| 6 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: মোহমুক্তি । সোমনাথ বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

লেখক পরিচিতি-

১৯৬৮ সনে গল্পকার সোমনাথ বরার জন্ম হয়।শ্রীবরা নগাঁও জেলার ডঃ বিরিঞ্চি কুমার বরুয়া মহাবিদ্যালয়ের অসমিয়া বিভাগে সহযোগী হিসেবে কর্মরত।প্রথম গল্প সঙ্কলন ‘দ্বিতীয় প্রহর রাত্রি’২০০৯ সনে প্রকাশিত হয়।‘এন্ধারর ধনগুলৈ’দ্বিতীয় গল্প সঙ্কলন।গল্পগুলির মধ্যে সমসাময়িক জীবন প্রবাহের সঙ্গে অসমের গ্রাম্য জীবনের বহু ছবি দেখতে পাওয়া যায়।   

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ—বাসুদেব দাস


ঠিক এভাবেই আমরা দুজন ভাবীকালের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তুলছিলাম।

বোঝার মতো বয়স হওয়ার পর থেকেই অবশ্য কথাগুলি বুঝতে পারিনি। বোঝার প্রয়োজনই হয়নি। সমস্ত দেখা ঘটনা বা শোনা কথা সব বয়সে বোঝার প্রয়োজন হয় না।

কিন্তু জোন এবং জুনুকা স্কুল যেতে শুরু করার সময় আগে অনেকের সংসারে দেখা কথাগুলি নিজেদের যাচাই করে নিতে হল। আমাদের সময় গ্রামের পাঠশালাটির  বাইরে বিদ্যারম্ভের বিকল্প চিন্তা স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। অঞ্চলের হাই স্কুলটিই প্রবেশিকার দরজা পার করে দিত। এখন অবস্থাটা বদলে গেছে। জোন এবং জুনুকা কোথায় পড়া উচিত—এই উপদেশ দেওয়া লোকেরা দুটো বিভাগে বিভক্ত হল।

‘এখানেই পড়ান বরা, না হলে আপনার হাত ছেড়ে কোথায় কোন ধুবড়ি পৌঁছে যাবে। ওদের আর ফিরে পাবেন না।’

‘এগিয়ে যেতে দাও বরা, না হলে পরে ওদের আফসোস করতে হবে।’

পরে আমরা নিজেদের বোঝার মতো করে জোন এবং জুনুকার বাবা-মা হিসেবে ওদের ভবিষ্যতের চিন্তা করার সঙ্গে আমাদের নিজের আগামী দিনের জন্য ও ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করে তুললাম।

বিয়ের ছয় সাত বছর পরে আমার রক্তে সুগার ধরা পড়েছিল। ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে প্রাতঃভ্রমণ করতে শুরু করেছিলাম। ইনি আমার সঙ্গী হয়েছিলেন। এটি রোড  থেকে দূরের গ্রাম পর্যন্ত ভেঙ্গে যাওয়া একটা পথ দিয়ে আমাদের প্রাতঃভ্রমণ চলে। দুপাশে খোলা মাঠ, শ্রাবণ ভাদ্র মাসে জলে ডুবে যায়, কার্তিক অগ্রহায়ণে সোনালি ধানে ভরে উঠে। অনেক দূর পর্যন্ত পথের দু’পাশে বড়ো গাছ নেই। কিন্তু কোনো এক বর্ষার ঋতুর কোনো এক সকাল বেলা পথের পাশে শিমুল গাছের চারা একটা আবিষ্কার করলাম। চারাটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে শ্রীমতকে জিজ্ঞেস করলাম—’ছায়া ,এই শিমুল গাছের চারাটা এখানে কোথা থেকে এল?’

