| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

মিলি ও মিলিন্দ সোমান । মৌমিতা ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
 
একটা কাঠের বাক্স এনে রাখা হল আলিশার সামনে, ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে মিলিন্দ সোমান, উফফ্, বুঝলি বুকের মাঝখানটা কেঁপে উঠলো!
তারপর?
তারপর আর কী! এক ছুটে ঘরে গেলাম। বালিশটা দুপায়ের মাঝখানে চেপে ধরলাম।
মিলি বসে বসে ভাবছে নব্বই দশকে ওরা, মফস্বলের বান্ধবীরা ‘মাস্টারবেশন’ শব্দটাই জানতো না। এরকম কিছু হয় তাই জেনেছে কলেজে উঠে। কিন্ত না জানলেও বয়স তো কথা বলে। ওদের সময় অস্বস্তি হলে ওরা বালিশটা চেপে ধরত। ওরা কোলবালিশে চুমু খেত। বুবলির সঙ্গে এই কথোপকথনের মাঝখানে টুম্পা কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছিল।
তোর এসব হয় না কি? তুই আবার মেয়ে হলি কবে?
কেন, আমি মেয়েই, তো।
দেখেছিস নিজেকে, আয়নায়? ছোট বয়েজ কাট চুল। বেশিরভাগ সময় শার্ট প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াস। মাঝেমধ্যে তো মাঠে ফুটবলও খেলতে দেখি।
কেন তোদের খুশি করার জন্য কি রান্নাবাটি খেলতে হবে না কি?
আমাদের খুশি করার জন্য না। তবে মিলিন্দ সোমান তো ছাড়, পাড়ার মিলনদাও মেয়েদের থেকে যা চায় তা তোর আছে তো?
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে টুম্পা। আনমনে, দুঃখে চোখে জল এসে যায় মিলির। ঠাটিয়ে এক চড় মারে টুম্পাকে। টুম্পা চড় খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। ক্লাস নাইনের মিলিকে বুলি বলে, মিলিদি, শান্ত হও। টুম্পা তো ওরকম অসভ্যই। তবে তুমি চড় না মারলেই পারতে। মিলি কিছু বলতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় নিজের বাড়ি।
আজ রবিবার। বাড়িতে পাঁঠার মাংস হয়েছে। মিলির ফেভারিট। আয়েশ করে নলির হাড়টায় সুরুৎ করে টান দেবে, ঠিক সেই সময় দরজায় খটখট্। মা গিয়ে খুলে দিল। দেখে টুম্পার মা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
ভিতরে এসো, বলে মিলির মা।
থাক্ তপতী, আমি ঢুকতে চাই না। তোমার ওই ছেলেমার্কা গুন্ডা মেয়েটাকে সামলে রেখো। আজ আমার টুম্পাকে ও চড় মেরেছে। মেয়ের আমার গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে। ওর এত সাহস হল কোথা থেকে?
ও তো কখনো কাউকে মারে না। নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।
এসব বলে বলে আরো মেয়ের দোষ ঢাকো। একে তো ছেলের মতো হাবভাবের মেয়ে, মেয়ে হতে শেখাও ওকে। লজ্জাও নেই। আবার সাফাই গাইছে। আজীবন বাপের বাড়ির ভাত খেতে হবে ও মেয়েকে, এই আমি বলে গেলুম। কে করবে ওই ধিঙ্গি মেয়েকে বিয়ে?
উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে যায় টুম্পার মা।
বুক ধুকপুক করতে থাকে মিলির। মা দরজার থেকে ওর সামনে আসার মধ্যে সুড়ুৎ করে টেনে নেয় মজ্জাটা।
মা এসে কঠিন চোখে তাকায় মিলির দিকে। মিলি মাথা নিচু করে বলে, “মিথ্যে কথা। আঙুলের দাগ পড়েনি। একটু লাল হয়ে গিয়েছিল।”
মা ঠাস করে একটা চড় মারেন ওর গালে।
আর কোনদিন যদি শুনি…
বলে চলে যায় অন্য ঘরে। মিলি খাবার টেবিলে বসেই ঝরঝরিয়ে কাঁদে। তারপর একসময় উঠে হাত ধুয়ে শুয়ে পড়ে। শুয়ে পড়তেই ওর সামনে আসে মিলিন্দ সোমান। ওর শরীরটা কেমন করে ওঠে। ও বালিশ চেপে ধরে এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
ক্লাস টেনে উঠে গেছে মিলি। এবারেও ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে ও। আর টুম্পা দশের মধ্যেও নেই। “ঠিক হয়েছে। উচিৎ শাস্তি,” ঠাকুরকে প্রণাম করতে করতে বলে মিলি। এ বছর ও আরো ভালো করে পড়াশোনা করে প্রমাণ করে দেবে যে ও বাবা- মার সত্যিই গর্ব করার মত মেয়ে। আজ ফিজিক্স কোচিং ক্লাসে অরিত্র বলে একটা ছেলে জয়েন করেছে নতুন। কী ভালো লেগেছে যে মিলির! লম্বা, বেশ সুন্দর ঝরঝরে চেহারা। মিলিন্দ সোমানের চেয়ে অনেক সুন্দর চোখ। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছিল না মিলি। অরিত্রকে নিয়ে ওর বান্ধবীরাও খুব উচ্ছসিত। এক মাস হয়ে গেছে। মিলি রোজ হাঁ করে দেখে অরিত্রকে। অরিত্র বিশেষ তাকায় না। মিলিরও লজ্জা করে। মিলি আজ একটা চিঠি লিখেছে। দেবে অরিত্রকে। জানাবে ওর কত ভালো লাগে ওকে। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। ক্লাস শেষ হতেই অরিত্রর হাতে তড়িঘড়ি একটা খাতা ধরিয়ে দিয়ে মিলি বলল, লাস্ট ক্লাসের নোট এতে আছে, তুমি আসোনি গত দিন। বলেই মিলি ছুটে গিয়ে রিক্সায় উঠে গেল।
বুক ঢিবঢিব।পরের টিউশন তিনদিন বাদে, বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবার মা পুজো করে। মিলি নেহাৎ কিছু চাওয়ার না থাকলে ঠাকুরের সামনে দাঁড়ায় না। মা বলে, “সুবিধাবাদী চরিত্র”। আজ দাঁড়াল। প্রণাম করলো, তারপর বেরোলো। শুনলো পেছনে কাকিমা চিৎকার করছে, “এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে, বাড়ির একটা কাজ করে না, জানেই না, লেখাপড়া শিখে মাথা কিনছে, রোজ। মেয়েদের ঘরের কাজ না জানলে চলে?” মিলি এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ওর কোন মেয়েলি কাজ করতে ভালো লাগে না। আর সবাই ওর পেছনে পড়ে থাকে কেন ও একটা কাপ ধুলো না, ঘর গোছালো না, অষ্টমীতে শাড়ি পরলো না। যেন এগুলো করলেই প্রমাণিত হবে ও মেয়ে। ওর বায়োলজিক্যাল অস্তিত্বটাকে সবাই অস্বীকার করছে।
কোচিং ক্লাসের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে অরিত্র, যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছে। মিলির মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো। অরিত্র এগিয়ে এলো। ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেললো মিলির চিঠি। তারপর বললো, “এত বড় সাহস কী করে হয় তোমার আমাকে চিঠি লেখার? আমার বাবা মা কখনো শার্ট- প্যান্ট পরা বৌ মেনে নেবে না। আমিও ভাবতেই পারিনা। এখানে কোচিংয়ে সব মেয়ে সাজগোজ করে, কত ভালো লাগে। তোমার মত রসকসহীন মেয়েকে আমার ভালো লাগতে যাবে কোন দুঃখে?”
অরিত্র বেশ জোরে জোরেই বলছিলো কথাগুলো। অরিত্রর কথা শেষ হতেই গা ঢলাঢলি করে হেসে উঠল ছোটন, টুম্পা, ঝুনু, সুলগ্না।
কাকের ময়ূর হবার শখ জেগেছে রে।
অপমানে কেঁদে ফেললো মিলি। জীবনে প্রথমবার ভালবেসে চিঠি লেখার সঙ্গে অপমান জড়িয়ে রইলো। আর কোন দিন কারো দিকে তাকায়নি মিলি। পড়াশোনা করে গেছে মন দিয়ে। ভুলেও কখনো লিপস্টিক লাগায় নি বা সাজেনি।
কলেজে পড়ে মিলি। প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স অনার্স। কলেজের প্রথম দিন থেকেই ও নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। দু-তিন দিন জ্বরে ভুগলো মিলি। চারদিন বাদে কলেজে ঢুকেই মধুপর্ণাকে বলল, “গত চারদিনের নোটস্ দে না, প্লিজ “। মধুপর্ণা এটা সেটা বলে কাটিয়ে দিল। নোটস্ দিল না। কলেজ শেষ হতে মিলির ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। “তুই নোটস্ দিবি না, বলতেই পারতিস, আমাকে এভাবে ইগনোর করার কি মানে?” মধুণর্ণা অতি অসভ্য। সবার সামনে বললো, গো টু হেল।

আরো পড়ুন: দুই জোড়া জুতার গল্প । মনিষা দাশ গুপ্ত


মিলি একেবারে চুপ করে গেল। লাইব্রেরি চলে গেল। নিজেই একটু পড়াশোনা করে বানিয়ে নেবে নোটস্। তারপর সুচেতা ম্যাডামকে রিকোয়েস্ট করে দেখিয়ে নেবে। লাইব্রেরিতে বসে নোটস বানাচ্ছে। হঠাৎ দেখে খাতার পাশে এগিয়ে এসেছে এক খাতা। চোখ তুলে দেখে রাজীব। ওদের ক্লাসেই পড়ে।
এই যে নোটস্। এরপর থেকে আমার কাছে চাস। কেমন? বলে মিষ্টি হেসে বেরিয়ে গেল রাজীব। নোটসের খাতার খুলতেই একটা সুন্দর গোলাপ পাপড়ি সাঁটা কাগজে বেরিয়ে পড়লো চিঠি।
জানি তুই ছেলেদের এড়িয়ে চলিস। এও বুঝতে পারি, কেন? আমার তোকে খুব ভালো লাগে। তুই খুব উজ্জ্বল। তোর চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল। আলাদা করে তোকে কখনো সাজতে হবে না আটেনশন কুড়োতে। আমি তোর ভিতরের আলোটা দেখতে পেয়েছি। ভরসা করা যায় আমাকে?
মিলি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর ভাবলো ও কেমন উচ্ছাস প্রকাশ করে, সেটা নিয়ে সর্বসমক্ষে উপহাস করার কোন প্ল্যান ফেঁদেছে বন্ধুরা। চুপচাপ চিঠিটা ব্যাগে ভরে রাখে ও। তিনরাত জেগে থাকে। রাজীব এসে জিজ্ঞেস করে, আমার উত্তর? মিলি চুপ করে সরে যায়। এক সপ্তাহ কাটলো। এবারে এলো আরো বড় চিঠি। সেই চিঠির আকুতি এড়াতে পারলো না মিলি। ক্লাস শেষ হলে বললো, হেদুয়া পার্কে হেঁটে আসি চল।
সেদিন ওরা প্রথম চুমু খেয়েছিল। আর কী ভালো যে লেগেছিল মিলির নারীত্বের স্বাদ!
মিলিন্দ সোমানের পর, আমীর খান, মেল গিবসন সবাই এসেছে। এর পর এসেছে রাজীব। পাগল করা রাজীব! ওকে এত্ত ভালবাসা রাজীব! ওদের এম এস সি কমপ্লিট। মিলি রিসার্চ করবে। রাজীব বললো,চাকরি বাকরি দেখি।
কেন? তুই পি এইচ ডি করবি না?
নাহ্, আসলে তোকে ছাড়া আর থাকতে পারছি না। বিয়ে করতে হলে রোজগার তো করতে হবে।
হঠাৎ ছলছল চোখে মিলি রাজীবের বুকে মুখ লুকোয়। রাজীবের মা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তাঁরা তাঁদের ছেলের পছন্দে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন এবং কিছুতেই সামাজিক ভাবে এ বিয়েতে থাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর রাজীবও একগুঁয়ে, কিছুতেই শুধু বিয়ে করার জন্য মিলি চুল বড় করবে না!
অগত্যা রেজিষ্ট্রি বিয়ে করে ওরা উঠে এল বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। এটাতে থাকা নিয়ে রাজীবের বাবা মা বিশেষ ঝামেলা করেননি। মিলিও শুরু করল টিউশন। রাজীব হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পড়ায়। একদিন তিন চার জন কমন বন্ধুবান্ধব নিমন্ত্রণ করল ওরা। বন্ধুরা এলো হৈহৈ করে। রাজীব নিজে বিরিয়ানি বানিয়েছে। শুরু করলো সুমন, উফ্ দারুণ, রাজীব আমার কপাল ভালো। আমার উড বি ওয়াইফ মিলির মতো পড়াশোনায় ভালো নয়। পড়াশোনায় ভালো হলে তো রান্না বান্না করতো না। তোর মতো আমাকেও বৌয়ের খিদমদগারি করতে হতো।
উত্তরটা মিলিই দিলো।
এর সঙ্গে পড়াশোনার কোনও সম্পর্ক নেই সুমন। ইট’স এবাউট চয়েস। আমার রান্না করতে ভালো লাগেনা, ওর লাগে।
মহুয়া বলে উঠল, তা বলে তুই বিয়ে করেও মেয়ে হয়ে উঠবি না? বিয়ে করে তুই বৌ না আসলে তুই বর, বোঝা দায়!
অনিকেত বললো, রাজীব, দুটোকেই লাথি মেরে বার কর। তোরা ভালো আছিস, ওরা খুঁজছে কে কাকে ডমিনেট করছে। কুচুটে, ওল্ড স্কুল, কনজারভেটিভ মাইন্ড, ভাগ শালা।
তারপর একচোট কুরুক্ষেত্র হল বন্ধুদের, সুমন আর মহুয়া বেরিয়ে গেল রাগ করে। ওরা বেরিয়ে যেতেই অনিকেত বললো, বাঁচা গেছে, রাম কিনে আনি, উই শুড সেলিব্রেট। 
মা আর কাকীমা এসেছে খবরটা শুনে।
ছুটে এসেছে ননদও।
সত্যি? বৌদি? তুমি প্রেগনেন্ট? তুমি কি করে প্রেগনেন্ট হয়ে গেলে?
যেমন করে আর পাঁচটা মেয়ে হয়। তুমি এত অবাক হচ্ছ কেন? ছোট চুল, ট্রাউজার পরা মেয়েরও ইউটেরাস, ভ্যাজাইনা, ক্লিটোরিস সব আছে।
না, মানে…আর কোন কথা খুঁজে পায় না ইতি।
অবশেষে মেয়ে এলো। রাজীব খুব খুশি। ছয় দিনের দিন মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে মিলি আর রাজীব। মিলির শ্বাশুড়ি প্রথম বার এসেছেন ওদের বাড়ি। গত একমাস আছেন নাতনীর জন্য। ওর কিন্ত ছোট চুল আমি রাখতে দেবো না রাজু। তোমার জীবন নিয়ে আমি কিছু বলিনি, কিন্ত আমার নাতনী আমার মতো হবে, কাজল পরবে, টিপ পরবে, তাই না দিদিভাই?
নাতনীর সঙ্গে কথা বলতে থাকেন রাজীবের মা।
রাজীব ইশারা করে। মিলি ঘরে ঢুকে আসে। দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মিলিন্দ সোমান মিলিকে খুব আদর করে। মিলি মেয়ে হয়ে আদর খায়, প্রেমিকা হয়ে আদর খায়, মেয়ের মা হয়ে আদর খায়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত