বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যের সব শাখায় তিনি সফল বিচরণ করেছেন। কম আলোচিত একটা দিক হচ্ছে, চিত্রকলাগুণ। ভারতবর্ষের চিত্রকলার নান্দনিকতায় ও বহুমুখীরেখায় নতুনত্ব এনে আধুনিকতায় নতুনমাত্রা যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। চিত্রশিল্পী হিসাবে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক। ভারতীয় মূলচেতনা রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এখানে তিনি অনন্য। বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী চিত্রকলায় ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্য ও খোলসবদল করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি প্রথার সঙ্গে আটকে থাকেননি। ইউরোপীয় ও ভারতীয় শিল্পের সম্মিলন করে তৈরি করেছেন নতুন বোধ।
শিল্প-সমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক কল্পনার সঙ্গে শেষ ঝগড়ার ফসল তার চিত্রকলা (রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা)।’ ষাটের বেশি বয়সে (১৯২৪ সালে) ‘‘পূরবী’’ কাব্যগ্রন্থের কাটাকুটি থেকেই রবীন্দ্রনাথের শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প শুরু হয়। ১৯২৩ সালে রক্তকরবীর পাণ্ডুলিপির খসড়ার পাতায়ও একইরকমের ঘটনা ঘটে। বলে রাখা দরকার যে, এসবের আগেও রবীন্দ্রনাথ অনেক ছবি এঁকেছেন। তবে ধারাবাহিকতা না থাকায় পাঠক-শ্রোতার আড়ালেই থেকে যায়। ১৮৭৮ সাল থেকে ১০৮২ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ‘‘মালতী’’ নামে একটি পুঁথির পাতায় ছবি আঁকতে শুরু করেন। তবে রবীন্দ্রনাথ পুরোদস্তুর ছবি আঁকা শুরু করেন ১৯২৮ সালে (শেষ বয়সে)। আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্য সমালোচক ও লাতিন আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-র বাড়িতেই পূরবী কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন বলে জানা যায়। ওকাম্পো আবিষ্কার করেন ‘চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ’-কে। ছোট্ট কবিতার খাতায় কবিতার কাটাকুটি ও তা থেকে ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ওকাম্পো লিখলেন, ‘ওঁর একটি ছোট খাতা টেবিলে পড়ে থাকতো, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন বাংলায়।…লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তার ওপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি।…সমস্ত ভুল, সমস্ত বাতিল করা লাইন, কবিতা থেকে বহিষ্কৃত সব শব্দ এমনি করে পুনর্জীবিত হতো এক ভিন্ন রূপের জগতে, আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন স্নিগ্ধ কৌতুকে হাসত তারা এই ছোট খাতাটাই হলো শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব’। জীবনের শেষ সতেরটি বছর তিনি একে গেছেন দুহাতে। প্রায় দিনেই তিনি চার পাঁচটি ছবি একে শেষ করতেন। ভ্রাতুষ্পুত্র প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ একে ‘আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত’ বলতেন। রেখা ও রঙের সমবায়ে নির্মাণ করে অভিনবত্ব এনেছেন তিনি।
স্বীকৃতি ও প্রশংসা ধরে নিলে আধুনিক ভারতীয় উপমহাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম ‘আন্তর্জাতিক চিত্রকর’। অতি অল্প সময়ের সাধনায় আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে গেছেন তিনি। ব্যাপক পাঠ করে আমরা বলতে পারি যে, রবীন্দ্রনাথের মনোজগৎ ছিল কলা ও সংস্কৃতির বিরাট এক চিন্তনভূমি। রবীন্দ্রনাথ রেখার ছন্দে রূপ তুলে ধরেছেন, রূপের ব্যঞ্জনা ছড়িয়েছেন। চিত্রকর্মে তিনি নিজের কর্মকৌশল সৃষ্টি করেছেন। চিত্রসাধনায় প্রথম কারণ হতে পারে, সমান গুরুত্ব দেওয়া এবং আবাল্য প্রেরণা। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, তাঁর পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ। আমরা লক্ষ্য করেছি অবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হ্যাভেলের (ই.বি) নেতৃত্বে সারা ভারতে ধ্রুপদী চিত্রসাহিত্যের নবজাগরণ শুরু হয়েছিল। আর খুব কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যক্ষ করেন এবং তা আন্তরিকভাবেই। ফলে জীবনের শেষের দিকে শুরু করেও চিত্রসাহিত্যে তিনি ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে পেরেছেন; আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তারই প্রমাণ। সেসময়ে ইউরোপ সাধারণত এশীয় বা চিনা চিত্রকর্মকে স্বীকৃতি দিতে চাইত না। ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি আমেরিকা ও ইউরোপীয় চিত্রবোদ্ধাদের কাছ থেকে সমীহ আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। কবি হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া তাঁর ক্ষেত্রে এ অভিযানকে সহজতর করেছে বলে মনে করি।
রবীন্দ্রনাথ মনে মনে ধারণ করতেন যে, আমাদের নববঙ্গের চিত্রকলায় আর একটু জোর, সাহস ও বৃহত্ব দরকার আছে। তিনি মনে করতেন, বাঙালিরা ছোটখাটোর প্রতি বেশি ঝোঁক দেন। তিনি বাঙালির অতীতের চিত্রকর্ম মাথায় রাখার পাশাপাশি উন্নত চিত্রশিল্পের অনুসরণ ও তাকে বৃহদায়তনে নিয়ে যাওয়া। বহির্জগতের সঙ্গে আদান-প্রদানের মাধ্যমে আধুনিকায়নে পৌঁছানো। কূপমণ্ড‚কতা পরিহার করে বাইরের জগতের শিক্ষণীয় বিষয়কে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার পক্ষে ছিলেন তিনি। আসলে চিত্রসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রচন্ডরকম মানসিক শক্তি ছিল। আলোচনা থেকে তৃতীয় কারণ বলতে পারি, বহিঃজগতের চিত্রকর্ম সম্পর্কে রবির ধারণার ব্যাপকতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনব ও অনবরত সৃষ্টিক্রিয়া এবং কল্পনার মিশেলে নতুন এক ঐকতান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। শুধুমাত্র ভারতীয় রীতি অনুকরণ না করে ইউরোপীয় তেজস্বী প্রয়োগ করেছেন আবার প্রাচ্যের রীতির সংমিশ্রণ দিয়ে ভারতীয় চিত্রকলায় নতুন এক অধ্যায় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। অর্থ্যাৎ যখন যা দরকার মনে করেছেন সে স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। অযথা শুধু পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে চিত্রকর্মের পথ চলতে চাননি। ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শেষ পর্যায়ের চিত্রকলায় তাঁর রঙ এমন আলো বিচ্ছুরিত করতে থাকল যে ভারতীয় চিত্রে যা আগে দেখা মেলেনি। তাতে আন্তর্জাতিক এক আবহ সৃষ্টি হল। ইউরোপীয় সমালোকরা স্বীকার করে নেন যে, এক্সপ্রেশনিজম (প্রকাশবাদ) রবীন্দ্র-চিত্রকল্পে অনস্বীকার্য একটি বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্র চিত্রকলায় মানুষের যে আকৃতি আঁকা হয়েছে তা এ রীতিকেই অনুসরণ করে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রে রেখার প্রাধান্য রয়েছে। ছন্দায়িত বিন্দুর সংযোগে তাঁর রেখা অন্যরকম মাত্রা পেয়েছে, নান্দনিক হয়েছে। তাঁর চিত্রের অভিব্যক্তি অনুধাবনযোগ্য। রেখার বিভিন্ন সমন্বয়ে এবং রঙ ব্যবহারে অনিন্দ্য রূপের সৃষ্টি হয়েছে।
রেখা থেকেই শুরু চিত্রকর্ম। কলম দিয়েই যার যাত্রা। পরবর্তীতে তুলিও নিয়েছেন। রেখাসমূহের জাল ক্রমশ রূপ নেয় তরঙ্গে। এরপর পায় অবয়ব। আবার অনেক রেখা রঙের ছোঁয়ায় ভিন্ন রূপ পায়। রবীন্দ্রনাথ অচেতনা ও চেতনতাকে মেধা ও মনন দিয়ে গড়েছেন, প্রকাশ্যে এনেছেন তুলির নানা রঙের মধ্য দিয়ে। কখনো কবিতা, কখনো গদ্যের শরীরে, কখনো ক্যানভাসের ছবির ভিতরের নির্জনতাকে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। রহস্যময়তাকে শক্তিশালী করতে রবীন্দ্রনাথ জলরঙের ব্যবহার করেছেন। অনেকক্ষেত্রে তিনি দুটি রঙের মাঝে সাদা রঙ দিয়ে বিভক্ত করার চেষ্টা করেছেন। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের শিল্পকলা অত্যন্ত আধুনিক। তাঁর সমকালীন শিল্পীদের তুলনায় তিনি অ্যাডভান্সড ছিলেন।’ রবীন্দ্রনাথের তুলিতে নারীর চিত্রগুলো শাশ্বত রূপ পেয়েছে বলেও তিনি মত তুলে ধরেন। শিল্পী রফিকুন নবী রবীন্দ্রনাথকে ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার জনক বলে উলে্লখ করে বলেন, ‘তিনি পেশাগত চিত্রশিল্পী হওয়ার চেষ্টা করেননি। নিজের খেয়াল-খুশিমতো তিনি ছবি এঁকেছেন। তার সমকালীন ভারতীয় শিল্পীরা এতটা স্বাধীনতা ভোগ করেননি।’
একজন চিত্রশিল্পী ও সমালোচক আধুনিক চিত্রশিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ে প্রথম প্রবন্ধ লেখেন যামিনী রায়। বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত ‘‘কবিতা’’ পত্রিকার রবীন্দ্র সংখ্যায় (আষাঢ়, ১৩৪৮) ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ছবিতে প্রবল শক্তি রয়েছে, রয়েছে বৃহত্তর রূপবোধ। তাঁর ছবির মধ্যে অনন্য এক ছন্দ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ছবি (যেমন মানুষ বা প্রাণীর) দেখলে মনে হয় তার মধ্যে বিপুল প্রাণশক্তি রয়েছে। নারীর চরিত্র সৃষ্টিতে তিনি বেশি সফল হয়েছেন বলে মনে করা হয়। তাঁর আঁকা নর-নারীর মুখের ছবিতে যেমন বিশিষ্ট মনের আকৃতি, তেমনি প্রতিকৃতিতে পাওয়া যায়। নিজেরসহ বহু প্রোট্রেট এঁকেছেন। রবীন্দ্রচিত্রকলায় লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, রেখাচিত্র ও বিভিন্ন রঙের ব্যবহার। খয়েরী রঙের ব্যবহার বেশি করা হয়েছে। তবে সবুজ ও নীল রঙের ব্যবহার নেই বললেই চলে। কালি ও কলমে আঁকা বেশ কিছু ছবি লিনিয়ার রেখায় ফুটে উঠেছে। তাঁর চিত্রকলায় অপরূপকে সন্ধানের কোন আকুলতা নেই। আছে শুধু রূপকে অপরূপ করার সাধনা। সৃজনশীলতা প্রকাশের যতগুলো মাধ্যম রয়েছে তার মধ্যে চিত্রকর্ম একটি অন্যতম মাধ্যম। বৈষয়িক জীবনে রবি ঠাকুরের মনে যে ভাবাবেগ, আবেগ,উদ্দীপনা, হৃদয়-বেদনা, শক্তির উপলব্ধি ও সৌন্দর্যবোধের উদয় হতো তা তাঁর চিত্রে প্রতিফলিত হতো। চিত্রকলায় কবির প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও তিনি চিত্র অঙ্কনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। চার খণ্ডের ‘‘রবীন্দ্র চিত্রাবলী’’-তে চিত্রের অনুলিপি রয়েছে ২ হাজার ৬৩টি। বেশিরভাগ ছবি আঁকা হয়েছে ১৯২৪ থেকে ১৯৪১ এর মধ্যে। এসব ছবিকে আমরা এখন ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা’ বলে থাকি। আঁকা ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি। ‘পূরবী’ ছবিটি তাঁর আঁকা অন্যতম ছবি। ‘‘মা ও ছেলে’’ শীর্ষক একটি ছবিতে দেখা যায় একজন মধ্যবয়সী মা তার শিশু ছেলেকে কোলে নিয়ে আসীন। হালকা বাদামী শাড়ি পরিহিত মা-র কোলে পরিধেয় বিহীন শিশুর অবস্থান আর মায়ের দৃষ্টি যেন দারিদ্রের প্রকাশ। প্রাণীসদৃশ ছবিগুলো তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ সেই তাঁর অনুজ্জ্বল রংয়ের মুন্সীয়ানা ব্যবহারে। গাঢ় কালো, বাদামী, লাল আর হলুদাভ রংয়ে তাঁর ক্যানভাস হয়ে উঠেছে মূর্ত। তাঁর অঙ্কিত ফর্মগুলোতে নেই রংঙের প্রচণ্ডতা। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি প্রকৃতির বিচিত্র রূপ এঁকেছেন। তবে রং তাঁর ছবিতে প্রাণময়তা খুব আনেনি বরং হয়েছে বিষন্নতার প্রতিমূর্তি। নারী রবীন্দ্রনাথের অন্যতম বিষয় ছিল। কখনও যোগাসনে, কখনও যুগলে, কখনও সুশ্রীতায়, কখনো উপবেশনে নানা আসনে নারী উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর ক্যানভাসে। উজ্জ্বল লাল রং, সাদা কালো, ধূসর, কালচে বাদামী রংয়ে নানা বৈচিত্রে নারী রবীন্দ্র চিত্রকলার উপজীব্য হয়েছে। ‘‘নিসর্গ’’ শীর্ষক তাঁর কাগজে কালি ও জলরং এ করা ছবিটি অনবদ্য হয়েছে। ঘন আধাঁর, গাছপালার, মাঝে কুটিরের আভাস, আর বন বনানীর ফাঁকে সাদা আকাশ সত্যিই নিসর্গের মাদকতা প্রকাশ করে।
জাপান ভ্রমণের পর শিল্পী মুকুল দে-কে নিয়ে ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। বলা দরকার যে, ১৯১২ থেকেই রবীন্দ্রনাথ বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে শিল্পীদের সঙ্গে নিতে থাকেন। কাশীনাথ দেবল, মুকুলচন্দ্র দে, নন্দলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ কর ও ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মা প্রমুখ তাঁর সফরসঙ্গী হন। ভারতীয় শিল্পের বিকাশকে গতিশীল করতে তাঁর এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। ১৯১২ সালে বিচিত্রা সভা প্রতিষ্ঠা ও ১৯১৬ সালে প্রথম জাপান ভ্রমণের ফলে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ভারতের শিল্পকলা বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে আরম্ভ করেন। প্যারিসে নিজের ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হবার আগে রবীন্দ্রনাথ উইলিয়াম রোথেরস্টাইনকে (১৯৩০) লেখেন, “My pictures certainly possess psychological interest being products of matured figures and untrained mind. I am sure they do not reveal a strangeness born of my utter inexperience and individual limitations.” চিঠির ভাষা থেকে বোঝা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ অভিজ্ঞতার ও একাডেমিক শিক্ষার অভাবের কথা স্বীকার করেছেন। ফলে, চিত্রপ্রদর্শনীর পূর্বে কিছুটা অস্বস্তি হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে (১৯৮৬ সালে) লন্ডনের বারবিকান গ্যালারিতে ঘটা করে তাঁর চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় হয়।
তিনি হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়ে ছবি এঁকেছেন। ভাঙা কলম-পেন্সিল, বাদ-দেওয়া কাগজ নিয়েই তৈরি করেছেন নতুন ছবি। তিনি ব্যবহার করতেন পেলিক্যান কালি। ভারতীয় মিথভিত্তিক এবং মুঘল চিত্রকলার সুদীর্ঘ অচলায়তন ভেঙে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব ঢঙে ছবি আঁকতে শুরু করেন। ভারতবর্ষের চিত্রকলার হাজার বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যবোধ থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে উপমহাদেশের চিত্রজগতে নতুন এক ধারার সৃষ্টি করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ছবি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবানুগ অনুকরণ অথবা চেনা শৈল্পিক ফর্মের অনুসরণ নয়। নিসর্গ, নারী-পুরুষ বা পশুপাখি যাই হোক তা কোনও ভাবেই বাস্তবের দাসত্ব করেনি। শুধু পশ্চিমী নয়, প্রাচ্যের চীন-জাপানের শিল্প, পেরু ও উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার ‘প্রিমিটিভ আর্ট’-এ মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। শিলাইদহ বা শাহজাদপুরে কবির আঁকা চিত্রকর্ম দেখা যাবে। কলকাতার জোড়াসাঁকো বা শান্তিনিকেতনে এ শিল্পকর্ম লক্ষ্য করা যাবে। প্রতিকৃতি, নারীদৃশ্য, বৃক্ষরাজি, বিমূর্ত ইত্যাদি ছবি শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িতে শোভা পাচ্ছে! শান্তিনিকেতনে কবির শিল্পকর্মের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। রবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে ভারত সরকার কবির চিত্রকর্ম নিয়ে বই প্রকাশ করেছে।
রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ কাজ এখনও প্রকাশিত হয়নি। সব কাজ প্রকাশিত হলে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। হয়তো ভবিষ্যতে অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’-ই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবেন। কারণ তাঁর এ দিকটিই এখন পর্যন্ত তেমন সুবিস্তৃতভাবে আলোচনায় আসেনি। প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম নিয়ে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মনে করা হয়েছে যে, তাঁর চিত্রকর্মগুলো শখের বশে বা তাঁর খেয়ালের প্রকাশ। কিন্তু কিছুদিন পরেই সমালোচকদের চিত্ত জয় করতে সক্ষম হয়। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পান। যত দিন অতিবাহিত হচ্ছে ততই রবীন্দ্রচিত্রকলার সমীহ ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাড়ছে আলোচনা, সমালোচনা। এখানেই রবীন্দ্র চিত্রকলা-র সফলতা।
সহায়কসূত্র :
১. রবীন্দ্রনাথের চিত্রচর্চা : একটি সংক্ষিপ্ত আখ্যান, গৌতম ধর;
২. রূপদর্শিকা, অসিতকুমার হালদার;
৩. রবীন্দ্র চিত্রকলা, রবীন্দ্র সাহিত্যের পটভ‚মিকা, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ;
৪. চিত্রকলা নিয়ে বিভিন্ন দৈনিক/ম্যাগের প্রবন্ধ;
৫. রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন চিত্রকর্ম।
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট