মারাঠি গানে ক্যারিয়ারের শুরু
লতা মঙ্গেশকর তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৪২ সালে, মারাঠি গান গেয়ে। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম হিন্দি সিনেমার জন্য গান করেন। বসন্ত জোগলেকরের ‘আপ কি সেবা মে’ ছবিতে তিনি ‘পা লাগু কার জোরি’ গানটি গেয়েছিলেন। দুই বছর পর সুরকার গুলাম হায়দার তাঁকে প্রথম বড় সুযোগ দেন। ‘মজবুর’ ছবিতে ‘দিল মেরা তোরা’ গানটির পর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

শাস্ত্রীয় থেকে রোমান্টিক—সব সংগীতেই লতা
তিনি ভারতের প্রধান সুরকারদের প্রায় সবার সঙ্গেই কাজ করেছেন। সংগীতের সব ধরনেই তিনি গান করেছেন। শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে শুরু করে রোমান্টিক গান, এমনকি ভজনও গেয়েছেন তিনি। সব ধরনের গানেই তিনি পেয়েছেন সাধুবাদ। কখনো দর্শকের, কখনো সমালোচকদের।
সাড়ে সাত হাজার গান
সংগীতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ডের ইতিহাস আশা ভোসলের। তিনি গেয়েছেন প্রায় ১০ হাজার গান। গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ছোট বোন আশার আগে ছিল লতা মঙ্গেশকর নাম। লতা গেয়েছেন প্রায় সাড়ে সাত হাজার গান।
চিরকুমারী লতা
কেন লতা মঙ্গেশকর কখনো বিয়ে করেননি? সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেও এমন বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী লতা সারাজীবন কেন অবিবাহিত ছিলেন? তাঁর বিয়ে না করার পিছনে কি এমন কারণ রয়েছে, এই বিষয়ে জানিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর নিজেই। ২০১১ সালে তাঁর জন্মদিনে একটি সাক্ষাত্কারে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন তিনি।সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়, বিয়ের স্বপ্ন নিয়ে বড় হওয়া প্রতিটি মেয়ের মতো আপনারও কি বিয়ে করার ধারণা আসেনি? এই প্রশ্নে লতার উত্তর ছিল না। তিনি বলেন, “সব কিছু ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী হয়। জীবনে যা ঘটে তা ভালোর জন্যই ঘটে এবং যা ঘটে না তাও ভালোর জন্যই ঘটে। সাক্ষাত্কার দেওয়ার সময় তিনি ৮২ বছরের ছিলেন। তিনি আরও বলেন, “এই প্রশ্নটা যদি চার-পাঁচ দশক আগে আমাকে করা হতো, হয়তো অন্য কোনও উত্তর পেতেন। কিন্তু আজ আমার এই ধরনের চিন্তার জন্য কোন জায়গা নেই।”লতা মঙ্গেশকর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি বাড়ির বড়, তাই তাঁর অনেক দায়িত্ব ছিল। তিনি বলেছিলেন, “বাড়ির সব সদস্যের দায়িত্ব আমার ওপর। এমতাবস্থায় বহুবার বিয়ের কথা ভাবলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি তিনি। আমি খুব অল্প বয়সে কাজ শুরু করি। আমার অনেক কাজ ছিল।” ১৯৪২ সালে, যখন তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়সের তখন লতা মঙ্গেশকরের মাথায় সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে, কারণ সেই সময় তিনি তাঁর বাবাকে হারান। রাজ সিং, যিনি লতা মঙ্গেশকরের খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস জানিয়েছে যে লতা মঙ্গেশকর এবং রাজ সিং দুঙ্গারপুর দুজনেই বিয়ে করতে চাইছিলেন, কিন্তু রাজ সিং তার বাবা-মাকে এই বিষয়ে জানালে, তার বাবা মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংজি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। যদিও লতা মঙ্গেশকর কখনোই এই কারণ নিশ্চিত করেননি, তবে বাড়ির দায়িত্বকেই কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন।সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে, যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি কখনও একাকীত্ব অনুভব করেন কি? তখন লতা মঙ্গেশকর বলেছিলেন, ‘জীবনে শূন্যতা আছে…’ কখনও কখনও তিনি শূন্যতা অনুভব করেন। তিনি বললেন, “আমার সব বন্ধু চলে গিয়েছে। নার্গিস ও মীনা কুমারী এরা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমরা নিয়মিত যোগাযোগে ছিলাম। আর একজন বন্ধুও ছিলেন আমার দেব আনন্দ, যার সঙ্গে আমি সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতাম। তিনি বলেছিলেন যে, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অনু মালিক প্রায়ই তাঁকে ফোন করতেন। আমির খান, শঙ্কর মহাদেবন, হরিহরন এবং সোনু নিগমও তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও যোগাযোগ রেখেছেন।সবচেয়ে আনন্দ এবং সবচেয়ে আবেগের সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, যখন তিনি গান করেন, তখন সেটিই তাঁর সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত। গান গাওয়ার সময় তিনি নিজেকে সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এবং তাদের অনুতপ্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই। তিনি বলেছিলেন যে ঈশ্বর যা কিছু দেন তা আপনার জন্য, এবং আপনি আপনার জীবনে যা কিছু মিস করেন, তা কখনই আপনার জন্য ছিল না। ঈশ্বর তাকে যা কিছু দিয়েছেন তাঁর জন্য তিনি কৃতজ্ঞ।
রয়্যালটি নিয়ে ঝগড়া!
ভারতীয় সংগীতের আরেক কিংবদন্তি শিল্পী মোহাম্মদ রফির সঙ্গে প্রায় তিন বছর কোনো গান করেননি লতা। পরে এক সাক্ষাৎকারে লতা বলেন, তাঁরা সংগীতের রয়্যালটি নিয়ে ঝগড়া করেছিলেন। ১৯৬০-এর দশকে শিল্পীদের একটি সমিতি ছিল। মুকেশ, তালাত মাহমুদরা তখন একটি দাবি তুলেছিলেন, শিল্পীদের তাঁদের প্রাপ্ত সম্মানী বুঝিয়ে দিতে হবে। যদিও লতা রয়্যালটি পেতেন, কিন্তু তিনি এই দাবি সমর্থন করেন। আর মোহাম্মদ রফি এ দাবির বিরোধিতা করেন। এ নিয়েই দুজনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি। লতা দাবি করেছেন, পরে রফি ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। এরপর শংকর-জয়কিষাণের সুরে গান করেন তাঁরা। কিন্তু মোহাম্মদ রফির ছেলে শহীদ রফি এ কথার প্রতিবাদ করে বলেছেন, এমন কোনো চিঠি রফি লেখেননি।

আশার সঙ্গে বিবাদ
বোন আশা ভোসলের সঙ্গেও লতার মনোমালিন্য হয়েছিল। লতা বলেছিলেন, আশার প্রথম স্বামী গণপতরাও ভোসলের কারণে তাঁদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। সম্ভবত গণপত মনে করতেন, আশা লতার কারণে কাজ পান না। চল্লিশের দশকের শেষদিকে দুই বোনের ক্যারিয়ার শুরুর পর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে লতার দ্রুত উত্থান ঘটে। অন্যদিকে আশা তখনো সংগ্রাম করছিলেন। লতা বলেন, গণপত আশাকে তাঁদের বাড়িতে যেতে নিষেধ করেন। তাঁদের দেখাসাক্ষাৎও তিনি বন্ধ করে দেন। পরে আশার দ্বিতীয় স্বামী রাহুল দেব বর্মণ দুই বোনকে কাছে আনেন।
রাজ্যসভার সদস্য
১৯৯৯ সালে ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে তাঁকে মনোনীত করা হয়। কিন্তু লতা রাজ্যসভার অধিবেশনগুলোতে খুব বেশি একটা যেতেন না। এ নিয়ে অন্য সদস্যরা তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। লতা তাঁর অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে বলেছিলেন তাঁর অসুস্থতার কথা।

৩৬ ভাষায় গান
লতা মঙ্গেশকর প্রায় ৩৬টি ভাষায় গান করেছেন। এর মধ্যে আছে বাংলাও। ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘ও পলাশ ও শিমুল’, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বেলে’সহ অনেক বিখ্যাত বাংলা গানের কণ্ঠ তাঁর।