Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,শহীদ

ধারাবাহিক: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-৩) । আদনান সৈয়দ

Reading Time: 4 minutes

নিউইয়র্ক জ্যাকসন হাইটস এর বাঙালিদের জীবন, তাদের স্বপ্ন, তাদের ত্যাগ, তাদের মন, মনন, প্রেম, ভালোবাসা আর বুক চাপা কান্নার গল্প । সব মিলিয়ে এই ধারাবাহিক লেখায় উঠে আসবে নিউইয়র্কের বাঙালির গল্পগাথা। আজ ইরাবতীর পাঠকদের জন্য থাকছে পর্ব-৩।


 

 

প্রবাসীর কান্নার দাগ

 

নিউইয়র্কের এক  আড্ডায়  কবি শহীদ কাদরীকে প্রশ্নটা করেছিলাম।  ‘এত এত বছর  ধরে আপনি বাংলাদেশের  বাইরে আছেন। দেশের জন্যে কেমন লাগে?’ প্রশ্নটা শুনে তিনি কেমন যেন উদাস হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘যেদিন থেকে দেশ ছেড়েছি সেদিন থেকেই দেশকে খুব গভীর ভাবে উপলব্ধি করি। আমার একজন ভারতীয় ডাক্তার বন্ধু বলতেন টকা—পয়সা অনেক করেছি কিন্তু রাত হলেই দেশের জন্যে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজাই। জানি দেশে অভাব অনটন আছে, দুঃখ আছে তারপরও দেশ তো দেশই। নিজ দেশের চেয়ে আর কি কোন দেশ হতে পারে?   এই আমেরিকাতেও বাংলাদেশের মত অবিরাম বৃষ্টি ঝড়ে কিন্তু বাংলাদেশের বৃষ্টির মতো এত সুন্দর বৃষ্টি পৃথিবীর আর কোন দেশে দেখতে পাব? বাংলাদেশের বৃষ্টি মানেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কাগজের নৌকা পানিতে ভাসাচ্ছে, প্যান্ট গুটিয়ে মানুষজন রাস্তা পার হচ্ছেন। এই দৃশ্যগুলো কল্পনা করলে আমার কাছে উৎসবের মতন মনে হয়। বাংলাদেশের আকাশ অনেক সুন্দর। আমি নিত্য স্বপ্ন দেখি কবে আবার সেই সবুজ দেশটাকে দেখবো। দেখবো তো?’

জ্যাকসন হাইটসে বই এর দোকান ‘অনন্যা’ ছিল একসময় আমাদের জ্যাকসন হাইটসবাসীদের আড্ডার তীর্থস্থান। এমনিতেই জ্যাকসন হাইটস এর প্রাণকেন্দ্রে বাংলা বইয়ের একটি দোকান পেয়ে আমরা রীতিমত আবেগে গদগদ অন্যদিকে সেই দোকানের মালিক কবি সৈয়দ শহীদ ছিলেন একজন তুখোড় আড্ডাবাজ। যার ফলে অনন্যা ছোট বইয়ের দোকানটি জ্যাকসন হাইটস এর বইপ্রেমিদের জন্য একটি আড্ডার সূতিগারে পরিনত হয়েছিল।  বলার অপেক্ষা রাখে না  অনন্যার সেই অনন্য আড্ডার মুল কেন্দ্রীয় আকর্ষণ ছিলেন স্বয়ং কবি সৈয়দ শহীদ অর্থাৎ আমাদের প্রিয় শহীদ ভাই। তিনি একজন কবি, বই বোদ্ধা এবং একই সঙ্গে তুখোড় আড্ডাবাজ মানুষ। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সেই ছোট্ট বইয়ের দোকান অনন্যাকে ঘিরে শুরু হত আমাদের নানা রকমের আড্ডার আয়োজন। বলার অপেক্ষার রাখে না  সেসব আড্ডার মুল বিষয়বস্তু থাকত বাংলাদেশ নিয়ে নানান বিষয়, সেই পেছনে ফেলে আশা সোনালী স্মৃতি, বাংলা শিল্প-সংস্কৃতির নানা রকম খবর, বাংলা বই আর দেশের জন্য বুকচাপরে আহাজারি। সেখানে আাড্ডা দিতে আসতেন অনেকেই। এঁদের মধ্যে বন্ধুজন আবেদীন কাদের, শিবলী আজাদ, অর্ণব দাশগুপ্ত, অনিন্দিতা ভৌমিক, মোনায়ার, মিতুল, খান ভাইসহ আরো অনেকের নামই উল্লেখযোগ্য।

 তেমনি একটি আড্ডার কথা  কথা বেশ মনে পড়ছে। আমাদের সাথে আড্ডায়  মাহফুজ নামের এক ভদ্রলোক সব সময় যোগ দিতেন। তিনি সেই সময় বাংলাদেশ থেকে সদ্য আগত  আর সে কারণেই তার কাছ থেকে বাংলাদেশ সংক্রান্ত তাজা খবর শোনার জন্যে আমরা আগ্রহের সঙ্গে বসে থাকতাম। একদিন আমাদের আড্ডার মাঝখানে হঠাৎ করে তার মোবাইলটা বেজে উঠল। তিনি কলটা ধরলেন। অনন্যার বই এর দোকানটা ছিল জ্যাকসন হাইটস এর প্রাণ কেন্দ্রে(এখন যেখানে বাংলাদেশ প্লাজা) একটা বেইসমেন্টে। তিনি কথা বলার জন্যে বাইরে গেলেন আর কিছুক্ষন পর চোখদুটো রক্তজবার মত লাল করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের আড্ডায় ফিরে এলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তার কান্না দেখে আমাদের আড্ডায় ছেদ পড়লো। তিনি একটা চেয়ারে ঝুপ করে বসে মাথা নীচু করে অঝোরে কেঁদেই চলেছেন। শহীদ ভাই পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা সবাই তাকে সান্তনা দেওয়ার নিস্ফল চেষ্টা করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ পর  জানা গেল এই কিছুক্ষন আগে বাংলাদেশে ওনার মা মারা গিয়েছেন। আরো জানতে পারলাম তিনি বাংলাদেশে মার জানায়ায় যেতে পারবেন না কারণ তার এই দেশে থাকার জন্য  বৈধ কাগজপত্র নেই। মাহফুজকে দেখে আমাদের বুকের ভেতরটা অজানা এক ভয়ে সাথে সাথেই যেন হু—হু করে উঠল!  আমরা সবাই বাংলাদেশে আমাদের বৃদ্ধ বাবা—মাদের রেখে আসি সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে যখন আমরা অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে বের হই তখন আমরা প্রবাসীরা সেই মুহুর্তে সবার আগে ভালো করে দেখে নেই আমাদের বৃদ্ধ বাবা—মাকে। তাদের চরণ যখন কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেই তখন বুকের ভেতরে যেন ভয়ংকর বাদ্য বাজতে থাকে।  “আবার দেখা হবে তো? নাকি এই আমাদের শেষ দেখা?” মনে তখন কত প্রশ্ন জাগে! তখন মনে হয় কিসের এই বিদেশ আর কিসের কী? দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না। কিন্তু প্রবাসীদের জন্য তাদের মনটাকে পাষান বানাতে হয় বাস্তবতার তাগিদেই। মনটা পিশাচের মত পাষান করেই আমরা সবাই ঘর থেকে বের হই।


আরো পড়ুন: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-২) । আদনান সৈয়দ


আমার যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার আগের রাতের স্মৃতিটা এখনো বুক খামচে পড়ে আছে। সেদিন আম্মা আড়াল করে নীরবে তার চোখ মুছছিলেন আর আমি আমেরিকার জোগাড় যন্ত্র বহন করার জন্য ব্যাগ গোছাতেই ব্যাম্ত। আর পিতার মুখোমুখি হয়ে ’লাস্ট মিনিট ফাদারলি এডভাইস’ শুনছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন হঠাৎ করে আব্বা আমার হাত দুটো ধরে বলেছিলেন, ” কিরে!  তোর সাথে আমার আবার দেখা হবে তো?”?

আমি আমার পিতাকে আস্বস্ত করে বললাম, ” কি যা তা বলছো? এইতো মাত্র চারটা বছর। তারপর দেশের ছেলে আবার দেশেই ফিরে আসবো।”

না, আমিও তার কথা  রাখতে পারেনি। সেই চার বছর এখন তির তির করে অনেকগুলো বছরে পেরুলো। এই জগৎ সংসারের বাস্তবতা, জীবনের এই কঠিন চেহারা, আর প্রতিষ্ঠার ইঁদুর  দৌড়ে আমিও আটকে গেছি। আমি তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে আমারও  আর কখনো দেখা হয়নি। আর কখনো দেখা হবে না। একদিন নিউইয়র্কে বন্ধুদের সাথে যখন আমি আমার জন্মদিন পালনে ব্যাস্ত ঠিক সেদিনটাতেই খবরটা পেয়েছিলাম। বাংলাদেশ থেকে একটা কল এল।  টেলিফোনের উপার থেকে কয়েকটা শব্দ ভেসে এল।  জানতে পেলাম বাবা আর নেই।  আমি তখন শোকে পাথর, চোখে অশ্রুধারা। বার বার মনে হচ্ছিল সেই বাবার চেহারাটা। শেষবারের মত সেই কথাগুলো। মনে হল আমার বাবা যেন আমার উপর অভিমান করেই চলে গেলেন। আমার জন্মদিনেই তাকে চলে যেতে হল! তখন আমার ছাত্র ভিসা। বাংলাদেশে যাওয়ার মত হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। তাই আমিও আমার বাবার মৃত্যু খবরে দেশে যেতে পারিনি। আরো অন্য সবার মত এই বেদনাকে বুকের ভেতর স্থান দিয়ে দুঃখে নীল হয়ে এই কঠিন পরবাসকে আগলে ধরে পড়ে রইলাম। 

আমি জানি একজন প্রবাসী হওয়ার চরম খেসরত হল এই ঘনিষ্ঠ আপনজনদের থেকে দূরে থাকা। আর সে কারনেই দেশে রেখে আসা বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের চিন্তায় একজন প্রবাসী ঠিকমত ঘুমাতে পারেন না। প্রতিদিন অজানা এক উৎকন্ঠায় তাদের সময় কাটে। যদি কোন অঘটন ঘটে? যদি কোন খারাপ খবর পেয়ে যাই? তারপরও আমাদের জীবন চলে। সব দুঃখকে হজম করার নামই তো প্রবাস জীবন? প্রবাসীর সেই কান্নার দাগ কি কখনো শুকায়? শুকাতে পারে?

কবি শহীদ কাদরী দীর্ঘ তিন যুগ প্রবাসে কাটিয়েও কেন এক মুহুর্তের জন্য দেশকে ভুলতে পারতেন না। যে কোন প্রসংগ এলেই তিনি বাংলাদেশকে তুলে নিয়ে আসতেন। তাঁর অনেক শখ ছিল তিনি বাংলাদেশে চলে যাবেন। কিন্তু সেই শখ আর তাঁর পুরণ হয়নি। তিনি তাঁর স্বদেশকে একটি আংটির মত তাঁর আঙুলে পড়েছিলেন। তাঁর কবিতায় সেই আর্তিটাই কত ভয়ানকভাবে বেজে উঠে!

“একটি আংটির মতো তোমাকে পরেছি স্বদেশ

আমার কনিষ্ঠ আঙুলে, কখনও উদ্ধত তলোয়ারের মতো

দীপ্তিমান ঘাসের বিস্তারে, দেখেছি তোমার ডোরাকাটা

জ্বলজ্বল রূপ জ্যোস্নায়। তারপর তোমার উন্মুক্ত প্রান্তরে

কাতারে কাতারে কত অচেনা শিবির, কুচকাওয়াজের ধ্বনি,

যার আড়ালে তুমি অবিচল, অটুট, চিরকাল।”

কবি শহীদ কাদরী একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন,“ বুজলা মিয়া, প্রবাসীর কোন নিজস্ব ঘর-বাড়ি নাই। তারা উন্মুল। আজ এখানে তো কাল ওখানে।”

কবি শহীদ কাদরীর কথা সেদিন বেশ মনে ধরেছিল। সত্যিই তাই! প্রবাসীদের কোন ঘর-বাড়ি নেই। তারা নানান দেশে নানান কারণে থাকেন বটে কিন্তু তাদের নিজের ঘর-বাড়ি বলতে সেই পেছনে ফেলে আসা স্বদেশকেই বুঝেন। প্রবাসীর এই কান্নার দাগ কখনো শুকিয়ে যায়?

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>