ইরাবতী ধারাবাহিক:ফুটবল (পর্ব-১৪) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
অষ্টম শ্রেণির দুই বন্ধু রাজ আর নির্ঝর। রাজ আর অনাথ নির্ঝরের সাথে এইগল্প এগিয়েছে ফুটবলকে কেন্দ্র করে। রাজের স্নেহময়ী মা ক্রীড়াবিদ ইরার অদম্য চেষ্টার পরও অনাদরে বড় হতে থাকা নির্ঝর বারবার ফুটবল থেকে ছিটকে যায় আবার ফিরে আসে কিন্তু নির্ঝরের সেই ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার পেছনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ঝরের জেঠু বঙ্কু। কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু ও তার ফুটবলার বন্ধু তীর্থঙ্করের বন্ধুবিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? সবশেষে নির্ঝর কি ফুটবলে ফিরতে পারবে? রাজ আর নির্ঝর কি একসাথে খেলতে পারবে স্কুল টিমে? এমন অনেক প্রশ্ন ও কিশোর জীবনে বড়দের উদাসীনতা ও মান অভিমানের এক অন্য রকম গল্প নিয়ে বীজমন্ত্রের জনপ্রিয়তার পরে দেবাশিস_গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন কিশোর উপন্যাস ফুটবল আজ থাকছে পর্ব-১৪।
পরের দিন স্কুল পৌঁছে রাজ দেখল হৈ- হৈ ব্যাপার।বড় ছেলেরা এসে বলে গেল আজ নাকি স্কুলে একজন দারুন লোক আসবেন। প্রথম পিরিয়ডেই স্কুলে নোটিশ ঘুরে গেল। একজন লোক আসবেন, তিনি নাকি সারা ভারতবর্ষ সাইকেল করে ঘুরেছেন। রাজরা খুব উৎসাহ পেল। এমন ঘটনার কথা সে শুনেছে। বাবা তাকে এক বিখ্যাত সাইকেল-অভিযাত্রীর জীবনী জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। রাজ বইটা পেয়ে খুব খুশী হয়েছিল। বইটা সম্পুর্ন পড়া না হলেও বেশ কিছুটা পড়া হয়েছিল তার। পড়ার পর তার যা হয়, দু-তিন ধরে মাথার মধ্যে সব জায়গাগুলো ঘুরে যাচ্ছিল। মাথার ভেতর ইচ্ছেগুলো ঘুরতে শুরু করে। সেবলেছিল,“ছোটমামা কেমন হয়? যদি সাইকেলে পৃথিবী ঘুরি?”
ছোটোমামা একটু অবাক চোখে চেয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন,“খামোকা পৃথিবী ঘুরতে যাব কেন?”
“কেন? মানে? কি দারুন ব্যাপার ভাবো। সাইকেল করে দুজন পৃথিবী ঘুরব।“
ছোটমামা আঁতকে উঠে বলছিলেন,- “না, না। আমি ওসবে নেই।বাপ রে! সাইকেল নিয়ে কেউ অত ঘোরে! পাগল।“
“ওমা! কেমন আনন্দ হবে বল তো?”
“আনন্দ! বল কষ্ট! এক তো প্যাডেল চালিয়ে যেতে হবে। তারপর টায়ার যদি ফেঁসে যায়। কি অবস্থা হবে বল তো? টেনে টেনে নিয়ে যেতে হবে।তখন কোথায় সাইকেল সারাবি বল।“
“উহু! সেসব ব্যবস্থা করা থাকে।যারা যায় তারা জানেন বা ঠিক ব্যবস্থা করেন।“
ছোটমামা বললেন,“ তাহলেও আরো কষ্ট! তাছাড়া তুই ভাব কি ঝামেলার। কোথায় খাবি? কোথায় থাকবি কোনো ঠিক আছে।“
রাজ ব্যাজার মুখে বলে, “তুমি ছোটমামা কুঁড়ে আছ।“
ছোটমামা একটা আরামের শ্বাস ফ্যালেন,“তা আছি।কিন্তু সে কি আর আমার দোষ! তোর বাবার দোষ।আমি কি খাই না খাই সেদিকে তাঁর বড্ড খেয়াল।“
আরো পড়ুন: ফুটবল (পর্ব-১৩) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
রাজ তা জানে। ছোটমামাকে বাবা খুবই স্নেহ করেন।বাজার গেলে ছোট্মামার জন্যই নানারকম মাছ নিয়ে আসেন। দাদুকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, টুবলু এখানে যেমন থাকার থাকবে। বাবা-ই একটা কিছু তার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবে্ন। তবে কাজ নিয়ে ছোটমামা অত ভাবেন না।একটা কিছু হবে তিনি জানেন। ছোটমামার কথা শুনে সে বলেছিল,“ আচ্ছা। বেশিদুর নয়, তবু সকাল সকাল সাইকেল নিয়ে চল এদিক-ওদিক ঘুরে আসি।“
ছোটোমামা বলল,“হুম! তা কোথায়?”
রাজের মাথায় ফাজলামি বুদ্ধি এসে গেছিল। সে বলছিল,“চল! সাইকেল নিয়ে তোমার বাড়িই যাই। অনেকদিন দাদু-দিদার বাড়ি যাই নি।“
ছোটমামা তার দিকে গম্ভীরচোখে চেয়ে বলছিল,“খুব ঠাট্টা করতে শিখেছিস!
রাজ হেসে বলছিল,“না। না।“
ছোটমামা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলছিল,“হ্যাঁ রে। ভাবছি। এবার ফিরব। বাবা মাঝেমাঝেই দিদির কাছে খোঁজ নেয়। এবার যাওয়া উচিত। বল।“
“তাতে কি? তুমি মাঝেমাঝে যাও তো।“
“এবার ভাবছি পুরোই চলে যাব।“
“সে যেও তোমার নাটক আগে শেষ হোক”
ছোটমামা বলেছিলেন,“হুম”।
ছোটমামা সেদিন রাজি হল না বলে রাজ আর কি করে! সে নিজেই মনে মনে কত পরিকল্পনা করেছিল। রাতে শুয়ে শুয়ে সে দেখেছিল সাইকেল চালিয়ে সে দুরদুরান্তে যাচ্ছে। সে পাহাড়ের পাশ দিয়ে, নদীর পাশ দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। কিছুদিন পর্যন্ত তার মাথায় এগুলো ঘুরেছিল। তারপর তা থিতিয়ে গেছিল। কিন্তু আজ আবার তা ফিরে এল।সাইকেল-অভিযাত্রীর কথা শুনে। কখন চার পিরিয়ড শেষ হবে সে তার অপেক্ষা করতে লাগল।চার পিরিয়ডের পরই তিনি আসবেন। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলবেন। কিন্তু আজ যেন ক্লাস শেষ হতে চায় না। এখন ক্লাস করছেন ইতিহাসের কমল স্যার। অন্যদিন তার ভালোই লাগে স্যারের পড়া।কিন্তু আজ তার মন লাগল না। মন ছটফট করতে লাগল।
“এই যে! তুমি! তুমি!”
রাজ চমকে তাকাল। সে দেখল স্যার তাঁর দিকে বাঘের চোখে তাকিয়ে আছেন। সে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াল।
স্যার জিজ্ঞেস করলেন,“ভারতের প্রথম ভাইসরয় কে ছিলেন বল তো? ”
স্যার এতক্ষন এটাই পড়াচ্ছিলেন। সে অন্যমনস্ক ছিল বলে শুনতে পায় নি। অথচ এটা তাঁর এমনিতে পড়া। কিন্তু এখন কিছুতেই তা মনে পড়ছে না। রাজ মাথা নীচু করে রইল।
স্যার কিছুক্ষন তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন।অপমানে তাঁর মুখ ঝাঁঝাঁ করছে। স্যার চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,“ কি ফুটবল টিমে চান্স পেয়ে গেছ? ভাল। তা ক্লাসে কেন বাপু! মৈনাকবাবুর কাছে গেলেই হয়।“
কমলস্যারের সাথে মৈনাকস্যারের আদায়-কাঁচকলা। মৈনাকস্যার স্কুলে যোগ দেবার আগে কমল স্যারই নাকি গেম-টিচারের কাজ করতেন। কিন্তু স্যার নিজে খেলতে পারতেন না। তাঁর হাঁটুতে ব্যথা। পাঁচ মিনিটের রাস্তা তিনি পঁচিশ মিনিটে যাতায়াত করেন। মৈনাকস্যার এদিকে নিজে একদা খেলতেন। এখনও নিয়মিত খেলেন। এসব নিয়েই দুজনের সমস্যা। তাই তিনি রাগটা তার উপর উশুল করলেন।
অপমানে রাজের মুখ কালো হয়ে গেল। সে স্যারকে বলতে পারত,না স্যার এখনও আমি চান্স পাই নি।কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না।
স্যার বললেন, “যাও! বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।“
বাইরে এসে দাঁড়ানোর সময় সে শুনতে পেল ইমন ওর দলবল নিয়ে হাসাহাসি করছে।একবার ওদের দিকে তাকিয়ে ওর মুখ কঠিন হয়ে গেল।গতকাল মাঠে ইমনের সাথে তার ঝামেলা হয়েছিল। একদম খেলতে পারছে না ও। অথচ লম্বাচওড়া কথা! কাল বলে কিনা ,”এই সৌম্য বল শুধু তোর কাছে রাখছিস কেন? আমাকে দে।“
রাজ তক্কে তক্কে ছিল। বল কাছে আসতেই সে দেখেছিল ইমন একদম পেনাল্টি বক্সের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।সে বল বাড়িয়েছিল। ইমন বল ধরবে কি! বলটা পাওয়ার পর ল্যাজেগোবরে হয়ে গেল। বল ধরতে পারল না। উপরন্তু নিজে দুম করে উলটে পড়ে গেল। তা দেখে রাজ ফিক করে হেসে ফেলেছিল। ইমন চিৎকার করে বলেছিল,“ওই হাসছিস কেন?”
“বেশ করেছি। কিভাবে বল ধরতে পারিস তাই জানিস না?“
“এই! এই। বাজে কথা বলবি না একদম।“
“কেন ? কি করবি?”
ইন্দ্রদা এসে তাদের দুজনকে থামিয়েছিল। বলেছিল,“স্যার যদি শোনে তোরা ঝগড়া করছিস।এখুনি বসিয়ে দেবে।একদম চুপ।“
ইমনদের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রাজ বাইরে বেরোল। নির্ঝর মাঠে আসছে না বলে ইমন শুধু খুশী নয়। সুযোগ পেলেই সে তার সঙ্গে ঠাট্টামন্দ করছে। ইমনের কথাই এখন সত্যি হয়ে গেল। নির্ঝর বোধহয় আর কোনদিন খেলতে আসবে না!
বাইরে এসে রাজ দাঁড়াল। দাঁড়াতে না দাঁড়াতে তার মনে পড়ে গেল শেষ গভর্নর জেনারেল ও প্রথম ভাইসরয়ের নাম। লর্ড ক্যানিং। স্যারকে সে উত্তর বলতেই পারে। কিন্তু তার ইচ্ছে করল না। সে বরং চারপাশ দেখতে লাগল।
বাইরে দাঁড়ালে একটা সুবিধা হয়, চারদিক দেখা যায়। পাশের ঘর থেকে অন্য স্যারদের কথা শোনা যায়। লম্বা করিডোরে দেখা যায় তার মতো আর কেউ বাইরে দাঁড়িয়েছে কিনা! এখন অবশ্য কেউ নেই। রাজ মাঠের দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইল।কিছুক্ষন পরে সে দুর থেকে দেখল গেটকিপার নিবারনকাকু স্কুলের বড় গেট খুললেন।একজন টুপি-পড়া মানুষ টুক করে সাইকেল নিয়ে ঢুকে পড়লেন। নিবারনকাকু আবার স্কুলগেট বন্ধ করে দিলেন। ইনি যে বিখ্যাত সাইকেল-অভিযাত্রী তা একনিমেষে রাজ বুঝে গেল। এতক্ষনের চাপা কষ্টটা তার দুর হয়ে গেল। সে লোকটার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। মানুষটা ধীরে ধীরে স্টাফরুমে ঢুকে পড়লেন।
দেড় দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। ‘কাঠবেড়ালি’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘চার অঙ্গ’, ‘তিথির মেয়ে’, গল্পগ্রন্থ : ‘গল্প পঁচিশ’, ‘পুরনো ব্রিজ ও অন্যান্য গল্প’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বীজমন্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন।