| 27 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: রক্ত । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

রাজেশ্বরী। একটু পুরোনো নাম ঠিকই, কিন্তু মেয়ের রূপ দেখলে লোকে মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হয়, এই মেয়েকে এই নামেই মানায় বটে। এক ঢাল ভ্রমরকৃষ্ণ চুল, দুধে আলতা রঙ, আয়ত দীঘল চোখ দুটি দেখলে কেমন যেন সম্ভ্রম জাগে, দেহের গড়নটি আশ্চর্য সুন্দর, হাতের শুধু আঙুল দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় কেন চাঁপা ফুলের সঙ্গে সাহিত্যে আঙুলের তুলনা করা হত! এমনকী ক্লাসে যে যখন রাজেশ্বরী-র পাশে বসত, একটা অদ্ভুত সৌরভ পেত। সবাই ওর পাশে বসার জন্য হুড়োহুড়ি করত। সবকটা মেয়ে! দিদিমণিরাও কেমন যেন নরম সুরে কথা বলতেন ওর সঙ্গে । শুধু আমি ছাড়া স্কুল শুদ্ধু সবাই, রাস্তাঘাটের সবাই ওকে দেখলে কেমন নুয়ে পড়ত। আমার অসহ্য লাগত। আমি পড়াশোনায় রীতিমতো ভালো ছিলাম । দেখতেও মন্দ ছিলাম না। কিন্তু রাজেশ্বরী-কে নিয়ে এই বাড়াবাড়িটা কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না । বিশেষ করে, লেখাপড়ায় ও একেবারে চৌকশ ছিল না । খেলাধুলোতেও তথৈবচ! বেশি কথাও বলতো না। আপন মনেই থাকত । এক এক দিন শুধু স্কুলে ঢুকত মুখটা লাল করে, আমার ক্লাসের অন্য মেয়েগুলো ওর দিকে তাকিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ত ওর হাতের ওপর, ওর মুঠো করে ধরে রাখা একটা কাগজের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে হি হি করে হাসতে আরম্ভ করত। আমি কখনো ওরকম কাগজ না পেলেও বুঝতাম ওগুলো এক একটা প্রেম পত্র। মেয়েগুলোর ছিটকে আশা কথায় বোঝা যেত প্রায় সবেতেই রাজেশ্বরী-র রূপের, দেহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা থাকত, আর ওকে না পেলে সেই প্রেমিকপ্রবরের কী ভয়ানক দশা হবে, তার ফিরিস্তি। আমি বাইরে পাত্তা না দিলে কি হবে, ভেতরটা জ্বলে যেত একেবারে! মনে মনে ভাবতাম, গুণের কদর ছেলেরা করতেই জানে না, আকাট মুখ্যু একেকটা! শুধু শরীর নিয়ে কারবার!!!

এমনি করেই স্কুলের দিনগুলো কেটে গেল। কলেজে ভর্তি হলাম। কলকাতায়। ও, বলা হয় নি। আমি বর্ধমানের মেয়ে। লেডি ব্রেবোর্নে পড়ার শখ ছিল বহু দিনের। ইতিহাস নিয়ে । কলেজ হস্টেলেই শুরু হল নতুন জীবন । বর্ধমান যতোই এখন শহর হয়ে উঠুক না কেন, কলকাতা কলকাতাই। শনি রবিবার করে বাড়ি ফেরাটা ক্রমশ কমতে শুরু করল। কারণ শনি রবি মানেই অকাদেমির নাটক। নন্দনে আড্ডা । সেসব ছেড়ে কে যায় বর্ধমান! আর হ্যাঁ, বলা হয় নি, কলকাতায় আসার মাসখানেক পরেই নাটক দেখতে গিয়ে সৃজিতের সঙ্গে আলাপ। দিনে চাকরি, সন্ধ্যা মানেই রিহার্সাল বা নতুন নাটক নিয়ে চিন্তা অথবা শো। ওর এই দিনলিপির মধ্যে আমি ঢুকে পড়লাম প্রথমে ছুঁচ হয়ে। সেই ছিদ্র দেখতে দেখতে বড় হতে লাগল! সৃজিত হাসতে হাসতে বলত, আমি নাকি ওর সর্বনাশ করেছি!! এত সবের মাঝে রাজেশ্বরীর কথা ভুলেই গেছিলাম!

এইবার বর্ধমানে যেতে একথা সে কথার মাঝেই মা হঠাৎ বলল, ” হ্যাঁ রে, রাজেশ্বরী-র কথা শুনেছিস”!!!
“কি? বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে নিশ্চয়ই! তাই জন্য আবার আমাকে বলতে এসো না ওসব বিয়ে ফিয়ের কথা, আগেই বলে দিচ্ছি” । মা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল! “না রে। বিয়ে না। বরং বিয়ের চেষ্টা চলছে। আর একটার পর একটা সম্বন্ধ ভেঙে যাচ্ছে, আর ওদের বাড়ির ব্যাপার তো জানিসই । মেয়েদের বেলা বিয়ে ছাড়া আর কিছুই বোঝে না “।
আমি তো অবাক! মাকে আর কিছু ঘাঁটালাম না। বিকেলে পুরোনো ডাইরি দেখে মণিদীপাকে ফোন করলাম। ও ছিল রাজেশ্বরী-র অন্ধ ভক্ত। কত সময় যে হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে দিদিমণিদের কাছে ধমক খেয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই! আমি জিজ্ঞেস করার আগেই ও হড়বড়িয়ে বলে উঠল, “এই, রাজেশ্বরী-র কথা শুনেছিস? ছি ছি ! কী কাণ্ড!! তাই আমরা যখন পেট ব্যথা, ব্লিডিং এ সব নিয়ে কথা বলতাম, ও চুপ করে থাকত! বুঝব কি করে?? ভেতরে ভেতরে এই ব্যাপার”!
আমার মাথা গুলিয়ে গেল! “কী বলছিস!! তুই ঠিক করে বললে বল্। নয়ত ছাড়!”
“আরে বলছি বলছি। শোন, রাজেশ্বরী-র না হয় না”!
“হয় না মানে! কী হয় না”!?
“উফ্, তুই কি গাধা হয়ে গেছিস পড়তে পড়তে! ওর পিরিয়ড হয় না! বুঝলি? জীবনে কখনো মা হতে পারবে না। ও তো মেয়েই নয় পুরো। হি হি! এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল সবার কাছে। তারপর অনিরুদ্ধর সঙ্গে প্রেম শুরু হল। তুই কলকাতায় চলে যাওয়ার পর পরই । মাস ছয়েক তুমুল প্রেম চলল। তারপর অনিরুদ্ধর বাড়ি থেকে বিয়ের কথাবার্তা বলতে ওর বাবা মা যাবেন বলে সব ঠিক; তার আগের দিন বোকার মত ও অনিরুদ্ধকে এই কথাটা বলে দিলো! ভাব একবার! কী বাঁচা বেঁচে গেল অনিরুদ্ধ! আর যায় ওর ধারেকাছে! ওর থেকেই জানাজানি হয়ে গেল ব্যাপারটা! এখন যত দূরেই সম্বন্ধ করার চেষ্টা করে ওরা, ঠিক খবর পৌঁছে যায় আর সম্বন্ধ ভেঙে যায় । কেউ জেনেশুনে এমন মেয়ে ঘরে আনে নাকি! সব গুমোর ভেঙে গেছে ওর!”
“কী রে কথা বল, এই তিথি, হ্যালো, হ্যালো”!
মণিদীপার কথা আর কানে যাচ্ছিল না আমার। ফোন রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। সবার আগে মনে হল রাজেশ্বরী-র তো কোনো অহঙ্কার ছিল না । ওর চুপ থাকাটা ছোটবেলায় অহঙ্কার ভাবতাম ঠিকই। এখন বুঝি ওর ধরণটাই ওইরকম ছিল, অন্তর্মুখী । আর পিরিয়ড হয় না বলে ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে গেল! তাহলে আদৌ তো ভালোবাসা ছিলোই না! শুধু ওর রূপের প্রতি শস্তা আকর্ষণ মাত্র! ভালো বাসলে এই কারণে কেউ ছেড়ে যায়! কত রকম চিকিৎসা আছে! তাতেও না হলে দত্তক নাও! আর মা হতে না পারলে একটি মেয়ে কি মূল্যহীন হয়ে যায়! আর শুধু ছেড়ে যাওয়া নয়, এই কথাটাকে রাষ্ট্র করা! আবার অন্য পরিবারে দায়িত্ব নিয়ে সেই ইনফরমেশন দিয়ে আসা! এরা কী মানুষ!

অবাক হয়ে অনুভব করলাম রাজেশ্বরী-র প্রতি মনটা কোমলতায় ভরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। আর সঙ্গে শ্রদ্ধা। ওই নরম চুপচাপ মেয়েটি কতখানি সাহস জুগিয়ে এই সত্যিটা ওই ইতর ছেলেটাকে বলেছিল! ভাবা যায়! কত ছেলের কত সমস্যা থাকে! ট্রেনে যাতায়াত করতে করতে বিজ্ঞাপনে দেখতাম। এখন তো বন্ধুদের থেকেই শুনি। ক্ষুদ্র বা বক্র লিঙ্গ, শীঘ্র পতন, বিবাহ-পূর্ব বদভ্যাসের জন্য বীর্যহ্রাস, নিষ্ক্রিয় শুক্রাণু এমন কত শত! ক’টা ছেলে বিয়ের আগে বলে একথা ভাবী বধূকে! এমনকী কজন বিয়ের পরেও ছেলেমেয়ে না হলে test করাতে রাজী হয়! সব মেয়েদের ঘাড়ে! এমনকী, এও শুনেছি ও, যে মেয়েটির রেসাল্টে কোনো ত্রুটি না থাকার পরেও ছেলেটি পরীক্ষা করাতে রাজী হয় নি! এক একটা এমন ছেলের জন্য কত যুগ ধরে মেয়েদের বাঁজা বন্ধ্যা আঁটকুঁড়ে উপাধিলাভ হয়েছে। এই একটা কারণ দেখিয়ে ওই গর্ভস্রাবগুলো একের পর এক বিয়েও করে গেছে একটা সময় পর্যন্ত !!! কিন্তু এখন, এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও মেয়েদের এই অবস্থা!!!! আমি আর ভাবতে পারছিলাম না!

পর দিন সকালে উঠেই মণিদীপাকে ফোন করে বললাম, “রাজেশ্বরী-র নম্বরটা থাকলে দে”। ও আবার হি হি করে হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এক ধমকে থামিয়ে দিলাম। খানিক থতমত খেয়ে একটা নম্বর দিয়ে বলল, “রাজেশ্বরীর ফোন মাসীর কাছেই থাকে”। ফোনটা কেটে ওই নম্বরে ফোন লাগালাম। তিন চারবার রিঙ হয়ে কেটে যাওয়ার পর রাজেশ্বরী-র মা ফোন ধরলেন। কেমন একটা বিধ্বস্ত হার মানা গলা। আমি বললাম, “মাসি, আমি তিথি, রাজেশ্বরী-র সঙ্গে স্কুলে পড়তাম । মনে আছে তোমার”?
“ও! তিথি! মনে আছে বইকী! এত ভালো মেয়ে তুমি! রাজেশ্বরী তোমার কথা খুব বলত! বলো, কেমন আছ”?
একটু থমকে গেলাম । রাজেশ্বরী-কে তো একদম পছন্দ করতাম না । ও কি সেটা টের পেতো না? তাও আমার কথা বলত!
একটু চুপ থেকে বললাম, “ওর সব কথা শুনেছি । তোমরা ওকে ডাক্তার দেখিয়েছ? দরকার হলে কলকাতা নিয়ে চলো। আমি থাকব তোমাদের সঙ্গে! প্লিজ মাসী”!
ওপ্রান্তের গলার সুরটা পাল্টে গেল মুহূর্তে । একটা তীব্র ফিসফিসে গলা যেন, “আমার মেয়ের এই নোংরা কথাটা ডাক্তারকে বলব!!! এটা ওর পাপ। ওর পাপের শাস্তি আমাদের সবাইকে পেতে হচ্ছে”!
“পাপ? মাসী, পাপ? কিসের পাপ? এটা একটা শারীরিক সমস্যা! ছেলেদেরও এমন কত সমস্যা থাকে! অনেক সময় সারে, আবার সারেও না। তাতে তো ওদের জীবন নষ্ট হয় না । বিয়েও হয় দিব্যি! মাসী, প্লিজ প্লিজ”!!! আমার কথার মধ্যেই কখন ওপ্রান্ত নীরব হয়ে গেছে, বুঝতেই পারি নি। আমার গলা বোধহয় একটু জোরে হয়ে গেছিল । কারণ পর্দা সরিয়ে মা ঢুকে এল ঘরে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মেয়েদের লড়াইটা এখনও সেই আগের জায়গাতেই আছে রে! তাছাড়া কুসংস্কার আর সামাজিক চাপ থেকে বেরোনো সহজ নয়! রামচন্দ্র পেরেছিলেন সমাজের চাপ সহ্য করে সীতাকে কাছে রাখতে? সেই চাপ এখনও সমান প্রবল রে!! যতোই চেষ্টা করিস, কিছু হওয়ার নয় রে! যদি না কেউ দয়া করে সব জেনেও ওকে বিয়ে করে”!
দয়া! যার থেকে এক ঝলক হাসি উপহার পেলে ছেলেগুলো বর্তে যেত, তাকে এখন দয়া নিয়ে বিয়ে করতে হবে!!! কিন্তু সত্যি তো বাইরে থেকে আমার কি বা করার আছে! পর দিনই ফিরে আসতে হল। সামনে পরীক্ষা । মন থেকে সব কিছু জোর করে সরিয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম । ভালো রেসাল্ট করতেই হবে। এমনকী সৃজিতের সঙ্গেও খানিক দূরত্ব তৈরি করলাম । ছেলেদের ওপর কেমন বিতৃষ্ণা এসে গেছিল। যদিও সৃজিত তা বোঝে নি। ও জানত আমি একটু পড়াপাগল টাইপ। সামনে পরীক্ষা বলে চুপচাপ বিরহ মেনে নিল। যেদিন পরীক্ষা শেষ হল, মায়ের ফোন পেলাম ।
“বুড়বুড়ি, রাজেশ্বরী-র বিয়ে ঠিক হয়েছে রে!”
“সত্যি”!!!
“হ্যাঁ, কিন্তু ছেলেটি, মানে লোকটির বয়স অনেকটাই বেশি রে। তোদের ডবল, প্রায় পঞ্চান্ন “!
“মানে?? কী বলছ?? এত বড়!! আচ্ছা, হয়ত তাই খানিক ম্যাচিওরড । এসব ফালতু বিষয় নিয়ে ভাবে নি। হয়ত সত্যি ভালোবাসবে ওকে। আজকাল কোনো দিক দিয়েই বয়সটা আর ফ্যাক্টর নয় গো মা “।
“হয়ত। তাই হোক রে! মেয়েটা সুখী হোক! ওর বাড়িটাও পেয়েছে বটে! অন্য কিছু শেখালো না! বসিয়ে রেখে দিলো এতগুলো বছর! যাক্ গে । এখন সব ঠিক হলেই হয়”।
সৃজিতকে ফোন করলাম । হইহই করা সেই গলাটা, “কী ব্রহ্মবাদিনী! আমাকে তো ভুলেই ছিলে! তা সাধারণ ছাপোষা মানুষকে এমন বিদুষী কন্যা মনে রাখবেই বা কেন”!!
“আহা! সৃজিত, ভালো করেই জানো তুমি সাধারণ নও, আমিও কিছু বিদুষী নই। ওসব ছাড়ো, বিকেলে আসছি কিন্তু নন্দনে। আসবে তো”?


আরো পড়ুন: উপন্যাস: বেহুলার বাসর । প্রশান্ত মৃধা


আবার শুরু হল জমিয়ে আড্ডা পড়াশোনা নাটক দেখা। দিনগুলো হু হু করে কেটে যাচ্ছিল। রেসাল্ট বেরোল। দেখা গেল কলেজে তো টপ করেইছি, জানতে পারলাম ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি। কলেজে, বন্ধুদের মধ্যে হইহই পড়ে গেল। তারপর যেদিন যাদবপুরে নাম বেরোল,স্বভাবতই সবার আগে, সেদিন সব ধরে বসল, নাকি বিরাট পার্টি মাস্ট । ঠিক হল বর্ধমান থেকে একবার ঘুরে এসেই পার্টি। সৃজিত তো পার্টি হবে, এই আনন্দেই পাগল হয়ে গেল একেবারে! বন্ধুদের সামনেই চুমুটুমু খেয়ে সে একেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড! সব তো হেসে গড়িয়ে যাচ্ছিল ওর ব্যাপারস্যাপার দেখে!! আমি বাইরে একটু লজ্জা দেখালেও মনে মনে দারুণ আনন্দ পাচ্ছিলাম অবশ্য! কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, যেদিন সৃজিত এমন পাগলামি করল, সেই দিনই অনেক দিন পর হঠাৎ রাজেশ্বরীর কথা মনে পড়ল। মনে হল, আরে, মাও তো আর কোনো কথা বলে নি ওকে নিয়ে!! আমিও জিজ্ঞাসা করিনি অবশ্য । মনে হতেই ফোন লাগালাম মাকে।
“মা, রাজেশ্বরীর খবর কি? সেই বিয়ের পর আর তো কিছু জানালে না”!
মা চুপ করে রইল। মায়ের নীরবতা দেখে আমি আরোও অধৈর্য হয়ে পড়লাম।
“কি গো!!! বলো”!!!
“তোর পরীক্ষা চলছিল বলে প্রথমে বলিনি কিছু। তারপরে তুই এত আনন্দ নিয়ে ফোন করতিস, যে কিছুই বলতে পারি নি “।
“তুমি বলবে??? এবার রাগ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু”!
“শোন, মাথা ঠাণ্ডা রাখ্। বলছি। বিয়ের এক মাসের মধ্যে ওর বর ওকে বাড়িতে ফেরত দিয়ে যায় । ও নাকি অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে ওকে নিয়ে গিয়ে । অনেক পরীক্ষা করিয়েছে। সব ডাক্তাররা বলেছেন ও কখনো কোনো ভাবেই মা হতে পারবে না । ওর এই ত্রুটি চিকিৎসার বাইরে। ওর বর ডিভোর্স ফাইল করেছে। শুনেছি রাজেশ্বরীর মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে । ও চুপচাপ ছিলোই, এখন আরোও চুপচাপ হয়ে গেছে । শুধু মাঝেমধ্যে হিস্টিরিক হয়ে যায় আর নাকি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে সামনে যাকে পায় তাকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে। আর নিজের জামাকাপড় টেনে টেনে ছিঁড়তে থাকে, যতক্ষণ না ওর বাবা ওকে টেনে নিয়ে যায়। তারপর অনেকক্ষণ নাকি কান্নার আওয়াজ আসে। তারপর আবার নিঃশব্দ হয়ে যায় বাড়িটা। ওর বাবা মাও যেন কেমন হয়ে গেছেন । ওর দাদা প্রকাশ তো কবেই আলাদা হয়ে গেছে। এখন ওরা তিনজন ভূতের মত ওই বাড়িতে বেঁচে আছে কোনরকমে। এর থেকে বোধহয় বিয়েটা না হলেই ভালো হত রে”।

মায়ের কথাগুলো কেমন যেন মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে বাজতে লাগল। ‘এর চেয়ে বোধহয় বিয়েটা না হলেই ভালো হত রে’! আমি কেমন অবশ হাতে ফোন ঘোরালাম। সৃজিতকে। অবাক সৃজিতকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম “এখুনি একবার আসতে পারবে? যা বলার, এলে বলব”।
“আমাকে পনেরো মিনিট দাও দেবী। পক্ষীরাজে চড়ে এক্ষুনি আসছি তোমার কাছে “।
বি এ র রেসাল্ট বেরোনোর পর দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলে একটা বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকি। বন্ধুবান্ধবেরাই দেখে দিয়েছিল। আর যাদবপুর থেকেই এম এ করার ইচ্ছে ছিল বলে আমিও চাইছিলাম কাছাকাছি থাকতে। এখানে শর্ত একটাই, কোনো ছেলে বন্ধুকে রাত আটটার পর ঘরে ঢোকানো যাবে না। এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা । তাই নিচে নেমে দাঁড়ালাম। ঠিক বারো মিনিটের মধ্যে ঢুকল সৃজিতের পক্ষীরাজ । লাফিয়ে নামল ছেলেটা, হেলমেট খুলতে খুলতেই এগিয়ে এল আমার দিকে, “কী? আমার বিরহ আর আর তিলেক সহ্য করতে পারছ না তো! তাই এত রাতে তলব”! এই বলে হাসতে হাসতে আমার দিকে হাত বাড়াতেই আমি শক্ত গলায় বললাম “আমার পিরিয়ড হয় না সৃজিত”।
“ম্ মানে! কী বলছ”!
“কেন? পিরিয়ড বোঝ না? মাসিক মাসিক! ওই প্রতি মাসে রক্তপাত হয় না আমার! আমি কখনো মা হতে পারব না! এবার বলো, আমাকে বিয়ে করবে? নাকি পালাবে”??
আমার গলাটা বোধহয় খানিক চড়ে গেছিল! ও কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল ওইখানেই। আমার গলায় মুখ গুঁজে বলল, “পাগল মেয়ে একটা! আমি যে তোকে কতখানি ভালোবাসি, তুই বুঝিস নি! তোর কী হয় না হয়, তুই মা হতে পারবি কিনা, এসব আমাদের মধ্যে আসছে কেন! বরং তোর যদি এ নিয়ে ভাবনা থাকে, তো চল ডাক্তারের কাছে! আমি তো তোকে ভালোবেসেছি রে! তোর সব কিছু, তোর সমস্যাগুলোও আমারও!! পাগলী, তুই সব মিলিয়েই আমার”!!
সৃজিতের কথা শুনতে শুনতে রাজেশ্বরীর জন্য বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগল! সৃজিতকে শক্ত করে ধরে আকুল হয়ে আমি কাঁদতে থাকলাম! কাঁদতেই থাকলাম!

রাজেশ্বরী। নামটা স্বভাবতই কাল্পনিক। মূল ঘটনাটি এক বন্ধুর থেকে জেনে স্তম্ভিত হলাম। প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ হলেও মনে হল এমন ঘটনা তো এখানেও হচ্ছে । জানতে পারি না, এই যা!

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত