| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

গদ্য: গোল এ শহরকে তুমি বলো না অচল পয়সা । মুরাদ নীল

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

“ওই যে ছাতিম গাছের মতোই আছি
সহজ প্রাণের আবেগ নিয়ে মাটির কাছাকাছি…।”

মধ্যরাতে শহরের একটা ব্যস্ত রাস্তার ধারে প্রকান্ড একটা ছাতিম গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আমি রবীঠাকুরের এই লাইন আওড়াচ্ছি। ভাবছি শহর নামের এই সিমেন্টের জঙ্গলে মাটির কাছাকাছি আর থাকা হলো কই? সহজ প্রাণ ওষ্ঠাগত।মনোটোনাস এই শহুরে জীবন থেকে পালাতে গিয়ে কেউ কেউ যখন একেবারেই পালাতে চায় জীবন থেকেও, তখন দড়িতে ঝুলে পড়াও কি মাটির থেকে দূরত্ব নয়? আহা,মৃত্যুর মতো সহজ,সুন্দর,পবিত্র ঘটনাটার সময় মাটির কাছাকাছি থাকবে না মানুষ? যাকগে, ছাতিম গাছটার কাছে ফেরা যাক এবার। পঞ্জিকার হিসাবে শরৎ শেষ,হেমন্তের শুরু,কার্তিকের পয়লা দিন।ছাতিমফোটার সময় চলে গেছে। ক্যালেন্ডার কি আর ফুল ফোটা থামাতে পারে?এই কার্তিকেও কেমন মাতাল করা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে ছাতিম ফুল। কার্তিক মাসের নাম শুনলে আমার শুধু মনে পড়ে কাতি মাস,মঙ্গা। মঙ্গার দিনগুলোতে এমনিতেই খাবার জোটানোর লড়াই, তার উপরে নামতো বৃষ্টি। সে বৃষ্টিকে মানুষজন ডাকতো কাইতান সাতাও নামে।মানে কার্তিক মাসের বর্ষা।এই যে এখন ছাতিম গাছটার কাছে দাঁড়িয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি।কিন্তু স্মৃতি আমাকে নিয়ে গেছে অন্তত বিশ বছর পেছনে আরেকটা ছাতিমগাছের কাছে। কৈশোরে ছাতিমকে চিনতাম আমি ছাইতন নামে। ছাইতন নামটা কিভাবে এলো সে কথা বলি, গ্রামে মানুষজনের বিশ্বাস এই গাছ হচ্ছে শয়তানের গাছ।শয়তান থেকে ছাইতন। এই শয়তানের একটা জাদুকরি ক্ষমতা আছে। কৈশোরকালে প্রায় রোজ সন্ধ্যায় দেখতাম আমার জেঠি একটা বড় কোটা দিয়ে ছাতিমের পাতা পাড়তেন,সেই পাতা শিলপাটায় বেটে কপালে লাগাতেন। উনি বলতেন আধকপালির বিষ।মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় আমরা যেটাকে মাইগ্রেনের পেইন বলে বুঝি, ধরে নেয়া যায় সেটাই আধকপালির বিষ/ ব্যথা। জেঠিদের উঠোনে যে মাঝারি সাইজের ছাতিমগাছটা ছিলো,সে গাছে আমি কখনো ফুল ধরতে দেখিনি।ফুল ধরতো না বলেই হয়তো গাছটা অনেকদিন বাঁচতে পেরেছে,ফুল ধরলে হয়তো তাকে অনেক আগেই কাটা পড়তে হতো।

ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ বিষয়ক আমার প্রথমদিকের অভিজ্ঞতা খুবই মজার।একটু পরে আসি সে প্রসঙ্গে।আমার গ্রাম থেকে বাজার বেশি দূরে না। বাজারের সাথেই লাল ইটের একটা কমিউনিটি হাসপাতাল।একদিকে সরকারি প্রাইমারি স্কুল, আরেকদিকে হাইস্কুল।এই দুই স্কুলের মাঝখানে হাসপাতালের চিপাকোণায় লম্বা একটা ছাতিমগাছ।হাইস্কুলে পড়াকালীন সময়ে ছাতিমফুল ফোটার সময়টাতে আমি স্কুল ছুটির পর গাছটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম কিছুক্ষণ। গন্ধটা যে ভালো লাগতো খুব,তেমন না। কিন্তু শরৎ এর শেষ দিকে যখন দিন ছোট হয়ে আসে,রোদমরা বিকেলে একটা প্রকান্ড দালান ঘেষে অমন ফুলে ফুলে ছাওয়া একটা গাছ দেখতে আমার খুবই ভালো লাগতো। এবার মজার প্রসঙ্গে আসি। ক্লাস নাইন পার হওয়ার পর রাতের খাবার শেষে ঘরের বাইরে বের হওয়ার একটু চান্স ছিলো। ঘর থেকে একটু দূরে একটা বটগাছ।রাত নয়/দশটার দিকে আমি হাঁটাহাঁটি করে বটগাছটার নিচে একটু বসতাম। ছাতিমফোটার মৌসুমে ঐ সময়টাতে বটগাছটার ঐদিকে,বাজার থেকে সোজা যে সড়কটা আমাদের গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে আরো পুবে, সেখানে দাঁড়ালে অদ্ভুদ একটা গন্ধ ভেসে আসতো।সম্ভবত রাত বাড়লে ছাতিমফুলের ঘ্রাণ আরো প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।এই গন্ধ আর বিকালে স্কুল পরীক্ষা শেষে নেয়া ছাতিমফুলের গন্ধের বিস্তর তফাৎ।তখন উঠতি বয়স,বন্ধুমহলে বাংলা মদ,গাঁজা এইসব নিষিদ্ধ জিনিস নিয়ে খুব আলাপ হতো।আমরাও চিপায়চুপায় অতি আগ্রহ আর উত্তেজনার বশে নেভি,কে-টু সিগারেটে টান দেয়া শুরু করেছি একটু আধটু। শুনেছি বাংলা মদের গন্ধ নাকি খুবই উৎকট হয়। তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে তখন ঐ গন্ধটার উৎস নিয়ে আমি কনফিউজড ছিলাম,তখন আমার পাশ ঘেষে বাজারের একজন জিলিপি বিক্রেতা তার দশহাজার টাকায় সদ্য কেনা সেকেন্ডহ্যান্ড লক্কড়ঝক্কড় ইয়ামাহা চেপে যেতো। চাচা ডাকতাম তাকে।আমি রোজ রাতে যে সময়টাতে রাস্তায় দাঁড়াতাম,তিনিও ঐ সময়টাতে বাজার থেকে বাড়ি ফিরতেন।আমার একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিলো এই চাচাই হয়তো মদ বা মালমুল কিছু খেয়ে বাড়ি ফিরছে!

দেশে দেশে ছাতিম কিভাবে শয়তান বা ডেভিল বৃক্ষ হয়ে উঠলো সে এক রহস্যই বটে। ফুলের গন্ধের কারনেই কি? অথচ সংস্কৃতে এই গাছটার কত সুন্দর একটা নাম আছে,সপ্তপর্ণ/সপ্তপর্ণা! মানে সাতটা পাতা। মূলাবর্তে একসাথে সাতটা পাতা থাকে বলে এই নাম। ছাতিম গাছ কিন্তু বিদ্বানও বটে। উদ্ভিদতাত্বিক নাম দেখলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা। Alstonia Scholaris, স্পেসিস প্রজাতি অংশটুকুর এমন নামকরণের কারন ছাতিমগাছের কাঠ থেকে লেখার উপকরণ তৈরি হতো একসময়। পেন্সিল এবং বোর্ড দুটোই। ইংরেজি নামটাও তাই Blackboard tree!

যেহেতু স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দু হাজার বছরেও সব মনে রাখে, সেহেতু আরো বিশ বছর পর মনে পড়বে এই ছাতিম গাছটাকে। এখন যেমন মনে পড়ছে ১৫/২০ বছর আগের স্মৃতি।নিয়ন আলোয় ধাঁধানো চোখ নিয়ে এই ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে আমার মনে পড়ছে অন্ধকার হয়ে আসে সেইসব সন্ধ্যার কথা।আধ কপালের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে আমার জেঠিমা ছাতিমের পাতা পাড়তেছেন। লাল ইটের প্রকান্ড দালান ঘেষা সেই ছাতিমগাছটা। শরৎ কিংবা হেমন্তের মৃদু হাওয়ায় হয়তো এখনো আমিনুর চাচা জিলিপির দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরেন রোজ।নৈশ হাওয়ায় হয়তো এখনো সেই ছাতিমগাছটার ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে আমার গ্রাম পর্যন্ত।এমন করে মনে পড়বে এই ছাতিমগাছটাকেও। ততদিনে হয়তো কাটা পড়বে, থাকলেও হয়তো তার দুদিকে আরো বড় বড় মাল্টিস্টোরয়েড বিল্ডিং উঠবে, হাসফাস করবে সে।কৃত্রিম আলোর ঝলকানি আর ছুটে যাওয়া কয়েকটা গাড়ির বিপরীতে তখনো হয়তো তার ঘ্রাণে কেউ আলুথালু হয়ে দাঁড়াবে তার পাশে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত