| 7 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-৮) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

সব ফেলে ঝালের ঝোলে  

বেশিদিন বিদেশী খাবার মুখে রোচে না রাণীয়ার। যতই বল মিডল ইষ্টের হামাস আর ফেলাফল কিম্বা মেডিটেরেনিয়ান পাস্তা অথবা মেক্সিকান চিমিচাঙা দিশী রান্নার ধারেকাছে কেউ নয়। এই নিয়ে কুশলের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া লাগে রাণীয়ার। মাঝেমধ্যেই তাই রাণীয়ার রান্নাঘরের স্বাদবদল হয় পাতি বাঙালি রান্নায়। এখানে মাছের স্বাদ দেশের মতো একেবারেই নয়। যতই লোকে বলুক আমেরিকান স্টোরের হ্যাডক, হেক বা কার্প বা ইন্ডিয়ান স্টোরে বহুদিনের বরফবন্দী বাংলাদেশী রোহু বা রুই । কোনটার স্বাদ দিশী কাটাপোনা, রুই, কাতলার মত একেবারেই নয়। তারপর হল মাছের যোগ্য সঙ্গত সর্ষের তেল। সেদেশে সরষের তেলে তেমন ঝাঁঝও নেই। সরষের তেলের শিশির গায়ে প্রথম বার মাসাজ অয়েল দেখে চমকে উঠেছিল সে। হ্যাঁ, এভাবেই বারেবারে রিফাইন্ড সরষের তেল আসে সেখানে। ততক্ষণে তার সব ঝাঁঝ গন্ধ উধাও। তবুও সন্তুষ্ট থাকতেই হয় বাঙালিকে। রাণীয়ার তাই অমন মাছের ঝোল রেঁধে সুখ হয়না। বাটি চচ্চড়ির কাঁচা তেল ছড়ানো জুতসই হয়না। ভাতের সঙ্গে কিছু আনাজ সেদ্ধ মেখে খেতে ব্ল্যান্ড টেস্ট লাগে মুখে। দেশের মত নয় একদমই। মাছের ঝোলেও কিছুতেই সেই মায়ের হাতের টেস্ট আসেনা যেন। কত তরিজুত করে সে গ্রাইন্ডারে ধনে, জিরে, গোলমরিচ, শুকনো লংকা বেটে নেয়। মায়ের রেসিপির সেই অমৃত সম পাতলা করে লম্বা একটা মাছের ঝোল। কাগচি লেবু ভাতের মধ্যে ডলে নিয়ে কী আনন্দে খেত দুই বোনে। গরমের দিনে যেন সত্যিই বডি চায় অমন রিফ্রেশিং পাতলা ঝোল ভাত। আর কিছুই লাগত না। এটাই বাঙালির একমাত্র স্টেপল ফুড।

হঠাৎ মনে পড়ে তার দিদার হাতের নিরামিষ সেই ঝোলের কথা। খেয়েছিল মামারবাড়িতে। কী যেন বলে তাকে। বড় বড় বড়া দিয়ে সেবার রেঁধেছিল দিদা ওদের জামশেদপুরের বাড়িতে। মা’কে ফোন করে রাণীয়া। ঝালের ঝোল নাম সেই সুস্বাদু ঝোলের। মা জানায়। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর বইতে খুঁজতে থাকে রাণীয়া। নাহ! তেমন কিছু খুঁজে পায় না সেখানে।

অথচ তার মা বলতে থাকেন গড়গড় করে…
 
“জানিস? ঠাকুরবাড়ির খুব ঘনিষ্ঠ একজন। অক্ষয় চৌধুরীর স্ত্রী শরৎকুমারী চৌধুরাণীর “দিদিমা” গল্পে সেসময়ের বঙ্গবিধবাদের ঝালের ঝোলের কথা আছে। আমাদের বাড়িতেও সেযুগের ব্রাহ্মণ বিধবারা খেতেন। আমার মা ঠাম্মার জন্য যেদিন রাঁধত সেদিন বলতাম আমার জন্য তুলে একটু রেখে দিতে। ইশকুল থেকে এসে চাট্টি ভাত দিয়ে খাব বলে। ‘  
রাণীয়া বলে, মা, কী করে বানাবো প্লিজ লিখে দাও হোয়াটস্যাপে। আর ঝালের ঝোল নিয়ে তুমি একটা ফান্ডা রেডি কর। আমি রেকর্ড করব কিন্তু।

মা টেক্সট করলেন।
মটরডাল আগে থেকে ভিজিয়ে বেটে নিবি। নুন, হলুদ, লংকাগুড়ো আর সামান্য সরষের তেল ছড়িয়ে ফেটিয়ে নিয়ে ছাঁকা তেলে চ্যাপ্টা আকারের বড়া ভেজে তুলে রাখো। এবার যা খুশি আনাজ… আলু, পটল, ঝিঙে, ফুলকপি, বেগুণ ফালাফালা করে কেটে নিয়ে সেই তেলে ভেজে নিবি হালকা করে। এবার সেই অল্প তেলের মধ্যেই নুন, হলুদ দিয়ে সব সেদ্ধ করে চিনি দিয়ে বড়া দিবি ফুটন্ত ঝোলে। এবার সর্ষে শুকনো লংকা বাটা। কয়েকটা কাঁচা লংকা চিরে। ডেঙো ডাঁটা আর কাঁঠালবীচিও দেয় অনেকে। নামিয়ে অন্য কড়াইতে ঘিয়ের মধ্যে অনেকটা পাঁচফোড়ন আর শুকনো লংকা দিয়ে ঝোলের মধ্যে ঝপাং করে ঢেলে দিবি সেই ছোক। এবার এক হাতা দুধ ছড়িয়ে একটা ফুট। বেশীক্ষণ না। ব্যাস।এবার ঢাকা দিয়ে রাখবি মনে করে। নয়ত সব গন্ধ উবে যাবে।
পরদিন রাণীয়া মায়ের একটু সময় নিল রেকর্ডিং এর জন্য। মা ভেবেচিন্তে বলবে আবারও। মায়ের এসবে খুব ইন্টারেস্ট। হারানো বাংলার রান্না নিয়ে মা এখন বইপত্র পড়ছে খুব।মেয়ের কাজে আসবে তাই।  

মা বলে চললেন গড়গড় করে, “সেসময়ের বঙ্গবিধবাদের ভুলিয়ে রাখা হত এভাবেই। দুধের শিশু নাবালিকাদের গৌরীদান হত বুড়ো বরের সঙ্গে আর স্বামী মারা যেতেই তার পায়ে বেড়ি পরানোর চল ছিল। এটা কোরোনা, ওটা কোরোনা। উঁহু! ব্লাউজ, সায়া নয়। এখনকার কাফতানের মত অনেকটা দেখতে সেমিজ পরতেই হবে থানের আড়ালে। তাদের আমিষ এমনকি পুঁইশাক, মুসুরডাল, পিঁয়াজ, রসুন ভুলেও খাবার অধিকার ছিলনা। কারণ এসবে নাকি মেয়েদের এক্সাইটমেন্ট বাড়বে। বিধবাদের অভিধানে এসব মানা। পুরুষ দেখলেই চিত্তচাঞ্চল্য হলে তা বিধবাদের পক্ষে অতীব নিন্দনীয়। অথচ ছেলেদের সাতখুন মাপ। বারবার বিয়ে করতে বাধা নেই তবে মেয়েদের আরেকবার বিয়ে হলেই চূড়ান্ত নিন্দে হবে সমাজে। সবসময় তাদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা। তাই চুল কাটো, সাদা থান পরো। বরং ঈশ্বর চেতনা নিয়ে থাকো। ধর্মকর্মে মতি হোক। বারান্দায় দাঁড়িওনা, ছাদে উঠোনা। আর ব্রাহ্মণ বিধবারা দুবার ভাতও খেওনা কারণ আলিস্যি আসবে। তারপর তো এঁটোকাঁটার বাছবিচার, ছোঁয়াছুঁয়ির ছ্যুৎমার্গ তো ছিলই। সদা জাগ্রত থাকো সংসারের মঙ্গলের জন্য। বরং বেশী করে ঘরমুখী করে দিয়ে তাদের হেঁশেল সামলানো, সেলাই ফোঁড়াই, ফি মাসে সত্যনারায়াণের পুজো গোছানো, বেস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজো এসবের কাজ করে মন ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাত সংসারের মাথারা। বেচারা বিধবারা রান্নাঘরের আঁশবঁটির দিকে চেয়ে চেয়ে মনের দুঃখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে একদিন উদ্ভাবন করে ফেলেছিলেন অসামান্য একটা নিরামিষ ঝোল। সেটাই হল ঝালের ঝোল। হেঁশেলের মাছের গন্ধ ভুলিয়ে দিয়ে ঘিয়ের গন্ধে ম ম করত আশপাশ। মাছের গাদাপেটির দুঃখ আর প্রোটিন সুখ জোগাতো মটরডালের বড়া। মায়ের মুখে শুনেছি তার বাল্যবিধবা পিসিমা ঝিঙে ছাড়াতে ছাড়াতে হয়ত হাত কেটে ফেলতেন হয়ত। আরেক একরত্তি নাবালিকা বিধবা মাসীমা হয়ত শিলে সর্ষে শুকনো লংকা ডলে ঝালের তাড়সে দুহাত নিয়ে সারাদিন ঝালাপালা হতেন। তবুও একটু সুস্বাদু কিছু হচ্ছে রান্নাঘরে সেই আশায় বুক বেঁধে। অনেকদিন বাদে তৃপ্তির গরাস। খেতে খেতে হাতের এঁটো শুকোত। দু-চারজন বিধবার  রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বসে সুখ ঢেঁকুর তুলতে তুলতে হাসির হররায় ফেটে পড়ত হেঁশেল। খেতে বসে বিধবাদের ওঠা মানা। তাই হাঁড়িকুঁড়ি, জামবাটি, কাঁসার কাঁসি তে রাখা সেই অমৃতসম ঝালের ঝোলের সবটাই উঠে যেত। সবচাইতে মজার ব্যাপার হল বিধবা মেয়েদের দেখাদেখি পরে বাড়িতে মেইন কোর্সেও সবার জন্য চালু হয়ে গেল সেই ঝালের ঝোল। মাঝেমধ্যে ভুলে যাও আলু-পটল-ঝিঙে-ফুলকপি দেওয়া মাছের ঝোল। ভুলে যাও বাদলা দিনে কাদলা মাছের পাদলা ঝোল। ভাগ্যিস! ঝালের ঝোল আবিষ্কার করেছিলেন সেইসব পিসিমা-মাসীমা রা! বলাই বাহুল্য, হিপোক্রিট সংসারের মাথা মানে সেইসব মৌলবাদী ধর্ম যোদ্ধারাও চেটেপুটে খেতে শুরু করেছিলেন এই নিরামিষ ঝালের ঝোল। ঘিয়ের মধ্যে পাঁচফোড়ন, শুকনো লংকার ফোড়নের গন্ধ উপচে পড়ার এমনি মাহাত্ম্য! বানানোও খুব সোজা।”

বলাই বাহুল্য রাণীয়ার মায়ের ঝালেরঝোলের এত সুন্দর ডিটেলিং রাণীয়া সবটুকুনিই তার পডকাস্ট চ্যানেলে তুলে রেখেছিল ভাগ্যিস। এটা ব্রডকাস্ট হতেই ঢি ঢি পড়ে গেল। ঠিক তারপরেই কোনও এক ডিজিটাল টেলিভিশন চ্যানেল আচমকা যোগাযোগ করেছিল ওর সঙ্গে। তারা এমন সব হারিয়ে যাওয়া বাংলার রান্না নিয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতে চায়।

রাণীয়া খুব উত্তেজিত হয়ে জানায় সে বর্তমানে আমেরিকার ডালাসের বাসিন্দা। প্রয়োজনে এমন সব রান্নার স্ক্রিপ্ট লিখে দিতে পারে চ্যানেল কে।  অথবা যদি তারা বলে সে নিজেও ভিডিও রেকর্ডিং করে পাঠাতে পারে তাদের।
অবশেষে রফা হয়েছিল এক ডিজিটাল চ্যানেলের সঙ্গে। রাণীয়া এখন সেই  চ্যানেলের ফুড কালচার নিয়ে কাজ করে চলেছে। নিজের পডকাস্টিং অডিও সেই চ্যানেলের মাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে নতুন প্ল্যাটফর্মে, নতুন রূপে। বাংলায় এভাবে হেঁশেল বৃত্তান্ত বিরল।
কুশল শুনেই একটা চকাস করে বৌ কে চুমু খেয়ে বলেছিল, তুই যাতেই হাত দিস সোনা হয়ে যায়। কনগ্রাচ্যুলেশন্স! সেলিব্রেশন টা কী দিয়ে হবে তবে?

রাণীয়া বলেছিল, দাঁড়া আগে তোর মা’কে ফোন টা করি। যিনি সবচেয়ে বড় ক্রিটিক আমার। নিন্দুকও বটে। প্রশংসা জন্মেও শোনেনি সে। বরং কথায় কথায় ইগো ক্ল্যাসের প্রচ্ছন্ন আভাস। তিনিও মস্তবড় রাঁধিয়ে কি না।  

সেদিনই শাশুড়ি মা ‘কে ফোন করে খবরটা দিতে পেরে খুব আনন্দ হয়েছিল রাণীয়ার। যেন সত্যিই জিতে গেছে সে। এদ্দিনে রাণীয়ার রান্নাঘর নিয়ে পড়ে থাকার একটা পজিটিভ উত্তরণ হয়েছে তবে।

” বুঝলেন মা? রান্নাবান্না শুধুই এখন হালুইকর বামুনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রান্না হল ভারতীয় সংস্কৃতির চৌষট্টি কলার অন্যতম শিল্প। ছবি আঁকা, চুল বাঁধা, সেলাই করা, কবিতা লেখা, মূর্তি গড়ার মতই  অভিনব হল রন্ধন শিল্প।”

জোঁকের মুখে নুন পড়েছিল সেদিন। রাণীয়ার শাশুড়ি ফোনটা দড়াম করে রেখে মনে মনে আওড়ে উঠেছিলেন।  
” তবু যদি সেই রান্নাবান্না আমার বাড়ির কোনও কাজে আসত! থাকে তো দুজনে কপোত কপোতী মিলে, দু কামরার ঘরে । আপনি আর কোপনি। না আছে কোনও যৌথ সংসারের দায়দায়িত্ব না আছে পুজো আচ্চার পার্ট । না আছে নিত্যি উপোসকাপাসের  ঝামেলা। দুটো সেদ্ধ ভাত কিম্বা খিচুড়ি, কচুরি বানিয়ে খেয়েদেয়ে ঐ চ্যানেল নিয়ে দিনরাত বকবক তোমার। বুঝতাম আমাদের মত জয়েন্ট ফ্যামিলির তিনটে বিধবা শাশুড়ি,  দুটো আইবুড়ো ননদ নিয়ে থাকো। তার মধ্যে একজন জেঠিমা শাশুড়ি আবার আঁটকুড়ো। ছেলেপুলে নেই বলে দিনের পর দিন তার ঘরে ঢুকে হাহুতাশ শোনো। তাঁর একটু বেশীই খেয়াল রাখতে হত ।তিনি  সিম্প্যাথি কুড়লেন তিনি সারাটা জীবন ধরে। এর সঙ্গে বিয়ের পরদিন থেকেই আইবুড়ো দেওরের কলেজের ভাত দিতে হয়েছে আমায়। তিনি আবার মা মনসার মত। সব ঠাণ্ডা চাই। গরম খাবেন না অথচ টাটকা খাবেন। তাই আগেভাগে রেঁধে ফ্যান চালিয়ে ঠাণ্ডা করে তবে সেই ভাত মুখে উঠবে তাঁর। তারপর আমার শাশুড়ির বাতিক। আঁশ নিরামিষ সব আলাদা বাসনে হবে। বারেবারে হাত ধুয়ে রান্নাঘরে কাজ। সংসার তো নয়। যেন এক একজন ঠাকুর দেবতা ছিল এঁরা সব। আর সেইসঙ্গে বাড়ির নিয়মমাফিক বারোমাসের পুজো পাব্বন তো ছিলই। তোমাদের তো সেসব এক কণাও চাপ নেই বাপু। “

সেদিন মনের দুঃখে ফোনটা ইচ্ছে করেই কেটে দিয়েছিল রাণীয়া। মুড অফ হয়ে যায় ওনাকে ফোন করলেই । তিনি ভাঙেন তবু মচকান না। কথার টোনে সর্বদা একটা চাপা ইগোর লড়াই। দিব্যি বুঝতে পারে বুদ্ধিমতী রাণীয়া।

তবে তিনি ছাড়বার পাত্র নন। আবার নিজেই ঘুরিয়ে ফোন করেছিলেন ছেলের বৌ কে। কথা শেষ হয়নি বলে। সেই বনফুলের গল্পের শাশুড়ির মত। বৌমা কে গাল দিতে গিয়ে পোড়ারমুখী একবারে বলতে না পেরে দুবারে বলেছিলেন। চোয়াল আটকে  গেছিল পোড়ার বলেই। চোয়াল খুলতেই অমনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল মুখী। তবুও বলা চাইই যে। সুযোগ পেলে শোনাতে ছাড়েন না তিনি। শাশুড়িদের এ এক ভয়ানক বদ অভ্যেস।
” তা বলি বকবক করলে ক’ লক্ষ টাকা দেবে তোমার ঐ চ্যানেল? রান্নাঘরের তাকবাক তো এখনও কিছুই শিখলে না। তোমার কাজ তো নিজের চোখেই দেখেছে এই শর্মা। হাতাখুন্তিও ধরতে শেখোনি। তারা তোমার রান্না টেস্ট না করেই পয়সা দিচ্ছে?”  
যেন ফোনের ওপারে একতরফাই বড় মাপের ঝড় বয়ে গেছিল। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ঝড়ের ঠাণ্ডা ঝাপটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই রাণীয়ার মুখে কুলুপ। থরথর করে কাঁপছিল শরীরটা।

তবুও সে ভদ্রভাবেই বলেছিল, এটা রান্না শেখানো বা টেস্ট করার ব্যাপার নয় মা। এটা রান্নার ক্লাসও নয়। কুকারি শো তো নয়ই । এর নাম খাদ্য সংস্কৃতি। আমি বিদেশে বসে বাঙালি ক্যুইজিন কে পপুলারাইজ করছি মাত্র । স্পেশ্যালি বাংলার হারানো সব রান্না নিয়ে কাজ করব বলে ঐ চ্যানেলের সঙ্গে কনট্র্যাক্ট সাইন করেছি অ্যাজ ফুড ইভেঞ্জালিস্ট ফর বেঙ্গলি ক্যুইজিন । বাই দ্যা ওয়ে আপনি ওই টেলিভিশন চ্যানেলের অদ্ভুত সব বোকা বোকা রান্নার প্রোগ্রাম গুলো এখনও দেখেন? রোজ রোজ? পাকা কলা দিয়ে মুরগীর মাংস, কদম ফুলের ফিরনি কিম্বা তেলাকুচোর বড়া অথবা সেচুয়ান ইলিশ যারা দেখায়? টিভির পর্দায় চ্যানেলের কী করে টি আর পি বাড়াতে হয় আর সং সেজে এসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে আপনার মত মানুষদের মনোরঞ্জন করতে হয় তা আমার জানা নেই।  আমাকে তাদের সঙ্গে প্লিজ তুলনা করবেন না আপনি। বরং আপনার ঝুলিতে অফবিট বাংলার হারানো রান্না থাকলে আমায় জানাবেন। কেমন?
কেন বলব? আমি অনেক এমন সব রান্না জানি। কিন্তু তুমি আমার জন্যে কী করলে যে তোমাকে আমি রান্নার রেসিপি দিয়ে উপকার করব? ভাবখানা এমনি তাঁর।
মনেমনে “যত্তসব” বলে সে যাত্রায় বৌমার সঙ্গে ফোন কলে ইতি টেনে ছিলেন তিনি। খেতে দিতে দিতে সে রাতে রাণীয়ার শাশুড়ি কুশলের বাবা কে বলেছিলেন, কী গো? তা তোমার বৌমা ক’ দিন রেঁধে খাইয়েছে আমাদের?

নিপাট ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বৌমার পক্ষ নিয়েই বললেন, কেন সেই যে আমাদের বিয়ের তারিখে কেমন পোলাও, মাংস রাঁধলো সেবার। তারপর একদিন বিকেলে চাউমিন রাঁধলো কী চমৎকার! তুমি কী যাচ্ছেতাই ভাবে কথা বললে আজ মেয়েটার সঙ্গে। এতটুকুনি কমনীয়তা নেই কণ্ঠস্বরে। জন্মের পরে তোমায় মুখে বোধহয় কেউ এক ফোঁটা মধু দেয়নি। ভদ্রলোকের মেয়েকে নিজে দেখেশুনে বাড়ির বৌ করে এনেছো। তায় আবার সব ছেড়েছুড়ে কত দূরে পড়ে রয়েছে সেই মেয়েটা। আমাদের ছেলেটা নিয়ম করে ভাতজল পাচ্ছে বলেই না ভালো করে কাজ করে আরও উন্নতি করতে পারছে।


আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-৭) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


শাশুড়ি মা বেশ ক্ষুণ্ণ হলেন যেন। তুমি যেন এমন ভাব করছো যে আমার হাতের রান্না যেন কস্মিনকালে খাওনি মনে হচ্ছে? চিরকাল বামুন দিদি থাকা সত্ত্বেও তোমাদের বাড়িতে আমি রাঁধিনি? আমার বিয়ের আগে জন্মেও রান্নাঘরে ঢোকার অভ্যেস ছিল না। জানোই তো সব। ঠাকুর চাকরের সংসারে বড় হয়েছি আমরা। তোমার বউয়ের বাবা মায়ের মত জামশেদপুরের ফ্ল্যাটে আপনি আর কোপনির সংসার দেখিনি কস্মিনকালে আমরা।আর আমার ছেলে কে ভাতজল দেবেনা? অমন হীরের টুকরো ছেলে আমার! তার রোজগারেই তো সব। সে আর ক’পয়সা আনছে ওই কাজ করে?

ভদ্রলোক কথা বাড়ান না। চুপচাপ রাতের খাওয়া সেরে উঠে পড়লেন সে যাত্রায়। তিনি খুব বুদ্ধিমান। তিনি জানেন, কথায় কথা বাড়ে। ছোটবেলায় তাঁর বাবা বলতেন সংসারে মেয়েরা যখন এক তরফা অনর্গল বলে চলে তখন মৌন থাকাই সমীচীন। য পলায়তি, স জীবতি।
নিজের হোয়াটস্যাপ খুলে আদরের একমাত্র বউমা’কে একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠান ভদ্রলোক।
“আমি সারদামায়ের মত জ্ঞান দিয়ে বলব না “যে সয় সে রয়” । আনন্দে থেকো তোমরা। দুঃখ পেওনা। এটা একটা অসুখের পূর্বাভাস। এর নাম বৈজ্ঞানিক ভাষায় “মেনোপজ”। উনি আজকাল এমনই খিটখিটে হয়ে যাচ্ছেন দিন দিন। আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছো আশাকরি। রিটায়ারমেন্টের পর নিজের বাড়িতে থাকাটাও  কী যন্ত্রণা! আমিও নিরূপায়। আব আর আঁচিলের মত। ফেলতেও পারছি না, গিলতেও পারছিনা। আফটার অল বিয়ে করে আমিই তো এনেছিলাম বাড়িতে।”

মনে মনে শ্বশুরবাবা কে প্রণাম করে সে একটা জোড় হাতের ইমোজি পাঠায় মেসেজে। এসব নিয়ে আর সে মাথা ঘামাতে রাজী নয়। অনেক ঘামিয়েছে একসময়। এখন সে নিজেকে নিয়ে একটু বেশীই ভাবে। তবে কুশল তার প্রয়োরিটি। কারণ একদিন এই ছেলেটাই প্রযুক্তির খানাখন্দ পেরিয়ে তাকে পথ দেখিয়েছিল আন্তর্জালে নিজেকে মেলে ধরার। ফুড ব্লগ, পডকাস্ট, রেকর্ডিং করে আপলোডিং  সব হাতে ধরে শিখিয়েছিল। আজ রাণীয়া যতটুকুনই তার মূলে তার মা অনসূয়া আর স্বামী কুশল। কোয়ালিটি থাকলেই হয়না। তার জন্য সাপোর্ট সিস্টেম চাই। চাকরী করলে হয়ত অন্য ধরণের কেরিয়ারের সুযোগ ছিল। কিন্তু চাকরী করতে তো সে চায়নি। গুছিয়ে সংসার করতেই চেয়েছিল প্রথম থেকেই। কুশলেরও বুঝি সেটাই ভালো লেগে গেছিল প্রথম আলাপে। এমন সোজাসাপটা কথা কেউ বলেনা আজকের দিনে। সবাই শুধু নিজের কথা আগে বলে। চাকরি, বাচ্ছা সব আঁটঘাট বেঁধে, নিজের স্বার্থের দিকে ঝোল টেনে কথা বলে। বিয়ের আগেভাগেই বলে দেয় আলাদা থাকবে। চাকরী ছাড়বে না। এখনই বাচ্ছা নেবে না। কলকাতার এই উচ্চশিক্ষিত  ন্যাকাগুলো  কুশলের দুচোখের বিষ ছিল বিয়ের আগে থেকেই। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়দের মুখে শুনে একসময় বিয়ে করবেনা ঠিকই করে ফেলেছিল একপ্রকার। রাণীয়াও তো কম উচ্চশিক্ষিত নয়। তবু তার সারল্য ওকে টেনেছিল। তার জন্য মনে মনে নিজের মাতৃদেবী কে ধন্যবাদ দেয় সে। মা ই সেবার বলেছিল, প্রবাসী বাঙালিগুলো মনেপ্রাণে ভালো হয়। দেখ, এই মেয়েটার ছবি। কথা বলে নে দুজনে। এ মেয়ে তোর পছন্দ হবেই। কিন্তু সেই মা যে কেন রাণীয়ার এত পেছনে লাগে সে রহস্য আজও অধরা কুশলের মনে। রাণীয়াও ফোন রেখে ভেবেছিল একই কথা।

“আপনার হেঁশেলের কোনও কাজে আসিনি আমি কিন্তু আপনার ছেলেকে তো এই বিদেশ বিভূঁইয়ে রান্না করে ভাত দিচ্ছি। আমি আছি বলেই সে কিন্তু আজ মন দিয়ে অফিসের কাজ করে এত উন্নতি করছে। সেটুকুনিই আপনার সৌভাগ্য। তাই তো মা? একটা  কথা মা। অদূর ভবিষ্যতে মানে আপনি যখন থাকবেন না আমিই কিন্তু দেখব আপনার বুড়ো ছেলেটা কেও। তেমনি তো হয় দেখি। যেমন আপনি দেখছেন আমার শ্বশুরবাবা কে। আমার মা দেখছে বাবা কে… আরও কত বলব?’’

এসব যুক্তি এতদূরে বসে দেখাতে গেলে রসাতলে যাবে সংসার। তার চাইতে নিজের কাজ নিয়েই বরং থাকুক রাণীয়া। তার একলার রান্নাঘরেই। একান্ত আপনার একলা মহলে।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত