| 28 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: নরক দহন । তন্ময় দেব

আনুমানিক পঠনকাল: 39 মিনিট

“ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে বহে কিবা মৃদু বায়,

তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়!

পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু কুহু কুহু গায়,

কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়!”

গানের সুরটা ফের আরেকবার কানে ভেসে আসতেই হাজারটা ঝড় যেন একসাথে বইতে শুরু করল চন্দনের বুকের ভেতরে।

‘ও ডাকছে আমাকে মা… ও ডাকছে আমাকে। এক্ষুনি যেতে হবে আমায়… নাহলে ও খুব কষ্ট পাবে। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে যেতে দাও মা। নাহলে ও আমাকে একা ফেলে রেখে চলে যাবে!

যেও না… দয়া করে আরেকটুখানি সময় দাঁড়িয়ে যাও আমার জন্য। আমি আসছি তোমার কাছে… আমি আসছি!’ – মোটা নাইলনের দড়ি দিয়ে খাটের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখা চার হাত-পা প্রবল আক্রোশে ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করে উঠল চন্দন। পড়ার টেবিলে রাখা হ্যারিকেনের সরু আলোকশিখা বারবার ওর শরীরের মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে। ইলেকট্রিক বাতির উজ্জ্বল আলোয় পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে বলে হ্যারিকেনের ব্যবস্থা করেছেন অশ্রুকুমার বাবু। সেই আলো-আঁধারিতে চন্দনের এইরকম অবস্থা দেখে ঘরে উপস্থিত সকলেই তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। 

কিন্তু সুপ্রিয়া দেবী আর বাকিদের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, আদরের ছোট ছেলেকে এভাবে উন্মাদের মতো আচরণ করতে দেখে আঁচলের খুঁটে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি।

চন্দ্রপুর ।। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ

চৌধুরীরা এককালে চন্দ্রপুরের জমিদার ছিলেন। তবে শুধু চন্দ্রপুরই নয়, আশেপাশের আরও বারোটি গ্রাম মিলিয়ে এক বিশাল জমিদারি গড়ে তুলেছিলেন ওনারা। চন্দ্রপুর ছিল চৌধুরীদের শাসনের মূল কেন্দ্রবিন্দু।

চন্দ্রপুরের সীমানা ঘেঁষে বয়ে চলা মহানন্দা নদী প্রতি বছর বন্যায় পলি জমিয়ে উর্বর করে তুলত চন্দ্রপুরের মাটিকে। আর তাতে ফলত বিঘার পর বিঘা পাকা ধান এবং খেত ভর্তি শাক-সবজি। তাছাড়া ছিল হরেক রকম ফলের বাগান, পানের বর, মহানন্দা নদীর টাটকা মাছ ও পশুপালনের জন্য অপর্যাপ্ত ঘাসজমি। এককথায় প্রকৃতির আশীর্বাদধন্য ছিল চন্দ্রপুর। ব্রিটিশদের বিপুল পরিমাণ কর দিয়েও বছর শেষে যে পরিমাণ লাভ হত তাতে চৌধুরীদের জমিদারি ক্রমেই ফুলে ফেঁপে উঠল।

তবে শাসক হিসেবে কখনও কোনো বদনাম ছিল না চৌধুরীদের। তারা জোরজুলুম করে খাজনা আদায় কিংবা প্রজাদের ওপর অন্যায়, অত্যাচার বা নিপীড়নে এক্কেবারেই বিশ্বাসী ছিলেন না। প্রজারাও ওনাদের খুবই ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন।

কিন্তু কথায় বলে সব ভালোরই শেষ আছে। তেমনি চন্দ্রপুরের চৌধুরীদেরও ভালো সময় ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এলো। ব্রিটিশরা দেশ থেকে বিতাড়িত হল। জমিদারি প্রথা উঠে গেল। তারপর এলো বর্গাদার আইন। এই আইনের যাঁতাকলে পরে অল্প কিছু সংখ্যক জমি হাতে রেখে বাকি সবটাই জনসাধারণের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হল চৌধুরীদের।

শরিকেরা সব বাটোয়ারা করে নিয়ে নেবার পর যে সামান্য পরিমাণ জমি ভাগে পাওয়া গেল সেটুকু আঁকড়ে ধরে সংসারের হাল বাইতে শুরু করলেন অশ্রুকুমার চৌধুরী, চৌধুরী পরিবারের বর্তমান কর্তা। চন্দন ওনারই কনিষ্ঠ পুত্র।

অশ্রুকুমারের দুটি ছেলে – বন্ধনকুমার ও চন্দনকুমার। বন্ধনের বয়স চব্বিশ বছর। সে ওকালতি পড়া শেষ করে শিলিগুড়ির এক বড় উকিলের সহযোগী হিসেবে কাজে যোগদান করেছে দেড় বছর হল।

ছেলে কর্মক্ষম হয়ে উঠতেই অশ্রুবাবুও তাই আর দেরি করেননি, ছ’মাস আগেই ওনার পূর্বপরিচিত, কোচবিহারের বড় তামাক ব্যবসায়ী সুকমল ঘোষের একমাত্র কন্যার সঙ্গে বন্ধনের বিয়ে দিয়ে সংসার পেতে দিয়েছেন। বউমা কামিনী খুব ভালো মেয়ে। বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক সে শাশুড়িমায়ের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে পরম নিপুণতায় ওনাদের এই ছোট্ট সংসার সামলাচ্ছে।

চন্দন তুলনায় অনেকটাই ছোট। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়স। পড়াশোনাতে যেমন চৌখস, ব্যবহারও তেমনি অমায়িক। বিভিন্ন কাজে ওকে এক ডাকে পাওয়া যায়। গ্রামের লোকেরাও তাই খুব ভালোবাসে চন্দনকে। এককথায় সে সকলের নয়নের মণি। অথচ ভাগ্যের কি পরিহাস! সেই চন্দনের সঙ্গেই কিনা ঘটে গেল এমন এক ভয়াবহ কাণ্ড!

চন্দন কি সত্যিই উন্মাদ হয়ে গেছে? নাকি কেউ ওর কোনো ক্ষতি করেছে? কিন্তু এমন ভালো ছেলের অযথা কেউ ক্ষতি করতে যাবেই বা কেন? আর যদি করেও বা তাহলে তার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? – এই ধরণের নানা প্রশ্ন মহানন্দার শীতল বাতাসের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে সমগ্র চন্দ্রপুর জুড়ে কিন্তু কারোর কাছেই যেমন এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই, তেমনি কেউই জানেন না সমাধানের রাস্তার অভিমুখটা ঠিক কোনদিকে।

চন্দনের এই ঘটনার সূত্রপাত দু’সপ্তাহ আগে। সেদিন ছিল ফাল্গুনী অমাবস্যা। অশ্রুকুমার বাবু মায়ের মন্দিরে পুজো সেরে তখন সবেমাত্র খেতে বসেছেন। পাশে জ্যেষ্ঠপুত্র বন্ধনকুমার। কামিনী ওনাদের ভাত বেড়ে দিচ্ছিল  আর অশ্রুকুমার বাবুর স্ত্রী সুপ্রিয়া দেবী পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করছিলেন। হঠাৎ ওপরের ঘর থেকে পরিচারিকা শ্যামলী খুব জোরে চিৎকার করে উঠল। সকলেই টেবিলের ওপর খাবার ফেলে রেখে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ছুটে গেলেন ওপরের ঘরে। গিয়ে দেখেন শ্যামলী সিঁড়ির এক কোনায় বসে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। অশ্রুকুমার বাবুদের দেখতে পেয়ে চন্দনের ঘরের দিকে কোনওমতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে অজ্ঞান হয়ে সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটি।

বন্ধন ছুটে গিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখে ঘরটা পুরো ফাঁকা। চন্দন ঘরে নেই। বন্ধনের প্রতিরাতে ঘুমনোর আগে গোয়েন্দা উপন্যাস পড়বার শখ আছে। বইয়ের পাতার গোয়েন্দারা ঘটনাস্থলে এসে প্রথমে কি কি দেখেন তা বন্ধনের নখদর্পণে। পাশাপাশি সে নিজেও ওকালতিতে হাত পাকাচ্ছে। বন্ধন নিজেকে তাই মাঝে মাঝে প্রাইভেট ডিটেকটিভ মনে করে। তারও শার্লক বা ফেলুদা হতে মন চায়। হাতের কাছে তাই এরকম একখানা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে বন্ধনের স্ব-স্বীকৃত ডিটেকটিভ সত্ত্বা পুনরায় জেগে উঠল।

প্রথমেই বন্ধনের নজর গিয়ে পরে চন্দনের বিছানার ওপর। সে দেখে বিছানা পরিপাটি করে সাজানো অর্থাৎ নৈশভোজ সেরে এসে চন্দন বিছানায় শোয়নি। তারপর তার চোখ যায় পড়ার টেবিলে, তাতে পৃথিবীর ভূগোল বইয়ের আবহবিকার অধ্যায়টা হাঁ করে খোলা, তার মানে চন্দন কিছুক্ষণ আগেও চেয়ারে বসে ভূগোল বই পড়ছিল কিন্তু তার কি এমন ব্যস্ততা ছিল যে বইয়ের পাতা বন্ধ করার সময়টুকু অবধি পায়নি!

শোঁ শোঁ শব্দে উত্তরের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ঢুকছিল ঘরে। বন্ধন দেখল পড়ার টেবিল থেকে অনতিদূরেই উত্তরের জানালাটা হাট করে খোলা। অতএব যা ঘটার এই খোলা জানালা দিয়েই ঘটেছে। বন্ধন ঝুঁকে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল, ঘন অন্ধকারে সন্দেহজনক কিছু নজরে এলো না ওর।

জানালার পাল্লা চাপিয়ে বন্ধনের মাথায় এবার বেশকিছু সম্ভাবনা উঁকি দিতে শুরু করল – ভাইকে যদি কেউ অপহরণ করে তাহলে তারা এই জানালা দিয়েই এসেছিল কিন্তু পরক্ষনেই বন্ধনের মনে হল ঘরটা দোতালায় এবং মাটি থেকে অনেকটাই উঁচুতে। অতএব কারোর পক্ষে দোতালা বেয়ে ওপরে উঠে এসে জোর খাটিয়ে চন্দনকে এই জানালা দিয়ে নীচে নামানো সম্ভব নয়। আর তা যদি ঘটেও, চন্দন তাহলে অন্তত একবার হলেও চিৎকার করত। কিন্তু যদি কেউ ঘরে এসে ওকে ক্লোরোফর্ম শুকিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে? তাহলে অবশ্য চিৎকার করার কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু তারপরেও কি প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, স্বাস্থ্যবান চেহারার অজ্ঞান চন্দনকে জানালা দিয়ে নীচে নামানো সম্ভব? ভাবনা ও বিরুদ্ধ ভাবনার ঘূর্ণিপাকে বন্ধন দিশেহারা হয়ে ওঠে।

‘শ্যামলীও অজ্ঞান হবার আর সময় পেলো না। ভাই তখন কি করছিল তা একমাত্র শ্যামলীই দেখেছ। তবে যা পরিস্থিতি তাতে ওর জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছুই জানা সম্ভব নয়!’ – অশ্রুকুমার বাবুর দিকে ফিরে বলেছিল বন্ধন। তারপর শ্যামলীকে যাতে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তোলা যায় তার জন্য সিঁড়ির কাছে এসে মুখ বাড়িয়ে বাড়ির দারোয়ান রামহরিকে ডাক দেয় –

‘হরি’দা তুমি এক্ষুনি আমার সাইকেলটা নিয়ে মণি ডাক্তারের বাড়ি যাও। আমার বা বাবার নামে জরুরি তলব করে ওনাকে ক্যারিয়ারে পেছনে চাপিয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসো’

সুপ্রিয়া দেবী ইতিমধ্যে ঘরে প্রবেশ করেছেন। চন্দনকে ঘরে না দেখতে পেয়ে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। অশ্রুকুমার বাবু ওনাকে সামলে নিয়ে নীচে নেমে গেলে, বন্ধন ও কামিনী শ্যামলীকে পাঁজকোলা করে তুলে এনে চন্দনের বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর কামিনীকে ওর পাশে বসিয়ে রেখে বন্ধন সারা ঘরময় ক্লু খুঁজতে শুরু করে। একের পর এক ভাবনার সুতো এসে তালগোল পাকাতে থাকে ওর মাথার ভেতরে।

চন্দনের সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা তাই সে আগেভাগেই রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে তারপর অনেক রাত অবধি জেগে পড়াশোনা করে। এমনও দিন গেছে যখন রাত আড়াইটে-তিনটের সময় ঘুম ভেঙে উঠে বন্ধন বাথরুমে গেছে তখনও চন্দনের ঘরে বাতি জ্বলছে। আজও অভ্যাসবশত চন্দন সাড়ে নয়টা নাগাদ সবার আগে খাওয়া-দাওয়া সেরে দোতালায় নিজের ঘরে চলে এসেছিল কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ছেলেটা তার ঘরে নেই। এত বড় ঘরটা থেকে যেন পুরো কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে।

বন্ধন ঘরের ভেতরে আরও একবার ভালো করে সব খুঁটিয়ে দেখছিল আর তখনই ভাইয়ের অন্তর্ধানের পেছনে আরেকটি কারণ ঢেউয়ের মতো ছুটে এসে ওর ভাবনার সৈকতে সজোরে ধাক্কা দেয় – ভাই পালিয়ে যায়নি তো বাড়ি থেকে!

ভাবনাটা মাথায় আসতেই বন্ধন ফের আরেকবার দোতালার সিঁড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে অশ্রুকুমার বাবুকে পুলিশে খবর দিতে বলে চন্দনের ঘরে ফিরে এসে কামিনীর কোনোরকম বারণ না শুনে উত্তরের জানালাটা খুলে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে নেমে যায়। তারপর সোজা হাঁটা দেয় চৌধুরী ভিলার পেছনে জঙ্গলাকীর্ণ মাঠের দিকে।

পূর্বগঞ্জ । ৭০ বছর আগে

‘তোমার ছেলের ওপর স্বয়ং মহাদেবের দৃষ্টি আছে ইন্দুভূষণ। তাই আমি ওর নাম দিলাম রুদ্রাক্ষ। এই ছেলে বড় হয়ে যোগী পুরুষ হবে, অশুভের বিনাশ করবে। তুমি কিন্তু ওকে তোমার মমতার বন্ধনে বাঁধার চেষ্টা কোরো না শুক্লা। সংসারে আটকে থাকার জন্য ওর জন্ম হয়নি। যদি সেই চেষ্টা করো, নিজেরাই মনঃকষ্টে ভুগবে!’ – কথাগুলো বলে শিশুটির ছোট্টদুটো পায়ের পাতা নিজের মাথায় ঠেকালেন সাধুবাবা। তারপর পরম তৃপ্তির স্বরে বললেন – ‘হরহর মহাদেব! আশীর্বাদ করো বাবা। এভাবেই যেন আজীবন তোমার চরণে দাস হয়ে থাকতে পারি’

সাধুবাবার কথা শুনে চোখ ছলছল করে উঠল ইন্দুভূষণ ও তার স্ত্রী শুক্লার। চার মাসের শিশুপুত্রটির স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা হুহু করে উঠল ওনাদের। গত উনিশ-কুড়ি বছর ধরে এই সাধুবাবা বছরে একবার করে পূর্বগঞ্জে আসেন। প্রতিবারই এক সপ্তাহের মতো থাকেন। সেই এক সপ্তাহে গ্রামের সকলেই বাবার কাছে তাদের নানান অভাব-অভিযোগ, সুবিধা- অসুবিধা, সুখ-দুঃখের ডালি নিয়ে আসেন।

কেউ আসেন মেয়ের বিয়ে কেন হচ্ছে না তার সমাধান চাইতে, কেউ আবার সদ্যজাত সন্তানের কপালে কি অপেক্ষা করে রয়েছে সেই বিষয়ে খোঁজ নিতে। সাধুবাবা কাউকে ফেরান না। পদ্মাসনে বসে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সকলের সব প্রশ্নের জবাব দেন। অনেকেই শ্রদ্ধা পরবশ হয়ে বাবাকে ফল-মূল, আতপ চাল, আনাজপাতি ইত্যাদি দিয়ে যান। কিন্তু আজ অবধি কেউ সাধু বাবাকে কারোর থেকে কখনোই কিছু চাইতে দেখেননি তেমনি কেউ বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ভোজন করাতে চাইলেও সাধুবাবা তাতে রাজি হননি।

কিন্তু ইন্দুভূষণকে অবাক করে দিয়ে সাধুবাবা বললেন – ‘আজ তোমার ঘরে আমায় ভোজন করাবে ইন্দুভূষণ? যে কাজের জন্য এতদিন ধরে আমি  পূর্বগঞ্জে এসেছি তা এতদিনে সফল হয়েছে। আপাতত দশ বছরের জন্য এইখানে আমার কাজ ফুরিয়েছে। দশ বছর পর আবার দেখা হবে তোমাদের সাথে। তখন এসে তোমার ছেলেকে আমার সঙ্গী করে নিয়ে যাবো!’

ইন্দুভূষণ ও শুক্লা দুজনেই জানেন সাধুবাবার বলা প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। তাই ছেলের বিষয়ে এই সমস্ত কথা শোনার পর ওনাদের মন যেমন খুশি হয়েছিল তেমনি সন্তানের সঙ্গে আসন্ন বিচ্ছেদের দুঃখে ঘন কালো মেঘের মতো ভারাক্রান্তও হয়ে উঠেছিল।

২.

‘মা… তুমি শুনতে পাচ্ছ? ও আমাকে ডাকছে মা। কিগো শুনতে পাচ্ছ না? আমি ওর কাছে যাবো মা। আমাকে যেতে দাও না গো… যেতে দাও না’ – চন্দনের করুণ আর্তি শুনে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সুপ্রিয়া দেবী। কামিনীও ছুটে গেল ওনার পিছু পিছু।

অশ্রুকুমার বাবুর আজকাল তাই বড্ড অসহায় লাগে সন্ধ্যে নামলেই। চোখের সামনে ছেলের এই পরিস্থিতি দেখেও বাবা হয়ে তিনি কিছু করতে পারছেন না – এরচেয়ে বড় যন্ত্রণা আর কি হতে পারে।

অশ্রুবাবু চন্দনের কাছে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন। জ্বরে ছেলেটার গা হাত পা পুড়ে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। তিনি টেবিল থেকে পেতলের গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে চন্দনকে জল খাওয়াতে চাইলেন কিন্তু চন্দন ওর চোয়ালের একধাক্কায় অশ্রুবাবুর হাত থেকে গ্লাসটাকে মেঝেতে ফেলে দিল। ঝনঝন শব্দে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। কারোর চোয়ালেও যে এতখানি জোর থাকতে পারে তা এই প্রথম অনুভব করলেন অশ্রুকুমার বাবু।

রাতের বেলা ঠিক মতো ঘুম না হওয়ায় ও তিন বেলা ভালো করে না খেতে খেতে চন্দনের শরীর এই কয়েক দিনেই একদম ভেঙে পড়েছে কিন্তু সন্ধ্যা হলেই যেন ওর ওপর সহস্র উন্মত্ত হস্তীর বল এসে ভিড় করে। পরিস্থতি এতটাই লাগামছাড়া হয়ে উঠছিল যে ওকে নাইলনের শক্ত মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছেন অশ্রুবাবু।

এতে হয়তো চন্দনের অন্ধকারে যখন খুশি তখন বেরিয়ে যাওয়া আটকানো গেছে কিন্তু ওর শরীরের ওপর খুব বড় রকমের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দড়ির বাঁধনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে চামড়া কেটে রক্ত পড়ে হাতে পায়ে গভীর কালশিটে পড়ে গেছে, সারা শরীরে অজস্র ক্ষতচিহ্ন কিন্তু তাতেও চন্দনের কোনো হেলদোল নেই। অজানা, অচেনা ও অদৃশ্য কারোর সঙ্গে দেখা করার তীব্র বাসনা নিয়ে রাতভর ধ্বস্তাধস্তি করে ছেলেটা। তারপর নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারাদিন বেঘোরে ঘুমোয়। সন্ধ্যা নামতেই ফের একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

গত দু’সপ্তাহ ধরে পুত্রের এইরকম পরিণতি দেখে তাই ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছেন অশ্রুবাবু ও চৌধুরী বাড়ির সকলেই। কত ডাক্তার যে এই বারো-তেরো দিন ধরে চৌধুরী বাড়িতে এসে অশ্রুকুমার চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্রকে ভালো করার চেষ্টা করে গেছেন তার ইয়ত্তা নেই।

‘ভাই কি আবারও হিংস্র হয়ে উঠেছে?’ – বন্ধনের ডাকে হুঁশ ফিরল অশ্রুবাবুর। ধাতস্থ হয়ে বললেন – ‘হ্যাঁ রে বাবা। তুই কিছু একটা কর। ওর এই কষ্ট আর চোখে দেখা যায় না’

– ‘তুমি চিন্তা কোরো না বাবা। আমি দেখছি কি করা যায়। আজ সকালে ভাইকে যে নার্ভের ডাক্তারটা দেখানো হল তিনি দেখলাম রিপোর্টে ভাইকে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করার কথা লিখেছেন। কিন্তু বাবা আমার মনে হয় না ভাইয়ের কোনো নার্ভের দোষ রয়েছে বা ও পাগল। আমি তো জানি কি পরিস্থিতিতে পেয়েছিলাম ওকে প্রথম দিন, কোনোভাবেই তাই আমাকে কেউ বিশ্বাস করাতে পারবে না ভাইয়ের এসব কোনো রোগ আছে। তুমি আমাকে আর একটা দিন দাও বাবা। ভাইকে আমি ভালো করে তুলবোই। কাল ভোরের ট্রেনে আমি আলিপুরদুয়ার যাচ্ছি। দেখি কতদূর কি করতে পারি।’

এনজেপি স্টেশন

চন্দ্রপুর থেকে রাত তিনটার বাস ধরে দেড় ঘণ্টার মধ্যে এনজেপি স্টেশনে পৌঁছে গেল বন্ধন। ভাগ্যিস কামিনীর কথা শুনে জ্যাকেট আর কানঢাকা উলের টুপিটা সঙ্গে এনেছিল নাহলে ঠাণ্ডায় বেশ ভুগতে হত ওকে।

রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উত্তরবঙ্গে শীত একটু বেশিদিন ধরেই রাজত্ব করে। ফাল্গুনের এই ভোরবেলায় তাই শুনশান এনজেপি স্টেশন ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে। এবছরের মতো বিদায় নেবার আগে শীত তার আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে।

এখনও কিন্তু দারুণ ঠাণ্ডা রয়েছে তাই না?’ – অসাড় হয়ে আসা আঙুলগুলোকে গরম করার জন্য হাতের তালাদুটো ঘষতে ঘষতে বলল বন্ধন। ট্রেনের কামরায় ওর উল্টো পাশের সিটে বসে থাকা লোকটা বন্ধনের কথার প্রত্যুত্তরে বলল – ‘সুউচ্চ ও সুদৃশ্য পাহাড় যার প্রতিবেশী তার আঙিনায় শীত একটু বেশিদিন ধরে খেলা করবে না তা কি হতে পারে!’

লোকটার মুখে শীতের এমন অদ্ভুত অথচ সুন্দর বর্ণনা শুনে বন্ধন খানিকটা অবাক আবার খানিকটা খুশিও হল। ওর জীবন ও চিন্তাভাবনা শেষ কয়েকদিনে শুধু অন্ধকারের অভিমুখেই ছুটে চলছিল। এখনও যে দুনিয়াতে সুন্দরের অস্তিত্ব রয়েছে লোকটার কথাই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। বন্ধন ওনার কথা শুনে অনেকদিন পর একটু হাসল।

ইঞ্জিনের হুইসল শোনা যাচ্ছে। বন্ধন হাতঘড়িতে দেখল পাঁচটা বাজতে আরও দশ মিনিট বাকি। তার মানে ইঞ্জিন সেট হচ্ছে। বন্ধন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলিপুরদুয়ারে পৌছতে হবে। বেরোনোর আগে বন্ধন দেখে এসেছে সারা সন্ধ্যা ও রাত দড়ির বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে যাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ধীরে ধীরে নেতিয়ে পরেছে ভাইয়ের দেহ।

বন্ধন লক্ষ্য করে দেখেছে অন্যান্যদিনের মতো আজও চন্দনের মুখ ক্লান্ত মলিন হলেও ওর ঠোঁটের কণায় অবাক করা একটুকরো মুচকি হাসি লেগে আছে। বন্ধন এই হাসির অর্থ জানে। কেউ একজন চ্যালেঞ্জ করছে ওকে। হাসিটার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে নিজের ভাইকে পারলে আমার কবল থেকে বাঁচিয়ে দেখাও!

তবে বন্ধনও ছাড়ার পাত্র নয়। ভাইকে সে বাঁচাবে… বাঁচাবেই। সেই সংকল্প নিয়েই চন্দনের কবজি ও পায়ের ক্ষতস্থানে মা’কে মলম লাগাতে বাড়ি থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পরেছিল বন্ধন।

স্টেশনে ঢোকার মুখে সিপিএমের লাল ঝাণ্ডা হাতে কিছু লোক ফেস্টুন লাগাচ্ছে। ‘ওহ! আজ তো মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পাহাড়ে আসার কথা!’ – মনে মনে ভাবল বন্ধন। শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশন মুখ্যমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে আজ দুপুরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বন্ধনেরও থাকার কথা ছিল তাতে কিন্তু ভাইকে সুস্থ করা সবার আগে জরুরি।

কিন্তু এই কাজে যাকে ওর সবচেয়ে দরকার তাকে কি আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে? সে তার আস্তানায় ফিরেছে কিনা সেই খোঁজ পেতেই দশদিন লেগে গেল বন্ধনের কিন্তু যদি গিয়ে দেখে ফের সে তার আস্তানা বদলে ফেলেছে তাহলে বন্ধন কি করবে? কোথায় খুঁজবে ও তাকে?

তবুও ভাইয়ের জন্য বন্ধনকে এটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। আশার আলো বলতে এইটুকুই যে বন্ধনকে সে বহুদূর থেকেও চরম মুহূর্তে বাঁচিয়ে এনেছে। আশ্বাস দিয়েছে যে আমি আছি, নজর রাখছি তোমার গতিবিধির ওপর। সেই ভরসা ও বিশ্বাসের ওপর ভর করেই কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা এনজেপি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করতে থাকে বন্ধন।

      

জয়ন্তীর পথে

ঘন কুয়াশার জন্য নির্ধারিত সময়ের পনেরো মিনিট পর ট্রেনটা ছাড়ল। ভারতীয় রেলের ‘দেরি’ নামক রোগের সঙ্গে বন্ধন সুপরিচিত। তবুও ওর বড্ড বিরক্ত লাগল আজ। একেকটা বেলা এখন ওর কাছে একেক বছরের সমান। আলিপুরদুয়ার পৌছতে অন্তত চার-সাড়ে চার ঘণ্টা তো লাগবেই। তারপর জংশনে নেমে প্রতিমের সঙ্গে দেখা করে বাস ধরে সোজা জয়ন্তী। সরাসরি জয়ন্তী যাবার বাস না পেলে কপালে যে কি দুর্ভোগ আছে তা বন্ধন জানে। পাঁচ বছর আগে সেটা ও হাড়েহাড়ে টেরও পেয়েছিল।

তবে বেশি লেট করেনি ট্রেনটা। দশটার মধ্যেই আলিপুরদুয়ার জংশনে এসে পৌঁছেছে। বন্ধনের চোখ লেগে গিয়েছিল। রাতে ঘুমনোর সময়ই পায়নি আজ। আর যে চড়াই উতরাই পেরিয়ে ওকে যেতে হবে তাতে ঘুম খুব জরুরি, নাহলে শরীর সঙ্গ দেবে না কোনোভাবেই। তাই এই ঘণ্টা চারেকের ঘুম বন্ধনকে বেশ চাঙ্গা করে তুলেছে। তবে ও আরও বেশি চাঙ্গা হল যখন স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখল প্রতিম ওর জন্য হাসিমুখে অপেক্ষা করে রয়েছে।

এতদিন পর দেখা হওয়ায় দু’বন্ধুই বেশ আপ্লুত হয়ে পড়ল। সৌহার্দ্য আলিঙ্গন শেষ হলে বন্ধন খানিকটা অভিমানের সুরে বলল – ‘বাবা নিজে এসে আমার বিয়ে উপলক্ষে তোদের নেমন্তন্ন করে গেলো, তবুও তোর একবারও মনে হল এতদিনের পুরনো বন্ধুর বিয়ে, যাওয়াটা দরকার। আমি তো ভেবেছিলাম যতদিন বেঁচে আছি কথাই বলব না আর তোর সাথে!’

       ‘ক্ষমা করে দে ভাই। আমার কিছু করার ছিল না। কাকু নিমন্ত্রণ করে যাবার পর থেকেই মা-বাবা, আমি তিনজনেই প্রস্তুতি নিয়ে ছিলাম যে চন্দ্রপুর যাবো। তোর বিয়েও অ্যাটেন্ড করা হবে আর হাওয়া বদলও হবে কিন্তু তার আগেরদিনই আমার সিনিয়র উকিল খবর পাঠালেন যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওনার একটা ডোমেস্টিক ভায়লেন্সের কেস হাতে আছে সেটা যেন আমি হ্যান্ডেল করি। ওনার আন্ডারে কাজে ঢুকেছি তখন মাত্র আট মাস হয়েছে, মুখের ওপর কিছুতেই না করতে পারলাম না রে। প্লিজ আমাকে মাফ করে দে’ – বিনয়ের সুরে বলল প্রতিম।

       ‘সে আমি বহু আগেই করেছি’ – প্রতিমের মুখ দেখে বন্ধন এবার সুর নরম করল – ‘সেদিন যদি কেসটা না নিতি তাহলে কি আর আজ আমরা প্রতিম দে’র মতো এতো বড় মাপের উকিলকে পেতাম। দারুণ কাজ করছিস ভাই একের পর এক। আমাদের শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশনে মাঝে মধ্যেই তোকে নিয়ে কথা হয়। আমরা সকলেই তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি। নেক্সট টার্গেট কি? কলকাতা হাইকোর্ট!’

       ‘ইচ্ছে তো তেমনই। এখন এসব বাদ দে তো। কাজ সারাজীবন থাকবে। আগে বল তুই আমাকে এত জরুরি তলব করে বড় মহাকালে গিয়ে গুরুদেবের আস্তানার খোঁজ করে আনতে বললি কেন? ফোনেও তোর স্বর খুবই চিন্তিত শোনাচ্ছিল। এখন দেখছি তোর চেহারা শুকিয়ে গেছে, চোয়াল বেরিয়ে এসেছে, চোখের নীচে কালি, অন্তত দশদিনের না কামানো দাঁড়ি। ব্যাপারটা কি? সব ঠিক আছে তো?’

       ‘না ভাই। কিচ্ছু ঠিক নেই। বড় বিপদের মধ্যে আছি… বড় বিপদের মধ্যে…’ – কথাটা বলে বন্ধন হুড়মুড় করে কেঁদে ফেলল। এতদিন ধরে চেপে রাখা সমস্ত কষ্ট যন্ত্রণা বন্ধুর সামনে জয়ন্তী নদীর স্রোতের মতো তীব্র বেগে বেরিয়ে এলো অক্ষিকোটর থেকে।

গুরুদেবের ডেরায়

বন্ধনকে দেখা মাত্রই প্রতিম বুঝতে পেরেছিল এই শরীরে বন্ধনের পক্ষে পাহাড়ের বন্ধুরতা পেরোনো অসম্ভব। তাই প্রতিম প্রথমে বন্ধনকে ওর বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে বন্ধন দাঁড়ি কামিয়ে, ভালো করে স্নান করে, প্রতিমের মায়ের হাতে বানানো সুস্বাদু নিরামিষ পদ দিয়ে আহারাদি সেরে তারপর প্রতিমের সদ্য কেনা মারুতি এইট হান্ড্রেডে চেপে রওনা দিয়েছিল জয়ন্তীর দিকে।

       জয়ন্তী পৌঁছে ফরেস্ট অফিসের গাড়ি জমা রেখে, যাবতীয় সইসাবুদ সেরে নিয়ে তারপর হাঁটা দিয়েছিল বড় মহাকালের দিকে। ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘর ছুঁলেও জয়ন্তী নদী, বক্সা পাহাড়, পাথরের পথঘাট সব কুয়াশায় ঢাকা। বন্ধনরা যত ওপরে উঠছিল তত শুনতে পাচ্ছিল পাতার গায়ে শিশির বিন্দুর টুপ টুপ করে পতনের শব্দ। তবে খাড়াই থাকায় এই শীতেও ঘেমে উঠছিল দুজনেই। দু’সপ্তাহ ধরে ভালো করে ঘুম হয়নি বলে বন্ধনের আর পা চলছিল না। ক্লান্ত হয়ে বারবার বসে পড়ছিল পাথরের ওপর। প্রতিম ওকে ‘আর সামান্য পথ বাকি’ বলে প্রত্যেকবার উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছিল ঠিকই কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছিল না। বন্ধনের এরপর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে শুরু করল। পেটের ভেতরটা যেন পাক দিয়ে উঠল। তারপর ও হড়হড় করে বমি করে ফেলল। প্রতিম দেখল বন্ধন আলগা করে শরীর ছেড়ে দিল মাটির ওপর আর তৎক্ষণাৎ পাশেই মাটিতে গেঁথে থাকা একটা ভাঙা পাথরের তীক্ষ্ণ কোণায় লেগে কেটে গিয়ে বন্ধনের কপালের ডান দিক থেকে গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করল।

       মাঝ পথে এসে বন্ধনকে এমন অবস্থায় দেখে প্রতিমের এবার অসহায় লাগতে শুরু করল। ও ছুটে গিয়ে রুমাল চাপা দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করল ঠিকই কিন্তু তাতে কোনও ফল হল না। ঠিক এমন সময়ই জঙ্গলের সমস্ত গাছপালা হাওয়ায় দুলতে শুরু করল। পাতায়-পাতায়, ডালে-ডালে ধাক্কা লেগে সরসর শব্দে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। ঠিক তারপরেই একটা মাতাল করা জঙ্গুলে গন্ধে প্রতিমও জ্ঞান হারাল।

       যখন ঘুম ভাঙল তখন প্রতিম একটা অন্ধকার ঘরের ভেতরে মাটির মেঝেতে তালপাতার চাটাইয়ের ওপর শুয়ে আছে। চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসেই প্রথমে ওর মাথায় এলো বন্ধন কোথায়?

হুড়মুড় করে অন্ধকার ঘরটা থেকে বেরিয়ে বাইরে পা রাখতেই প্রতিম বুঝতে পারল যে ও গুরুদেবের ডেরায় এসে পৌঁছেছে কারণ এই মাটির ঘর, আঙিনা, সামনে মাটির মন্দিরে সাতফুট লম্বা শিবলিঙ্গ – সব ওর চেনা কিন্তু প্রতিম এই ভেবে আশ্চর্য হল যে এখানে ও এলো কিভাবে? ওরা দুজনে যেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল সেখান থেকে এতটা রাস্তা আসতে আরও অন্তত মিনিট চল্লিশ তো লাগতই। আর এই পথে গাড়ি চলা অসম্ভব। তাহলে ওদের তুলে নিয়ে এল কে? তবে কি গুরুদেব ওদের…

ভাবনাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না প্রতিম কারণ বন্ধন ওকে ডাকছে – ‘কিরে প্রতিম ঘুম ভাঙল অবশেষে? নন্দদা তোকে ডাকছেন। গুরুদেবের কাছে নিয়ে যাবেন আমাদের। চল তাড়াতাড়ি’

       প্রতিম দেখল দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। অনতিদূরে পাহাড়চূড়াগুলো ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। একটু বাদেই বিন্দু বিন্দু আলোয় ভরে উঠবে পেছনের পাহাড়গুলো। ওটা ভুটান পাহাড়ের ভাগ। এমনকি বড় মহাকালও ভুটানেরই অন্তর্গত কিন্তু মহাদেব এসব দেশ-কালের সীমানা মানেন না। তাই তো ভুটানের মাটিতে তার এই জাগ্রত মন্দিরে সকলে ভক্তিভরে পুজো দিতে আসে।

       প্রতিম আড়মোড়া ভাঙল। তারপর বন্ধনের দিকে তাকাতেই ও অবাক হয়ে গেল। বন্ধনের কপালে আজ দুপুরে পাথরে কাটার ক্ষতস্থানটা উধাও। তবে কি প্রতিমের ধারনাই সঠিক? গুরুদেব কি আবার অলৌকিক ক্ষমতা দেখানো শুরু করলেন কিন্তু সেবার তো তিনি বলেছিলেন এই শেষ! মানুষের জীবন এবং মানব সভ্যতার কোনও বিষয়েই তিনি আর কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না। তবে কি এমন হল যে গুরুদেব নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলেন?

       এমন হাজারো সব প্রশ্নের মায়াজালে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে গুরুদেবের ধ্যানকক্ষের দিকে পা বাড়াল প্রতিম।

৩.

এভারেস্ট শৃঙ্গ ।। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ

‘প্রভু এই শৃঙ্গের নাম কি?’

– এই শৃঙ্গের অনেকগুলো নাম রয়েছে বৎস। কেউ বলে চোমোলাংমা, কেউ বলে সগরমাথা, কেউ বা আবার এভারেস্ট। তুমি কি জানো এই যে আমরা এই শৃঙ্গের চূড়ায় বসে আছি তা যে আমাদের আগে আর কেউ চড়েনি!

– সত্যি?

– হ্যাঁ! বৎস। আরও জেনে রাখো আমাদের মতোই একজন বাঙালি মানুষ, নাম রাধানাথ সিকদার, তিনি এই শৃঙ্গের উচ্চতা মেপেছেন, তাও শুধু অঙ্ক কষে। ভাবতে পারো! তার অঙ্ক অনুসারে, এই শৃঙ্গ বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম স্থান।

– কি দারুণ। তাহলে গুরুদেব, পৃথিবীর এই সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গে কি আমরা ছাড়া আর কেউ কখনও উঠতে পারবে না?

– পারবে বৎস, অবশ্যই পারবে কিন্তু সেই ঘটনা ঘটতে আরও তেইশ বছর বাকি। তবে একজন নয়, দু’জন মানুষ মিলে পা রাখবে এই সুন্দর শৃঙ্গের চূড়ায়। যেমন আজ আমরা রাখলাম।

– গুরুদেব, ভগবান শিব আসলে কে? তিনি কি সত্যিই বরফঘেরা এই হিমালয়ে হেঁটে বেড়াতেন? তিনিও এই সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় পা রেখেছেন?

       – অতি উত্তম সব প্রশ্ন করেছ তুমি রুদ্র। তোমার এই কৌতূহল, জানার আগ্রহ দেখে আমি যারপরনাই আনন্দ অনুভব করছি। একে একে বলছি শোনো।

মহাদেব আসলে কে তা জানতে ও বুঝতে দীর্ঘ তপস্যার প্রয়োজন। কয়েক জন্ম তপস্যার পরও বহু যোগী ঋষি বুঝতে পারেন না ভগবান শিবের প্রকৃত স্বরূপ। তিনি সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। তোমার চোখের সামনে মাটিতে পতনশীল এই শীতল বরফকুচি থেকে শুরু করে মরুভূমির তপ্ত বালিকণা – মহাদেব সর্বত্র রয়েছেন। তোমাকে যে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বাণী পড়ে শুনিয়েছিলাম তা নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি – ‘শিবজ্ঞানে জীব সেবা’ অর্থাৎ ভগবান শিব সকলের মাঝে রয়েছেন। জীবনে সৎ থেকে বিনা স্বার্থে জীবসেবা করে গেলে তবেই ভগবান শিবের চরণ লাভ সম্ভব।

       – তবে কি তিনি আমার মধ্যেও রয়েছেন?

       – অবশ্যই। তুমিও তো শিব। তাই তো জন্মের পর তোমার মা বাবা যখন আমার আশীর্বাদ নিতে এসেছিলেন তোমার চরণে আমার মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে তোমার নাম রেখেছিলাম রুদ্রাক্ষ।

       – গুরুদেব আমি আপনার একনিষ্ঠ শিষ্য। আমি আপনার চরণের দাস। আপনি কেন আমার প্রণাম নেবেন। বরং আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।

       – থামো বৎস! থামো। মনে রাখবে প্রণাম ও শ্রদ্ধা বয়স দেখে নয়, একজন মানুষের কর্মের ওপর নির্ভর করে।

ধ্যানকক্ষ । জয়ন্তী পাহাড়

‘তোমরা দু’জন আমার পিছুপিছু এসো’ – শান্ত স্বরে কথাটা বলে জঙ্গলের দিকে পা বাড়াল নন্দকিশোর। ওর আদেশ মেনে প্রতিম ও বন্ধনও পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল। পাঁচ বছর আগে প্রথমবার যখন গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তখনই নন্দকিশোরের সঙ্গেও পরিচয় হয় ওদের। গুরুদেবের নির্দেশ মেনে নন্দকিশোরই নাকি সেদিন ওদের ডেরায় উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল।

‘আজও কি তবে নন্দকিশোরই ওদের…’ – ভাবনাটা মাথায় আসতেই নন্দকিশোরের হেঁটে চলার ধরণ ভালো করে লক্ষ্য করল প্রতিম। সেবারের মতোই অবাক করার মতো কিছু ওর নজরে এলো না। নন্দকিশোরের যা চেহারা তাতে দুজন মানুষকে একা হাতে তুলে এতটা পথ নিয়ে আসা সম্ভব নয়। গুরুদেব হয়তো নিজের অলৌকিক ক্ষমতা জাহির করতে চান না বলেই  নন্দকিশোরের নাম নিয়েছিলেন।

তবে নন্দকিশোরকে নিয়েও প্রতিম ও বন্ধনের মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। নন্দকিশোর সেবার গল্পে গল্পে বলেছিল পনেরো বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর গুরুদেবের সঙ্গে দেখা হয় আর তারপর থেকে অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে সে গুরুদেবের সঙ্গেই রয়েছে অর্থাৎ হিসেব করলে নন্দকিশোর এখন সত্তর বছরের একজন বৃদ্ধ কিন্তু চেহারা দেখলে কেউ বলবে না নন্দকিশোরের এত বয়স। ওরা তো নন্দকিশোরকে সেবার সমবয়সীই ভেবেছিল। পরে আসল বয়স হিসেব করে ওদের মুখে আর রা কাড়েনি! নন্দকিশোর কিভাবে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে সেটা প্রতিমদের কাছে রহস্যের বিষয়। নন্দকিশোরকে জিজ্ঞেস করাতে সে হেসে বলেছিল – ‘যোগ ব্যায়াম করে!’

পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরে পাহাড় ও জঙ্গলের পথে সাবধানে হাঁটার পর ওদের একটি ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে গুহার সামনে এনে দাঁড় করাল নন্দকিশোর। তারপর বলল – ‘তোমরা ভেতরে যাও। গুরুদেব তোমাদের অপেক্ষায় রয়েছেন। আমি বাইরে পাহারায় আছি’

নন্দকিশোরের কথা আপ্তবাক্য মেনে ওরা দুজনেই পা বাড়াল গুহার ভেতরে। এতক্ষণ ধরে নন্দকিশোরের হাতে থাকা টর্চের আলোয় পথে দেখতে অসুবিধা হয়নি কিন্তু গুহার ভেতরে পা রাখতেই ওদের চোখ ঘন অন্ধকারে পুরোপুরি ডুবে গেল। চরম সাবধানতার সঙ্গে গুহার প্রস্তর দেয়ালে হাতড়ে হাতড়ে খানিকটা পথ এগোতেই ওরা দেখতে পেলো নীলাভ সবুজ আলোয় ভরে আছে চারপাশ। এতটাই স্নিগ্ধ অথচ তীব্র সেই আলো যার বর্ণচ্ছটায় সমগ্র গুহা দৃশ্যমান হয়ে রয়েছে। এরকম অপার্থিব দৃশ্য দেখে প্রতিম ও বন্ধন দুজনেই মুগ্ধ হয়ে গেল। ওদের মনে হল ওরা যেন কোনো রূপকথার জগতে এসে উপস্থিত হয়েছে।

বন্ধন প্রতিমকে ফিসফিস করে বলল – ‘এগুলোকে বলে জ্বলন্ত ছত্রাক। গুহার স্যাঁতস্যাঁতে শরীরে এত পরিমাণে জন্মেছে যে পুরো আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছে গুহাটাকে’। তারপর ভালো করে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল – ‘গুহাটার নীচে হয় জয়ন্তী নদীর চোরাস্রোত কিংবা কোনো পাহাড়ি ঝোরা রয়েছে, নাহলে শীতকালেও এতটা ভিজে উঠত না, ছত্রাকগুলোও জন্মাত না’

প্রতিম জানে গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ে পড়ে বন্ধন নিজেকে ডাকসাইটের প্রাইভেট গোয়েন্দা মনে করে, তাই ও খোঁচা দিয়ে বলল – ‘এখন তোর ব্যোমকেশগিরিটা বন্ধ কর আর আমাদের গুরু ব্যোমকেশের কাছে চল!’

জলের ক্ষয়কার্যের ফলেই হোক কিংবা ভুমিকম্পে, গুহার ভেতরের বড় বড় পাথরগুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুহাগর্ভে বেশ কয়েকটা প্রাকৃতিক সিঁড়ি বানিয়ে ফেলেছে। সেগুলোরই একটা ধরে নীচে নেমে এলো দু’জনে। প্রতিম ওপরের দিকে তাকিয়ে নীচ থেকে গুহা মুখের উচ্চতা ঠাওর করার চেষ্টা করল – অন্তত কুড়ি ফুট তো হবেই, বেশি হলেও অবাক হবার কিছু নেই।

বন্ধন ততক্ষণে এগিয়ে গিয়েছে সামনের দিকে। প্রতিম দেখল বন্ধন ওর হাত থেকে তিরিশ চল্লিশ হাত দূরে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রতিমও গুহার পিচ্ছিল মাটি ও পাথরের মেঝের ওপর দিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে বন্ধনের পাশে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো দৃশ্যটা –

একটা বিশাল বড় মাপের শ্বেতশুভ্র পাথরের ওপর গুরুদেব রুদ্রাক্ষ ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে রয়েছেন আর জ্বলন্ত ছত্রাকগুলো ওনাকে ঘিরে এমন ভাবে জ্বলছে যেন গুরুদেবের শরীর থেকে দিব্যজ্যোতি ঠিকরে বেরোচ্ছে। বাকরুদ্ধ প্রতিম এরকম অলৌকিক দৃশ্য দেখে আনতভূমি হয়ে প্রণাম জানাল গুরুদেবকে।

ছল ও চাতুরী

ভক্তিভরে প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়াতেই প্রতিম দেখতে পেল গুরুদেব স্থির দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কি তেজ সেই চোখে, কি তীব্র সেই দৃষ্টি। প্রতিমের মতো সাধারণ মানুষের কি সাধ্যি যে সেই দৃষ্টির সামনে যুঝবে, ও তাই শ্রদ্ধাবনত হয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। সেবার জেদ দেখিয়ে গুরুদেবের চোখের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকার ফলে যে কি ফল ভোগ করতে হয়েছিল অমল তা জানে। ছেলেটা এখনও ঠিক মতো চোখে দেখতে পায় না। গুরুদেব কৃপা না করলে অমল পুরোপুরি অন্ধই হয়ে যেত সেদিন।

       প্রতিম ও বন্ধন একসাথে শ্রদ্ধা মেশানো স্বরে বলল – ‘প্রণাম গুরুদেব’

       – ‘জয় শিবশম্ভু। মহাদেব তোমাদের মঙ্গল করুন। তা প্রতিম, আমার আস্তানা আছে কিনা সেটা কি শুধু দূর থেকে দেখে নিয়ে চলে গেলেই হবে, গুরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করে যাবে না? আমি কিন্তু খুব কষ্ট পেয়েছি বাবা’

       গুরুদেব রুদ্রাক্ষের কথা শুনে লজ্জা ও অনুতাপে প্রতিমের প্রায় মাটিতে মিশে যাবার জোগাড় হল। ও কোনওমতে বলল – ‘আসলে গুরুদেব, আমি আপনাকে বিব্রত করতে চাইনি। নন্দদা’র সঙ্গে বড় মহাকাল মন্দিরে দেখা হয়ে যাওয়ায় ওনার থেকেই খবর পাই যে আপনি আগামী অমাবস্যা অবধি এখানেই থাকবেন এবং নতুন ধ্যানকক্ষ গড়ে বর্তমানে ধ্যানমগ্ন রয়েছেন। তাই আমি আর আপনার ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি’

       ‘তুমি জানোই প্রতিম আমার কাছে আমার শিষ্যেরা সকলেই সন্তানসম। পিতামাতা যতই কাজে ব্যস্ত থাকুন না কেন তারা কিন্তু ঠিক তাদের সন্তানের জন্য সময় বার করেন। আমিও তাই আমার সন্তানদের কুশল সংবাদ জানার জন্য সামান্য সময় বার করতে পারবো না তা কি হয়?

আর বাবা বন্ধন তুমি বিবাহের মতো এত বড় একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলে কই আমাকে তো একটা খবর দিলে না। তোমার এই বুড়ো বাবাকে ভুলে গিয়েছ নাকি এই কয়েক বছরে?’

এবার বন্ধনের লজ্জায় পরার পালা। সে সজল নয়নে করজোড়ে গুরুদেবের দিকে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে বলল – ‘প্রভু, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করুন। আসলে মা তখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় খুব তাড়াহুড়ো করে আমার বিবাহকার্য সম্পন্ন করতে হয়েছে। কোর্টে একের পর এক কেস থাকায় আমি ছাদনাতলায় বসে বিবাহটুকু বাদে আর কোনো কাজেই সাহায্য করতে পারিনি। বাবা আর ছোট ভাই মিলে সমস্ত দিক সামলেছে। অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করুন গুরুদেব। ইচ্ছে থাকলেও বাবার পক্ষে আপনার ঠিকানা খুঁজে এখানে পৌঁছে নিমন্ত্রণ করাটা সম্ভব ছিল না।

কিন্তু গুরুদেব আমি আজ আপনার কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি। দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আমার ভাইয়ের বড় বিপদ। আপনি আমার সাথে চন্দ্রপুরে না গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাদের সব উজাড় হয়ে যাবে’

– আমি জানি তুমি কি কাজে এসেছ বন্ধন। তবে আমি শুধু এতক্ষণ ধরে তার সাহসের মাত্রাটা দেখছিলাম যে তোমার বেশ ধরে আমার ধ্যানকক্ষ অবধি এসে পৌঁছেছে।

কি হে মায়াবিনী ভালোই তো ছদ্মবেশ নিয়েছিলে, অভিনয়টাও ভালো করেছ কিন্তু তোমার বোঝা উচিত ছিল তুমি রুদ্রাক্ষের সীমানায় এসে তারই শিষ্যদের ভুলিয়ে ভালিয়ে ক্ষতি করার চেষ্টা করছ। তা কি আমি হতে দিতে পারি? আমি জানি তোমার মা অসুস্থ ছিলেন না, তোমার বিবাহের চিঠি পিওন এসে এখানে আমাকে দিয়ে গিয়েছে। আমি যে বন্ধন কে চিনি সে এতটাও দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়!’

গুরুদেবের কথা শুনে প্রতিম খানিকটা হকচকিয়ে গেল। এ আসল বন্ধন নয়? গুরুদেব বলেন কি! তাহলে জঙ্গলে ওরকম গাছপালার দুলুনি, এতটা পথ বিনা খাটুনিতে পেরিয়ে আসা সব এই মায়াবিনী করেছে? এই কারণেই তো বন্ধনের কপালের কাটা দাগটাও নেই!

প্রতিম ভেবেছিল গুরুদেব হয়তো নিজের অলৌকিক শক্তি দিয়ে চোট ও দাগ সারিয়ে দিয়েছেন। ওর নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হল, গুরুদেবের মতো যোগী পুরুষ যে নিজের কথায় অটল থাকবেন তা ওর বোঝা উচিত ছিল কিন্তু তাহলে বন্ধন কোথায়? মায়াবিনী কি ওকে মেরে ফেলেছে? ভয়ে ও চিন্তায় প্রতিমের হাত পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। মনে মনে প্রার্থনা করতে শুরু করল – গুরুদেব আপনিই এখন আমাদের ভরসা।

গুরুদেব রুদ্রাক্ষ ততক্ষনে বন্ধনরূপী মায়াবিনীকে নাগপাশে জড়িয়ে ফেলেছেন। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা সেই রাক্ষসী এরপর ধীরে ধীরে তার রূপ বদলাতে শুরু করল। বন্ধনের দেহের আড়াল ভেদ করে বেরিয়ে এলো এক কালো কুচকুচে নরকের কীট, যার অগুনতি দাঁড়াগুলো অদ্ভুত এক ছন্দে কিলবিল করছে, আর দেহটা ক্রমাগত নাগপাশ ভেদ করে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। প্রতিম জানে গুরুদেবের এই নাগপাশ কেটে বেরিয়ে আসার শক্তি এই দুনিয়ায় কারোর নেই। এমনকি গুরুদেবের নিজেরও না!

গুরুদেব রুদ্রাক্ষ ক্রোধান্বিত স্বরে বললেন – ‘আমার শক্তির দৌড় কতখানি তা মাপার জন্য যে তোকে এখানে পাঠিয়েছিল তাকে বলিস আমি আসছি তার বিনাশ করতে। পৃথিবীতে পুনরায় তার সাম্রাজ্য গড়ে তোলার সমস্ত স্বপ্ন আমি নিজে হাতে ধ্বংস করব। এতে যদি আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হয় তাতেও কোনো খেদ নেই কিন্তু আমার ধরিত্রীমা’কে কোনোভাবেই আমি তার অন্ধকারের দুনিয়ার ভাগীদার হতে দেবো না… কক্ষনো না’

প্রতিম দেখল গুরুদেব মন্ত্রপূত নাগপাশে তীব্র ক্রোধে চাপ দিতেই মায়াবিনী কীটের দেহ শুভশক্তির আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল।

সমস্যা ও সমাধানের উপায়

‘বন্ধন… এই বন্ধন… বন্ধন… চোখ খোলো। দেখো রাত ফুরিয়ে ভোর হচ্ছে। চন্দ্রপুর ফিরতে হবে তো আমাদের, নাকি? বন্ধন… এই বন্ধন!’

– কেউ যে একটানা ওর নাম ধরে ডাকছে বন্ধন তা শুনতে পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু উত্তর দেবার শক্তি বা সামর্থ্য কোনটাই আর ওর দেহে অবশিষ্ট নেই।

‘নন্দ, পঞ্চপত্রিকার যে ক্বাথটা বানিয়ে রেখেছি সেটা নিয়ে এসো, এক্ষুনি। তারপর ঘরে গিয়ে আমাদের সরঞ্জামগুলো গুছিয়ে নাও, বন্ধন সুস্থ হয়ে উঠলেই আমরা চন্দ্রপুর রওনা দেবো’ – গুরুদেব রুদ্রাক্ষের আদেশ পেয়ে নন্দকিশোর তৎক্ষণাৎ মন্দির প্রাঙ্গণ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ফিরল মিনিট পাঁচেক পর। হাতে পঞ্চপত্রিকার ক্বাথ ছাড়াও দুটো পাকা পেঁপে। নন্দকিশোর জানে এই ক্বাথ পেটে পড়া মাত্রই কি পরিমাণ রাক্ষুসে খিদে পায় মানুষের। সে পেঁপে দুটো প্রতিমের হাতে দিয়ে গুরুদেবের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম গুছোতে যাবার আগে প্রতিমের কানে ফিসফিস করে বলে গেল – ‘এখন যা যা ঘটতে দেখবে, সেসব তোমার সাথেও পাঁচ বছর আগে ঘটেছে। অতএব ভয় পাওয়ার কিছু নেই!’

নন্দকিশোরের মুখে এমন হেঁয়ালি ভরা কথা শুনে প্রতিম কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। গুরুদেব রুদ্রাক্ষ ততক্ষণে বন্ধনের শয্যার পাশে বসে পড়েছেন। তিনি পরম মমতায় বন্ধনের মাথাটা তুলে নিজের কোলে রাখলেন। তারপর ওর চোয়ালের পেশিতে সামান্য জোরে চাপ দিতেই বন্ধন মুখ খুলল আর তিনিও সঙ্গে সঙ্গে মাটির সরা থেকে গাঢ় সবুজ রঙের ক্বাথের খানিকটা পরিমাণ ঢেলে দিলেন ওর মুখে। তারপর চোখের ইশারায় প্রতিমকে পেঁপে দুটো বন্ধনের শয্যার পাশে রাখতে বলে সরে এলেন ওর সামনে থেকে।

মিনিট খানেকের মধ্যেই ক্বাথ তার কাজ করতে শুরু করল। বন্ধনের শরীরটা প্রথমে হরধণুর ছিলার মতো টানটান হয়ে উঠল। ফের কুঁকড়ে গিয়ে ভয়ার্ত কেন্নোর মতো গুটিয়ে গেল। তারপর বন্ধন তালগাছের মতো সোজা হয়ে মাটি থেকে উঠে দাঁড়াল।

প্রতিম অবাক চোখে এইসব কিছু হাঁ করে দেখছিল। আবার ভয়ও পাচ্ছিল বন্ধনের এরকম আধিভৌতিক শারীরিক অবস্থা দেখে। সেবার তাহলে ও নিজেও এমন করেছে কিন্তু ওর কিছুই মনে নেই, বন্ধনেরও থাকবে না।

এই ফাঁকে বন্ধন আবার দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মাটিতে চার হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে। তারপর চোখ খুলে ঘোলা দৃষ্টিতে একবার আশপাশ দেখে নিয়ে পেঁপে দুটোর ওপর শিকারি জন্তুর মতো হামলে পড়ল।

‘বুঝলে প্রতিম, এই হল গিয়ে আমাদের আদি রূপ। আমরা আগে ঠিক এই রকমই ছিলাম – জান্তব, হিংস্র। ফলের বদলে বন্ধন যদি এখন কাঁচা মাংস খেতে পেতো তাহলে ওর এই আদিম রূপকে আর রোখা যেত না। মানুষের সমস্ত সত্ত্বা বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে ওর মধ্যে জেগে উঠত কিছু আদিম শক্তি যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই’ – গুরুদেবের মুখে একথা শুনে প্রতিম ভয় পেয়ে খানিকটা পিছিয়ে এলো। নন্দকিশোর কেনো যাবার আগে ওকে কথাগুলো বলে গেছে তা হাড়েহাড়ে টের পেল এবার।

তবে বেশিক্ষণ এই অবস্থার মধ্যে কাটাতে হল না বন্ধনকে। গুরুদেব রুদ্রাক্ষ কমণ্ডলু থেকে ত্রিবেণীর জল ছিটিয়ে শান্ত করলেন ওকে। ঘোলা দৃষ্টি মুছে গিয়ে ফের ঝলমল করে উঠল বন্ধনের দু’চোখ। বন্ধুকে আবার ফেরত পেয়ে প্রতিম ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে।

খানিকটা ধাতস্থ হতেই বন্ধন দেখল গুরুদেব রুদ্রাক্ষ ওর সামনে বসে রয়েছেন। ও প্রায় একপ্রকার ছুটে গিয়েই গুরুদেবের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। গুরুদেব রুদ্রাক্ষ ওকে আশীর্বাদ করে বললেন –

‘জয় শিবশম্ভু! মহাদেব তোমার মঙ্গল করুন পুত্র। আমাকে তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে আজ। নন্দকিশোর না থাকলে তোমাকে উদ্ধার করা মুশকিল হয়ে যেত!’

‘কেন গুরুদেব, কি হয়েছিল আমার?’ – গুরুদেবের পায়ের কাছে বসে করজোড়ে বলল বন্ধন।

‘তুমি মায়াকীটের কবলে পড়েছিল। যদিও আমি তাকে অগ্নিনাগের মন্ত্র-ছোবলে পুড়িয়ে ফেলেছিলাম ঠিকই তবুও আর এক প্রহর যদি তুমি ওর মায়াকোকুনে আবদ্ধ থাকতে তাহলে সেই মায়াকীটের তোমার শরীর থেকে পুনর্জন্ম হত। আমার ডেরায় আসার আগে সে সেই ব্যবস্থাই করে এসেছিল। সে এও জানত যত যাইই হোক না কেন, দ্বিতীয়বার আমি আর তাকে পোড়াতে পারতাম না কারণ তাহলে তার সাথে সাথে তোমার মৃত্যুও অনিবার্য ছিল। তোমাকে বাঁচানোর আর কোন আশাই থাকত না।

মায়াকীটরা বিভিন্ন ধরণের মায়া জানলেও তাদের শরীর থেকে যে সূক্ষ্ম জঙ্গুলে গন্ধ বেরোয় সেটা তারা মুছতে পারে না। এটা ওদের একটা দুর্বলতা ভাবতে পারো। তাই এই মায়াকীট যখন প্রতিমকে অজ্ঞান করে তোমার ছদ্মবেশ নিয়ে এখানে আসে, সেই জঙ্গুলে গন্ধের দৌলতে সে নন্দকিশোরের কাছে ধরা পরে যায়। নন্দকিশোর জানত আমার দৃষ্টির সামনে পড়লে কোনো কীট কেন কোনো মায়ারই নড়বার ক্ষমতা নেই, তাই সে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ধ্যানকক্ষে পাঠাবার ব্যবস্থা করে এবং পাহারা দেবার বাহানা দিয়ে তোমার দেহ খুঁজতে বেরিয়ে পরে।

কিন্তু এই মায়াকীট দারুণ চালাক ছিল। তোমার দেহ তার লালার কোকুনে এমন ভাবে মুড়ে রেখেছিল যে আমিও তোমার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিলাম না।

ভাগ্যিস নন্দ ছিল। ও সারা জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজে মহাদেবের কৃপায় এখানে থেকে সাত কিমি দূরে বড় শিমূল গাছের মগডালে তোমার কোকুনে মোড়া দেহ খুঁজে পেয়ে আমার কাছে নিয়ে আসে। প্রতিম ও আমি মিলে মন্ত্রপূত কাঁচি দিয়ে সেই কোকুন কেটে তোমায় বের করে আনি। বড় দুশ্চিন্তায় ছিলাম বাবা এতক্ষণ আমরা। তুমি সুস্থ বোধ করছ তো এখন?’

– হ্যাঁ গুরুদেব। আপনার আশীর্বাদে আমি ঠিক আছি। নন্দদা ফের আরেকবার প্রাণ বাঁচালে আমার। চিরঋণী হয়ে রইলাম তোমার কাছে।

– এবার বলো তুমি কি কাজে আমার কাছে এসেছ? যদিও আমি সবই জানি কিন্তু তোমার মুখ থেকে না শোনা অবধি আমার কিছু করার নেই

– ‘কেন গুরুদেব? আর আপনি যদি সবই জানেন তাহলে আমাকে সাহায্য করার জন্য চন্দ্রপুর এলেন না কেন?’ – ক্লান্ত স্বরে বলল বন্ধন।

‘দেখো পুত্র, গুরুর ধর্মই হল শিষ্যকে সঠিক মার্গ দর্শন করানো, ন্যায় ও নীতির শিক্ষা দেওয়া কিন্তু শিষ্য যদি নিজে থেকে গুরুর কাছে সাহায্য চাইতে না আসে তাহলে গুরু কোনোভাবেই যেচে গিয়ে শিষ্যের জীবনে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।

একটা উদাহরণ দিলে আমার বলা কথাটা আরও পরিষ্কার হবে। মহাভারতে যুদ্ধ শুরুর আগে দুর্যোধন ও অর্জুন মিলে যদি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে নিজ নিজ দলে যোগদানের অনুরোধ নিয়ে না যেতেন, তাহলে শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু কোনোভাবেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগদান করতে পারতেন না।

মনে রাখবে, দীক্ষা নেবার প্রথম ধাপই হল বীজমন্ত্র। এই  বীজমন্ত্র আসলে গুরুর ও শিষ্যের মাঝে বিরাজমান অদৃশ্য সেতু। এই সেতুর পেরিয়ে দুজনেই একে অপরের জীবনে যাতায়াত করতে পারেন কিন্তু আমি ভবঘুরে মানুষ, এসব দীক্ষা, বীজমন্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই। আর তোমরাও আধুনিক যুগের ছেলে, এসবের প্রয়োজন না পড়ারই কথা কিন্তু তোমাদের দুয়ারেও যে এমন করাল শমন এসে কড়া নাড়বে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।

আর আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা থেকে যে সে তোমাদের এমন ক্ষতি করতে উদ্যত হবে তা আমার আগেভাগেই বোঝা উচিত ছিল। বলতে গেলে এ আমারই দোষ যার ফল ভোগ করছ তোমরা। কিন্তু তুমি নিজে এগিয়ে এসে আমাকে আহ্বান না করা অবধি আমি তাই কিছুই করতে পারছিলাম না। বারবার শুধু তোমাকে আমার উপস্থিতির জানান দিচ্ছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম কবে তুমি আমাকে ডাক দেবে, আমিও সাড়া দেব সেই ডাকে। তারপর দুজনে মিলে সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করবো সেই অশুভ শক্তির’ – কথাগুলো বলতে বলতে গুরুদেব রুদ্রাক্ষের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। প্রতিম ও বন্ধন বুঝতে পারল গুরুদেব অনেকদিন আগে থেকেই কি করবেন তা মনস্থির করে রেখেছেন।

‘কে আপনার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায় গুরুদেব? কার এত বড় স্পর্ধা?’ – প্রতিম বিস্মিত স্বরে বলে।

‘অসুর বিদ্যুন্মালির অবতার – নরক-পাল!’

৪.

অসুর কথা

‘দীর্ঘ তপস্যার পর প্রজাপতি ব্রহ্মার মন জয়লাভ করে তারকাসুর দু’খানা বর চেয়েছিলেন – এক, তাকে ত্রিভুবন অর্থাৎ স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের কেউই কোনোদিন হারাতে পারবেন না আর দুই, একমাত্র ভগবান শিবের সন্তানই তার মৃত্যুর কারণ হবেন।

তারাকাসুর জানতেন মহাদেব যোগী মানুষ। বিবাহ, স্ত্রী, পুত্র, সংসার এইসকল বিষয়ে ওনার কোন মোহ-মায়া নেই। তাই ভগবান ব্রহ্মা তার চাওয়া দুটো বরেই সম্মতি প্রদান করলে তারকাসুর নিজেকে অমর ভেবে বসেন ও ত্রিভুবন জুড়ে অত্যাচার চালাতে শুরু করেন। এমনকি স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে নিজে দেবতাদের রাজা অর্থাৎ ইন্দ্রের পদ দখল করে নেন।

তারকাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা ভগবান ব্রহ্মার কাছে গেলে তিনি তাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দেন। অতঃপর আর কোনো উপায় না পেয়ে স্বর্গের সিংহাসন চ্যুত ইন্দ্রদেব, কামদেব ও রতির সঙ্গে শলাপরামর্শ করে ভগবান শিবের তপস্যা ভঙ্গ করে ওনার ভেতরে প্রেমভাব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন এবং তাতে সফলও হন। ভগবান শিব, মা পার্বতীর তপস্যা ও ন্যায়নিষ্ঠা দেখে ওনার প্রেমে পড়েন এবং তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। জন্ম নেন ভগবান কার্ত্তিক, দেবতাদের সেনাপতি। তিনি তারাকাসুর ও তার রাক্ষস সেনাদের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর তারকাসুরকে হত্যা করেন ও ত্রিভুবনে শান্তি স্থাপন করেন’ – একটানা কথা বলে থামলেন গুরুদেব রুদ্রাক্ষ।

       সকলেই চৌধুরী ভিলার সামনে চাতালে বসেছিলেন আর ভক্তিভরে গুরুদেব রুদ্রাক্ষের মুখ থেকে পুরাণের কথা শুনছিলেন। তখনই প্রতিমের গাড়িটা চৌধুরী ভিলার লম্বা লোহার ফটক পেরিয়ে চাতালের কাছে এসে দাঁড়াল।

বন্ধন খানিকটা সুস্থ বোধ করলে নিজের গাড়ি নিয়েই আলিপুরদুয়ার থেকে চন্দ্রপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল প্রতিম। বন্ধুকে এতটা পথ ও একা ছাড়তে চায়নি। তবে গুরুদেব ও নন্দকিশোর ওদের সঙ্গে আসেননি, ওনারা নাকি গাড়িতে চড়েন না কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় এই যে এত দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে, মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে, প্রতিম যখন চৌধুরী ভিলার চাতালের সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করাল, দেখল গুরুদেব ও নন্দকিশোর ইতিমধ্যেই এসেই উপস্থিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, গুরুদেবকে ঘিরে চৌধুরী বাড়ির সদস্যরা ছাড়াও, গ্রামের অনেকেই বসে রয়েছেন।

       গাড়ি থেকে নেমে গুরুদেবকে প্রণাম জানিয়ে বন্ধন কামিনীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল – ‘গুরুদেব এখানে কখন এসে পৌঁছেছেন গো?’

কামিনী বলল – ‘তাও তো ঘণ্টা তিনেক হয়ে গিয়েছে। তোমাদের এত দেরি হল কেন? মা আর আমি মিলে গুরুদেব ও নন্দকিশোর বাবুকে সেবা শুশ্রূষা করে, নিরামিষ পদ রান্না করে ভোজন করিয়ে চাতালে বিশ্রাম করার জন্য আসন পেতে দিলাম অথচ তোমাদের কোন পাত্তাই নেই! কোথায় ছিলে এতক্ষণ? সব ঠিক আছে তো?’

বন্ধন এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। শুধু জিজ্ঞেস করল – ‘কতক্ষন বললে যেন? তিন ঘণ্টা, তাই না?’

‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ! আমি খামোখা মিথ্যা বলতে যাবো কেন তোমায়’ – কামিনী খানিকটা রুষ্ট হল।

‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। রাগ কোরো না। আমি তোমাকে অবিশ্বাস করিনি। শুধু কিছু হিসেব মিলছিল না তাই। আর ভাই কেমন আছে? কাল রাতেও কি একই রকম ছিল সব?’

কামিনীর গলার স্বরে দুঃখের ছাপ ফিরে এলো – ‘হ্যাঁ একই রকম ভাবে চিৎকার ও ধ্বস্তাধস্তি করেছে ভাই কাল রাতেও। আর এখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। তোমার গুরুদেব ভাইকে ভালো করে দিতে পারবেন তো গো?’

‘ভরসা রাখো কামিনী। গুরুদেব থাকতে কোনো চিন্তা নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার এক ক্লাসমেট, প্রতিম এসেছে। তুমি আমাদের দুজনের জন্য একটু গরম জল বসাও দেখি। আমি ভাইকে দেখে তারপর স্নান সেরে নেবো। প্রতিমও স্নান করবে বলল।’

বন্ধনের কথা শুনে কামিনী ‘ঠিক আছে’ বললেও ওর মন পড়েছিল চাতালের দিকে। জল গরম করতে যাবার আগে শুনতে পেলো গুরুদেব রুদ্রাক্ষ তখন পরবর্তী কাহিনী শুরু করেছেন –

‘তারকাসুর বধ তো হল। কিন্তু তার তিন ছেলে তখনও বেঁচে ছিল – তারকাক্ষসুর, বিদ্যুন্মালি ও কমলাক্ষসুর। তারাও তাদের পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য ভগবান ব্রহ্মার কাছে বর লাভের আশায় তীব্র তপস্যা করতে শুরু করলেন। ব্রহ্মার উদার মন, তিন ভাইয়ের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন, বললেন তোমাদের কি বর চাই বলো। তিনি ভাইই ভগবান ব্রহ্মার কাছে অমরত্বের বর চেয়ে বসেন কিন্তু ব্রহ্মা বললেন ওনার পক্ষে এই বর দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ জন্ম এবং মৃত্যুর – একটি সদা ঘূর্ণায়মান চক্র, তাতে ব্যাঘাত ঘটানোর সাধ্যি দেবতাদেরও নেই।

একথা শুনে এরপর তিন ভাই দাবি করেন ত্রিভুবনে তাদের তিন জনের জন্য এমন সুন্দর শহর গড়ে দেওয়া হোক যা সৌন্দর্য ও চাকচিক্যে ইন্দ্রের সভাকেও হার মানাবে। ব্রহ্মা তখন অসুর মায়াকে নির্দেশ দেন তারকাক্ষসুরের জন্য স্বর্গে সোনার শহর, কমলাক্ষসুরের জন্য মহাকাশে রূপোর শহর ও বিদ্যুন্মালির জন্যে পৃথিবীতে লোহার শহর গড়ে দিতে। সঙ্গে এই শর্তও দেন যে প্রত্যেক হাজার বছর অন্তর তিনটি শহর ঘুরতে ঘুরতে একই সরলরেখায় এসে উপস্থিত হবে আর তখন যদি কেউ একটি তীর দিয়ে তিনটি শহরকে আঘাত করতে পারেন, তাহলে ত্রিপুরা অর্থাৎ তিনটি শহর একসাথে ধ্বংস হয়ে যাবে’

‘অসুররা যাতে কখনও জিততে না পারেন, তাই তাদের এমন সব শর্ত দেওয়া হয়, তাই না সাধুবাবা?’ – ভিড়ের মাঝ থেকে এক কিশোরী গুরুদেব রুদ্রাক্ষের উদ্দেশ্যে নম্র গলায় প্রশ্নটা করল।

গুরুদেব রুদ্রাক্ষ তার কথা শুনে হাসি মুখে বললেন – ‘জেতা বা হারা সবটাই কর্মফলের ওপর নির্ভর করে মা। যারা ভালো কাজ করেন তারা সবসময় যেতেন আর যারা খারাপ কাজ করেন তাদের হার অবধারিত। তুমি তো জানোই অসুররা কিভাবে সকলের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন করে বেড়াতো। তাই তো অবশেষে তাদের হারতেই হত। তাই না?

আর কেউ ভগবানের কাছে তখনই বর চায় যখন তার ভেতরে নিজে থেকে কিছু করার মতো মনের জোর বা বল থাকে না, শুরু থেকেই সে ভাবে সে একজন পরাজিত ব্যক্তি, তাই তাদের হার অনিবার্য’

‘এতদিনে বুঝতে পারলাম গুরুদেব। আশীর্বাদ করুন আমি যেন আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে জীবনে সব কিছু করতে পারি, সত্যের পথে চলতে পারি।’

‘অবশ্যই পারবে না। জয় শিব শম্ভু। মহাদেবের আশীর্বাদ তোমার জীবন শুভ হোক। যা বলছিলাম –

তিন অসুর ভাইয়ের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখে এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছিলেন। ত্রিভুবনে ফের আরেকবার নিজের প্রভাব ও প্রতিপত্তি  ফেরত পাবার লোভে তিনি ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর তিনজনের কাছেই ছুটে গেলেন কিন্তু তারা কেউই তাকে কোনো সাহায্য করলেন না। যদিও শেষমেশ ভগবান বিষ্ণু ইন্দ্রকে কথা দিলেন তিনি নিশ্চয়ই কোনো উপায় বার করবেন এদের তিন ভাইকে পরাজিত করার।

অথচ তিন ভাই এমন ন্যায়-নিষ্ঠা মেনে ত্রিভুবন শাসন করছিলেন যে ভগবান বিষ্ণু তাতে কোনো ফাঁকফোকর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে তিনি এক ফন্দি আঁটলেন। তিন ভাইকে ভুল পথে চালনা করার জন্য একটি মিথ্যে ধর্ম তৈরি করলেন এবং মহামুনি নারদকে পাঠিয়ে বিদ্যুন্মালিকে সেই ধর্মে যোগদানের আহ্বান জানালেন। একে একে বাকি দুই ভাইও সেই ধর্ম গ্রহণ করলেন। বলা হল এই ধর্ম যারা মেনে চলবেন তাদের দান-ধ্যান করা বন্ধ করতে হবে, বেদ ও পুরাণের কথা মানা চলবে না, হিংসা ও হানাহানিই  মুক্তির প্রধান উপায়। নারদের মোহগ্রস্ত তিন ভাই সেসব মেনে নিলেন ও ধীরে ধীরে পাপের সাগরে ডুবে গেলেন।

তিন ভাইয়ের এই চারিত্রিক অবনতির খবর নিয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও বাকি দেবতারা কৈলাসে ধ্যানমগ্ন মহাদেবের কাছে গেলেন ত্রিপুরাসুরকে বধ করার অনুরোধ নিয়ে। ভগবান শিব রাজি হলেন। দেবতাদের কারিগর বিশ্বকর্মা মহাদেবকে সোনার রথ এবং তীর-ধনুক গড়ে দিলেন।


আরো পড়ুন: সাক্ষী সূর্যমুখী । তন্ময় দেব


তারপর মহাদেবের নির্দেশ সব দেবতা পশুর রূপ ধারণ করে মহাদেবের রথের পিছুপিছু তিনটি শহরকে আক্রমণ করতে ছুটলেন। সেই দিন থেকে মহাদেবের নাম হল পশুপতি। তিনদিন ধরে তীব্র যুদ্ধের পর তিনটি শহর যখন এক সরলরেখায় এল, মহাদেব তখন অগ্নিবাণ মেরে তাদের ধ্বংস করলেন। তারকাক্ষসুর, বিদ্যুন্মালি ও কমলাক্ষসুর এবং শহরে বসবাসকারী বাকি সব অসুরেরা মহাদেবের বাণে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এভাবে মহাদেব ত্রিভুবনকে উদ্ধার করলেন।

       তাহলে আজকের মতো এইটুকুই। আবার অন্য একদিন পুরাণের গল্প হবে। আমাকে এবার উঠতে হবে, চন্দনের বিষয় নিয়ে বন্ধন ও প্রতিমের সঙ্গে কিছু কথা আছে’ – গুরুদেব রুদ্রাক্ষ আসন ছেড়ে উঠতেই সবাই ওনাকে প্রণাম করলেন।

       গুরুদেব হাত তুলে বললেন – ‘জয় শিবশম্ভু। মহাদেব তোমাদের মঙ্গল করুন!’

পরিকল্পনা

‘বন্ধন, তুমি সেদিন কি দেখেছিলে আমায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলো। কিচ্ছু বাদ দেবে না’ – গুরুদেবের আদেশ শুনে মেরুদণ্ড টানটান করে বসল বন্ধন। চোখ বুজে ফের একবার ডুব দিল সেদিনের সেই ভয়াল দৃশ্যে। তারপর বলতে শুরু করল –

       ‘ভাইকে ঘরে না দেখতে পেয়ে আমি জানালা গলে আমাদের বাড়ির পেছনের মাঠ ধরে হাঁটা দিই। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার জানান দিচ্ছিল ভাইয়ের কিছু একটা হয়েছে, নাহলে ও উধাও হয়ে যাবার মতো ছেলে নয়। তখন কুয়াশা পড়ছে খুব। কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি পকেট থেকে টর্চ বার করে জঙ্গল মাড়িয়ে দ্রুত পায়ে ছুটতে থাকি মাঠ বরাবর। কিছু দূর যাবার পর দেখতে পাই ভাইয়ের গলার মাফলারটা কুল গাছের কাঁটায় আটকে আছে। এতে আমি আরও নিশ্চিত হয়ে যাই যে ভাই এই পথ ধরেই গেছে।

মাঠটা প্রায় মাইলখানেক লম্বা। তারপর ঘোষেদের আরও তিন বিঘার মতো ধানী জমি। সেটা পেরোলেই মহানন্দা নদী। শীতকালে জল কম থাকায় নদী কিনার থেকে অনেকটা ভেতরে চলে যায়। ঘুটঘুটে অমাবস্যায় অন্ধকারে টর্চ মেরে এগোতে এগোতে দেখি ভাই নদীর দিকে উদভ্রান্তের মতো হেঁটে চলেছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় এই যে আমি যত বালুর ওপর দিয়ে ভাইয়ের কাছে ছুটে যাবার চেষ্টা করতে থাকি, নদী তত দূরে সরে যেতে থাকে, ভাইও আরও দূরে চলে যেতে থাকে। এভাবে ঘণ্টাখানেক কসরতের পর আমি ক্লান্ত হয়ে বালুর ওপর মুখ থুবড়ে পরে অজ্ঞান হয়ে যাই। কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরেছিল তা আমি জানিনা কিন্তু তখনও আকাশ ঘন কালো। কুয়াশা ঘিরে রেখেছে চারপাশ আর আমার চোখের সামনে ভাই শূন্যে ভেসে আছে। এই দৃশ্য দেখে আমার হৃদস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

যদি না নদীর স্রোতের কাছে থেকে কিশোর কুমারের গলায় আবছা গানটা না আমার কানে ভেসে আসতো’

– ‘কিশোর কুমারের গান? ঠিক শুনেছ তো? আর তোমার কি কিশোর কুমার প্রিয় গায়ক?’ – গুরুদেব রুদ্রাক্ষের গলায় সন্দেহের সুর।

‘হ্যাঁ! উনি আমার সবচেয়ে প্রিয় গায়ক। মেরে ন্যায়না সাবন ভাদো – গানটা একটা মেয়ে মিহি গলায় গাইছিল আর হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমায়। আমারও ইচ্ছে করছিল ভাইকে ওভাবে ফেলে রেখে তার কাছে ছুটে যেতে। আর তখনই আমার গলায় সুতো দিয়ে বাঁধা একমুখী রুদ্রাক্ষটা গরম হয়ে ওঠে আর বুকে ছ্যাঁকা লাগতেই আমার হুঁশ ফেরে। তারপর উঠে গিয়ে ভাইকে ছুঁতেই ওর দেহটা ছেঁড়া পালকের মতো আমার দু’হাতের মাঝে এসে পরে এবং দুজনেই বালুর ওপর গড়িয়ে পরে আবার অজ্ঞান হয়ে যাই। তারপর নাকি পুলিশ এসে আমাদের উদ্ধার করেছিল।

পরদিন বেলা এগারোটায় ঘুম ভাঙলে বুকের কাছে ক্ষতটা দেখে সহজেই বুঝতে পারি যে রুদ্রাক্ষের ছ্যাকাটা আপনিই দিয়েছিলেন সেই মায়াবী শক্তিকে পরাস্ত করার জন্য। আমিও প্রতিমকে ফোন করে আপনার খোঁজ করতে বলি। কিন্তু গুরুদেব কে এই নরক-পাল? কেনই বা সে আমাদের ক্ষতি চাইছে?’

এই প্রশ্ন যে শুধু বন্ধন নয়, ঘরে উপস্থিত সকলেরই তা তাদের উৎসুক চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারছেন গুরুদেব রুদ্রাক্ষ। বললেন – ‘নরক-পাল কে তা জানতে হলে আমাদের আরও পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে যেতে হবে। তখন আমার গুরুদেব আদিনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে আমার পদব্রজে হিমাচল ভ্রমণের বারো বৎসর হয়ে গিয়েছে। সেই যে দশ বছর বয়সে ঘর ছাড়া হয়েছিলাম গুরুদেবের হাত ধরে, তারপর থেকে হিমালয়ের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে দু’জনে তখন নেপালের চৌরিখারকা নামে এক গ্রামে এসে পৌঁছেছি। যেমন সুন্দর সেই গ্রামের পরিবেশ তেমন ভালো গ্রামের বাসিন্দারা।

আমাদের গ্রামের সীমানায় ঢুকতে দেখে নিজে এগিয়ে এসে আপ্যায়ন করলেন একজন বয়স্কা বৃদ্ধা। তারপর একে একে গ্রামের বাকিরাও এলেন। গ্রামের মোড়ল রিংচিং দোরজি অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তার বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। গুরুদেব আদিনাথ শাস্ত্রী একজায়গাতে বেশিদিন থাকতেন না, বড়জোর এক সপ্তাহ কিন্তু চৌরিখারকায় দেখতে দেখতে আমাদের এক মাস হয়ে গেল।

গুরুদেবের আদেশে মোড়ল গ্রামের কারিগরকে দিয়ে পাথর কুঁদে ধ্যানমগ্ন মহাদেবের প্রস্তর মূর্তি গড়ালেন। গুরুদেব গ্রামের পূর্বদিকে ছোট্ট মন্দির তৈরি করে তাতে সেই মূর্তি স্থাপন করলেন ও পূজা শুরু হল। সেখানেই আমাদের পরিচয় হল গগন শেরপার সাথে।

গগন শেরপার আদি বাড়ি ছিল কালিম্পঙে কিন্তু বিদেশীদের পাহাড় চড়া শেখানোর পেশা নিয়ে সে এই গ্রামে এসেছিল। গ্রামেরই এক মেয়ের সঙ্গে তার ভাব-ভালোবাসা হয়ে যায় ও এখানেই সংসার পেতে বসে। গগন ও তার স্ত্রী তাদের এক মাসের শিশুপুত্রকে নিয়ে গুরুদেবের কাছে আশীর্বাদ নিতে এসেছিল।

গুরুদেব পরম আদরে শিশুটিকে কোলে তুলে নিতেই দেখলাম ওনার মুখে এক অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন দেখা দিল। তিনি তৎক্ষণাৎ গগনকে বললেন সে যেন নিজের স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে অবিলম্বে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়, নাহলে ভবিষ্যতে গগন ও তার পুত্রের ওপর ঘোর বিপদ ঘনিয়ে আসছে। তারপর আমাকে নির্দেশ দিলেন, রুদ্র তুমিও সব গুছিয়ে নাও। আমরা আজই এই গ্রাম ছাড়ব।

গুরুদেব ও আমি সেদিনই গ্রাম ছাড়লাম। গগন বা পুত্রের কথা আমার আর মাথায় রইল না কিন্তু গুরুদেব ওদের ভোলেননি। এরপর আমাদের পদব্রজে ভ্রমণের আরও পাঁচ বছর কাটল। তখন আমরা মানস সরোবরের কাছে এসে পৌঁছেছি। গুরুদেব আমাকে বললেন, রুদ্র আমার যাত্রা এখানেই শেষ। তুমি এবার নিজের ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়ে পড়ো। তোমাকে সব ধরনের শিক্ষাই আমি দিয়েছি। মনে রাখবে, জীবনে সৎ থেকে বিনা স্বার্থে জীবের সেবা করে গেলে তবেই ভগবান শিবের চরণ লাভ সম্ভব। যে হানাহানি ও হিংসার যুগ আগামীতে আসতে চলেছে তার অবক্ষয় রোধ করা তোমার বা আমার কারোর পক্ষেই আর সম্ভব নয়। কিন্তু সেই অবক্ষয়ের মাঝেও সমাজ ও সভ্যতা যাতে সুষ্ঠু ভাবে আরও কয়েক হাজার বছর চলতে পারে তার ভার আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম। তোমার মধ্যে যে শিব বিরাজ করে আছেন তাকে বাকিদের মনেও সঞ্চার করার দায়িত্ব আজ থেকে তোমার।

তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, গগন শেরপা কে তোমার মনে আছে রুদ্র? পাঁচ বছর আগে চৌরিখারকা গ্রামে তার সাথে আমাদের দেখা হয়েছিল, পেশায় শেরপা, কালিম্পং শহরে আদি বাড়ি, তার একটি পুত্র সন্তানও ছিল। কিন্তু আমি কিছুতেই গগন শেরপা বা তার ছেলেকে মনে করতে পারলাম না। গুরুদেব তখন আমার দুই চক্ষুর ঠিক মাঝে ওনার ডান হাতের তর্জনী দিয়ে চপ দিতেই পাঁচ বছর আগে গগন শেরপার সঙ্গে সাক্ষাতের সমস্ত দৃশ্যই স্বচ্ছ কাঁচের মতো ভেসে উঠল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম গুরুদেবের দিকে, তিনি বুঝতে পেরে বললেন, আরও সাধনা ও সত্যের পথে পথে হেঁটে বেড়াও, তুমিও পারবে একদিন। ভেবো না আমি কোনো অলৌকিক জাদুগর।

আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিতেই তিনি আবার বললেন, কথায় কথায় মাথা নীচু করবে না রুদ্র। অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে পৃথিবীতে শুভ শক্তির প্রসারের জন্য তোমার জন্ম হয়েছে। সেই কাজের প্রথম ধাপই হল গগনের সন্তানের খোঁজ নিয়ে তার ভেতরে শিবজ্ঞানে সঞ্চার করা। পারবে তো রুদ্র? নাহলে কিন্তু চরম বিপদ!

গুরুদেবের চরণ স্পর্শ করে কথা দিয়েছিলাম পারব কিন্তু পারলাম না, অশুভকে রুখতে পারলেও তার ভেতরে শুভের সঞ্চার করতে পারিনি, হেরে গিয়েছি’ – গলার স্বর কেঁপে উঠল গুরুদেব রুদ্রাক্ষের।

ওনার মতো একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে সকলে আরও নিশ্চুপ হয়ে গেল। শুধু প্রতিম ঠাণ্ডা গলায় বলল – ‘তারপর কি হল গুরুদেব?’

গুরুদেব রুদ্রাক্ষ আসন থেকে উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন। নীল আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন – ‘গুরুদেবের আদিনাথ শাস্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রথমেই চৌরিখারকা গ্রামে গেলাম। শুনলাম এক বিদেশী দলের সাথে শৃঙ্গ অভিযানে গিয়ে গগন নাকি আর ঘরে ফেরেনি। সবাই ওকে মৃত বলেই ধরে নিয়েছে।

স্বামীর জন্য তিন, তিনটে বছর অপেক্ষা করার পর, গগনের স্ত্রী তার ছেলেকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে যে কোথায় চলে গেছেন তা কেউই জানেন না। গুরুদেব আদিনাথ শাস্ত্রী ত্রিকালজ্ঞ ছিলেন, হয়তো তিনি হদিশ দিতে পারতেন, সেই আশায় ধ্যানে বসে ওনাকে স্মরণ করলাম কিন্তু ওনার তরফ থেকে কোনো সাড়া পেলাম না অর্থাৎ গুরুদেব নশ্বর দেহ ত্যাগ করে কৈলাস ধামে মহাদেবের চরণ লাভ করেছেন, আমাকে যা করার একাই করতে হবে।

মনে পড়ল গগনের আদি বাড়ি ছিল কালিম্পঙে। চলে এলাম কালিম্পঙে। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পেয়েও গেলাম গগনের বাড়ি কিন্তু ওরা এখানেও আসেনি। অগত্যা আমাকে হাল ছেড়ে দিতে হল। গুরুদেবের দেওয়া প্রথম আদেশ পালন করতে না পারার যন্ত্রণা বহুদিন মনের মধ্যে ক্ষত হয়ে ছিল। এভাবে আরও পনেরো বছর কাটল, আমিও ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছিলাম সেই কথা, কিন্তু নিয়তি আমাকে ফের ব্যর্থতার চৌকাঠে এনে দাঁড় করালো।

তখন আমি বিহারের পুর্নিয়া জেলার এক গ্রামে গিয়ে উঠেছি। আমার এক শিষ্যের ডাকে সেই গ্রামে যেতে হয়েছিল। কোন এক অশুভ শক্তির প্রভাবে গ্রামের যুবকরা নাকি তিনদিন আগে অমাবস্যার রাতে মেয়েলি কণ্ঠে গান শুনে বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। পরদিন সকালে তাদের নদীর ধারে পাওয়া যায়। কিছু ছেলে ঘাড় ভেঙে মারা গিয়েছে, যারা বেঁচে আছে তাদের কিছুই মনে নেই।

আমি তাই সন্ধ্যে হতেই গায়ত্রী মন্ত্রে পুরো গ্রাম বন্ধন করে দিয়ে গ্রামের সীমানার বাইরে এসে অপেক্ষা করতে থাকি সেই অশুভ শক্তির মুখোমুখি হবার জন্য।

এভাবে কয়েক ঘণ্টা কাটে। গ্রামের সকলের নৈশভোজন শেষ হলে একে একে গেরস্তের ঘরের বাতি নিভতে থাকে। শেষ বাতিটা নিভতেই শুনতে পাই একজন কমবয়সী মহিলা মিষ্টি সুরে গান করতে করতে গ্রামের দক্ষিন দিকের সীমানা ধরে এদিকটায় আসছে। তারপর সে নিশ্চিন্ত মনে গ্রামের পথে পা বাড়াতেই আমার টেনে দেওয়া বন্ধনরেখায় বাঁধা পেয়ে রাগে ফোঁস করে উঠল। বুঝলাম সে আমার উপস্থিতি টের পেয়েছে। মনে মনে প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কিন্তু সেই মহিলা অবয়ব ধীরপায়ে আমার কাছে আসামাত্রাই চেহারাখানা বদলে গিয়ে দেখি এক বিশালাকার পুরুষে রূপান্তরিত হল এবং তার মুখ দেখামাত্রই আমি চমকে উঠি – এ যে গগন! আরও অবাক করা বিষয় যে মাঝে কুড়ি বছর কেটে গেলেও গগনের চেহারা এখনও ঠিক আগের মতোই রয়েছে!

জীবনে বহু অশুভ শক্তির মুখোমুখি হয়েছি বুঝলে তো কিন্তু চেনামুখ দেখলে, তা সে যতই অশুভ হোক না কেন, লড়াই করতে কষ্ট হয়। মানুষটির অসহায়তার ওপর দয়া হয় অথচ হাতে আর কোন উপায়ও থাকে না। গগনের ক্ষেত্রেও তাই হল।

কাছে এসে সে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সাদা ধবধবে হাড়হিম করা রক্তশূন্য সেই মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি এই দেহ অন্য কারোর বশে রয়েছে, বহুদিন হল এতে কোন প্রাণ নেই। অগত্যা মন থেকে সব দয়া-মায়া ঝেড়ে ফেলে মন্ত্রপূত ছাই ছুঁড়ে দিতেই গগনের দেহটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে বিকট চিৎকার করে ওঠে আর ঠিক তখনই মাটি ফুঁড়ে আবির্ভাব ঘটে গগন শেরপার পুত্র – নরক-পালের। চোখ বুঝলে এখনও দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পাই।

চোখ দুটো লাল টকটকে অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে। একেকটি পেশি যেন পাথর কেটে বানানো। মুখের হাত ও পায়ের নখগুল নেকড়ের মতো তীক্ষ্ণ। মুখ থেকে লম্বা জিভ বেরিয়ে এসে লালা ঝরছে। যথার্থ রেখেছিল, মানে রেখেছে সে তার নামটা – নরক-পাল। তার ওই রূপ দেখার পর যে কেউ একবাক্যে মেনে নেবে যে গগন শেরপার এই ছেলে নরকের যোগ্য পালনকর্তা।

লড়াই যাতে এড়ানো যায় তার সবরকমের চেষ্টা করেছিলাম সেদিন। চেষ্টা করেছিলাম অশুভের পথ থেকে ওকে শুভ শক্তির পথে টেনে আনতে কিন্তু ততদিনে সে প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে। আর তার সমস্ত দায় এসে পড়েছে ভগবান শিবের ওপর। আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি রেখে সে বজ্রগম্ভীর গলায় বলেছিল –

‘তোমার শিব একজন ভণ্ড। তার কিছু যায় আসে না মর্তের কারোর কিছু হলে। দেখতেই পাচ্ছ পরপর দুটো বিশ্বযুদ্ধ হল কিন্তু শিব কি এলেন? শুনেছি হিমালয় তার নিজেরই বাড়ি কিন্তু আমার বাবা যে হিমালয় চড়তে গিয়ে আর ফিরে এলেন না শিব কি তাও কিছু করলেন? আমার মা’কে রাস্তায় কিছু লোক মিলে ধর্ষণ করে খুন করল, শিব তাও চুপ। তাহলে কেন মানবো তোমার শিবকে?

চিন্তা কোরো না, আমি কিন্তু লোকগুলোকে শাস্তি দিয়েছি। সে আমাকে সাহায্য করেছে মায়ের ওপর অত্যাচার করা লোকগুলোকে খুঁজে দিতে। তারপর আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে যেখানে বাবার মৃতদেহ বরফের নীচে চাপা পড়ে ছিল এতদিন। বাবার মৃতদেহে তার দৌলতেই প্রাণ ফেরাতে পেরেছি। আমি তার সেবক, তার নির্দেশে এবার আমি ধীরে ধীরে এই মর্তলোকের সব শান্তি, সমৃদ্ধি মুছে দিয়ে নরক বানাবো। তারপর সে ফিরবে, তাকে ফিরতে হবেই।

দেবতাদের ছলনায় ভুল পথে চালিত হয়ে সে শিবের রুদ্ররোষে পড়েছিল। শিব তাদের তিন ভাইকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন, একবারও ভেবে দেখেননি কেন এত ন্যায়পরায়ণ তিনজন হঠাৎ করে অন্যায়ের পথে চালিত হল। শুধু অসুর ছিলেন বলে? শুনেছি শিব নাকি তিনি ত্রিকালজ্ঞ, তার নাকি দয়ার শরীর। এই তার দয়ার নমুনা?

আমি, নরক-পাল! আমি অসুর বিদ্যুন্মালির জ্বলন্ত অবতার। পৃথিবীতে তিনি ফিরবেন আর পুনরায় তার রাজত্ব দখল করে ফিরিয়ে আনবেন অসুরদের রাজত্ব’

গুরুদেব আদিনাথ শাস্ত্রী কেন গগনকে তখন সাবধান করেছিলেন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। এমনিতেই দুনিয়ায় মানুষ রূপী অসুরের অভাব নেই। তার ওপর এই অশুভও যদি তার উৎপাত শুরু করে তবে আর রক্ষে নেই। পৃথিবীর ধ্বংস অবশ্যাম্ভাবী।

তাই নরক-পাল যখন তীব্র অহংকার মেশানো গলায় বিদ্যুন্মালির গুণগান গাইছিল, আমি সেই অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে ওকে নাগপাশে বেঁধে ফেললাম কিন্তু সেও শক্তিতে কিছু কম যায় না। লক্ষাধিক সাপের মুহুর্মুহু ছোবলও তাকে কাবু করতে পারল না। আমি হত্যায় বিশ্বাসী নই তা সে যত অশুভই হোক না কেন, তার ওপর এই ছেলেকে অশুভের পথে ঠেলে দেওয়ার পেছনের আমারও যে দায় রয়েছে তা আমি অস্বীকার করতে পারি না। অতএব একটাই পথ খোলা – নরক-পালকে বন্দী করা। পরিকল্পনাটা মাথায় আসতেই গুরুদেবের শেখানো পাতালকুণ্ড মন্ত্র প্রয়োগ করে নরকপালকে সোজা পাতালদেশে পাঠিয়ে দিলাম যেদিক থেকে ও মাটি ফুঁড়ে এসেছিল। তারপর মৃত্তিকা দেবীর চৌষট্টি মহামন্ত্রে পাঠ করে গণ্ডী কেটে চিরতরে বুজে দিলাম সেই গর্তের মুখ। ধীরে ধীরে আকাশ বাতাস শান্ত হয়ে এলো। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

পরদিন গ্রামের লোকের সাহায্যে গগনের দেহ সৎকার করে গ্রামের সীমানায় ঐ গর্তের চারপাশে একশ শালগাছের চারা লাগিয়ে গ্রাম ছাড়লাম। ভাবিনি নরকপাল আবার কখনও ফিরে আসবে। হয়তো সেই জঙ্গল কেটে মাটি খুঁড়ে শহর গড়তে গিয়ে কেউ ফের নরকপালকে জাগিয়ে তুলেছে।

আজ আমি শেষবারের মতো ওর মুখোমুখি হব। তবে এবার আর কোন ক্ষমা নয়। অন্ধকারের দুনিয়া গড়ার যে কর্মযজ্ঞে ও নেমেছে তার আগুন আমি একমুঠো বালি ঢেলে চিরতরে নিভিয়ে দেবো। ওর অগ্নিতেই ওর দহন সম্পন্ন হবে এই আমি বলে দিলাম তোমাদের। চন্দনের শরীর ও আত্মাকে ঐ নরকের কীটের মায়া থেকে ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা করলাম’

কথা বলতে বলতে রুদ্রাক্ষের কপালের শিরা রাগে ফুলে উঠল। চোয়ালের দুই হাড় যেন দীর্ঘদিন ধরে মাটিতে পরে থাকা সেগুন গাছের গুঁড়ির মতো শক্ত ও স্থির। চোখে হাজারো ভয়াল ভয়ঙ্কর সমুদ্রের ঢেউ। ঘরের উপস্থিত বাকিরা কেউই ওনাকে এরকম চেহারায় আগে কখনও না দেখলেও বন্ধন তার গুরুদেবের এইরকম তেজোদীপ্ত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পূর্বপরিচিত।

সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল – ‘কি করবেন বলে ঠিক করেছেন গুরুদেব?’

‘আদিশক্তির আহ্বান। নন্দকিশোর তুমি সব সঙ্গে করে এনেছ তো?’ – গুরুদেব রুদ্রাক্ষের গলায় বজ্রপাত হল যেন।

‘হ্যাঁ! গুরুদেব এনেছি কিন্তু আপনি…’ – নন্দকিশোর কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না, রুদ্রাক্ষ বললেন –

‘আর কোন কিন্তু নয় নন্দ। হয় এসপার নয় ওসপার!’

যুদ্ধের প্রস্তুতি

আজ ফাল্গুনী পূর্ণিমা অথচ চন্দ্রপুরের আকাশ এক দীর্ঘ ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে। গ্রামের পথ-ঘাট সব শুনশান। একটা কুকুর অবধি দেখা যাচ্ছে না। ইলেকট্রিক বাতি, লন্ঠন, উনুন – সব ধরনের আলোর উৎস নিভিয়ে দিয়ে গ্রামের প্রতিটি মানুষ ঘরের ভেতরে প্রবল উৎকণ্ঠায় বসে রয়েছেন। গুরুদেব রুদ্রাক্ষ তেমনই নির্দেশ দিয়েছেন সকলকে। আজকের রাত বড় ভয়ঙ্কর রাত। বাইরের জগত জানে না, চন্দ্রপুরে আজ যা ঘটবে তার ওপর পৃথিবীর আসন্ন ভবিষ্যৎ নির্ভর করে রয়েছে।

       ‘কাল মুখ্যমন্ত্রীর সভা কখন বন্ধন?’ – গুরুদেব রুদ্রাক্ষ গায়ে চিতাভস্ম মাখতে মাখতে প্রশ্নটা করলেন।

‘বেলা একটায় গুরুদেব’ – শান্ত স্বরে জবাব দিল বন্ধন।

‘মুখ্যমন্ত্রীর সভার সময় কেন জানতে চাইছেন গুরুদেব? আপনি কি বড় কিছু আশঙ্কা করছেন?’ – পাশ থেকে প্রশ্নটা করল প্রতিম।

‘এখনও তোমরা নরক-পালের আসল চালাকিটাই ধরতে পারনি। নন্দকে দিয়ে খোঁজ লাগিয়েছিলাম, সে আশেপাশের গ্রামগুলো ঘুরে খবর নিয়ে এসেছে যে শুধু চন্দনই নয়, আরও অন্তত বারোজনকে বশ করেছে নরক-পাল। ঠিক একই পদ্ধতিতে।

আজ পূর্ণিমা রাতে সে এদের সকলের দেহ পুড়িয়ে ও আত্মার বলি চড়িয়ে বিদ্যুন্মালিকে জাগাবে। নরক বলতে ভেবো না সব ধ্বংস করে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে, মনে রেখো বিদ্যুন্মালির লোহার শহর কিন্তু এই পৃথিবীতেই ছিল, অতএব সে কখনোই চাইবে না পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক বরং সে চায় পুনরায় তার রাজ্য দখল করতে। আর তার কাণ্ডারি হবে চন্দন ও বাকি বারোজন। নরক-পালের শাগরেদ হয়ে এরা দিকে দিকে হিংসা ছড়িয়ে দেবে। আমার তো মনে হয় কাল মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিরও চেষ্টায় আছে নরক-পাল যাতে উত্তপ্ত পাহাড়ের রাজনীতিতে আরও বেশি পরিমাণে হিংসার ঘি ঢেলে বড় আকারে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করা যায় যা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে’

‘কিন্তু গুরুদেব, বিদ্যুন্মালি তো ভালো অসুর ছিলেন আর মহাদেব তো ওনার তিন ভাইকেই পুড়িয়ে মেরেছিলেন’ – বলল প্রতিম।

‘ছাই, প্রতিম, ছাই। ছাইয়ের যে গুরুত্ব কতখানি অপরিসীম সেই বিষয়ে তোমার কোনো ধারণাই নেই। ছাই আমাদের জীবনচক্রের সর্বশেষ রূপ, তা সে মানুষ হোক বা দেবতা কিংবা অসুর।

মহাদেব কেন চিতাভস্ম গায়ে মাখেন জানো? এর মাধ্যমে তিনি তার প্রাণপ্রিয় ভক্তদের মৃত্যুর পর তাদের সমস্ত সুখদুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা নিজের অঙ্গে ধারণ করেন। তেমনি বিদ্যুন্মালির ছাইও হয়তো যুগ-যুগান্তর ধরে অপেক্ষা করে ছিল নরক-পালের মতো কোনো অবতারের। যখন কলি যুগ আসবে, দেবতারা সব মুখ ফিরিয়ে নেবেন মর্তলোক থেকে, আর মানুষেরা ধীরে ধীরে হিংসা, হানাহানি ও অবক্ষয়ের পথে পা বাড়াবে, তখন সে পুনরায় জেগে উঠবে সেই ছাই থেকে আর দখল করবে এই পৃথিবী, তার রাজত্ব। আজ রাত সেই রাজত্ব দখলের প্রথম ধাপ। তৈরি হয়ে নাও সকলে। নরক-পালকে আমাদের আটকাতেই হবে।

আর ভুলে যেও না প্রতিম মহাদেবের হাতে ছাই হবার আগে বিদ্যুন্মালিরা কিন্তু সকলেই অন্যায়ের পথে চলে গিয়েছিলেন। তাদের অসুর সত্ত্বা পুনরায় জেগে উঠেছিল। অতএব এবার একটাই পথ অশুভের সম্পূর্ণ বিনাশ!’

‘প্রভু আমরা তৈরি। অশ্রুকুমার বাবু আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আছেন। আপনি আদেশ দিলেই তিনি চন্দনের দড়ির বাঁধন খুলে দেবেন’ – দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল নন্দকিশোর।

‘হ্যাঁ! বাঁধন খুলে দিতে বলো। তারপর মহাদেবের নাম করে সকলে রওনা দাও যুদ্ধক্ষেত্রে। জয় শিবশম্ভু!’ – গুরুদেব রুদ্রাক্ষের কথা শুনে বাকিরাও বলে উঠল – ‘জয় শিবশম্ভু! হরহর মহাদেব!’

যুদ্ধক্ষেত্রে

ছুটছে, চন্দন ছুটছে। এতদিন পরে ছাড়া পেয়েছে ও। পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে সে জঙ্গল পেরিয়ে। আর কেউ ওকে এবার আটকে রাখতে পারবে না… কেউ না।

‘ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে বহে কিবা মৃদু বায়,

তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়!’

ঐ তো নদীর ধার থেকে ভেসে আসছে গানটা। কি সুন্দর গায় মেয়েটা। শোনামাত্রই মুগ্ধ হয়ে ওঠে দেহ প্রাণ। কেন আটকে রেখেছিল সবাই ওকে এতদিন। মেয়েটা প্রতিদিন ওকে এত প্রাণ ভরে গান গেয়ে গেয়ে ডাকত ওকে কিন্তু দড়ির বাঁধন ছেড়ে যেতে পারত না চন্দন। দুঃখে কষ্টে বুকটা ফেটে যেত ওর। আজ চন্দন সব বাঁধন মুক্ত।

‘দাঁড়াও মেয়ে, আমি আসছি …’ – চন্দন ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে উঠল।

এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটা চন্দনের খুবই প্রিয়। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস অনুষ্ঠানে বহুবার গেয়েছে ও। মেয়েটা কি করে জানল কে জানে, কিন্তু গান গেয়ে যে সে চন্দনকে আপ্লুত করতে পেরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নাহলে কি আর মেয়েটার সঙ্গে দেখা করার জন্য এমন পাগল পাগল লাগত ওর।

ছুটছে… বন্ধনও ছুটছে। ভাইকে বাঁচানোর যে যুদ্ধে ও নেমেছে তাতে আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। কোনোভাবেই ওর হারা চলবে না। গুরুদেব বলেছেন হয় আর এসপার নয় ওসপার।

বন্ধন দেখল প্রতিমও ওর পাশে তালে তাল মিলিয়ে ছুটে চলেছে। এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ফের একবার মহাদেবকে ধন্যবাদ জানাল বন্ধন। কিন্তু গুরুদেব কোথায়? চন্দনের পিছু নিতে বলে তিনি গেলেন কোথায়?

মাঠ পেরিয়ে এখন ধানের খেতে এসে পড়ল দুই বন্ধু। প্রতিমের হাতে থাকা পাঁচ ব্যাটারির টর্চের জোরালো আলো চন্দনকে চোখের আড়াল হতে দেয়নি। চন্দন ওদের থেকে মোটামুটি বিশ হাত দূরে রয়েছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে নদীর দিকে ছুটে চলেছে।

‘রাতের বেলায় ছেলেটার গায়ে যে কোথা থেকে এত শক্তি চলে আসে কে জানে, নিজে চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না’ – ছুটতে ছুটতে প্রতিমকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল বন্ধন।

হঠাৎ একটি উন্মত্ত ষাঁড়ের ডাক শুনতে পেলো দুজনে। ষাঁড়টা গোঁ গোঁ করতে করতে ওদের পেছনে থেকে তিরবেগে ছুটে আসছে এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওদের পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল নদীর দিকে।

বন্ধন ষাঁড়টার শরীরে টর্চের আলো ফেলতেই দেখতে পেল – ‘গুরুদেব রুদ্রাক্ষ পরম নিশ্চিন্তে ষাঁড়টার ওপর বসে রয়েছেন আর তার ধূসর ছাইমাখা শরীর থেকে এক অদ্ভুত আলো বিকিরিত হচ্ছে!’

‘তবে কি গুরুদেব সবসময় এই ষাঁড়ের পিঠে চড়েই যাতায়াত করেন? তাই ওনারা আজ সকালে অত তাড়াতাড়ি চন্দ্রপুরে পৌঁছে গিয়েছিলেন? কিন্তু নন্দ’দারও তো সঙ্গে আসার কথা ছিল এখন, তাই না? সে কোথায়? তবে কি নন্দকিশোরই…’ – বন্ধন দৌড় থামিয়ে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পরে হাঁপাতে হাঁপাতে লাগল।

প্রতিমও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তারও ভাবনার খাতও একই দিকে বইছে। দুজনে দেখতে পেলো মহানন্দার ধারে ততক্ষনে ঝড় বইতে শুরু করেছে। অর্থাৎ লড়াই আসন্ন। দুজনেই ফের ছুট লাগাল।

রুদ্রাক্ষকে নামিয়ে দিয়ে নন্দকিশোর ফের তার মানুষ রূপে ফিরে এলো। চন্দনও ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছে। এসে পৌঁছেছে বাকি আর বারোজন যুবকও। প্রত্যেকের চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। শরীরে অজস্র ক্ষত। হাত-পা’গুলো লাউয়ের ডগার মতো লিকলিকে, যেন কেউ ধীরে ধীরে ওদের দেহ থেকে সমস্ত প্রাণশক্তি শুষে নিচ্ছে।

রুদ্রাক্ষ দেখলেন ছেলেগুলো পুতুল নাচের মতো একই ছন্দে দুলে উঠে একের অপরের হাত ধরে গোল হয়ে মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর একই সুর, তাল ও ছন্দে ভ্রমরের গুঞ্জনের মতো গুনগুন করে দুর্বোধ্য ভাষায় মন্ত্র পড়তে শুরু করল। রুদ্রাক্ষ বুঝলেন যুদ্ধের সময় আসন্ন। তাই তিনিও আর দেরি করলেন না। নন্দও বুঝতে পেরে ওর ঝোলা থেকে পঞ্চপত্রিকার ক্বাথটা বার করে এনেছে।

‘জয় শিবশম্ভু!’ – বলে ক্বাথটা গলায় ঢাললেন গুরুদেব রুদ্রাক্ষ। তারপর সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন বালুর ওপর।

প্রতিম ও বন্ধন এসে দেখল গুরুদেবের শরীরে ততক্ষণে একের পর এক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।

‘ফল এনেছ তো নন্দ দা?’ – জিজ্ঞেস করল প্রতিম।

‘না। গুরুদেব বলেছেন ফল নয়, কাঁচামাংস খাবেন’ – নন্দকিশোর নিঃস্পৃহ স্বরে উত্তর দিল।

‘কি! মানে কেন!’ – বন্ধনের গলা কেঁপে উঠল।

‘গুরুদেব আজ অশুভের বিনাশ করতে আদিশক্তিকে নিজের মধ্যে ধারণ করবেন তাই। তোমরা সরে এসো’ – কথাটা বলে গুরুদেব রুদ্রাক্ষের দিকে একটা মৃত পায়রা ছুঁড়ে দিয়ে পিছিয়ে এল নন্দকিশোর।

শুভ বনাম অশুভ

আদিশক্তির রূপ যে কি প্রবল হতে পারে তার সামান্যতম অংশ আজ চাক্ষুষ করল প্রতিম ও বন্ধন।

গুরুদেব রুদ্রাক্ষ প্রথমে হিংস্র পশুর মতো মৃত পায়রাটাকে পালক শুদ্ধু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে খেয়ে শেষ করে ফেললেন। পায়রার রক্ত হাতে, মুখে ও শরীরে লেগে ওনাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। চোখের মণিদুটো অস্তগামী সূর্যের মতো কমলা বর্ণ হয়ে আছে ও দপদপ করে জ্বলছে। রুদ্রাক্ষ যেন উচ্চতায়ও বেড়ে গিয়েছেন অনেকটা। ওনার শরীর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা এক অপার্থিব নীল আলোকরশ্মিতে ভরে উঠেছে এতক্ষন ধরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে থাকা মহানন্দার চর।

রুদ্রাক্ষ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উঠে দাঁড়ালেন আর তারপর কুয়াশা ঘেরা বালুচরে শুরু করলেন তীব্র তাণ্ডবনৃত্য। পাশাপাশি চলল ওনার বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে সব ধরণের রোগ, ব্যাধি ও মৃত্যুর বিনাশকারী মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রপাঠ –

ॐ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্।

উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মাহমৃতাৎ।।

গুরুদেব রুদ্রাক্ষের ক্রমাগত মন্ত্রোচ্চারণে মুখরিত হয়ে উঠল আকাশ বাতাস। ওনার বেঁধে রাখা লম্বা জটা খুলে গিয়ে লক্ষাধিক সাপের চেরা জিভের মতো হিলহিল করে উড়তে শুরু করল বাতাসে।

       বন্ধন দেখল এদিকে চন্দন ও বাকিদের মধ্যেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ওরা একে অপরের হাত ছেড়ে ঘন কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত তুলে কাকে যেন আহ্বান করছে। ওদের মন্ত্রপাঠের শব্দ এখন ভ্রমরের গুঞ্জন ছাড়িয়ে ঝড় ডেকে আনা মেঘের গর্জনের মতো শোনাচ্ছে। প্রতিমরা বুঝতে পারছে শুভ ও অশুভের লড়াই অবশ্যাম্ভাবি।

তেরোটি ছেলে এরপর মন্ত্র পড়া থামিয়ে তারস্বরে বিকট চিৎকার করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আর তখনই ওদের ঠিক মাঝ বরাবর মাটি ফুঁড়ে উঠে এলো এক অদ্ভুত দর্শন পুরুষ, যার শরীর থেকে লাভার মতো ঝরছে টকটকে লাল বর্ণের আগুন।

‘নরক-পাল!’ – ফিসফিস করে বলে উঠল প্রতিম।

শোঁ শোঁ শব্দে বাতাসের বেগ আরও বেড়ে গেল। যেন হাজারটা ঘূর্ণিঝড় একসাথে ছুটে চলেছে ঐ দুই শুভ ও অশুভ শক্তিকে ঘিরে অথচ প্রতিম, বন্ধন বা নন্দকিশোর কারোর শরীরেই ঝড়ের বিন্দুমাত্র আঁচও এসে লাগছে না।

‘ভাই!’ – প্রবল হাওয়ার তোড়ে ভাইয়ের অবয়ব ক্রমশ মুছে যাচ্ছে দেখে বুকফাটা রাগে, দুঃখে, হতাশায় চিৎকার করে উঠল বন্ধন কিন্তু ওর ডাক চন্দনের কান অবধি পৌঁছল না। এদিকে ততক্ষণে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে।

ওরা তিনজন শুধু দেখতে পাচ্ছে একটি লাল রঙের চঞ্চল ও ক্ষিপ্র আলোক শিখা প্রবল ঝড়ের মাঝে বারবার একটি শান্ত ও স্থির নীল বর্ণের আলোকশিখার দিকে ছুটে যাচ্ছে এবং বাঁধা পেয়ে ফিরে আসছে।

‘গুরুদেব এখনও হয়তো আশা ছাড়েননি। তিনি হয়তো নরক-পালক শুভ ও শিবের পথে ফিরিয়ে আনার শেষ চেষ্টাটুকু চালিয়ে যাচ্ছেন’ – নন্দকিশোর ও প্রতিমের দিকে ফিরে বলল বন্ধন।

কিন্তু তাতে হয়তো কোন লাভ হল না কারণ একটু বাদেই দেখা গেল নীল শিখা আর আগের মতো স্থির নেই, সে প্রবল পরাক্রমে লাল শিখাকে পর্যদুস্ত করে চিরতরে নিভিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো চরাচর। কালো মেঘ কেটে গিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি দিলো আকাশে।

বিদায় পর্ব

‘গুরুদেব, আর দুটো দিন যদি আমাদের সেবা করা সুযোগ দিতেন?’ – করজোড়ে বললেন সুপ্রিয়া দেবী।

রুদ্রাক্ষ বললেন – ‘আমি ভবঘুরে মানুষ মা। এক জায়গায় বেশিদিন মন টেকে না। আজ এখানে তো কাল সেখানে। তবুও তোমাদের আপ্যায়নে বড় শান্তি পেয়েছি বলে তিনদিন থেকে গেলাম। আমার গুরুদেব আদিনাথ শাস্ত্রী বলতেন কোথাও ঠাঁই নেবার পর যদি দেখিস সেখানে তোর মন টিকে গেছে, অবিলম্বে সেই জায়গা ত্যাগ করবি। আমাদের মতো মানুষদের বটগাছ নয়, বরফগলা নদী হতে হয়, সর্বদা চলমান। একই জায়গায় বসে কখনও শিব শক্তির সঞ্চার করা যায় না বৎস।

আমি তাই সর্বদা গুরুদেবের আদেশ পালন করে চলি। অন্যথায় তাকে অপমান করা হয়। এমনিতেই তো আমি তার এক ব্যর্থ শিষ্য’

‘এভাবে বলবেন না গুরুদেব। আপনি না থাকলে পৃথিবী আজ অশুভ শক্তির কবলে চলে যেত’ – গুরুদেবের পায়ে প্রণাম করে বলল বন্ধন।

‘প্রভু, আপনি আবার আসবেন তো?’ – ধরা গলায় বলল কামিনী।

– ‘আসব মা, অবশ্যই আসব। এই ক’দিনে তোমাদের প্রতি আমার মনে এক অন্যরকম জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছে। বছরে অন্তত একবার চন্দ্রপুরে এসে ঘুরে যাবো, কথা দিলাম’

‘গুরুদেব সব গুছিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছি। আমার প্রণাম গ্রহণ করুন’ – অশ্রুকুমার বাবু এগিয়ে এসে প্রণাম করতে চাইলে রুদ্রাক্ষ তার হাত ধরে থামালেন। বললেন – ‘আপনি আমার শিষ্যের জন্মদাতা। আপনার প্রণাম আমি নিতে পারবো না অশ্রুকুমার বাবু। মহাদেব আপনার ও আপনার পরিবারের মঙ্গল করুন। জয় শিবশম্ভু!’

চন্দন দরজার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। সবার প্রণাম পর্ব সারা হলে সে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে গুরুদেব রুদ্রাক্ষকে আভূমি প্রণাম করল। তারপর উঠে বলল – ‘গুরুদেব নরকপালের তারপর কি হল? আপনি কি ওকে বধ করলেন?’

‘বধ, হিংসা, খুন এসব বড় খারাপ জিনিস বাবা। কিন্তু কখনও কখনও দুষ্টের দমন করতে হলে মহাদেবও হাতে অস্ত্র তুলে নেন। আমিও তাই করেছি। প্রায় পঞ্চাশ বছর সুযোগ ছিল নরকপালের কাছে নিজেকে শুধরে নেবার কিন্তু সে শুভশক্তির পথে না গিয়ে, মুক্তি পাওয়ামাত্রই প্রতিহিংসার পথ বেছে নিলো। একের পর এক ঘৃণ্য পাপের পরও তাকে রেহাই দিয়েছিলাম কিন্তু এবার সে সমগ্র মানবজাতির ক্ষতি সাধন করার খেলায় মেতেছিল। তাকে বধ করতেই হত। আদিশক্তি তাই তার বধ করেছেন বাবা। আমি নিমিত্ত মাত্র’

‘না গুরুদেব। আপনি মহান, আপনি আমার কাছে মহাদেব তুল্য। আমি কি করলে আপনার মতো হতে পারবো? আমাকেও আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন না গুরুদেব’ – সরল মনে আবদার করে চন্দন।

‘তা হয় না বাবা। এই সংসার, বাবা, মা সকলের প্রতি তোমার দায়িত্ব রয়েছে। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।

আর আমার মতো নয়, তুমি আরও ভালো মানুষ হবে। শুধু ন্যায় ও সত্যের পথে থেকে মানুষের উপকার করে যাবে, দেখবে ঠিক মহাদেবের চরণ লাভ করবে। বুঝলে?

আচ্ছা, আসি তবে। ভালো থেকো সকলে তোমরা’

       সকলের থেকে বিদায় নিয়ে চৌধুরী ভিলা থেকে বেরিয়ে এলেন রুদ্রাক্ষ। বন্ধনও এলো ওনার পিছুপিছু। হাতে গুরুদেবের দক্ষিণাস্বরূপ চাল, ডাল ও সব্জির ব্যাগ।

রুদ্রাক্ষ দেখলেন চাতালের সামনে প্রতিম ও নন্দকিশোর গাড়ি নিয়ে তৈরি। ওনাকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রতিম ছুটে এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

রুদ্রাক্ষ বললেন – ‘আশা করি এরপর থেকে প্রয়োজন ছাড়াও তোমাদের দেখা পাবো’

       প্রতিম ও বন্ধন দুজনেই লজ্জিত মুখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

       বন্ধন বলল – ‘গুরুদেব একটা প্রশ্ন শুধু আমার মাথায় ঢুকছে না যে নরক-পাল সবাইকে গান গেয়ে ডাকত কেন? আমাকেও ডেকেছিল, কিন্তু শুনলাম দুজনের জন্য দু’ধরণের গান!’

রুদ্রাক্ষ বললেন – ‘বিদ্যুন্মালা অসুর হলেও খুব ভালো গান গাইতে পারতেন। তার গানের মায়ায় কত মুণি ঋষির যে অনিষ্ট হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অতএব তার অবতার যে গান শুনিয়ে শিকার টেনে আনবে এতে আর আশ্চর্য কি! আর দু ধরণের গান কারণ, যে মানুষের যে গান প্রিয় তাকে সেই গান শুনিয়ে ডেকে আনা অতীব সহজ কাজ। এটা আসলে নরক-পালের একপ্রকার মায়াজাল বলতে পারো।’

রুদ্রাক্ষের উত্তর দেওয়া শেষ হতেই, প্রতিম নন্দকিশোরের দিকে ফিরে কৌতুকের স্বরে বলল – ‘কি নন্দ দা, আমি তো জানতাম তুমি ও গুরুদেব গাড়ি চড় না। আজ কি হল? গুরুদেবকে নিয়ে ছুটে যাবে না!’

প্রতিমের কথা শুনে গুরুদেব রুদ্রাক্ষ ও নন্দকিশোর দুজনেই বুঝতে পেরেছেন প্রতিম কি ইঙ্গিত করেছে।

প্রত্যুত্তরে নন্দকিশোর কিছু বলে উঠবার আগে গুরুদেব রুদ্রাক্ষ মুচকি হেসে বললেন – ‘নন্দরও তো আমাকে টানতে গিয়ে মাঝে মাঝে পিঠে ব্যাথা হয় নাকি! তখন আমি ওকে যন্ত্রের পিঠে চড়িয়ে দিই। কি নন্দ তাই তো?’

গুরুদেবের কথা শুনে ওরা তিনজনেই একসাথে হেসে উঠল।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত