| 8 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৩) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

প্রজ্ঞাসুন্দরী কে নিয়ে রাণীয়ার ভ্লগ

আজকাল বিদেশের মাটিতে বসে প্রজ্ঞাসুন্দরী-র বইখানি ওলটাতে গেলেই রাণীয়ার নিজেকে ঠাকুরবাড়ির সেই স্বনামধন্য শিক্ষিতা, আধুনিক রুচিসম্মত মহিলার মত মনে হয়। জন্মের ১৪০ বছর পার করেও প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী আজো প্রাসঙ্গিক । রাণীয়া নিজেকে দস্তুর মত প্রমাণ করছে প্রতিনিয়তই। ভুল নেই তার মধ্যে একটুও। নেই কোনও তঞ্চকতাও। এর মধ্যে কোনও খামতি নেই। বাপের বাড়ির লোকজন হয়ত বলেই উঠবে মনের আনন্দে একদিন
“শাশুড়ির মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে আমাদের মেয়েটা” নাহ! তেমন অবিশ্যি ভাবেনা রাণীয়া কখনোই। তবে হ্যাঁ, জিততে পারলে আনন্দ তো হবেই। এই রান্না খাওয়া নিয়ে এ যুগের উচ্চশিক্ষিত মেয়েকেও শুনতে হয়েছে বলে।প্রচুর খোঁটা খেয়েছে মিঠিও। নিত্যনতুন খাওয়ার বেলায় সবাই আছে কিন্তু বলার বেলায় সেই বাড়ির বৌ কে ছোটো করা। এ যেন চিরাচরিত ট্র্যাডিশন মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে। শ্বশুরমশাইয়ের মুখেও কুলুপ। কোনদিন তাঁকেও বলতে শোনেনি রাণীয়া। বিয়ের পরে মাত্র দুটো বছর ছিল সে কলকাতার শ্বশুর ঘরে। বরং তিনিও শাশুড়ি মায়ের ভয়ে কুঁকড়ে থাকতেন। পাছে বৌমা কে সাপোর্ট করলে তিনিও বকুনি খান। সেই ভয়ে। বুঝে গেছিল শান্তিপ্রিয় শ্বশুরমশাইয়ের আপাত প্রচ্ছন্ন সাপোর্ট আর প্রকট ইণ্ডিফারেন্স। আবার সেই শাশুড়ি মা নিজের ছেলেকে স্ত্রৈণ বলতেও ছাড়েন না যখন ছেলে তার বৌয়ের হয়ে মা’কে কথা বলে। কুশল প্রথম দিকে এমন কাউন্সেলিংয়ের চেশটা করেছে কয়েকবার কিন্তু এতে লাভের চাইতে ক্ষতি হয়ে বাড়ির শান্তির পরিবেশ নস্ট হয়েছে। তাই সে মুখের ওপরে বলত ইদানিং। “তোমরা দু পক্ষই যুযুধান। নিজেদের ইগোর লড়াইটা নিজেরাই বুঝে নাও, আমাকে টেনো না এর মধ্যে ” রাণীয়া ভাবত তখন, তবু তো কুশল মুখ ফুটে কিছু বলে। শ্বশুরমশাই তো বোবাকালা এক্কেবারে।

সেই পরিমণ্ডল থেকে এদ্দূর পৌছিয়ে আনন্দ তো হবারই কথা রাণীয়ার। সে যুগে প্রজ্ঞাসুন্দরী পেয়েছিলেন তাঁর বাবা এবং স্বামীর পূর্ণ সাপোর্ট । এ যুগের রাণীয়ার তাঁর মত অতটা প্রজ্ঞা না থাকলেও তার স্বামী কে পেয়েছে সবসময়ই তার পাশে। পেয়েছে তার মা অনসূয়া কেও।

এবারের পডকাস্ট আর ভ্লগিং প্রজ্ঞাসুন্দরীকে স্মরণ করেই করবে রাণীয়া। ক্যালেন্ডারে ২৫শে বৈশাখের ইংরেজী তারিখটা মাথায় রেখে এগোয় সে । মানুষের জানা উচিত সে যুগেও রান্না কে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন অভিজাত ঠাকুরবাড়ির এই শিক্ষিত মেয়ে। আজ টেলিভিশনে সব ভয়ানক কুকারি শো তে আজগুবি সব রান্নাবান্নার ভীষণ উল্টোপাল্টা দেখনদারি। তার চেয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে গ্রাম থেকে শহর, দেশ, বিদেশের কুকারি শো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কত বেশী ভিউয়ারশিপ আর সাবস্ক্রাইবার এইসব ডিজিটাল ফুড চ্যানেলের। বলাই বাহুল্য তার নিজের চ্যানেলটি ইতিমধ্যে বিশ্ব তথা দেশের মানুষের কাছেও দিব্য পৌঁছে গেছে জনপ্রিয়তার শিখরে ।

রবিঠাকুরের জন্মদিনে রাণীয়ার শ্রদ্ধা জানানোর শুরু থেকে শেষ অবধি টান টান । প্রজ্ঞাসুন্দরীর বই থেকে মণিমাণিক্য তুলে ধরল রাণীয়া সেদিন নিজের মুখে। নিজের লেখায়। গাইবে দু চার কলি গানও।

সেসময়টা ছিল উনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরু। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কলাকৃষ্টি, শিল্প সাহিত্য, সঙ্গীত, ছবি আঁকার পাশাপাশি উদ্দাম নাট্যচর্চার জোয়ার। বানভাসি সংস্কৃতির এহেন জোয়ারে ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও তালে তাল মিলিয়ে সমানতালে উদ্যমী হয়ে পড়েন।রক্ষণশীলতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে, প্রচারের আলোয় তাঁরাও তদ্দিনে আলোকিত। ঠাকুর পরিবারের নারী পুরুষের মধ্যে যার যা প্রতিভা ছিল সবের যেন উন্মেষ ঘটতে শুরু করেছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ গদ্য, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ লিখছেন দাপিয়ে। দীনেন্দ্রনাথ মেতেছেন সুরের মৌতাতে। অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ নিমগ্ন ছবিঘরে। এঁকে চলেছেন একের পর এক ছবি। আর স্ত্রী শিক্ষার অগ্রসরের পুরোধায় রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা রসায়নবিদ হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর স্ত্রী নীপময়ীও কম যান না। তিনি দেবেন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা। একদিকে তিনি সঙ্গীতজ্ঞা, অন্যদিকে ছবি আঁকা ও নানাভাষায় বইপড়া রপ্ত করার পাশাপাশি নিজের হেঁশেল ঘর সামলাতে রীতিমত দক্ষ এক রন্ধনে দ্রৌপদী। কারণ হেমেন্দ্রনাথ। কুলীন ব্রাহ্মণের সঙ্গে পিরালী বামুনের বিয়েতে পরিবারে নানা ওজর আপত্তি সত্ত্বেও সেই নবদম্পতি আলাদা থাকলেন। আর সেই ফাঁকে তাঁর স্ত্রী কে সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে উঠে পড়ে লেগেছেন তখন। মদ্যা কথা ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে তখন নারী জাগরণের সর্বপ্রকার প্রস্তুতি চলছে। এই হেমেন্দ্রনাথ ও নীপময়ীর মেজো কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই রূপে লক্ষ্মী এবং গুণে সরস্বতী। দ্বারিকানাথ ঠাকুরের এই প্রপৌত্রী প্রজ্ঞাসুন্দরী-র জন্ম ১৮৮৪ সালে।


আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১২) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


ঠিক সেইসময়েই ঠাকুরবাড়ির বিদুষী কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর সম্পাদনায় সম্পূর্ণ বাংলায় কালিনারি ম্যাগাজিন “পুণ্য” পত্রিকা ঠাকুরবাড়ির রান্নাবান্না কে আরও ছড়িয়ে দিয়েছিল মানুষের কাছে। সংস্কৃত, বাংলা এবং ইংরেজীর পাশাপাশি লরেটোয় শিক্ষাপ্রাপ্ত প্রজ্ঞাসুন্দরীর রন্ধনশিল্পে এক বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। তার মূলে ছিলেন প্রজ্ঞার মা নীপময়ী এবং বাবা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
পুণ্য পত্রিকায় কবিতা লেখার ফাঁকে ফাঁকে বাড়িতে রন্ধনের তালিম শুরু হয়ে গিয়েছিল মেয়ের বিয়ের আগেই। সেইসঙ্গে পুণ্য পত্রিকায় নিয়মিত সংযোজিত হতে থাকল ঠাকুরবাড়ির অভিনব, অবলুপ্ত সব পদ নিয়ে রন্ধন বৃত্তান্ত ও আরো কিছু।
ঠাকুরবাড়ির ঘরোয়া রান্নাবান্নাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এই নাতনী এই প্রজ্ঞাসুন্দরীর। কিন্তু তাঁর বিয়ে হয়ে গেল বিখ্যাত অসমিয়া দীননাথ বেজবড়ুয়ার পুত্র সুসাহিত্যিক, সুপুরুষ লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সঙ্গে। পরিবারে প্রচন্ড আপত্তি ছিল কারণ প্রায় কাকা রবিঠাকুরের বয়সী সেই পাত্র। কিন্তু এমন গুণী সাহিত্যিক পাত্রকেই তো মনে ধরল প্রজ্ঞার। নতুন অসমীয়া সাহিত্যের জনক এমন পাত্রও তো প্রজ্ঞাসুন্দরীর ছবি দেখেই নাছোড়। তাঁর এমন বুদ্ধিদীপ্ত পাত্রীই চাই, বলে দেবেন্দ্রনাথের কাছে সোজা আর্জি জানিয়েছিলেন। লক্ষ্মীনাথ ও প্রজ্ঞার জীবন রসায়নে যেন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের হাজারো মিল। আর খাদ্যানুরাগী, গুণী, জহুরী স্বামী এহেন প্রজ্ঞাসুন্দরীর মত এক জ্বলজ্বলে নক্ষত্র সম জহর খুঁজে পেয়ে আপ্লুত। স্ত্রীর মেধার উত্তরোত্তর লালনেও আগ্রহী হয়ে পড়লেন লক্ষ্মীনাথ। প্রজ্ঞার মা নীপময়ীও খুব ভালো রান্না করতেন। কিন্তু রন্ধন শিল্পের প্রতি প্রজ্ঞার উৎসাহের প্রকৃত প্রেরণা ছিলেন বাবা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং স্বামী লক্ষ্মীনাথ। শাস্ত্রে বলা হয়েছে ভারতীয় চৌষট্টি শিল্পকলার অন্যতম হল রন্ধনশিল্প আর তাই বুঝি সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রশিল্পের মতোই প্রজ্ঞাসুন্দরীর কাছে রন্ধন সত্যি সত্যিই একটি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়। তিনি বিজ্ঞানবিতের ন্যায় আমাপা কল্পনাশক্তির সাহায্যে ৬৫৮ প্রকার রন্ধন প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন যার মধ্যে অধিকাংশই তাঁর নিজের উদ্ভাবন। এ বুঝি পিতা হেমেন্দ্রনাথের ধীশক্তি এবং বিজ্ঞানমনস্কতা আর মা নীপময়ীর কল্পনাশক্তি ও রন্ধনের কৌশল যা তিনি ভাগ্যবলে পেয়েছিলেন রক্তসূত্রে।
বিয়ের পর প্রজ্ঞা একের পর এক নিত্যনতুন পদ রান্না রাঁধতেন আর স্বামী কে খাইয়ে ডায়েরীতে লিখে রাখতেন। স্বামী লক্ষ্মীনাথ উতসাহ তো দিতেনই আর সেইসঙ্গে বলাই বাহুল্য সেগুলিই সযত্নে লিখে রাখতেন প্রজ্ঞাসুন্দরী। ইউরোপিয়ান লেডি মিসেস বীটন যদি ইংরেজী রান্নার বই বের করতে পারেন তাহলে প্রজ্ঞাই বা কেন বাংলায় রান্নার বই বের করবেন না ?
রান্নার বই লেখার সুপ্ত ইচ্ছে ছিলই হয়ত প্রজ্ঞার আপন মনের মাঝারে কিন্তু সেযুগে সেই ব্যাপারে ইন্ধন যোগালেন বাবা এবং স্বামী। ভাবা যায়? এই বিষয়ে নানা তথ্যে ভরা একটি খাতা ছিল তাঁর। মেয়েদের রান্না শিখিয়েছেন, ‘পুণ্য ’পত্রিকা প্রকাশে উৎসাহ দিয়েছেন। তুতো ভাইবোনদের দিয়ে নিয়মিত রান্নার রেসিপি লেখাতেন পুণ্য পত্রিকার সম্পাদিকা প্রজ্ঞাসুন্দরী । প্রথম থেকেই এই পত্রিকার পাতায় পাতায় বিচিত্ররকম আমিষ নিরামিষ রান্নার নির্মাণকৌশল ছাপা হত। সে যুগে তাঁর আড়াই হাজারের কাছাকাছি সমস্ত রেসিপি দু মলাটে আবদ্ধ হয়ে বই আকারে প্রকাশিত হবার মূলে ছিলেন এই দুজন পুরুষ। প্রজ্ঞার পিতা এবং স্বামী। নিজের এক্সপেরিমেন্টাল রান্না, ঠাকুরবাড়ির রান্না, এপার-ওপার বাংলা, শ্বশুরবাড়ি অসমের রান্না, কেতাদুরস্ত সাহেবি পদ সব মিলিয়ে মোট তিনটি বইতে স্থান পেল প্রায় ২৫০০ রেসিপি। ৬০ বছর ধরে লেখা হয়েছিল তিনখানি বই। ১৩০৭ সনে ৫৫ নং আপার চিৎপুর রোডের আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হল সম্পূর্ণ নিরামিষ রান্নার সংকলনের প্রথম খন্ড। এরপর হিন্দু বিধবা ও অন্যান্য নিরামিষাশীদের জন্য দ্বিতীয় খন্ড।
এই বইগুলি শুধুমাত্র রেসিপি বই নয়। অনেক কিছু শেখার আছে সেখানে। তিনটি ভাষায় ব্যুৎপত্তি সম্পন্না প্রজ্ঞাসুন্দরী সে যুগের রান্নাঘরের ভাষা নিয়ে রীতিমত জাগলিং করে গেছেন। আমি তাঁকে বলি আক্ষরিক অর্থে ওয়ার্ডসস্মিথ। তাঁর লেখা বইগুলিতে রান্নাঘরের তাকবাক, তরিবৎ থেকে নানাবিধ কৌশল, সে যুগের হেঁশেল পারিপাট্য সব রয়েছে। যা এই আধুনিক যুগে আমাদের ভাবায়। তাঁর এই রান্নার বইগুলি গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের পাঠ্য বই হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়। তিনি একাধারে রান্নার পুষ্টিতত্ত্ব, অন্যদিকে পরিচ্ছন্নতা সব মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। আজো প্রত্যেক গৃহস্থীর শিক্ষণীয়।
অথচ প্রজ্ঞা তখন স্বামীর কর্মসূত্রে হাওড়ার নিবাস থেকে কখনো সম্বলপুর তো কখনো ঝাড়সুগাদায়। নিজের মেয়ে সুরভীর মৃত্যু হয়েছে তার মাঝে। তার পরে জন্মেছে আরো তিন মেয়ে… অরুণা, রত্নাবলী এবং দীপিকা। শোকতাপ। ঝড়ঝঞ্ঝা সামলেছেন। মেয়েদের মানুষ করেছেন। বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু থেমে থাকেনি তাঁর বই লেখার কাজ। রান্নার নিত্যনতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা, নতুন নতুন পদ আবিষ্কার এবং বইয়ের ৩য় খন্ডে সেসব সংযোজিত হয়েছে।
এবার বইয়ের বপু আরো বৃহৎ কারণ সম্পূর্ণ আমিষ রান্নার রেসিপি এবং সেইসঙ্গে গল্প। আমিষ আহারের পাশাপাশি নিরামিষ সব অবলুপ্ত পদগুলিকে সীতা উদ্ধারের মত টেনে হিঁচড়ে বের করে “ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল” এ স্থান না দিলে দেশীয় সংস্কৃতি যে লোপ পাবে। তেমনই যেন উচাটন ছিল প্রজ্ঞার। তাই তার ধারক ও বাহক হিসেবে সে সময়ের রান্নার দলিল হয়ে থেকে গেল সেই বই। নয়ত সে যুগে ছেলেদের মুখে প্রায়শই শোনা যেত “রান্না হল হালুইকর বামুন ঠাকুরের কাজ” কিম্বা “শাক সুক্তো রাঁধতে আবার কেতাব পড়তে হবে কেন?”। সব যেন “গতঃ স পন্থা” অর্থাৎ মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করেন গমন। মানে রান্নাঘরে মা, ঠাকুমা, দিদিমা গতানুগতিক যে পথ দেখিয়েছেন সেই পন্থাই অবলম্বন করা শ্রেয়। নতুন গবেষণা বা ইম্প্রোভাইজেশন যেন সমীচীন নয়। কিন্তু প্রজ্ঞা সে যুগেই ছক ভাঙলেন। সাদামাটা উপকরণ দিয়ে, সামান্য পদ্ধতির রদবদল করে কতরকমের যে পারমুটেশন- কম্বিনেশন হতে পারে কিম্বা ফোড়নের এদিক ওদিক ব্যাবহারে রান্নার স্বাদবদল যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সেটা দেখাই ছিল রন্ধনশিল্পী প্রজ্ঞার লক্ষ্য।

রান্নার বৈচিত্র্যময় পদ্ধতি যে একজন রন্ধনশিল্পী কে কতরকম ভাবে ভাবাতে পারে তা সত্যিই দেখবার মত বিষয়। তাঁর বই গুলির মধ্যে বিভিন্ন কোণা থেকে আবিষ্কার করা যায় প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী কে।

যেমন ঝালফ্রেজি এসেছে “ফেরিজি” থেকে।
বইটিতে একটি সুন্দর শ্লোক পেলাম যোগী যাজ্ঞবল্ক্য র। যা থেকে পরিষ্কার হয় ঝালফ্রেজির মানে।
“ভৃজি পাকে ভবেদ্ধাতুরজস্মাত পাচয়তে হ্যসউ”
ভৃজ ধাতুর অর্থ পাক করা। আমাদের দেশের ভাজি বা ভাজা, ইংরেজই তে ফ্রাই। এই দুটি শব্দ ভৃজ ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই ভাজি আর ফ্রাই এর মধ্যবর্তী আরেকটি শব্দ ‘ফেরিজি’। যা তিনি ভাজা মাংস রান্নার নাম দিয়েছেন। যা থেকে ঝালফ্রেজি। ভৃজি শব্দের ‘ভ’ ‘ফ’ তে পরিণত হয়ে ফ্রাই হয়েছে। ফেরিজি আরও সংক্ষিপ্ত হয়ে ফ্রাই হয়েছে। ভাষা ভাষান্তরে পরিভ্রমণ কালে অনেকসময় ‘ভ’ ‘ফ’ তে পরিণত হতে দেখি আমরা। যেমন ইংরেজী ফান্ড শব্দ আমাদের ভাণ্ড ও পরে তা থেকে ভাণ্ডার।

রন্ধন পটীয়সীদের চোখের আন্দাজ বা হাতের মাপে ছিল যাদু। তাই বুঝি প্রজ্ঞাসুন্দরীও আমাদের মায়ের মত বলে উঠেছেন এক চিমটে চিনি বা নুনের কথা কিম্বা তর্জনী সমান আনাজ কাটার কথা। ঘিভাতে তিন আঙুল সমান জল দেওয়ার কথা বা সিকি চামচ মধু, ১ সের মাংস অথবা এক মুঠো চাল, এক কোষ জল, এক ছটাক ঘি, এক পোয়া দুধ কিম্বা এক তোলা ময়দা এসব পরিমাপের কথাও পাই তাঁর লেখায়। এসব পরিমাপ হল প্রাচীন রান্নার ঐতিহাসিক মৌলিকত্ব।
আমরা রান্নাঘরে পাঁচমেশালি আনাজপাতি দিয়ে একটা ঘ্যাঁট বা চচ্চড়ি রাঁধি। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী একটি মজার নাম দিয়েছেন এই চচ্চড়ির “হাব্ জা – গোব্ জা” অর্থাৎ হাবিজাবি আনাজপাতি দিয়ে প্রস্তুত তরকারী। এই চচ্চড়িই আবার চৈতন্যভাগবতের কথাকারের লেখায় ওড়িশার ভাষার ‘নাফরা’ বা ‘লাফরা’। সে তো আমাদেরই পাঁচমেশালি ‘লাবড়া’রই অনুরূপ। এভাবেই তো হয়েছে বাংলাভাষার বিবর্তন। সেকালে গৃহস্থের সংসারে অনেক পাত পড়ত তাই একটা জবরদস্ত পাঁচ মেশালি চচ্চড়ি আয় দিত সবার পাতে ভাগ করে দেবার কারণে। মঙ্গলকাব্যের শশ্শরির আধুনিক রূপান্তর এই চচ্চড়ি। তবে সে যুগের গৃহিণীদের চচ্চড়ির বিলাসের অন্যতম প্যারামিটার ছিল প্রতিটি সবজির মাপ এবং তাঁদের সুচারু হস্তে কেটে নেওয়া। আর সে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে বাংলাভাষার দারস্থ হন বাংলার সু- গিন্নীমায়েরা। কোনোটি ফালাফালা, কোনোটি ডুমোডুমো, কোনোটা আবার কুচিকুচি তো কোনোটা ঝিরিঝিরি আবার কোনোটি একফালি চাঁদের মত … এসব নিদিনিক্ষিতে লক্ষ রাখতে দেখেছি আমাদের মা, দিদিমার রান্নাঘরে। ভাষার মিষ্টতায় এমন সব শব্দবন্ধ আজো আমাদের হেঁশেলে জিন্দাবাদ। এটাই তো আমাদের মাতৃভাষার পরম্পরা।

ধনে, জিরে, শুকনো লংকা, গোলমরিচ এইসব মশলাকে শুকনো খোলায় নেড়ে নেওয়া বা কাঠখোলায় ভেজে নেওয়ার নাম প্রজ্ঞাসুন্দরী দেন ‘কাঠখোলায় চমকান’। এখন আধুনিক রান্নাঘরে তা ড্রাই রোস্ট। আর সামান্য তেলে ফোড়ন দিয়ে কুচোনো আনাজপাতি দিয়ে রান্নার চিরপরিচিত ছেঁচকি রান্নার পদ্ধতি কে কী চমৎকার নাম দিলেন তিনি। ‘হেলানি’। কারণ বারেবারে জল ছাড়া এই রান্নায় কম আঁচে নাড়াচাড়া করাটাই তো হেলানি। বিশ্বায়নের মাতাল হাওয়ায় আট থেকে আশি, সবার মুখে যা এখন স্টার ফ্রাই।
প্রজ্ঞাসুন্দরীর লেখা ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ বইটির তিনটি খণ্ড সযত্নে স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব লাইব্রেরিতে। রবীন্দ্রনাথের বড়ো মেয়ে মাধুরীলতা এই বইটির দ্বিতীয় খণ্ড বাবার কাছ থেকে একবার চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। এই বইটিতে প্রথমেই খাদ্য, পথ্য, ওজন, মাপ, দাসদাসীর ব্যবহার, পরিচ্ছন্নতা, এসব ব্যাপারেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ আছে। রান্নাঘরে ব্যবহার করা শব্দের পরিভাষা রয়েছে এই বইটিতে।
হাবিজাবি আনাজপাতি দিয়ে প্রস্তুত চচ্চড়ির এক মজার নাম দিয়েছিলেন তিনি “হাবজা গোবজা”। ফোড়নের শব্দ কে চুটপুট, কুমড়ো বা এঁচোড় এর মধ্যে এঁতো (ভুতি), পোলাও রান্নায় ফাঁকি মশলা, মাংস ‘সিটে’ হয়ে যাওয়া কিম্বা জলের আছড়া দেওয়া কে ছিটা… এগুলো পাই তাঁর বইতে।
পাপড়ি কে ‘বাখরা’ বা সেঁকা পাউরুটি কে ‘রুটিতোষ’, ‘ঘিয়ে গরম মশলা ছাড়িয়ে পাক করা’ ইত্যাদি এমন অনেক অনেক শব্দগুচ্ছের পরিভাষা পাই তাঁর বইতে। প্রজ্ঞাসুন্দরীর মতে নানাবিধ কুচোনো ড্রাই ফ্রুটস পোলাও ভাতের “সোহাগ” উৎপাদন করে। এমন শব্দ প্রয়োগ বুঝি ঠাকুরবাড়ির রান্না অন্তপ্রাণ কোনও রমণীই উচ্চারণ করতে পারেন।
নানারকম বাসনের উল্লেখও পাই এই বইতে। যেমন মালপোয়া ভাজবার পাত্র ‘তৈ’, ডাল রাঁধবার চওড়া মুখের হাঁড়ি ‘তিজেল’ ইত্যাদি।
পোলাও এর গরম মশলা কে তিনি তিনভাগে ভাগ করেছেন। আঁখনি মশলা, ফাঁকি মশলা আর চালমাখা মশলা। আঁখনি মশলা পাতলা কাপড়ে বেঁধে জলে ফোটানো হয়। সেই জলে পোলাও ভাত রান্না হয়। ফাঁকি মশলা হল সেই মশলাকেই মিহি করে গুঁড়ো করে পাতলা কাপড়ে ছেঁকে নেওয়া হয়। আর যে মশলাগুলি চাল ধুয়ে মেখে রাখা থাকে তা হল চালমাখা মশলা।

সে যুগে প্রজ্ঞাসুন্দরী একটি সম্পূর্ণ নতুন জিনিস উদ্ভাবন করে ভোজসভায় এনেছিলেন। বাংলা মেনু কার্ড বা নির্ঘণ্ট। নাম দিয়েছিলেন ক্রমণী।
নিজের অকালমৃতা মেয়ে সুরভির নামে তৈরী করেছিলেন সুরভি পায়েস।

রবীন্দ্রনাথের নোবেল জিতে দেশে ফেরার পরে সেবার জন্মদিনে ফুলকপি, খোয়াক্ষীর, বাদাম, কিশমিশ, জাফরান, সোনা ও রুপোর তবক দিয়ে যে বরফি তৈরি করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন, তার নামকরণ করেছিলেন ‘কবিসম্বর্ধনা বরফি’।
শেষ পাতের রেলিশ বা টাকনার নাম দিয়েছিলেন তিনি চাকনা। পটলের দোলমার নাম দিয়েছিলেন পটলপূরণ ভাজা। পর্তুগীজ ডিশ ভিন্ডালুর নামকরণ করেছিলেন বৃন্দালু।

প্রজ্ঞাসন্দরীর মতে ” অনুপানের গুণে যেমন ঔষধির গুণ হয় , সৈন্যের গুণে সেনাপতির খ্যাতি বর্ধিত হয়, সেইরূপ আনুষাঙ্গিক খাদ্যের গুণে প্রধান খাদ্য সমধিক রুচিকর হইয়া ওঠে। ” এই বাক্যটির কারণেই বুঝি আজো প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী মেয়েদের রান্নাঘরের প্রণম্য রয়েছেন আজো।
তাঁকে রন্ধনবিশারদ বললেও কম বলা হবে কারণ রান্নার পাশাপাশি তাঁর বইয়ের উপরি পাওনা হল তাঁর স্বরচিত পদ্য।
তাঁর নিরামিষ আহারে অপূর্ব এক ছড়ায় বাঁধা এই বাঙালী ঘণ্ট রান্নার রেসিপি।

নামেতে যেমন ঘণ্ট, কাজেও তাহাই।
ঘণ্টেতে রাঁধিতে অনেক মশলা চাই।
ফোড়নের মশলা তেজপাতা, হিং জিরা।
ভুলোনাকো দিতে তাতে আদা এক গিরা।
দুধ, চিনি আরও জিরা মরিচ বাটা ।
সাঁতলাবে শেষে ঘিয়ে, কর ঘাঁটা ঘাঁটা।

আজকের অনুষ্ঠান শেষ করার আগে একটা মজার গল্প না বললেই নয়।
প্রজ্ঞার ন্যায় সু গৃহিণীর গিন্নীপনায় সবাই মুগ্ধ তখন। তাঁর বইয়ের প্রকাশক শ্রী ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী একবার অতর্কিতে দলবেঁধে প্রজ্ঞার গৃহে হাজির হলেন এক গুঢ় উদ্দেশ্য নিয়ে। তাঁর গৃহিণীপনার দৌড় পরীক্ষা করতে। সেদিন প্রজ্ঞার ঘরে দুধ ছাড়া আর কিছুই মজুত নেই। আধঘন্টার মধ্যে চার প্রকার চব্যচূষ্য নিজের হাতে প্রস্তুত করে প্রজ্ঞা সুন্দরী অতিথি আপ্যায়ন করেছিলেন। পদ্গুলির মধ্যে দই ছিল মুখ্য। জিগেস করায় তিনি ‘চীনে ঘাস’ বা লেমন গ্রাসের ফান্ডা দিয়ে বলেছিলেন, “চীনে ঘাসে এরূপ হয়”। এই ছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দরী। যার প্রজ্ঞা, প্রত্যুৎপন্নমতি আর কল্পনাশক্তি ছিল অফুরান।

জীবনের কাজে ছিল তাঁর অসামান্য দায়বদ্ধতা আর নিপুণ একাগ্রতা। রচনাগুলির ছত্রে ছত্রে সেই প্রতিফলন। মেয়েদের রান্নাঘর তো শুধুই রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা নয়। রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতা, জোগাড়, সহকারী, পরিমিত্ত, খাদ্য-অখাদ্য, বর্জনীয় পদার্থ, বাসন কোসন, রান্নার উপকরণের মাপ ও ওজন এমন কী উনুন সবের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

সেদিন রাণীয়া তার সব শ্রোতা বন্ধুদের উদ্দেশ্যে জানিয়েছিল বইখানি পড়ে দেখার জন্য। বাঙালির গর্ব প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর বই। আপনারা পড়ে দেখলে বুঝতে পারবেন। রবিঠাকুরের জন্মদিনে তাই তাঁর সুযোগ্যা ভাইঝির ঠাকুরবাড়ির রান্না নিয়ে স্মরণে মননে আজকের অনুষ্ঠান।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত