| 4 মে 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: এক অসমাপ্ত কথা: কচ ও দেবযানী । পারমিতা চক্রবর্ত্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

চারিদিকে সোহালী  আলো৷সুন্দর ফুল ফুটেছে বাগানে৷ অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে বিস্মিত হন দেবযানী৷ বন্যতা তাঁকে বেশী আকর্ষণ করে৷ পিতার খুব প্রিয় কন্যা দেবযানী৷ তাঁর পিতার কাছে অনেক শিষ্য শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতেন৷ কিন্তু তাদের সবার থেকে কচকে একেবারে অন্য রকম বলে তাঁর মনে হয়। দেবযানী  মনে মনে ভাবতেন তাঁর হৃদয়ের সংবাদ কী ভাবে পড়তে জানেন কচ৷ দেবযানীর এমন সুন্দর রূপ দেখে লোকের চোখ ঝলসে যেত৷ আর সেই কারণেই ধারণা হয়েছিল দেবযানীর তাঁর রূপের আগুনে নিশ্চই পুড়ে মরবেন কচ। দেবযানীও কচের রূপগুণে মুগ্ধ৷ প্রতিদিনই তিনি নানা ধরনের ফরমায়েশ করতেন কচকে৷ কচ খুব আনন্দের সাথে তাঁর সকল আবদার পূরণ করতেন৷ প্রতিদিন হরেক রকমের ফুলের আবদার করতেন দেবযানী। আর কচ সারা বন তন্যতন্য করে খুঁজে এনে দিতেন সে সব৷ দেবযানী পিতৃপরিচয়ের কারণে অহংকারী  প্রকৃতির ছিলেন। না শব্দটা শুনতে একদমই পছন্দ করতেন না ৷ তাঁর সকল আবদার পূরণ করতেন গুরু শুক্রাচার্য৷ তিনি কন্যাকে এমন রূপে মানুষ করেছিলেন যাতে তাঁর মনে কোন দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব না থাকে নিজেকে নিয়ে৷ দেবযানী আসলে গুরু শুক্রাচার্যর মানসকন্যা ৷ তিনি তাঁর হৃদয়ের সকল সূক্ষ্মতী সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে সুন্দর ভাবে আরোপ করেছিলেন দেবযানীর উপর৷ দেবযানী জানতেন  তাঁর কোন দাবী পিতা অপূর্ণ রাখবেন না। দেবযানী প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের ফুলের আবদার করতেন আর কচ বনের পর বন ঘুরে ঘুরে সেই সব ফুল তুলে আনতেন। এমনই এক দুঃসহ দিনে দানবদের পাল্লায় পড়েন তিনি৷ তারা তাঁকে হত্যা করে মাংস খাইয়ে দেয় কুকরকে৷ কচের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দ্বন্দ্বে থাকে তারা৷ তাই তো তারা কচকে হত্যা করে৷ কচকে ছাড়া দেবযানীর পৃথিবী অন্ধকারে পতিত হয়৷ গোটা পৃথিবীটা তার কাছে শূন্য মনে হয়৷ তিনি পিতা শুক্রাচার্যের কাছে প্রার্থনা করেন মন্ত্রবলে খুঁজে দিতে তাঁর প্রিয়তম কচকে ৷

– পিতা নিশ্চই সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে কচের জীবনে৷ তাই তিনি কুঠিরে ফিরে আসতে পারেননি৷ আপনি কিছু একটা করুন৷ আমি যে স্থির থাকতে পারছি না৷ কচবিহীন পৃথিবী বিস্বাদ বড়৷

পিতা শুক্রাচার্য কন্যার আকুতিতে সাড়া দেন৷ তাঁকে মন্ত্রবলে ফিরিয়ে আনতে হবে৷

“এসো কচ৷”

বলতেই কচ আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসেন৷ তাঁকে দেখে দেবযানী আহ্লাদিত হন৷ একটু একটু করে কচের প্রতি অধিকারবোধ জন্মে যায় দেবযানীর৷ আর কচের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায় তাঁদের প্রতি৷ কচ গুরুদেব এবং গুরু কন্যার প্রতি আরও অনুরক্ত হন৷ দেবযানী ভাবতে শুরু করেন কচ তাঁকে ভালোবাসেন৷ এই ভালোবাসা সম্পূর্ণত ঈশ্বরপ্রদত্ত৷ কচের দিন দিন আশ্রমের প্রতি এবং দেবযানীর প্রতি দায়িত্ববোধ আরও বাড়তে থাকে৷ কচ নিঃসার্থ ভাবে তাঁদের প্রতি আজ্ঞা পালন করেন৷ দিন যায় কিন্তু কচ বুঝতে পারেন তাঁকে এবার স্বর্গলোকে ফিরতে হবে৷ কিন্তু দানবেরা এত সহজে ক্ষান্ত হয় না। একদিন দেবযানীর খোঁপার জন্য এক বিশেষ ধরনের ফুল প্রয়োজন। তিনি কচকে বললেন

– কচ আমার জন্য এক প্রকার বিশেষ ফুল এনে দিতে পারেন৷ জানি আপনি আমার কোন অনুরোধ উপেক্ষা করেননি৷ তবুও আপনার প্রতি দাবী আমার দিনদিন বর্ধিত হচ্ছে৷

কচও ধীরে ধীরে দেবযানীর প্রেমে মগ্ন হতে শুরু করেন৷ তিনি কিছু সময়ের জন্য ভুলে যান তাঁর এখানে আগমনের হেতু৷ বারবার তিনি নিজেকে শক্ত থাকবার প্রতিজ্ঞা করেন কিন্তু প্রায়সই তা বিফলে যায়৷ সারাদিন তাঁরা একসাথে সঙ্গীতে নিমগ্ন থাকেন৷ দেবযানীর ওই রূপ থেকে চোখ সরাতে পারেন না তিনি৷ তাই তাঁর জন্য ফুলের সংগ্রহে বেড়িয়ে পড়েন৷  ক্রমশ গভীর বনে এগিয়ে যেতে থাকলেন তিনি আর সেখানেই অসুরেরা আবার কচকে হত্যা করে এবং তার হাড়-মাংস ছুঁড়ে ফেলে সমুদ্রে। এবারও কন্যার করুণ আকুতিতে শুক্রাচার্য কচকে প্রাণদান করলেন।

পরপর দু’বার এরকম নিদারুণ ব্যর্থতা দানবদের ভাবিয়ে তোলে। সহজ উপায়ে কচকে আবার হত্যা করে যে লাভ নেই, বুঝেছিল তারা। তাই এবার নতুন ফন্দি আঁটতে হবে। তারা জানতেন কচকে হত্যা করার পর তার হাড় যাকেই খাওয়ানো হবে তার গুরুর মন্ত্রবলে মৃত্যু হবে এবং কচ আবারও প্রাণ ফিরে পাবে৷

দানবরা দেবযানীর রূপে মুগ্ধ ছিলেন৷  তারা চাননি কচ ও দেবযানী মিলিত হোক৷ অপরদিকে কচ এখানে এসেছেন দেবতাদের অনুনয়ের জন্য তা তারা বুঝতে পেরেছিলেন৷ দেবতারাই সুদর্শন কচকে পাঠিয়েছেন গুরুগৃহে দেবযানীকে মুগ্ধ করতে৷  সেই সুযোগে কচ

সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে নিতে পারবেন গুরু শুক্রাচার্যের থেকে৷ তাই তারা এবার কচকে মারার জন্য অন্তিম উপায় ব্যবহার করল৷ তারা কচকে  হত্যা করে তার মৃতদেহের ছাই সোমরসের সঙ্গে মিশিয়ে  গুরু শুক্রাচার্যকে খাইয়ে দিলেন। কচ আশ্রমে ফিরছেন না দেখে কাতর হয়ে পড়লেন দেবযানী৷ তিনি মৃত্যুবরণ করবেন বলে পিতাকে জানান৷ মাতা পরিত্যক্তা দেবযানীর প্রতি দুর্বল গুরু শুক্রাচার্য তাঁকে বললেন

– আমি ইতিমধ্যে দুবার তাঁকে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছি ৷ আর সম্ভব নয়৷

পিতার কথা শুনে দেবযানী বলেন

– আমার বেঁচে থাকার কোন প্রয়োজন নেই ৷ মৃত্যু শ্রেয়৷

দেবযানীর থেকে এমন কথা শুনে পিতা আবারও ধ্যানে বসলেন৷ বসে দেখেন কচ তারই উদরে। কচের কাছে থেকে সব ঘটনা শুনলেন গুরু। কচের উপর এবার সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করলে কচ তার উদর ভেদ করে বেরিয়ে আসবেন। তাতে শুক্রাচার্য নিজেই মারা যাবেন। আবার কচকে না বাঁচালে তার দ্বারা ব্রাহ্মণহত্যা হবে। এ মহাপাপ I অপরদিকে তাঁর আদরের কন্যাটিও কচের শোকে মুহ্যমান।

 দেবযানীর সামনে প্রবল ধর্মসংকট উপস্থিত হয়। পিতার জীবনের বিনিময়ে তিনি প্রেমিকের জীবন চাইতে পারেন না। যে কোনো একজনের মৃত্যুই তার কাছে নিজের মৃত্যুতুল্য। দেবযানী শোকে স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। কী করবেন স্থির করতে পারলেন না৷ সারাদিন অন্ধকার কক্ষে থাকেন দেবযানী৷ আহার, নিদ্রা সবই পরিত্যাগ করেছেন৷ অবশেষে শুক্রাচার্য নিজের গর্ভে থাকা কচকে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শেখালেন, যাতে মৃত্যুর পর কচ আবার তাঁকে জীবিত করে তুলতে পারেন। গুরুর পাকস্থলী থেকে বের হয়ে কচ এ বিদ্যা প্রয়োগ করে শুক্রাচার্যকে নবজীবন দিলেন। এরপর আরো বহু বছর কচ গুরুগৃহে বিদ্যাচর্চায় কাটালেন।


আরো পড়ুন: ইরাবতী শারদ সংখ্যা’২২


এবার বিদায়ের আলো দেখা যায় আকাশে৷ দেবযানী অনুভব করলেন তাঁর পক্ষে কচকে ছেড়ে থাকা সম্ভবপর নয়৷ তিনি এক সন্ধ্যায় নিবিড় বনে কচকে বললেন

– আমাদের এবার বিবাহ করা উচিত৷ আমার রূপ যৌবন সমস্ত ধ্বংস হতে বসেছে৷ এই শরীর আপনার স্পর্শ চাইছে৷ প্রতিদিন আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি ক্লান্ত ৷ এবার সময় হয়েছে পরিণয়ের৷

কচ বুঝতে পারেন তাঁকে এবার সত্যই বিদায় জানাতে হবে ৷ দেবযানীর প্রেমে তিনি মুগ্ধ ৷ কিন্তু তাঁদের এই বিবাহ সম্ভবপর নয় ৷ দেবতাকূল কোন ভাবেই মেনে নেবে না তাঁদের বিবাহ৷ তিনি এক বিশেষ কার্যে এখানে উপস্থিত হয়েছেন ৷ কিন্তু তিনি দেবযানীকে কী বলবেন! তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয় ৷ এই বিচ্ছেদ তাঁকেও বড় শাস্তি প্রদান করবে৷ কিন্তু তাঁকে সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে৷ তিনি জানালেন দেবযানীকে

–  দেবযানী৷ আপনার এই প্রস্তাবে আমি সত্যই মর্মাহত৷ আমি আপনাকে গুরুতনয়া রূপেই দেখেছি৷ আমি আপনার সকল অনুরোধ পালন করেছি মাত্র৷ এ বিবাহ ন্যায়সঙ্গত নয়৷  আমাকে এখনই এই স্থান পরিত্যাগ করতেই হবে৷

একথা শুনে বাহ্যজ্ঞান লোপ পায় দেবযানীর৷ তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করার সাহস কী ভাবে পেলেন কচ তাই বুঝতে পারছিলেন না ৷ তাছাড়া তাঁর মত সুন্দরীকে কে না  পেতে চান৷ কচ কেন অস্বীকার করছেন? কচ তাঁকে অপমান করছেন৷ তাঁর কথার অস্বীকার করার স্পর্ধা কেউ দেখায়নি৷ দেবযানী লজ্জা , অপমানে জর্জরিত হন৷ তিনি  কচকে অভিশাপ দেন

– আপনি  কখনও সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারবেন না। শুধুমাত্র অপরকে শেখাতে পারবেন। হাজার বছর ধরে অর্জিত বিদ্যার ভারবাহক হয়ে থাকতে হবে আপনাকে।

একথা শুনে কচ দুঃখ পান৷ তিনি মনে মনে ভাবেন এত দিনের সমস্ত প্রতিদান মিথ্যা৷ শুধুমাত্র দেবযানীর প্রস্তাবে রাজী হননি বলে এমন অভিশাপ দেবেন৷এও কী সম্ভব! এতো ভালোবাসা নয় শুধুমাত্র অধিকারবোধ৷ ভালোবাসা যদি থাকত তাহলে কচকে অভিশাপ দিতে পারতেন না দেবযানী৷ ক্রোধে ফেটে পড়েন কচ৷ তিনিও পাল্টা অভিশাপ দেন,

দেবযানী! আপনার  কখনই কোন ব্রাহ্মণ পু্ত্রের সঙ্গে বিবাহ হবে না। যে অভিশাপ আমাকে দিলেন তার ফল আপনাকে ভোগ করতে হবে৷ বিদায়!

বলে কচ চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলে যান৷ বিচ্ছেদব্যথা ব্যাথীত করে কচকে ৷ মনে পড়ে কত স্মৃতি৷ কিন্তু হায়! ব্যর্থ সে সব৷

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত