| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

অনুবাদ গল্প: ইনোক । রবার্ট ব্লক । অনুবাদক: সানজিদা হক

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

রবার্ট অ্যালবার্ট ব্লক (১৯১৭-১৯৯৪) একজন আমেরিকান কথা সাহিত্যিক মূলত অপরাধ, মনস্তাত্ত্বিক, হরর, ফ্যান্টাসি ধারার। তিনি অল্প কিছু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিও লিখেছেন। তিনি জনপ্রিয় বিখ্যাত ‘সাইকো’ এর লেখক হিসেবে। তার রচিত বেশীর ভাগ গল্পই রেডিও, টেলিভিশন প্রযোজনা, চলচ্চিত্র এবং অডিওবুক   হিসেবে প্রচারিত ও জনপ্রিয়। তিনি ‘হুগো অ্যাওয়ার্ড’, ‘ব্রাম স্টোকার অ্যাওয়ার্ড’, ‘ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড’ পুরষ্কারে ভূষিত হয়ছেন। 

অনুবাদকৃত গল্পটি ‘বেষ্ট অফ রবার্ট ব্লক’ গল্প গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।


এটা শুরু হয় সবসময় একই ভাবে।

প্রথমে সেই অনুভূতি। আপনি কি কখনো খুলির উপর দিয়ে ছোট ছোট পায়ের হাঁটাচলা অনুভব করেছেন? খুলির উপরে পদচারণা? একবার সামনে, আবার পিছনে, সামনে আবার পিছনে?

শুরুটা এভাবেই হয়।

হাঁটাহাঁটি কে করছে আপনি দেখতে পারবেন না। যেহেতু এটা ঘটছে আপনার মাথার উপরে। আপনি যদি চালাক হন, হয়তো সুযোগ বুঝে হঠাৎ মাথার চুলের ভিতরে হাত দিয়ে ঝেড়ে দিলেন। তারপরও হাঁটনে ওয়ালাকে কিন্তু ধরতে পারবেন না। সে বুঝতে পারে, এমনকি আপনি যদি দুই হাত একসাথে আঁকড়ে ধরে মাথার উপর বিছিয়ে রাখেন সে এঁকেবেঁকে ঠিকই বের হয়ে যায়। কোন এক উপায়ে। হয়তো সে লাফ দেয়।

সে সাংঘাতিক দ্রুতগতির। এবং আপনি তাকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। আপনি যদি তার হাঁটায় মনযোগ না দেন সে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়। সে আপনার ঘাড় বেয়ে পিছলে নেমে যায় আর কানের কাছে ফিসফিস করতে থাকে।

আপনি তার শরীর অনুভব করতে পারবেন, খুবই ছোট আর শীতল, আপনার মগজের গোড়ায় শক্ত হয়ে চেপে আছে। মনে হয় তার থাবায় অবশ কারক কিছু আছে কারণ সেগুলো ব্যথা দেয় না—যদিও পরে আপনি ঘাড়ে ছোট ছোট আঁচর খুঁজে পাবেন, যেগুলো থেকে রক্ত পড়তেই থাকে, পড়তেই থাকে। কিন্তু সেই সময়টায় আপনি শুধু বুঝবেন ছোট আর ঠান্ডা কিছু একটা সেখানে চেপে আছে। চেপে আছে আর ফিসফিস করছে।

ঠিক এসময়ই আপনি তাকে ঠেকানোর চেষ্টা চালান। সে কি বলছে আপনি তা না শোনার চেষ্টা করেন। কারণ যদি শোনেন তাহলে আপনি হারিয়ে যাবেন। ওর আদেশ তখন আপনাকে মানতেই হবে।

ওহ, সে খুব ধূর্ত আর জ্ঞানী। 

সে জানে কিভাবে ভয় দেখানো যায়, শাসানো যায়, যদি আপনি তাকে অমান্য করার চেষ্টা করেন। আমি এখন আর তেমন চেষ্টা করিনা। তাকে শোনা আর মেনে চলাটাই আমার জন্য হিতকর। তাকে শোনার ইচ্ছা পোষণ করলে তখন ব্যাপার স্যাপার খুব একটা খারাপ লাগে না। সে প্রশান্তি দিতে পারে, প্ররোচিতও করতে পারে। যেটা লোভনীয়। সে আমাকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার সেই রেশমের মতো মসৃণ ফিসফিসানি দিয়ে!!

সে তার অঙ্গীকার রক্ষাও করে।

লোকজন ভাবে আমি গরীব, কারণ আমার কখনোই টাকা পয়সা ছিলোনা আর আমি জলাভূমির ধারে একটা পুরানো ছাপড়ায় থাকি। কিন্তু সে আমাকে সম্পদ দিয়েছে। সে যা চায় তা করার পর সে আমাকে আমার থেকে বের করে নিয়ে যায়—বেশ কয়েকদিনের জন্য। আপনি জানেন এই দুনিয়া ছাড়া আরো অনেক জায়গা আছে যেখানে আমিই রাজা।

মানুষ জন আমাকে দেখে হাসাহাসি করে, বলে আমার কোন বন্ধুবান্ধব নেই। শহরের মেয়েরা আমাকে ডাকতো ‘’কাকতাড়ুয়া’’। তারপরও মাঝেমাঝে—তার আদেশ পূরণ করার পর—সে আমার বিছানায় রানীদের এনে দেয়। 

এটা কি শুধুই স্বপ্ন? আমার তা মনে হয় না। বরং অন্য জীবনটাই একটা স্বপ্ন; জলাভূমির পাশের ছাপড়ার জীবনটাই শুধু একটা স্বপ্ন। সেই জীবনের অংশটা আজকাল আর সত্যি মনে হয়না।

এমনকি খুনগুলাও…

হ্যাঁ, আমি মানুষ খুন করি।

জেনে রাখুন ইনোক সেটাই চায়।

সেটাই সে ফিসফিস করে জানায়। সে আমাকে মানুষ খুন করতে বলে—তার জন্য।

আমি সেটা করতে পছন্দ করিনা। এটা প্রতিরোধের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি—যেটা মাত্রই বললাম তাই না?—কিন্তু আমি আর পারি নাই। ইনোক, সে চায় তার জন্য আমি মানুষ খুন করি। এই সেই জিনিস যার বসবাস আমার মাথার উপরিভাগে। আমি তাকে দেখতে পারিনা। আমি তাকে ধরতে পারিনা। শুধু তাকে অনুভব করতে পারি, এবং শুনতে পারি, এবং মান্য করতে পারি।

মাঝে মাঝে সে কয়েকদিনের জন্য আমাকে একা থাকতে দেয়। তারপর হঠাৎ আমি তাকে অনুভব করতে পারি, আমার মগজের উপরে সে খামচে উঠে যাচ্ছে। আমি তার ফিসফিসানি পরিষ্কার শুনতে পারি। সে বলতে থাকে জলাভূমির দিক দিয়ে কেউ একজন আসছে।

আমার জানা নেই সে তাদের সম্পর্কে কিভাবে জানে। সে নিশ্চয়ই তাদেরকে দেখতে পায়না তবুও তাদের নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারে।

“এক ভবঘুরে এইলসওরদি রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আসছে। খাটো, মোটা, মাথায় টাক। নাম মাইক। সে বাদামী সোয়েটার আর নীল ওভারঅল পরে আছে। সে সূর্য ডোবার দশ মিনিটের ভেতর জলাভূমি পার হবে। আবর্জনার স্তুপের পাশের বড় গাছটার নীচে দাঁড়াবে।‘’

‘’ভালো হয় গাছটার পিছনে লুকিয়ে থাকলে। অপেক্ষা করো যতক্ষণ পর্যন্ত না সে জ্বালানি কাঠ টোকানো শুরু করে। এরপর কি করতে হবে তুমি জানো। কুড়ালটা নিয়ে আসো। যাও। তাড়াতাড়ি করো।‘’

মাঝে মাঝে ইনোক কে জিজ্ঞেস করি সে আমাকে কি দেবে। সাধারণত তাকে আমি বিশ্বাসই করি। যাই হোক আমি জানি আমাকে এটা করতেই হবে। তাই তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলাই ভালো। ইনোক কোন বিষয়েই ভুল করে না এবং আমাকে বিপদ থেকে মুক্ত রাখে।

ঠিক তাই, সে সবসময়ই সেটা করে আসছে—গতবারের আগ পর্যন্ত।

এক রাতে আমার কুটিরে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম তখন সে এই মেয়েটি সম্পর্কে বললো।

সে ফিসফিসিয়ে বললো ‘’মেয়েটি তোমার সাথে দেখা করতে আসছে। সুন্দর একটি মেয়ে। পুরো কালো পোষাক পরে আছে। তার মাথার গুণাবলী চমৎকার—হাড়গুলি সুন্দর। খুব সুন্দর।‘’

প্রথমে ভেবেছি সে আমার উপহার নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু ইনোক আসলে সত্যিকারের মানুষ নিয়ে বলছিলো।  

‘’সে দরজায় আসবে এবং তার গাড়ি ঠিক করার জন্য তোমাকে সাহায্য করতে বলবে। সে বিকল্প রাস্তা ধরে শহরে যেতে চাচ্ছিলো। এখন গাড়ী ডোবায় আটকেছে আর গাড়ীর চাকা একটা বদলাতে হবে।‘’

ইনোক যানবাহনের চাকা নিয়ে কথা বলছে এটা শুনতে বেশ হাস্যকর লাগছিলো। কিন্তু ইনোক এগুলো বিষয়ে জানতো। সে সবকিছুই জানে।

‘’তুমি তাকে সাহায্য করতে যাবে। সাথে কিছু নিও না। তার গাড়ীতে রেঞ্চ আছে। সেটাই কাজে লাগাবে।‘’

এইবার আমি একটু প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলাম। ঘ্যান ঘ্যান করে বললাম ‘’আমি এটা করবো না, করতে পারবো না।‘’

সে হেসে উঠলো এবং বললো আমি কাজটা না করলে আমাকে সে কি করবে। সে আমাকে সেটা বারবার বলতে লাগলো, বলেই চললো।

‘’আরো ভালো হয় যদি এটা তোমার সাথে না করে মেয়েটির সাথে করি।‘’ ইনোক আমাকে মনে করিয়ে দিলো ‘’নাকি তুমি চাও আমি—‘’

‘’না!’’ আমি বললাম ‘’না। আমি করবো।‘’

‘’সে যাই হোক’’ ইনোক ফিসফিসিয়ে বললো ‘’আমি নিরুপায়। মাঝে মাঝে আমাকে এভাবে পরিচর্যা করতে হবে। আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আমাকে শক্তিশালী করার জন্য। যেনো আমি তোমার সেবা করতে পারি। যেনো তোমাকে জিনিস দিতে পারি। এইজন্যই তুমি আমার নির্দেশ মতো চলবে। যদি না চলো তাহলে আমি এখানে থাকবো এবং—‘’

‘’না!’’ আমি বললাম ‘’না। আমি করবো।‘’

এবং করলাম।

মেয়েটি আর কয়েক মিনিট পরেই দরজায় টোকা দিলো, এবং ইনোক যেমনটা বলেছিলো ঠিক সেরকমই। মেয়েটি সোনালী চুলের সুন্দরী—সোনালী চুল আমার ভালো লাগে। মেয়েটিকে নিয়ে যখন জলার দিকে গেলাম আমি খুশী ছিলাম এই ভেবে যে আমাকে তার চুলের কোন ক্ষতি করতে হবে না। রেঞ্চ দিয়ে তার ঘাড়ের পিছনে বাড়ি দিলাম।

ইনোক আমাকে কি করতে হবে ধাপে ধাপে বলে দিলো।

কুড়াল ব্যবহারের পর তার শরীরটা চোরাবালিতে ফেলে দিলাম। ইনোক আমার সাথেই ছিলো। সে আমাকে হিলের ছাপের ব্যাপারে সতর্ক করে দিলো। সেগুলো মুছে দিলাম।

আমি গাড়ীটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম, কিন্তু সে আমাকে দেখালো কিভাবে পচা কাঠের গুঁড়ি দিয়ে উল্টে ফেলানো যাবে। গাড়ীটা পুরাপুরি ডুববে কিনা নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু ডুবেছিলো এবং দ্রুতই।

গাড়ীটা মিলিয়ে যেতে হাঁফ ছাড়লাম। এরপর রেঞ্চটারও একই গতি করলাম।

ইনোক আমাকে বাড়ী যেতে বললো, গেলাম, এবং সাথে সাথে অনুভব করলাম একধরণের স্বপ্নীল অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। 

ইনোক এবার আমার জন্য বাড়তি বিশেষ কিছুর কথা দিয়েছিলো এবং আমি সাথে সাথে ঘুমিয়ে গেলাম। ইনোক যখন জলাভূমিতে তার পুরষ্কার সংগ্রহ করতে লাফিয়ে আমাকে ছেড়ে গেলো তেমন টেরই পাইনি। 

আমি জানিনা কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম। বেশ লম্বা সময় ধরে হবে হয়তো। যতদূর মনে করতে পারি আমি জেগে উঠছিলাম এবং বুঝতে পাছিলাম ইনোক আবার ফিরে এসেছে এবং অনুভব করছিলাম কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।

পুরোপুরি জেগে উঠলাম কারণ দরজায় ধাক্কাধাক্কি হচ্ছিলো।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। অপেক্ষা করলাম ইনোকের ফিসফিসানির জন্য, আমাকে বলে দিতে আমি কি করবো। 

কিন্তু ইনোক ঘুমাচ্ছিলো। সবসময় ঘুমায়—এটার পরে। কয়েকদিন তাকে কিছুই জাগাতে পারবেনা; এবং এই কয়টা দিন আমি মুক্ত, স্বাধীন। এবং সাধারণত এই স্বাধীনতা আমি উপভোগ করি কিন্তু এই মুহূর্তে আমার তার সাহায্যের দরকার ছিলো। 

দরজায় ধাক্কার শব্দ আরো বেড়ে যাওয়ায় আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। 

উঠে দরজা খুলে দিলাম। বুড়ো শেরিফ শেলবি ঘরে ঢুকে বললেন ‘’চলো সেথ, আমি তোমাকে জেলে নিয়ে যাচ্ছি।‘’

আমি কিছু বললাম না। তার পুঁতির মতো ছোট কালো চোখগুলো আমার ঘরের চারদিকে দেখতে লাগলো। উনি যখন আমার দিকে তাকালেন মনে হলো কোথাও লুকাই, আমি সাংঘাতিক ভয় পাচ্ছিলাম।

তিনি ইনোক কে দেখতে পেলেন না, অবশ্যই কেউ দেখেও না। কিন্তু সে ছিলো। আমি অনুভব করতে পাচ্ছিলাম সে আমার খুলির উপরে, চুলের চাদরের নীচে, বাচ্চাদের মতোই আরাম করে ঘুমাচ্ছে।

শেরিফ বললেন ‘’এমিলি রবিনস এর বাবা-মা জানিয়েছে তার এই জলার শর্টকাট রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। আমরা গাড়ীর চাকার ছাপ অনুসরণ করে পুরানো চোরাবালি পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছি।‘’

ইনোক গাড়ীর চাকার ছাপের কথা ভুলে গিয়েছে। আমার আর কিইবা বলার আছে, এছাড়া শেরিফ বললেন ‘’তুমি যা বলবে তোমার বিরুদ্ধে সেটা ব্যবহৃত হবে। চলো সেথ।‘’

আমি তার সাথে গেলাম। আমার আর কিছু করার ছিলো না। তার সাথে শহরে গেলাম এবং সব নিষ্কর্মা লোকজন গাড়ী তাড়া করার চেষ্টা করলো। সেই ভীড়ের মধ্যে মহিলারাও ছিলো। তারা পুরুষদের প্রতি চিৎকার করছিলো আমাকে ‘ধরার’ জন্য।

কিন্তু শেরিফ শেলবি তাদের ঠেকিয়ে রাখলেন এবং আমাকে আড়াল করে নিরাপদে, অক্ষত ভাবে জেলখানায় নিয়ে গেলেন। মাঝের সেলটাতে আমাকে আটকে রাখলেন। আমার দুইপাশের সেলদুটি খালি থাকায় আমি একদম একা ছিলাম। একদম একা ইনোক বাদে, যে কিনা পুরো ঘটনা ঘুমিয়ে পার করে দিলো। তখন সময়টা একদম ভোরবেলা। শেরিফ শেলবি সাথে কিছু লোকজন নিয়ে আবার বের হয়ে গেলেন। আমি ধারণা করলাম উনি চোরাবালি থেকে শরীর উদ্ধারের চেষ্টা করবেন, যদি পারেন আরকি। উনি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করেননি। এতে আমি অবাক হয়েছিলাম।

কিন্তু চার্লি পটার, সে ছিলো আলাদা প্রকৃতির। সে সব কিছু জানতে চেয়েছে। শেরিফ শেলবি বাইরে গেলে তাকে জেলখানার ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে যায়। সে সকালের নাস্তা এনে দিয়ে কিছুক্ষণ পর আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে আর আমাকে প্রশ্ন করতে থাকে। 

আমি স্থির রইলাম। চার্লি পটারের মতো বোকার সাথে কথা বলে কোন ফায়দা নেই। সে আমাকে পাগল ভাবতো বাইরের সেই উত্তেজিত জনতার মতোই। শহরের বেশীর মানুষই আমাকে পাগল মনে করে—আমার মায়ের কারণে, আমার তাই ধারণা, এবং আরো একটা কারণ হলো আমি জলার পাশে একা একা থাকি।

আর চার্লি পটার কে বলবোই বা কি? ইনোকের কথা বললে সে এমনিতেও বিশ্বাস করবে না।

তাই আমি কিছু বললাম না।

বরং শুনলাম।

চার্লি পটার এমিলি রবিনসের সন্ধান করা নিয়ে বললো, আরো বললো শেরিফ শেলবি কিভাবে কয়েকদিন আগে হওয়া কিছু নিখোঁজ ঘটনা নিয়ে সন্দেহ করেছেন। পটার বললো এটা নিয়ে বিশাল বিচারকার্য চলবে আর জেলা এটর্নি স্বয়ং আসবেন। সে আরোও শুনেছে আমাকে দেখার জন্য তারা একজন ডাক্তার পাঠাবে। তো নাস্তা খাওয়া শেষ করা মাত্রই ডাক্তার এসে হাজির হলো। পটার দ্রুত তাকে ঢুকালো যেনো বাইরের লোকজন ভিতরে না ঢুকে যায়। তারা মনে হয় আমাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছিলো।

ডাক্তার একজন ছোটখাটো মানুষ, থুতনিতে হাস্যকর ধরণের দাঁড়ি ছিলো। উনি পটার কে অফিসের সামনে পাঠিয়ে দিয়ে আমার সেলের বাইরে বসলেন এবং কথা বললেন।

তার নাম ছিলো ড: সিলভারস্মিথ।

তখন পর্যন্তও আমি কোন কিছু অনুভব করতে পারছিলাম না। সবকিছু এতো দ্রুত ঘটেছে যে আমি ভাবার সুযোগও পাইনি।

সব কিছু কেমন একটা স্বপ্নের অংশ বলে মনে হচ্ছিলো। শেরিফ, উত্তজিত জনতা, তারপর বিচারের কথাবার্তা, ফাঁসির ইচ্ছা এবং জলাভূমির লাশ।

কিন্তু ড: সিলভারস্মিথের উপস্থিতিতে সবকিছু কেমন করে যেনো বদলে গেলো। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিলো সে এমন এক ডাক্তার যে আমাকে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠাতে চায়।

তার প্রথম প্রশ্নই ছিলো আমার মায়ের কি হয়েছিলো? সে আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে বলে মনে হচ্ছিলো তার ফলে আমার জন্য কথা বলাটা সহজ হয়েছিলো।

অচিরেই দেখলাম তাকে অনেক কিছু বলছি। আমার মা আর আমি কিভাবে সেই কুটিরে থেকেছি, মা কিভাবে প্রণয়োদ্দীপক পানীয় তৈরী করে বিক্রি করতো, বলেছি বিশাল পাতিল সম্পর্কে এবং কিভাবে আমরা সারা রাত ধরে ঔষধি গাছ গাছড়া সংগ্রহ করতাম, বলেছি সেই রাতগুলো নিয়ে যখন মা একা একা চলে যেতো আর দূর থেকে আসা বিচিত্র সব আওয়াজ শুনতাম।

আমি খুব বেশী কিছু বলতে চাইনি কিন্তু ডাক্তার জানতো। সে জানতো সবাই তাকে ডাইনী বলে ডাকতো। এমনকি মা কিভাবে মারা গিয়েছে সেটাও সে জানতো—স্যান্টো ডিনোরেলি মাকে ছুরি মেরেছিলো কারণ তার মেয়েকে মা পানীয় তৈরী করে দিয়েছিলো যে কিনা এক শিকারীর সাথে ভেগে গিয়েছিলো। এরপর থেকে জলাভূমিতে যে আমি একাই থাকতাম সেটাও সে জানতো।

কিন্তু সে ইনোক সম্পর্কে জানতো না। সেই ইনোক যে কিনা সবসময় আমার মাথার উপরে থাকে সে তখনও ঘুমাচ্ছিলো আমার সাথে কি হচ্ছিলো সেসব কিছু না জেনেই।

কোন এক ভাবে আমি ড: সিলভারস্মিথের সাথে ইনোক সম্পর্কে বলতে শুরু করলাম। আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম আসলে আমি মেয়েটিকে মারিনি। তাই ইনোকের কথা বলতে হলো। এটাও বললাম আমার মা কিভাবে জঙ্গলে একটা দর কষাকষি করেছিলো। সে আমাকে তার সাথে যেতে দিতো না—আমি মাত্র বারো বছরের তখন—কিন্তু মা একটি ছোট বোতলে আমার রক্ত নিয়েছিলো।

তারপর মা যখন ফিরে এলো ইনোক তার সাথে ছিলো। মা বললো ইনোক সারাজীবন আমার থাকবে, আমার দেখাশোনা করবে, আমাকে সব ধরণের সাহায্য করবে।  

আমি খুব সতর্কতার সাথে এগুলো বললাম আর ব্যাখ্যা করলাম আমি যা করি নিরুপায় হয়েই করি কারণ মা মারা যাওয়ার পর ইনোক আমাকে পরিচালিত করেছে।

হ্যাঁ, মা যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলো ঠিক সেভাবেই ইনোক আমাকে রক্ষা করেছে। সে জানতো আমি একা একা চলতে পারবো না। ড: সিলভারস্মিথের কাছে এগুলো আমি স্বীকার করলাম কারণ তাকে আমার বিজ্ঞ মানুষ মনে হয়ছিলো, ভেবে ছিলাম সে বুঝবে।

সেটা ভুল ছিলো।

আমি বলা মাত্রই ধরতে পারলাম। কারণ ড: সিলভারস্মিথ যখন সামনে ঝুঁকে বসে, তার ছোট দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ঘন ঘন ‘আচ্ছা’ ‘হ্যাঁ’ বলছিলো তখন অনুভব করলাম তার চোখগুলো আমাকে খেয়াল করছে। ঠিক সেই মারমুখী লোকগুলোর মতোই। খারাপ দৃষ্টি। অবিশ্বাসের দৃষ্টি।

তারপর সে আমাকে নানা রকম আজব আজব প্রশ্ন করা শুরু করলো। প্রথমেই ইনোক সম্পর্কে, যদিও বুঝলাম সে ইনোক কে বিশ্বাস করার ভান করছে। জিজ্ঞেস করলো ইনোক কে না দেখলে তাকে শুনি কিভাবে। জিজ্ঞেস করলো আমি আরো কোন আওয়াজ শুনি কিনা। জানতে চাইলো এমিলি রবিনস কে খুন করার সময় আমার কেমন লেগেছিলো। আরেহ সে এমন ভাবে কথা বলছিলো যেনো আমি—পাগল! 

সে ইনোক সম্পর্কে না বুঝেই এতক্ষণ ধরে আমাকে বোকা বানাচ্ছিলো। সেটা ধরা গেলো যখন সে জানতে চাইলো আর কতজন মানুষ কে আমি হত্যা করেছি, তারপর যখন জিজ্ঞেস করলো ওদের মাথাগুলো কোথায়?

সে আমাকে আর বোকা বানাতে পারবেনা। 

আমি তার মুখের উপরে হেসে দিলাম, তারপর একটা ঝিনুকের থেকেও শক্ত ভাবে মুখ বন্ধ করে ফেললাম।

এর কিছুক্ষণ পরে সে হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেলো। আমি তাকে উদ্দেশ্য করে হেসে ফেললাম কারণ সে যা বের করতে চেয়েছিলো করতে পারেনি। সে আমার মায়ের, আমার এমনকি ইনোকের সব গোপন অন্ধিসন্ধি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলো কিন্তু পারেনি। আমি হাসলাম। তারপর ঘুমাতে গেলাম। প্রায় পুরো বিকেল জুড়ে ঘুমালাম।

যখন জেগে উঠলাম দেখলাম একজন নতুন মানুষ আমার সেলের সামনে দাঁড়ানো। তার ছিলো বিশাল, মাংসল হাসি হাসি চেহারা এবং দয়ালু দৃষ্টি। সে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে বললো ‘’হ্যালো সেথ। হালকা ঘুম দিলে? 

আমি মাথার উপরে খোঁজ করলাম। ইনোক কে টের পেলাম না। যদিও জানি সে আছে এবং তখনও ঘুমাচ্ছে। সে ঘুমের মধ্যেও খুব দ্রুত জায়গা বদলায়।

লোকটি বললো ‘’ভয় পেওনা, আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না।‘’

আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘’ডাক্তার আপনাকে পাঠিয়েছে?’’

লোকটা হেসে দিলো, বললো ‘’অবশ্যই না। আমার নাম ক্যাসিডি। এডউইন ক্যাসিডি। আমি জেলা এটর্নি এবং এখানকার দায়িত্বে আছি। আমি কি ভিতরে এসে বসতে পারি? কি বলো তুমি?’’

‘’আমি তো ভিতরে বন্দী’’ বলাম আমি।

মি. ক্যাসিডি বললেন ‘’আমি শেরিফের কাছ থেকে চাবি পেয়েছি। উনি চাবি বের করে আমার সেল খুলে দিলেন। সোজা ভিতরে ঢুকে আমার পাশে বেঞ্চে এসে বসলেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘’আপনি ভয় পাচ্ছেন না? আমাকে তো খুনী বলে মনে করা হচ্ছে।‘’

মি. ক্যাসিডি হাসলেন ‘’আরে সেথ, আমি তোমাকে ভয় পাচ্ছি না। আমি জানি তুমি কাওকে খুন করতে চাওনি।‘’

উনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন। আমি সরে গেলাম না। হাতটি ছিলো নরম, থলথলে। আঙ্গুলে একটা বিশাল হীরার আংটি ছিলো সেটা সূর্যের আলো লেগে ঝিলিক দিচ্ছিলো।  

‘’ইনোক কেমন আছে?’’ উনি বললেন।

 আমি লাফিয়ে উঠলাম।

‘’আহা ঠিক আছেতো। সেই গাধা ডাক্তারটা আমাকে বলেছে যখন রাস্তায় তার সাথে দেখা হলো। সে ইনোক সম্পর্কে কিছুই বোঝেনি তাই না সেথ? শুধু তুমি আর আমি ছাড়া।‘’

আমি ফিসফিস করে বললাম ‘’সেই ডাক্তার আমাকে পাগল ভাবছে।‘’

‘’শোন সেথ, ব্যাপারটা শুধু তোমার আর আমার ভিতরে, প্রথমে বিষয়টা আসলে বিশ্বাস করা কঠিনই বটে। কিন্তু আমি মাত্রই জলাভূমি ঘুরে এসেছি। শেরিফ শেলবি তার লোকজন নিয়ে সেখানে এখনো কাজ করে যাচ্ছে।‘’

‘’তারা কিছুক্ষণ আগেই এমিলি রবিনসের লাশ খুঁজে পেয়েছে। এবং আরো কিছু লাশও। একটা মোটা লোকের শরীর, একটা ছোট ছেলে আর কয়েকজন ইন্ডিয়ানের শরীর। চোরাবালি সব সংরক্ষণ করে রাখে বুঝলে?’’

আমি তার চোখগুলো খেয়াল করলাম, সেগুলো তখনও হাসি মাখানো। তাই আমি জানতাম এই লোকটিকে বিশ্বাস করা যায়।

‘’তারা যদি খোঁজা চালু রাখে তাহলে আরো শরীর খুঁজে পাবে তাইনা সেথ?’’

মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

‘’কিন্তু আমি সেখানে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করিনি। যতটুকু দেখেছি সেটাই বোঝার জন্য যথেষ্ট যে তুমি সত্যি কথাই বলছিলে। ইনোক তোমাকে দিয়ে এসব করিয়েছে তাইনা?’’

আমি আবার মাথা নাড়লাম।

মি. ক্যাসিডি আমার কাঁধে চাপ দিয়ে বললেন ‘’চমৎকার। এখন আমরা পরষ্পরকে বুঝতে পারছি। তাই তুমি আমাকে যেটাই বলবে তার জন্য তোমার দোষ দেবোনা।‘’

বললাম ‘’কি জানতে চান?’’

‘’ওহ অনেক কিছু। আমি ইনোক কে নিয়ে আগ্রহী বুঝলে? তো সে কতজন লোককে খুন করতে বলেছে –মানে মোট কতজন হবে?

‘’নয় জন’’ জানালাম।

‘’তাদের সবাই চোরাবালির নীচে পোঁতা?’’

‘’হ্যাঁ’’

‘’তাদের নাম জানো?’’

‘’অল্প কয়েক জনের।‘’ যা জানা ছিলো বললাম। ব্যাখ্যা করলাম ‘’ইনোক মাঝে মাঝে তাদের বর্ণনা দিতো আর আমি যেয়ে দেখা করতাম।‘’

মি. ক্যাসিডি মুখ টিপে হাসির মতো করলেন এবং একটা চুরুট বের করলেন। আমি ভ্রূ কুঁচকে ফেললাম।

‘’তুমি চাওনা আমি ধূমপান করি এহ?’’

‘’প্লিজ—আমার এটা পছন্দ না। আমার মা ধূমপানে বিশ্বাস করতো না; আমাকে কখনো করতে দেয়নি।‘’

মি. ক্যাসিডি এবার জোরে হেসে উঠলেন, তবে চুরুট নিভিয়ে দিলেন আর সামনে ঝুঁকে এলেন।

উনি ফিসফিস করে বললেন ‘’সেথ তুমি আমার জন্য একটা বড় সাহায্য হবে।‘’ 

‘’একজন জেলা এটর্নির কাজ কি জানো নিশ্চয়ই?’’

‘’তারা এক ধরণের উকিল তাইনা—বিচার-আচার, মামলা ইত্যাদি নিয়ে তাদের কাজ?’’

‘’ঠিক তাই। আমি তোমার বিচারের সময় থাকবো সেথ। তুমি নিশ্চয়ই ঐসব লোকদের সামনে হাজির হয়ে কি ঘটেছে এগুলো নিয়ে কথা বলতে চাওনা তাইতো?’’

‘’না চাইনা মি. ক্যাসিডি। শহরের ঐসব খারাপ নীচু প্রকৃতির লোকদের সামনে যেতে চাই না। তারা আমাকে ঘৃণা করে।‘’

‘’তাহলে কি করবে বলি। তুমি আমাকে সব খুলে বলো এবং আমি তোমার হয়ে কথা বলবো। এটা যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ হবে তাইনা?’’

আমি চাচ্ছিলাম ইনোক আমাকে সাহায্য করুক। কিন্তু সে ঘুমাচ্ছে। আমি মি. ক্যাসিডির দিকে তাকালাম এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।  

বললাম ‘’ঠিক আছে, আমি আপনাকে বলতে পারি।‘’

তো আমি যা জানতাম সব তাকে বললাম।

কিছুক্ষন পরেই তার মুচকি হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। আসলে উনি এতো আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন যে হাসি বা অন্য কিছুর ঝামেলা না করে শুধু শুনে যাচ্ছিলেন।

উনি বললেন ‘’আরেকটা ব্যাপার। আমরা শুধু শরীর খুঁজে পেয়েছি। এমিলি রবিনস সহ আর গুটি কয়েকজন কে সনাক্ত করতে পেরেছি। আমাদের জন্য সহজ হতো যদি আরো কিছু জানতে পারতাম। তুমি আমাকে এটা বলতে পারো সেথ।‘’

‘’ওদের মাথাগুলো কই?’’

আমি দাঁড়ালাম আর ঘুরে গেলাম। ‘’আমি আপনাকে এটা বলবো না। কারণ আমি জানি না।‘’

‘’জানো না?’’

‘’আমি ওগুলো ইনোক কে দিয়ে দিতাম।‘’ব্যাখ্যা দিলাম। ‘’আপনি বুঝতে পারছেন না কেনো—এ কারণেই তো তার জন্য আমাকে মানুষ খুন করতে হয়। সে তাদের মাথাগুলো চায়।‘’

মি. ক্যাসিডি কে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিলো।

আমি বলতে থাকলাম ‘’সে সবসময় আমাকে মাথাগুলো কেটে ফেলতে বাধ্য করে তারপর সেগুলো রেখে চলে আসি। শরীরগুলো চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে বাড়ী চলে যাই। সে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় এবং পুরষ্কৃত করে। এরপর সে চলে যায়—মাথাগুলোর কাছে। সেটাই তার চাওয়া।‘’

‘’সেথ, সে কেনো সেগুলো চায়?’’

বললাম ‘’দেখুন ওগুলো পেয়েও আপনাদের কোন লাভ হবে না। কারণ সম্ভবত আপনারা কিছু চিনতে টিনতে পারবেন না।‘’

মি. ক্যাসিডি সোজা হয়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ‘’কিন্তু কেনো তুমি ইনোক কে এসব করতে দাও?’’

‘’অবশ্যই করতে হবে। নইলে সে এটা আমার সাথে করবে। এই হুমকিটাই সে আমাকে দেয় সবসময়। তার এসব লাগবেই। তাই আমি তাকে মেনে চলি।‘’

আমি হাঁটাহাঁটি করছিলাম আর মি. ক্যাসিডি আমাকে লক্ষ্য করছিলেন, কিন্তু কিছু বলেননি। তাকে হঠাৎ করেই ভীত সন্ত্রস্ত মনে হচ্ছিলো এবং যখন কাছে গেলাম একটু পিছনে হেলে গেলেন।

বললাম ‘’বিচারের কাজ চলাকালীন আপনি অবশ্যই সব বুঝিয়ে বলবেন। ইনোক সম্পর্কে, সবকিছু সম্পর্কে।‘’

উনি মাথা নাড়লেন।

‘’আমি ইনোক সম্পর্কে কিছু বলবো না, তুমিও বলবেনা।‘’ মি. ক্যাসিডি বললেন ‘’এমনকি কেউ জানবে না যে ইনোক বিদ্যমান।‘’

‘’কেনো?’’

‘’আমি তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি সেথ। তুমি তো জানোই লোকজন কি বলবে যদি তুমি তাদেরকে ইনোকের কথা বলো? তারা তোমাকে পাগল বলবে! এবং তুমি চাওনা তেমন কিছু হোক।‘’

‘’না। কিন্তু আপনি কি করতে পারবেন? আমাকে কিভাবে সাহায্য করবেন?’’ 

মি. ক্যাসিডি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ‘’তুমি ইনোক কে ভয় পাও তাইনা? তাই আমি গভীর ভাবে চিন্তা করলাম। কেমন হয় যদি তুমি ইনোক কে আমার কাছে দিয়ে দাও?’’

আমি ঢোক গিললাম।

‘’হ্যাঁ। ধরো ইনোক কে এক্ষুনি আমার কাছে দিলে। বিচার চলাকালীন আমি তোমার হয়ে তার দেখাশোনা করলাম। তখন তাহলে সে আর তোমার থাকলো না আর তোমারও তাকে নিয়ে কিছুই বলতে হলো না। সে এমনিতেও মনে হয় চায় না মানুষ জানুক সে কি করে।‘’

বললাম ‘’ঠিক তাই। ইনোক খুব রেগে যাবে। সে একটা গোপনীয় বিষয়, বুঝলেন? 

কিন্তু জিজ্ঞেস না করে তো তাকে আপনার কাছে দিতে পারিনা। সে এখন ঘুমাচ্ছে।‘’

‘’ঘুমাচ্ছে?‘’

‘’হ্যাঁ। আমার খুলির উপরে। আনি তাকে দেখতে পাবেন না অবশ্য।‘’

মি. ক্যাসিডি আমর মাথার দিকে তাকিয়ে আবার একটু হাসলেন।

উনি বললেন ‘’ওহো ও জেগে উঠলে আমি তাকে সব বুঝিয়ে বলবো। যখন জানবে এসব কিছু ভালোর জন্যই করা হচ্ছে, আমার ধারণা সে খুশীই হবে।‘’

ধীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম ‘’আচ্ছা—তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু কথা দিন যে খুব ভালোমতো তার দেখাশোনা করবেন।‘’

‘’অবশ্যই’’

‘’এবং অন্য কাউকে বলবেন না’’

‘’কাউকেই না।‘’

‘’ইনোক যা চায় তা যদি না দেন তাহলে আপনি জানেন যে সে আপনার সাথে কি করতে পারে।‘’ মি. ক্যাসিডি কে সতর্ক করে দিলাম। ‘’সে আপনার কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করে নেবে।‘’  

‘’চিন্তা করো না সেথ।‘’

আমি মিনিট খানেক স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। কারণ সাথে সাথে বুঝলাম কিছু একটা কানের কাছে সরে এসেছে। 

ফিসফিসিয়ে বললাম ‘’ইনোক, আমাকে শুনতে পাচ্ছো?’’

সে শুনতে পেয়েছে।

তারপর সব কিছুই তার ব্যাখ্যা রলাম। কিভাবে তাকে মি. ক্যাসিডির কাছে দিচ্ছি।

ইনোক একটা কথাও বলেনি।

মি. ক্যাসিডিও কিছু বলেননি। উনি শুধু বসে রইলেন আর দাঁত বের করে হাসতে লাগলেন। মনে হয় আমার শূন্যের সাথে কথা বলাটা তার অদ্ভুত লাগছিলো।

‘’মি. ক্যাসিডির কাছে যাও।‘’ ফিসফিসিয়ে বললাম ‘’উনার কাছে যাও, এখনি।‘’

এবং ইনোক চলে গেলো। 

অনুভব করলাম মাথার ভার কমে গেলো। শুধু এইটুকুই হলো কিন্তু বুঝলাম সে চলে গিয়েছে। 

জিজ্ঞেস করলাম ‘’আপনি তাকে অনুভব করছেন মি. ক্যাসিডি?’’

‘’কি—ও হ্যাঁ অবশ্যই।‘’ বলে উঠে দাঁড়ালেন।

তাকে বললাম ‘’ইনোকের ভালো যত্ন নেবেন।‘’

‘’সর্বোত্তম যত্ন নেবো।‘’

‘’আপনি হ্যাট পরবেন না।‘’ তাকে সতর্ক করলাম। ‘’ইনোক হ্যাট পছন্দ করে না।‘’

‘’সরি, ভুলে গিয়েছিলাম। তো সেথ এবার বিদায় নিতে হচ্ছে। তুমি আমার জন্য বিশাল একটা সাহায্য ছিলে—এবং এখন থেকে আমরা ইনোকের বিষয়টা ভুলে যেতে পারি।‘’

‘’আমি আবার এসে বিচার বিষয়ক কথা বলবো। ঐ ডা: সিলভারস্মিথ তোমাকে পাগল হিসেবে চালাতে চেষ্টা করবে। সব থেকে ভালো হয় তুমি তাকে যা যা বলেছো সেগুলো যদি অস্বীকার করো—যেহেতু ইনোক এখন আমার কাছে।‘’

বুদ্ধিটা ভালোই আর মি. ক্যাসিডি একজন চৌকষ মানুষ।

‘’আপনি যেভাবে বলবেন মি. ক্যাসিডি, শুধু ইনোকের সাথে ভালো হবেন তাহলে সেও আপনার সাথে ভালো করবে।‘’

তারপর আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে মি. ক্যাসিডি আর ইনোক চলে গেলো।আমি আবার ক্লান্ত বোধ করতে লাগলাম। হয়তো সেটা ধকলের কারণে অথবা অদ্ভুত লাগছিলো এই ভেবে যে ইনোক চলে গিয়েছে। যাইহোক, লম্বা সময় ধরে ঘুমে ফেরত গেলাম।

যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন রাতের বেলা। বুড়ো চার্লি পটার আমার রাতের খাবার নিয়ে সেলের দরজা ধাক্কাচ্ছিলো।

সে লাফিয়ে উঠলো যখন তাকে হ্যালো বললাম এবং পিছু হটে গেলো।

সে চেঁচিয়ে বললো ‘’খুনী! তারা জলাতে নয়টা লাশ পেয়েছে। পাগল শয়তান কোথাকার!’’

‘’আরে চার্লি, তোমাকে তো সবসময় আমার বন্ধু ভেবেছি’’

‘’উন্মাদ! আমি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাচ্ছি—সারা রাতের জন্য তোমাকে বন্ধ রেখে। শেরিফ দেখবে কেউ যেনো জেল ভেঙ্গে তোমাকে ফাঁসিতে না ঝুলায়—আমার মতে সে তার সময় নষ্ট করছে।‘’

এরপর চার্লি সব লাইট নিভিয়ে চলে গেলো। শুনতে পেলাম সামনের দরজা দিয়ে বের হয়ে সে তালা লাগিয়ে দিলো এবং আমি জেলখানায় একা হয়ে গেলাম। 

একদম একা! অদ্ভুত লাগছিলো এতোগুলো বছর পর এই প্রথম আমি একা, একদম একা—ইনোক কে ছাড়া।

মাথার উপরে আঙ্গুল চালালাম। কেমন খালি খালি আর আজব লাগছিলো। 

জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছিলো, সেখানে দাঁড়িয়ে খালি রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইনোক সবসময় চাঁদ ভালোবাসতো। চাঁদ তাকে প্রাণবন্ত করে। করে অস্থির, লোভী। আমি ভাবছিলাম তার এখন কেমন লাগছে মি. ক্যাসিডির সাথে।

বোধহয় অনেকক্ষণ ধরে এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পা গুলো অবশ হয়ে গিয়েছিলো যখন সামনের দরজায় হাতড়ানোর আওয়াজ শুনে ঘুরে দাঁড়ালাম।

ক্লিক শব্দে দরজা খুলে গেলো, এবং মি. ক্যাসিডি দৌড়ে ভিতরে ঢুকলেন।

‘’তাকে আমার থেকে সরাও’’ চিৎকার করে উঠলেন ‘’তাকে নিয়ে নাও।‘’

জিজ্ঞেস করলাম ‘’কি হয়েছে?’’

‘’ইনোক—তোমার সেই জিনিস—আমি ভেবেছিলাম তুমি পাগল—হয়তো আমিই পাগল—কিন্তু তাকে সরাও।‘’

‘’ওহো মি. ক্যাসিডি! আমিতো বলেইছি ইনোক কেমন।‘’

‘’সে এখন উপরে হামাগুড়ি দিচ্ছে। আমি তাকে অনুভব করতে পারছি। এবং তাকে শুনতে পারছি। তার ফিসফিসানি!’’

‘’কিন্তু এগুলো সবই তো আপনাকে বলেছি মি. ক্যাসিডি। সে আপনার কাছে কিছু চাচ্ছে, তাই না? আপনি জানেন কি সেটা। এবং আপনাকে সেটা দিতে হবে। আপনি কথা দিয়েছেন।‘’

‘’আমি পারবো না। তার জন্য আমি খুন করবো না—সে আমাকে দিয়ে করাতে পারবে না—‘’

‘’সে পারবে। এবং সে করাবে।‘’

মি. ক্যাসিডি সেলের দরজার শিক আঁকড়ে ধরলেন। ‘’সেথ আমাকে সাহায্য করো। ইনোক কে ডাকো। তাকে ফেরত নাও। তাকে তোমার কাছে ফেরত নেওয়াও, তাড়াতাড়ি করো।‘’

‘’ঠিক আছে মি. ক্যাসিডি’’

‘আমি ইনোক কে ডাকলাম। সে উত্তর দিলো না। আবার ডাকলাম। নীরবতা।

মি. ক্যাসিডি কাঁদতে শুরু করলেন। এটা আমাকে অবাক করলো এবং তার জন্য একটু মায়াই লাগলো। মোটের উপর উনি আসলে বিষয়টা বোঝেননি। আমি জানি ইনোক আসলে কি করতে পারে যখন সে ঐরকম ভাবে ফিসফিসায়। সে প্রথমে চাপ দেবে, তারপর অনুরোধ করবে, তারপর হুমকি দেবে—

মি. ক্যাসিডি কে বললাম ‘’আপনার উচিৎ তাকে মানা। সে কি বলেছে কাকে খুন করতে হবে?’’

মি. ক্যাসিডির আমার প্রতি মনোযোগো ছিলো না। উনি শুধু কেঁদেই চললেন। তারপর জেলখানার চাবিগুলি বের করে আমার পাশের সেলটি খুলে ফেললেন। ভিতরে ঢুকে দরজা আটকে দিলেন। 

ফুঁপিয়ে বললেন ‘’আমি করবো না। আমি করবো না! করবো না!’’

‘’কি করবেন না?’’

‘’আমি হোটেলে যেয়ে ড: সিলভারস্মিথ কে খুন করবো না আর তার মাথা ইনোক কে দেবোনা। আমি এখানে থাকবো। এই সেলের ভিতর। এখানে আমি নিরাপদ। উফ তুই একটা শয়তান, দানব—‘’

তিনি ধপ করে একপাশে বসে পড়লেন। আমাদের সেলের মাঝখানের মোটা শিকের ফাঁক দিয়ে তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। উনি একদম কুঁজো হয়ে বসে দুই হাতে মাথার চুল ছিঁড়ছিলেন।

ডেকে বললাম ‘’আপনার করাই উচিৎ। নয়তো ইনোক কিছু একটা করে ফেলবে। প্লিজ, মি. ক্যাসিডি—ওহ—তাড়াতাড়ি—‘’

এরপর মি. ক্যাসিডি একটা গোঙরানি দিলেন তারপর হয়তো জ্ঞান হারালেন। কারণ এরপর তিনি আর কিছু বলেননি আর খামচানিও বন্ধ হয়ে গেলো। একবার তাকে ডাকলাম কিন্তু উত্তর দেননি।

তো আমি আর কি করতে পারি? আমার সেলের অন্ধকার কোনায় বসে চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চাঁদের আলো সবসময় ইনোক কে বন্য করে তোলে। 

এরপর মি. ক্যাসিডি চিৎকার করতে লাগলেন। আওয়াজ জোরে হচ্ছিলো না। গলার গভীর থেকে বের হচ্ছিলো। উনি একদম নড়ছিলেন না শুধু চিৎকার করছিলেন।

আমি জানতাম সেটা ইনোক, সে যা চাচ্ছিলো নিয়ে নিচ্ছে—উনার কাছ থেকে। এখন আর তাকিয়ে থেকে কি ফায়দা? তাকে থামানো যাবেনা। সতর্ক করেছিলাম মি. ক্যাসিডি কে।

আমি দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে সেখানেই বসে রইলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা শেষ হলো।

এরপর যখন ঘুরলাম মি. ক্যাসিডি তখনও পড়ে আছেন শিকে হেলান দিয়ে। আর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছিলো না।

নাহ যাচ্ছিলো। মৃদু গরগর। কোমল, দূরবর্তী গরগর আওয়াজ। এটা ইনোকের খাওয়ার পরের গরগরানি। তারপর শুনলাম আঁচরের শব্দ। ইনোকের থাবার আঁচর যখন যে লাফায় কারণ সে খেয়েছে।

গরগরানি আর আঁচরের আওয়াজ আসছিলো মি. ক্যাসিডির মাথার ভিতর থেকে।

হ্যাঁ সেটাই ইনোক এবং এখন সে খুশী।  

আমিও খুশী হলাম। 

শিকের ভিতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে মি. ক্যাসিডির পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে নিলাম। আমার সেলের দরজা খুললাম এবং আবার মুক্ত হয়ে গেলাম। মি. ক্যাসিডি চলে যাওয়ায় এখানে আর থাকার কোন প্রয়োজন নেই। আর ইনোকও থাকবে না। তাকে ডাক দিলাম।

‘’ইনোক, এখানে!’’

সেটা ছিলো আমার জন্য সত্যিকারের ইনোক কে প্রায় কাছ থেকে দেখার ক্ষণ—এক ধরণের সাদা রেখা মি. ক্যাসিডির খুলির পিছনের খেয়ে ফেলা বিরাট লাল গর্ত দিয়ে সেটা একটা ঝলকের মতো বের হয়ে আসলো।

তারপর অনুভব করলাম একটা নরম, ঠান্ডা, থলথলে ওজন আবার আমার মাথায় অবতরণ করলো এবং জানতাম ইনোক তার বাড়ী ফিরে এসেছে।

করিডোর ধরে হেঁটে যেয়ে জেলখানার বাইরের দরজা খুললাম।

আমার মগজের ছাদে ইনোকের ছোট ছোট পা গুলো টুক টুক করে চলতে লাগলো।

আমরা একসাথে রাতের ভিতরে হেঁটে গেলাম। চাঁদ জ্বলজ্বল করছিলো, সবকিছু স্থবির, কানের কাছে শুনতে পেলাম ইনোকের নরম, আনন্দিত হাসির শব্দ।

                   

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত