Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,মিষ্টু

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-৭) । শ্যামলী আচার্য

Reading Time: 4 minutes

রাতের খাবার দেওয়ার সময় মিষ্টু বিশাখাকে জিগ্যেস করল, “দাদা এখনও ফেরেনি মা?”

       বিশাখা অন্যমনস্ক ছিলেন। হাতে কুরুশের কাঁটা চলছে। চোখ টিভির পর্দায়। সাদা-কালো ছবি। মাঝেমধ্যে ঝাপসা হয়ে যায়। তখন টিভিটার ওপরে একটু চড়-চাপড় মারতে হয়। কখনও ‘অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত’ লেখা একটা বোর্ড দেখা যায়। বাংলা সিনেমা চলাকালীন এইসব লেখা দেখলেই ঠাম্মা বলে, “অগো অ্যাকখান গঁদের আঠা দিয়া আয়”। রাতের দিকে ঠাম্মা টিভি দেখে না। শুয়ে পড়ে। ঘুমোয় না। কারণ একটু পর পর যে বাড়ি ঢোকে, তার জন্য হাঁক পাড়েন। শিবু আইলি, মিষ্টু আইলি, খোকন আইলি।

এখন টিভিতে ‘মুঙ্গেরিলালকে হসীন সপনে’ শুরু হয়েছে। ডিডি টু। দূরদর্শনের দু’নম্বর চ্যানেল। কট কট করে রেগুলেটর ঘোরানোর মতো করে চ্যানেল বদলাতে হয়। গান শুরু হল। সপনো কে নাম নেহিঁ, সপনো কে দাম নেহিঁ, সপনো কে ঘোড়োঁ পর কিসি কি লাগাম নেহিঁ….. গানটা খুব ভাল লাগে মিষ্টুর। ও হাঁ করে তাকিয়ে রইল পর্দার দিকে। একজন কেরানির দিবাস্বপ্ন। স্বপ্নে তার ইচ্ছেপূরণ হয়। দিব্যি লাগে দেখতে। সব সময় দেখা হয় না অবশ্য। টিউশনি সেরে ফিরতে কত রাত হয়ে যায় এক-একদিন। তখন ফিরে চোখ টেনে আসে। কুয়ো থেকে তুলে রাখা ঠাণ্ডা জলে হাতমুখ ধুতে ধুতেই পর পর কাজগুলো মনে পড়ে। সবাই খেয়ে উঠলে ওর কাজ থালাবাসন মেজেধুয়ে রাখা। ঘরে গিয়ে দুটো বিছানা ঝাড়া। চাদর তুলে মশারি খাটিয়ে গুঁজে তারপর মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে জলচৌকি টেনে পড়তে বসে মিষ্টু। সকালে আর পড়তে বসার সময় হয় না।    

       মিষ্টু আবার বলে, “দাদা কোথায় মা?”

       “কী বলছিস?”

       “বলছি, দাদা ফেরেনি এখনও?”

       “এত তাড়াতাড়ি? দাঁড়া, সাড়ে দশটা বাজুক। দেশের দশের কাজকর্ম মিটুক সব। তারপর তো…” মায়ের কথার মধ্যে ক্লান্তি আর বিরক্তি সমান সমান।

       মিষ্টু-র পিঠোপিঠি খোকন। দু’বছরের বড়। ঠাম্মা তাঁর স্বপ্নের পুরুষের নামে নাতির নাম রেখেছেন উত্তম। তা’ নিয়ে প্রায়শই হুলুস্থুল হয়। নিজের নাম উত্তমের পছন্দ নয়। কিন্তু ঠাম্মাকে ঝাঁঝিয়ে নিজের মতামত দিলেও মায়ের সামনে গলা তুলতে পারে না উত্তম। একটু ভয় খায়। মিষ্টুর কাছে তার যত তড়পানি। মিষ্টু দাদা-অন্ত প্রাণ। অনেক পাওয়া-না পাওয়ার সংসারে দাদাকে সে অনেক কথা বলতে পারে। তাকে দাদা যতই ক্যাবলাকান্ত বলুক, মিষ্টু জানে, ওসব দাদার আগলে-রাখা ভালবাসা।

       “মা, তার মানে আজও তুমি না খেয়ে বসে থাকবে?”

       “উপায় কি বল? সবাইকে খাইয়েদাইয়ে সাত তাড়াতাড়ি সব গুটিয়ে শুয়ে পড়ার কপাল করে আসিনি মা। তা’ও ভাল, তুমি আজ সাড়ে আটটার মধ্যে ঢুকলে। অন্যদিন তুমিও তো সাড়ে ন’টা বাজিয়ে ফেরো।”

       মিষ্টু কথা বাড়ায় না। টিভির দিকে তাকায়। “এটা দেখে নিয়ে খেতে বসছি দাঁড়াও,” মুঙ্গেরিলালের দিবাস্বপ্নের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে মিষ্টু। একফালি রান্নার জায়গার সামনে একটা খোলা অংশ। দুদিকে দুটি ঘর। দালানের মতো জায়গাটির এককোনে মীটসেফের ওপরে টিভিটা বসানো। খেতে খেতে টিভি দেখা যায়। রান্না করতে করতেও দেখা যাবে বলে এইখানে রাখা হয়েছে। মায়ের কথাতেই এখানে রাখা হয়েছে। বাইরের ঘর বলে তো কিছু নেই। আর শোবার ঘরে গাদাগাদি জিনিস। ঠাকুমার একচিলতে ঘরে তার ঠাকুরের আসন আর পুজোর জিনিসপত্র বাসনকোসন ট্রাঙ্ক বাক্স মিলিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি। আর একটাই বেশ বড় ঘর। একদিকে মায়ের আর মিষ্টুর বিছানা, অন্যদিকে বাবা আর উত্তম। সেখানে টিভি রাখার জায়গা কোথায়?

আজকাল উত্তম অবশ্য সেই বড় ঘরে সকলের সঙ্গে শুতে চায় না। একেবারে বাইরের বারান্দায় একটা সিঙ্গল চৌকি পেতে নিয়েছে সে। একটা কম পাওয়ারের টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে অনেক রাত অবধি লেখাপড়া করে। ঘরে সকলের সঙ্গে অসুবিধে হচ্ছে তার।


 আরো পড়ুন: কদমতলি (পর্ব-৬) । শ্যামলী আচার্য


এর মধ্যেই খাবার জায়গায় জল ঢেলে ন্যাকড়া বুলিয়ে চটের আসন পেতে দিয়েছে মা। তাতে রঙিন উলে কারুকাজ। ক্রসস্টিচ। দেখে মনে হচ্ছে আনকোরা নতুন আসন। ঠাম্মা দেখলেই বলত, “ঠাকুরপুজায় দিলে পারতা বউমা।” ঠাম্মার কত ঠাকুরের যে কত রকম আসন লাগে! মা অবসরে বহু কিছু বানায়। একা নিজে বানায় না। পাড়াপ্রতিবেশিদের সঙ্গে আড্ডার ছলে সেলাইয়ের প্যাটার্ন বিনিময় হয়। শীতের গোলগলা সোয়েটার, বাবার জন্য মোটা মাফলার, উলে-কুরুশে বোনা গায়ে দেওয়ার বাহারি চাদর… সারা বছর ধরে আসন সেলাই করছে, বালিশের ওয়াড়ে বাহারি সুতো দিয়ে কাজ করছে, সাদা সুতো দিয়ে লেস বুনে লাগিয়ে দিল সায়ার তলায়… মায়ের হাত চলতে থাকে। আর ঠাকুমা একনাগাড়ে বলে যেতে থাকেন, ‘বউমা এবার তোমার চোখ দুইটা যাইব হনে।’

বিশাখা এতসব কথা কানে তুললে তো।  

       “এই আসনটা নতুন করলে মা? দেখিনি তো!”

       মিষ্টুর প্রশ্নে একবার তাকান বিশাখা। “হ্যাঁ রে। আজই শেষ হল। চটের টুকরোটা পড়েছিল। ভাবলাম একটু কাজ করে রাখি। ভাল হয়েছে রে?”

       মিষ্টু হেসে ফেলে। “তোমার হাতের কাজ খারাপ হয় কখনও?”

       “তুই ছোটবেলায় কতকিছু দিব্যি পারতিস। এখন সেলাইফোঁড়াই ছেড়েই দিলি।”

       “কী যে বলো, তার নেই ঠিক। কলেজ করে, টিউশনি করে কখন বসে সেলাই করব বলো তো! নিজের পড়াও তো আছে…,” গড়গড় করে বলতে বলতেই মিষ্টু জিগ্যেস করে, “আজ এই আসনটা কার জন্যে পাতলে মা?”

       “কেন রে! তোর জন্য পাতলাম। তুই আজ একটা নতুন আসনে বসলি নাহয়।”

       মিষ্টু অবাক হয় না। মা এইরকমই। ঠাকুমা হলে জন্মতিথিতে দিও, শুভদিন দেখে পেতো… কতরকম যে নিয়মকানুন শোনাতো। মা এইসব চলতি আচারের ধার ধারে না, সেজন্য অনেকের কাছে টুকটাক কথা শোনে। আবার সেই সব কথা কেমন দিব্যি ঝেড়েও ফেলতে পারে। মিষ্টু মায়ের এই স্বভাবটা মাঝেমধ্যে লক্ষ্য করে। কিন্তু ও মায়ের মতো নয়। মায়ের মতো হতে পারবে না কখনও। ও বেভুল। আনমনা। যে প্রতি পদে হোঁচট খায়।     

       বিশাখা সব গোছাতে গোছাতে বলেন, “তোর বাবাকে ডাক এবার। রাত হল অনেক। পেটের রুগী। রোজ কেবল বলে পেটে ব্যথা। ভালো ডাক্তার দেখাতে বলছি কত করে। কীসব কোবরেজি ওষুধ দিয়েছে অফিসের কে। সে-ই খাবে। সে কারও কথা শুনলে তো! বড় ডাক্তার দেখানোর নাকি তার সময়ই হয় না। কৌটোয় করে সঙ্গে মুড়ি দিয়ে রাখি, একমুঠো খেয়ে একটু জল খেলেও পেট খালি থাকে না… সে কে শোনে কার কথা? এ বাড়িতে কথা শোনার কোনও চল নেই।”

       মিষ্টু ভাবে, বাবা তো অন্যদিন এই ঘরে বসে টিভি দেখে, চা খায়, ঠাম্মার ঘরে গিয়ে বসে। আজ হঠাৎ ঘরের মধ্যে কেন?

       সে ঘরের দরজার পর্দা সরায়। “ও বাবা,” শিবপদ চোখ বুজে শুয়ে ছিলেন। মেয়ের ডাকে চোখ খোলেন।

       “বাবা, তোমার কি শরীর খারাপ?”

       “না রে, ওই পেটের মধ্যে কেবল জ্বালাপোড়া করে। এসে এক ঘটি ঠাণ্ডা জল খেলাম নুন-চিনি দিয়ে। এখন ভাল লাগছে।” 

       “চলো, খেতে যাবে না? মা খাবার বাড়ছে।”  

       “যাব। তোর পড়াশোনার কি খবর রে? কলেজে ক্লাস কামাই করিস না যেন।”

       “আরে না না, ক্লাস কামাই করব কেন?” মিষ্টু আর কথা বাড়ায় না। এতদিন ইস্কুলের দিদিমণিদের পড়ানো শুনেছে, এখন কলেজে কত স্যার আর ম্যাডাম। গড়গড় করে তারা কত কিছু বলেন। ডায়াসে এসে দাঁড়ান। বলেন। তক্ষুনি তক্ষুনি শুনে লিখে নিতে হয়। মিষ্টু এখনও পুরোটা ধাতস্থ হতে পারেনি। কিন্তু এসব কথা বাবা’মাকে বলা যায় না। দাদাকে তবু বলা যায়। দাদাও অবশ্য কেমন দূর গ্রহের প্রাণী হয়ে যাচ্ছে আজকাল। কত রাত্তির করে ফেরে। কীসব বই পড়ে রাত জেগে। আগে ভোরবেলা উঠে জগিং করত, পাশের মাঠে ছেলেরা মিলে ফুটবল খেলত। এখন আর মাঠে যায় না। সেদিন বিশ্ব বলছিল, “উত্তমকে দুপুরে পার্টি অফিসে ঢুকতে দেখি আজকাল। কলেজে যায়? ক্লাস-টাস করে?”

       মিষ্টু বাড়িতে এসে কিছু বলেনি। দাদার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া ওর কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগে না। এমনটিই তো হওয়ার ছিল। এই পাড়ায় বড় হওয়া দাদা খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের কথা বলবে, এ আর অসম্ভব কী! বাবার কাছে শুনেছে, এই কলোনীর মধ্যে তাদের একফালি জমি পেতে একদিন কীভাবে পার্টির সাহায্য নিতে হয়েছে। উদ্বাস্তু কলোনীর আজকের চেহারা দেখে সেদিনের দরমা বাঁশ টিন মনে পড়ে না কারও। এখন পাড়ায় সবারই পাকা বাড়ি।   

       ‘কংগ্রেসি গুণ্ডা’ শব্দটাও কেমন ফিকে হয়ে আসছে।

       আবছা শব্দে মিষ্টু বুঝতে পারে, মুঙ্গেরিলালের গল্প আজ শেষ হয়ে গেল। ওর স্বপ্ন ভেঙে গেল নির্ঘাত। সেখানেই তো গল্প শেষ হয়ে যায় রোজ।        

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>