‘বাতাসে উড়ে কোথাও থেকে এসেছে বোধহয়।’

‘ঠিকই বলেছ। আমাদের বিহুগীতে যে রয়েছে—

ঘরতো নবহে          মন সমনীয়া

          পথারতো নবহে মন,

কমোয়া তুলাবোর    যেনেকৈ  উরিছে

         তেনেকৈ উড়িবর মন।

ভেবে দেখবেন,কাপাস তুলোর সঙ্গে প্রায়ই একটি করে গুটি থাকে।প্রথমে গুটিটা কাপাস তুলোর সঙ্গে আকাশে উড়ল।তারমানে সে কিছুটা রোমাঞ্চ করল।তারপরে মাটির জিনিস মাটিতে নেমে এসে স্থায়ী আসন নিল।’

‘ঠিক বলেছেন।দেখেছেন বংশ বিস্তারের কৌশল।কোথাকার গুটি,কোথায় যে ছিটকে এল।আসল গাছটাই বা কোথায় পড়ে রইল।’—পরের কথাগুলি যেন ছায়া নিজের মনে নিজেকেই বলে গেল।

এই কথাগুলিই আমি একদিন মা এবং বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।কথাটা একই হলেও শব্দগুলি ছিল আলাদা।দশ-বারো বছরের একটি ছেলে যে সমস্ত শব্দ ব্যবহার করতে পারে, সেই ধরনের।

কার্তিক বিহুর পরে মা এবং বাবার সঙ্গে গরুর গাড়িতে উঠে রূপহীর মূল বাড়ি থেকে শিবস্থান গড়গুরির পামে যাবার সময় বার্মা রিজার্ভের কাছে থাকা বিলের পারের বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে মিষ্টি এবং পিঠা দিয়ে জলখাবার খেয়ে থাকার সময় মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম –‘মা,এতবড়ো রিজার্ভের মধ্যে এই গাছটা কোথা থেকে এল?’

‘বংশবিস্তারের ইচ্ছা বাবা।কাক-শালিক গাছের কত গুটি খেল,কোথায় মলের সঙ্গে 

বীজ ছড়াল।মানুষেরাও একই।গাছের পাতা একসঙ্গে খসে পড়ে না,দাদা-ভাইও একসঙ্গে মরে না।সংসারের ধর্ম বাবা।বাবা যে গড়গুরিতে পাম পেতেছে ,বড়ো হলে দাদা আর তুই দুই জায়গায় থাকতে হবে। 

‘বিস্তৃত মাটি,বিস্তৃত চাষাবাস,বিস্তৃত সংসার –তারবেশি আমাদের আর কী চাই বাবা?’—মায়ের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাবা বলেছিল।

মা-বাবার স্বপ্ন সফল হল না।হিসেবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরে আলাদা হিসেব করলেন।আমার বিস্তৃত মাটিতে বিস্তৃত চাষবাস করে বিস্তৃত সংসার করা হল না।মা-বাবার ছয়টি কন্যা আর দুই পুত্রের বিপরীতে আমাদের সময়ে দুটি সন্তানে সীমাবদ্ধ হল।পাঠশালার দরজা না মাড়ানো মা এবং বাবা কীভাবে ভাববে যে তাঁদের কনিষ্ঠতম সন্তান পড়াশোনায় গ্রামের মধ্যে ভালো ফল করে নগরে চাকরি করবে?চাষ-বাস,গরু-ছাগল,বাজার-টাজারের নামে মাসে সপ্তাহে-দশদিনই দেখছি স্কুল ক্ষতি।আমি চাকরি্তে যোগ দেবার পরে বাবার ও সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হল—‘বাবা,আমি বুঝতে পেরেছি ,তুই আর গড়গুরি পামে বাড়ি তৈরি করে চাষ-বাস নিয়ে বাস করতে যাবি না।হবে,নগরে চাকরি যখন বর্ষার দিনে গ্রাম থেকে এই ছয়মাইল পথ কাদা-জল মাড়িয়ে পাকা রাস্তায় গিয়ে উঠে নগরে যাবার চেয়ে গড়গুরির জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে শহরে কিছুটা জমি কিনে একটা বাড়ি তৈরি কর।দাদা-ভাই দূরে থাকলে ভালোবাসা বাড়ে।’

কাদা-জলকে ভয় করি না।কিন্তু বর্ষার দিনে কোনোমতেই ভালো জামা কাপড় পরে ভালোভাবে অফিস যেতে পারব না সেটা ঠিক।কিন্তু মা-বাবাকেই বা কীভাবে ছেড়ে যাই?তারচেয়ে বরং,মেইন রোডের পাশে বাড়ি তৈরি করলে কেমন হয়?বাড়িও হবে,শহর ও পাব।গ্রামের চেয়ে অনেকটা সংকীর্ণ,নগরের চেয়ে বড়ো জমিতে আমার বাড়িটা তৈরি হল।দেড়বিঘা জমির ওপরে বাড়ি।ছোটো-বড়ো গাছপালা নিয়ে চারপাশের গম্ভীর পরিবেশ।আসলে গ্রামেই,মাত্র হাইওয়ের কাছে।

অনেকের সংসার দেখতে শুরু করেছিলাম।অফিসের ভট্টদার রিটায়ার হতে দুই বছর বাকি আছে।কাজে ঘনঘন ভুল করে।বেশিরভাগ সময় আনমনা হয়ে থাকে।সহকর্মী সমীর নন্দীর কাছ থেকে জানতে পারলাম ভট্টদার নিঃসঙ্গ জীবনের কথা।পত্নীর মৃত্যুর দশ বছর পার হয়ে গেছে—কুয়েতে থাকা ছেলে এখনও আসতে পারে নি।কী সাংঘাতিক মেধাবী ছিল ভট্টদার ছেলেটি।প্রত্যেক পরীক্ষার ফলাফলের পরে ভট্টদার বুক গর্বে ফুলে উঠে।এখন দিনদিন এক আঙুল চেপ্টা হয়।

ভট্টদা মাত্র একটা উদাহরণ।এটি রোডের আশেপাশে কখনও অনেকদিন ধরে তালাবন্ধ হয়ে থাকা দুই-চারটে ঘর চোখে পড়ে।উঠোনে ঘাস,কেঁচুমটা এবং শুকনো গাছের পাতা।কখনও হয়তো কারও মুখে কোনো একটি বাড়ির ইতিহাস শুনি—‘ছেলেটি (বা মেয়েটি)বড়ো মেধাবী ছিল,আজকাল আমেরিকায় থাকে।

অতি সাধারণ কথা।এইসমস্ত আমার জীবনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়।গল্প,উপন্যাসের জন্যও অগতানুগতিক আকর্ষণীয় কাহিনি হয়ে থাকে নি।লিখলেই ‘সস্তা 

সেন্টিফুলা’বলে হাসবেই।সময় এবং সমাজের পরিবর্তন হয়েছে,তার সঙ্গে তাল মে্লাতে না পেরে ভট্টদারা দুঃখ পেয়েছে।জোন এবং জুনুকাও হয়তো দূরে চলে যাবে ধরে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকাই ভালো। আমরা দুঃখ করব না, মা-বাবা বলেছিল— সংসারের ধর্ম। মা, বাবা আমাকে ছেড়ে দিতে পেরেছিল। আমরা জোন জুনুকাকে  ছাড়তে পারব না কেন?

আমাদের চিন্তা চেতনার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোন এবং জুনুকা এগিয়ে চলেছে। জোন দিল্লির কলেজ এবং জুলুকা অসম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পা রাখতেই অনুভব করেছিলাম— ভট্টদার মতো আমাদের ও জীবনের একটি পর্যায় আরম্ভ হল।

জোনের রেজাল্টের পরে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—’ আমেরিকায় যাবি না ইংল্যান্ডে যাবি?’

জোন জিজ্ঞেস করল —’মানে?’

‘মানে আর কি, তোর যা রেজাল্ট, সরকারের কাছ থেকে তো বৃত্তি পাবিই; আমিও যা পারি জমিয়ে রেখেছি। পরবর্তীকালে কষ্টের সঙ্গে চালিয়ে নিতে পারব। শুধুমাত্র তোর আশাটা পূরণ হোক। মানুষ জীবন একবারই পায়। যতটা পারিস উপরে উঠ, নিজের মতো জীবনটাকে সাজিয়ে নে। আমাদের কথা চিন্তা করতে হবে না। নল গাছ মরে কিন্তু তার থেকেই আবার অঙ্কুরিত হয়।

জোন হেসে বলল—’দেখা যাক।’

সন্ধেবেলা সে বাজানো ভায়োলিনের সুরে যেন বুকটা চেপে ধরল। পরের মুহূর্তে যেন বুকটা শূন্য হয়ে গেল। আমি ছটফট করে উঠলাম। ছায়া দুবার গলাখাকারি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে অস্বাভাবিক কন্ঠে পাশের ঘরে থাকা জোনকে ধমক দিয়ে উঠল—’জোন,ভায়োলিনটা রাখলি? আমাদের কি কাঁদাবি নাকি?’

জোন ভায়োলিনটা রেখে বেরিয়ে এসে আমাদের অদ্ভুত ধরনের হেসে ওঠা একটা ভঙ্গি দেখাল এবং বেড়াতে বেরিয়ে গেল।আমরা হাসতে চেষ্টা করলাম।মনে মনে ভাবলাম,আমরা এত আগে থেকেই প্রস্তুত।তবু এরকম অবস্থা।প্রস্তুত হয়ে না থাকা ভট্টদাদের অবস্থা কীরকম হতে পারে?

কতদিন গড়িয়ে গেল,কত তারা সন্ধ্যার আকাশে তিরবির করে জ্বলল এবং ভোরের রাতে লুকোল,কতবার তারা স্থান পরিবর্তন করল,কত আলোকবর্ষ দূরে থাকা কোনো নক্ষত্র থেকে এক ছটাক আলো বহু বছর ধরে এসে পৃ্থিবীতে পরে গলে গলে পৃ্থিবীতে মিলে গেল,কত পাহাড়িয়া নদী পাতা,ফুল,কাদা সমতলের নদী সাগরে বয়ে গেল।সামনের দুটো লেনযুক্ত প্রধান পথ চার লেনযুক্ত হল এবং পথ প্রশস্ত হতে দিয়ে আমাদের চারসীমার পথের পাশের দুটো বড়ো গাছ ছিটকে পড়ল।আমাদের স্কুল জীবনে নগরে যাবার জন্য মাত্র ছয়টা গাড়ি চলার জায়গায় এখন রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে যেতে হলে মাঝে মধ্যে পাঁচ দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়।এটি রোডের পাশের খালি জায়গাগুলিতে অনেক দোতলা,তিনতলা এবং আরসিসি বাড়ি তৈরি হয়ে গেল।আমরা প্রাতঃভ্রমণে যাওয়া কাঁচা রাস্তাটা এখন পিচের রাস্তা হয়ে গেছে।খোলা মাঠের মাঝখানের রাস্তাটা কেটে জল যাবার জন্য একটা খাল করে দেওয়া হয়েছিল।এখন খালের উপরে সেতু হয়েছে।কখনও কখনও তীরে উজিয়ে উঠা শোল মাছও পেতাম।খালটার কাছে মাছ পাক মেরে থাকে।খালের মুখটার স্রোতের কাছে একদিন মাছগুলিকে দল বেঁধে যেতে দেখে ছায়াকে বলেছিলাম—‘তুমি জান কি ছায়া,এই ধরনের স্রোতে রুই,ভকুয়া ইত্যাদি মাছ ডিম পাড়ে,স্রোত ডিমগুলিকে বহুদূরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।স্রোত না পেলে ডিম ফুটে না।’

‘তুমি কী বোঝাতে চাইছ?’—ছায়া উল্টে জিজ্ঞেস করল।কথার সুরটা এই ধরনের—‘আমি বুঝতে পেরেছি,সব সময় এই সমস্ত প্রসঙ্গ উত্থাপিত না করলেও হবে।তুমি জোন এবং জুনুকার কথা বলতে চাইছ।‘

আমাদের চোখের সামনে পথের আশেপাশে লাগানো ঝোপ এবং বড়ো জাতের গাছগুলি অনেক বড়ো হয়েছে।ডাল-পাতায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে।

রাতের দিকে তুফান হয়েছিল।বাগানের বেশ কিছু গাছ শিকড় থেকে উপড়ে গেছে।বেশ কিছু গাছের ডালপালা ভেঙ্গেছে।একটা ছোটো ডাল এসে ঘরের ওপর পড়েছে।

ভোরের দিকে জোন ফোন করল—‘বাবা সব কিছু ঠিক আছে তো?’

‘ঠিকই আছে।কী হল এত সকালে ফোন করেছ যে?’

‘রেখে দাও তোমার সকাল।আমাদের এখানে মানুষ দেড়ঘন্টা আগেই উঠে পড়েছে।তিনটার পরে আমরা আর শুয়ে থাকতে পারি না।’

‘আচ্ছা তোর কথাটা বল।এত তাড়াতাড়ি ফোন করলি যে?’

‘না,নিউজে দেখলাম যে ওদিকে নাকি প্রচণ্ড তুফান হয়েছে।বাড়ির কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে কি?আমি দুদিনের ছুটি নিয়ে আসব বলে ভাবছি।’

‘দূর’,আমাদের এখানে কারেন্টই যায় নি,কীসের প্রচণ্ড তুফান?আসতে হবে না,রাখ।’

রিসিভারটা রাখতেই পুনরায় বেজে উঠল।রাগ হল।এবার বোধহয় জুনুকা।ঘুমোতে যেতে আরও আধঘন্টা বাকি। সকালের পরিচ্ছন্ন ঘুম।মা ফোন ধরল।

দুজনেই প্রাতঃভ্রমণের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম।সত্যিই প্রচণ্ড তুফান।যেখানে সেখানে গাছের ডাল।সাইনবোর্ড ইত্যাদি বিধ্বস্ত।কোথাও কোথাও টিন পড়ে রয়েছে।নতুন করে গড়ে উঠা গ্রামটা পার হলাম।পথের পাশের বারো চৌদ্দ ফুট উঁচু গাছটা উপড়ে পড়েছে।গাছটাকে অতিক্রম করতে যেতেই চিঁচিঁ ধরনের কণ্ঠস্বর শুনে কাছে গিয়ে দেখি—দুটো চড়াই পাখির বাচ্চা।বিধ্বস্ত প্রায় বাসাটার ওপরে বসে ঠোঁট দুটি বিস্তৃতভাবে মেলে ওরা ডাকাডাকি করছে।গাছটার একটা ডাল একটা পাখিকে চেপে ধরে আছে।পা দুটো মেলে ওটা মরে পড়ে আছে।আশে-পাশে তাকালাম।পাখিদুটোর দেখাদেখি নেই।আমি কিছু বলার আগেই সে বাচ্চা দুটি আলগোছে তুলে নিয়ে বলল—‘ও মাগো।’

দুজনেরই কাজ বাড়ল।সময়-অসময় নেই,আমরা যেন ওদের আহার,পানীয় জল জোগান দিয়ে যাব।ওদের কাণ্ড-কারখানার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

জোন ফোনে মাকে অভিমানের সুরে বলল—‘মা,তোমার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলতেই চাই না।কী হয়েছে তোমাদের?’

জুনুকা সেদিন জামাইয়ের সঙ্গে এসে বারান্দায় বাচ্চা দুটির সঙ্গে্ লেগে থাকা অবস্থায় পেল।জুনুকা যেন অতি গোপন কথা একটা ধরে ফেলল,সেরকম ভাবের একটা রহস্যময় হাসি মুখে ফুটিয়ে তুলল।জামাই হেসে হেসে জুনুকাকে বলল—‘তুমি বহুদিন আসনি বলে বাবা মা খারাপ পেয়েছে বলে কেঁদে চোখ ফোলালে।এখন দেখ,নাতি-নাতনির জন্য বাবা-মা আমাদের দেখার মতো সময় পায় নি। গেট খুলে বারান্দা পেল,তবু বলতেই পারে না।’জুনুকা মুখ ফুলিয়ে বলল—‘কথার গোড়া কোথায়।’

খাঁচায় আবদ্ধ একজোড়া ছোটো পাখি।ক্রমে ওরা বড়ো হয়ে উঠছে,ফুর্তি বেড়েছে।খাঁচায় থাকতে ওদের আপত্তি নেই।আমরা ওদের কাছ থেকে সরে এলে ওরা আপত্তি করে।কোনো একজনকে না দেখলে চিৎকার চেঁচামিচি শুরু হয়ে যায়,দেখলেই শান্ত।

ওরা যুবক-যুবতি হল।আমরা দুজনেই কথা বললাম—ওদের খাঁচা থেকে মুক্ত করে দেবার সময় হয়েছে।ওরা উড়ে যাক,যতদূর ওদের মন যায়।গিয়ে বাসা তৈরি করুক,ডিম পারুক,বাচ্চার জন্ম দিক।খাঁচায় থাকলে বাসা বাঁধবে কীভাবে,ডিম পাড়বে কীভাবে,বাচ্চাকে খাওয়াবে কোথা থেকে?একদিন আমরা দুজনেই খাঁচার দরজাটা খুলে দিলাম এবং দুটিকেই উড়িয়ে দিলাম।কিন্তু ওরা দুটি দেখছি খাঁচার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল।হাত ঢুকিয়ে দুটোকে ধরে বের করে আনলাম এবং উঠোনে এসে একটা ছায়ার হাতে দিয়ে দুটোকেই উড়িয়ে দিলাম।ধপধপ করে উড়ে গিয়ে দুটিই টিনের চালের টইয়ে বসল এবং অবাক বিস্ময়ে গলা তুলে নিচের দিকে ,ওপরের দিকে ,চারপাশে দেখতে লাগল।অনেক সময় এভাবে থাকার পরে ওরা দুটো উড়ে গিয়ে কাঁঠাল গাছে বসল। 

আমি ভেতরে এসে আরাম কেদারায় বসলাম।ও শোবার ঘরের বিছানায় শুয়ে পড়ল।বিকেল হল,কারও কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।ক্ষুধা পাচ্ছে না।এক ফাঁকে আমি শোবার ঘরে গেলাম।ওর চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে আছে।আমাকে দেখে বসলেন এবং উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন—‘কী হল তোমার?চোখ দুটি ফুলে আছে কেন?’

আমি বললাম—‘না তো,কোথায়?ওরা দুটো বোধহয় অনেক দূরে চলে গেছে।’

‘কেন যাবে না?বনের পাখী,বনের কথা’—ছায়া অমনোযোগিতার কথা বলল।এই সময় বারান্দায় পরিচিত চিৎকার ধ্বনি শুনে দুজনেই প্রায় দৌড়ে যাবার মতো করে সেখানে পৌছালাম;দেখলাম পাখিদুটি পুনরায় খাঁচায় ঢুকেছে।কিন্তু কেন এল ওরা?

জামের ঝোপে ওদের বাসা।আমরা উঠোনে থাকলে ওরাও আমাদের খবর নিয়ে যায়।কয়েকমাস পরে ওরা ওদের বাচ্চা দুটিকেও আমাদের উঠোন এবং ভেতরে বেরিয়ে নিয়ে গেল।আগে অপরিচিত এবং সাবধানী হয়ে থাকাদেরও ওদের সাহায্যে আমাদের বারান্দা পর্যন্ত নিয়ে আসা হল।

জোন এবং জুনুকার পরিবার পরিপূর্ণ হয়েছে।তথাপি ওদের সঘন আসা-যাওয়া।ছয়মাইল দূরে দাদা থাকে।একটা ভাইপো নগরে যাবার সময় সবসময় আমার এখানে সাইকেল রেখে যায়।বয়স হয়ে এসেছে মানে হইচই ,চিৎকার-চেঁচামিচি সইতে না পারা হয়ে এসেছি।এরও একই দশা।কিন্তু গরমের বন্ধে,পুজোর বন্ধে চাঁদ এবং জুনুকার ছেলেমেয়েরা এখানে থাকতে ভালোবাসে।এই সময়ে ওদের পড়াশোনা নেই নাকি?আমাদের প্রতিবেশী শইকীয়ার কাছ থেকে শুনি ,নাতি নাতনির পড়ার চাপে তাদের ছেলে-বৌমা পুজো বা বিহুতেও বাড়িতে আসতে পারে না।জোন এবং জুনুকা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় খুব একটা গুরুত্ব দেয় না নাকি?ওদের এতদিন এখানে থাকার কী প্রয়োজন?অবশ্য ওরা সন্ধ্যাবেলা অনেক রাত পর্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা করে।তবুও সারাদিন হাসি-স্ফুর্তি,চিৎকার চেঁচামিচি ,দৌড়া-দৌড়ি!ছিঃ! কী ভরসায় ওদের মা-বাবা ওদের আমাদের কাছে রেখে যায়?আইআইটির প্রফেসার হয়ে জোনও এতদিন ছুটি পায় কি?

আর এই পাখির ঝাঁক?এত পাখি বেড়ে গেছে!সন্ধেবেলা ওদের চিৎকার চেঁচামিচি কে শুনবে?কারও কণ্ঠস্বর কোথাও শোনা যায় না।প্রথম অবস্থায় হুর হুর করে টিন একটা বাজালে কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল,কিন্তু আজকাল আর টিনের শব্দে কোনোরকম গুরুত্ব দেয় না।অবিরাম,অবিশ্রান্ত চিৎকার-চেঁচামিচি।এসব এখান থেকে কেন সরে যায় না?

এবার জোন বাড়িতে এলে তাকে বললাম—‘এই পাখির ঝাঁক থেকে আমার খুব অশান্তি হচ্ছে হে জোন।সন্ধেবেলা এত চিৎকার চেঁচামিচি!কিছু একটা বুদ্ধি করে তাড়ানো যায় না কি?

একটা দুষ্টুমির হাসি হাসি হেসে জোন জুনুকার দিকে তাকাল।সে দুদিন আগে এসেছে।সে বলল—‘করাতিদের ডেকেছি,কাল গাছগুলির গুড়ি কাটতে হবে।’

‘কী? কী?’—আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।

একটা মুচকি হেসে জোন বলল—‘বাবা,গাছে পাখি আসবেই।পাতা শূন্য গাছে পাখি বাসা বাঁধতে পারে না।আর দিনের বেলা তো পাখিরা প্রায় থাকেই না।রাতের বেলা গাছে পাখিরা ফিরে এসে সুখে কাটায়।তাতে তুমি কেন খারাপ পাও বাবা?

জুনুকা আস্তে করে বলল—‘বাবা,তুমি ওদেরকে খাঁচা থেকে বের করে দিলে,এখন গাছে বিশ্রাম নিতেও দেবে না?’

আমি ছায়ার চোখের দিকে তাকালাম।তা জুনুকা কী বোঝাতে চাইছে আমি ভালোভাবে বুঝতে পারলাম কিনা ধরতে পারলাম না।ছায়া বা কী বুঝতে পারল?  

 

 

 

     

 

 

        




 





















error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত