অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-১৩) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ‘কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার’ আরু ‘অর্থ’ এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি। ইতিহাস বিষয়ক মূল্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’। শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িতরয়েছেন।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকা গিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।
অনুবাদকের কথা
আলোচ্য উপন্যাস ‘রক্তের অন্ধকার'(তেজরএন্ধার) একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস। এটি লেখার সময় কাল ২০০০-২০০১ ছিল অসময়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্যোগের সময়। সেই অশান্ত সময়ে, আমাদের সমাজে, আমাদের জীবনে এক দ্রুত অবক্ষয়ের স্পষ্ট ছাপ পড়তে শুরু করেছিল। প্রতিটি অসমিয়াইমর্মেমর্মে একথা উপলব্ধি করে ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। রাজ্যের চারপাশে দেখা দেওয়ানৈরাজ্যবাদী হিংসা কোনো ধরনের মহৎ রূপান্তরের সম্ভাবনাকে বহন করে তো আনেই নি, বরঞ্চ জাতীয় জীবনের অবক্ষয়কে আরও দ্রুত প্রকট করে তুলেছিল। আশাহীনতা এবং অনিশ্চিয়তায় সমগ্র রাজ্য ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই যেন থমকে যেতে চায় কবির কবিতা , শিল্পীর তুলি, লেখকদের কলম। তবে একথাও সত্যি যে শিল্পী-সাহিত্যিকরা সচেতন ছিলেন যে সমাজ জীবনের ভগ্নদশা’ খণ্ডহর’এর মধ্যে একমাত্র ‘সৃষ্টি’ই হল জীবন এবং উত্তরণের পথ। এই বিশ্বাস হারানোর অর্থ হল মৃত্যু । আর এই বিশ্বাস থেকেই সেই সময় লেখক লিখেছিলেন কালান্তর ত্রয়ী উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব – রক্তের অন্ধকার ।
এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম। আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবেন ।নমস্কার।
বাসুদেব দাস,কলকাতা
‘ হ্যাঁ বুড়োবুড়ি দুজনেই ভূত-পেত্নীর মতো ভিটেটা কে ধরে রেখেছে।’
‘ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি প্রত্যেকেই আজকাল গুয়াহাটিতে থাকে। বাড়ি ভাড়া নিয়েছে।’
‘ কিনে নিয়েছে বোধ হয়।’
‘ কিনে নিয়েছে,কিনে নিয়েছে। ওদের আবার টাকার অভাব কোথায়।’
‘হ্যাঁ, সরকার দিতে চাওয়া এক লাখ টাকাও নাকি মা-বাবা নেবে না বলে শুনেছি।’
‘ লাখ টাকা নেবে না বলেছে? লাখ টাকা?’
‘ লাখ টাকা!’
প্রেমের বুকটা এবার ঢেঁকিতে ধান বানার মতো ধপধপ করতে লাগল। পয়সা পয়সা! ওরা পয়সার কথা বলছে। পয়সার কথাই বলছে!সেনাড়াচড়া করে উঠল। এবার সে দোকানির চোখে পড়ল।
‘ কীহে প্রেম?’–দোকানি বলে উঠল–’তোরা টাকার কোনো খবরা খবর পেয়েছিস কি?’
বাকি লোকজনেরাওউৎসুক হয়ে তার দিকে তাকাল।
প্রেমের বড়ো অস্বস্তি হতে লাগল। এখন সে কি বলবে? দোকানি এবং বাকি মানুষ দুজনও তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রেম ওদের দিকে তাকিয়ে মাথা তুলে বলল–’ এসেছে।’
সে মিথ্যে কথা বলল। সে যে কাজের জন্য দোকানে এসেছে,মিথ্যা কথা না বললে সে কাজটা হবে না। দোকানি তাকে বাকি দেওয়ার সম্ভাবনা কম। তার অনুমান ঠিকই ছিল। কারণ দোকানি সঙ্গে সঙ্গে বলল–’ভালো। ভালো কথা। টাকাটা তাড়াতাড়ি পেয়ে গেলেই ভালো। আমার কাছে তোর মা অনেক টাকা বাকি করে রেখেছে।’
‘ ডিসির হাতে টাকা এসে গেছে।’– প্রেম অকাতরে মিথ্যা কথা বলে গেল–’ আগামী সপ্তাহে টাকাটা দিয়ে দেবে।’
‘দে, দ্রুত এইসব লেনদেনের পাট চুকিয়ে দেওয়াই ভালো।– দোকানে বসে থাকা মানুষটা মন্তব্য করল।’ হেম যাওয়ার বছর খানেক হয়ে গেল। টাকা দেওয়ার ঘোষণাও সরকার অনেকদিন আগেই করেছে। এতদিনে কিছু হয়নি দেখে হবে না বলেই ভেবেছিলাম। এখন যখন হয়েছে ভালোই হয়েছে।’
মানুষটা যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল–’ সরকারি প্রতিশ্রুতিটা রাখে না রাখে তার কোনো ঠিক নেই। যতীন নিজের দলের মানুষ ছিল বলেই এই টাকাটা এল।’
সঙ্গের জনও এবার যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। দোকানিএগিয়েদেওয়া সিগারেটের প্যাকেটটা থেকে আরও একটা সিগারেট বের করে তার হাতে নিলেন। প্রেমের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন–’ টাকা আসার খবর পেয়েই গ্রামীণ ব্যাংকে নিশ্চয়অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়েছিস? ভালোই করেছিস। সরকার তো নগদ টাকা দেয় না, চেক দেবে। এটা ভাঙ্গানোর জন্য ব্যাংকে জমা দিতে হবে।’
গদি থেকে দিয়াশলাইটানিয়ে তিনি ফস করে সিগারেটটা জ্বালালেন । দোকানির কাছ থেকে বিদায়নিয়ে এবার দুজনেই দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন।
প্রেমের মনে হল যে মানুষ দুজনের কথাবার্তার প্রভাব দোকানির ওপরে ভালোভাবেই পড়েছে। তিনি প্রেমকে এবার গদিতে বসতে বললেন। একটা চারমিনার সিগারেটও বের করে দিলেন।
‘ বেশি দিন আর বাকি দিতে হবে না।’– প্রেম বেশ গম্ভীরভাবে দোকানিকে বলল–’ টাকাটা ব্যাংকে জমা হলেই পুরো ধারটা একবারেশোধ করেদেওয়া যাবে।’
দোকানি মাথা নাড়ালো।
কোনো বিশেষ আপত্তি না করে তিনি প্রেমের চাহিদা অনুযায়ী আলু,পিয়াজ, ডাল, তেল, নুন,সবকিছুই বাকিতে দিলেন।
‘মাসের প্রয়োজনীয় জিনিস একবারেইনিয়েনেওয়া ভালো, প্রতিদিন একটু একটু করে নেবারচেয়ে।–’ প্রেম বলল।
আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-১২) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
দোকানি কোনো জবাব দিল না।- বাকি খাতা দেখে তিনি শুধু বললেন–’ আজকেরটা নিয়ে তোমাদের বাকি প্রায় ৫০০ টাকা হয়েছে প্রেম। টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে তুমি এসে ধারটা শোধ করে দিও, নাহলে আমার পক্ষে চলা মুশকিল হয়ে যাবে।’
‘দেবই, এই দুঃখের দিনে তোমার করা উপকারের কথা ভুলে যাব নাকি? টাকা এসে ব্যাংকে ঢুকলেই প্রথমে তোমাকেই দেব।’– প্রেম জোর দিয়ে বলল। বিপদের দিনের বন্ধুই আসল বন্ধু বুঝেছ।’
দোকানি নীরবে মাথা নাড়ল। মুখ দিয়ে তিনি কোনো শব্দ করলেন না।
একটা ছেঁড়া থলেতে বাজারের জিনিসগুলি ভরিয়ে পিঠে ফেলে প্রেম দোকান থেকে লেংচেলেংচে বেরিয়ে এল। কয়েকটি জায়গায় তাকে দাঁড়াতে হল। জিনিসগুলি তুলে আনতে তার কষ্ট হচ্ছিল।
পথের পাশে একটা বড়ো অর্জুন গাছ রয়েছে।
সেখানে গ্রামের ছেলেরা আলকাতরার একটা ড্রাম গড়িয়েনিয়ে তার ওপরে ক্যারাম বোর্ডটা পেতে নিয়েক্যারাম খেলে। ক্যারামখেলায় তার রীতিমতো নাম রয়েছে।
এখন ছেলেগুলির মধ্যে কেউ নেই। দুপুরের ভাত খেয়েপ্রত্যেকেরইবোধহয় এখন বাড়িতে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকছে। আলকাতরার ড্রামটা কেউ কেটে গড়িয়ে ফেলে রেখেছে। একপাশে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ড্রামটা অর্জুন গাছের নিচে একটা ব্যাঙ বসে থাকার মতো দেখাচ্ছে। প্রেম মাটিতে বাজার আনা ছেঁড়া থলেটা নামিয়ে রেখে ড্রামটার ওপরে বসে পড়ল। তার সত্যিই ক্লান্ত লাগছিল। দুপুরের ভাত খেয়েই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
বাজারের ব্যাগটাও যথেষ্ট ভারী। এক ফোঁটা বাতাস নেই।
পয়সার কথাটা তার চট করে পুনরায় মনে পড়ে গেল।
দোকানের কাছে এতগুলি মিথ্যা কথা বলে এসেও তার মনে কিন্তু কোনো ধরনের গ্লানি বা পাপ বোধ জাগল না। বরঞ্চ এক অদ্ভুত মানসিক অবসাদ তাকে চেপে ধরল। হ্যাঁ, টাকাটা- ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য সরকার তাদেরকে দেবে বলে ঘোষণা করা টাকাটা এখন ওদের জীবনে, সমগ্র পরিবারটির জন্য সবচেয়ে বড় কথা হয়ে পড়েছে। সেই টাকাগুলিকে ঘিরেওদের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ, অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত আবর্তিত হচ্ছে। ওদেরপ্রত্যেকের সমস্ত স্বপ্ন টাকাটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। যদি টাকাটা না আসে? যদি না আসে?
যদি কোনো কারণে টাকাটা না আসে তাহলে কী হবে?
প্রেম ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠল। তার হঠাৎ গরম লাগল। সে যেন ঘামতে শুরু করেছে। হাতের পেছন দিকটা দিয়ে সে কপালটা মুছে ওপরের দিকে তাকাল। না, অর্জুন গাছের একটা পাতাও নড়ছেনা, একটুও বাতাস নেই।
অনুবাদক