২৬ মার্চ সংখ্যা: ধর্মনিরপেক্ষতাই মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র । যতীন সরকার
‘স্বাধীনতা— এ কি তবে নষ্ট জন্ম?
এ কি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল!
জাতির পতাকা আজ খামচে ধরছে পুরোনো শকুন।
বাতাসে লাশের গন্ধ—
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান।’
বাতাসে লাশের গন্ধ এখনো মিলিয়ে তো যায়ইনি, প্রতিনিয়ত সে-গন্ধ বরং বাতাসকে কেবলই দূষিত করে চলছে। সেই গন্ধের হাত থেকে কি মুক্তি মিলবে না আমাদের।
মিলবে অবশ্যই। তবে সে-মুক্তি আপনা আপনিই আমাদের হাতে এসে ধরা দেবে, আমাদের কিছুই করতে হবে না—এমন ভেবে আত্মপ্রসন্ন হয়ে বসে থাকলে সেটি হবে মূর্খের স্বর্গবাস। ও-রকম মেকি স্বর্গ থেকে মাটিতে নেমে আসতেই হবে। আত্মপ্রসাদের সামান্যতম অবকাশও নেই। জাতির পতাকাকে খামচে ধরেছে যারা সেই পুরোনো শকুনগুলোর নোংরা হাতগুলো ভেঙে না-দেওয়া অবধি আমাদের পরিত্রাণ নেই। শুধু পুরোনো শকুন নয়, ওদের নতুন চেলাগুলোকেও রেয়াত দেওয়া চলবে না। মিত্রের বেশ ধরে আমাদের ভেতরে ঢুকে পড়া শত্রুদের যথাসময়ে চিনতে পারিনি বলেই অনেক অনেক বিপত্তি এতকাল ধরে পোহাতে হয়েছে।
সমস্ত বিপত্তি থেকে পরিত্রাণ লাভের একমাত্র উপায়ই হলো মুক্তিসংগ্রামের মূল্যবোধের আলোতে পথচলা। আমাদের শত্রুদের লক্ষ্যই হলো সেই আলোটি নিভিয়ে ফেলা, অন্তত জনগণের দৃষ্টিসীমা থেকে আলোটিকে দূরে নিয়ে যাওয়া। সেই আলোক বর্তিকাটিকে আড়াল করে খোপ খোপ অন্ধকার ওরা এখানে-ওখানে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ-রকম অন্ধকারের মূল উপাদানই হলো ধর্মান্ধতা। স্পষ্ট করে বলি : ধর্ম নয়, ধর্মান্ধতা। আমাদের মানুষের ধর্মপ্রাণতা হচ্ছে ‘ধর্ম’ শব্দটির মূল মর্মের ধারক, আর ধর্মান্ধতা ধর্মের মূল মর্মেরই সংহারক। ধর্মপ্রাণদের চিত্ত শুভবুদ্ধি ও মুক্তবুদ্ধিতে ভরপুর বলেই সাম্প্রদায়িকতা তাদের কাছে একান্তই ঘৃণ্য।
মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে এই ধর্মপ্রাণতা আমাদের ভেতর জাগিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ধর্মান্ধতা কখনো সখনো আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। কিন্তু আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার যে শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতার যে শক্তি তা সবসময়ই জয়ী হয়েছে এবং ভবিষ্যতের যে জয়, তাও হবে ধর্মনিরপেক্ষতার হাত ধরেই। মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র এটাই।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ আগস্ট (বাংলা ১৩৪৩ সনের ২ ভাদ্র) তারিখে যতীন সরকারের জন্ম হয় নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে।
শিক্ষকতা করতে করতেই তিনি আজ ‘গণশিক্ষক’। ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বিএ পরীক্ষা দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে তিনি দু’মাস কেন্দুয়ার আশুজিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরবর্তী দু’বছর (১৯৫৯-১৯৬১) বারহাট্টা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পরীক্ষা দেয়ার পর দশমাস গৌরীপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা শেষে ১৯৬৪ সালে যোগ দেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসাবে।
চার দশক একাগ্রচিত্তে শিক্ষকতার পর অবসর নেন তিনি।
কলেজ জীবনে লেখালেখির সূচনা হলেও যতীন সরকারের লেখা প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে, পঞ্চাশ বছর বয়সে। প্রথম বইয়ের নাম ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যশা’। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশের কবিগান’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, মানবমন, মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’, ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’, ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’, ‘পাকিস্তানের ভূত দর্শন’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও সমাজ চেতনা’, ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’, ‘রাজনীতি ও দুর্নীতি বিষয়ক কথাবার্তা’, ‘আমদের চিন্তার চর্চার দিক্ দিগন্ত, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভুত ভবিষ্যত’, ভাষা সংস্কৃতি উৎসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’, ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন’, ‘সত্য যে কঠিন’, ‘বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি’, ‘বাংলা কবিতার মূলধারা এবং নজরুল’, ‘ভাবনার মুক্ত বাতায়ন’, রচনা সমগ্র(১ম ও ২য় খ-)সহ আরও বেশকিছু জীবনীগ্রন্থ ও সম্পাদিত বই। ‘সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ নামে একটি তাত্ত্বিক ত্রৈমাসিক সম্পাদনা করতেন তিনি।
রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য সবক্ষেত্রেই তিনি এক ক্ষুরধার লেখক। অসামান্য প্রতিভার কারণেই মফস্বলের নিভৃতে পড়ে থাকা সত্ত্বেও সচেতন লোকচক্ষু তাকে এড়িয়ে যায়নি কখনও।
স্বাধীনতা পদক(২০১০), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার(২০০৭), বাংলা একাডেমী প্রদত্ত ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক(১৯৬৭), খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পরস্কার(১৯৯৭), প্রথম আলোর বর্ষসেরা বই পুরস্কার(২০০৫), মনিরউদ্দিন ইউসুফ স্মৃতি পদক(১৯৯৭), ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব সাহিত্য পদক(২০০১), আলতাব আলী হাসু পুরস্কার(২০০৯) সহ অসংখ্য পুরষ্কার-খ্যাতি পেয়েছেন।