| 27 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা মালয়ালম অনুবাদ: দাঁড় । ই সন্তোষ কুমার

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

লেখক পরিচিতি- ই সন্তোষ কুমার মালয়ালম ভাষার এই প্রজন্মের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য লেখক। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা পনেরোর বেশি। সেরা গল্প সংগ্রহের জন্যে এবং উপন্যাস অন্ধাকরানঝি –র জন্যে দুবার পেয়েছেন কেরালা সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার যথাক্রমে ২০০৬ আর ২০১২ সালে। এই উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ- আইল্যান্ড অফ লস্ট শ্যাডোজ ২০১৫ সালের ক্রসওয়ার্ড পুস্কারের জন্য বাছাই করা হয়েছিল। তাঁর দুটি গল্প থেকে মালয়ালম সিনেমা হয়েছে। তাঁর লেখা অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি, তামিল, হিন্দি এবং জার্মান ভাষায়। বাংলায় অনুবাদ এই প্রথম।


 

ডিমের পোচ বানানো একটা শিল্প। খুব সাবধানে বানাতে হয়। একটু মনোযোগ সরে গেছে তো কুসুমটা ছড়িয়ে যাবে আর সেই চিরকেলে দু দিক ভাজা ডিম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। প্রতি রবিবার সকালে আমি দুটো ডিমের পোচ বানাই, একটা মেয়ের জন্যে আর একটা আমার জন্যে। রবিবার সকালে রান্নাঘরের দায়িত্ব আমার, যার মানে হচ্ছে খুব হালকা জলখাবার হবে। সাধারণত পাঁউরুটি আর ডিম, যা আমি শনিবার সন্ধেয় ফেরার সময় কিনে আনি। পদ্মিনী রবিবার খুব সকাল থেকেই তার মন্দির পরিক্রমা শুরু করে। বোধহয় আজকাল সে ব্রেকফাস্টও স্কিপ করছে। আমি ঠিক জানি না ঠিক কোন কোন দিনে সে এইরকম উপোষ করে। যাই হোক, ও ডিমের পোচ  পছন্দ করে না।

ও বলে ডিমের পোচ  দেখলে ওর বায়োলজি ক্লাসের ভ্রূণের কথা মনে পড়ে যায়। আমার বায়লজিতে কোন আগ্রহ নেই। আমার বিষয় অংক আর অংকে ডিমকে ইলিপ্সের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এই পাঁচ বছরের দাম্পত্যের একঘেয়েমির মধ্যে খাওয়া দাওয়া ঝগড়ার বিষয় হয়ে উঠেছে। পশ্চিমে ওরা বলে সেভেন ইয়ার ইচ, কিন্তু আমরা একটু আগেই শুরু করেছি। ভাব হয়ে যাবার পর হালকা মুহূর্তগুলোতে  আমরা হাসতাম একসময়।

‘দেখো ও ভিজিয়ে ফেলেছে’ আমি আঙুল দেখালাম। দুএক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে পদ্মিনী একটা উদাসীন ভাব দেখিয়ে রান্নাঘরে ন্যাতা আনতে যায়। আমি খবরের কাগজে ডুবে থাকার ভান করি, কিন্তু আসলে ওকে সমস্ত সময় লক্ষ করে চলি।

 
আমার সাত বছরের মেয়ে মেঝেতে বসে, ওর জামা পেচ্ছাপে ভিজে গেছে, অদ্ভুত হাত পা নেড়ে খেলে যাচ্ছে।

আমাদের বিয়ের অলিখিত আবশ্যিক শর্তের অন্যতম এই বাচ্চাটি। আমার মেয়ের মায়ের মৃত্যুর দু বছরের মাথায় আমি আর পদ্মিনী বিয়ে করি। আমি কাগজে একটা পাত্র পাত্রী কলামে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম, তারই ফলশ্রুতি এই বিয়ে। কিছুই লুকোইনি। দাবীর মধ্যে ছিল একটি বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন শিশুর প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন কোন অবিবাহিতা বা বিধবা। পদ্মিনী সেসময় পাঁচ বছর হল বিধবা হয়েছে।

 
প্রথম দেখা হয়েছিল এক বন্ধুর বাড়ি। আমার মেয়ে সেইদিনও তার জামা ভিজিয়ে ফেলেছিল। আমি পদ্মিনীকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, সে আমার মেয়েকে পরিষ্কার করিয়ে জামা পালটে দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করেনি।

‘কেন তুমি বাচ্চা নাওনি?’ আমি ওর বিবাহিত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম যেখানে কোন বাচ্চা ছিল না। আমাদের কথাবার্তা কিছু তথ্যের মধ্যেই সীমিত ছিল।কোন রোম্যান্টিক ব্যাপারই ছিল না। একটা অপরাধ করার আগে মানুষের মনের অবস্থা যেমন হয়, আমাদের মনের অবস্থাও সেইরকম ছিল।
‘প্রথম প্রথম আমরা বাচ্চা চাইনি কারণ হরবখত বদলি আর অন্যান্য কাজকর্মের জন্যে। আর যখন আমরা এটা নিয়ে ভাবলাম, তখন ওর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করেছে।’

‘ওঁর সমস্যা কী ছিল?’ যদিও বন্ধুটি আমাকে সমস্ত ভালভাবে বলেছিল, তবু আমি কৌতূহলের ভান দেখালাম।
‘ক্যানসার’ কোন দুঃখ বা শোকের লেশমাত্র ছিল না পদ্মিনীর গলায়, এমন ভাবে বলছিল যেন অন্য কোন জীবনের কথা বলছে। ‘ব্রেন টিউমার’ ‘উমার খুব জ্বর হয়েছিল’ আমি আমার স্ত্রীর কথা বলছিলাম ‘কিন্তু কেউ ভাবতে পারেনি জ্বর থেকে মারা যেতে পারে ও’ ওর মৃত্যুর প্রথম কয়েক বছর এ নিয়ে বলতে গেলে আমার কথা হারিয়ে যেত।কিন্তু পরে বুঝলাম, সময় ভাঙ্গা বাক্যকে জুড়ে দ্যায়।

চায়ের কাপ চামচ দিয়ে ঠুকতে ঠুকতে অনুর আঙুল কাঁপছিল। আমি ওকে আমার সঙ্গে ইচ্ছে করেই নিয়ে গেছিলাম। ‘জন্মের সময় অনু একদম স্বাভাবিক বাচ্চা ছিল।’  চামচটা ওর হাত থেকে নিয়ে আমি বললাম। ‘ ওরও জ্বর হয়েছিল। সেটা এপিলেপ্সির দিকে ঘুরে গেল। সেই থেকে কিছুই ঠিকঠাক হয়নি’ ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।‘ পদ্মিনী অনুকে কোলে তুলে উৎসাহের সুরে বলে। ওর গলার স্বর বলে দিচ্ছিল ও অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে এসেছে। সেইদিন থেকে আমাদের মধ্যে অলিখিত চুক্তির শুরু। ও অনুর দায়িত্ব নিয়েছে। অনুকে একা মানুষ করব কী করে সেই নিয়ে আমার বেশ  ভয় ছিল।

অনু খুব সহজ বাচ্চা নয়। সে স্নেহ ভালবাসা বুঝতে বা তাতে সাড়া দিতে অক্ষম। ওর স্বাদ কোরকের বেলায়ও তাই। খিদে পেলে ও যা খুশি খায়। আমিই রবিবার সকালে ডিমের পোচ খাওয়ার চল  করেছি। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারি না অনু এটা পছন্দ করে কিনা।

মাত্র কিছুদিন আগে  পদ্মিনী আমাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ওর অপছন্দের ইঙ্গিত দিয়েছে, সেদিন আমরা প্রথম ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। বাড়িটা প্রায় সারাদিন বন্ধ ছিল, ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে না ধোয়া জামাকাপড় আর বদ্ধ বাতাসের গন্ধ আমাদের নাকে এল।

‘কী দুর্গন্ধ!’খুলতে খুলতে অভিযোগের সুরে বলল পদ্মিনী। আমি ভাবলাম ডাক্তারের কাছে গিয়ে সে খানিকটা হতাশ।

‘ফ্যান চালিয়ে দাও’ অনু আমার কাঁধে ঘুমোচ্ছিল, ওকে সোফায় শোয়াতে শোয়াতে আমি বললাম। ঠোঁট অল্প খোলা, ঘুমের মধ্যে অনু পাশ ফিরে শুল।

‘ফ্যান চালালে কিছু হবে না,’ পদ্মিনীর বিরক্তি গোপন ছিল না। ‘এটা হচ্ছে সকালে তুমি ডিম করেছিলে তার গন্ধ। তুমি নিশ্চয় পরিষ্কার করোনি’

‘আমরা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলাম, তাই না? এখনো করা যায়’

‘কে করবে? আমি অন্তত না। আমি ডিমের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। বমি পায়’

‘তো আমি আজ থেকে সব থালাবাসন ধোব’ আমি একটা উদ্ধত ভেঙ্গানির সুরে বললাম-

‘আমি তা বলতে চাইনি’ পদ্মিনী ওর গলা নামাল ‘তুমি ডিমের পোচ করতে যে বাসনপত্র ব্যবহার করেছ সেগুলো আমি ধুতে পারব না।’

আমরা কথা আর বেশি টানিনি। আমি রান্নাঘরে গিয়ে এক্সজস্ট ফ্যান চালিয়ে দিলাম। একটা ঘুঘু যে একজস্টের ফাঁকে বাসা বেঁধেছিল, তাড়াতাড়ি উড়ে গেল। বাসা মজবুত করতে ঘুঘুটা যেসব শুখনো পাতা আর খড়কুটো এনেছিল, সেগুলতে ফ্যানের ব্লেড লেগে কাটাকাটা আওয়াজ হতে লাগল।

পদ্মিনী ফ্যানটা অফ করে দিল। ‘পাখিটাকে এখানে থাকতে দাও। হয়তো ও ডিম পাড়বে’

আমি ক্ষেপে গেলাম। এদিকে বলছ দুর্গন্ধ আর যখন একজন সেটা দূর করার চেষ্টা করছে, অন্য প্রসঙ্গ পেড়ে তাকে বাধা দিচ্ছ! এই ঘুঘুগুলোর কি অন্য কোণাকাঞ্চি নেই যেখানে তারা বাসা বাধতে আর ডিম পাড়তে পারে?

আমি আমার স্কুটার নিয়ে শহরে বেরিয়ে গেলাম। যেতে যেতে আমি মনে করছিলাম ডাক্তারের সঙ্গে  হওয়া কথাবার্তা আর তিনি যে টেস্টগুলো করতে বলেছেন। আমার বিশ্বাস সমস্যাটা যে পদ্মিনীর তার অনেক ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন, যদিও খুব বেশি কথা এ নিয়ে বলেননি। আরে, আমার তো প্রথম বিয়ে থেকে একটা বাচ্চা আছে। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেছেন রিপোর্ট পদ্মিনীর পক্ষে।

‘আমি সত্যি কোন সমস্যা দেখছি না’ আবার একবার রিপর্ট দেখে ডাক্তার বললেন। ‘হতে পারে ওর স্বামীর সমস্যা ছিল’ পদ্মিনীর প্রথম বিয়ের কথা তুলে বললেন তিনি।
 
‘ও কিছু ওষুধ খেত’ দৃশ্যতই উৎসাহ নিয়ে পদ্মিনী বলেছিল।

‘হয়তো কিছু সময় লাগবে’ ডাক্তার কাগজে কিছু লিখতে লিখতে বললেন। ‘হয়তো আমাদের আরও কিছু টেস্ট করাতে হবে। কিন্তু ভাগ্যেরও একটা ভূমিকা আছে, আমি বিশ্বাস করি’ তিনি পরামর্শ দিলেন ভালো করে ঘুমোতে আর রোদে না যেতে।

‘পরের বাচ্চাটা কি স্বাভাবিক হবে?’ দ্বিধানবিত গলায় বলল পদ্মিনী।

‘বোকা বোকা কথা বলবেন না’ ডাক্তার জোর দিয়ে বললেন। ‘প্রথমত ওর ক্ষেত্রে এটা জেনেটিক ডিসঅর্ডার নয়।আর যদি তাও হয়, তবে সাধারণ অভিজ্ঞতায় বলে এরকম জিনিস দুবার হয় না’ এর পর থেকে পদ্মিনীর মন্দিরে যাওয়া আরও বেড়ে গেল। এলাকার মন্দিরগুলোয় সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যেতে লাগল।

ঘুঘু তার বাসা বাঁধার কাজে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খড়কুটো, দড়ি আর পাতার জন্যে একজস্ট ফ্যানের ব্লেডগুলো প্রায় ঘোরেই না। সুইচ অন করলে শুধু গুনগুন করে। কালচে ছাই রঙের পাখিটি প্রায় সারাক্ষণই সেখানে হাজির।

এটা শিগগিরই আরেকটা ঝগড়ার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। ‘ডিমের গন্ধ নিয়ে তুমি কি তুলকালামই না করলে। এখন তো ঘুঘুর গুয়ের গন্ধে রান্নাঘরে ঢোকাই যায় না’ আমি অভিযোগ করলাম। সে শেষ কথা বলার সুরে বলে ‘ডিম ফুটে গেলেই ও চলে যাবে’ ‘এইটা আমার মাথায় ঢুকছে না। এইটা কি ডিম পাড়া আর তা দেবার জায়গা?’ ‘না, তুমি কখনো বুঝবে না’ ও চেঁচিয়ে ওঠে। ‘মাঝে মাঝে এই বাচ্চার থেকেও তোমার বুদ্ধি কম মনে হয়’ আমার কাছে কথাটা একটা থাপ্পড় হয়ে এল। আমাদের ঝগড়ায় কখনো অনুর প্রসঙ্গ আসেনি।এটা আমাদের অলিখিত চুক্তির আরেকটা শর্ত।

আমার মেয়ে বারান্দায় বসে একটা বইয়ের পাতা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করছে। আমি ওকে বাধা দিলাম না। যাইহোক পদ্মিনী ওর হাত থেকে বইটা নিল, টুকরোগুলো জড়ো করে রান্নাঘরে চলে গেল।ওর মুখের রঙ কাগজের মতো, ভালবাসা বা ঘৃণা কিছুই ফুটে ওঠে না।

এখনো বাচ্চাটাকে স্নান করানো হয়নি। আমি পদ্মিনীকে দেরির কারণ নিয়ে জিগ্যেস করলাম না। কিন্তু নিজেও স্নান করানোর উদ্যোগ নিলাম না। ওই করুক। ও তো কী দায়িত্ব আছে না আছে সেসব বুঝেই বিয়েতে রাজি হয়েছে।

একটু পরে পদ্মিনী গরম জল নিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। বাথরুম থেকে ট্যাপকল খোলার আর বালতিতে জল পড়ার শব্দ এল। এরপর সে অনুর জামা খুলে মাথায় তেল দিয়ে বাথরুমে নিয়ে গেল। মাথায় জল পড়লেই অনু কাঁদতে থাকে। কিন্তু আজ আমি শুনলাম পদ্মিনী ওকে বকছে। এটা সচরাচর কর না। যেন কিছুই শুনিনি এমন ভাব দেখিয়ে টিভি চালিয়ে দিই।  বিস্তীর্ণ বরফে প্রশান্তমুখে ঘুমোনো মেরু ভালুক পর্দা জুড়ে।

গতকাল আমি অফিস থেকে একটু আগে ফিরে দেখেছিলাম অনু পড়শি বাচ্চাদের সঙ্গে উঠোনে খেলছে। কাদা আর ধুলো মাখামাখি।আমি রান্নাঘর থেকে আওয়াজ পাচ্ছিলাম।রান্নাঘরের ভেতরে গেলাম। ঘুঘুর সাদা গু মেঝেতে ভর্তি।

আমি চিৎকার করে বললাম ‘ঘুঘুর জন্যে তোমার যা দরদ, বাচ্চাটার জন্য অন্তত সেটুকু যদি থাকত’
পদ্মিনী অবাক হয়ে গেল।‘কী করেছি আমি?’ সে পাথর হয়ে যাওয়া চোখে তাকিয়ে বলল।
‘অনু কোথায়?’
‘কেন, উঠোনে খেলছে না?’
‘খেলছে! কী অবস্থা চেহারার। ভিখিরির বাচ্চারাও এর থেকে পরিষ্কার থাকে’
‘কী বলছ কি তুমি? আমিই কি ওর দেখাশোনা করি না? এইরকম বাচ্চা মানুষ করার কষ্টের তুমি কি জানো?’
‘আমি যা দেখতে পেলাম তাই শুধু বললাম’
‘শুধুই তাই? তোমার কথায় মনে হল ওকে আমি ইচ্ছা করে অবহেলা করছি। আমি কি এত বড় একটা বাচ্চার পেচ্ছাপ পায়খানা পরিষ্কার করি না?আমি কি কোন দিন ওর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছি? সবই আমার ভাগ্য’
সে কাঁদতে  শুরু করে।
কান্না ওর অন্যতম অস্ত্র। কিন্তু আমি অবিচল । ‘সবাই এর মর্ম বোঝে না’
কাঁদতে কাঁদতে পদ্মিনী আমার দিকে তাকাল।
‘বুঝতে গেলে…’ আমি ডিম ভাঙ্গার সূক্ষতা নিয়ে থামলাম।
‘বুঝতে গেলে?’ সে ভয় গোপন রেখে আমার কথার প্রতিধ্বনি করল।আমি কথাটা শেষ করব না ঠিক করলাম। এটা বিদ্যুতের এক ঝলক। ও ধৈর্য ধরে বাজ পড়ার অপেক্ষা করুক।
ঘুঘুটা একজস্টের চৌখুপির ফাঁক দিয়ে ডাকছে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আমি অনুকে কোলে তুলে নিলাম। ও তখন উঠোনে বসে কাঁদছিল। অনুও বেরিয়ে এসেছে।
‘ওর স্নানের গরম জল রেডি’ ও বলল। আমি ওকে পুরো উপেক্ষা করলাম।
‘তুমি একটা বেইমান, কোন কৃতজ্ঞতা নেই’ আমাদের মধ্যের অসহনীয় নৈঃশব্দ্য ভেঙে ও বলল।
এই প্রথম ও আমার সম্পর্কে এরকম কথা ব্যবহার করল। এর অশ্লীল হিংসা কানে গরম সীসা ঢেলে দিল।
‘তুমি বুঝবে না, বলেছিলাম না? কারণ তুমি… তুমি একটা বাঁজা মাগী’ আমি গলা ফাটিয়ে বললাম।
আগে যে বিদ্যুৎ চমকে ছিল, এটা তার ভয়ঙ্কর ব্জ্রপাত।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকল পদ্মিনী।

‘বাঁজা মাগী’ আমি জোরে বললাম ‘ বাচ্চাকে ভালবাসতে গেলে প্রসব বেদনা কী তা জানতে হয়’ উসুম উসুম গরম জল দিয়ে অনুর  গা থেকে ধুলো কাদা ধুয়ে দিতে দিতে আমার মনে হল বিরাট জয় হয়েছে আমার। তখন সন্ধে হয়ে আসছে বলে অনুর মাথায় আর জল ঢাললাম না। অনু শুধু মাথায় জল পড়লেই কাঁদে।

বেডরুম থেকে পদ্মিনীর ফোঁপানির আওয়াজ আসছিল। আমি অনুকে জামাকাপড় পরিয়ে ওকে সঙ্গে নিয়ে স্কুটারে শহরের দিকে গেলাম পরের দিনের ব্রেকফাস্টের জন্য ডিম পাঁউরুটি কিনতে।

ফিরে এসে মনে হল অন্ধকার বাড়িটা একা একা কাঁদছে।

আমিই সেই রাতে অনুকে খাওয়ালাম। সত্যিই, কঠিন কাজ। প্রতেক গ্রাসের জন্য কত ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হয়।
রোববার সকালে দেরি করে উঠলাম।
অন্য রোববারের মতো পদ্মিনী মন্দিরে যায়নি। কিন্তু আমি ওকে পাত্তা দিলাম না। রান্নাঘরে যখন ঢুকলাম, সারা মেঝেতে ঘুঘুর গু।

আমি ঠিক করলাম ব্রেকফাস্টের আগেই এই ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করব।

একটা চেয়ার এনে তার ওপর দাঁড়িয়ে ঝাঁটা দিয়ে একটা খোঁচা মারতে চেষ্টা করলাম।পাখিটা সরে যাবার চেষ্টা করল, শেষ পর্যন্ত উড়ে গেল। কিন্তু তারপর ও আবার ওর বাসার দখল নিতে চেষ্টা করল, আমি আবার খোঁচা দিলাম। এবার ও একজস্ট ফ্যানের বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। শুখনো পাতা, কুটো, হয়তো ডিম… । আমি ওগুলো ঝেঁটিয়ে ফেলে দিলাম।আমি ঠিক করলাম বাইরে থেকে একটা জাল আটকে দিয়ে এই ঝামেলা থেকে চিরতরে মুক্তি পাব।

চেয়ার থেকে নেমে আমি মেঝের পালক আর গু সব ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করলাম।

অনুকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ওর দাঁত মাজাবার চেষ্টা করলাম। ও আমার আঙুল অন্তত একবার জোরে কামড়ে দিল। যদিও খুব লেগেছিল, তবু আমার মুখ দিয়ে একটা টুঁ শব্দও বের হল না, কারণ আমি চাইনা পদ্মিনীর কানে যাক…

চায়ের জন্যে জল ফোটাতে দিয়ে, আমি পাঁউরুটি স্লাইস করে কাটলাম।

এবার রোববারের নৈমিত্তিক পোচ করার পালা।

সাবধানে ডিম ফাটিয়ে গরম চাটুতে ফেললাম। একটা গুনগুন আওয়াজ, তার মানে ফ্রাই রেডি। প্লেটে তুলে, নুন মরিচ ছিটিয়ে দিলাম। দুটো হলুদ চোখ কি আমার দিকে চেয়ে আছে? একটা অদ্ভুত ধরনের সন্তুষ্টি হল।
চা তৈরি করে, অনুকে নিয়ে এসে চেয়ারে বসালাম।

ওর কোন ধারণাই নেই কী করে পোচ খেতে হয়। আমি চামচ করে ওকে খাইয়ে দিলাম। কিন্তু হলুদ কুসুম ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে গেছে।

অনু গিলছে না। সে এটা নিয়ে খেলছে, মুখের মধ্যে ঘোরাচ্ছে। আমি ওকে গিলতে বললাম।

সে চারদিকে তাকিয়ে মুখের মধ্যে যা কিছু ছিল আমার মুখে ছিটিয়ে দিল।প্রচণ্ড রাগে প্লেট দুটোও মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

ধৈর্য হারিয়ে, বা যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, আমি ওর গালে থাপ্পড় কশালাম। তিন আঙুলের  লাল দাগ বসে গেল গালে। চিলচিৎকার করে ও মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে লাগল।

আমি আমার রাগ সামলাতে চেষ্টা করছিলাম।বাইরে বেরিয়ে গিয়ে কল চালিয়ে মুখ ধুয়ে নিলাম। কিন্তু গন্ধটা কিছুতে গেল না। ডিমের একটা নাছোড় গন্ধ আছে, সত্যি কথা।

রান্নাঘর থেকে প্লেট তুলে রাখার আওয়াজ এল। অনুর কান্না থেমে গেছে।

কালচে ছাই পালকের ঘুঘুটা, জলের কলের ঠিক ওপরে আমগাছের একটা নিচু ডাল থেকে আমাকে দেখছিল।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত