| 7 অক্টোবর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য প্রবন্ধ: স্বস্তিকা: স্বস্তি না অস্বস্তি । অদিতি ঘোষ দস্তিদার

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

 

“খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর!” সেই খ্যাপারা ছড়িয়ে আছেন সারা পৃথিবী জুড়ে। 

তেমনি এক খ্যাপা প্রত্নতাত্ত্বিক ছিলেন শ্লিম্যান, খুঁজে বেড়াতেন ট্রয় নগরী। সেই ছোটোবেলায় যখন হোমারের ইলিয়াড আর ওডিসি পড়েছেন সেই থেকে শ্লিম্যানের লক্ষ্য ইলিয়াডের প্রাচীন ট্রয় নগরীকে খুঁজে বের করা! সুন্দরী হেলেনকে পাবার জন্য যে ট্রয়ের যুদ্ধ তা আমজনতার কাছে নিছক গল্প ছাড়া কিছুই ছিল না, কিন্তু শ্লিম্যান মনে করতেন শুধুমাত্র কল্পনার ওপর ভিত্তি করে এ মহাকাব্য সম্ভব নয় – নিশ্চয়ই বাস্তব অস্তিত্ব আছে ট্রয়ের! তাই খোঁজ খোঁজ খোঁজ! বার বার পড়েন হোমারের ইলিয়াড – আর খুঁজতে থাকেন কোথায় ছড়িয়ে আছে সন্ধান! ইলিয়াডেই পাবেন সেই প্রাচীন শহরের মানচিত্রের ধারণা এ শ্লিম্যানের দৃঢ় বিশ্বাস!  

শ্লিম্যান প্রত্নতাত্ত্বিক হলেও একজন গোলাবারুদের ব্যবসায়ী – ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে তাঁর ব্যবসা বেড়ে উঠছে – অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি চলছে কিন্তু ট্রয় নগরী সন্ধান। হাতে গাইডবুক বলতে শুধু ইলিয়াড – হোমারের ভার্সগুলো শ্লিম্যানের জলের মতো মুখস্থ! হোমার যেমন যেমন বলেছেন সেই ভাবে গোটা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার স্থানীয় ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে চিকিৎসা সবরকম খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন – ধ্যান জ্ঞান শুধু কোথায় কোন ঘটনায় মিল পাওয়া যায় ইলিয়াডের বর্ণনার সঙ্গে! এক একটা জায়গা দেখেন আর ভাবেন এই কি ট্রয় শহর! সত্য আর ব্যাখ্যার থেকে লোককথা আর গল্পের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন, বেশির ভাগ সময়ই সহকারীদের সমর্থন পান না, তবুও খুঁজে চলেন।

শ্লিম্যানের স্বপ্ন কিন্তু সার্থক হল একদিন – সত্যি সত্যিই তিনি ১৮৭১ সালে খুঁজে বের করলেন তাঁর স্বপ্নের শহর – কিন্তু তার সঙ্গে পেলেন এমন একটি জিনিস – যা বদলে দিল আগামীর ইতিহাস! 

শ্লিম্যানের সুদূর কল্পনাতেও যা ছিল না!

তুরস্কের তাজায়িন উপকূলে শ্লিম্যান খুঁজে পেলেন তাঁর মহাকাব্যের শহর আর পেলেন এক চিহ্ন-স্বস্তিকা!

খননকার্য চালাবার সময় শ্লিম্যনের সঙ্গী ছিলেন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রাঙ্ক কালভার্ট। হিসারলিক মাউন্ড নামে এক ঢিপির মধ্যে মিলল হাজার হাজার বছর ধরে চাপাপড়া স্তরে স্তরে সাতটি বিলুপ্ত সভ্যতার সন্ধান।

শ্লিম্যানের স্বপ্নের ট্রয় নগরী তো মিললই মিলল। তার সঙ্গে পাওয়া গেল ইলিয়াড বর্ণিত সভ্যতার আগের আর পরেরও অনেক অনেক নিদর্শন। 

গোটা এলাকা জুড়ে শ্লিম্যান দেখতে পেলেন প্রচুর বিভিন্ন রকমের স্পিন্ডল হোলস বা স্বস্তিকা!

ব্যস! ট্রয় নগরীর সন্ধান পেয়েও শ্লিম্যানের স্বস্তি হল না! ধ্যান জ্ঞান জুড়ে এখন শুধু স্বস্তিকা! 

তিব্বত থেকে প্যারাগুয়ে সর্বত্র ছুটে বেড়িয়ে বেড়িয়ে খ্যাপা শ্লিম্যান এবার খুঁজে ফিরতে লাগলেন স্বস্তিকার সন্ধানে!

শ্লিম্যান যতক্ষণ স্বস্তিকা খুঁজছেন ততক্ষণ আমরা বরং স্বস্তিকার সম্বন্ধে একটু জেনে নিই।  

স্বস্তিকা শব্দটির উৎস সংস্কৃত হলেও পৃথিবীর প্রায় সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাতেই এই চিহ্ন ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সবচেয়ে প্রাচীন স্বস্তিকা চিহ্নের সন্ধান পাওয়া গেছে ইউক্রেনের মেজিনে (Mezine)। প্রায় ১৫০০০ (মতান্তরে ১২০০০) বছরের পুরোনো হাতির দাঁতের তৈরি একটা ছোট্ট পাখির সারা গায়ে এই চিহ্ন উর্বরতা বা fertility বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে বলে পুরাতত্ববিদরা মনে করেন। তবে কোথা থেকে এই চিহ্নের ভাবনা মানুষের মনে এসেছিল এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। 

এই জ্যামিতিক চিত্র যিনিই প্রথম শুরু করুন না কেন সহজ অথচ সূক্ষ্ম প্যাটার্নের জন্যে সহজেই সমাদর পায়। অনেকের মতে এই চিহ্নের ধারণা প্রাচীন মানুষের মনে এসেছিল রাতের আকাশে কোনো ধূমকেতু দেখে। 

গোটা ইউরোপ জুড়ে এই স্বস্তিকা চিহ্নের ছড়াছড়ি! প্রত্নতাত্ত্বিকরা পূর্ব ইউরোপে প্রায় সাত হাজার বছর আগের নিওথিলিক যুগের ভিনকা সভ্যতায় প্রচুর আলাদা আলাদা স্বস্তিকা চিহ্নের সন্ধান পেয়েছেন। এখনকার সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া যে জায়গায় সেই এলাকায় ছিল এই ভিনকা সভ্যতা।  

মোটামুটিভাবে ব্রোঞ্জযুগে এই ভিনকারা সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। হয়ত সেখান থেকে এশিয়াতেও এই চিহ্নের কদর হয়।

মেসোপটেমিয়া পাওয়া মুদ্রায়, গ্রিসে পাওয়া ফুলদানি, রোমের মোজাইক টাইলস, সেলটিকদের ক্রসে কোথায় নেই স্বস্তিকা? ইলিরিয়ানয়সদের কাছে স্বস্তিকা চিহ্ন ছিল সূর্যের প্রতীক। গামাডিয়ন( gammadion) বা ফ্লাইফট( flyflot) এই নামেই স্বস্তিকা তখন ইউরোপে সুপরিচিত ছিল। প্রথমদিকে যিশুখ্রিষ্টের রেজারেকশন বা পুনরুত্থানকে বোঝাতে স্বস্তিকা ব্যবহার হত, আবার একই চিহ্নের মাধ্যমে নর্সরা তাদের ভগবান থরের হাতুড়ি বোঝাত। 

মধ্যযুগের ইউরোপের গির্জা অলঙ্করণে স্বস্তিকার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়, শুধু তাই নয় শ্লাভ রাজকুমারীর( দ্বাদশ শতাব্দীর) পোষাকের এমব্রয়ডারিতেও স্বস্তিকা। ছোটোবেলা এডলফ হিটলার অস্ট্রিয়ার যে মঠের স্কুলে পড়তেন সেখানে পাথরে আর কাঠে স্বস্তিকা খোদাই করা ছিল!

পিথাগোরাস এই চিহ্নটি (তাঁর দেওয়া নাম Tetraktys)কে ব্যাখ্যা করেছিলেন স্বর্গ আর পৃথিবীর মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে, চিহ্নের ডানদিক স্বর্গকে সূচিত করছে আর বামদিক পৃ্থিবীতে!  

ইথিওপিয়ার লাইবেলার চার্চের জানলায় দেখা যায় এই চিহ্ন, রোমে ক্রিশ্চিয়ান ক্যাটাকম্বে ZOTIKO ZOTIKO শব্দটির (শব্দটির অর্থ life of life) পাশেই আছে স্বস্তিকা চিহ্ন, আমেরিকার আদিম অধিবাসী নাবাহো উপজাতির মধ্যেও স্বস্তিকার ব্যবহার জানা ছি। প্রশ্ন জাগে তাহলে কি আমেরিকা আবিষ্কারের আগেও তাদের যোগাযোগ ছিল মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে নাকি স্বস্তিকার ব্যবহার পৃথিবীতে আলাদা আলাদা ভাবে হয়েছে! চিনে, জাপানেও স্বস্তিকা শুভ চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।

প্রাচীন সভ্যতায় স্বস্তিকার বামাবর্ত আর দক্ষিণাবর্ত প্রকাশকে যাথাক্রমে অশুভ (নেগেটিভ) আর শুভ (পজিটিভ শক্তি) বলে গণ্য করা হত! তবে এরকম উভয় অর্থ অনেক চিহ্নেরই প্রাচীনকালে করা হত। যেমন পেন্টাগ্রাম বা পাঁচমুখী তারা যা বিভিন্ন ধর্মে শুভ হিসেবে ধরা হয়, সেটাই আবার উলটে ধরলে শয়তানের চিহ্ন বলে ভাবা হত। 

তবে একথা ঠিক যে ইউরোপে প্রথম স্বস্তিকার নিদর্শন পাওয়া গেলেও এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি এই স্বস্তিকা চিহ্নের ব্যবহার দেখা যায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী হিন্দু, বৌদ্ধ, এবং জৈনরা স্বস্তিকাকে একটি পরম পবিত্র চিহ্ন হিসেবে মেনে এসেছেন।  জৈনরা মনে করেন স্বস্তিকা হল তাদের ২৪ তীর্থঙ্করদের মধ্যে একজন। আবার বৌদ্ধরা মনে করেন এটি স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ন। তবে হিন্দুরা দক্ষিণাবর্ত স্বস্তিকাকেই পবিত্র বলে মানেন।   

ফিরে আসি আবার শ্লিম্যানের প্রসঙ্গে। সেই যে ১৮৭০ সালে শ্লিম্যান ট্রয় নগরীর বাস্তব অস্তিত্ব আর স্বস্তিকার সন্ধান পেলেন – আর তা নিয়ে আলোড়ন তুললেন – তিনিই প্রথম জানালেন যে এই চিহ্ন অবশ্যই ইউরোপিয়ানদের পূর্বপুরুষের খুব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রতীক।

শ্লিম্যান খুঁজে  খুঁজে প্রায় ১৮০০ রকম বিভিন্ন স্বস্তিকার নিদর্শন সংগ্রহ করলেন, সারা ইউরোপে, আমেরিকায় স্বস্তিকা চিহ্ন কোকাকোলার বোতল থেকে ম্যাগাজিনে সর্বত্র ব্যবহার হতে দেখা গেল। এমনকি গার্ল স্কাউটের প্রাইজের ব্যাজেও স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা থাকত।

এর মধ্যে আবার শ্লিম্যানের সহকর্মী এমিলি বাবনফও স্বস্তিকা চিহ্ন নিয়ে প্রবল উৎসাহী। প্রাচীন সভ্যতা আর স্বস্তিকা নিয়ে ভাবতে ভাবতে তিনি পড়ে ফেললেন ঋকবেদ। জানতে পারলেন যে স্বস্তিকা আর প্রাচীন আর্যদের মধ্যে একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে।

এই সময় জার্মানরা সংস্কৃত ভাষা ও ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে প্রবলভাবে আগ্রহই হয়ে ওঠেন। জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার সাহেব ভারতে আসেন সংস্কৃত শিখতে ও ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে। তখন পর্যন্ত ভাবা হত আর্যসভ্যতাই ভারতের প্রাচীন সভ্যতা। সংস্কৃত আর জার্মান ভাষার মধ্যে মিল থাকায় অনেক জার্মান মনে করলেন আর্যরা জার্মানি থেকে এসেছিল আর জার্মানরা বিশুদ্ধ রক্তের অধিকারী।

শ্লিম্যান বা বারনফ কেউই বোধহয় স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে এই ‘আর্যতত্ত্ব ‘ যে পৃথিবীর ইতিহাসে কী ভীষণ বিভীষিকা নিয়ে আসবে। সত্যি বলতে কী, আর্যশব্দের সংস্কৃত অর্থ সম্মাননীয় বা সম্ভ্রান্ত – শব্দটি বোঝানো হত সামাজিক বা ভাষাগত পার্থক্য বোঝাবার জন্য- আর্য বলে কোনো জাতি আদপে ছিলই না!

নাৎসিদের আগে গোটা ইউরোপে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে যে চিহ্ন ব্যবহার করা হত, সেই স্বস্তিকা চিহ্ন এখন লক্ষ লক্ষ ইউরোপিয়ানদের মনে জাগায় শুধুই দুঃস্বপ্ন!

শ্লিম্যানের এই আবিষ্কার নতুন করে জার্মানিতে নতুন করে এক জাতীয়তাবোধের জন্ম দিল, যা তীব্রভাবে অ্যান্টি সেমেটিক বা ইহুদি বিরোধী। জার্মানরা ভাবতে শুরু করলেন যে তাঁরাই একদিন সারা পৃথিবীকে দমন করতেন, এই চিহ্ন তাঁদেরই শৌর্য আর বীর্যের প্রতীক। সত্যি বলতে কী, যে বিদ্বেষ আর দম্ভ কাজ করত এক শ্রেণীর জার্মানদের কাছে, শ্লিম্যানের আবিষ্কার যেন সেই অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিল।

ব্রিটিশ ভাষাতত্ত্ববিদ আর্চিবল্ড সেস ১৮৯৬ সালে বলেন, “The antiquities unearthed by Dr. Schliemann at Troy acquire for us a double interest. They carry us back to the later stone ages of the Aryan race.”

হিটলারের যখন উত্থান হচ্ছে তখন হিটলার নিজের দলের প্রতীক হিসেবে তাই স্বস্তিকাকেই নির্বাচন করলেন নাৎসি ভাবনা আর আদর্শের ঐতিহাসিক ভিত্তি হিসাবে। তিনি অবশ্য বামাবর্ত স্বস্তিকা বেছে নিলেন। হিটলার ভাবতে শুরু করলেন যে জার্মানির ক্রিশ্চান যাঁদের পূর্বপুরুষরা ইহুদি ছিলেন তাঁদের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই- তিনি আর তাঁর নাৎসি বাহিনী পবিত্র বিশুদ্ধ আর্য  রক্তের অধিকারী- অনন্য এক পরাক্রান্ত জাতি।

তারপর কী ঘটেছিল সে তো ইতিহাস সাক্ষী! এটুকু শুধু বলতে পারি যে নাৎসি পতাকার স্বস্তিকা এক নারকীয় প্রতীক হয়ে উঠেছিল- ষাট লক্ষ ইহুদীর রক্তে লাল হয়ে গেছিল পতাকা।

হলোকাস্ট ফেরত তিরানব্বই বছরের ফ্রেডি নলার সেই দুঃস্বপ্নের দিন আর স্বস্তিকা চিহ্ন নিয়ে বলেছেন,

For the Jewish people the swastika is a symbol of fear, of suppression, and of extermination. It’s a symbol that we will never ever be able to change. If they put the swastika on gravestones or synagogues, it puts a fear into us. Surely it shouldn’t happen again.

জার্মানিতে স্বস্তিকা চিহ্ন ব্যবহার নিষিদ্ধ, মোটামুটিভাবে উত্তর আমেরিকাতেও প্রকাশ্যে ব্যবহার করা যায় না, তবে এশিয়াতে বৌদ্ধ, হিন্দু, জৈনরা স্বস্তিকা চিহ্নকে পবিত্র চিহ্ন হিসেবেই ব্যবহার করেন।

হাজার হাজার বছর ধরে যে চিহ্নটি সৌভাগ্যের চিহ্ন বলে প্রায় সারা পৃথিবীতে মানা হত, এক অত্যাচারী রণ নায়কের ঘৃণ্য প্রয়োগে সেই চিহ্ন আজ অনেক মানুষের আতঙ্কের কারণ। হয়ত আবার অনেক অনেক বছর পর স্বস্তিকা তার পুরনো সম্মান শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানবজাতির কাছে ফিরে পাবে!

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত