরের জেঠু বঙ্কু। কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু ও তার ফুটবলার বন্ধু তীর্থঙ্করের বন্ধুবিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? সবশেষে নির্ঝর কি ফুটবলে ফিরতে পারবে? রাজ আর নির্ঝর কি একসাথে খেলতে পারবে স্কুল টিমে? এমন অনেক প্রশ্ন ও কিশোর জীবনে বড়দের উদাসীনতা ও মান অভিমানের এক অন্য রকম গল্প নিয়ে বীজমন্ত্রের জনপ্রিয়তার পরে দেবাশিস_গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন কিশোর উপন্যাস ফুটবল আজ থাকছে পর্ব-৭।
রাজের মাঠে যাবার খবর পেয়ে ছোটমামা আসরে নেমে পড়লেন। রাজ তাকে বোঝাল, স্যার তাকে মোটেই খেলতে নেবেন না। মাঠে এমনি যেতে বলছেন। দাদাদের সঙ্গে স্যারের রাগারাগি হয়েছে বলেই তাদের যেতে বলেছেন। অনীকদা,সন্তোষদারা খেলেও খুব ভালো। তারা চান্সই পাবে না।
ছোটমামা ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তিনি গলা কাঁপাতে কাঁপাতে বললেন,“তুই জানিস না।রাজ। এইটুকু চান্স কি বিরাট ব্যাপার! ভাবতে পারবি না তুই! এত এত ছেলে ছিল তোকে হঠাৎ স্যার বললেন কেন বল?”
“নির্ঝরকেও বলেছে।“
ছোটমামা বললেন,“ওর কথা বাদ দে। স্যার নিশ্চয় তোর খেলা দেখেছেন।“
রাজ বলল,“আমার খেলা?”
“আরে যে খেলে সে কি দেখে তার খেলা কে দেখছে?তোর খেলাও স্যার দেখেছেন।“
“কি জানি?”
“মনে করতে পারছিস না তো?”
“হ্যাঁ।“
“হয়ত তুই স্কুলের মাঠে খেলছিস সেসময় তোকে দেখেছেন স্যার।“
রাজ ভাবতে বসল। স্কুলের মাঠে একদম খেলে নি তা নয়।কিন্তু তা ঠিক খেলা নয়।তাছাড়া স্কুলের ভেতরে মাঠটা খুব একটা বড় নয়। সে বলল,“ঐ আর কি।“
“ওতেই হবে। স্যার বুঝে গেছেন। ঠিক চিনে নিয়েছে তোকে।“বলে ছোটমামা একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন,“আমাকেও এমন চিনে ছিল রে! কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি।“
রাজ বুঝল ছোটমামা এবার নিজের লাইনে ঢুকছেন। তাঁর অভিনয়ের কথা তিনি নির্ঘাত বলতে শুরু করবেন। এখনো তাঁর আশা পুরণ হয় নি। বাবাদের নাটক শুরুই হয় নি! ছোটমামাও আর এখন আর সে কথা তোলেন না। তবু তাঁর মনে দু;খটা আছে।মাঝে মাঝে তা ফুটে ওঠে।সে বলল,- “তুমি আবার কি চান্স মিস করেছিলে?”
ছোটমামা বললেন,“তুই জানিস না?”
“না।“
“সেবার অল্পের জন্য আমি সিনেমায় চান্স পাই নি।“
রাজ চোখ গোলগোল করল। ছোটমামার হাজার রকম বানানো কথা শুনতে ওর ভালোই লাগে। সে কখনও অবিশ্বাস করে না। তবে এ গল্পটা সে আগে শোনে নি।সে বলল,“তাই! জানি না তো?মা জানে?“
ছোটমামা মাথা নীচু করে বললেন,“না। জানে না। বলি নি। তোকে বিশ্বাস করে বলছি।“
“বলো।“
“তেমন কিছুই না। সেবার পুজোর দিন বন্ধুদের একটা সিনেমার অভিনয় দেখাচ্ছিলাম। ওই যে আমীর খানের নতুন সিনেমার একটা সিন। বন্ধুরা তো খুব হইহই করল। তখনই একজন লোক ভিড় থেকে এসে বলল, “অভিনয় করবে? কাল হোটেল গোধুলিতে এসো।“ আমি পাত্তা দিই নি। কে না কে ভেবে! সবাই কে তো চিনি না। তা গেলাম না। দুদিন বাদে জানলাম লোকটা একজন নামকরা ডিরেক্টর।“
“কি নাম?”
ছোটমামা মাথা চুলকে বললেন,“ওই যে? বল না। কি যেন নাম। মনে পড়ছে না।“
রাজের মনে হল ছোটমামা কে সে যা নাম বলবে তাতেই তিনি সায় দিয়ে দেবেন।সে তাই বলল,”সে বাদ দাও। তাহলে তো দারুন হত।“
“তা তো হত! আমার বদলেই তো তোদের স্বপ্নজিত চান্স পেল!”
কিছুদিন হল স্বপ্নজিত বলে এক নায়ক সিনেমায় নাম করেছে। খুব নাম হয়েছে তার।শুনে রাজ কোনরকমে হাসি চেপে রইল।
ছোটমামা উঠে দাঁড়িয়ে বলবেন,“এবার যাই রে। দেখি জামাইবাবু এল কিনা? নাটক কবে শুরু করবে দেখি।“
এখনো নাটক শুরু হয় নি ছোটমামাদের। আদৌ হবে কিনা সন্দেহ আছে রাজের।ছোটমামা চলে যাবার পর সে হাসি দমাতে পারল না । হো হো করে সে হাসল খানিকটা। হাসি থিতিয়ে যাবার পর তার হঠাৎ অন্য একটা কথা মনে হল। আচ্ছা! সে কেন ছোটমামার কথা শুনে অকারণে হাসছে?এমন ঘটনা কি কোথাও ঘটে না? কেউ কি এমনভাবে সিনেমায় চান্স পায় না? ছোটমামার না হয় ঘটে নি। পৃথিবীতে কারুর না কারুর তো ঘটে। হয়ত স্বপ্নজিতেরই এমন ঘটেছিল ! ছোটমামা পারেন নি। কিন্তু তার ইচ্ছে বা স্বপ্নটা আর মিথ্যে নয়।ভাবতে রাজের গা শিরশির করল।তারও ভাবতে ইচ্ছে করল ছোটমামার কথা যেন সত্যি হয়। স্যার যেন তাকে আর নির্ঝরকে দুজনকেই খেলায় নেয় এবং তারা এমন খেলবে স্যার বসাবেন না।
আরো পড়ুন: ফুটবল (পর্ব-৬) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
খাওয়ার সময় মাকে কিছু বলার আগে ছোটমামা-ই খবরটা দিলেন। তিনি বললেন,“ দিদি। ভাবিস না। কাল আমি বিকেলে ওদের স্কুলে যাব। সন্ধ্যে হলে অসুবিধা নেই।“
মা বললেন,“তুই খেলবি? তোর সব আছে?”
রাজ বলল,“ হু। প্যান্ট জার্সি আছে। কিন্তু জুতো নেই।“
বাবা কি যেনগম্ভীরস্বরে ভেবে বললেন,“এখনই কি! দু-একদিন যাও তারপর চান্স পেলে দেখা যাবে।“
বাবার গলায় উৎসাহ কম। রাজ নিরাশ হয়ে পড়ল। রাজ মুখ নিচু করে খেতে লাগল। ওর হঠাৎমনে পড়ল, নির্ঝরের জার্সি-প্যান্ট আছে কি? না থাকারই কথা। মা কে কি সে এখন কথাটা বলবে? বাবার সামনে তার বলতে ইচ্ছে করল না। সে উঠে পড়ল খাবার টেবিল থেকে।
বিছানায় যাবার আগে মা ঘরে এলেন। তার মাথায় হঠাৎ হাত বুলিয়ে বললেন,“বাবার কথায় দু;খ পেলি?”
অপ্রতিভস্বরে রাজ বলল,“কই নাতো?”
“পেয়েছিস। জানি।বোকা ছেলে।“
রাজ চুপ করে থাকল।
মা বললেন,“তোর খেলার যা যা লাগবে সব বাবা দেবে। চিন্তা করিস না। এখন শুতে যা। আর হ্যাঁ।নির্ঝরের জন্যও আনব।“
রাজ মায়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তাকে কিছু বলতে হয় নি।মা ঠিক বুঝে গেছেন।
রাজ বলল,“কিন্তু জান মা। নির্ঝর কাল খেলতে আসবে কিনা গ্যারান্টি নেই।“
“ওমা!কেন?”
“ওর জেঠু চায় না ও পড়ুক, খেলুক।“
“তাহলে কি চায়?”
“বলে ওকে নাকি মামার বাড়ি দিয়ে আসবে।“
“যা!”
রাজ মাথা নেড়ে বলে,“ওর তো খুব চিন্তা নাইনে উঠলে কি হবে?”
“চিন্তা কেন?”
“এইট অবধি মিড ডে মিল দেয়। নাইনে দেয় না।“
মা বিষন্ন হয়ে গেলেন। তাঁর মুখ-চোখ কষ্টে ভরে গেল। তিনি মাথা নেড়ে বললেন,“না ।না ওকে বলিস ভাল করে পড়তে। ওর কোনও অসুবিধে হবে না। আর নির্ঝরকে বলবি কাল যেন খুব ভাল করে খ্যালে।“
“আর আমি!”
“হ্যাঁ। তুইও। বলে মা গাল টিপে দিলেন।“
রাজের মন ভাল হয়ে গেল।
দেড় দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। ‘কাঠবেড়ালি’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘চার অঙ্গ’, ‘তিথির মেয়ে’, গল্পগ্রন্থ : ‘গল্প পঁচিশ’, ‘পুরনো ব্রিজ ও অন্যান্য গল্প’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বীজমন্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন।