| 7 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-৯) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

কেজুনে ক্রেওলে মাখামাখি

এহেন ফুড ইভেঞ্জালিস্ট রাণীয়ার মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় আমেরিকার যেখানে বেড়াতে যায় সেখানকার ফুড কালচার নিয়ে পড়াশুনো করতে। জোগাড় যন্ত্র করেও ফেলে। পাবলিক লাইব্রেরী যায়। বই আনে। দিব্য পড়াশুনো করে ফেলে।

আবার এক ভোরে প্ল্যানমাফিক ওরা বায়ুপথে পাড়ি দিয়েছিল ডালাস থেকে নিউইয়র্ক । কুশলের কাজের সূত্রেই যাওয়া। সেখানে বিখ্যাত নিউইয়র্ক স্টাইল পিতজায় হাতেখড়ি হয়েছিল বাংলাদেশী পিতজা কর্নারে। রাণীয়া বেশ বুঝতে পারে রান্নার পদ্ধতির খুঁটিনাটি সব। সেইজন্যই বুঝি তার এত ইন্টারেস্ট বিশেষ জায়গার বিশেষ সব খাবারদাবারে।
সবচেয়ে মজা হল এই ট্রিপের পরে পরেই লুইসিয়ানায় বেড়াতে গিয়ে। অন্যরকম অভিজ্ঞতা। গাড়ী চালিয়ে গেছিল কুশল। সেখানে গিয়ে রেস্তোরাঁর শেফের ইন্টারভিউ নিয়েই ফেলল একেবারে।

আমেরিকার একটি পাঁচমিশেলি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বন্দর শহর হল লুইসিয়ানা স্টেটের নিউঅর্লিন্স । মিসিসিপির মোহানায় অবস্থিত এই শহর। টেক্সাসের ডালাস থেকে ধূসর, রুক্ষ প্রকৃতির শুষ্কতা ছেড়ে লুইসিয়ানার সবুজ প্রকৃতির আদ্রর্তা নিয়ে গাড়ি করে এক ভোরে রাণীয়া আর কুশল পাড়ি দিয়েছিল নিউঅর্লিন্সের দিকে। সবশুদ্ধ প্রায় ন’ ঘন্টা লেগেছিল নিউঅর্লিন্স পৌঁছতে । ডিউক অফ অর্লিন্স, ফিলিপ-ডি-অরলিন্সের নামে সাউথ-ইস্টার্ন লুইসিয়ানার অন্যতম এই শহরের নাম হয় La Nouvelle-Orleans বা নিউ অর্লিন্স ।
পথে যেতে যেতে নেটে সার্চ করছিল রাণীয়া। পেল কিছু তথ্য।
বুঝলি কুশল?
ভারতবর্ষে গ্রেট ব্রিটেনের ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন রাজত্ব করতে এসে কোলকাতায় গড়েছিল তাদের রাজধানী ঠিক তেমনি ৭ই মে, ১৭১৮ সালে ফ্রেঞ্চ মিসিসিপি কোম্পানি আমেরিকায় এসে নিউঅর্লিন্স শহরের গোড়াপত্তন করেছিল। তারপর নেপোলিয়ান এই শহরের আশপাশের এলাকা লুইসিয়ানা স্টেট হিসেবে আমেরিকাকে বিক্রি করেন ১৮০৩ সালে।

কুশল বলেছিল, তুই বাইরে তাকিয়ে দেখ আগে। এমন দেখতে পাবি না আর। শুধু নদী আর নদী।

বিশাল চওড়া তরঙ্গায়িত মিসিসিপি নদীর দুকূল জুড়ে অবস্থিত এই শহরের পশ্চিম জুড়ে রাজকীয় হ্রদ লেক পনচার্ট্রেনের নীল জলরাশি, আর দক্ষিণে গাল্ফ অফ মেক্সিকো। অমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নিউঅর্লিন্স । অফশোর এবং অনশোর পেট্রোল এবং ন্যাচারাল গ্যাস উতপাদনের ঘাঁটি ও অমেরিকার পঞ্চম বৃহত বন্দর এটি । ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে আমাদের কোলকাতায় যেমন এক সময় ফরাসী, ওলন্দাজ সহ বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল নিউ অর্লিন্সে এসে ঠিক তেমন মনে হল ওদের। এই শহরটি আমেরিকার এক অনন্য শহর যেখানে নানা মত, নানা পরিধানের মাঝে বিবিধ ভাষা এবং সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। আর বহুমুখী ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে নিউঅর্লিন্স বাকি আমেরিকা থেকে যেন বিছিন্ন । নতুন আমেরিকার শপিংমলের গন্ধ আছে  আবার মোড়ে মোড়ে পিত্জা জয়েন্ট বা বার্গার পয়েন্টও আছে । আছে এক্সপ্রেস ওয়ের চাকচিক্য কিন্তু তার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় প্রাচীন যুগের প্রেতাত্মারা।  ইওরোপীয় সংস্কৃতির অনন্দাধারা বইছে যেন সেখানে ।

সেদিন প্রথমেই ওরা পা রাখলো সেখানকার ফুর্তির পাড়া, হুল্লোড় পট্টিতে । ব্যস্ততায় মুখর বুর্বন স্ট্রীটে। রাস্তার ধারের একটা পাবে ঢুকে এখানকার বিশেষ পানীয় “মার্গারিটা”য় প্রথম চুমুক দিতেই রাণীয়া আর কুশলের পথশ্রমের সব ক্লান্তি  নিমেষে উধাও। মেক্সিকোর “ব্লু আগাভে” নামক ক্যাকটাস জাতীয় গাছ থেকে তৈরী পানীয় “টেকিলার” সঙ্গে আরো অনেক কিছু মিশিয়ে বানানো হয় এক অসাধারণ পানীয়টি। টুক করে নেট সার্ফ করে জেনে নিল রাণীয়া। সেবার নিউঅরলিন্সে বিখ্যাত বুর্বন স্ট্রীটের এক পুরোনো রেস্তোরাঁতেই ওর প্রথম হাতেখড়ি হল কেজুন এবং ক্রেওল ঘরানার ক্যুইজিনের সঙ্গে।

হোটেলের ঘরে বেশ কয়েকটা বইপত্র ছিল। রাণীয়ার সুখ যেন উপচে ওঠে তাই দেখে। মাথায় আইডিয়া এল। তাহলে এবার পডকাস্ট এর পরের এপিসোড ক্রেওল আর কেজুন নিয়ে। কয়েক দশক ধরে ইতিহাসবিদ, ভাষাবিদ এবং লুইসিয়ানদের মধ্যে একটি চলমান বিতর্ক চলে আসছে এই কেজুন আর ক্রেওল নিয়ে। সে এক জটিল কাহিনী যার মধ্যে রয়েছে আন্তঃমহাদেশীয় যুদ্ধ, স্থানান্তর, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষা সবমিলিয়ে গত তিনশো বছরে ঘটে যাওয়া এক প্রেক্ষাপট। কেজুনরা হল ফরাসি ঔপনিবেশিক যারা ১৬০০ দশকে কানাডার সমুদ্র প্রদেশে বসতি স্থাপন করে। এদের আকেদিয়ান বলা হত কিন্তু তারা ব্রিটিশ প্রটেস্ট্যান্ট আধিপাত্য না মানায় তাদের কানাডা থেকে বিতাড়িত হয়ে লুইসিয়ানা তে আশ্রয় নিতে হয়। লুইসিয়ানায় সেইসময় একটি ফরাসী ক্যাথলিক বাতাবরণ ছিল। ঢুকে পড়ল কেজুন সম্প্রদায় । ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে আকাদিয়ান শব্দ থেকেই কেজুন শব্দের উৎপত্তি। কেজুনরা ফরাসি ভাষার একটি অনন্য উপভাষা বজায় রেখেছিল। এরা ইউরোপীয় দেহাতি মানুষ যাদের জীবিকা মাছ ধরা, শিকার করা এবং কৃষি। আর ক্রেওল হল লুইসিয়ানার পুরনো বাসিন্দা তা সে ফরাসী হোক বা আফ্রিকান। ক্রেওল এর অর্থ “উপনিবেশের আদিবাসী” এবং তাদের গায়ের রঙের সঙ্গে যেন আবহমান কাল ধরে সেই তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছে। ক্রেওলের মূলে হল আফ্রিকান শিকড় । লুইসিয়ানাতে ব্যাবহৃত ভাষা। ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় তালিকাভুক্ত। বিগত কয়েক দশকের মধ্যে, কেজুন নিউ অরলিন্সের সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত হলেও ক্রেওলের সঙ্গেও তাদের প্রতিনিয়ত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান । শেফ Paul Prudhomme এবং আরও অনেক প্রতিভাবানদের রন্ধনসম্পর্কীয় উদ্ভাবিত এক অনন্য রন্ধনশৈলী উপহার পেল নিউ অর্লিন্স।  
এই শহর নিউ অর্লিন্স হওয়ার আগে, স্থানীয় আমেরিকানরা যাকে “বুলবাঞ্চা” নাম দিয়েছিল।  যার অর্থ হল “অনেক ভাষার স্থান”। যার ফলে এই ক্রেওল এবং কেজুনও নানাভাবে গড়ে ওঠা এক মিশ্র সংস্কৃতির রন্ধনপদ্ধতিও বটে।
আমেরিকার লুইসিয়ানা স্টেটের নিউ অরলিন্স সবসময় সমৃদ্ধ তার মিশ্র সংস্কৃতির জন্য। যার মধ্যে স্থানীয় আমেরিকান, ইউরোপীয় এবং শক্তিশালী আফ্রিকান আর যথেষ্ট ক্যারিবিয়ান প্রভাব রয়েছে। এই কারণেই নিউ অরলিন্সকে আমেরিকার সবচাইতে ইউরোপীয় আর একই সঙ্গে সর্বাধিক ক্যারিবিয়ান শহর বলা হয়। লুইসিয়ানার অথেনটিক খাবার হল কেজুন স্টাইল ক্র’ফিশ। সঙ্গে স্মোকড রাইস। আরেকটি হল শ্রিম্প ক্রেওল। সঙ্গে কেজুন রাইস। রাণীয়া মিঠি কে ছবি পাঠায়। জানিস দিদি? আজ আমরা দু’জনে দুরকম প্লেট নিলাম। স্বাদের ভাগ নেব বলে। ক্র’ ফিশ বা ক্রে’ ফিশ আমাদের ছোট্ট গলদা বা স্ক্যাম্পির মত। তবে কাঁকড়ার মত দাঁড়া আছে। রান্না করলে টুকটুকে লাল হয়ে যাওয়া সামুদ্রিক মাছ। চিংড়ির মতোই স্বাদ। ওখানে অনেকে বলে “মাডবাগ্ স ” কারণ ফ্রেশ ওয়াটার লেকের কাদার মধ্যে থাকে । তবে কেজুন বা ক্রেওল সিজনিং অনেকটা কাছাকাছি হলেও পরিবেশনায় অভিনবত্ব উভয়েরই। ট্রাইবাল কুইজিন তো কি! সার্ভ করার ধরণ ধারণে সাহেবিয়ানার স্পর্শ ।
তারপরেই সেই মেসেজ ওদের মায়ের কাছে গেল ফরোয়ার্ড হয়ে।  
মা লেখে, দারুণ তো। জমিয়ে খাস কিন্তু ।
মা জানো?
Lousiana Cajun delicacy বলতেই সর্বাগ্রে বলতে হয় গাল্ফ অয়েষ্টার, স্টীমড বা বয়েল্ড ক্র-ফিশ, রেড বিনস আর স্মোকড রাইস এর কথা।    
অসাম অ্যান্ড হোলসাম ফুড।
এবার সোজা শেফের কিচেনে ঢুঁ মারল রাণীয়া। জানতেই হবে কী করে ওরা বানাচ্ছে। হাতের মুঠোফোনে সব বন্দী হতে থাকল।
ক্যান আই টেক আ শর্ট ভিডিও?


আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-৮) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


কৃষ্ণকায়, ভারী চেহারার এপ্রন পরিহিতা সেই মহিলা শেফ বললেন, অফকোর্স। হোয়াই নট। রাণীয়া ভাবল এই হল আমেরিকা। আমার দেশের রাঁধুনি হলে নির্ঘাত আপত্তি করত। যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট করে দিই সেই ভয়ে। এদেশে ওরা জানে যত পাবলিসিটি হয় ততই ওদের লাভ। Lousiana Cajun delicacyর অন্যতম আরেকটি পদ শ্রিম্প ক্রেওল রান্না হচ্ছিল তখন। কেজুন স্টাইল কুকিং এর মশলার মূলে কেজুন স্পাইসের ঝাঁঝালো গন্ধ আর রঙ। শেফ সুজানা জানিয়েছিল তাকে। রাণীয়াও শেফ কে এটা কী, ওটা কী বলে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিল । গ্রানাইটের ঝকঝকে কিচেন স্ল্যাবে রাখা ছিল টুকটুকে লাল স্যস, নানারকম হার্ব। শেফ সুজানা বলেছিল, ক্রেওল টাইপ রান্নার মূলে ক্রেওল স্যস। বানানো হয় মূলতঃ টম্যাটো, সেলারি, বেল পেপার আর পিঁয়াজ দিয়ে। সঙ্গে থাকে কিছু সিজনিং যেমন রসুন, থাইম, পার্সলে। রাণীয়ার সামনেই শেফ সেই ফুটন্ত স্যসে ফেলে দিয়েছিল তেজপাতা, নুন, গোল মরিচের গুঁড়ো। রাণীয়া বলেছিল, অ্যান্ড হোয়াট আবাউট কেজুন?
কৃষ্ণকলি শেফ সুজানা রান্না নিয়ে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি কোনোদিন। কত লোক আসে রেস্তোরাঁয়। খেয়ে বেরিয়ে চলে যায়। ভালো লাগছিল তারও রাণীয়াকে সব জানাতে। নিজের দেশের ক্যুইজিন নিয়ে বলতে কার না ভালো লাগে?
কেজুন মশলার বিশেষত্ব তার রঙ আর গন্ধ। প্রধান উপকরণ হল কেইন (cayenne) আর প্যাপরিকা এই দু’ধরণের লংকার গুঁড়ো। cayenne ও paprika এই দুই ধরণের শুকনো আর গুঁড়ো লঙ্কাই ঝাল তবে কেইন পেপারে একটা মিষ্টি ফলের গন্ধ থাকে। এই দুই লঙ্কা ছাড়াও কেজুন মশলায় থাকে রসুন, থাইম, ওরেগ্যানো, সাদা আর কালো গোল মরিচের গুঁড়ো। কেজুন আর ক্রেওল নিয়ে এসব জ্ঞান দেবার পরেই ওকে কৃষ্ণাঙ্গ শেফ সুজানা বলেছিল এবার বাইরে গিয়ে বোসো দিকিনি। তোমাদের খাবার সার্ভ করব।  

এপ্রন পরিহিতা সুজানা ধূমায়িত স্মোকড কেজুন রাইসের ফুরফুরে বাগানে সার্ভ করেছিল মশলাদার উপাদেয় সেই ক্র-ফিশ কারি।
বাইরে গিয়ে লোহার চেয়ারে মুখোমুখি বসল কুশলের সঙ্গে। রাণীয়া ভাবে বাইরে এত সুন্দর বাঁধানো ফুটপাথ, রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি, সাবেকি স্ট্রীটল্যাম্প আর তার মাঝে টুকটুকে লাল ডেলিকেসি ।
চিংড়ি জাতীয় মাছ ও মশলার যুগলবন্দী ভালোই জমে যাবে কী বল? ইন্ডিয়ান টেস্ট বাডে খিদের মুখে তা অমৃতসম তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কেজুন রাইসও হল কেজুন মশলার সমন্বয়ে নানারকম সবজী দিয়ে ভাজা ভাত। সুগন্ধি চাল ব্যবহৃত হয় সেখানেও। মানে আমাদের ফ্রায়েড রাইসের মত। তবে কেজুন পাউডারের ব্যাবহারে চালের গন্ধ ঢেকে যায়। ইচ্ছেমত মাংসের চয়েস সেখানেও মেলে। কেউ বিফ কিমা, কেউ পর্ক কেউ আবার চিকেন দিয়ে অর্ডার করে।
রাণীয়া জানিয়েছিল শেফ সুজানা কে। তোমাদের এই কেজুন অ্যান্ড ক্রেওল এত মশলাদার বলেই হয়ত এত ভালো লাগছে আমাদের। সেদিন আলাদা করে সামান্য টিপস দিয়ে এসেছিল সুজানার হাতে। নিজের সঙ্গে তার একটা ছবি তুলে সঙ্গেসঙ্গে পোষ্ট করার লোভও সামলাতে পারেনি ফেসবুক আর ইন্সটা হ্যান্ডেলে।
 
লুইসিয়ানার সেই পুরনো শহরে পা দিয়েই মনে হয়েছিল প্রাচীন ঐতিহ্যের ছোঁয়া সেখানে, পুরণো বাড়িদের, পুরনো লাল ট্রামেদের সারি । ফুটপাথ ঘেঁষা গথিক স্টাইলের স্থাপত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা স্বমহিমায়। কেমন একটা মন কেমন করা পুরনো গন্ধ পেয়েছিল ওরা, আমেরিকার অন্য শহর গুলিতে গিয়ে যা পায়নি । ঠিক কলকাতার নিউমার্কেট, এস্প্ল্যানেডের অলিগলি আর কলেজ স্ট্রীট কফি হাউসের গন্ধ যেন নাকে এল কুশলেরও। পরিচ্ছন্নতা দেখে আবার কেঁদে উঠল প্রাণ পুরনো সাহেবি কলকাতার জন্যে ।
এখানকার হার্টল্যান্ড হল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ  জায়গা  যার নাম “vieux carre” ।
কুশল বলল, উচ্চারণ টা কী জানিস তো? “ভু ক্যারে” । নিউ অর্লিন্সের প্রাণকেন্দ্র। পুরনো নিউঅর্লিন্সের ফ্রেঞ্চকোয়ার্টার ছিল এককালে, তাই ফরাসী ঐতিহ্য বহমান এখনো রাস্তার মাঝে । এই শহরই নাকি জ্যাজ মিউজিকের পীঠস্থান বলে জনপ্রিয় । বিখ্যাত জ্যাজ শিল্পী লুই আমস্ট্রং এখানকারই লোক ছিলেন। পথেঘাটে সারাদিন অণুরণিত হচ্ছে জ্যাজ টিউন । রাস্তার ধারে বাদ্যশিল্পীর জ্যাজ অনুশীলন, বিশালকার স্যাক্সোফোন নিয়ে সঙ্গীত চর্চা দেখে মুগ্ধ হয় ওরা । এ শহরের আকাশে বাতাসে জ্যাজ।
রাণীয়ার আগে চোখে পড়ল খুদে চিত্রশিল্পীর মন দিয়ে ছবি একে চলা। রাস্তার ফুটপাথে ছবি আঁকার  ক্যানভাস, রঙতুলি বিছিয়ে বসে আঁকছে অনেকেই।  দাড়িওয়ালা এক শিল্পী কিছু দূরে তার ইজেল নিয়ে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে ছবি এঁকে চলেছে। এ যেন আরেক মিনি ফ্রান্স। টুক করে ঘর সাজানোর জন্য একটা সস্তার ছবিও কিনে ফেলে রাণীয়া।
কোনোবাড়ির পোর্টিকোতে গীটারে জ্যাজ বাজায় তরুণ, কোথায় আবার বিউগল বাজিয়ে ভিক্ষা চাইছে যুবক, কোথাও আবার অ্যাকর্ডিয়ানে সুর তুলতে ব্যস্ত কোনো শিল্পী। “Vieux Carre” যেন ফরাসীয়ানায় অমলিন। সেই সঙ্গে দিব্য বেঁচে থাকে এখানে কেজুন ভার্সেস ক্রেওলের তর্ক।
কুশল মনে কারিয়ে দেয় রাণীয়া কে। জানিস তো?
২০০৫ এর সেই “হারিকেন ক্যাটরিনা” গাল্ফ অফ মেক্সিকো থেকে উড়ে এসে আছড়ে পড়ে এখানে। তার আঘাতে মিসিসিপি নদীর বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের জলের উচ্ছ্বাসে সারা নিউ অর্লিন্স শহর গভীর জলে নিমগ্ন হয় ।
আমাদের কোম্পানির মত কত ফরচুন ফাইভ হান্ড্রেড কোম্পানির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেছিল সেবারে। তবে আবারও উঠে দাঁড়িয়েছে।
রাণীয়া কুশল কে বলে, জানিস? সেই কারণেই “vieu carre” তে হয়ত এখনো বাজছে সেই জ্যাজের করুণ টিউন। ধীরে ধীরে সামলে উঠেছে হয়ত নিউ অরলিন্স।

 
সেদিন ওদের নিউঅরলিন্সের রাতটাও কেজুন আর ক্রেওলের মাখামাখি কেমিস্ট্রির মতোই হয়ে রইল। কুশল যেন একটু বেশীই আবেগপ্রবণ। ফুড ইভেঞ্জালিস্ট বউকে সেদেশের মাটিতে সামান্য আলো দেখাতে পেরে সেও বিস্তর খুশি। যেন বঁধু তোমার গরবে গরবিনী আমি রূপসী তোমার রূপে। আর সত্যিই তো। ব্যাক্তিত্ত্বময়ী রাণীয়ার রূপও যেন তার কাজের কাছে হার মানছে। দিকে দিকে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে। ঠিক এটাই তো চেয়েছিল কুশল মনে মনে।   
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত