| 27 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: মাছগুলো সাঁতার জানে না । সাদিয়া সুলতানা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

ভদ্রমহিলাকে দেখে আমরা থেমে যাই। তাকে আমরা রাফির মা বলে ডাকি। তিনি আমাদের কাছে নিজেকে পাপড়ি বলে পরিচয় দেন। বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকের একটা করে নাম আছে আপা। আসুন, আমরা পরস্পরকে সেইসব নামে ডাকি।’ তার কথা আমরা আমলে নিই না। আমরা জানি বড় বড় বুলি আউড়ে লাভ নেই, দিনের ভেতরে কমপক্ষে একশবার নিজেদেরকে আমাদের ঝর্ণার মা, শান্তার মা, কোয়েলের মা, পুলিশ ভাবী, বাড়িওয়ালা ভাবী, দোতলার ভাবী, মুনতাহার মা ইত্যাদি নামে পরিচিত হতে হয়।

আমাদের মধ্যে ফরিদ ভাবীর কোনো বাচ্চা-কাচ্চা না থাকায় তাকে আমরা ফরিদ ভাবী বলে সম্বোধন করি। ভুল করে আমরা কেউ তাকে ফরিদ আপা বলে সম্বোধন করে ফেললে আমাদের মধ্যে হাসির হুল্লোড় পড়ে যায়। তবে রাফি-র মাকে দেখলে আমরা চুপ হয়ে যাই। ভদ্রমহিলা বিশেষ কোনো মানুষ না যে তাকে দেখে আমাদের চুপ হয়ে যেতে হবে। অবশ্য আমাদের আড্ডার মাঝখানে অনাহুতের মতো আড্ডার চুম্বক বিষয়বস্তুর মানুষটি ঢুকে পড়লে আমরা এমনিভাবে চুপ হয়ে যাই, ডাঙায় থাকা মাছের মতো নিষ্প্রাণ চাহনিতে একে অন্যের দিকে নৈর্ব্যক্তিক ইশারা করি।

এমনিতে আমাদের আড্ডা কল্লোলমুখর থাকে। ইউটিউবে হায়াত মির্জার রেসিপি, শেনাজের বিউটি টিপস, পুলিশ ভাবী আর ঝর্ণার মায়ের অনলাইন পেইজের শাড়ি-কাপড়ের দর-দাম, বাচ্চাদের জে.এস.সি, পি.এস.সির রেজাল্ট নিয়ে গরম গরম কথার ধোঁয়ার উষ্ণতায় বুঁদ হতে হতে কখনো কখনো মুনতাহার বাবা রেজাউল আনামের মেয়েদের দেখলেই ছোঁকছোঁক স্বভাবের গল্প চলে আসে। আর ঠিক তখনই অপ্রত্যাশিতভাবে মুনতাহার মা অর্থাৎ রেজাউল ভাবী আড্ডায় ঢুকে পড়লে আমাদের চুপ হয়ে যেতে হয়।

এই এখন যেমন আমরা রাফির মাকে দেখে চুপ হয়ে গেছি।

রাফি-র বাবা ইশতিয়াক হায়াত পেশায় বিচারক। রোজ সকালে উর্দি পরা লোক এসে সালাম ঠুকে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়, সন্ধ্যায় একইভাবে সালাম ঠুকে তাকে বাড়ির গেটে নামিয়ে দেয়। এই দুই সময়ে আমরা দুএকবার জানালার ফাঁকফোকর গলে তাকে দেখতে পেলেও দিনের অন্য কোনো ভাগে বা ছুটির দিনেও তাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেখি না। ছুটির দিনে দুজন পিয়ন এসে ঢাউস ব্যাগে বাজারসদাই করে দিয়ে যায়। রাফিকে স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজ ওরাই করে। রাফির মা কিংবা বাবা ছেলেকে নিয়ে কখনো স্কুলে বা বাড়ির বাইরে যান না। এই বাড়িতে আমরা কোনো অতিথিকে আসতেও দেখি না।

অন্তঃপুরবাসী এই ভদ্রলোকের প্রতি বরাবর আমাদের কম-বেশি কৌতূহল থাকে। তবে মাঝেমাঝে রাফির বাবার চেয়ে রাফির মা আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। এই যেমন আজ আড্ডার শুরুতে কোয়েলের মা আমাদের একটা চমকপ্রদ খবর দিলেন। রাফির মা সকালে তার প্রোফাইল পিকচারে একটা বিড়ালের ছবি দিয়েছেন। যার চোখদুটো সবুজ, মাথাভর্তি খাড়া খাড়া সাদা লোম আর শরীরের বর্ণ কালো। গলার বেল্টে ছোট্ট একটা ঘন্টা বাঁধা। রাফির মা রোজই তার প্রোফাইলে নতুন নতুন ছবি দেন। যেগুলোতে নানা ভঙ্গিমার বিড়াল দেখা যায়। পুলিশ ভাবীর ধারণা বিচারক ভদ্রলোক স্ত্রীকে মোটেও সময় দেন না। তাই রাফির মা দিনরাত বিড়ালদের নিয়ে পড়ে থাকেন। আর বিড়ালদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ভদ্রমহিলার আচরণই বিড়ালের মতো হয়ে গেছে।

সেই গল্প পরে বলছি। আগে কোয়েলের মায়ের কথা বলে নিই। কোয়েলের মা না থাকলে আমাদের আড্ডা জমেই না। আজ অবশ্য কোয়েলের মা একটু দেরিতে এসেছেন। ভাবীর বাসায় বিনা নোটিশে শ্বশুর বাড়ির অনেক মেহমান এসেছিল। তবে দেরিতে এলে কী হবে, কোয়েলের মা এসেই মুনতাহার মায়ের সঙ্গে বেশ শীতল একটা কথোপকথন সেরে ফেলেছেন।

মুনতাহার মা আমাদের মধ্যে একমাত্র কর্মজীবী মানুষ। আমরা বুঝতে পারি এ নিয়ে মহিলার অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। আমাদের মাঝে তার উপস্থিতি আমরা তেমন পছন্দ করি না। তবু তিনি হঠাৎ হঠাৎ আমাদের আড্ডাতে সামিল হন।

মাঝেমাঝে কোয়েলের মা তাকে চেপে ধরলে আমরা বিনা টিকেটে দারুণ একটা মঞ্চনাটক দেখে ফেলি। দুজনের কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। আজও তেমনটি হয়েছে। একজন আরেকজনকে কথা দিয়ে কোণঠাসা করেছে আর আমরা আশেপাশে দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি হেসেছি। আজ আক্রমণ শুরু করেছিলেন কোয়েলের মা। ব্যস আর যায় কোথায়! এখনো তাদের মধ্যকার ঝড়ের সেই শোঁ শোঁ শব্দ আমাদের কানে বাজছে।

‘ভাবী, আপনার মতো চাকরি করি না একদিকে ভালো আছি। পুরোটা সময় সংসারে দিই।’

‘ঠিক ভাবী। আমি তো দুদিক সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাই। সংসারেও সময় দিতে হয়। অফিসেও। যদিও একঅর্থে আমিও হোমমেকার। দুটো চাকরি করি। আপনার মতো ঘরেও, বাইরেও।’

‘রান্না কে করে ভাবী?’

‘আমিই করি। একদিন রেঁধে দুদিন খাই। ভোরে ছয়টার দিকে উঠে করি। না পারলে রাতে করে রাখি।’

‘আপনার ভাই তো, একবেলার রান্না আরেক বেলাতে মুখেই তোলে না। আমারও ভালো লাগে না ভাবী।’

‘কদিন না খেতে পেলে ভাবী ঠিকই মুখে তুলবে। আমার জনও এমন ছিল। এখন এক সপ্তাহ আগের রান্না তরকারিও খায়।’

‘তারপরও ভাবী। ফ্রেশ খাওয়ার একটা ব্যাপার আছে না? বাচ্চাদের জন্যও ভালো।’

‘তা ঠিক ভাবী।’

‘তা আপনার বাচ্চাকে কোন কোচিং এ দিয়েছেন? সামনে তো ওর পি.এস.সি. পরীক্ষা।’

‘ওকে তো আমিই পড়াই ভাবী। অফিস থেকে এসে আর এনার্জি থাকে না। তবু কী করবো বলেন, ঘরে টিচার রেখে দেখেছি রেজাল্ট আরও খারাপ করে।’

‘আমার মেয়ের রেজাল্ট মাশাআল্লাহ ভালো। দুই জায়গায় কোচিং করতে নিয়ে যাই। চাকরি করলে এই এক সমস্যা ভাবী। বাচ্চাদের দিকে ঠিকমতো খেয়াল রাখা যায় না। সংসারেও না। আমার ঘরের কাজে কোনো ত্রুটি দেখতে পাবেন না। সারাদিনই পুরো মনোযোগ সংসারে। আমার বিছানার চাদর পর্যন্ত টান টান থাকে। ঘরের কোনো জিনিস এদিকসেদিক পাবেন না।’

‘বাহ। বেশ তো। আমি তো অফিস থেকে ফিরে হুড়মুড় করে সংসারের পেছনে লাগি। বাচ্চারা ঘর গোয়ালঘর করে রাখে। সব গুছিয়ে নিয়ে তবে আমার শান্তি। সিরিয়াল-টিরিয়াল দেখার সময় পাই না, অযথা গালগল্পেরও সময় নেই।’

‘তবে যাই বলেন ভাবী, আমরা লাখ টাকা কামাই না ঠিকই তবে এটা দাবী করে বলতে পারি চাকরিজীবী মায়েদের চেয়ে আমরা নিখুঁতভাবে সংসার করি।’

কোয়েলের মায়ের শেষ কথাটি মাটিতে পড়তে না পড়তেই মুনতাহার মা অসন্তুষ্ট চেহারায় আড্ডা ছেড়ে চলে গেছেন। এরপরেই রাফির মায়ের বিড়াল প্রসঙ্গটি আমাদের আড্ডায় ঢুকে পড়েছে।

৩.

রাফি-র মা বিড়ালচোখের মানুষ। তার চোখের মণিতে সবুজের আধিক্য এত বেশি যে দেখে চমকে যেতে হয়। ছোটোখাটো শারীরিক গড়নের ভদ্রমহিলার সঙ্গে তার স্বামী ইশতিয়াক হায়াতের শারীরিক গড়ন ও চেহারায় অদ্ভুতরকম মিল আছে। যদিও চোখের বিষয়ে মিল আছে কিনা সেই বিষয়টি আমাদের জানা নেই। কারণ ভদ্রলোককে কখনো আমরা সামনাসামনি দেখিনি।

বাড়িওয়ালা ভাবী বুদ্ধমতী, রসিকও। তার ভাষ্যমতে বিয়ের দশ বছর পর স্বামী-স্ত্রী উভয়ের চেহারাতেই আশ্চর্য ধরনের সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, আর তাদের চেহারা অনেকটা ভাইবোনের মতো হয়ে যায়। প্রথমদিন ভাবীর কথাটা আমরা হেসে উড়িয়ে দিলেও আজকাল আয়নার সামনে দাঁড়ালে কথাটার সত্যতা উপলব্ধি করি। যদিও আমরা এখনো কেউ কারও কাছে বিষয়টা স্বীকার করিনি।

আমরা আরও একটা বিষয় খেয়াল করেছি রাফির মায়ের চোখই কেবল বিড়ালের মতো না। তার চলাফেরাও বিড়ালের মতো শব্দহীন ও নরম। আমরা যখন সিঁড়িঘরে দাঁড়িয়ে গোটা তিন চার মাথা আলাপচারিতায় মত্ত থাকি তখন পেছন থেকে চুপিসারে রাফির মা এসে দাঁড়ান। আচমকা পিছু ফিরে তার জ্বলজ্বলে বিড়ালচোখ দেখে আমরা চমকে উঠি। নরম পায়ে চলাফেরা করলেও আমাদের মধ্যে ফেসবুকে একমাত্র তারই সরব উপস্থিতি থাকে।

ঝর্ণার মায়ের অনলাইনের শাড়ি-কাপড়ের বিজনেস ভাই বন্ধ করে দিয়েছেন। ভাই বলেন, এসবে মেতে থাকলে বাচ্চাদের পড়ালেখায় ক্ষতি হয়, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও থাকে। কিন্তু রাফির মা একেবারে অন্য ধাঁচের মানুষ। সারাদিনই ফেসবুকে থাকেন। এ নিয়ে কানাঘুষাও কম হয় না। ঠোঁটকাটা কোয়েলের মা সেদিন তো বলেই ফেলেছেন, ‘আপা সারাদিনই তো দেখি ফেসবুকে থাকেন, বাসায় সময় দেন কখন?’ প্রশ্ন শুনে বিড়ালের নরম স্বরে প্রতিউত্তর দিয়েছিলেন রাফির মা, ‘আপনি নিজে সারাদিন ফেসবুকে না থাকলে আমাকে দেখেন কী করে ছন্দা আপা?’ কোয়েলের মায়ের নাম যে ছন্দা তা সেদিন তিনি নিজেও শুনে চমকে উঠেছিলেন।

এই হলো আমাদের আড্ডার সবচেয়ে অনাকাঙিক্ষত সদস্য বিড়ালচোখী রাফির মা। যার অসম্ভব বিড়ালপ্রীতি রয়েছে। সামনে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলের জে.এস.সি. পরীক্ষা, অথচ রাফির চেয়ে বিড়ালের দিকেই তার বেশি মনোযোগ। আমরা মাঝেমাঝে খুব উৎকণ্ঠা নিয়ে এসব বিষয়ে আলাপ করি।

ঐ বাড়ির দরজা একটু ফাঁক হলেই ঘরের মেঝেতে, সোফাতে ছয়-সাতটি বড়-ছোট নানা আকৃতির বিড়াল দেখতে পাওয়া যায়। কিছুদিন পর পর বিড়াল পরিবারসহ তিনি লিফটে করে সাত তলার ছাদে ওঠেন। কখনো কখনো এদের সঙ্গে রোদে হুটোপুটি করেন, কখনো কখনো কোলে বসিয়ে শ্যাম্পুতে ফেনা তুলে রোদগরম পানিতে ওদের গোসল করান। ঐ বাড়ির বিড়ালগুলোও মুনিবের আদর খেয়ে খেয়ে একেবারে পেল্লাই হয়ে উঠেছে। এদিকে লিকলিকে গড়নের রাফিকে ভীষণ রোগগ্রস্ত দেখায়।


আরো পড়ুন: তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: আমার জন্ম । নাসরীন জাহান


৪.

বিড়ালের প্রসঙ্গ এলে যুক্তিসঙ্গতভাবে মাছের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। তাই রাফি-র মায়ের বাড়িতে গিয়ে আমরা তার বসার ঘরে ডাউস সাইজের অ্যাকুরিয়ামটি দেখে প্রথমে অবাক হইনি। সেই গল্পতে যাবার আগে সামাজিক সংসর্গবঞ্চিত এই পরিবারে আমাদের আমন্ত্রিত হবার শানে নজুলটি জানানো আবশ্যক। পুরো পরিকল্পনার পেছনে ছিলেন বাড়িওয়ালী ভাবী। আগেই বলেছি অল্পকথার মানুষ বাড়িওয়ালী ভাবী ভীষণ বুদ্ধিমতী। তার বাবা সিএসপি অফিসার, সাবেক আমলা। ভাবী আচার-আচরণে পারিবারিক গাম্ভীর্য আর তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা বিরাজমান।

কদিন ধরে রাফির মাকে আমরা কোনো আড্ডাতে পাইনি। বাড়িওয়ালি ভাবী গতকাল বিকালে আমাদের খবর দিয়ে রেখেছিলেন। রাফির মা যেহেতু কোনোদিন নিজে থেকে চা-নাস্তার দাওয়াত দেননি বা আমাদের বাড়িতে এটাসেটা পাঠাননি সেহেতু রান্নাবান্না সেরে হুট করে বেলা বারোটার দিকে ঐ বাড়িতে আমাদের দলেবলে ঢুকে পড়তে হবে।

কদিন ধরে ঐ বাড়ির কারও দেখা নেই। ইশতিয়াক হায়াতকেও গাড়ি নিতে আসছে না। এমনকি গত তিন দিন ধরে রাফি-র মায়ের ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে একই ছবি ঝুলছে। ছবিতে ছয়টি বিড়াল কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। ওদের জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি নাকি ভীষণ অস্বস্তিকর। যথারীতি এই খবরটি আমাদের দিয়েছেন কোয়েল ভাবী। আমাদের মধ্যে তিনিই ফেসবুকে খানিকটা সক্রিয়।

আমাদের সবার ফেসবুক আইডি নেই। এর মধ্যে শান্তার মায়ের আইডি তার স্বামী চালান। বুদ্ধিমতী বাড়িওয়ালি ভাবী যদিও আমাদের জানিয়েছেন তার এসব ফেসবুক-টেসবুক ভালো লাগে না কিন্তু আমাদের কাছে খবর আছে, বাড়িওয়ালা ভাইয়ের ফেসবুকের প্রতি বিপুল অসন্তুষ্টি রয়েছে। তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ফেসবুকে এক যুবকের সঙ্গে প্রেম করে আঠারো বছরের সংসার ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তারপর থেকে তিনি পরিবারের সদস্যদের ওপরে স্মার্টফোন ব্যবহারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।

আমাদের এই সাত তলা ভবনের মালিক শওকত আলী ভাই ঝানুলোক, বিরাট ব্যবসায়ী। কোয়েলের মায়ের কাছে শুনেছি শওকত ভাই নিয়মিত মদ খান। শুনে তো আমরা শিউরে উঠেছি। শান্তার মা ভয়ে বাড়িওয়ালার বাড়িমুখো হন না, ভাইয়ের হাত দিয়ে বাড়িভাড়ার টাকা পাঠান।

আমাদের এ বাসা সে বাসায় মাস শেষে টানের চিনি, নুন, তেল লেনদেনের সঙ্গে সঙ্গে পাকোড়া, পাস্তা, শুটকি, ভর্তা কিংবা ইউটিউব থেকে শেখা কোনো নতুন ধরনের কেক, পুডিং, পিঠার আদানপ্রদান লেগেই থাকে। একদিন বাড়িওয়ালার বাসায় শুটকি তরকারি দিতে গিয়ে কোয়েলের মা গেস্টরুমের টেবিলে মদের বোতল আর পানের সাজসরঞ্জাম দেখে ফেলেছিলেন। ঐ রাতেই ভাবী ফোনে ফোনে ঘটনাটা আমাদের জানিয়েছিলেন।

মুনতাহার বাবা মানে রেজাউল ভাইয়ের কোনো মেয়ে দেখলেই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো, চার তলার কিংবা দোতলার ভাবীর সংসারজীবনের গোপন হতাশা, ফেসবুকে ‘রেজাল্ট কোনো ব্যাপার না চাই মেয়ে মানুষের মতো মানুষ হোক’ স্ট্যাটাস দেওয়ার পরেও বাড়িতে জে.এস.সি.র রেজাল্টের পর ঝর্ণাকে চড় থাপ্পড় মারা, দাগহীন টান টান চাদরের মতো নিখুঁত জীবনের অধিকারী কোয়েলের মায়ের গালে অদৃশ্যভাবে লেগে থাকা পাঁচ আঙুলের দাগের নেপথ্যরহস্য, বেতন পেতে না পেতেই মুনতাহার মায়ের হাত খালি হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি খবরগুলো কবুতরের ডানায় ভর করে ঠিকই আমাদের কাছে পৌঁছে যায়।

আমরা এভাবে নিজেদের চার দেয়ালের গল্পগুলো কেউ কাউকে না জানালেও অন্যদের গল্পগুলো ঠিকই জেনে যাই।

৫.

‘আন্টি জানেন, এই সোনালি মাছগুলো না একেবারে বনসাইয়ের মতো। ঘরে থাকলে ছোট থাকে আর যদি খোলা পানিতে থাকে তাহলে এত্ত বড় হয়।’

রাফি হাত দিয়ে বড় গোল্ডফিশের আয়তন দেখায় আর আমরা ওর চেহারার তুলনায় বিশাল বিশাল চোখ দুটির দিকে কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে থাকি। এ প্লাস না পেলেও বুদ্ধির দীপ্তি ওর চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে।

‘আন্টি এই যে দেখেন, এই পাঁচটি হচ্ছে জাইকিন প্রজাতির। এই দুটো কমেট আর ওয়াকিন প্রজাতির। বাবাকে বলেছি ওরান্ডা, ব্ল্যাক মোর আর ফান্টাইলও এনে দিতে।’

‘এগুলো কী মাছ?’

‘কাঁচের গায়ে লেগে থাকা এই মাছগুলোর নাম সাকারমাউথ ক্যাটফিশ। ওরা চিংড়ির পিলেট খেতে খুব পছন্দ করে।’

রাফি কে দেখে আমাদের মনে হয় ও অনেকদিন কারও সঙ্গে কথা বলে না। তাই আজ বকেয়া কথাগুলো সেরে নিচ্ছে। অনেক কথা বললেও ওর কথা বলার ভঙ্গি ওর মায়ের মতোই নরম আর ধীরস্থির। ফরিদ ভাবী বিপুল আগ্রহে রাফিকে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন। রাফিও মনোযোগী ছাত্রীকে বোঝাচ্ছে কোন মাছের সঙ্গে গাছ রাখা যায় না, কোন কোন মাছ একসঙ্গে রাখা যায় না, দিনে ঠিক কবার খাবার দিতে হয়, কদিন পর পর অ্যাকুরিয়ামের পানি পরিষ্কার করতে হয়, কীভাবে পানির তাপমাত্রা ঠিক রাখতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।

ততোক্ষণে আমরা এই বাসায় আসার প্রাথমিক কৌতূহল সামলে উঠছি। ফরিদ ভাবীর আচরণকে আমাদের কাছে আদেখলাপনা লাগছে। অ্যাকুরিয়ামের স্বচ্ছ কাচ থেকে চোখ ফিরিয়ে আমরা এই বাসার সাজসজ্জার দিকে মনোযোগ দিই। বাসায় পা দিতেই আমরা দেখেছি ডাইনিং রুমে খুব সাদামাটা আসবাবপত্র, ছোট একটা ফ্রিজ। ঘরদোর বেশ পরিচ্ছন্ন। পনেরো স্কয়ার ফিটের এই ফ্লাটের বসার ঘরটিই সবচেয়ে বড়। বসার ঘরের ডানদিকের দেয়ালের এক মাথা থেকে আরেক মাথা অবধি তিন পার্টের বিশাল আলমারি বইয়ে ঠাসা। সোফা, সেন্টার টেবিল আর লম্বাটে একটা ডিভানের ওপরে ল্যাপটপ খোলা, একপাশে একটা গিটার রাখা। ডিভানের এক কোনায় ক্রীড়ামগ্ন বিড়ালগুলোকেও দেখা যাচ্ছে।

এবার ফরিদ ভাবী একটা উটকো প্রশ্ন করে বসেন, ‘রাফি, বিড়াল অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলো খেতে লোভ করে না?’

‘না আন্টি। ওরা খুব ওয়েল ট্রেইন্ড। যেখানে সেখানে খায় না। মা সময়মতো দিলে খায়, সময়মতো টয়লেটে যায়।’

আমরা টয়লেটে বিড়ালের মল-মূত্র ত্যাগ করার দৃশ্যটি কল্পনা করে ঘেন্নায় নাকমুখ কুঁচকে ফেলি। তখনই রাফি-র মা ট্রেতে করে চা, নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢোকেন। ডিভান থেকে এক লাফে সাদা-কালো দুটি বিড়াল তার পায়ের কাছে নেমে আসে। বিড়ালদুটির দিকে তাকিয়ে মুখে আদুরে শব্দ করতে করতে রাফির মা ছেলেকে বলেন, ‘মাছেদের খাবার দাও রাফি। সময় হয়ে এলো।’

রাফি ছেলেটার এক মাথা চুল। কতদিন চুল ছাঁটতে নেয় না বাবা মা কে জানে। কপালে এলিয়ে থাকা চুল সরাতে সরাতে রাফি বলে, ‘যাই মা।’ যেন খুব জরুরি কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে রাফি এবার আমাদের দিকে তাকায়। ‘আন্টি, দেখেন প্লিজ। এই যে, এই যে এই সবুজ বড় ঝাউ গাছটা দেখতে পাচ্ছেন না? ওটা কিন্তু প্লাস্টিকের, গায়ে শ্যাঁওলা জমে গেছে এটার। এই দিকটাতেই খাবার দিই আমি। ওরা প্রতিদিন ঠিক এদিকটাতেই খাবার খুঁজতে থাকে। অন্য কোথাও ভিড় জমায় না।’

‘কেন? কেন?’ আমাদের উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে রাফি নির্লিপ্তভঙ্গিতে বলে, ‘বাবা বলে, মাছেদের স্বভাব এমন বলেই ওরা মাছশিকারির কাছে ধরা পড়ে।’

আমাদের সবার চোখ এখন একুরিয়ামের সবুজ গাছের দিকে। আমরা বিস্ফারিত চোখে দেখি, মাছগুলো একসঙ্গে গাছের আশেপাশে উলম্ব ভঙ্গিতে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের শরীর স্থির, মুখগুলো ঈষৎ হাঁ করা। দেখে মনে হয় মাছগুলো সাঁতার জানে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত